যুধিষ্ঠির – ৫

রত্নাভূতা দ্রৌপদীর সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের বিয়ে হল, তাই আমাদেরও দায় আছে সেই রত্নের একটু বিচার করার। শুনেছি বিশিষ্ট রত্নের ওপর রঙের ছায়া পড়ে। রত্নের ওপর রঙের ছায়া পড়লে সেই রত্ন নতুন রূপ ধারণ করে। কথাটা অসত্য নয়, তবে সে রত্ন যদি হীরকখণ্ডের মতো উজ্জ্বল সাদা হত, তবে এই বিচিত্র রঙের খেলা মানাত ভাল। কিন্তু মহাভারতের কবি দ্রৌপদীকে উজ্জ্বল নীলাভ বৈদুর্যমণির সঙ্গে তুলনা করেছেন বারবার। হতে পারে, এ তুলনা তাঁর গায়ের রঙের সঙ্গে। কিন্তু দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্বের মধ্যেও এই বৈদূর্য-নীলিমা জমাট বাঁধা আছে। ফলে অন্য রঙের ছায়া পড়া মাত্রই নীলাভ সেই মণি অন্যতর এক রূপ পরিগ্রহ করে না। আপন রঙের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে, সে অন্য রঙের ছায়া গ্রহণ করে স্বল্পমাত্র, এবং সে ছায়া কখনওই দ্রৌপদীর আপন বিদগ্ধতার বৈদূর্য-নীলপ্রভা অতিক্রম করতে পারে না।

দ্রৌপদীর পঞ্চস্বামীর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সাধারণ সূত্রটি সর্বত্র দৃঢ়, এবং তা একই রকম। কিন্তু এই পাঁচ ভাইয়ের প্রত্যেকের চরিত্র আলাদা, ব্যক্তিত্বও আলাদা। যুধিষ্ঠির যেদিন ইন্দ্রপ্রস্থে রাজা হয়ে বসলেন, সেদিন তাঁর পট্টমহিষীর আসন অলংকৃত করেছিলেন দ্রৌপদী। নারদের দেওয়া বিধানে জ্যেষ্ঠের পরম্পরায় দ্রৌপদী প্রত্যেক স্বামীর ঘর আলো করবেন এক বৎসর ধরে—একৈকস্য গৃহে কৃষ্ণা বসেদ্‌বর্ষমকল্মষা—এই ঠিক ছিল পাঁচ স্বামীর মধ্যে। অত্যন্ত প্রত্যাশিতভাবে যুধিষ্ঠিরই প্রথম সুযোগ পান দ্রৌপদীর সঙ্গসুখ উপভোগ করার। এই বিদগ্ধা রমণীর সঙ্গ লাভ করে যুধিষ্ঠিরের মন কতটা রঞ্জিত হল, নববধূর লজ্জিত বাসরশয্যায় যুধিষ্ঠিরের কানে কানে কী কথা বলেছিলেন দ্রৌপদী—সে সব খবর মহাভারতের কবি দেননি।

শুধু একদিন যখন সেই ব্রাহ্মণের গরু চুরি হয়ে গেল, আর অর্জুন অস্ত্র-সংগ্রহের জন্য ঢুকলেন যুধিষ্ঠিরের ঘরে—হয়তো তখন একান্তে জ্যেষ্ঠস্বামীর সঙ্গে বসেছিলেন দ্রৌপদী। বাস্‌! এইটুকুই। মহাভারতের কবি দ্রৌপদীর স্বামী-সম্বন্ধ নিয়ে আর দ্বিতীয় কোনও অন্তরঙ্গ-চিত্র তৈরি করেননি। যেখানে অন্যের প্রবেশ ছিল অপরাধের মতো সেখানে অর্জুন যুধিষ্ঠিরের ঘরে প্রবেশ করে অপরাধী হলেন পূর্বকৃত বিধানে। কী আশ্চর্য! আর কেউ নয় অর্জুনই, যাঁকে স্বয়ম্বরে বরণ করার সময় দ্রৌপদী এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, মদ্যপান না করলেও তাঁর অন্তর্গত মুগ্ধতায় তিনি মদস্খলিতা যুবতীর মতো বিনাবাক্যে শুধু চোখের দৃষ্টিতে কথা বলছিলেন অর্জুনের সঙ্গে—মদাদৃতে’পি স্খলতীব ভাবৈর্বাচা বিনা ব্যাহরতীব দৃষ্ট্যা।

দ্রুপদ-সভায় ব্রাহ্মণ-সমাজের মধ্যে বসে যুধিষ্ঠির কি বিদগ্ধ রমণীর এই সরস সাত্ত্বিক বিকার লক্ষ করেননি? মায়ের কথায় তথা পরিবারের মধ্যে অন্তর্ভেদের ভয়ে যুধিষ্ঠিরের মুখ দিয়েই একক রমণীর পঞ্চস্বামিত্বের প্রস্তাব বেরিয়েছিল এবং পরিস্থিতির চাপে দ্রৌপদীকে তা মেনেও নিতে হয়েছিল বিনা বাক্যে। কিন্তু এই কারণে দ্রৌপদীর মনে কোনও ক্ষোভ ছিল কিনা, তা প্রায় কখনওই বোঝা যায়নি। যদি সে ক্ষোভ থেকেও থাকে, তবে রমণীয় গুণে এবং বিদগ্ধতায় তা কখনও বাইরে প্রকট হতে দেননি দ্রৌপদী। তবে মহাভারতের কবির হাতে আছে কবিত্বের কৌশল, আর ব্যঞ্জনাবৃত্তির অপূর্ব উন্মিলনী ক্ষমতা। কবি সেই শক্তিতে বিভিন্ন জায়গায় এমন এমন সব ঘটনার সন্নিবেশ করেছেন, যাতে করে পঞ্চ-স্বামীর প্রত্যেকের হৃদয়ের গভীরে কী ছিল অথবা দ্রৌপদীর অন্তহৃদয়েই বা কী আছে, তা বেশ বোঝা যায়।

যেমন এই ঘটনাই ধরুন না। অর্জুন ব্রাহ্মণের স্বার্থে যুধিষ্ঠিরের ঘরে ঢুকে অপরাধী হলেন এবং পুর্ববিধান মেনে নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে নির্দ্বিধায় বললেন—আদেশ করুন, আর্য। দ্বাদশ বৎসরের জন্য বনে যেতে চাই। আমরা তো এইরকমই নিয়ম করেছি—বনবাসং গমিষ্যামি সময়ো হ্যেষ নঃ কৃতঃ। ঠিক এই কথাটি শোনার পর যুধিষ্ঠিরের মুখের অবস্থাটি বোঝা না গেলেও মনের অবস্থাটা বোঝা যায়। নিশ্চয়ই সেই স্বয়ম্বর-সভার কথা তাঁর মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল—দ্রৌপদীর বাক্যহীন মদস্থলিত সেই মুগ্ধদৃষ্টি অর্জুনের দিকে প্রসারিত। অথচ সেই মানুষটিকে আজ বনবাসে যেতে হবে। যুধিষ্ঠির যেন আর সহ্য করতে পারলেন না। নিজেকে তাঁর এতই অপরাধী মনে হল যে, তিনি যেন কেমন থতমত খেয়ে বললেন—তুমি তো আমাকে সমস্ত কাজে প্রমাণ বলে মানো। তা আমাকেই যদি মানো, তবে শোনা—তোমার কোনও অন্যায়ই হয়নি অর্জুন। বড়দাদার ঘরে ছোটভাই ঢুকলে কীসের দোষ—গুরোরনুপ্রবেশো হি নোপঘাতো যবীয়সঃ? দোষ হত, যদি আমি ঢুকতাম তোমার ঘরে।

কথাটা যুধিষ্ঠির যতখানি অর্জুনের উদ্দেশে বলেছেন, তাঁর চেয়ে বেশি বলেছেন দ্রৌপদীর উদ্দেশে। এ যেন নিজের হাতে তাঁকে পঞ্চ-স্বামীর শাস্তি দিয়ে দ্রৌপদীর কাছে জবাবদিহি করা—তুমি ফিরে এসো অর্জুন। আমার কথা শোনো। এতে তোমার কোনও অধর্ম হবে না, আমার ঘরে ঢুকে তুমি একটুও অন্যায় করনি—ন হি তে ধর্মলাপো’স্তি ন চ মে ধর্ষণ কৃতা। যুধিষ্ঠির অর্জুনকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি দ্রৌপদীর কাছে। অর্জুন বড়ভাইকে শাসন করে বলেছেন—“তোমার কাছেই না শিখেছি দাদা, চালাকি করে ধর্ম হয় না—ন ব্যাজেন চরেদ্ধর্মমিতি মে ভবতঃ শ্রুতম্। অর্জুন বনবাসে চলে গেছেন।

অর্জুনের সুনা দ্রোপদীর মনে যত দুর্বলতাই থাক, যুধিষ্ঠিরের এই ব্যবহারে কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর হতবাক হওয়ার কথা। হয়তো সেদিনই তিনি বুঝেছেন—কত অসহায় এই মানুষটি! স্বামী হিসেবে নিজেকে সশক্তিতে চাপিয়ে দেওয়ার ক্ষমতাও তাঁর নেই, অথচ সেই মানুষটি রাজা হয়ে বসেছেন ইন্দ্রপ্রস্থে। এটাই সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা, রাজা হওয়ার জন্য যে মানসিক শক্তি এবং চারিত্রিক দৃঢ়তার দরকার হয়, সেই রাজনৈতিক দৃঢ়তা তাঁর ছিল না। দ্রুপদসভায় দ্রুপদের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা এবং মিত্রপক্ষে পাঞ্চাল যাদবদের লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর রাজনৈতিক দৃঢ়তা শেষ বিন্দুতে পৌঁছেছে। একটি সম্পূর্ণ রাজ্য স্বাধিকারে পাওয়ার পর মহাভারতের কবির মুখে আমরা, তাঁর রাজ্য পরিচালনার প্রশংসা শুনি। কিন্তু এ প্রশংসা নিতান্তই অর্থবাদ মনে হয়। কারণ, সভাপর্বের আরম্ভেই আমরা নারদকে যুধিষ্ঠিরের সভায় প্রবেশ করতে দেখছি রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে।

ঋষি হলে কী হবে, নারদের রাজনৈতিক জ্ঞান রাজাদের থেকেও অনেক বেশি। স্বয়ং কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে নারদের উল্লেখ করেছেন বারবার। নারদ যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে তাঁর রাজ্যের কৃষি-ব্যবস্থা, বাণি-জ্যকর্ম, গুপ্তচর, মন্ত্রী, অমাত্য, সৈন্য-সামন্ত সম্বন্ধেই শুধু প্রশ্ন করলেন না, তাঁর রাজ্যের জল-নিকাশী ব্যবস্থা থেকে আরম্ভ করে বীজধানের বিলিব্যবস্থা নিয়ে পর্যন্ত উপদেশ দিলেন। বলতে পারেন—যুধিষ্ঠির নতুন রাজা হয়েছেন ইন্দ্রপ্রস্থে, তাই এত উপদেশ। আমাদের ধারণা তা নয়, যুধিষ্ঠিরকে তিনি ভালই চিনতেন। রাজনীতির খেলা খেলতে হলে যে একে রাখতে হবে, তাকে ফেলতে হবে, একে যমদণ্ড দিতে হবে, তাকে তোষাতে হবে এবং এই অদ্ভুত খেলা যে যুধিষ্ঠিরের জানা নেই, সেটা নারদ খুব ভাল করেই বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন।

নারদের মুখে আদর্শ রাজার কর্তব্যগুলি শুনে যুধিষ্ঠির যে খুব স্বস্তিতে ছিলেন, তা মনে হয় না। এক সময় তাঁকে অতি বিহুলভাবে—রাজার জীবনে ধর্ম, অর্থ এবং কামের সাফল্য নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন করতে দেখি—কথং বৈ সফলা বেদা কথং বৈ সফলং ধনম্‌? অন্তত এই প্রশ্নের উত্তর যুধিষ্ঠিরের জানা ছিল। কিন্তু অনধীত বিষয় নিয়ে শিক্ষকের প্রশ্ন-পরম্পরায় বিব্রত হয়ে অতি ভাল ছাত্রও যেমন মাঝে মাঝে বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলে, রাজনীতির উপদেশ-কুট যুধিষ্ঠিরের মনেও তেমনই এক গভীর বিহ্বলতা তৈরি করে। তিনি বুঝতে পারেন—অন্তত যুধিষ্ঠির নিজেকে চেনেন বলেই পরিষ্কার বুঝতে পারেন যে, রাজনীতির এই দ্বিরূপকোষ তাঁর ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। নারদকে তিনি বলেই দেন—আমি যথাসাধ্য যথামতি চেষ্টা করে যাচ্ছিমাত্র। বড় বড় রাজারা যেভাবে রাজ্য শাসন করে গেছেন—আমরা তাঁদের সৎ আদশটুকু গ্রহণ করতে পারি মাত্ৰ—বয়ন্ত সৎপথং তেষাং যাতুমিচ্ছামহে প্রভো—এইটুকুই যা। তবে তাঁরা যেভাবে রাজ্য চালিয়েছেন, আমরা তা সত্যিই পারি না।

সন্দেহ নেই, এই ভাষার মধ্যে বিনয় আছে। তবে এর মধ্যে সত্যও আছে। নারদের মুখে ইন্দ্রসভা, যমসভা এবং আরও নানান দেবসভার কথা শুনে আপন রাজসভাকে কোনও দেবসভায় পরিণত করার কথা তিনিও মুহূর্তের জন্য ভেবে থাকতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হল, অসম্ভব আগ্রহ আর মনোযোগ দিয়ে ঋষিবাক্য শুনতে শুনতে যুধিষ্ঠিরের যে ছোট্ট একটা বিপদের সূচনা হয়ে গেল, সেটা তিনি ভাল করে বুঝলেন না।

অবশ্য এরকম হয়। যে একটা বিষয় ভাল জানে এবং অন্যটা মোটামুটি জানে, সেখানে যদি কেউ তার দ্বিতীয় আকর্ষণ সেই মোটামুটি বিষয়টার সম্বন্ধে বৃহত্তর আকর্ষণ তৈরি করতে পারে তখন মানুষ ভাবে—ওটাও পারব, ভাল করেই পারব। নারদ এই বিপদটাই করে গেলেন। যুধিষ্ঠির একটা সামান্য রাজ্য চালাচ্ছেন বটে কিন্তু রাজ্য চালাতে গেলে যে শুধু রাজ্য নিয়েই ভাবতে হয়, এ বোধ বুঝি তাঁর ছিল না। ওদিকে নারদঋষি নিপুণ বক্তৃতা দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বলে গেলেন—মহারাজ! তোমার ভাইরা সব মহাশক্তিধর। তুমি ইচ্ছে করলে এই সমস্ত পৃথিবী জয় করতে পারো। তুমি এক কাজ করো—রাজসূয় যজ্ঞ করো—রাজসূয়ং ক্রতুশ্রেষ্ঠম্‌ আহরস্বেতি ভারত।

কথাটা সোজাসুজি নারদের মুখ থেকে বেরোলেও হত। কিন্তু তা নয়। নারদ নাকি দেবসভায় যুধিষ্ঠিরের পিতা পাণ্ডুর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন এবং পিতা পাণ্ডু নাকি স্বর্গালোক মহারাজ হরিশ্চন্দ্রের ঐশ্বর্য দেখে স্তম্ভিত। হরিশ্চন্দ্র সসাগরা ধরণীর অধিপতি ছিলেন এবং রাজসূয়যজ্ঞ করে সমস্ত রাজাদের তিনি বশে স্থাপন করেছিলেন। মহারাজ পাণ্ডু হরিশ্চন্দ্রের এই অতুল কীর্তি দেখে নারদের মুখ দিয়ে পুত্রদের বলে পাঠিয়েছেন—তোমরা রাজসূয়যজ্ঞের আইয়োজন করো—পিতা চাহ কৌন্তেয় পান্ডুঃ কৌরবনন্দনঃ। পাণ্ডু আরও বলে দিয়েছেন—তোমরা রাজসুয়যজ্ঞ করলে আমি হরিশ্চন্দ্রের মতো ইন্দ্রের সভায় যেতে পারব এবং বহুকাল সেখানে থাকতেও পারব—ত্বয়ীষ্টবতি পুত্ৰাহং হরিশ্চন্দ্রবদাশু বৈ।

কথাটা শুনলে কার না মন বিচলিত হবে! পিতা স্বর্গ থেকে আর্তস্বরে পুত্রদের কাছে বলছেন—বাছারা! রাজসূয়যজ্ঞ করো, তবে আমার আত্মার শান্তি হবে। এই অবস্থায় যে কোনও পুত্রই অন্তত পিতৃকার্য করার জন্যই, যে কাজের সে যোগ্য নয়, সেই কাজও করার চেষ্টা করবে। যুধিষ্ঠির নারদের মুখে পিতার প্রার্থনা শুনে রাজসূয়যজ্ঞের উদ্যোগ গ্রহণ করলেন ঠিকই, কিন্তু মহাভারতের কবি জনান্তিকে লক্ষ করেছেন যে, যুধিষ্ঠির নারদের কথা শুনে একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাসও ফেলেছিলেন—ঋষেন্তদ্‌ বচনং শ্রুত্বা নিঃশশ্বাস যুধিষ্ঠিরঃ।

আসলে রাজসূয়যজ্ঞ যে যুধিষ্ঠিরকে মানায় না, তা নয়। কিন্তু যজ্ঞের সম্পূর্ণটাই যদি ব্রাহ্মণ্য তপস্যা বা সাধনের বিষয় হত, তাহলে যুধিষ্ঠিরের অত ভাবনার কিছু ছিল না। কিন্তু এই যজ্ঞে শম-দমের সাধন যদি বা কিছু থাকেও তবে তার সবটাই এক বিশাল ক্ষত্রিয়-লালসার জন্য। রাজ্যের বৃদ্ধি হবে, সামন্ত রাজারা সর্বত্র আনত হবেন এবং রাজসূয় অনুষ্ঠানকারী রাজার প্রতিস্পর্ধী হবেন না কেউ। আসলে রাজসূয় মানে নিজের শক্তিটা ভাল করে যাচাই করে নেওয়া। রাজপ্রতিনিধি সেনা-নায়করা চতুর্দিকে যাবেন, যে বশ্যতা মানবে না তার সঙ্গে যুদ্ধ করবেন এবং অজস্র ধনরত্ন নিয়ে রাজার কাছে ফিরবেন। তারপর যেদিন যজ্ঞের আসল অনুষ্ঠান হবে, সেদিন পরাজিত রাজারা নজরানা নিয়ে আসবেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে যুধিষ্ঠিরের বশ্যতা স্বীকার করে যাবেন। এই তো রাজসূয়। কিন্তু এই যজ্ঞ করতে হবে শুনে যুধিষ্ঠিরের নিঃশ্বাস দীর্ঘতর হল। তাঁর শান্তি বলে কিছু থাকল না—চিন্তায়ন্‌ রাজসুয়েটিং ন লেভে শৰ্ম ভারত।

ক’দিন ধরে শুধু এই শলা-পরামর্শেই কাটল যে, যুধিষ্ঠির নিজে রাজসূয়যজ্ঞ করার যোগ্য কি না। শেষে মন্ত্রী পুরোহিত এবং অন্যান্য সকলেই যখন তাঁর যোগ্যতার বিষয়ে একমত হলেন, তখন তিনি কৃষ্ণকে ডাকতে পাঠালেন দ্বারকায়। কৃষ্ণ এলেন এবং তিনি এসেই যুধিষ্ঠিরের চটকা ভেঙে দিলেন। রাজসূয়যজ্ঞ করে যুধিষ্ঠির সম্রাট হবেন কি, দেখা গেল—সম্রাটের মতো অন্য এক ব্যক্তি পূর্বাহ্নেই চিহ্নিত হয়ে আছেন। তিনি জরাসন্ধ। সমস্ত রাজমণ্ডল তাঁর আজ্ঞাবর্তী এবং তাঁকে অতিক্রম করার মতো কোনও রাজা তখন ভূভারতে নেই। স্বয়ং কৃষ্ণ তাঁর ভয়ে লুকিয়ে থাকেন মথুরায়। কৃষ্ণ জরাসন্ধের রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সৈন্য-সামন্তের অপ্রতিরোধ্য শক্তি সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরলেন যুধিষ্ঠিরের সামনে। তাতে তাঁর হতাশ হওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প রইল না। ঠিক এই সময়ে কৃষ্ণের উদ্দেশে যুধিষ্ঠিরের বক্তব্যটুকুই প্রকৃত যুধিষ্ঠিরকে চিনিয়ে দেয়।

যুধিষ্ঠির বললেন— কৃষ্ণ! তুমি সত্যিই বুদ্ধিমান। এমন করে আমাকে এখনও পর্যন্ত কেউ বুঝিয়ে বলেনি, তুমিই আমার সমস্ত সন্দেহ দূর করে দিয়েছ। আসলে যুধিষ্ঠিরের আশেপাশে এতদিন যাঁরা ছিলেন, তাঁরা সব হুজুগে মাতার মতো একটা ঘটনা পেয়ে যুধিষ্ঠিরকে খুব করে রাজসূয়ের জন্য মাতিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কৃষ্ণের কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের বোধ-বুদ্ধি জাগ্রত হল। প্রকৃত যুধিষ্ঠির কী সুন্দর করে এবার নিজের প্রকৃতি উদঘাটন করছেন। যুধিষ্ঠির বললেন—এই বিশাল পৃথিবীতে কত ছোট ছোট রাজারা আছেন। এতটুকু রাজ্য, এতটুকু সম্পত্তি, এতটুকু রাজকোষ আর গুটিকতক বশংবদ প্রজা—নিজেদের ছোট্ট ছোট্ট বিষয়-আশয় নিয়ে কী সুখেই না আছেন তাঁরা—গৃহে গৃহে হি রাজানঃ স্বস্য স্বস্য প্রিয়ঙ্করাঃ। তাঁরা কেউ বিশাল সাম্রাজ্য লাভ করেননি, সম্রাট হওয়াটা অত কষ্টকর জেনেই তাঁরা নিজের ছোট্ট রাজ্যটি নিয়েই সন্তুষ্ট আছেন। যুধিষ্ঠির এবার নিজের সিদ্ধান্ত জানাচ্ছেন— আমারই বা এত কী দরকার? আমার কাছে শান্তিই সবচেয়ে বড় কথা, আমার তাতেই মঙ্গল। ধনরত্নসম্বলিত এই বিপুলা পৃথিবীকে যদি জয় করতে পারতাম এবং সে জয়ের মধ্যেও যদি মঙ্গল থাকত, তবেই বুঝতাম যে আমার মঙ্গল হল—তাং বিজিত্য বিজানামি শ্ৰেয়ো বৃষ্ণিকুলোদ্বহ। কিন্তু তার চেয়ে আমার কাছে শান্তিই অনেক বড় কথা, সেই শান্তির মধ্যেই আমার মঙ্গল লুকানো আছে—শমামেব পরং মন্যে শমাৎ মেমং ভবেন্মম।

যুধিষ্ঠির শান্তি চান। এক মুহূর্তের মধ্যে তাঁর সম্রাট হবার সব ইচ্ছে চলে গেছে। তিনি বুঝেছেন—অনেক ছোট ছোট রাজার মধ্যে একজন বড় রাজা, একজন সম্রাট থাকতেই পারেন—কশ্চিৎ কদাচিদেতেষাং ভবেচ্ছ্রেষ্ঠো জনার্দন। তাতে তাঁর কী আসে যায়? কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মতো এমন সন্তুষ্ট, এমন শান্ত অন্যেরা হবেন কেন? তাঁর ভাইরা ভীম, অর্জুন এমনকী কৃষ্ণও একে একে ওজস্বিনী বক্তৃতা দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে চেতিয়ে তুললেন। যুধিষ্ঠির কী করবেন? দুর্ভাগ্যবশত তিনি জ্যেষ্ঠপুত্র, দুর্ভাগ্যবশত তিনি রাজা। জরাসন্ধ-বধের উদ্যোগ তাঁকে নিতেই হল। তবু সেই প্রবল পরাক্রমী রাজার সঙ্গে লড়তে যাবার আগে ছোট দুই ভাইয়ের জন্য তাঁর পিতৃতুল্য উদ্বেগটুকু স্মরণ করার মতো। যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে বলেছিলেন—ভীম আর অর্জুন, এরা আমার দুই নয়নের মণি। আর তুমি? কৃষ্ণ! তুমিই আমার মন। আমি স্বার্থপর লোকের মতো শুধু সাম্রাজ্যের লোভে কী করে এই সাংঘাতিক রাজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে আমার ভাইদের পাঠাব? এদের কিছু হলে আমি বাঁচব কী করে—মনশ্চক্ষুবিহীনস্য কীদৃশং জীবিতং ভবেৎ?

আমরা জানি—জরাসন্ধের সঙ্গে যুদ্ধ করে ভীম জিতেই ফিরেছিলেন। কিন্তু জরাসন্ধের সঙ্গে এই যুদ্ধ এবং রাজসূয়যজ্ঞের আগেই যুধিষ্ঠিরকে আমরা দু-হাত তুলে কৃষ্ণের কাছে আত্মসমর্পণ করতে দেখছি। তিনি বলেছেন—পাণ্ডবদের প্রভু তুমি, আমরা তোমাকেই আশ্রয় করে আছি—পাণ্ডবানাং ভবান্‌ নাথো ভবন্তঞ্চাশিতা বয়ম্। এই কথাটাকে সরস ভক্তিভাবে নেবার কোনও প্রয়োজন নেই, ভক্তিরসের ঘটনাও এটা নয়। ভাল করে লক্ষ করলে বোঝা যাবে—যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের আরম্ভ থেকে সমস্ত কাজে কৃষ্ণই পাণ্ডবদের রাজনৈতিক উপদেষ্টা। রাজনীতির মধ্যে যে জটিলতা আছে, যে আবর্ত আছে, যুধিষ্ঠির তার মধ্যে সফলভাবে প্রবেশ করতে পারেন না বলেই তিনি কৃষ্ণের ঘাড়ে তাঁর জীবনের ওই অংশটুকু চাপিয়ে দিয়েছেন। রাজসূয়যজ্ঞের শেষ পর্বে সমস্ত বিরাট পুরুষদের বাদ দিয়ে কৃষ্ণকে অর্ঘ্য নিবেদন করে যুধিষ্ঠির আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর নিজের রাজনৈতিক ভার কৃষ্ণের কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছেন। রাজসূয়যজ্ঞের শেষে কৃষ্ণের উদ্দেশে যুধিষ্ঠিরের অকপট স্বীকারোক্তি ছিল—তোমার জন্যই রাজসূয়যজ্ঞ করতে পেরেছি, তোমার জন্যই সমস্ত ক্ষত্রিয়রা আজ আমার বশীভূত—ক্ষত্রং সমগ্রমপি চ ত্বৎপ্রসাদাদ্‌ বশে স্থিতম্‌।

যুধিষ্ঠিরের একটা সুবিধে অবশ্যই ছিল। যাঁরা তাঁর রাজসূয়যজ্ঞের সমাপন-ক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করতে পারতেন—যেমন জরাসন্ধ, শিশুপাল—এঁরা একই সঙ্গে কৃষ্ণেরও সমান শত্রু ছিলেন। ফলে কৃষ্ণকে এ ক্ষেত্রে নেতা নির্বাচন করার মধ্যে যুধিষ্ঠিরেরই বুদ্ধিমত্তা নিহিত। কারণ কৃষ্ণের রাজনৈতিক বুদ্ধি ততদিনে প্রায় সর্বত্রই প্রকট হয়ে উঠেছে। অন্য দিকে কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের আপন মামাতো ভাই বলেই শুধু নয়, পিতৃহীন, এবং পদে পদে বঞ্চিত পাণ্ডবদের জন্য কৃষ্ণের সম্পূর্ণ সহানুভূতি ছিল বলেই যুধিষ্ঠির তাঁর আপন রাজনৈতিক ভার কৃষ্ণের স্কন্ধে ন্যস্ত করেছেন। কৃষ্ণও সেই ভার পালন করেছেন যথাসাধ্য যথামতি।

রাজসূয়যজ্ঞের অনুষ্ঠানে যুধিষ্ঠিরের চরম বাড়-বাড়ন্ত হল। চার ভাই চতুর্দিক জয় করে যুধিষ্ঠিরের ইন্দ্রপ্রস্থে ধন-রত্ন নিয়ে এলেন। সমস্ত রাজা যুধিষ্ঠিরের বশ্যতা স্বীকার করলেন। এ পর্যন্ত বেশ ভাল ছিল। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের রাজ্যের সমৃদ্ধি, ময়-দানবের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থের জাঁক-জমক, এবং সামন্ত রাজাদের আনা মহামূল্য উপহার দুর্যোধনের মনে চরম ঈর্ষা এবং অসূয়া জাগিয়ে তুলল। স্ফটিক নির্মিত রাজসভায় নিজের কারণে নিজেরই যে অপমান ঘটল দুর্যোধনের, সেটার থেকেও বড় কথা হল দুর্যোধন আর যুধিষ্ঠিরকে সইতে পারছিলেন না। অবশ্য যুধিষ্ঠিরেরও সামান্য একটু দোষ আছে এখানে, অবশ্য দোষ না বলে এটাকে দুষ্টুমি বলাই ভাল। অতি গম্ভীর ভদ্র-সজ্জনের মনের মধ্যেও সাময়িক একটা দুষ্টুমি চেপে বসে। এই দুষ্টুমি বাইরে থেকে ধরার উপায় নেই, কিন্তু চাপা একটা দুষ্টুমি সেখানে হয়েই যায়।

রাজসূয় সমাধা করার জন্য যুধিষ্ঠির কৌরবপক্ষের গণ্য-মান্য ব্যক্তিদের নানা কাজে লাগিয়েছিলেন। কৃপাচার্যের কাজ ছিল—ধন-রত্নের রক্ষণ এবং দক্ষিণাদান। বিদুরের কাজ ছিল অর্থব্যয়ের হিসেব রাখা এবং ব্যয় করা। দুঃশাসন খাদ্য-পানীয়ের তত্ত্বাবধান করছিলেন। কিন্তু দুর্যোধনকে যুধিষ্ঠির বললেন—সমবেত এবং ক্রমাগত আসা সামন্ত রাজাদের কাছ থেকে উপহার এবং নজরানাগুলো এক জায়গায় করে রাখবে তুমি। নিছক দুষ্টুমি ছাড়া এটা আর কী হতে পারে? আসলের ওপর ফাউ পেলে মানুষের বেশি আনন্দ হয়। কিন্তু দুর্যোধনের ক্ষেত্রে সেটা বিপরীত হয়ে গেল। আনুষ্ঠানিক করদান ছাড়াও যুধিষ্ঠিরের সন্তোষ বিধানের জন্য শত শত সামন্ত রাজার আনা মহামূল্য পারিতোষিকগুলিই দুর্যোধনের হৃদয়ে আগুন ধরিয়ে দিল। দুর্যোধন পরে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন—আমি সবার বড়, তাই আমাকেই যোগ্যতম মনে করে যুধিষ্ঠির আমাকে রাজাদের কাছ থেকে ধনরত্নের উপহারগুলি সংগ্রহ করতে বলেছিলেন। আমি কিন্তু রাজাদের আনা সেই রত্নরাশির এপার-ওপার দেখতে পাইনি। ধন-রত্ন হাতে ধরে নিতে নিতে আমার হাত ব্যথা হয়ে গিয়েছিল। আমাকে পরিশ্রান্ত দেখে রাজারা সব রত্নোপহার হাতে করে দাঁড়িয়েই রইল, দাঁড়িয়েই রইল—অতিষ্ঠন্ত ময়ি শ্রান্তে গৃহ্য দূরাহৃতং বসু।

দূর দূর থেকে আসা রাজাদের বশ্যভাব এবং তাঁদের আনা উপহার-রাশি যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের পরিবেশ যতই উন্নত করুক, সেটা দুর্যোধনের মনে সম্পূর্ণ বিপরীত এক প্রতিপক্ষতা তৈরি করল। তার মধ্যে রাজসূয়যজ্ঞের প্রধান অর্ঘ্য পাণ্ডবদের পরমাত্মীয় বৃষ্ণিকুলের ধুরন্ধর কৃষ্ণের উদ্দেশে নিবেদিত হওয়ায় দুর্যোধনের পক্ষে সেটা আতঙ্কেরও কারণ হয়ে উঠল। রাজসূয়যজ্ঞের আগেই তৎকালীন দিনের অবিসংবাদিত নেতা জরাসন্ধের বধ, এবং রাজসূয়যজ্ঞের শেষ পর্বে জরাসন্ধের শিষ্য এবং পুত্র বলে আখ্যাত শিশুপালের মৃত্যু হওয়ায় দুর্যোধনের মনে নতুন এক রাজনৈতিক আবর্ত তৈরি করেছিল এবং এটাকে আবর্ত না বলে আতঙ্ক বলাই ভাল। রাজসূয়যজ্ঞের অব্যবহিত পরে দুর্যোধন এই আতঙ্কিত মনোভাব ব্যক্তও করেছেন শকুনির কাছে। তিনি বলেছেন—দেখ! কৃষ্ণ শিশুপালকে মেরে ফেলল, কিন্তু সেই সভায় এমন কোনও পুরুষ ছিল না, যে শিশুপাল-বধের প্রতিশোধ নিতে পারেন চ তত্র পুমানাসীৎ কশ্চিত্তস্য বশানুগঃ।

যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ষজ্ঞ পাণ্ডবদের কাছে এক বিরাট সাফল্য মনে হলেও জরাসন্ধ এবং শিশুপালের মৃত্যু রাজনৈতিক দিকে নতুন এক মাত্রা তৈরি করল। ফলত যুধিষ্ঠিরের পরম-ঈপ্সিত সেই শান্তি বোধহয় তাঁর জীবন থেকে দূরেই রয়ে গেল। যুধিষ্ঠির বোধহয় নিজে বুঝেওছিলেন এ-কথা। হয়তো সেই কারণেই রাজসূয়যজ্ঞের শেষে যুধিষ্ঠির পিতামহ ব্যাসকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—চেদিরাজ শিশুপাল তো মারা পড়লেন। এতে আবার কোনও উৎপাত সৃষ্টি হবে না তো—অপি চৈদ্যস্য পতনাচ্ছন্নম্‌ ঔৎপাতিকং মহৎ। ভবিষ্যতে যিনি মহাভারতের কবি হবেন, তিনি তাঁর ক্রান্তদর্শিনী দৃষ্টিতে বুঝেছিলেন যে, যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের পর রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটা বড় রকমের পালা-বদল হয়ে গেল। ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে বললেন—তোমার আশঙ্কা সম্পূর্ণ ঠিক। গোলমাল লাগবে এবং সাংঘাতিকভাবেই তা লাগবে। তোমাকে কেন্দ্র করেই ভারতবর্ষের ক্ষত্রিয়কুল প্রায় লুপ্ত হয়ে যাবে—সমেতং পার্থিবং ক্ষত্রং ক্ষয়ং যাস্যতি ভারত।

কথাটা যুধিষ্ঠিরের কাছেও আতঙ্কের কারণ। রাজসূয়যজ্ঞ করে এই ফল তিনি কামনা করেননি। সঙ্গে সঙ্গে ভাইদের ডেকে যুধিষ্ঠির বলেছেন—আজ থেকে আমার প্রতিজ্ঞা শোনেনা। আজ থেকে আমরা কারও সঙ্গে কটু কথা বলব না—জ্ঞাতি-ভাইদের সঙ্গেও না, অন্যান্য রাজাদের সঙ্গেও না। বরঞ্চ জ্ঞাতিরা যেভাবে বলেন, সেইভাবেই চলার চেষ্টা করব—স্থিতো নিদেশে জ্ঞাতীনাং যোক্ষ্যে তৎ সমুদাহরন্‌। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এত সদিচ্ছা সত্ত্বেও, তিনি যা ভাবলেন, তা হল না। পিতামহ ব্যাস বলেছিলেন—উৎপাত যাই আসুক তা নিয়ে চিন্তা কোরো না তুমি। কেননা কালের গতি রোধ করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়—মা তৎকৃতে হ্যনুধ্যাহি কালো হি দুরতিক্রমঃ।

যুধিষ্ঠির তবু চিন্তা করেছিলেন, চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু দুর্যোধন যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়যজ্ঞের আড়ম্বর দেখে ঈষার আগুনে জ্বলে-পুড়ে মরছেন, তখন সেই আগুনে ইন্ধন জোগালেন শকুনি। তিনি দুর্যোধনকে বোঝালেন—কম চেষ্টা তো তুমি করনি। বিষ দেওয়া, আগুন লাগানো সবই তোমার বিফলে গেছে। এমনকী সমস্ত রাজন্যবর্গের পরম আকাঙ্ক্ষিত দ্রৌপদীকেও পেয়েছে ওরাই। মাঝখান থেকে লাভের লাভ এই হয়েছে যে, দ্রুপদরাজার মতো একজন সহায় তার লাভ করেছে, বাসুদেব-কৃষ্ণও এসে গেছেন পাণ্ডবদের পক্ষে। দুর্যোধন বললেন—তা হলে আজই সকলে মিলে আক্রমণ করি ওদের। শকুনি বললেন—মাথা খারাপ! ভীম, অর্জুন, দ্রুপদ, কৃষ্ণ—এঁদের সঙ্গে যুদ্ধ করা অত সহজ নয়। তার চেয়ে স্বয়ং যুধিষ্ঠিরকে জয় করে কী তাঁর রাজ্য এবং ধনরত্ন লাভ করা যায়, তার উপায় বলি শোন।

দুর্যোধন উৎকর্ণ হলেন এবং শকুনি তাঁর সর্বস্বহারী প্রস্তাব পেশ করলেন দুর্যোধনের কাছে। শকুনি বললেন—যুধিষ্ঠির ভীষণ পাশা খেলতে ভালবাসে কিন্তু পাশা-খেলার কৌশল জানে না—দৃতপ্রিয়শ্চ কৌন্তেয়ো ন স জানাতি দেবিতুম্‌। অন্য দিকে পাশা-খেলার কৌশলে আমার সমকক্ষ কাউকে আমি এখনও দেখিনি। যুধিষ্ঠিরকে যদি পাশা-খেলার জন্য আহ্বান করা যায়, তবে সে ‘না’ করবে না। সে আসবে এবং আমার সঙ্গে খেলবেও। তখন পণে জিতে তার রাজ্য এবং রাজলক্ষ্মী দুইই আমি এনে দেব তোমার হাতে—রাজ্যং শ্রিয়ঞ্চ তা দীপ্তাং ত্বদর্থং পুরুষর্ষভ।

এই প্রথম আমরা যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে এমন একটা কথা শুনলাম, যা যুধিষ্ঠিরের চরিত্রের সঙ্গে যেন মানায় না। মহাভারতেই অন্যত্র দেখব যে, রাজা-রাজড়াদের কতগুলো সর্বনেশে অভ্যাস থাকে। যেমন ঘুমোনো, শিকার করা, পাশা-খেলা, পরনিন্দা, স্ত্রী-সঙ্গ, মদ্যপান, গান-বাজনা ইত্যাদি। মনু মহারাজ থেকে আরম্ভ করে সেকালের রাজনীতির তত্ত্বজ্ঞ পণ্ডিতেরা সবাই বলেছেন—আদর্শ রাজা যেন কখনও এই সব বদভ্যাস না করেন। তা হলে রাজা এবং রাজ্য—দুয়েরই সর্বনাশ হবে। এগুলি কামজ ব্যসন এবং এই বিলাস-ব্যসনের কোনও অন্ত নেই। রাজারা যেন কখনও এ-সবে লিপ্ত না হন ব্যসনানি দুরন্তানি প্রযত্নেন বিবর্জয়েৎ।

প্রাচীন তত্ত্বজ্ঞদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলি—উপদেশ এবং আদর্শের জগৎ এক রকম, আর বাস্তব জগৎ আর একরকম। বাস্তবে এমন রাজপুরুষ, এমনকী আধুনিক গণতন্ত্রের মন্ত্রিপুরুষ কাউকে দেখাতে পারবেন, যাঁরা মদ্যপান, স্ত্রী-সঙ্গ অথবা মনুকথিত পৈশুন্য, সাহস, দ্রোহ অথবা অর্থদূষণের মতো সাংঘাতিক ব্যসনের সঙ্গে যুক্ত নন? পাশা-খেলা, শিকার অথবা গান-বাজনার ব্যসন এখন ‘আউটডেটেড’। এখনকার রাজমন্ত্রীরা আরও বড় বড় ব্যসনে লিপ্ত। যাক সে-কথা, সকলেই এটা বলেন যে, যুধিষ্ঠিরের মতো মহামতি মানুষ কেন এই পাশা-খেলার বদভ্যাস করেছিলেন? সম্ভাবিত উত্তর দেওয়ার আগে আরও একটি কথা বলে নিই—তত্ত্বজ্ঞেরা ব্যসনগুলির নিন্দা যতই করুন, মানুষের কিছু অভ্যাস থাকেই। আসল কথা, অতিরিক্ত কিছুই ভাল নয়। যে ব্যক্তি সারাক্ষণ বই পড়ে এবং আর কোনও দিকেই মন দেয় না, সংসারে তাঁরও সুখ নেই। বই-পড়া বা ছবি আঁকাও অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে গেলে তা ব্যসনের মধ্যেই গণ্য হয়ে যাবে। তত্ত্বজ্ঞেরা এই অতিরিক্ত আসক্তি বন্ধ করার জন্যই একেবারে বর্জনের বিধান জারি করেছেন।

বাস্তবের দিকে তাকিয়ে দেখুন—স্বয়ং মুনি-ঋষিরা রাজসুয়যজ্ঞের আসরে, অগ্ন্যাধেয় যাগের আসরে পাশা খেলতেন। সমাজে পাশা-খেলা অতিরিক্ত অভ্যাস ছিল বলেই খোদ ঋগ্‌বেদে অক্ষসূক্তের জন্ম হয়েছে। অন্য দিকে গান-বাজনা এবং নাচের ব্যসন রাজমহলে চালু ছিল বলেই আজকের দিনে আমরা রাগ-রাগিণী আর বহুতর নৃত্যকলার ছন্দে মনোরঞ্জন করতে পারছি। রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে রাগ-রাগিণী, নৃত্যকলা এবং সাহিত্যের বিবর্তন আধুনিক কাল পর্যন্ত ঘটত না বলেই আমার ব্যক্তিগত ধারণা।

এ সব কথা বলে আমরা অবশ্য যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার সাফাই গাইছি না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলাটা তাঁর ধর্মভাবনার সঙ্গে একান্ত স্ববিরোধী কিনা, সেটার একটা মীমাংসা চাইছি আমরা। আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যদি জিজ্ঞাসা করেন, তবে আমি বলব—একমাত্র পাশা-খেলাই যুধিষ্ঠিরকে মানুষ করেছে, নইলে তিনি দেবতা হয়ে যেতেন, অথবা দেবতাও নয়, কারণ দেবতাদেরও এসব দুর্বলতা আছে। তা হলে কী? জানি না। যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে শুধু আমরা কেন, মহাভারতে তাঁর স্বপক্ষ-প্রতিপক্ষ সকলেই এমন একটা আদর্শ ধারণা প্রচার করেন, যেন যুধিষ্ঠিরের কোনও দোষ থাকতে নেই এবং সামান্য দোষ হলেই তাঁকে ভণ্ড মনে করতে হবে। না হলে ‘ধর্মপুত্র’ যুধিষ্ঠিরের’ মতো এমন একটা সাংঘাতিক প্রবাদই বা তৈরি হবে কেমন করে? যুধিষ্ঠিরের শতসংখ্যক উদার ধর্ম-ভাবনার সঙ্গে যাঁরা পাশা-খেলাকে মেলাতে পারেন না, তাঁদের জানাই—মহাভারতের কবির কাছে যুধিষ্ঠির একটা ‘এক্সপেরিমেন্ট’। একটি নীতিশুদ্ধ মানুষ, যাঁর মন সদা-সর্বদা ধর্ম এবং ত্রিজগতের মঙ্গল ভাবনায় পরিশীলিত, তিনিই যুধিষ্ঠির—এ-কথা যেমন ঠিক, তেমনই একটি মানুষ, যিনি সব সময় নীতি-যুক্তির ‘পারফেকশনে’ পৌঁছতে চাইছেন, অথচ পারছেন না—এটাও যুধিষ্ঠির। এই যে ‘চাইছেন, অথচ পারছেন না’—এই চেষ্টা এবং অসাফল্যের মধ্যেই মানুষ যুধিষ্ঠিরের ব্যক্তিচরিত্র নিহিত আছে।

একবার ভাবুন—কৃষ্ণা-পাঞ্চালীকে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তিনি নিজে কী পেয়েছেন? দ্রৌপদীর এক-পঞ্চমাংশ পতিত্ব লাভ করে তিনি নিজে সব সময় এমন থতমতভাবে থেকেছেন যে, কখনওই তিনি ভাবতে পারেননি—এই রমণী সর্বাংশে আমারই। আবার সবার মধ্যে ভাগ করে দিয়ে তিনি যে মহত্ত্বের প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছিলেন, তাও সফল হয়নি। কারণ দ্রৌপদী তাঁর পঞ্চস্বামীর প্রত্যেকের একক সম্পূর্ণ মন জয় করতে পারলেও তাঁর স্বামীদের মনে সব সময়েই কিছু সঙ্কোচ থেকে গেছে। অন্য দিকে জ্ঞাতি-বিরোধের তপ্ত আগুনের মধ্যে বসে পাঞ্চাল এবং বৃষ্ণিদের সমর্থনে যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটে গেল, এও কি তাঁর কাছে খুব কাম্য ছিল? পৈতৃক রাজ্যের একাংশমাত্র লাভ করে তার ছোট্ট ইন্দ্রপ্রস্থের গণ্ডির মধ্যেই তিনি সুখী থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এবং পরিবেশ তাঁকে তেমন সুখী থাকতে দেয়নি। রাজা হলে সম্রাট হওয়ার চেষ্টা করতে হবে, রাজসূয়যজ্ঞ করে সকলের অধীশ্বর হতে হবে—এই কি তিনি চেয়েছিলেন? তিনি যা চেষ্টা করেন, তা সর্বাংশে সফল হয় না, যা ভাবেন, সবাই তা ভাবে না। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন—জ্ঞাতিদের সঙ্গে তিনি খারাপ ব্যবহার করবেন না; তিনি তা করেনওনি। কিন্তু নিজেকে জ্ঞাতি-বিরোধ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে গিয়ে, সমস্ত জগতের কাছে তিনি ঘৃণাস্পদ হয়ে গেলেন।

পাশা খেলতে যুধিষ্ঠির খুব ভালবাসতেন। কবে কখন কার সঙ্গে পড়ে তাঁর এই পাশা-খেলার অভ্যাস তৈরি হয়েছিল মহাভারতের কবি তার বিন্দুবিসর্গ পূর্বে জানাননি। সভাপর্বে এসে দুর্বাত্মা শকুনির কুমন্ত্রণার মধ্যে আমরা হঠাৎই শুনতে পেলাম—যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে ভালবাসেন—দৃতপ্রিয়শ্চ কৌন্তেয়ঃ হয়তো এটা তাঁর বিলাস, ঠিক আমাদের যেমন ‘হবি’। কিন্তু শকুনি যে বলেছেন—যুধিষ্ঠির পাশা খেলতে জানেন না—এটা ভুল। যুধিষ্ঠির ধর্মভীরু মানুষ। পাশাযুদ্ধের নীতিনিয়ম বজায় রেখেও পাশা-খেলা যায়, যুধিষ্ঠির সেই খেলাই জানেন। পাশা-খেলার মধ্যে যে শঠতা আছে, যে জুয়োচুরি আছে—সেটা তিনি শকুনির মতো জানতেন না বলেই, শকুনি মন্তব্য করেছেন—তিনি পাশা-খেলা জানেন না।

দুর্যোধনের ঈর্ষা, অসূয়া আর মনস্তাপে বিগলিত হয়ে ধৃতরাষ্ট্র যখন শকুনির পাশা-খেলার প্রস্তাবটাই মেনে নিলেন, তখন কুরুসভার প্রবর-মন্ত্রী বিদুরকে পাঠানো হল ইন্দ্রপ্রস্থে, যুধিষ্ঠিরের কাছে। বিদুর যুধিষ্ঠিরের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের মুখোদ্‌গীর্ণ যে আহ্বান-বাণীটি পাঠিয়েছিলেন, তার মধ্যে সংশয় কিংবা ভয়ের কিছু ছিল না। ধৃতরাষ্ট্র বলেছিলেন—পুত্র! আমাদের সভাটা এখন তোমাদের ইন্দ্রপ্রস্থের মতোই হয়েছে। ভাইদের সঙ্গে একবার তুমিও এসে দেখে যাও এই সভা। আরও একটা খবর আছে। আমরা এখানে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে একটা পাশা-খেলার আসর বসিয়েছি। আমার ইচ্ছে—ভাইদের সঙ্গে তুমিও এসে এই খেলায় যোগ দাও। অন্যান্য কৌরবরাও সব এসে গেছেন। মজাও হবে খুব। তোমরা আসলে আমরা সবাই আনন্দ পাব—প্রীয়ামহে ভবতাং সঙ্গমেন সুহৃদ্‌-দ্যুতং ক্রিয়তাং বম্যতাঞ্চ।

ধৃতরাষ্ট্র বলেছিলেন—‘সুহৃদ-দ্যুত’ অর্থাৎ বন্ধুরা মিলে যেমন তাস-পাশা খেলে। কিন্তু এই কথাটার মধ্যে যে ফাঁকি আছে, সে-কথা বিদুর সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার করে বলে দিয়েছেন। বিদুর বলেছেন—মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যে সব জুয়াড়িদের নিযুক্ত করেছেন পাশা-খেলার জন্য—দুরোদরা বিহিতা যে তু তত্র—সেই সব ধুতদের তুমি গিয়েই দেখতে পাবে। বিদুরের কথা থেকে যতটুকু বোঝা যায়, যুধিষ্ঠিরও তা বুঝেছিলেন। বিদুরকে তিনি জিজ্ঞাসাও করেছিলেন—ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা ছাড়া সে সভায় আর কারা আছেন, বিদুর? শত শত পণ রেখে খেলব, তাদের নামটা অন্তত জানি—ব্রুহি নস্তান/ যৈদীব্যামঃ শতশঃ সন্নিপত্য। বিদুর বললেন—সবার আগে আছেন শকুনি। তাঁর মতো অক্ষ-নিপুণ এবং পাশার অনুরাগী আর কে আছেন? পাশা-খেলায় তাঁর হাত একেবারে মোক্ষম ফল নিয়ে আসে—রাজাক্ষদেবী কৃতহস্তো মতাক্ষঃ। জুয়াড়ি আছেন আরও। বিবিংশতি, চিত্রসেন, সত্যব্রত, পুরুমিত্র—এঁরাও উপস্থিত আছেন দ্যূতসভায়।

যুধিষ্ঠির নাম শুনেই আঁতকে উঠলেন; বললেন—এরা তো সব সাংঘাতিক জুয়াড়ি! ছল আর শঠতাই তো এদের প্রধান অস্ত্র—মহাভয়াঃ কিতবাঃ সন্নিবিষ্টা/মায়োপধা দেবিতারো’ত্র সন্তি। তবু বলছি—পিতৃতুল্য ধৃতরাষ্ট্র যদি ডেকে পাঠান, তবুও আমি যাব না—এমন তো হতে পারে না। পাশা-খেলার জন্য আমায় ডাকলে যেতেই হবে আমাকে—আহুতো’হং ন নিবর্তে কদাচিৎ—আমি সেখানে ফিরে আসতে পারি না।

যুধিষ্ঠির ফিরতে পারতেন। বিদুরের কথা শুনেই ফিরতে পারতেন। বলতে পারতেন—খেলব না শকুনির সঙ্গে। একবার বলেছিলেন সে-কথা; কিন্তু সেখানেও সেই ধৃতরাষ্ট্রের প্রসঙ্গটা রেখেই দিলেন যুধিষ্ঠির! অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র যদি না বলেন, তবে শকুনির সঙ্গে কিছুতেই খেলব না—ন চাকামঃ শকুনিং দেবিতাহং/ন চেন্মাং জিষ্ণুরাহ্বয়িতা সভায়াম্‌। এটা কি পাশা-খেলার একটা অজুহাত!

দেখুন, আজকালকার দিনের কুলতন্তুছিন্ন তিন-সভ্যের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবারগুলিতে জ্যাঠামশাই অথবা কাকাবাবুদের কথার কোনও মূল্য নেই। কিন্তু পিতৃহীন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে শত বঞ্চনা করা সত্ত্বেও ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি যুধিষ্ঠিরের শ্রদ্ধা কিছু কম ছিল না। নানা বঞ্চনার এবং নানা ঘটনার অনুক্রমে সেই শ্রদ্ধায় ঘাটতি নিশ্চয়ই হয়েছে, তবু যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের অসহায় অবস্থা বোঝার চেষ্টা করতেন তাঁরই যুক্তি-তর্কের অনুকূলে। আরও একটা কথা—এই অন্ধ জ্যাঠামশাইটির সম্বন্ধে যুধিষ্ঠিরের অভিমানও কিছু কম ছিল না। এই যে বিদুর এসে ধৃতরাষ্ট্রের পাশা-খেলার প্রস্তাব করলেন তাঁর কাছে, এবং তাঁকে যে সতর্কও করে দিলেন, যুধিষ্ঠির কি তার পরেও পাশা-খেলার গৃঢ়ার্থ বোঝেননি? বুঝেছেন। বিদুরকে তিনি বলেছিলেন—এই পাশা খেলার মধ্যে আমি ঝগড়ার গন্ধ পাচ্ছি—দ্যুতে ক্ষত্তঃ কলহো দৃশ্যতে নঃ! ঝগড়ার কথা বুঝেও কোন বুদ্ধিমান লোক পাশা খেলতে যায়?

যুধিষ্ঠির তবু যাচ্ছেন। বিদুরকে তিনি বলেছেন—ধৃতরাষ্ট্র ডাকলে আমার না গিয়ে উপায় নেই। পুত্রের কাছে পিতার এই আহ্বান আমি তুচ্ছ করি কী করে, তিনি যে আমার চিরকালের প্রিয়—ইষ্টো হি পুত্ৰস্য পিতা সদৈব। কী করে বোঝাব—আজকের সামাজিক পরিস্থিতি এবং আজকের পারিবারিক গঠনের নিরিখে কী করে এই সম্পর্ক বোঝাব? জ্যাঠামশাই ডাকলে পরে ভ্রাতুস্পুত্র যে সেটাকে পিতাঠাকুরের ডাক বলেই মনে করতেন—এমন সম্পর্ক যে আমি চোখে দেখেছি, আর দেখেছি বলেই যুধিষ্ঠিরের সূক্ষ্ম অনুভবটুকু বুঝতে পারি। তাঁর না গিয়ে উপায় নেই, কারণ জ্যাঠামশাই ডেকেছেন মানে পিতাঠাকুরই ডেকেছেন—টীকাকারের ভাষায়—পর্যায়সাম্যাৎ জ্যেষ্ঠতাতো’পি তাত এব। কিন্তু মনে মনে যুধিষ্ঠিরের কিছু অভিমান ছিলই। যে ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি এত সম্মান করেন, যাঁকে তিনি পিতার মতো মনে করেন, তিনি আপন পুত্রস্নেহে অন্ধ হয়ে পিতৃহীন ভ্রাতুস্পুত্রদের সঙ্গে বিবাদ ডেকে আনছেন? তিনি এইভাবে বঞ্চনা করতে চান পরম বিশ্বাসী ভ্রাতুস্পুত্রদের? তাই যদি হয়, তবে তোক সেই বঞ্চনা। যুধিষ্ঠির মনে মনে ভাবেন—তবে নেমে আসুক সেই চরম শাস্তি। জ্যাঠামশাই হয়েও তিনিই না হয় চরম বঞ্চনা করুন আমাদের সঙ্গে। দুনিয়ার লোক দেখুক। যুধিষ্ঠিরের কোনও দোষ নেই, কিন্তু পিতৃতুল্য জ্যাঠামশাই তাঁকে সহ্য করতে পারলেন না। এই অভিমানটুকু যুধিষ্ঠিরের ছিল বলেই মহাভারতের নিরপেক্ষ বক্তা বৈশম্পায়ন মন্তব্য করলেন—যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের এই পাশা-খেলার আহ্বান সহ্য করতে না পেরেই যেন সাভিমানে হস্তিনাপুর রওনা হলেন—অমৃষ্যমাণস্তস্যাথ সমাহ্বানম্ অরিন্দমঃ।

ভাইদের নিয়ে, দ্রৌপদীকে নিয়ে যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরে পৌঁছলেন। প্রথম দিন আদর-আপ্যায়ন আর পুনর্মিলনের আচ্ছন্নতার মধ্যেই কেটে গেল। পরের দিন দ্যূতসভার আয়োজন। সকালে উঠে স্নান-আহ্নিক সেরে যুধিষ্ঠির ভাইদের সঙ্গে দ্যূতসভায় উপস্থিত হলেন। দ্যূতসভা রমরম করছে। কোনও কথা বলার আগেই তাঁকে যিনি সাদর আহ্বান জানালেন, তিনি দুর্যোধনের মাতুল শকুনি। শকুনি বললেন—সভা প্রস্তুত। সকলে তোমার জন্যই অপেক্ষা করছেন—উপস্তীর্ণা সভা রাজন্‌ সর্বৈঃ ত্বয়ি কৃতক্ষণাঃ, —পাশা-খেলা আরম্ভ হোক।

শকুনির কথা শোনামাত্রই যুধিষ্ঠিরের সাতঙ্ক উত্তর শোনা গেল—দেখ মাতুল! দ্যূতক্রীড়ায় শঠতা অর্থাৎ জুয়োচুরি চলে প্রচুর। এখানে ক্ষত্রিয়ের শক্তি কোনও কাজে লাগে না, —নিকৃতি-র্দেবনং পাপং ন ক্ষাত্রো’ত্র পরাক্রমঃ। তাই বলছিলাম—মাতুল! তুমি যেন অন্যায় পথে একজন জুয়াড়ির মতো শঠতা করে আমাকে নৃশংসভাবে জিতে নেওয়ার চেষ্টা করো না। যুধিষ্ঠির শকুনিকে দেখেই বুঝে গেছেন—কী হতে চলেছে। তিনি যেমন হাহাকার করে শকুনির কাছে অনুনয় জানালেন, তাতে শকুনির মতো জুয়াড়ির মনে কোনও কোমল স্পর্শ লাগল না। এ যেন ভয়ঙ্কর এক ঠগ দোকানদারের কাছে ভদ্রলোকের অনুনয়—আমায় ঠকিয়ে নিয়ো না ভাই। দোকানদার ভাবলেশহীন মুখে অভিনয় করে বলে—আপনি জিনিস চেনেন, আপনার ভয় কী? শকুনিও একইভাবে বললেন—যে মানুষ পাশার দান পড়ার আগেই সংখ্যাটি বুঝতে পারে, শঠতা বা অন্যায় হলে যে তার প্রতিকার করতে জানে, পাশার দান ফেলার ব্যাপারেও যে ওস্তাদ, সেই মানুষ অন্যের শঠতাও সহ্য করতে পারে। অর্থাৎ সে ঠিক ধরে ফেলতে পারবে অন্যের শঠতা কোথায়।

শকুনি যা বলেছেন তার মধ্যে তাঁর পাশা-খেলার কায়দাটা পুরোই বলা ছিল। সেকালে পাশা-খেলা কীভাবে হত এবং শকুনি কীভাবে পাশা খেলেছিলেন—সে সব কথা আমি অন্যত্র বলেছি। এখানে শুধু এইটুকু জেনে রাখলেই হবে যে, সম্ভবত অনেকগুলি ঘুঁটি নিয়ে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে শকুনির পাশা-খেলা হয়েছিল এবং দান ফেলার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুঁটিগুলো গুনে ফেলার একটা তৎপরতা থাকত। পণ্ডিতেরা সন্দেহ করেন—ঘুঁটি গোনার সময়েই পাশা-খেলায় কে কত ধূর্ত, তার প্রমাণ হয়ে যেত। আসলে সেকালের পাশা খেলাটা হয়তো প্রধানত জোড়-বিজোড়ের খেলায় নিষ্পন্ন হতো। ডাক দেওয়ার পর পাশার ঘুঁটি চেলে গুনতে হত এবং গোনবার সময় চোখ বুলিয়েই অক্ষশৌণ্ড বুঝতে পারত যে, দানটি তার ডাকের সংখ্যা অনুসারেই পড়েছে কি না। শকুনি এটাকেই বলেছেন—যো বেত্তি সংখ্যাং নিকৃতৌ বিধিজ্ঞঃ। চালের ঘুঁটি যদি ডাক অনুসারে না পড়ে তখনই নিপুণ জুয়াড়ির কেরামতি। জোড়-বিজোড় যাই হোক, নিজের ডাকের সঙ্গে মিলিয়ে অসামান্য ক্ষিপ্রতায় ঘুঁটি সরিয়ে ফেলতে হবে অথবা জোগাতে হবে। শকুনি তাই বলেছেন—ধূর্ত জুয়াড়ি তার দানের পর সমস্ত চেষ্টা চালাবে অসামান্য ক্ষিপ্রতায়—চেষ্টাস্বখিন্নঃ কিতবো’ক্ষজাসু।

শকুনি কী করবেন, শকুনি তা বলেই দিয়েছেন। যুধিষ্ঠির এই রকম করে, ‘প্রফেশনালি’ পাশা-খেলা শেখেননি। পাশা খেলতে তিনি ভালবাসেন এই মাত্র। তিনি আবারও শকুনিকে সানুনয়ে সবিনয়ে বললেন—দেখ মাতুল! আমরা ক্ষত্রিয়। শঠতা করে পাশা-খেলা আমরা শিখিনি। শঠতা করে পরের ধন-সম্পত্তি আত্মসাৎ করার কোনও ইচ্ছে আমার নেই। জুয়াড়ির পাশা-খেলাকে কি ভদ্রলোকেরা ভাল বলে? শকুনি এবার যুধিষ্ঠিরের মনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে আরম্ভ করলেন। তিনি বললেন—এই পাশা খেলার আড্ডায় এসে তুমি যদি আমাদের সবাইকে শঠ, কপট বলতে থাক, আর পাশার আড্ডায় এসে যদি তুমি এত কপটতার ভয়ই পাও, তা হলে তোমার খেলতে হবে না বাপু, তুমি বাড়ি যাও—দেবনাদ্‌ বিনিবর্তস্ব যদি তে বিদ্যতে ভয়ম্‌।

যুধিষ্ঠির ফেরেননি। ধৃতরাষ্ট্রের কথা তাঁর মনে আছে! ধৃতরাষ্ট্রের কথাই তাঁর কাছে এখন নিয়তি হয়ে গেছে। অতএব বিধিই বলবান, আমি দৈবাধীন—এইসব শুদ্ধ নিয়তির কথা বলে যুধিষ্ঠির খেলতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু খেলতে গিয়েই প্রথম ধাক্কা খেলেন যুধিষ্ঠির। তাঁর প্রতিপক্ষে দুর্যোধন খেলবেন না। খেলবেন মাতুল শকুনিই। দুর্যোধন শুধু পণ দেবেন। যুধিষ্ঠির প্রতিবাদও করেছিলেন—একের খেলা অন্যে খেলবে, এ তো ঠিক নয়—অন্যেনান্যস্য বৈ দ্যূতং বিষমং প্রতিভাতি মে। তুমি যখন পণ দেবে, তবে তুমিই পাশা হাতে নাও।

যুধিষ্ঠিরের তর্ক-যুক্তি কেউ কানেও তোলেননি। খেলা আরম্ভ হয়েছে এবং যুধিষ্ঠির একের পর এক পণ হারতে আরম্ভ করলেন। পাশা-খেলার ঝোঁকে এবং নেশায় যুধিষ্ঠিরের রোখ চেপে গেল। যুধিষ্ঠির এই পাশা-যুদ্ধে স্থির থাকতে পারলেন না। এমনকী বিদুর যখন নিজের ব্যক্তিত্বে কঠিন কথা বলে সাময়িকভাবে দ্যূতসভা স্তব্ধ করে দিয়েছিলেন, তখনও যুধিষ্ঠির নিজেকে সংযত রাখতে পারেননি। দুর্যোধন-শকুনির উস্কানিতে তিনি আবারও খেলা আরম্ভ করেছেন। প্রাণপ্রিয় ভাইদের নিয়ে বাজি ধরতে তাঁর কণ্ঠস্বর স্খলিত হয়নি এবং শেষমেষ পঞ্চস্বামী-গর্বিতা দ্রৌপদীকে নিয়ে বাজি ধরতেও তিনি কুণ্ঠিত হলেন না। এক মুহূর্তের মধ্যে ধর্মরাজ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের ‘ইমেজ’ ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

মহাভারত একটু-আধটু পড়ি বলে শতজনে শতরকম কটুক্তিতে যুধিষ্ঠিরের এই বাজি-ধরা বিশেষত দ্রৌপদীকে বাজি-ধরার প্রসঙ্গ তোলেন এবং মন্তব্য করেন যুধিষ্ঠিরের মতো ভণ্ড, কাপুরুষ, অসভ্য বাজে লোক আর দ্বিতীয়টি হয় না। আমিও মেনে নিই—সত্যি কথা। অন্তত এই জায়গায় যুধিষ্ঠিরের জন্য সাফাই গাইবার কিচ্ছুটি নেই। আমি সাফাই গাইবার চেষ্টাও করি না, আর আমার মতো সামান্য মানুষ যুধিষ্ঠিরের হয়ে গান গাইলেও সে গান লোকে শুনবে না। তাঁদের যুধিষ্ঠির তাঁদের মতোই। কিন্তু আজকে যখন এই যুধিষ্ঠিরের চরিত্র লিখতে বসেছি, তখন আমার কথাটি না বলেও পারছি না। কারণ মহাভারতের কবি তো আমাদের মতো ক্ষুদ্র হৃদয় মানুষ নন, তিনি যে বিশালবুদ্ধি—‘ব্যাসস্য, বিশালবুদ্ধে’। সত্যি কথা বলতে কি মহাভারতের কবির আশয় বুঝে যুধিষ্ঠিরকে আমি একটু অন্য চোখে দেখি।

আচ্ছা ভাবুন তো, আপনি হলে কী করতেন? ভীমকে বিষ খাওয়ানো হল, অথচ যুধিষ্ঠির তা নিয়ে কথাই বলতে দিলেন না। আপনি-আমি হলে হস্তিনাপুরে শোরগোল তুলে দুর্যোধনের বাপের শ্রাদ্ধ করে দিতাম। কিন্তু যুধিষ্ঠির চুপ করে থেকেছেন। আমার-আপনার যদি ভীম-অর্জুনের মতো বশংবদ দুটি মহাবীর ভাই থাকত, তা হলে জতুগৃহে আগুন লাগানোর প্রস্তাব বোঝমাত্র—কারণ যুধিষ্ঠির তা আগেই বুঝেছিলেন—আমরা তখনই কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে দিতাম। আপনি-আমি যদি অর্জুনের কাছ থেকে বড়ভাই হওয়ার সুবাদে এবং সুযোগে কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর মতো রমণীকে বিবাহ করার বিনীত অনুরোধ পেতাম, তা হলে সেই মুহূর্তেই রাজি হতাম। পাঞ্চাল-বৃষ্ণিদের সহায় থাকা সত্ত্বেও আমাকে-আপনাকে যদি পৈতৃক রাজ্য থেকে বঞ্চিত করে আমাদের জ্যাঠামশাই বলতেন—তোমরা খাণ্ডবপ্রস্থের মতো শস্যহীন বন্ধুর মালভূমিতে গিয়ে বাড়িঘর তৈরি করে থাক, তা হলে কি যুধিষ্ঠিরের মতো বিনা বাক্যে জ্যাঠামশাইয়ের বচন মাথায় করে আমরা চলে যেতাম? যুধিষ্ঠির তাই গেছেন। আর আমাদের জ্যাঠামশাই আমাদের ঠকাবে জেনেও যদি জুয়ো খেলতে ডাকতেন, তা হলে কি আমরা সেই অনুরোধ মেনে বউ-ভাই সঙ্গে নিয়ে পাশায় হারতে আসতাম? যুধিষ্ঠির কিন্তু এসেছেন।

মহাভারতের কবি দেখেছেন—সাধারণ মাঝারি-মাপের মানুষ যা করে যুধিষ্ঠির তা করেন না। এই যে পাশা-খেলা হল—তার সম্বন্ধে ভগবান বলে চিহ্নিত সেই মানুষটি কী বলেছিলেন? পাণ্ডবদের বনবাসের সময় কৃষ্ণ এই কপট পাশা-খেলার গল্প শুনে প্রথম মন্তব্য করেছিলেন—আমি ছিলাম না সেই সভায়, তাই। আমি যদি দ্বারকাতেও থাকতাম, তা হলে আমাকে না ডাকলেও আমি অনাহূত অবস্থায় কৌরবসভায় উপস্থিত হতাম। প্রথমে নিশ্চয়ই এই পাশা-খেলা যাতে না হয়, সেই চেষ্টা করতাম, কিন্তু তার পরেও যদি আমার কথা না শুনত তা হলে পাশা খেলতে বসা ওই বদমাশ জুয়াড়িদের মেরে সভাটাকেই লণ্ডভণ্ড করে দিতাম—তাংশ্চ হন্যাং দুরোদরান্। আর ওই দুর্যোধন কর্ণ, শকুনি, দুঃশাসন—এঁদের সবাইকে মেরে—এতান্ নিহত্য সমরে—আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকেই সিংহাসনে বসাতাম।

আমরা জানি—কৃষ্ণ যা বলেছেন, হয়তো তাই করতেন। কিন্তু কৃষ্ণ যা করতেন বলে বলেছেন, সেটা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ইঙ্গিত মাত্রেই ভীম-অর্জুনও করে দিতে পারতেন। কিন্তু সে সব কিছুই নয়, একের পর এক বাজি ধরে নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত হারিয়ে বসলেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু আমরা যা করতাম, এমনকী কৃষ্ণ অথবা ভীম-অর্জুন যা করতে পারতেন, যুধিষ্ঠির তা করেন না বা করেননি। পাশা-খেলার আগে পর্যন্ত যা যা ঘটেছে, তাতে যুধিষ্ঠিরের অশেষ এবং অতুলনীয় ধৈর্য লক্ষ করেছি আমরা। অথচ পাশা-খেলার মতো এমন একটা তুচ্ছ অভ্যাস, যা আমি-আপনিও বৃহত্তর স্বার্থে অবশ্যই বর্জন করতাম, সেখানে যুধিষ্ঠির এমন একটি কাণ্ড করে বসলেন, যা সাধারণ জনেও সাধারণত করে না। আর সমস্ত ঘটনার এই কেন্দ্রবিন্দুতেই আমি আমার একান্ত ব্যক্তিগত মন্তব্য পেশ করে থাকি—ঠিক এই মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরকে আমার একান্ত মানুষের মতো লাগে।

শাস্ত্রে-কাব্যে, ইতিহাসে-পুরাণে আমরা শত শত ‘ধ্যানাবস্থিত’ ‘তদ্‌গত’, মুনি-ঋষিদের দেখেছি। অধিগুণসম্পন্ন শত শত দেবতা-পুরুষ দেখেছি। তাঁদের জ্ঞান, তপস্যা, বৈরাগ্য—কোনওটাই কিছু কম নয়, বরঞ্চ বেশ বেশি। কিন্তু তবু কোনও বসন্তের উতলা বাতাসে, অথবা ক্রোধ-মোহের কোনও উত্তেজনায় দেবতা, মুনি, সাধুপুরুষ—সবারই কোনও না কোনও সময় চারিত্রিক ত্রুটি ঘটে যায়, আর ঠিক সেই সময়েই তিনি আমাদের মতো মানুষ হয়ে যান। শ্রীচৈতন্যদেবের ধর্ম-দর্শনের প্রবক্তা জীব গোস্বামী তাঁর ষট্‌ সন্দর্ভের একটির মধ্যে নারদ, শুকদেব ইত্যাদি এমন কতগুলি ঋষি-মুনির সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন, যাঁদের মধ্যে দোষের অণুমাত্রও সম্ভাবনা করা যায় না। কিন্তু একটা সময় সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম তর্কযুক্তির শেষ পর্যায়ে তাঁদের মধ্যেও ‘কষায়’ বা দোষ লক্ষ করা গেছে। কিন্তু তাই বলে তাঁদের ধ্যান, জ্ঞান, তপস্যা বৃথা হয়ে যায়নি।

আমাকে অনেকে বলেন—অমুক সাধু, অমুক মহাপুরুষ, তাঁর এই দোষ। তিনি অমুক স্ত্রীলোকের গায়ে হাত দিয়েছিলেন। অমুকের টাকা-পয়সার লোভ আছে। তমুকে ভীষণ বদরাগি—ইত্যাদি। তামি কিছুতেই বোঝাতে পারি না। ছোটবেলা থেকে আমার যুবক বয়স পর্যন্ত বহু সাধু-মহাত্মার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ আত্মিক যোগাযোগ ছিল। এঁদের ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং সাধনের কোনও তুলনা আমি খুজে পাইনি। কিন্তু আত্মিক যোগাযোগ থাকার ফলে এঁদের কিছু কিছু দোষও আমার চোখে পড়েছে, যা সাধারণ জনের চোখে আরও বেশি খারাপ লাগবে। আমি অনেককে জিজ্ঞাসা করেছি এবং শাস্ত্র-দর্শন ঘেঁটেও দেখেছি—এই সামান্য সামান্য দোষগুলির জন্য তাঁদের ধ্যান-জ্ঞান-তপস্যা মোটেই বৃথা নয়। ইন্দ্রিয়বৃত্তি এমনই জটিল এক জীবনগ্রন্থি যা হাজার শম-দম-সাধনের মধ্যেও আপন সত্তা প্রকট করে ফেলে। রুদ্ধা প্রকৃতি কখনও বা তার বিরুদ্ধতার প্রতিপক্ষে প্রতিশোধ নেয় কিন্তু তাই বলে তাঁদের সারা জীবনের ধ্যান, ধারণা, দর্শন-মনন, সারা জীবনের শম-দম-সাধন ব্যর্থ হয়ে যায় না। তবে এ সব কথা বলে বুঝিয়ে হয় না, এগুলি অনুভববেদ।

পাশা-খেলায় যুধিষ্ঠিরের আত্মবিস্মৃতির কথাটা আমরা এই নিরিখেই অন্তত সহৃদয়ের সমব্যথা দিয়ে বিচার করতে চাই। জীবনের কোনও একটি কাজেও যেখানে তিনি কোনও দিন মাত্রা দান লঙ্গন করেননি, সেখানে এই মাত্ৰাজ্ঞানহীন আত্ম-বিস্মৃতিই তাঁকে আমার কাছে মানুষ করে তোলে। যুধিষ্ঠিরের একটি কর্ম-পদ্ধতিও আমার আপনার কর্ম-পদ্ধতির সঙ্গে মিলবে না। তাঁর ধৈর্য, স্থৈর্য, সহ্যশক্তির সঙ্গে কখনও কোনও অবস্থায় আপনি একাত্ম হতে পারবেন না। সেই ধৈর্য-স্থৈর্য এতই বিপুল, এতই তা অতিমানুষিক যে সব সময়ই তা বাহুল্য মনে হবে। আর এই রকম একজন বিরাট মানুষ যখন পাশা-খেলার নেশায় আত্ম-বিস্মৃত হন, তখনই এক মুহূর্তে তিনি মানুষের চোখে সত্যধর্মের সিংহাসন থেকে ভ্রষ্ট হয়ে যান। কিন্তু ভারী আশ্চর্য—মহাভারতের কবিও এই মুহূর্তটির অপেক্ষা করেন। সাধারণ জনের মতো তিনি কঠিন, নৃশংস নন বলেই পাশা-খেলার চরম মুহূর্তে তাঁর আপন সৃষ্ট ধর্মরাজকে জুগুপ্সার জগতে নামিয়ে দিয়েই তাঁকে একান্ত মানুষোচিত করে তোলেন। এক বিশাল ভুল করিয়ে দিয়ে প্রতিতুলনায় তাঁকে আরও এক মহত্তর এবং লোকোত্তর ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করেন মহাকবি।

যে মুহূর্তে দ্রৌপদীর প্রত্যঙ্গ বর্ণনা করে তাঁর পণের উৎকর্ষ প্রকট করেছিলেন যুধিষ্ঠির, সেই মুহূর্তে তাঁর কোনও জ্ঞান ছিল না। কৌরবসভার বৃদ্ধরা হাহাকার করে উঠেছিলেন, বিদুর নিজের মাথা টিপে ধরে বসে পড়েছিলেন সবার মধ্যে। আর ধৃতরাষ্ট্র! পিতৃহীন যুধিষ্ঠির যাঁকে পিতা বলেন? সেই ধৃতরাষ্ট্র আনন্দ ধরে রাখতে পারছিলেন না। কেবলই—শকুনি জিতেছে কি, জিতেছে কি—এই প্রশ্নে আকুল করে তুললেন সভাগৃহ। কর্ণের হাসি, অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের চিৎকার আর বৃদ্ধদের চোখের জলের মধ্যে শকুনি ঘোষণা করলেন—জিতমিত্যেব—জিতেছি, অবশ্যই জিতেছি। খেলা শেষ। যা যা পাবার ছিল পেয়ে গেছেন কৌরবেরা। সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের আদেশ নেমে এসেছে—কাকা বিদুর। দ্রৌপদীকে নিয়ে আসুন এই রাজসভায়, আমাদের দাসীদের সঙ্গে রাজবাড়ির ঘর-দোর ঝাড় দিতে ডেকে আনুন তাঁকে।

বিদুর চিৎকার করে উঠেছেন প্রতিবাদে। কিন্তু লাভ হয়নি কিছু। চুলের মুঠি ধরে দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে এলেন দুঃশাসন। ব্যাপারটা আর ঘর-দোর ঝাড় দেওয়ার পর্যায়ে রইল না। পাণ্ডবদের কুলবধূ কৌরবদের সভাবঙ্গে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুঃশাসন, দুর্যোধন অথবা কর্ণের যে জঘন্য মনোবৃত্তির পরিচয় পাওয়া গেল, তা না হয় আমরা আগেই খানিকটা বুঝেছি। কিন্তু পাণ্ডবদের বিপন্ন অবস্থায় কুরুসভার বৃদ্ধদের কী চরিত্র প্রকাশ পেল? বিদুর-বিকর্ণ ছাড়া একটি লোকও দ্রৌপদীর সহায়তায় এগিয়ে আসেননি। যুধিষ্ঠির যদি পাশা-খেলার মন্দ বুদ্ধি প্রকাশ না করে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজধানীতেই রাজমর্যাদা নিয়ে বসে থাকতেন, তা হলে মহাভারতের কবির পক্ষে এই সব বাস্তব পরিস্থিতি, এবং এই সব প্রতিনিয়ত ঘটমান বর্তমানগুলি এমন সত্যের দৃষ্টিতে দেখা বা লেখা সম্ভব হত না। ধর্মরাজের চরিত্র-হানি করার এটাও একটা উদ্দেশ্য।

ধার্মরাজ যুধিষ্ঠির পাশা খেলে এবং পণ রেখে অন্যায় উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেছেন—তাতে করে এটাও না হয় বোঝানো গেল যে, পাশা খেললে একজন শুদ্ধসত্ত্ব পুরুষেরও এই গতি হতে পারে, তার মান-সম্মান গৃহ-বিত্ত-দারা সবই নষ্ট হতে পারে। কিন্তু আশ্চর্য, এই অসামান্য বিপর্যয়ের মধ্যেও যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে কেউ কিন্তু এমন কথা বলছেন না যে, তিনি ধর্ম থেকে পতিত, নষ্ট চরিত্র এবং অসৎ। এমনকী দ্রৌপদী কৌরবসভায় যাবার আগে একটি আইনের প্রশ্ন তোলেন—যুধিষ্ঠির আগে নিজেকে বাজি রেখে তারপরে দ্রৌপদীকে বাজি রেখেছেন, নাকি আগে দ্রৌপদীকে বাজি রেখে পরে নিজেকে হেরেছেন? এ প্রশ্নের মীমাংসা শেষ পর্যন্ত হয়নি। কিন্তু ভারী আশ্চর্য, কুরুসভার রঙ্গস্থলে পৌঁছেও দ্রৌপদী সোচ্চারে বলেছেন—ধর্মপুরুষ যুধিষ্ঠির ধর্মের দিকেই তাকিয়ে আছেন এবং সে ধর্ম এতই সূক্ষ্ম, এতই নিপুণভাবে সে ধর্ম বুঝতে হয় যে, আমরা তা ধারণ করতে পারি না বলে আমরা তাঁর দোষ ধরতে পারি না—বাচাপি ভর্তুঃ পরমাণুমাত্রমিচ্ছামি দোষান্ ন গুণান্ বিসৃজ্য।

দোষ একটাই। যুধিষ্ঠির পাশা খেলেছেন এবং জুয়াড়ির মতো পণ রেখেছেন। কিন্তু হেরে যাবার পরেও যুধিষ্ঠির বলবেন—না আমি দ্রৌপদীকে পণ রাখিনি ; এই দুরাত্মা শকুনিটা জোর করে আমাকে দিয়ে পণ রাখিয়েছে এবং হারিয়েছে—না, এই সব ওজর-আপত্তি তিনি একবারও তোলেননি। কুরুবৃদ্ধ ভীষ্ম স্বয়ং দ্রৌপদীর প্রশ্নের কোনও মীমাংসা করে দিলেন না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই বিপর্যস্ত মুহূর্তেও ভীষ্ম তাঁর সম্বন্ধে মন্তব্য করছেন—তিনি এই ঋদ্ধা পৃথিবীও ত্যাগ করবেন বরং, কিন্তু সত্য ত্যাগ করবেন না। ভীষ্মের ছোট্ট কথাটার মধ্যেও কুরুসভায় দূতক্রীড়ার সমস্ত তথ্যটা দেওয়া আছে। ভীষ্ম বলেছেন—শকুনির মতো পাশা খেলতে পারে এমন দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি দূতক্রীড়ায় যুধিষ্ঠিরের ইচ্ছা তৈরি করেছেন—কুন্তীসুতস্তেন নিসৃষ্টকামঃ।

আসলে পরের পর বাজি রাখতে রাখতে যুধিষ্ঠিরের ঘোর লেগে গিয়েছিল। তিনি বাজি রাখছেন, হারছেন এবং যখন বাজি ধরার মতো আর কিছুই নেই, তখন শকুনিই তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন—কোন বস্তু তিনি বাজি রাখতে পারেন। দ্রৌপদীকে বাজি রাখার ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে কিন্তু খেলায় যে শঠতা হচ্ছে, শকুনি যে সব অন্যায় করছেন, যুধিষ্ঠির সময়ে তার প্রতিবাদও করেননি। সময়ে ‘শঠতা’র উচ্চারণ না করায়—ন মন্যতে তা নিকৃতিং যুধিষ্ঠিরঃ—তিনি এক সময় পরাজিত ঘোষিত হয়েছেন। এ বিষয়ে ভীষ্মের ধারণা এইরকমই। দ্রৌপদী ভীষ্মকে বলেছেন—কুরুসভার বদমাশ শঠ জুয়াড়িরা রাজাকে ডেকে এনেছে এখানে। পাশা-খেলার ইচ্ছে তাঁর মোটেই ছিল না, কাজেই শকুনি তাঁকে প্ররোচিত করেছেন এটা কেমন কথা! আসল কথা হল, শুদ্ধস্বভাব যুধিষ্ঠির শকুনির শঠতা ধরতেই পারেননি—সংশুদ্ধভাবো নিকৃতিপ্রবৃত্তম্ অবুধ্যমানঃ। সকলে একসঙ্গে মিলে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করে এই খেলা জিতেছে শকুনি এবং যুধিষ্ঠিরও পরে বুঝতে পেরেছেন—শকুনি কতটা অন্যায় করেছে-পশ্চাদয়ং কৈতমভ্যুপেতঃ।

কিন্তু পরে বুঝে তো আর লাভ নেই। তখন যা হবার হয়ে গেছে। ভদ্রলোকের ওই এক বিপদ। পরে বুঝতে পারে। কিন্তু যুধিষ্ঠির অন্যায়ভাবে পরাজিত হলেও তিনি যখন নিজেই এই আত্মহত্যার খেলা খেলেছেন ও পরাজিত হয়েছেন, তখন তাঁর মুখ দিয়ে কোনও ওজর আপত্তি শোনা যায়নি। দ্রৌপদীর চরম অপমান দেখে ক্রুদ্ধ ভীম দাদা যুধিষ্ঠিরকেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিতে আরম্ভ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—যুধিষ্ঠির! জুয়াড়িদেরও পোষা বেশ্যা থাকে, তারাও অন্তত সেই বেশ্যাদের বাজি রাখে না। তুমি সেখানে কুলবধূ দ্রৌপদীকেও বাজি ধরেছ। বেশ্যার ওপর মানুষের যে দয়া থাকে, তোমার কি তাও নেই? ভীম রাগের চোটে যুধিষ্ঠিরের পাশা-খেলার হাতটি পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভীমের কথা বেশি দূর এগোতে পারেনি। তার আগেই সর্বদর্শী অর্জুন যুধিষ্ঠিরের চিরন্তন মর্যাদা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ভীমকে স্তব্ধ করে দিয়ে বলেছেন—তুমি তো আগে কোনও দিন এইভাবে কথা বলনি। পরম ধার্মিক, আমাদের সবার বড়দাদাকে এইভাবে তুমি অপমান করতে পার না—ভ্রাতরং ধার্মিকং জ্যেষ্ঠং মাতিক্রমিতুমর্হসি। শত্রুরা কি তোমারও ধর্মগৌরব নষ্ট করে দিয়েছে?

কী ভয়ঙ্কর ঘটনাই না ঘটতে চলেছে পাশাখেলার আসরে। সে যে কত বড় বিপদ, তা ভীম না বুঝলেও অর্জুন অন্তত বোঝেন। এই অসম্ভব মুহূর্তেও যুধিষ্ঠিরের ওপর অর্জুনের মায়া হল। হয়তো তাঁর মনে পড়ল সেই দিনটির কথা, যেদিন স্বয়ম্বরসভার ভূষণ-মণ্ডিতা দ্রৌপদীকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন তিনি। সেদিনও এই ভীমই ছিলেন তাঁর সঙ্গে। দুজনে একসঙ্গে মায়ের কাছে এসে বলেছিলেন—মা! কেমন ভিক্ষা এনেছি দেখ! নিজের অজান্তে জননী কুন্তী পাঁচ ভাই মিলে ভিক্ষা ভাগ করে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু তারপর? তারপর যখন জননীর ভুল ভাঙল, তখন যে যুধিষ্ঠিরই সমস্ত ভবিষ্যতের নির্ণায়ক হয়ে দাঁড়ালেন। জননী যে যুধিষ্ঠিরকেই সিদ্ধান্ত নেবার ভার দিয়েছিলেন।

সেদিনের কথা আজ ভীমের মনে নেই। কারই বা থাকে? সেদিন যুধিষ্ঠির তাঁর চার ভাইয়ের দিকে তাকিয়েই বুঝেছিলেন—কোনও ভাইই যদি কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর অধিকারে বঞ্চিত হন, তো ভাইতে ভাইতে বিভেদ ঘটবে। যুধিষ্ঠির তা চান না। এক রমণীর জন্য ভ্রাতৃ-বিবাদ—যুধিষ্ঠির, পিতৃসম যুধিষ্ঠির, সংসারের কর্তা-ঠাকুর যুধিষ্ঠির তা হতে দেবেন না। অথচ আজ তাই ঘটতে চলেছে। দ্যূতসভার নীচতায় পাঞ্চালীর অপমান ঘটল, সেটা সহ্য করা যেমন কঠিন, ঠিক তেমনই অসহনীয় এই ভ্রাতৃ-বিবাদ। এই ঘটনায় যুধিষ্ঠিরের মনে যে কত ব্যথা লাগবে, তা ভীম না বুঝলেও অর্জুন বোঝেন। তিনি যুধিষ্ঠিরের ভাই নন শুধু, শিষ্যও বটে—ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য। ভাই বলে তিনি যুধিষ্ঠিরের প্রতি মায়ায় কাতর হন, আর শিষ্য বলে যুধিষ্ঠিরের অপমান তাঁর সহ্য হয় না। অর্জুন তাই যুধিষ্ঠিরের হয়ে ভীমের কাছে ওকালতি করতে আরম্ভ করলেন বৃহত্তর স্বার্থে।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরের পক্ষে দাঁড়ালেন—ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনুসারে। পাশা-খেলায় আহূত রাজাকে তো আসতেই হবে। তাঁকে খেলতেও হয়েছে পরের ইচ্ছায়—আহূত হি পরৈ রাজা ক্ষাত্রং ধর্মম্ অনুস্মরন্। দীব্যতে পরকামেন…। তবে শুধু শুধু তাঁকে গালমন্দ করছেন কেন? অর্জুনের যুক্তি থেকে বোঝা যায়—যুধিষ্ঠির পুরোই দোষী নন। কিন্তু সব কিছুর মধ্যে বিপদ ঘটিয়েছে তাঁর ভদ্রতা এবং মুখচোরা স্বভাব। ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয়যজ্ঞের সময় চেদিরাজ শিশুপাল যখন তাঁর অভীষ্টতম কৃষ্ণকে গালাগালি দিচ্ছিলেন, তখনও সেই চরম মুহূর্তে যুধিষ্ঠির শিশুপালের পিছন পিছন অনুগমন করে তাঁকে সানুনয়ে বলেছিলেন—এরকম করে কঠিন কথা বলবেন না রাজা, এতে অধর্ম হয়—অধর্মশ্চ পরো রাজন্ পারুষ্যঞ্চ নিরর্থকম্। আবার ধৃতরাষ্ট্রের পাশা-খেলার আহ্বান শুনেও তিনি সেই একই ভদ্রতা দেখিয়েছেন—পিতার সমান জ্যাঠামশাই ডেকেছেন, অতএব যেতেই হবে। শকুনির সঙ্গে খেলতে বসেও সেই একই ভদ্রতা—ঠকিয়ে দিয়ো না, মাতুল। ক্ষত্রিয়ের ছেলে, যুদ্ধবিগ্রহ করে যথাসাধ্য ব্রাহ্মণদের রক্ষা করি। তুমি অন্যায়ভাবে খেলে আমাদের ঠকিয়ো না, মাতুল—তদ্ বৈ শ্ৰেয়ো মাস্ম দেবী র্মা জৈষীঃ শকুনে পরান।

আপনারাই বলুন, এই ভদ্রতা কি শকুনির মতো খলস্বভাব ঠগীর সঙ্গে চলে। পাশা-খেলার সময় খেলার ঝোঁকে শকুনির ছল-জুয়াচুরি তিনি কিছুই ধরতে পারলেন না। কিন্তু পণ ধরে হেরে যখন গেছেন, তখন তিনি প্রতিজ্ঞাত ধর্ম থেকে সরে আসবেন না। তা হলে যুধিষ্ঠিরের ভদ্রতা, ধর্ম এবং সত্যের কী ফল হল? সারা সময় জুড়ে দ্রৌপদীর ওপর যথেচ্ছ অপমান তাঁকে সহ্য করতে হল অধোবদনে, একটি কথাও না বলে। সভার মধ্যে কর্ণ-দুর্যোধনের বিকৃত চিৎকার, দ্রৌপদীর কাপড় ধরে দুঃশাসনের টানাটানি, মাঝে মাঝে ভীমের আস্ফালন, হুঙ্কার, প্রতিজ্ঞা আর দ্রৌপদীর করুণ তর্কযুক্তি,—সব যুধিষ্ঠিরকে সহ্য করতে হয় নিজেরই দুঃসহ অপমানের যন্ত্রণায়। উত্তরঙ্গ সভাগৃহের মাঝখানে যুধিষ্ঠির বসে রইলেন সমাহিতের মতো।

শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীই বাঁচালেন। বীরের ঘরণী তিনি, রাজসভার মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে একটুও অপমানিত না করেও তিনিই যুধিষ্ঠিরকে বাঁচালেন। ধৃতরাষ্ট্র বর চাইতে বললে—তিনি প্রথম যাঁকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে বললেন, তিনি যুধিষ্ঠির। পণ্ডিতেরা কেউ কেউ এই ঘটনায় যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর অন্তর্নিহিত ভালবাসার সন্ধান পেয়েছেন এবং তাঁকে দ্রোপদীর নায়ক ঠাউরে বসেছেন। সবিনয়ে জানাই—এ ঘটনায় দ্রৌপদীর ভালবাসা কিছুই প্রকট হয় না তাঁর ভালবাসাটা বড় জটিলও বটে। এখানে যুধিষ্ঠিরকেই প্রথম দাসত্ব থেকে মুক্ত করার পিছনে দুটি কারণ আছে। প্রথম কথা হল যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা এবং তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামী। শ্রেষ্ঠ এবং জ্যেষ্ঠের মুক্তিতে তাঁর নিজেরই মাহাত্ম্য বাড়ে। দাসী থেকে তিনিও এক মুহুর্তেই রানির পর্যায়ে উন্নীত হন। সেই মুহূর্তে এই মর্যাদাই তাঁর প্রয়োজন ছিল। আরও একটা কথা। যুধিষ্ঠিরকে মুক্ত করে তিনি তাঁর পাশা-খেলার অমানুষী ইচ্ছেটাকে চরম লজ্জা দিলেন।

সর্বশেষে জানাই—যুধিষ্ঠিরকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। তিনি পাশা খেলুন আর নাই খেলুন, পণ ধরুন বা নাই ধরুন, কৌরবরা পাণ্ডবদের রাজ্যচ্যুত করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। যখন ধৃতরাষ্ট্র এবং দুর্যোধন—দু’জনেই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে পাণ্ডবভাইদের আবার ইন্দ্রপ্রস্থের রাস্তা থেকে ধরে আনলেন দ্বিতীয়বার পাশা খেলার জন্য, তখনই বোঝা যায়, মহাভারতের কবির কাছে যুধিষ্ঠিরের অপটু পাশা খেলাটা একটা জুতসই নিমিত্তমাত্র, প্রতিতুলনায় কৌরবদের জঘন্য চক্রান্তটা সর্বসমক্ষে তুলে ধরাটাই মহাকবির আসল উদ্দেশ্য; যুধিষ্ঠিরকে সামান্য আদর্শভ্রষ্ট করে তারই পথ ধরে মহাকাব্যের গতি এবং নাটকীয়তা এক চরম খাতে বইয়ে দিয়েছেন মহাভারতের কবি।

দ্রৌপদী এবং ভাইদের নিয়ে যুধিষ্ঠির বনে চললেন নির্বিণ্ণ মুনির মতো। যাবার সময় কুরুবৃদ্ধদের সবার কাছে বিদায় চাইলেন যুধিষ্ঠির। সবাইকে বলে গেলেন—আবার দেখা হবে—সর্বান্ আমন্ত্র্য গচ্ছামি দ্রষ্টাস্মি পুনরেত্য চ। কুরুবৃদ্ধরা দুঃখে লজ্জায় কেউ কথা বলতে পারলেন না। শুধু বিদুর যুধিষ্ঠিরকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন—অন্যায়ভাবে কেউ যদি জিতে নেয় তোমাকে, তবে তোমার সেই পরাজয়ে লজ্জা নেই কোনও, দুঃখও কিছু নেই—নাধর্মেণ জিতঃ কশ্চিদ্ ব্যথতে বৈ পরাজয়ে। তুমি শুধু ধর্মকেই জান, অতএব জয় তোমাদের হবেই। যুধিষ্ঠির বনের পথে পা বাড়ালেন কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে। ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে এই মুখ ঢাকার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন—অন্যায়ভাবে আপনার ছেলেরা তাঁর রাজ্য কেড়ে নিলেও যুধিষ্ঠির কখনও ধর্মভ্রষ্ট হন না। বনে যাবার সময় একান্ত ধর্মনিষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের চোখেও হয়তো ক্রোধের ছায়াপাত ঘটেছে। ধর্মিষ্ঠের চক্ষু থেকে যদি ক্রোধাগ্নির উৎপত্তি ঘটে এবং তাতে যদি জগৎ ধ্বংস হয়, যুধিষ্ঠির তাই বস্ত্রে আবৃত্ত করেছেন তাঁর মুখ—বস্ত্রেণ সংবৃত্য মুখং কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।

যুধিষ্ঠির বনের পথে রওনা হলে হস্তিনাপুরের প্রজাদের মধ্যে রীতিমতো বিক্ষোভ শুরু হল। তারা ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহান্ধতার নিন্দা করার সময় নীতি-নিপুণ অন্যান্য কুরুবৃদ্ধদেরও ছেড়ে কথা কইল না। তারা যুধিষ্ঠিরের পিছন পিছন চলল বনের পথ ধরে। তাদের ধারণা—ধর্মভ্রষ্ট ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যে থাকার চেয়ে যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষের সঙ্গে বনে থাকাও ভাল। তারা বলল—আপনারা যেখানে যাবেন, আমরাও সেখানেই যাব—বয়মপ্যনুগচ্ছামো যত্র যূয়ং গমিষ্যথ। যুধিষ্ঠির তাদের অনেক বোঝালেন। ভীষ্ম, বিদুর এবং জননী কুন্তীর সুরক্ষা এবং সেবা করার জন্যই যে তাদের রাজ্যে থাকাটা একান্ত প্রয়োজন—এই কথা বলে যুধিষ্ঠির তাদের ফিরিয়ে দিলেন সানুনয়ে। ফিরে যাবার সময় তারা রীতিমতো কাঁদতে থাকল—চক্রুরার্তস্বরং ঘোরং হা রাজন্নিতি দুঃখিতাঃ।

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে প্রজারা দুঃখিত মনে ফিরে গেলেন বটে, কিন্তু রাজ্যের ব্রাহ্মণ-সজ্জন অনেকেই যাঁরা ধৃতরাষ্ট্র-দুর্যোধনের রাজ্য ত্যাগ করে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে চলে এসেছিলেন, তাঁরা কিন্তু কিছুতেই ফিরে যেতে রাজি হলেন না। যুধিষ্ঠির তাঁদের কত বোঝালেন—আমাদের রাজ্য নেই, সম্পত্তি নেই, বনের মধ্যে কোনওমতে ফল, মূল, মাংস জুটিয়ে খাওয়া-দাওয়া চলবে। সেখানে যদি আপনারা থাকেন, তবে আপনাদের বড় কষ্ট হবে এবং সে কষ্ট আমি সইতে পারব না। বামুন-ঠাকুররা বললেন—মহারাজ! বনে আপনারা যেমন থাকবেন, আমরাও সেইভাবে থাকতে প্রস্তুত হয়েছি—গতি র্যা ভবতাং রাজন্ তাং বয়ং গন্তুমুদ্যতা। আর দেখুন, ভগবানও ভক্তকে ছাড়েন না, আপনি সেখানে…। যুধিষ্ঠির তাঁদের কথা তেমন করে না ফুরোতেই বললেন—ব্রাহ্মণদের প্রতি আমার ভক্তি চিরন্তনী। কিন্তু কী করি, নির্জন বনে আমার কোনও সহায় থাকবে না। যে ভাইরা আমার ফল-মূল, মাংস জোগাড় করে আনবে, তারা দুঃখ-শোকে কাতর হয়ে পড়েছে। দ্রৌপদীর অপমান, রাজ্যহরণ—সব কিছু মিলিয়ে তাদের মনের অবস্থা এমন যে, আমি তাদের বলতে পারব না যে—যাও এখন, বামুন-ঠাকুরদের তণ্ডুল জোগাড় করে আন।

সাধারণ অবস্থায়, ক্ষত্রিয় পুরুষ উপস্থিত থাকতে ব্রাহ্মণদের অন্ন সংগ্রহের কথা ভাবতে হত না। তাঁরা ধ্যান-জপ, যজ্ঞ-হোম নিয়ে থাকতেন, ক্ষত্রিয়রা তাঁদের অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করতেন। কিন্তু ব্রাহ্মণরা যুধিষ্ঠিরের অসহায় করুণ অবস্থা জেনেও তাঁর অনুগামী হয়েছেন স্বেচ্ছায় যুধিষ্ঠিরকে ভালবেসে। অতএব যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে তাঁরা বললেন—আমাদের ভরণ-পোষণ নিয়ে আপনাকে একটুও বিব্রত হতে হবে না, মহারাজ—অস্মৎপোষণজা চিন্তা মা ভূত্তে হৃদি পার্থিব। আমাদের খাবার-দাবার আমরাই জোগাড় করে নেব। আমরা ধ্যান করব, জপ করব, আর শুধু আপনার মঙ্গলের চিন্তা করব। আর অবসর সময়ে নানা কথায়, মনোহর উপাখ্যানে আমরা ভুলিয়ে রাখব আপনাদের সবাইকে—কথাভিশ্চাতিরম্যাভিঃ সহ রংস্যামহে বয়ম্।

যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে সঙ্গে ব্রাহ্মণদের এই অনুযাত্রার একটা বিশেষ তাৎপর্য আছে বলে আমাদের ধারণা। তৎকালান সমাজে ব্রাহ্মণরা ছিলেন রাজষন্ত্রের স্তম্ভস্বরূপ। রাজনীতির তাত্ত্বিক জ্ঞান যেমন তাঁদেরই অধিগত ছিল, তেমনই রাজাদের সিংহাসনে স্থাপন করা থেকে আরম্ভ করে রাজ্য পরিচালনা এবং রাজত্বে তাঁদের স্থিতিসাধন করাটাও তাঁদেরই ওপর অনেকটা নির্ভর করত। ঠিক এই নিরিখে দেখতে গেলে হস্তিনাপুর ছেড়ে ব্রাহ্মণদের বহুলাংশে চলে আসাটা একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। অন্য দিকে যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে দেখতে গেলেও ব্রাহ্মণদের এই সঙ্গতি তাঁর বনবাসী জীবনের পরম রসায়ন। তার কারণ শুধু এই নয় যে, অরণ্যের মুক্ত পরিবেশে উতলা হাওয়ার মধ্যে ব্রাহ্মণদের মুখোদগীর্ণ নানা উপাখ্যান আর খেচরান্নের সহযোগে তাঁর বনবাস-কাল মুখর হয়ে উঠবে। আসল কথা ব্রাহ্মণদের সঙ্গ এবং তাঁদের দার্শনিক যুক্তি-তর্ক যুধিষ্ঠির ব্যক্তিগতভাবে এতই পছন্দ করেন যে, স্বয়মাগত ব্রাহ্মণদের উপস্থিতিতে তিনি উদ্বেলিত বোধ করেছেন। তিনি তাঁর ভাব গোপন না করেই বলে ফেলেছেন—কোনও সন্দেহ নেই, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে থাকতেই আমার সব সময় ভাল লাগে—এবমেতন্ন সন্দেহো রমে’হং সততং দ্বিজেঃ। তবে আমরা থাকতেও ব্রাহ্মণরা তাঁদের নিজেদের খাবার নিজের জোগাড় করবেন—এ আমি কেমন করে সইব?

যুধিষ্ঠিরের এই খেদ সত্ত্বেও ব্রাহ্মণরা তাঁর সঙ্গে থেকে গেছেন এবং বনবাসের প্রথম দিন থেকেই ব্রাহ্মণদের নানা উপদেশ এবং আলোচনার মধ্য দিয়েই যুধিষ্ঠির এবং পাণ্ডবদের বনবাস-জীবনের সূত্রপাত হয়েছিল। মাঝখানে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে অপমানিত হয়ে মহামতি বিদুর কয়েকদিনের জন্য পাণ্ডবদের কাছে এসেছিলেন। দ্বারকা থেকে এসেছিলেন কৃষ্ণ আর পাঞ্চাল থেকে ধৃষ্টদ্যুম্ন। বিদুরের সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের যৎসামান্যই কথা হয়েছিল, কিন্তু সেই সামান্য কথারও একটা রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে। কারণ, বিদুর যা বলেছিলেন, যুধিষ্ঠির সেইভাবে চলছিলেন অনেক আগে থেকেই। সে-কথায় পরে আসব। অন্য দিকে বনবাসের কুটীরে কৃষ্ণ এবং অর্জুনের আগমন তাঁর অস্বস্তিই তৈরি করেছিল বেশি। কারণ, কৃষ্ণ যেমন পাণ্ডবদের ভাই এবং বন্ধু ছিলেন, ঠিক তেমনই ছিলেন দ্রৌপদীর সখা।

কৌরব-সভায় দ্রৌপদীর যে চরম অপমান হয়েছিল, তার প্রথম বিস্ফোরণ ঘটেছিল এই বনবাসের কুটীরে—কৃষ্ণের সামনে এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের সামনে। দ্রৌপদী সেদিন শুধু যুধিষ্ঠিরকে নয়, পঞ্চপাণ্ডবদের কাউকেই তিরস্কার করতে বাকি রাখেননি। কিন্তু যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলার দাযেই যে শেষ পর্যন্ত দ্রৌপদীর অপমান চরমে পৌঁছেছিল, সেটা যুধিষ্ঠির ভাল করেই জানতেন। আর জানতেন বলেই—পড়লে কথা সবার মাঝে/ যার কথা তার গায়ে বাজে—এই নিয়মে যুধিষ্ঠির যথেষ্টই বিব্রত ছিলেন। আশ্চর্য হল, যে মুহূর্তে কৃষ্ণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং স্বয়ং অর্জুন দ্রৌপদীর সামনে তাঁদের কঠোর প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করলেন দুর্যোধন-দুঃশাসনদের বিরুদ্ধে, তখনও কিন্তু কথা শেষ হয়ে যায়নি। কৃষ্ণ বার বার বলেই চলেছিলেন—“ইস্! আমি যদি সেই সময় দ্বারকায় থাকতাম, তা হলে এই ভয়ঙ্কর পাশা-খেলা হতে দিতাম না। পাশা-খেলার হাজারো দোষ দেখিয়ে আমি কুরুবৃদ্ধদের প্রত্যয় জন্মাতাম এবং তারপরেও যদি ওরা না শুনত, তা হলে…ইত্যাদি ইত্যাদি। সবার শেষে কৃষ্ণ আবারও যুধিষ্ঠিরকে বললেন—আমি দ্বারকায় ছিলাম না, সেই জন্যই তোমরা এই পাশা খেলার ফাঁদে পড়লে, দাদা—যেনেদং ব্যসনং প্রাপ্তা ভবন্তো দ্যুতকারিতম্।

যুধিষ্ঠির দেখলেন—পাশা-খেলার ধূয়াটা কৃষ্ণ কিছুতেই ছাড়ছেন না। যে কথাই বলেন, তার শেষেই কৃষ্ণ যোগ করেন—ইস্! আমি যদি তখন দ্বারকায় থাকতাম…ইত্যাদি। যুধিষ্ঠির দেখলেন—বারংবার এই পাশা-খেলার উচ্চারণ তাঁর নতুন বিপদ ডেকে আনবে দ্রৌপদীর সামনে। এতক্ষণ যে তিরস্কার পাণ্ডবদের সবার উদ্দেশে উচ্চারিত হয়েছে, হয়তো সেই তিরস্কার এবার নেমে আসবে ব্যক্তিগতভাবে যুধিষ্ঠিরের ওপরেই। হয়তো এই যাত্রা কোনও রকমে বাঁচবার জন্যই ভারতবর্ষীয় একান্নবর্তী পরিবারের বড়কর্তার মতো যুধিষ্ঠির কী নিপুণভাবে কথা ঘোরালেন। বললেন—কী জন্য তুমি দ্বারকায় ছিলে না, ভাই? কোথায় গিয়েছিলে কী বা করলে সেখানে—ক্ক চাসীদ্ বিপ্রবাসস্তে কিঞ্চাকার্ষীঃ প্রবাসতঃ? অর্থাৎ অন্য গল্প বল, পাশা-খেলা থাক।

কৃষ্ণ নিজের প্রবাস-কাহিনী শোনালেন, সাময়িকভাবে যুধিষ্ঠিরের ফাঁড়াও হয়তো কাটল। কিন্তু যে বিদগ্ধা রমণীর এক পঞ্চমাংশ মাত্র লাভ করে একটুও যাকে সামলাতে পারেননি যুধিষ্ঠির, সেই রমণী যে তাঁকে এত সহজে ছেড়ে দেবেন না, তাও তিনি ভালই জানতেন। আসলে যুধিষ্ঠিরকে আপনি কীভাবে দেখবেন? তিনি ক্ষত্রিয়ের বংশে জন্মেছেন বটে, কিন্তু তাঁর স্বভাবটা একটুও ক্ষত্রিয়জনোচিত নয়। যে উৎসাহনশক্তি বা উদ্যম ক্ষত্রিয়ের প্রধান গুণ, তা তাঁর মধ্যে কোনও দিন লক্ষিত হয়নি। এই বনবাসে আসা অবধি ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তিনি একটি কথাও বলেননি। এমনকী ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের বিরুদ্ধেও সামান্য ধিক্-শব্দ উচ্চারণ করা ছাড়া—ধিক্ পাপান্ ধৃতরাষ্ট্রজান্—তিনি এমন কথা কখনও বলেননি—যাতে মনে হয় একটা প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যাপার নিশ্চয়ই আছে।

বনে এসে ইস্তক তিনি কী করছেন? ব্রাহ্মণ-সজ্জনের সঙ্গে সদা সর্বদা তত্ত্ব-তথ্য আর দার্শনিক আলোচনায় মত্ত আছেন যুধিষ্ঠির। অনুতপ্ত ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ পেয়ে সারথি সঞ্জয় যখন অপমানিত বিদুরকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এলেন তখন সঞ্জয় এসে দেখেছিলেন—যুধিষ্ঠির বসে আছেন বিদুরের সঙ্গে শত-সহস্র ব্রাহ্মণের দ্বারা পরিবৃত হয়ে। এই ব্রাহ্মণ-পরিবারের মধ্যে বসে যুধিষ্ঠির যা বুঝতেন, যা শুনতেন, তা অন্তত উৎসাহ-উদ্যমের কথা নয়। তা শুধুই তত্ত্ব কথা। ক্ষত্রিয়াণী দ্রৌপদী, কৌরবসভায় চরম লাঞ্ছিতা দ্রৌপদী কি এই তত্ত্ব-কথা শুনে পুলকিত বোধ করতেন একটুও?

কৃষ্ণ আর ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন কুরুকুল ধ্বংসের প্রতিজ্ঞা সেরে যে যার বাড়ি ফিরে গেলেন, তখন কুরুদেশের পৌরপ্রধানেরা—মুখ্যাশ্চ সর্বে কুরুজাঙ্গলানাম্—যুধিষ্ঠিরের কাছে এসে বিলাপ করেছিলেন অনেক। যুধিষ্ঠির তাঁদের আদর করেছিলেন খুব, কিন্তু কোনও উৎসাহের প্রতিশ্রুতি উচ্চারণ করেননি। রাজনীতিতে পৌরমুখ্যদের এই সমর্থন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ জেনেই সেদিন অর্জুন উত্তর দিয়েছিলেন—বনবাসের কাল শেষ হলেই মহারাজ যুধিষ্ঠির বলপ্রয়োগ করে শত্রুদের যশ হরণ করবেন। পৌরমুখ্যরা সেদিন সানন্দে অর্জুনের জয়ধ্বনি দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন। কিন্তু যুধিষ্ঠির কী করেছিলেন? কুরুজঙ্গলবাসী ব্রাহ্মণ এবং পৌরমুখ্যেরা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বলেছিলেন—বারো বছর এই নির্জন বনে থাকতে হবে। তোমরা একটা জায়গা খুঁজে বার কর, যেখানে ফুল-ফলের অভাব নেই, মৃগপক্ষীর অভাব নেই, আর অভাব নেই ধার্মিক মানুষের—বারোটা বছর যেখানে সুখে শান্তিতে কাটাতে পারি—যত্রেমাঃ শরদঃ সর্বাঃ সুখং প্রতিবসেমহি।

অর্জুন যুধিষ্ঠিরের মন জানেন। নারদ এবং ব্যাসদেবের সুচিরসঙ্গরঞ্জিত যুধিষ্ঠির, ব্রাহ্মণদের স্পর্শলুব্ধ যুধিষ্ঠির কোথায় থাকতে চান, অর্জুন তা জানেন। অর্জুনের তত্ত্বাবধানে দ্বৈতবনের সুশীতল সরোবরের তীরে যেখানে থাকবার ব্যবস্থা হল—সেখানে হাজার ব্রাহ্মণ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে এলেন—বহবো ব্রাহ্মণাস্তত্র পরিবব্রু-র্যুধিষ্ঠিরম্—আর দ্বৈতবনের তাবৎ ব্রাহ্মণ এবং মুনি-ঋষিরা—পূতাত্মনাং চীরজটাধরাণাম্—এসে মিলিত হলেন পূর্বাগত ব্রাহ্মণ পরিবারের সঙ্গে। দ্বৈতবনে আসবার পরেই যুধিষ্ঠিরের সাক্ষাৎ হয় বিখ্যাত মার্কণ্ডেয় মুনির সঙ্গে। সমস্ত দ্বৈতবনের মধ্যে এক বিশাল ব্রাহ্মণ্য পরিমণ্ডল রচিত হল। একদিকে ঋক্-সাম-যজুর্বেদের মন্ত্রধ্বনি, অন্যদিকে পাণ্ডবদের ক্ষত্রোচিত ধনুর্ঘোষ—দুয়ে মিলে ব্রাহ্মণ্য এবং ক্ষাত্ৰতেজের মিল সূচিত হল—জ্যাঘোষঃ পাণ্ডবানাঞ্চ ব্ৰহ্মঘোষশ্চ ধীমতাম্।

সন্দেহ নেই, সেকালে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়ের এই পরস্পর অন্বয় যুধিষ্ঠিরের সঙ্কট অনেক লঘু করে দিয়েছে। কিন্তু মহাভারতের তথ্য থেকে বুঝতে পারি—শুধুমাত্র পাণ্ডবদের জ্যাঘোষ ছাড়া ক্ষাত্রশক্তির আর কোনও আস্ফালন দ্বৈতবনে শোনা যায়নি। বস্তুত সম্পূর্ণ দ্বৈতবন যুধিষ্ঠিরের অনুগামী ব্রাহ্মণ্যের সমর্থনেই মুখরিত ছিল—অনুর্কীর্ণং মহারণ্যং ব্রাহ্মণৈঃ সমপদ্যত। নিশ্চয়ই এটাও খুব কম কথা নয়। কিন্তু স্বয়ং যুধিষ্ঠির পাণ্ডবদের জ্যাঘোষে যতখানি পরিতৃপ্ত ছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি আনন্দিত ছিলেন বক দালভ্য অথবা নারদ, বেদব্যাস, কাশ্যপ, শৌনক, সুহোত্র, হোত্রবাহনের ব্রাহ্মণ্যভাবনায়।

এইভাবে কতদিন চলে? বিস্ফোরণ ঘটল। দিবারাত্র চোখের সামনে বই নিয়ে যে অধ্যাপক বসে আছেন, তাঁর স্ত্রী যেমন সংসারের চালচুলো সামলাতে গিয়ে নিরীহ স্বামীটির ওপর মাঝে-মাঝেই ঝেঁজে ওঠেন, দ্রৌপদী একদিন সেইভাবে ঝেঁজে উঠলেন যুধিষ্ঠিরের ওপর। লক্ষ করে দেখুন—ভীম থেকে সহদেব—এই চতুষ্পাণ্ডবের চাইতে মাত্র এক থেকে চার বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরের ভাবটি ছিল এক বৃহৎ সংসারের কর্তামশাই পিতা ঠাকুরটির মতো। এ-কথা আমি আগেও বলেছি। কোনও দিন কোনও ভারী কাজ যুধিষ্ঠিরকে করতে হয়নি। কোনও অসুর-রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ নয়, বনবাসের ফল-মূল আহরণ নয়, কোনও লঘু কাজও নয়। সব তাঁর বশংবদ ভাইরা করেন যুধিষ্ঠিরের প্রতি গুরুর সম্মানে—গুরুবন্-মানবগুরুং মানয়িত্বা মনস্বিনম্।

কিন্তু কেন এই গুরুর সম্মান? কারণ সেই ধর্ম। কারণ সেই সর্বাশ্লেষী বিশ্বজনহিতকর মানবতা, যা তাঁকে সমস্ত ব্যক্তিগত আবর্ত থেকে উঠিয়ে এনে এক নির্বিকার জগতে সমাসীন করে দিয়েছে। ক্ষত্রিয় তো নয়ই, এমনকী সাধারণ ব্রাহ্মণ মুনি-ঋষিদের মতোও তিনি নন। হাজারো ব্রাহ্মণের সাহায্য এবং উপদেশ তিনি লাভ করেছেন, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তাঁর উপদেষ্টা ব্রাহ্মণ এবং ঋষিরাও যেখানে ক্রোধ প্রকাশ করেছেন, অভিশাপ দিয়েছেন, সেখানে তিনি তাঁদের থেকেও ঊর্ধ্বে। আমরা এক সময়ে অন্যত্র বলেছিলাম—শ্রীমদ্ ভগবদ্‌গীতার মতো এক সারাৎসার দার্শনিক উপদেশের পাত্র যুধিষ্ঠির না হয়ে অর্জুন হলেন কেন? আমরা দেখিয়েছিলাম—শমদমাদি সাধন-সম্পদ অর্জুনের মধ্যে ছিল তথা গীতায় উপদিষ্ট দার্শনিক-তত্ত্ব ধারণ করার মতো যোগ্যতা এবং পাত্ৰতা ছিল বলেই, অর্জুন গীতার শ্রোতা নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু গীতার মধ্যে যে স্থিতধী মানুষের বর্ণনা আছে, সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ এবং জয়-পরাজয়ের সমানবোধসম্পন্ন যে মহান ব্যক্তির বর্ণনা আছে, যুধিষ্ঠির নিজে তো তার উদাহরণ-স্বরূপ বটেই এবং যুধিষ্ঠির আরও বড় কিছু।

গীতায় বলা হয়েছে—যে ব্যক্তি যোগসিদ্ধির পথে আরোহণ করতে ইচ্ছুক, তাকে কর্ম করতে হয়। আর যিনি যোগসিদ্ধ ব্যক্তি তার কর্ম করার প্রয়োজন নেই। কর্মত্যাগই তার পক্ষে প্রশস্ত—যোগারূঢ়স্য তস্যৈব শমঃ কারণমুচ্যতে। একজন যোগের উচ্চতায় আরুরুক্ষু অন্যজন আরূঢ়। অর্জুন আর যুধিষ্ঠিরের মধ্যেও এই পার্থক্য। অর্জুন যথেষ্ট নির্বিণ্ণ হলেও তাঁকে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম-কর্ম পুরোপুরি পালন করতে হয়। আর যুধিষ্ঠির যোগারূঢ় বলে, তাঁর কাছে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম-উৎসাহ-উদ্যমের কোনও মূল্য নেই। যুধিষ্ঠিরকে কখনও আমরা রাজোচিত উত্থানশক্তিসম্পন্ন দেখিনি। মনে মনে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম ত্যাগ করে তিনি জীবনমুক্ত এক সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন।

মুশকিল হল, এত বড় বড় কথা বললে প্রশ্ন ওঠে—তা হলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুদ্ধ করা, বিবাহ করা, গৃহস্থ ধর্ম, পুত্রলাভ—এগুলি কি মজা নাকি? উত্তরে বলি—এ সব দার্শনিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া এই স্বল্প পরিসরে সম্ভব নয়। ভগবদ্‌গীতায় রাজর্ষি জনকের উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি জীবন্মুক্ত সর্বত্যাগী ঋষি হওয়া সত্ত্বেও রাজধর্ম, সংসারধর্ম সবই করেছেন—রামকৃষ্ণের ভাষায় পাকাল মাছের মতো। যুধিষ্ঠিরের জীবনযাত্রার উদাহরণও আমরা রাজর্ষি জনকের একাত্মতায় দেখতে চাই। যুধিষ্ঠিরের এই জীবন্মুক্ত মনোভাব সাধারণ্যে বোঝানোর মতো নয়। এমনকী তাঁর ভাইরাও যে তাঁকে সম্পূর্ণ বুঝেছেন, তা নয়। স্ত্রী দ্রৌপদী যথেষ্ট বিদগ্ধা হওয়া সত্ত্বেও যুধিষ্ঠিরের এই মানসিক পর্যায় কখনও সম্পূর্ণ অনুভব করতে পারেননি বলেই মনে করি। আর আধো-বোঝা আধো-না-বোঝা মনোভাব থেকেই তাঁদের মনে সেই শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে, যাতে যুধিষ্ঠির সমস্ত পরিবারের কাছে কর্তামশাইয়ের মতো, গুরুঠাকুরের মতো হয়ে গেছেন।

কিন্তু বাস্তব জগতের নানান জটিলতার মধ্যে এই গুরুঠাকুরটির কী অবস্থা হতে পারে, তার প্রমাণ যেমন আমরা আগেও পেয়েছি, এখনও পাব। ব্যাপারটা দ্রৌপদীর দিক থেকে দেখুন। কী পেয়েছেন তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে? সারাক্ষণ জ্ঞান আর সত্যের উচ্চচুড়ায় বসে থাকা যুধিষ্ঠির তাঁর প্রথম এবং জ্যেষ্ঠ স্বামী। তাঁকে সহজে ভালবাসা বড় কঠিন। সাধারণের মতো তাঁকে ভালবাসতে গেলেই মনে হয়—ইনি তো সাধারণ নন। ধর্ম, সত্য এবং দর্শনের আবরণ ভেদ করে তাঁর প্রেমিক হৃদয়খানি আবিষ্কার করার চেয়ে কোনও দেবতার হৃদয় আবিষ্কার করাও অনেক সহজ। লোকটি একাধারে অবুঝ এবং কঠিনও বটে। অন্য সবার যখন রাগ হয়, তখন তাঁর রাগ হয় না। সবার যখন লজ্জায় মাথা নুয়ে যাচ্ছে, তখনও তাঁর কোনও লজ্জা নেই—আমরা তাঁকে পাশা খেলবার সময়েও এইরকম দেখেছি। সবাই যখন প্রতিশোধ-স্পৃহায় অভিশাপ অথবা বধের প্রতিজ্ঞা করেন, তখন এই মানুষটি চোখে কাপড় জড়িয়ে হাঁটেন।

এমন মানুষের স্ত্রী হয়ে দ্রৌপদী কী করবেন? দ্রৌপদীর দুঃখ হয়, রাগ হয়, আর সব চেয়ে বেশি হয় মায়া। এই পরম জ্যেষ্ঠ-স্বামীটির আবরণ ভেদ করতে পারেন না বলেই কখনও তাঁর ওপর রাগে ফেটে পড়েন, কখনও তাঁর জ্ঞান আর তাত্ত্বিক বোধের গরিমায় অসম্ভব শ্রদ্ধালু বোধ করেন, আর কখনও পরম স্নেহময়ী জননীর মতো—সংসারের বড় ছেলে, ধম্ম-কম্ম ছাড়া কিচ্ছুটি বোঝে না—এমনই এক মায়ায় যুধিষ্ঠিরকে লালন করেন দ্রৌপদী। কিন্তু যেখানে দ্রৌপদীর স্ত্রীত্বের অধিকার, সেখানে যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর ব্যবহার অনেকদিন ঘর করা প্রাচীন গৃহিণীটির মতো। ভাবটা এই—সংসার তোমার। কেন তুমি সংসারের সমস্ত প্রাণীগুলোর সুখ-দুঃখ বোঝ না। শুধু দিনরাত ওই জটাধারী মুনি-ঋষিগুলোর সঙ্গে বসে বসে ধম্মচর্চা করলেই চলবে। আমার কথা ছেড়েই দিলাম না হয়, চারটে ছোট ছোট ভাই আছে, তাদের কথা ভেবে দেখেছ কখনও।

বলা বাহুল্য, দ্রৌপদীর এই প্রাচীন গৃহিণী-স্বভাবের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি আক্ষেপ-অধিক্ষেপ যতই লক্ষিত হোক, এর মধ্যে অন্তঃসলিলা নদীর মতো এক মমতা ছিল দ্রৌপদীর। একে পরিষ্কারভাবে প্রেম বলতে আমরা রাজি নই। তবে মমতা, মায়া—এগুলিও প্রেমের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যেই পড়ে। মহাভারতে দেখা যাবে—অসংখ্য ঋষি-ব্রাহ্মণের সঙ্গে দিন দিন যুধিষ্ঠিরের আধ্যাত্মিক চর্চা যখন বেড়েই চলেছে, সেই সময়েই দ্বৈতবনের অন্তর্গৃহে একটা বিস্ফোরণ ঘটল।

কথাটা আরম্ভ হয়েছিল ঠাণ্ডাভাবেই, তারপর ক্ষত্রিয়াণী দ্রৌপদীর রাজরক্ত উদ্বেলিত হয়ে উঠল উত্তেজনায়, প্রতিশোধ-স্পৃহায়, আর ধর্মশুদ্ধ যুধিষ্ঠির তখন নিজেকে পুনরায় স্বরূপে প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য হলেন। দ্রৌপদী বলেছিলেন—রাজা আমার! সেই যেদিন ধৃতরাষ্ট্রের অসভ্য ছেলেগুলো তোমাকে এবং আমাকে মৃগচর্ম পরিয়ে বনবাসে পাঠাল, সেদিন কিন্তু ওদের দুঃখও হয়নি, অনুতাপও হয়নি—বনং প্রস্থাপ্য দুষ্টাত্মা নান্বতপ্যত দুর্মতিঃ। তুমি ওদের সবার বড়ভাই এবং ধর্মই ছিল তোমার একমাত্র আশ্রয়, তবু ওরা তোমার সঙ্গে কী নোংরা ভাষাতেই না কথা বলেছিল। যে তুমি কোনও দিন কষ্টে অভ্যস্ত নও, তাকে কষ্ট দিয়ে ওরা কীরকম মজা পাচ্ছে দেখ—ঈদৃশং দুঃখমানীয় মোদতে পাপপূরুষঃ। ইন্দ্রপ্রস্থে তোমার সেই দুধ-সাদা বিছানা, সোনার আসন, বহুমূল্য পোশাক, গা দিয়ে চন্দনের গন্ধ বেরোচ্ছে ভুর-ভুর করে। ভাবতেও কেমন লাগে। আর এখানে? এখানে তোমার কন্টক শয্যা, কুশের আসন, কৌপীন পরিধান, আর গা থেকে ধুলো ঝাড়তে হচ্ছে সব সময়—সত্যিই আমার মনে কোনও শান্তি নেই—কা শান্তি-র্হৃয়দস্য মে।

মানুষ নিজের কষ্টকে সব চেয়ে বড় করে দেখে। দ্রৌপদীও ভেবেছিলেন, হয়তো যুধিষ্ঠির তাঁর কথা শুনে বিষণ্ণ বোধ করবেন। কিন্তু না, কিছুই হল না। দ্রৌপদী এবার বললেন—আচ্ছা ভীমকে বনবাসীর সাজে দেখে তোমার কষ্ট হয় না, রাজা? ওই অমানুষিক শক্তি! ওই তেজ! সে বুঝি একাই সমস্ত কৌরবকে ধ্বংস করে দিতে পারে। অথচ সে এখন এই বনের মধ্যে ফল-মূল কুড়িয়ে দিন কাটাচ্ছে। দ্রৌপদী একে একে ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব—সবার সঙ্গে নিজেরও দুর্দশার বর্ণনা করলেন এবং এঁদের সকলের অনুষঙ্গে বারংবার তাঁর প্রশ্ন ছিল একটাই—তোমার রাগ হয় না? কেন রাগ হয় না তোমার—কস্মাদ্ রাজন্ ন কুপ্যসি? কস্মান্-মন্যুর্ন বর্ধতে?

এতগুলো কথা শুনে যুধিষ্ঠির একটা কথারও উত্তর দিলেন না। দ্রৌপদীর মেজাজ আস্তে আস্তে চড়ছে। তিনি বললেন—তোমার বোধহয় রাগ বলে কোনও জিনিস নেই। চিরকাল শুনে এসেছি—রাগ ছাড়া ক্ষত্রিয় হয় না—তোমায় দেখে বুঝি কথাটা উলটো। তবে এটাও জেনে রেখ—যে ক্ষত্রিয়-পুরুষ তেজ দেখানোর সময় এলেও তেজ দেখায় না, তাকে লোকে অবজ্ঞা করে। তাই বলছিলাম—শত্রুদের ওপর এত ক্ষমা তুমি দেখিয়ো না—তৎ ত্বয়া ন ক্ষমা কার্যা শত্রূন্ প্রতি কথঞ্চন।

যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ দ্রৌপদীর কথা শুনে একটু তির্যকভাবেই উত্তর দিলেন—মহাপ্রাজ্ঞে! আমাকে যে তুমি এত করে ক্রোধী হওয়ার উপদেশ দিচ্ছ, সেই ক্রোধ জিনিসটা কি খুব ভাল? ক্রোধ যে সহ্য করতে পারে, সেই তো মঙ্গল লাভ করে। যে ক্রোধের বশীভূত হয়ে মানুষ যা করা উচিত নয় তাই করে, যা বলা উচিত নয় তাই বলে, সেই সর্বনাশা ক্রোধ কী করে আমি করতে পারি—তৎ কথং মাদৃশঃ ক্রোধং বিসৃজেল্লোকনাশনম্। কোনও জ্ঞানী মানুষ রাগ পুষে রাখতে বলেন না। অন্য মানুষ ক্রোধ প্রকাশ করলেও যে রেগে ওঠে না, সে যেমন নিজেকেও বাঁচাচ্ছে, তেমনই অন্যকেও বাঁচাচ্ছে—ক্রুধ্যন্তম্ অপ্রতিক্রুধ্যন্ দ্বয়োরেষ চিকিৎসকঃ।

দ্রৌপদী এতক্ষণ যে বস্তুটিকে ‘তেজ’ বলে মনে করছিলেন যুধিষ্ঠিরের মতে তা আদৌ তেজ নয়। যে ক্রোধ শুধুমাত্র দুর্যোধনের বধের উদ্দেশ্য নিয়ে বল্গাহীন ছুটতে থাকবে, সেই ক্রোধ অন্তত যুধিষ্ঠিরকে মানায় না—মাদৃশঃ প্রসৃজেৎ কস্মাৎ সুযোধনবধাদপি। যুধিষ্ঠির মনে করেন—যিনি প্রকৃত তেজস্বী, তাঁর হৃদয়ে ক্রোধের স্থান নেই। বস্তুত মূর্খ লোকেরাই ক্রোধ জিনিসটাকে তেজ বলে ভাবে। যুধিষ্ঠিরের মতে ক্ষমাই মনস্বীদের আসল তেজ। দুর্যোধন ক্ষমা ধারণ করার যোগ্য নয় বলেই, তাঁর মধ্যে ক্ষমা নেই। আর যুধিষ্ঠির যোগ্য বলেই ক্ষমা তাঁকে আশ্রয় করেছে—অৰ্হস্তত্ৰাহমিত্যেবং তস্মান্মাং বিন্দতে ক্ষমা।

যুধিষ্ঠিরের কাছে ‘ক্ষমা’ বস্তুটা ক্রোধের উলটো পিঠে একটা বৃত্তিমাত্র নয়। বস্তুত এটা তাঁর রাজনীতিবোধেরও অঙ্গ। সেই কবে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে অপমানিত হয়ে বিদুর চলে এসেছিলেন স্বেচ্ছা-বনবাসে যুধিষ্ঠিরের কাছে। বিদুর চলে যাবার পরেই ধৃতরাষ্ট্র ভয় পেয়েছিলেন। রাজনীতির বোধে বিদুর ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম প্রধান তাত্ত্বিক। তিনি যদি নিজের অভিজ্ঞতা এবং রাজনীতিবোধে পাণ্ডবদের ঋদ্ধ করতে থাকেন, তবে যে ধৃতরাষ্ট্রের আপন পুত্রদের সর্বনাশ হবে—এ-কথা ধৃতরাষ্ট্র বুঝেছিলেন—বিবৃদ্ধিং চ পরাং মত্বা পাণ্ডবানাং ভবিষ্যতি। কিন্তু বিদুর যতটুকু সময় বনে ছিলেন, সেই সময়টুকুই যুধিষ্ঠিরের মতো স্থিতধী মানুষকে রাজনীতি বোঝানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল। বিদুর সেদিন যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন—শত্রুরা সাংঘাতিক বিপদের মধ্যে ফেলে দিলেও, যে রাজা ক্ষমা অবলম্বন করে উৎকৃষ্ট কালের অপেক্ষা করেন, তিনি একাকী এই পৃথিবী শাসন করার যোগ্য হন—ক্লেশৈ স্তীব্রৈ-যুর্য্যমানঃ সপত্নৈ:/ক্ষমাং কুর্বন্ কালমুপাসতে যঃ।

শুকনো ঘাস দিয়েও যেমন আগুন জিইয়ে রাখা যায়, ক্ষমা অবলম্বন করেও তেমনই এক সময় নিজেকে সম্পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। বিদুরের এই ক্ষমার রাজনীতিই যৌধিষ্ঠিরী নীতিতে পরিণত হয়েছে। ‘ক্ষমা’ জিনিসটা তাই তাঁর কাছে কোনও ক্ষণিক হৃদয়বৃত্তি নয়। ক্ষমা তাঁর কাছে রাজনীতি, অধ্যাত্মনীতি, জীবননীতি। যুধিষ্ঠির বলেছেন—আমার এই ‘ক্রোধ-শান্তির রাজনীতিই ক্ষমা’—যে নীতির প্রশংসা করবেন কুরুবৃদ্ধ পিতামহ, যে নীতির প্রশংসা করবেন কৃষ্ণ, যে নীতির সমর্থন করবেন দ্রোণাচার্য এবং বিদুর।

খুব পড়াশুনো করা লোক অবুঝ স্ত্রীর কাছে পড়াশুনো নিয়ে জ্ঞান দিলে যা হয়, দ্রৌপদীরও বুঝি তাই হল। অথচ দ্রৌপদী ততখানি অবুঝ বা নির্বোধ নন, যেমনটি অন্যান্য সাধারণীরা। আসলে ক্ষত্রিয়াণী দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের এত ক্ষমা সইতে পারছিলেন না বলেই চেঁচিয়ে উঠলেন—সৃষ্টিকর্তা বিধাতার পায়ে নমস্কার, যিনি এমন মোহগ্রস্ত করে রেখেছেন তোমাকে। দেখ, তোমার ভাইরাও ধর্ম কিছু কম বোঝে না। নিজের প্রাণের চেয়েও ধর্মই তাঁদের কাছে বড়। অন্য দিকে ধর্মের জন্য, সত্যরক্ষার জন্য তুমি ভাইদের এবং আমাকেও যে ত্যাগ করতে পার তাও আমি জানি। কিন্তু যে ধর্মের জন্য তোমার এত দরদ—সে ধর্ম তোমাকেও কিন্তু রক্ষা করছে না। আমরা শুনেছি—রাজা, যদি ধর্মকে রক্ষা করেন, তবে সেই ধর্ম রাজাকেও রক্ষা করে। কিন্তু সে ধর্ম তোমাকেই শুধু রক্ষা করে না—ত্বান্তু মন্যে ন রক্ষতি। দ্রৌপদী অভিমান থেকেই এ সব কথা বলেছেন, নইলে যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধে তাঁর কোনও অশ্রদ্ধা ছিল না। যুধিষ্ঠিরের রাজত্বে আপামর জনসাধারণ কত সুখে ছিল, কত সম্মান নিয়ে যুধিষ্ঠির রাজত্ব চালিয়েছেন, তার সরব প্রশংসা দ্রৌপদীর মুখে শোনা গেছে। কিন্তু আজ সেই ধর্মশুদ্ধ রাজা বনবাসের জ্বালা ভোগ করছেন আর ধর্মনাশী দুর্যোধন সম্পত্তি ভোগ করছেন—বিধাতার এই বিপরীত আচরণে দ্রৌপদী বিধাতার ওপরেই ক্ষুব্ধ—ধাতারং গর্হয়ে পার্থ বিষমং যো’নুপশ্যতি। দ্রৌপদীর সাভিমান বক্তব্য—মানুষ যদি আপন কৃতকর্মের ফল পায়, একজনের কৃতকর্মের ফল যদি অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত না হয়, তাহলে ধর্মযাজী যুধিষ্ঠিরের দুর্ভোগ আর ধর্মনাশী দুর্যোধনের সম্ভোগ লাভ হতে পারে না। বিধাতার এই বিষম উপন্যাসে ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ দ্রৌপদী ধারণা করেন—স্বয়ং ঈশ্বরই বুঝি আজ পাপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন—কর্মণা তেন পাপেন লিপ্যতে নূনমীশ্বরঃ।

অভিমানহতা দ্রৌপদীর কথাগুলি শুনতে লাগল সেই বিলাপিনী নারীর মতো, যে স্বামী-পুত্রের বিপত্তিতে ঈশ্বরকেই দোষ দেয়—হায়! এ কী হল, ভগবান! এই তোমার মনে ছিল?—ইত্যাদি। বস্তুত কারও ভাল বা মন্দ অবস্থার জন্য ঈশ্বর দায়ী নন। গীতায় সেই অমূল্য কথাটি আছে ভগবানের জবানীতে—ঈশ্বর কারও পাপও গ্রহণ করেন না, পুণ্যও গ্রহণ করেন না। অজ্ঞান মানুষ তবুও ঈশ্বরের মধ্যে বৈষম্য-আচরণ আবিষ্কার করে। দার্শনিক, তত্ত্বজ্ঞ যুধিষ্ঠির তাই দ্রৌপদীর এই সাভিমান আক্ষেপ সহ্য করতে পারেননি। তিনি বলেছেন—তুমি বলেছ ভাল দ্রৌপদী, কিন্তু কথাটা বলেছ নাস্তিকের মতো। দ্রৌপদী কী করে বোঝাবেন—পাগল দার্শনিক স্বামী তার প্রিয়া পত্নীর মমতামাখা অভিমানটুকু পর্যন্ত বোঝেন না। তিনি জ্ঞান দিতে থাকেন। তত্ত্বে, দর্শনে, বিশ্বাসে ঘা পড়েছে, অতএব যুধিষ্ঠির থামবেন না। তিনি বলতে থাকবেন।

তিনি যা বলবেন—তা সব আমরা এখানে উদ্ধার করব না। শুধু সেইটুকু বলব—যাতে বোঝা যায় আমরা কেন তাঁকে এক সময় ক্ষত্রিয় রাজা অথবা একজন ব্রাহ্মণ ঋষির চেয়েও বড় বলে মনে করেছি। সেইটুকু বলব, যাতে বোঝা যায় কেন তাঁকে আমরা পূর্বে রাজর্ষি জনকের মান্যতা দিয়েছি, কেনই বা বসিয়েছি গীতোক্ত যোগারূঢ় ব্যক্তির সিংহাসনে। যুধিষ্ঠির বললেন—দ্রৌপদী! আমি ধর্মাচরণ করি, অতএব আমাকে সুখভোগই করতে হবে—এর কোনও মানে নেই। আমি ধর্মের ফল খুঁজে বেড়াই না। দান করতে হয় তাই দান করি, যজ্ঞ করতে হয়, তাই যজ্ঞ করি। ধর্মের অনুষ্ঠানে কোনও ফল হোক বা না হোক, ধর্মের আচরণটাই আমার স্বভাব—ধর্মং চরামি সুশ্রোণি ন ধর্মফলকারণাৎ। ধর্মের ফল নিয়ে আমার কোনও মাথা-ব্যথা নেই, কারণ আমি ধর্মের এমন বাণিজ্য করি না যে, আমাকে ভাবতে হবে—আমি এতটুকু দিয়েছি, অতএব ততটুকু আমায় পেতে হবে।

গীতার সঙ্গে কেমন মিলে যাচ্ছে—কর্মেই তোমার অধিকার আছে অর্জুন, ফলে কোনও অধিকার নেই—কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। অর্জুন এই পর্যায়ে উঠতে চান, অতএব তাঁকে গীতার উপদেশ করতে হয়েছে। আর যুধিষ্ঠির এই পর্যায়ে উঠে গেছেন, অতএব তিনি যোগারূঢ়, রাজনীতির ক্ষেত্রেও এই নীতি তাঁকে সহসা উদ্যোগী হয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেয় না। বিপন্নতা, দুঃখ, বিপর্যয় তাঁকে শান্ত করে, আরও শান্ত করে। তাঁকে বুঝতে শেখায়—মানুষ যখন পৃথিবীর মতো সহনশীল আর ক্ষমাবান হবে, তখন সেই ক্ষমা আর শান্তির মধ্যেই শুধু নতুনের জন্ম হয়। ক্রোধ শুধু মৃত্যু আর বিনাশ ডেকে আনে, সে সৃষ্টি করে না—ক্ষমাবতো হি ভূতানাং জন্ম চৈব প্রকীর্তিতম।

আমরা জানি—দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে যেভাবে তিরস্কার করেছিলেন, তার মধ্যে মায়া-মমতার ভাগটাই ছিল বেশি। যুধিষ্ঠিরের ধর্ম এবং যুধিষ্ঠিরের ঈশ্বরের ওপর দ্রৌপদী যে আক্রোশ দেখিয়েছিলেন, তা বাস্তবে দ্রৌপদীর অন্তর্গত হৃদয়ের ভাব নয়। দ্রৌপদী নিজেও তা বুঝিয়ে দিয়েছেন—আমি কোনও ভাবেই তোমার ধর্ম বা ঈশ্বরকে আঘাত দিতে চাইনি—নাবমন্যে ন গর্হে চ ধর্মং পার্থ কথঞ্চন। আমার দুঃখ হয়েছে, তাই বলেছি। যুধিষ্ঠিরের মুখে হাজার তত্ত্বকথা শুনেও দ্রৌপদী কিন্তু থামেননি। কৌরব রাজনীতির শঠতা এবং কপটতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বার বার রাজধর্মে স্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। রাজধর্ম বলতে দ্রৌপদী বুঝিয়েছেন সেই প্রচণ্ড উদ্যম, উদ্দীপনা, উত্থানশক্তি এবং শত্রুপক্ষের সতত ছিদ্রান্বেষণ, যুধিষ্ঠিরের মধ্যে এই বৃত্তি একটুও লক্ষিত হয় না।

মৃদু তিরস্কার শোনার পর বিদগ্ধা দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের মতো সমান দার্শনিকতা প্রয়োগ করেই তাঁর তর্ক-যুক্তি সাজিয়েছেন। কিন্তু কথা শেষ হতে না হতেই মধ্যম-পাণ্ডব ভীম একেবারে সপ্তম সুরে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ক্রোধ বর্ষণ করলেন। যুধিষ্ঠিরের বনবাসে আসার প্রতিজ্ঞা পালন তাঁর মতে ক্ষুদ্র একটুখানি ধর্মলেশমাত্র ; শকুনির কাছে বনবাসের বাজি হারার সামান্য প্রতিজ্ঞার জন্য এত কষ্ট পাওয়ার কোনও অর্থই নেই তাঁর কাছে—ধর্মলেশাপ্রতিচ্ছন্নঃ… দুঃখেষু পরিতপ্যতে। যুদ্ধ, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ—ভীম শুধু যুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠিরকে বললেন—আমরা ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রিয়ের কাছে যুদ্ধই সব। সেই ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে তুমি শুধু লোকের কাছে হাস্যাস্পদ হবে। শকুনি-দুর্যোধনরা শঠ আচরণ করেছে, অতএব তাদের সঙ্গে শঠ আচরণই করা উচিত। ভীম যুধিষ্ঠিরকে রীতিমতো গালাগালি দিলেন এবং ছোটভাই ভীম বলেছেন বলেই যুধিষ্ঠিরের মনে তা বড় বেশি বাজল।

যুধিষ্ঠির খুব দুঃখ পেলেন। এমন কথাও তিনি ভীমকে বললেন যে—তুমি আমার বনবাসের প্রতিজ্ঞার সময়েই এই কঠিন কথাগুলো বলতে পারতে, আজ বলে লাভ কী? এতই যখন গালাগালি দিচ্ছ, তো সেই সময়ে তুমি যে আমার পাশা-ক্রীড়ার হস্তটি পুড়িয়ে দেবে বলেছিলে, তাই করলেই পারতে। তাতে এমন কী দুষ্কর্ম হত? তোমার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে তরল বিষ পান করছি যেন—দুয়ে বিষস্যেব রসং হি পীত্বা। সেই সময় এক রকম প্রতিজ্ঞা করে, এখন আরেক রকম করব, তা আমার দ্বারা হবে না। মাটিতে গাছের বীজ ফেলে যেমন অঙ্কুরের জন্য অপেক্ষা করতে হয়, তেমনই আমাদেরও অপেক্ষা করতে হবে।

ভীম অধৈর্য মানুষ। তিনি এতটুকুও অপেক্ষা করতে চান না। এখনই ঝাঁপিয়ে পড়তে চান শত্রুর ওপর। ভীম বললেন—তোমার স্বভাবের কোমলতায় তুমি বেশি দয়ালু হয়ে গেছ। বামুনরা যেমন নিরুদ্যমে যাগ-যজ্ঞ করে নিশ্চিন্ত বসে থাকে, তেমনই শাস্ত্র-শাস্ত্র আর ধর্ম-ধর্ম করে তোমার বুদ্ধিটাই ভোঁতা হয়ে গেছে—অনুবাকহতা বুদ্ধি নৈর্ষা তত্ত্বাৰ্থদর্শিনী। আমার কেবলই ভাবনা হয়—এমন এক দয়ালু ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্মাল কী করে—ঘৃণী ব্রাহ্মণরূপো’সি কথং ক্ষত্রেজায়থাঃ?

যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ভীমের সমস্ত গালাগালি শুনলেন। উলটে কোনও গালাগালি করলেন না, মন্দ কথাও বললেন না। ভীমের ধৈর্যহীন ক্রুদ্ধ ভাষণের প্রত্যুত্তর দিলেন রাজনীতির যুক্তিতে, যৌধিষ্ঠিরী নীতির মাহাত্ম্যে। যুধিষ্ঠির বললেন—রাজধর্ম, বর্ণধর্ম—দুটোই আমার একটু-আধটু জানা আছে ভাই—শ্রুতা মে রাজধর্মাশ্চ বর্ণানাঞ্চ বিনিশ্চয়াঃ। কিন্তু যে মানুষ ভবিষ্যতে কী করা উচিত তাও জানে আর বর্তমানে কী করা উচিত তাও জানে, সেই কিন্তু বুদ্ধিমান লোক। তুমি নিজের শক্তি আর বলদর্পিতার জোরে যেমন চপলতা প্রকাশ করলে, তার উত্তরে দু-চারটে নাম শোনাই, শোন।

পাণ্ডব-কৌরবের কল্পিত যুদ্ধকালে কী ধরনের যুদ্ধপক্ষ বা ‘অ্যাক্সিস্’ তৈরি হতে পারে, তার একটা নিপুণ চিত্র তুলে ধরলেন যুধিষ্ঠির। যুধিষ্ঠির বললেন—ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করবেন। কারণ এঁরা কৌরবদের অন্নের ঋণ মেটাবেন—অবশ্যং রাজপিণ্ডস্তৈ-নির্বেশ্য ইতি মে মতিঃ। রাজ্যের বাইরে যাঁরা কৌরবদের হিতার্থী তাঁরাও তাঁদের পক্ষে আসবেন। এদিকে রাজসূয়যজ্ঞের সময় যে সব রাজাকে আমরা যুদ্ধে জয় করে, উৎপীড়ন করে রাজকর দিতে বাধ্য করেছিলাম, তাঁরা সবাই দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দেবেন, আমাদের পক্ষে নয়—দুর্যোধনহিতে যুক্তা ন তথাস্মাসু ভারত। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ—এঁরা সব দিব্য-অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করবেন, অন্য দিকে তাঁদের সঙ্গে আছেন কর্ণ—তাঁর মতো যুদ্ধ-বীর খুব বেশি নেই। এঁদের প্রতিপক্ষে তুমি আমাদের দেখ। আমাদের সহায়-সম্পদ, দিব্য-অস্ত্র কিছুই নেই। অথচ এই বীর যোদ্ধাদের যুদ্ধে জয় না করে তুমি কোনওভাবেই দুর্যোধনকে মারতে পারবে না—অশক্যো হ্যসহায়েন হন্তুং দুর্যোধনস্থয়া।

যুদ্ধকালের বাস্তবচিত্রখানি ভীমের সামনে তুলে ধরে যুধিষ্ঠির তাঁর সিদ্ধান্ত জানালেন—ভাই! ভীষ্ম-দ্রোণের মতো মহাবীর এবং কর্ণের মতো ক্ষিপ্রহস্ত ধনুর্ধর বীরের কথা চিন্তা করে রাত্রে আমার ঘুম হয় না, আর তুমি এখনই যুদ্ধ-যুদ্ধ করছ—ন নিদ্রামধিগচ্ছামি চিন্তয়ানো বৃকোদর। ভীম নিজের বাহুবলে যতই বিশ্বাসী হোন, ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণের শক্তি তিনি জানেন। যুধিষ্ঠিরের মুখে হঠাৎ এই রাজনৈতিক মেরুকরণের বাস্তব তাৎপর্য বুঝে ভীম কিন্তু রীতিমতো চিন্তিত হলেন। তিনি আর একটুও অধৈর্য হলেন না, একটাও কথা বললেন না যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধে।

যুধিষ্ঠির-ভীমের ঝটিকা-সংলাপের অব্যবহিত পরেই বনবাসের কুটীরে উপস্থিত হলেন ব্যাসদেব। তিনি যুধিষ্ঠিরকে দিব্য-অস্ত্র সংগ্রহ করার জন্য উদ্যোগী হতে বললেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, অশ্বত্থামা—এই সব মহাবীরদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হলে যে দিব্যাস্ত্রের প্রয়োজন হবে—সেটা ভাল করেই বুঝিয়ে দিলেন ব্যাসদেব। ব্যাস যুধিষ্ঠিরকে ‘প্রতিস্মৃতি’ বিদ্যা দান করলেন, যে বিদ্যার সাধনে অর্জুন দেবতাদের তুষ্ট করে অস্ত্র লাভ করতে পারবেন। যে উদ্যোগ এবং উৎসাহশক্তির কথা দ্রৌপদী-ভীম বলে আসছিলেন, তার সূত্রপাত হল এক ঋষির মাধ্যমেই, যে ঋষি কৌরব-পাণ্ডবের এক পিতামহ হওয়া সত্ত্বেও পাণ্ডবদের পক্ষপাতী হয়ে পড়েছেন যুধিষ্ঠিরের প্রতি দুর্বলতায়। অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছে বিদ্যা শিখে চলে গেলেন তপস্যায়।

বনবাসকালে যে সময়টুকু অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছাকাছি থাকলেন না, সেই সময়টুকু শুধু যুধিষ্ঠির কেন, কারওই ভাল কাটল না। ভীম যুধিষ্ঠিরের পিঠোপিঠি ভাই। দাদা বলে যুধিষ্ঠিরকে তিনি মোটেই ছেড়ে দেন না, অর্জুনের মতো গুরু বলেও মানেন না যুধিষ্ঠিরকে। যুধিষ্ঠির-ভীমের ঝগড়া লাগলে একমাত্র সামাল দেওয়ার লোক হলেন অর্জুন। তিনি ভীমকে কোনওমতে থামিয়ে রাখেন। এই মুহূর্তে অর্জুন চলে যাওয়ায় ভীমের আক্রোশ বেড়েই চলল যুধিষ্ঠিরের ওপর। থামাবারও কোনও লোক নেই। যুধিষ্ঠির অসহায়। ভীম সেই একই কথা আবারও বলে চললেন—তোমার জন্যই আজকে আমাদের এই বনবাসের কষ্ট। পাশা খেলা জান না, তবু পাশা খেলতে বসেছিলে। অর্জুন আজকে তপস্যা করতে গেল, এর জন্যও তুমি দায়ী। এখনও বলছি, আমাদের ভাল চাও তো, একবার শুধু বল। তারপর দেখ, আমি দুর্যোধনকে কীভাবে মেরে ফেলি—ইত্যাদি ইত্যাদি।

যুধিষ্ঠির একটুও মাথা গরম করলেন না। পরিবর্তে তাঁকে জড়িয়ে ধরে পরম স্নেহে মস্তকাঘ্রাণ করে বললেন—ভাই! আমাদের বনবাসের কাল অতীত হলে, তুমি একেবারে অর্জুনের সঙ্গে গিয়ে দুর্যোধনকে মেরে আসবে। আমাকে যে তুমি উলটে ওদের সঙ্গে শঠতা করতে বলছ, সেই শঠতা ছাড়াও দুর্যোধনকে মারতে পারবে—হন্তা ত্বমসি দুর্ধর্ষং সানুবন্ধং সুযোধনম্। ভীম বারবার যুধিষ্ঠিরকে ভয় দেখিয়েছিলেন যে, অজ্ঞাতবাসের পর কৌরবরা আবারও যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে পাশা খেলে তাঁকে হারাবে। যুধিষ্ঠির সে ব্যাপারেও একটা ‘গার্ড’ নিলেন। বৃহদশ্ব নামে এক মুনি এসে যুধিষ্ঠিরকে নলরাজার পাশা-খেলার বৃত্তান্ত শুনিয়েছিলেন। সেই বৃহদশ্ব পাশা-খেলার সমস্ত কূট রহস্য জানতেন। যুধিষ্ঠির তাঁর কাছে ‘অক্ষহৃদয়’ শিখে নিয়ে অন্যতর এক বাস্তবের জন্যও নিজেকে তৈরি রাখলেন।

কাম্যক বনের আশ্রমে তিন ভাই আর দ্রৌপদীকে নিয়ে যুধিষ্ঠির অর্জুনের ফিরে আসার অপেক্ষা করছিলেন। এই সময়ে অর্জুনের জন্য দ্রৌপদীর সপ্রেম বিলাপ তাঁকে ধৈর্য ধরে শুনতে হয়েছে। অর্জুনকে কেউই কম ভালবাসতেন না। দ্রৌপদীর বিলাপের সঙ্গে ভীম-নকুলদের আর্ত কণ্ঠও মিশ্রিত হয়েছিল। কিন্তু অর্জুনের জন্য দ্রৌপদীর একান্ত অনুভূতি যুধিষ্ঠিরকে আলাদাভাবে মথিত করেছিল নিশ্চয়। কিন্তু তিনি তা বুঝতে দেননি। অর্জুনের অনুপস্থিতিতে স্ত্রী এবং ভাইদের সঙ্গে তিনিও একাত্ম হয়েছেন একইভাবে—শ্রুত্বা বাক্যানি বিমনা ধর্মরাজো’প্যজায়ত—কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে। অর্জুনের বিরহ-কষ্ট ভোলাবার জন্য তিনি এবার সবাইকে নিয়ে তীর্থযাত্রা অর্থাৎ আমাদের লৌকিক ভাষায় দেশ-ভ্রমণে বেরলেন। এই সম্পূর্ণ সময় ধরে দেশ-ভ্রমণ আর নানা মুনির কাছে নানা উপাখ্যান শুনে দিন কাটল যুধিষ্ঠিরের। এরই মধ্যে অর্জুনের ফিরে আসবার সময় হল। পাণ্ডবরা সবাই গন্ধমাদন পর্বতের কাছে এসে অর্জুনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন—ষড়্ রাত্রমবসন্ বীরা ধনঞ্জয়দিদৃক্ষবঃ।

অর্জুনের জন্য সবার এই অপেক্ষার মধ্যেই যুধিষ্ঠিরের জীবনে সেই মিষ্টি ঘটনাটি ঘটল। কোথা থেকে এক দিব্যগন্ধী পদ্মপুষ্প হাওয়ায় উড়ে এসে পড়েছিল দ্রৌপদীর সামনে। আর দ্রৌপদী অমনি সেটা কুড়িয়ে নিয়ে আপন প্রেম-বশংবদ ভীমকে বললেন—আমাকে এইরকম পদ্ম আরও এনে দাও। এই মনোহর সুরসৌগন্ধিক পদ্মপুষ্প আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে উপহার দেব—ইদঞ্চ ধর্মরাজায় প্রদাস্যামি পরন্তপ। ভীমকে পাঠিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী পুষ্পবতী হয়ে পৌঁছলেন ধর্মরাজের কাছে। দ্রৌপদীর কাছে থেকে অনর্ঘ উপহার লাভ করে যুধিষ্ঠির কতটা পুলকিত হয়েছিলেন, মহাভারতের কবি তা পরিষ্কার করে বলেননি। পণ্ডিত-রসিকজনে কেউ কেউ এই ঘটনার ওপর অতিরিক্ত গুরুত্ব আরোপ করে যুধিষ্ঠিরকেই দ্রৌপদীর আসল প্রেমিক এবং নায়ক হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন। কিন্তু আমাদের দৃষ্টিতে দ্রৌপদীর এই পুষ্পহরণের ঘটনা যুধিষ্ঠিরের প্রতি রসাবেশ হিসেবে ব্যাখ্যা না করাই ভাল। পঞ্চস্বামীর চির-প্রার্থনীয়া দ্রৌপদী তাঁর একেক স্বামীকে একেক সময়ে একেকভাবে তুষ্ট করেছেন। কিন্তু আপ্রবন্ধস্থিত স্থায়িভাবের মতো দ্রৌপদীর প্রেম-সর্বস্বতা যে অর্জুনকে কেন্দ্র করেই চিরকাল আবর্তিত হয়েছে, তা অর্জুনের চরিত্র আলোচনাতেই পরিষ্কার হয়ে পড়বে। এমনকী এই মুহূর্তে যে পরম সরসতায় পদ্ম-পুষ্পের উপহার নিয়ে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের কাছে ছুটলেন—জগাম পুষ্পমাদায় ধর্মরাজায় তত্তদা—তার মধ্যেও আমরা অলক্ষিতভাবে এবং তির্যকভাবে অর্জুনের উপস্থিতি লক্ষ করি।

এই কিছুক্ষণ আগে আমরা দুর্গম পার্বত্যপথ ভেঙে সমস্ত পাণ্ডবভাই এবং দ্ৰৌপদীকে চলতে দেখেছি। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বারণ করেছিলেন। কিন্তু অর্জুন ফিরে আসবেন স্বর্গপুরী থেকে, আর সেই সময় দ্রৌপদী সেখানে উপস্থিত থাকবেন না—এ তিনি মেনে নিতে পারেননি। দ্রৌপদীকে অবশ্য নিজমুখে যাবার প্রস্তাব করতেই হয়নি। দ্রৌপদীর মন বুঝে তাঁর বশংবদ ভীমই জোর করে বলেছিলেন—অর্জুনকে দেখবার জন্য দ্রৌপদী তো অবশ্যই যাবেন—ব্রজত্যেবেহ কল্যাণী শ্বেতবাহ-দিদৃক্ষয়া। দরকার হলে আমি তাঁকে কাঁধে করে নিয়ে যাব। পার্বত্যপথ বেয়ে যেতে যেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিয়েছিলেন দ্রৌপদী। নকুল তাঁকে কোনওমতে ধরে ফেলেই চিৎকার করে উঠেছিলেন যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে।

যুধিষ্ঠির পরম স্নেহে দ্রৌপদীকে নিজের কোলে শুইয়ে সেদিন অনেক কেঁদেছিলেন। বারবার নিজেকেই ধিক্কার দিয়ে বলেছেন—আমারই পাপে আজ এই বরবৰ্ণিনী সুন্দরীর এমন হতদশা এমন সুন্দর পা দু’টি, এমন সুন্দর মুখ। আমার জন্যই আজ তাঁর সর্বাঙ্গ কালো হয়ে গেছে—মৎকৃতে’দ্য বরার্হায়াঃ শ্যাম সমুপাগতম্। যুধিষ্ঠির অনেক বিলাপ করেছিলেন—কেন আমি পাশা খেলেছিলাম। কেন সেই দুর্বুদ্ধি হল? পঞ্চ-পাণ্ডবের সঙ্গে কৃষ্ণার বিয়ে হয়েছে, সে কত না সুখ পাবে—এই ভেবে দ্রুপদরাজা কতই না সুখী হয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুখ-পালিতা রমণী আজ আমারই কর্মদোষে মাটিতে পড়ে আছে—শেষে নিপতিতা ভূমৌ পাপস্য মম কর্মভিঃ।

দ্রৌপদীর জন্য যুধিষ্ঠিরের এই শোকের মধ্যে ভালবাসা নিশ্চয়ই আছে কিন্তু এই ভালবাসার ওপর অযথা গুরুত্ব আরোপ করার কোনও প্রয়োজন নেই। অনুরূপ অবস্থায় নকুল কি সহদেবের পতন ঘটলেও যুধিষ্ঠির একই রকম বিলাপ করতেন। দ্রৌপদী ভীমকে সুর-সৌগন্ধিক আহরণ করার জন্য দূরে পাঠিয়েছিলেন এবং সেই কারণে তাঁর দেরি হওয়ায় যুধিষ্ঠিরের পরম উদ্বেগ আমরা আশ্চর্য বিস্ময়ে লক্ষ করেছি। দ্রৌপদী এই ঘটনার জন্য যুধিষ্ঠিরের কাছে তিরস্কৃতও হয়েছিলেন। লক্ষ করে দেখবেন, শুধু স্ত্রী কিংবা ভাই নয়, পরবর্তী সময়ে আপন-পক্ষীয় কোনও বিপন্ন রাজা অথবা পুত্রস্থানীয় অভিমন্যুর জন্যও আমরা তাঁর পরম আর্তি লক্ষ করব। এমনকী শত্রুপক্ষের মহাবীরদের ওপরেও তাঁর সম্মান এবং মমতা কিছু কম ছিল না। বস্তুত সর্বভূতের হিতের জন্য মহামানবের মমতা অফুরান না হলে যুধিষ্ঠিরও আমাদের মতোই শুধু স্ত্রী-পুত্র কেন্দ্রিক এক সাধারণ প্রাণী হতেন।

আসলে আমরা বলতে চাইছিলাম যে,—যুধিষ্ঠির যেমন আকস্মিকভাবে দ্রৌপদীর পদ্মোপহার লাভ করলেন, তার মধ্যে দ্রৌপদীর যুধিষ্ঠির-গত প্রেম যতখানি ছিল, তার চেয়ে বেশি ছিল অন্যতর এক ‘অকারণ’ পুলক—অর্জুনের সঙ্গে অতি শীঘ্রই তাঁর দেখা হবে সেই পুলক—যে পুলকে হৃদয়-হরণ নায়ক এসে পৌঁছবার আগেই আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়, হৃদয় নাচতে থাকে, দ্রৌপদী পদ্ম হাতে ছুটতে থাকেন যুধিষ্ঠিরের কাছে, অন্য একজনকে নিমিত্তমাত্র ব্যবহার করে।

যাই হোক অর্জুন স্বর্গ থেকে ফিরে এলেন দিব্য-অস্ত্রের সম্ভার স্কন্ধে বহন করে। সমস্ত পাণ্ডবভাই আনন্দে আত্মহারা হলেন। আর এই প্রথম আমরা যুধিষ্ঠিরকে ক্ষত্রিয়ের প্রত্যয়ে কথঞ্চিৎ দৃঢ় হতে দেখলাম। অর্জুনকে যুধিষ্ঠির সোচ্চারে বলে উঠলেন—আজকে আমি মনে করছি সমস্ত পৃথিবী বিজিতা হয়েছে, আজকে সত্যিই মনে হচ্ছে—ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা আমাদের বশে আসতে বাধ্য হবে—মন্যে চ ধৃতরাষ্ট্রস্য পুত্রানপি বশীকৃতান্।

পাণ্ডবদের বনবাসকালে ভীম অজগরে পরিণত নহুষের কবলে পড়লেন এবং তাঁর মুক্তি ঘটল যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে অজগরের বিশাল এক সংলাপ শেষ হবার পর। এই সংলাপ মানবিক তত্ত্বের দার্শনিক আলোচনা। জাতিবর্ণ নির্বিশেষে মানুষের ধর্মই যে সবচেয়ে বড়, এ-কথা যুধিষ্ঠিরের মুখেই আমরা প্রথম শুনতে পাই। এই সংলাপে সারাৎকার হিসেবে এ ঘটনা যুধিষ্ঠিরের দার্শনিক সত্তা প্রমাণ করার জন্য খুব বড় উদাহরণ হতে পারে, কিন্তু পাণ্ডবদের পারিবারিক ঘটনার পরম্পরায় আমরা এই দার্শনিক আলোচনা আপাতত দূরে সরিয়ে রাখতে চাই। আমরা যুধিষ্ঠিরের মুখে ক্ষত্রিয়জনোচিত প্রথম প্রত্যয়ের কথা শুনেছি। পাণ্ডবদের বনবাস-কাল শেষ হয়ে আসছে। অতএব ক্ষমতার ধর্মে উপযুক্ত কাল প্রতীক্ষা করার যে যৌধিষ্ঠিরী নীতির কথা আমরা পূর্বে উচ্চারণ করেছিলাম, এখন সেই ব্যাপারে আমাদের অবহিত থাকতে হবে।

আশ্চর্য হল—যুধিষ্ঠিরের মুখে যখনই ক্ষত্রিয়ের প্রত্যয় দৃঢ় হতে আরম্ভ করেছে, তখনই আরও একবার বৃষ্ণিবীর কৃষ্ণকে যুধিষ্ঠিরের বনবাস-ভবনে উপস্থিত দেখতে পাচ্ছি আমরা। এর আগে কৃষ্ণ এসে দ্রৌপদীকে পরম সান্ত্বনা দিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বার বার বলেছিলেন—আমি যদি সেদিন থাকতাম, তা হলে সব লণ্ড-ভণ্ড করে দিতাম। কৃষ্ণের মতো অসাধারণ রাজনীতিবিদের মুখে এই সব অধীর কথাবার্তা শুনে দ্রৌপদীর সঙ্গে ভীমও ভাবতেন যে, যুধিষ্ঠিরের প্রতিজ্ঞাত বনবাস-কাল সম্পূর্ণ না করেই বোধহয় কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে নামা উচিত। ভীমের মুখ দিয়ে সে-কথা স্পষ্ট করে একবার বেরিয়েওছে। ভীম বলেছিলেন—বারো বছর শেষ হবার আগেই চলুন আমরা গিয়ে দুর্যোধনদের মেরে ফেলব। শুধু অর্জুন তপস্যা করতে গেছে, তাকে বন থেকে নিয়ে আসব, আর দ্বারকা থেকে নিয়ে আসব কৃষ্ণকে—নিবর্ত্য চ বনাৎ পার্থমানায্য চ জনার্দনম্। বাস, তারপর আক্রমণ।

ভীম যা বলছেন, কৃষ্ণ তাতে রাজি হতেন কি না, তা রহস্যই থেকে যাবে। কিন্তু রাজনীতিবিদ্যার সর্বশেষ রহস্য-জানা কৃষ্ণও যে এই বিষয়ে সময়ের অপেক্ষায় আছেন অথবা তিনিও যে হঠকারিতা করার মতো লোক নন, তা তাঁর অন্তর্দেশীয় রাজনীতি-চক্রেও বোঝা গেছে, এখনও বোঝা যাবে। কৃষ্ণ তাঁর নিজের শত্রু জরাসন্ধ-বধের জন্য বহুকাল অপেক্ষা করেছেন। আত্মীয়-বন্ধুদের সঙ্গে মথুরা ছেড়ে দ্বারকায় পালিয়ে গেছেন, সেখানেও বহুকাল অপেক্ষা করেছেন, কিন্তু নিজে থেকে জরাসন্ধের আক্রমণে যাননি। ঠিক একইভাবে কৃষ্ণ দ্রৌপদীর সামনে যত উষ্ণ ভাষণই দিয়ে থাকুন, আজ সপ্রশংসভাবে তিনি যুধিষ্ঠিরকে বলছেন—রাজ্যলাভের থেকেও ধর্ম অনেক বড় কথা—ধর্মঃ পরঃ পাণ্ডব রাজ্যলাভাৎ। সত্য এবং সরলতার গৌরবে তুমি শুধু ইহলোক নয়, পরলোকও জিতে নিয়েছ। কোনও গ্রাম্য আচরণে তোমার মন লুব্ধ হয় না, কামনায় তুমি জর্জরিত নও, ধন-সম্পত্তির লোভে তুমি তোমার আপন সত্য-ধর্ম ত্যাগ কর না—সত্যিই তোমাকেই তো ধর্মরাজ বলব—তস্মাৎ প্রভাবাসি ধর্মরাজঃ। সভ্যতা-ভব্যতা এবং ধর্ম মাথায় উঠিয়ে কৌরবরা যেভাবে দ্রৌপদীকে অপমান করেছিল, তা তোমার মতো ধৈর্য, সহ্য এবং বুদ্ধিসম্পন্ন না হলে অন্য কারও পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হত না—অপেতধর্মব্যবহারবৃত্তং/সহেত তৎ পাণ্ডব কস্ত্বদন্যঃ।

কৃষ্ণ পরিষ্কার যৌধিষ্ঠিরী নীতির প্রশংসা করছেন। ক্ষমা, ধৃতি, কাল-প্রতীক্ষা। শেষ বাক্যে কৃষ্ণ তাঁর রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তার প্রতিজ্ঞা করে রাখলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে—যেদিন তোমার প্রতিজ্ঞার দিন শেষ হবে, সেদিন আমরা সবাই কৌরবদের শাসন করার জন্য তোমার পাশে এসে দাঁড়াব—ইমে বয়ং নিগ্রহণে কুরূণাং যদি প্রতিজ্ঞা ভবতঃ সমাপ্তা।

পাণ্ডবদের বনবাস-কুটীরে ব্রাহ্মণ-ঋষিদের আসা-যাওয়া পূর্ববৎ চলছে। বনবাসের শেষ প্রস্থে কৃষ্ণ এসে বৃষ্ণিবীরদের সমর্থনের কথা জানিয়ে গেলেন এবং তৎকালীন রাজনৈতিক স্থিতিতে বৃষ্ণিবীরদের পাশে থাকার মূল্য অনেক। এঁরা অবশ্য আগেও তাঁর সহায় ছিলেন, কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাণ্ডবরা যখন বিপন্ন বনবাসে দিন কাটাচ্ছেন, তখন এই সমর্থন জরুরি ছিল যুধিষ্ঠিরের কাছে। অজ্ঞাতবাসের আগে আগেই পাণ্ডবরা যখন দ্বৈতবনে বাস করছেন তখন কতগুলি খুচরো ঘটনা ঘটে গেল। শকুনি-কর্ণের পরামর্শে দীন-হীন পাণ্ডবদের কুটীরের কাছাকাছি তাঁবু গেড়ে তাঁদের সামনে কৌরবদের সমৃদ্ধি প্রমাণের একটা ঝোঁক চাপল দুর্যোধনের। গরিব আত্মীয়ের সামনে ধনীর পোশাক পরে গাড়ি হাকিয়ে চলার যে বিকৃত আনন্দ, সেই আনন্দ পেতে চাইলেন দুর্যোধন—অসমৃদ্ধান্ সমৃদ্ধার্থঃ পশ্য পাণ্ডসুতান্ নৃপ।

ধৃতরাষ্ট্রকে বিপরীত বোঝানো হল। দুর্যোধন কুরুবাড়ির বউদের গা ভর্তি গয়না পরিয়ে সদলবলে পাণ্ডবদের কুটীরের সামনে এসে তাঁবু গাড়লেন। কিন্তু ঘটনা যত সহজ হবে ভেবেছিলেন, তত সহজ হল না। গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন আগে থেকেই সেই জায়গা দখল করে রেখেছিলেন। ফলে দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর বিবাদ বাধল। যুদ্ধ আরম্ভ হল গন্ধর্বসৈন্যদের সঙ্গে কৌরবদের। কৌরবরা সদলে পরাজিত হলেন। দুর্যোধন কুরুবাড়ির বউ-ঝিদের নিয়ে বন্দি হলেন গন্ধর্ব চিত্রসেনের হাতে। মহারথ কর্ণ পালিয়ে বাঁচলেন। দুর্যোধনের মন্ত্রীরা কোনও রকমে এসে যুধিষ্ঠিরের কাছে দুর্যোধনের বিপদের কথা জানালেন এবং সাহায্য চাইলেন। ঠিক এইখানে মহামতি যুধিষ্ঠিরের ব্যবহার দেখবার মতো।

অন্য সাধারণ কেউ হলে যা করতেন, দুর্যোধনের দুরবস্থার কথা শুনে ভীম তাই করলেন। বললেন—আমাদেরও ভালবাসার লোক আছে তা হলে—দিস্ট্যা লোকে পুমানস্তি কশ্চিদস্মৎপ্রিয়ে স্থিতঃ। হাতি-ঘোড়া সাজিয়ে আমাদের যে কাজটা করার কথা ছিল, সেটা গন্ধর্বরাই করে দিয়েছে। বেশ হয়েছে। ব্যাটা, আমাদের খারাপ অবস্থার সুযোগ নিয়ে মেজাজ দেখাতে এসেছিলি। এখন হল তো? আমরা সুখে বসে রইলাম, অথচ আমাদের কাঁধের ভারটা অন্য লোক টেনে দিল—যেনাস্মাকং হৃতো ভার আসীনানাং সুখাবহঃ।

যুধিষ্ঠির ভীমকে স্তব্ধ করে দিলেন। বললেন—এমন করে বোলো না, ভীম। জ্ঞাতি-ভাইদের সঙ্গে বিবাদ-বিসংবাদ হয়েই থাকে। কিন্তু তবু জেনো, আমরা একই বংশজাত। আজকে বাইরের কোনও লোক এসে আমাদের জ্ঞাতি-ভাইদের মারবে-ধরবে, আমাদের কুলবধূদের ধর্ষণা করবে—সে আমাদের বংশের অপমান। আমাদের বংশের গৌরব রক্ষা করার জন্যই অন্তত আজ আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে এবং তা এখনই—উত্তিষ্ঠধ্বং নরব্রাঘ্রাঃ সজ্জীভবত মা চিরম্।

যুধিষ্ঠিরকে এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে আমরা কখনও দেখিনি। শরণাগতকে রক্ষা করতে হবে অথবা বংশের গৌরব রক্ষা করতে হবে—শরণঞ্চ প্রপন্নানাং ত্রাণার্থঞ্চ কুলস্য চ—এই সাধারণ রাজধর্মের কথা তো যুধিষ্ঠির বলতেই পারেন এবং ক্ষত্রিয় হিসেবে ভীম-অর্জুনের মতো ব্যক্তির কাছে সে-কথা যথেষ্ট গ্রাহ্যও হবে, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের এই অতি সদ্‌ব্যবহারের সঙ্গে দুষ্টুমিও আছে কিছু। রাজসুয়যজ্ঞের সময় দুর্যোধনকে রাজাদের দেওয়া উপহার গোছানোর কাজ দিয়ে শান্তবুদ্ধি যুধিষ্ঠির যে মিষ্টি দুষ্টমিটুকু করেছিলেন, সেই দুষ্টুমি এখানেও আছে।

মনে রাখতে হবে—দুর্যোধন কুলবধু দ্রৌপদীকে রাজসভায় এনে অপমান করেছিলেন। আজ যুধিষ্ঠির কী মিষ্টি-মধুর বিনিময়ে সেই অপমানের শোধ তুললেন। যুধিষ্ঠির বারবার বলেছেন—দুর্বুদ্ধি দুর্যোধন আমাদের অপ্রিয়-সাধনের জন্য এখানে এসেছিল। দুর্যোধন বন্দি হয়েছে। ঠিকই হয়েছে। কিন্তু দুর্যোধন বন্দি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কুলস্ত্রীরা যে অন্যের হাতে বন্দি হল—তাতে আমাদের কুলের মর্যাদাটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াল—স্ত্রীণাং বাহ্যাভিমর্শাচ্চ হতং ভবতি নঃ কুলম্? জ্ঞাতি-ভাইদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হচ্ছে বলে বাইরের লোকের হাতে কুলস্ত্রীর মর্যাদা লঙ্ঘিত হবে—ভদ্রলোকেরা অন্তত এ জিনিস সহ্য করে না—ন মর্ষয়ন্তি তৎসন্তো বাহ্যেনাভিপ্ৰধর্ষণম্।

বস্তুত দুর্যোধন তো তাই করেছিলেন। কুলস্ত্রী দ্রৌপদীকে বাইরের লোকের সামনে রাজসভায় এনে দুর্যোধন যে অদ্ভুত ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছিলেন, আজকে ভদ্রলোকের মর্যাদা বুঝিয়ে দিয়ে যুধিষ্ঠির শান্তভাবে তার প্রত্যুত্তর দিলেন। দুর্যোধনের অমাত্যরা তা শুনে গেলেন। আরও একটা দুষ্টুমি আছে এর মধ্যে। যে ব্যক্তি অসহায় দীন পাণ্ডবদের সামনে ধনমানের সমৃদ্ধি প্রকট করতে এসেছিল, তাকে যদি বিপন্ন অবস্থায় রক্ষা করা যায় তবে উলটে নিজের সমৃদ্ধিটাই তাকে দেখানো যায় শান্তভাবে। দ্বৈতবনে আসবার আগে শকুনি দুর্যোধনকে বলেছিলেন—কী মজাই না হবে, যখন ঝলমলে পোশাকে আমরা গিয়ে বাকল-পরা অর্জুনকে দেখব—অভিবীক্ষেত সিদ্ধার্থো বল্কলাজিনবাসসম্। কিন্তু সেই বাকল-পরা অর্জুনই যখন বিপন্ন দুর্যোধনকে বাঁচিয়ে ফিরবেন, তখন সুদিনের আশায় যুধিষ্ঠির ভীমকে বলেন—দুর্যোধন বিপদে পড়ে যখন তোমার বাহুবলের ভরসায় বাঁচতে চাইছে—তার চেয়ে আনন্দের আর কী আছে—কিং চাপ্যধিকমেতস্মাৎ…জীবিতং পরিমার্গতে। দ্বৈতবনে আসবার আগে শকুনি বলেছিলেন-ধন-পুত্র-রাজ্য লাভ করেও সেই আনন্দ হয় না, যতটা হয় দুরবস্থায় পড়া শত্রুদের সামনে নিজের ঋদ্ধি প্রকট করার সময়। যুধিষ্ঠির শকুনি-দুর্যোধনের মতো বিকৃত আনন্দ পছন্দ করেন না। তিনি বললেন—একটা লোককে বরদান করলে যে আনন্দ হয়, রাজ্যলাভ অথবা পুত্রজন্মের জন্য যে আনন্দ হয়, শত্রুকে বিপদ থেকে উদ্ধার করার মধ্যে আনন্দের সেই মর্যাদা আছে জেনো।

এও এক ধরনের ফিরিয়ে দেওয়া। যুধিষ্ঠির এই মর্যাদায় প্রতিশোধ গ্রহণ করেন। সেদিন যুধিষ্ঠিরের কী বিপুল উৎসাহ। তিনি বলেছিলেন—ভীম তুমি যদি না যাও তো আমি নিজে যাব—এই আমার ব্রত, এই আমার যজ্ঞ—স্বয়মেব প্রধাবেয়ং যদি ন স্যাদ্ বৃকোদরঃ। যুধিষ্ঠিরকে নিজে যেতে হয়নি। যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য ভীম-অর্জুন খুশি হয়ে মেনে নিয়েছিলেন। গন্ধর্ব-চিত্রসেনের হাত থেকে তাঁরা মুক্ত করে এনেছেন দুর্যোধনকে। ভীম-অর্জুনের সঙ্গে এসেছিলেন গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন। সেদিন রাজার মতো লাগছিল যুধিষ্ঠিরের ব্যবহার। দুর্যোধনের সামনেই চিত্রসেনকে ধন্যবাদ দিয়ে তিনি বলেছিলেন—অনেক উপকার করলেন আমার। মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অসভ্য ছেলে এই দুর্যোধন—দুবৃত্তো ধার্তরাষ্ট্ৰো’য়ম্। তবু ভাল এই দুরাত্মাকে ছেড়ে দিয়ে আপনারা আমার কুলমর্যাদা রক্ষা করেছেন—কুলং ন পরিভূতং মে মোক্ষণে’স্য দুরাত্মনঃ। বেশ আপনারা আসুন, বড় ভাল লাগল—প্রীয়ামো দর্শনেন বঃ।

যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে বুঝিয়ে দিলেন কেমন করে কুলস্ত্রীর মর্যাদা রাখতে হয়। সেই সামান্য বনভূমির মধ্যে গন্ধর্বের কবলমুক্ত কৌরবস্ত্রীদের সামনে কুরুবাড়ির মন্ত্রীদের দ্বারা স্তুত হতে হতে যুধিষ্ঠির ঠাণ্ডা মাথায় দুটি কথা বললেন দুর্যোধনকে—এরকম সাহস আর কোরো না, বৎস। হঠাৎ করে যারা কাজ করে তাদের ভাল হয় না, দুর্যোধন। যাও, ভাইদের সঙ্গে মনের সুখে সবাই মিলে এবার বাড়ি ফিরে যাও। আমরা তোমাদের বাঁচিয়েছি, তাতে কোনও দুঃখ, বা লজ্জা পেয়ো না—গৃহান্ ব্রজ যথাকামং বৈমনস্যং চ মা কৃথাঃ।

লজ্জা দেবার জন্যই যেন এ-কথা বলা। আরও একবার ঠিক এই রকম ভাবেই যুধিষ্ঠির কথা বলেছিলেন। সেবার দুর্যোধনের ভগ্নীপতি ধৃতরাষ্ট্রের একমাত্র জামাই সিন্ধুপ্রদেশের রাজা জয়দ্রথ এসেছিলেন যুধিষ্ঠিরের অরণ্যকুটীরে। পাণ্ডবরা সেদিন কেউ বাড়ি ছিলেন না। মৃগয়ায় বেরিয়েছিলেন। দ্রৌপদী জয়দ্রথের সামান্য আতিথেয়তা করতেই তিনি তার প্রতিদান দিয়েছিলেন দ্রৌপদীকে জোর করে রথে টেনে তুলে।

জয়দ্রথ যা ভেবেছিলেন, তা অবশ্য হল না। দ্রৌপদী নিজেও বুঝি সে ব্যাপারে নিশ্চিন্তই ছিলেন। তাই প্রথম দিকে জয়দ্রথের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিরোধ সৃষ্টি করেও শেষ পর্যন্ত নিজেই জয়দ্রথের রথে উঠে পড়েছেন দ্রৌপদী। তিনি জানতেন যে, তাঁর পাঁচ স্বামীর কেউ না কেউ ঠিক খবর পাবেন এবং তাঁকে উদ্ধার করবেন। সত্যিই পাঁচ ভাই মৃগয়া সেরে ফেরার পথেই খবর পেয়ে গেলেন—জয়দ্রথ দ্রোপদীকে হরণ করেছেন। একসঙ্গে তাঁরা অনুসরণ করলেন জয়দ্রথের রথবর্ত্ম। জয়দ্রথ দেখতে পেলেন পাণ্ডবদের রথ আসছে। এঁদের কথা তিনি অনেক শুনেছেন বটে, তবে এঁদের শক্তি এবং মর্যাদা তেমন করে জানেন না জয়দ্রথ। তিনি দ্রৌপদীকেই প্রশ্ন করলেন—মনে হচ্ছে, এঁরাই তোমার স্বামীরা, তা এঁদের কার কোন বিষয়ে শ্রেষ্ঠতা একটু বল দেখি বুঝিয়ে।

দ্রৌপদী বলেছেন—নিশ্চয়ই বলব। মৃত্যু-পথযাত্রীর শেষ ইচ্ছা পূরণ করাটা আমার ধর্ম—আখ্যাতব্যং ত্বেব সর্বং মুমুর্ষোঃ। দ্রৌপদী প্রথমেই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথা বলেছেন। তাঁর সৌম্য সুন্দর চেহারার বর্ণনা দিয়ে দ্রোপদী জানিয়েছেন—ওই যে দেখছেন সোনার বরণ গায়ের রং, দীর্ঘ আয়ত দুটি চোখ, সবাই ওঁকে কুরুকুলের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি বলে বর্ণনা করে—এনং কুরুশ্রেষ্ঠতমং বদন্তি। ইনি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির। চেহারার বর্ণনা দিয়েই দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের ব্যক্তি-চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যটি উল্লেখ করছেন। আশ্চর্য হল—সেটা কোনও যুদ্ধবীর ধীরোদাত্ত বা ধীরোদ্ধত নায়কের চরিত্র-বৈশিষ্ট্য নয়। সে চরিত্র এমনই এক প্রশান্তি আর ক্ষমতার মায়া দিয়ে তৈরি যে, অন্য মানুষের কাছে তার প্রথম পরিচয়টাও তেমন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না।

দ্রৌপদী বললেন—শত্রুও যদি এই ধৰ্মচারী মনুষ্য-বীরের শরণাগত হয়, তবে ইনি তাঁর জীবন দান করেন। কথাটা বলেই দ্রৌপদী জয়দ্রথকে বাঁচবার পরামর্শ দিয়ে অন্তত যুধিষ্ঠিরের শরণ গ্রহণ করতে বললেন। বললেন—ওরে বোকা! এখনও যদি বাঁচতে চাস তো তাড়াতাড়ি গিয়ে ওই যুধিষ্ঠিরের পায়ের কাছে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত জোড় করে দাঁড়া—পরেহ্যেনং মূঢ় জবেন ভূতয়ে/ত্বমাত্মনঃ প্রাঞ্জলি র্ন্যস্তশস্ত্রঃ। নিজের অভিজ্ঞতায় দ্রৌপদী এ-কথাটা যথেষ্টই জানেন যে, জয়দ্রথ যদি তাঁর অন্য স্বামীদের, বিশেষ করে তাঁর দ্বিতীয়-স্বামী ভীমের হাতে পড়েন, তবে তিনি বেঁচে ফিরবেন না এবং কোনও অজুহাতও তাঁর কাছে খাটবে না। কিন্তু হাজারো অন্যায় করেও যদি যুধিষ্ঠিরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে দাঁড়ানো যায়, তবে সেই আপাতদৃষ্ট অনুতাপ-গ্রস্ত পাপিষ্ঠকে প্রায় খ্রিস্টীয় করুণায় ক্ষমা করে দেবেন যুধিষ্ঠির।

কিন্তু জয়দ্রথ দ্রৌপদীর কথা মোটেই শোনে নি। তিনি তাঁর মহান সৈন্যবাহিনীকে যুদ্ধের আদেশ দিয়েছিলেন। অল্পক্ষণের মধ্যেই অবশ্য ভীমার্জুনের সম্মিলিত আক্রমণে তাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল এবং জয়দ্রথ রণে-ভঙ্গ দিয়ে পলায়নে মন দিয়েছিলেন দ্রৌপদীকে ছেড়ে—পলায়নমনাভবৎ। কিন্তু পালাতে চাইলেই বা তিনি পালাবেন কোথায়? ভীম যুধিষ্ঠিরকে বলেই দিলেন—আপনি দ্রৌপদীকে নিয়ে কুটীরের অভিমুখে যাত্রা করুন, জয়দ্রথ আমার হাত থেকে বেঁচে ফিরবে না—ন হি স মোক্ষ্যতে জীবন্ মূঢ়ঃ সৈন্ধবকো নৃপঃ।

যুধিষ্ঠির মধ্যম-পাণ্ডবের এই ক্রোধমূর্তি চেনেন এবং তাঁর কথা যে শেষ পর্যন্ত কাজে পরিণত হবে, তাও তিনি ততক্ষণে বুঝে গেছেন। এক লহমার মধ্যে তাঁর সুদূরদর্শী চক্ষুতে দুটি করুণ নারীমুখ উদয় হল। তিনি মানসচক্ষে দেখতে পেলেন—জয়দ্রথ ভীমের হাতে মারা গেছেন এবং তাঁর মৃত শরীরের উপরে আছড়ে পড়েছেন একটি বিধবা রমণী, যিনি সম্পর্কে তাঁর জ্যাঠতুতো বোন দুঃশলা। আর এক রমণী বৃদ্ধা মাতৃসমা, যাঁর বন্ধনেত্র থেকে জলধারা নিঃসৃত হচ্ছে। তিনি হস্তিনাপুরবাসিনী গান্ধারী। জামাতার অন্যায় জেনে তাঁকে তিনি সমর্থনও করতে পারবেন না, অথচ বিধবা কন্যার জন্য পটবদ্ধ-চক্ষু থেকে তাঁর অবিরাম জলধারা নির্গত হবে।

আগেই বলেছিলাম—যুধিষ্ঠির সব দেখতে পান। অতি বিপন্ন এবং চরম মুহুর্তেও সবার কথা তাঁর মনে থাকে। অতএব যে মুহূর্তে ভীম বললেন—ব্যাটা বাঁচবে না আমার হাত থেকে—সেই মুহুর্তেই তিনি সকরুণ আর্তনাদে বলে উঠলেন—যত অসভ্যতাই করুক ওকে একেবারে মেরে ফেলো না ভীম। দুঃশলা ভগিনীর কথা মনে রেখো। মনে রেখো জননী গান্ধারীর কথা—দুঃশলামভিসংস্মৃত্য গান্ধারীঞ্চ যশস্বিনীম্। আপনারাই একবার ভাবুন—যার স্ত্রীকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল এক অশিষ্ট লম্পট, তাকে শাস্তি দেবার চরম মুহূর্তে কি শত্ৰুপুরবাসিনী দুটি নিরীহ অসহায় নারীর কথা একবারও মনে আসবে আমাদের?

স্বয়ং দ্রৌপদীও তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামীর এই ভালমানুষি সহ্য করতে পারেননি। ভীমকে তিনি বলে দিয়েছিলেন—যদি আমার প্রিয়ত্বের কথা ভাব, তবে জয়দ্রথকে হত্যাই করবে। ভীম জয়দ্রথকে ধরে ফেলেছিলেন এবং যেভাবে তিনি তাঁকে মারতে আরম্ভ করেছিলেন, তাতে তাঁর মৃত্যু অবধারিত ছিল। সেই অবস্থায় এই হত্যাকাণ্ড থেকে তাঁকে বিরত রেখেছিলেন অর্জুন, যিনি যুধিষ্ঠিরের ভ্রাতা এবং শিষ্য বলে পরিচিত। জয়দ্রথকে যখন যুধিষ্ঠিরের কাছে ধরে আনা হল তখন ভীম তাঁর সমুচিত প্রতিক্রিয়ায় দ্বিধা বিভক্ত ছিলেন। ভীম পূর্বাহ্নেই জয়দ্রথের মাথার চুল খানিকটা খানিকটা কামিয়ে দিয়েছিলেন। ক্ষত্রিয় বীরের কাছে এই অপমান ছিল মৃত্যুর মতোই। যুধিষ্ঠির জয়দ্রথের এই অবস্থা দেখে করুণ হাস্যে ভীমকে বলেছিলেন—অনেক হয়েছে। এবার ছেড়ে দাও ভাই—তং রাজা প্ৰাহসদ্ দৃষ্ট্বা মুচ্যতামিতি চাব্রবীৎ।

ভীম কিন্তু যুধিষ্ঠিরের কথা শোনেননি, উলটে তাঁকে বলেছেন—আপনি দ্রৌপদীকে জিজ্ঞাসা করুন—অর্থাৎ সোজা কথায়, দ্রৌপদীর অনুমতি নিতে হবে এই বাবদে, শুধু যুধিষ্ঠিরের কথায় হচ্ছে না। জয়দ্রথের কামানো মাথাটি তাঁর নিজের কাছে যতটা অপমানকর ছিল, সবার সামনে ভীমের এই অতিক্রমও যুধিষ্ঠিরের কাছে অপমানকর ছিল সমান। তাঁর মতো মর্যাদার মানুষের নির্দেশ অনুজ ভাইরা শুনছে না, অথবা সবার সামনে তাঁকে স্ত্রীর নির্দেশ মেনে নিতে বলছে—এই অপমানও যুধিষ্ঠিরের কাছে খুব কম কষ্টকর নয়। কিন্তু কষ্টকর হলেও যুধিষ্ঠির প্রতিবাদ-প্রতিরোধে সব লণ্ডভণ্ড করে দেবেন—এমন ব্যক্তিত্ব তিনি নন। তাঁর ব্যক্তিত্ব এমনই যে, ওই অপমানকর কথা শুনেও তিনি আবারও তাঁর পূর্ব বক্তব্যই উচ্চারণ করবেন এবং সেটা আরও মধুর করে। কিন্তু সেই মধুর উচ্চারণের মধ্যেই এমন দু-একটি শব্দ থাকবে, এমন দৃঢ় উন্নত এক মর্যাদা থাকবে যাকে অতিক্রম করা ভীষণই কঠিন হবে।

ভীম যেমন বলেছিলেন তাতে মনে হবার কথা যেন দ্রৌপদীই এখানে শেষ কথা বলবেন। যুধিষ্ঠির ভীমের ওই কথা শুনেও কিন্তু দ্রৌপদীকে কোনও কথা জিজ্ঞাসা করলেন না। জিজ্ঞাসা করলে দ্রৌপদীর দিক থেকে এমন অনেক কথা আসতে পারত, যা তাঁর কাছে রুচিকর হত না। অথচ দ্রৌপদীই যেহেতু এখানে প্রধান বিপন্নতার শিকার, তাই দ্রৌপদীর দিকে না তাকিয়েও ভীমকে বলে তিনি যেন দ্রৌপদীকেই অনুরোধ করলেন। যুধিষ্ঠির বললেন—আমাদের মতো মানুষের কথা যদি প্রমাণ বলে মনে কর তবে এই পুরুষাধমকে ছেড়ে দাও—মুঞ্চেমমধমাচারং প্রমাণা যদি তে বয়ম্।

দ্রৌপদী এতক্ষণ ধরে যুধিষ্ঠিরের বিরুদ্ধ-স্থিতিতে দাঁড়িয়ে জয়দ্রথকে হত্যা করার কথা বলেছেন এবং ভীমকেও তিনি সেইমতো প্রস্তুত করে ফেলেছেন। কিন্তু এই যে নিস্তরঙ্গ ব্যক্তিত্ব, ক্রোধ, লোভ, মাৎসর্যের ওপরে উঠে যুধিষ্ঠির যখন আপন মত প্রকাশ করেন, তখন তাঁর সামনে একবার-দুবার প্রতিবাদ করা যেতে পারে বটে, কিন্তু ওই সর্বহিতৈষিণী দৃঢ়-বাক্যের বিরুদ্ধে বেশিক্ষণ নিজের মত টিকিয়ে রাখা যায় না। দ্রৌপদীকে তখন পূর্বের বলা কথা গিলে নিয়ে বলতে হয়—ঠিক আছে, ছেড়েই দাও, ভীম! ওর মাথাটা তো কামিয়েই দিয়েছ, ওতেই যথেষ্ট অপমান হয়েছে। আর ও তো আমাদের দাসত্বও স্বীকার করেছে।

দ্রৌপদীর কথায় ভীম জয়দ্রথকে ছেড়ে দিলেন। জয়দ্রথ যুধিষ্ঠিরকে কৃতজ্ঞতার অভিবাদন জানালে, যুধিষ্ঠির বললেন—যাও, তোমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিলাম। কোনও দিন যেন এমন পাপ আর করতে যেয়ো না। একজন ক্ষত্রিয় রাজপুত্র হওয়ার দরুন যুধিষ্ঠির জানেন যে, জয়দ্রথের কতটা অপমান হয়েছে। ভীম কিংবা দ্রৌপদী সেটা বুঝতে পারেন না। পারা সম্ভবও নয়। কারণ দ্রৌপদীর সঙ্গে জয়দ্রথ যে ব্যবহার করেছেন, তার প্রতিরোধ-বৃত্তিতে ভাবনা করলে জয়দ্রথের মুক্তি অসম্ভব ছিল। কিন্তু ওই মুহূর্তে জয়দ্রথের মনে কী হচ্ছে, সেটা তেমন মানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব, যিনি শত্রুরও সহমর্মিতায় দায়বদ্ধ। জয়দ্রথকে মুক্তি দেবার সময় যুধিষ্ঠির তাঁকে বলে দিলেন—তোমার বুদ্ধি ধর্মে স্থিত হোক, কখনও অধর্মে মন দিয়ো না—ধর্মে তে বর্ধতাং বুদ্ধিমা চাধর্মে মনঃ কৃথাঃ।

জয়দ্রথের মন মোটেই ধর্মে স্থিত হয়নি, বরঞ্চ স্থিত হয়েছে প্রতিহিংসায়। কারণ তিনি যুধিষ্ঠির নন। জয়দ্রথ মুক্তি পেলেন যুধিষ্ঠিরের করুণায়। আমরা আগেও বলেছি, এখনও বলছি—একই অবস্থায় সকলে যা করে, যুধিষ্ঠির তা করেন না। দুর্যোধন বনের মধ্যে এসে যে উৎপাত করেছেন, জয়দ্রথ যেভাবে পাণ্ডবদের প্রিয়া পত্নীকে হরণ করেছেন, তাতে অন্য কেউ হলে, এবং সত্যিই যদি তাঁর বল-বীর্য হত ভীম কিংবা অর্জুনের মতো, তাহলে দুর্যোধন এবং জয়দ্রথ কেউই প্রাণ নিয়ে ফিরতেন না। কিন্তু এই ক্রুদ্ধ-বিপন্ন মুহূর্তেও কুলবধূদের মর্যাদার কথা ভাবা, কিম্বা জয়দ্রথকে হত্যার অঙ্গীকার প্রায় সমুচিত জেনেও একমাত্র যুধিষ্ঠিরই সেখানে দুঃশলা ভগিনী কিংবা জননী গান্ধারীর হৃদয় মনে রাখতে পারেন।

বিচিত্র এই যৌধিষ্ঠিরী নীতির সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ লুকিয়ে আছে বনপর্বের শেষে, যখন ধর্মরূপী যক্ষ সেই বিষ-সরোবরের ধারে আসা প্রত্যেক পাণ্ডব-ভাইকে জলস্পর্শের কারণে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। ধর্মরূপী যক্ষের বায়না ছিল—তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবে জলস্পর্শ করতে হবে। যুধিষ্ঠির হঠকারিতা করেননি ; হঠকারিতা করা তাঁর অভ্যাসই নয়। তিনি যথাসাধ্য উত্তর দিতে প্রবৃত্ত হয়েছেন। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যক্ষের প্রশ্নোত্তর-পর্ব মোটেই গতানুগতিক ধারায় প্রবাহিত হয়নি। যক্ষের প্রশ্নগুলি শুনলে মনে হবে—এ তো একেবারেই সহজ কথা। সামান্য পড়াশুনো থাকলেই যক্ষের প্রত্যেকটি প্রশ্নেরই যেন উত্তর দেওয়া যায়। কিন্তু ধর্মরূপী যক্ষ এমনই এক মাষ্টারমশাই যিনি প্রশ্ন করেন সহজ, কিন্তু, উত্তরটা চান একেবারেই অসাধারণ। এমনই সে উত্তর, যা শত শাস্ত্রের নোটবই মুখস্থ করে দেওয়া যাবে না। নিজের জীবন মন্থন করে, শাস্ত্র-সিন্ধু মন্থন করে হাজারো মুনি-ঋষির উপদেশ মন্থন করে যে সারটুকু উঠবে, সেই সার থেকেই শুধু ধর্ম-যক্ষের প্রশ্ন সমাধান করা যায়।

যুধিষ্ঠির বনে নির্বাসিত হয়েও প্রতিহিংসার জ্বালায় জ্বলে মরছেন না। তিনি যেখানেই থাকেন, সেখানেই ক্ষত্রিয়ের জ্যাঘোষের সঙ্গে ব্ৰহ্মঘোষ মিলিত হয়। অধ্যায়ের পর অধ্যায় জুড়ে যুধিষ্ঠির মুনি-ঋষিদের কাছ থেকে নানা উপদেশ শুনে গেছেন। বিভিন্ন অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তীর্থের পর তীর্থ ঘুরে বেড়িয়েছেন। বারো বচ্ছর বনবাসের পর যুধিষ্ঠির এখন আরও শান্ত, আরও দান্ত আরও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এর ফলে অতি সাধারণ কথাও তাঁর কাছে গভীর অন্বীক্ষার বিষয়। যুধিষ্ঠির যদি সেই সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেন, তা হলে বোঝা যাবে কোনও প্রশ্নই সাধারণ নয়। জয়দ্রথকে হত্যার প্রশ্নে যখন তাঁর মনে দুঃশলা-গান্ধারীর চকিত আবির্ভাব ঘটে, এই প্রশ্নোত্তরপর্বেও দেখব—যা আমরা কখনও ভাবিনি, অথচ ভাবা উচিত ছিল, সত্যিই ভাবা উচিত ছিল, যুধিষ্ঠির সেই সত্যটা উচ্চারণ করেন। সেই সত্যটা এমন সাংঘাতিক, এমন নির্মম যে, আমাদের ভাবতে ভয় করে বা অস্বস্তি লাগে বলেই যেন আমরা ভাবি না। অথচ যুধিষ্ঠিরের সারা জীবনের নীতিবোধ, জীবনবোধ এবং সার্বিক ভাবনা আমাদের সেই ভয় এবং অস্বস্তির দিকেই অঙ্গুলি-সংকেত করে বুঝিয়ে দেবে—তুমি ঠিক ভাবনি, তোমার ভাবনায় গলতি আছে। তুমি সবার কথা ভাবনি, শুধু নিজের কথা ভেবেছ। আর এটা বোঝার পরেই যুধিষ্ঠিরের ওপর আপনার রাগ হবে, ক্ষোভ হবে, লোকটাকে নীতিবাগীশ বলে গালাগালি দিতে থাকবেন, কিন্তু সবার শেষে ওই দ্রৌপদী, ওই ভীমের মতো তাঁর সর্বময় সর্বহিতকর-ব্যক্তিত্ব মেনে নিতে বাধ্য হবেন।

যক্ষ যখন জিজ্ঞাসা করবেন—আচ্ছা! জ্ঞান কাকে বলে অথবা দয়া জিনিসটাই বা কী, তখন আমি-আপনি বলব—আরে ভাল করে পড়াশুনো করলেই জ্ঞানলাভ হয়। আর দয়া? গরিব মানুষকে একটু-আধটু সাহায্য করলেই সেটা দয়া। যুধিষ্ঠির গম্ভীর হয়ে বলবেন—জ্ঞানং তত্ত্বার্থসম্বোধঃ—জ্ঞান হল যেটা যা, তার স্বরূপটি ঠিকঠাক বোঝা। এই জ্ঞানের পরিণতি আত্মচৈতন্যের উপলব্ধিতে। আর দয়া? দয়া সর্বসুখৈষিত্বম্, অর্থাৎ দয়া হল সবার সুখের জন্য চেষ্টা করা। গরিবকে দুটো পয়সা দিয়ে ভালমানুষি করলাম আর বড়লোককে ঝাঁটা-পেটা করলাম—এটা দয়া নয়। দয়া মানে সকলের সুখচেষ্টা, বিশ্বজনহিতায়।

এই সামান্য কথা শুনলেই বোঝা যায়—যুধিষ্ঠিরের ভাবনাগুলি এক অন্যতর খাতে বইছে, এ সব ভাবনা আমার-আপনার মতো নয়। আমরা যদি যক্ষের প্রশ্ন শুনতাম—আচ্ছা স্থৈর্য, ধৈর্য এ সব কী? স্নান করা বা দান করা—এ সবই বা কাকে বলে। আমরা উত্তরে বলতাম—স্থিরতাই স্থৈর্য কোনও ঘটনায় আকুল-ব্যাকুল না হওয়াই তো স্থৈর্য, আর ধীরতা বা ধৈর্যও ওই একইরকম জিনিস—ধীর থাকা। যুধিষ্ঠির বলবেন—নিজের ধর্মে ঠিক থাকাটাই হল ধৈর্য—স্বধর্মে স্থিরতা ধৈর্যম। আপনারা বলবেন—এও কি কোনও ধর্ম হল? ধর্ম বলতে চাল-কলা-নৈবেদ্য বলুন ঠিক আছে ; এমনকী স্বধর্ম বলতে ব্রাহ্মণের যজন-যাজন-অধ্যয়ন, ক্ষত্রিয়ের রাজ্যশাসন-প্রজাপালন ইত্যাদি বলুন, তাও বুঝি। কিন্তু যে কোনও মানুষের স্বধর্মে স্থিরতা—এ তত যেন কেমন কঠিন কথা। সহজ প্রশ্নের কঠিন উত্তর। ভেবে দেখুন—যিনি যে কাজটি করেন, দিনের পর দিন সে কাজের একঘেঁয়েমি তাঁকে পেয়ে বসে। এই অবস্থায় যদি প্রত্যেকেই নিজের নিজের কাজটি করতে চায় এবং তা সুষ্ঠু ভাবেই করতে চায়, তবে তার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্থিরতা। যে ছাত্র, তার স্বধর্ম পাঠাভ্যাস ঠিক রাখতে গেলে যে স্থিরতা দরকার, ঠিক সেই স্থিরতাই দরকার একজন করণিকেরও, একজন চিকিৎসকেরও, একজন শিক্ষকেরও।

তা হলে দেখা গেল, আমাদের স্থৈর্যের চিন্তা-ভাবনা একরকম, যুধিষ্ঠিরের স্থৈর্য-চিন্তা আরেক রকম। একইভাবে যুধিষ্ঠিরের ভাবনায় ‘ধৈর্য’ শুধুমাত্র মানসিক ধীরতা নয়, ধীরতা হল ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ। ইন্দ্রিয়-নিগ্রহ এমনই এক গভীর তত্ত্ব, যা অভ্যস্ত হলে কাম-ক্রোধ-লোভ আপনিই প্রশমিত হবে। যুধিষ্ঠির এই মূলটাকে ধরেন, একেবারে মূল, যেখান থেকে সমস্যাটা আরম্ভ হয়। এই মৌলিক ভাবনায় ‘স্নান’ ব্যাপারটা জলস্থান নয় মোটেই। স্নান হল মনের ময়লা দূর করা, আর দান মোটেই করুণার দান নয়। মুদ্রা দুই-চারি দানের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের দান-মাহাত্ম্য নিহিত নয়, তাঁর দান মানেই গভীর এক অর্থবোধ। দানং বৈ ভূতরক্ষণম্—দান সমস্ত প্রাণীকে রক্ষা করে।

এমনতর ছোট-বড় নানান প্রশ্নোত্তরেই যুধিষ্ঠিরের অনন্যতা বোঝা গিয়েছিল। এই অনন্যতা চরমে উঠল যক্ষের চারটিমাত্র প্রশ্নে। যক্ষ বললেন—কে সবচেয়ে আনন্দে আছে? যুধিষ্ঠির বললেন—যে মানুষ নিজের দেশে থাকতে পারে, সেই মানুষ যদি ধার-কর্জ না করে দিনের শেষে নিজের ঘরে চারটি শাক-ভাত খেতে পারে, তবে তার চেয়ে আনন্দে আর কেউ নেই।

আমার প্রথম বয়সে ভেবেছি—এ আবার কীরকম আনন্দ? শাক-ভাত খেয়ে কি কেউ আনন্দে থাকতে পারে? এখন এই বয়সে এসে বুঝি—শাকান্নেই পরম আনন্দ, যদি না তার মধ্যে দরিদ্রতার অতৃপ্তিটুকু না থাকে। এখানে যক্ষ-প্রশ্নে না থাকলেও অন্য এক মহাপুরাণে এই প্রশ্ন শুনেছি—দরিদ্র কাকে বলে? উত্তরটা এসেছে যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকেই। আসল দরিদ্র হল সেই, যে সব সময় অসন্তুষ্ট। সন্তুষ্টি, আত্মতৃপ্তিই হল ধন-সম্পত্তির প্রধান লক্ষণ। এই নিরিখে দেখতে গেলে দিনান্তে শাকান্ন-ভোজী এক দরিদ্র ব্যক্তিও শুধুমাত্র তাঁর সন্তুষ্টির গুণে পরম ধনী হয়ে উঠতে পারেন এবং গৃহস্থের ঘর-সংসার সামলেও পরম আনন্দে থাকতে পারেন।

অথচ দেখুন, আমরা এমন করে কখনও ভাবিনি। অথবা ভাবুন সেই পরম আশ্চর্য বস্তুটির কথা—তাও কি আমরা সেইভাবে ভেবেছি। আমাদের নিয়ত পরিবর্তনশীল জগতে নিয়ত নতুন আবিষ্কারেই আমরা শুধু আশ্চর্য হই, চমৎকৃত হই। কিন্তু কখনও কি ভেবেছি যে, দিনের পর দিন কত মানুষ মারা যাচ্ছে, আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে কত শত কালপক্ক শরীর। অথচ আমরা ভাবছি—আমরা থাকব, আমাদের গতায়ু হতে বিলম্ব আছে। সত্যিই তো, এর থেকে আশ্চর্য আর কিছু নেই।

এ ছাড়া যক্ষের সেই প্রশ্নটাও তো সাংঘাতিক—পথ কাকে বলে? কত সহজ সরল প্রশ্ন! অথচ বেদ-বেদান্ত-উপনিষদের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে, ছ-ছ’টা আস্তিক দর্শনের তর্ক-যুক্তির সম্পূর্ণ মাহাত্ম্য হৃদয়ঙ্গম করেও যুধিষ্ঠির সেই যুগে বলতে পেরেছেন—দেখ বাপু! দার্শনিক তত্ত্বানুসন্ধানের ব্যাপারে তর্ক-যুক্তি কখনও শেষ কথা বলতে পারে না; শ্রুতি-স্মৃতির বিভিন্ন প্রস্থান, ঋষি-মুনিদের ভিন্ন ভিন্ন মত, একজনের সঙ্গে আরেক জনের কোনও মিল নেই—এই অবস্থায় কাউকে শেষ প্রমাণ বলে মানা যায় না—তর্কো’প্রতিষ্ঠঃ শ্রুতয়ো বিভিন্না/নৈকো ঋষি-র্যস্য মতং ন ভিন্নম্। যুধিষ্ঠির বললেন—ধর্মের সত্য-তত্ত্ব কোন গুহায় নিহিত আছে জানি না। ধর্মশাস্ত্রের শাসন আর অনুশাসনের সহস্র পথ বাদ দিয়ে তাই সেই পথেই যাওয়া ভাল, যে পথে বহু মানুষ গেছে। পথ সেইটাই।

আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে এই ভারতবর্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে শাস্ত্র নয়, মুনি-ঋষির অনুশাসন নয়, বহুজনের পদ-প্রশস্ত পথই পথ—এ কথা বলা অত সহজ ছিল না। কিন্তু যুধিষ্ঠিরই শুধু এমন কথা বলতে পারেন, কেননা তিনি অন্য মানুষের মতো কথা বলেন না। আরও একবার সেই বিলক্ষণ স্বভাব ফুটে উঠবে যক্ষ-যুধিষ্ঠির-সংলাপের শেষকল্পে। ধর্মরূপী যক্ষ পুত্র যুধিষ্ঠিরের সমস্ত উত্তর শুনে পরম প্রীত হয়ে বললেন—তোমার ভাইদের মধ্যে একজনের অন্তত প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারি আমি। তুমি কাকে বাঁচিয়ে তুলতে চাও বল– তস্মাত্ ত্বমেকং ভ্রাতৃণাং যমিচ্ছসি স জীবতু।

চতুম্পাণ্ডবের একতমকে তা হলে বাঁচিয়ে তোলা যাবে। যুধিষ্ঠির মাদ্রীপুত্র নকুলের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। ভীম নয়, অর্জুন নয়, নকুল। ধর্মরূপী যক্ষ ঠিক আমাদের মতোই অবাক হলেন। বললেন—কেন ভীম তো তোমার অত্যন্ত প্রিয় ভাই। আর অর্জুন? সেই তো তোমাদের ভবিষ্যতের একমাত্র আশা-ভরসা। তাঁদের ছেড়ে তুমি তোমার মায়ের সতীন-পো নকুলকে বাঁচাতে চাইছ কেন—সাপত্নং জীবমিচ্ছসি? তুমি একবারও একটু ভেবে দেখলে না? যাঁর গায়ে হাজার হাতির বল, ভবিষ্যতে যাঁকে তোমার কাজে লাগবে, তাঁকে বাদ দিয়ে তুমি কিনা নকুলকে বাঁচাতে চাইছ? যে বাহুবলের জন্য অর্জুনকে তোমরা সব সময় মাথায় তুলে রাখ, সেই অর্জুনকে বাদ দিয়ে তুমি কিনা নকুলকে বাঁচাতে চাইছ? এ কেমন বুদ্ধি?

যুধিষ্ঠির তাঁর বিলক্ষণ-উত্তর দিলেন আবার। বললেন—ধর্ম। বুদ্ধি নয়, ধর্ম। ধর্ম যদি একবার বিপর্যস্ত হয়, তবে সেই ধর্মই মানুষকে হত্যা করে। আর ধর্মকে যদি সদা-সর্বদা রক্ষা করে চলা যায়, তবে সেই মানুষকে রক্ষা করে—ধর্ম এব হতো হন্তি ধমো রক্ষতি রক্ষিতঃ। আমি কোনও পরমার্থ চাই না, যক্ষ! আমি চাই সর্বত্র আমার অনৃশংসতা বজায় থাকুক, সেই আমার ধর্ম। আমার পিতার ধর্মপত্নী দু’জন। কুন্তী এবং মাদ্রী। তাঁদের দুজনেই অন্তত পুত্রবতী থাকুন, এই আমার অভিলাষ—ইতি মে ধীয়তে মতিঃ। আমার দুই জননী কুন্তী এবং মাদ্রীর মধ্যে আমি কোনও পার্থক্য করি না। নকুল যদি বেঁচে ওঠে, তবে আমার দুই মায়ের মধ্যে সেই সমতা আসে, যে সমতা আমি চাই—মাতৃভ্যাং সমমিচ্ছামি নকুলো যক্ষ জীবতু। কুন্তীর জ্যেষ্ঠপুত্র আমি বেঁচে আছি, আর আমার দ্বিতীয়া-জননী মাদ্রীর জ্যেষ্ঠপুত্র নকুল বেঁচে উঠুক। তাতে আমার দুই জননী সমান জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবেন।

এ হল সেই সহৃদয়তা যাতে এই বিপন্ন সময়েও তাঁর মৃতা জননীটি কথা মনে আছে। তুলনায় অন্য পাণ্ডবভাইদের চেয়ে দুর্বল বলে, ভবিষ্যতে কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধে নকুল ভীম-অর্জুনের মতো কার্যকরী হবেন না বলে নকুলের জীবনের কোনও মূল্য নেই—এই নৃশংসতা যুধিষ্ঠিরকে মানায় না। সমস্ত পরমার্থের চেয়েও আজকে সেই প্রেতা জননীর আকাশ-দৃষ্টি তাঁর কাছে বড় হয়ে উঠেছে। স্বর্গস্থা হয়েও সেই জননী যাতে না বলতে পারেন—তোমার মায়ের পেটের ভাইই তোমার কাছে বড় হল, বাছা। আমি কি তোমার পিতৃকূলের ধর্মপত্নী নই যে আমার সব পুত্রগুলিকেই মরণের পথে ঠেলে দিলে? যুধিষ্ঠির কী করে এই পূর্বমৃতা জননীর দুঃখ সইবেন?

আমরা জানি—ওই অসাধারণী সর্বকল্যাণময়ী যুক্তির পরে শুধু নকুল কেন, সমস্ত পাণ্ডবভাইরা এবং দ্ৰৌপদীও বেঁচে উঠেছেন ধর্মের করুণায়। ধর্ম যুধিষ্ঠিরকে পরীক্ষা করতে এসেছিলেন, যুধিষ্ঠিরকে, নিজের পুত্রকে। তিনি দেখে গেলেন যে, কপট পাশায় বিতাড়িত হয়ে বারো বছর বনবাস যাপন করার পরেও ক্রোধ, লোভ অথবা কোনও স্বার্থপরতা যুধিষ্ঠিরকে এতটুকু অস্থির করেনি। তিনি স্থিত হয়ে আছেন চিরন্তন এবং শাশ্বত ধর্মের অনুশাসনে। মানবিকতার সমস্ত সাধারণ গুণ নিয়েই তিনি অসাধারণ। স্বয়ং ধর্মের দ্বারা পরীক্ষিত যুধিষ্ঠির ধর্মের পরীক্ষায় যেমন উত্তীর্ণ হলেন, তেমনই উত্তীর্ণ হলেন বারো বছরের বনবাসের পরীক্ষায়। তাঁর এবং তাঁর ভাইদের বনবাস-পর্ব শেষ হল। এবার এক বছরের অজ্ঞাতবাস।