দ্রৌপদী – ৬

কথাটা আমি আগেও একবার উল্লেখ করেছি, তবে তা অন্য প্রসঙ্গে, অন্যভাবে। উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদের দূত হয়ে কৌরবসভায় যাচ্ছেন, তখন তো যুধিষ্ঠির—ভীম—দুজনেই সন্ধিকামী হয়ে উঠলেন। অর্জুন সন্ধির কথা বলেওছেন, আবার বলেনওনি। সহদেব সন্ধির বিরুদ্ধে ছিলেন, এবং প্রধানত তাঁর কথাকে প্রাধান্য দিয়েই দ্রৌপদী প্রথমে রাজনীতির কথা তুললেন। দ্রৌপদীর যে রাজনীতি ভাল বুঝতেন অথবা এ বিষয়ে যে তাঁর যথেষ্ট পড়াশুনো ছিল—সে কথা সেই কৌরবসভায় অপমানের পর থেকে একেবারে যুধিষ্ঠিরের রাজ্যলাভ পর্যন্ত শত শতবার প্রকাশিত হয়েছে। পাণ্ডব-কৌরবদের আভ্যন্তরীণ রাজনীতি যেভাবে, যে পথে চলছিল—সেখানে যুধিষ্ঠিরী নীতি তাঁর পছন্দ হয়নি। এই স্থিরবুদ্ধি মনস্বীর ‘ধীরে চল’ নীতি, অথবা শত্রুর বিরুদ্ধে নিজের উত্থান-শক্তি বিলম্বিত করাটা দ্রৌপদীর রাজনীতি-বোধে আঘাত করেছে। এর প্রমাণ দ্রৌপদী আর যুধিষ্ঠিরের বহুতর কথোপকথনে বারংবার ফুটে উঠেছে। দুর্যোধনের বিরুদ্ধে সঠিক কী নীতি গ্রহণ করা উচিত ছিল বা এখনও উচিত—তা নিয়ে এই দুই জনের মধ্যে রাজনৈতিক মত-পার্থক্য উদ্যোগ-পর্বের এই মুহূর্ত পর্যন্তও দূর হয়নি।

হ্যাঁযা, স্বামী বলে দ্রৌপদী এইটুকু মেনে নিতে রাজি আছেন যে, ঠিক আছে, যুধিষ্ঠির তো ইন্দুপ্রস্থের পরিবর্তে পাঁচখানি গ্রাম ফিরে পাবার প্রস্তাব দিয়েছেন দুর্যোধনকে ; সে অন্তত তাই দিক। কিন্তু গোটা রাজ্যের বদলে এই যে যুধিষ্ঠির কঠিন কিছু করতে পারেন না বলে লজ্জা-লজ্জা মুখ করে সন্ধির কথা বলছেন—দ্রৌপদীর সাফ কথা—পঞ্চ গ্রামের শর্তে যদি দুর্যোধন রাজি না হন, তবে যেন কৃষ্ণ আগ বাড়িয়ে সন্ধির কথা না বলেন। অর্থাৎ দ্রৌপদীর মতে—তোমরাই অন্যায়ভাবে আমাদের রাজ্য কেড়ে নিয়েছ, অথচ এখন সন্ধির কথা তোমাদের দিক থেকেও উঠছে। কিন্তু সন্ধি যদি আদৌ করতে হয়, ‘অ্যাজ আ টোকেন অব গুড জেসচার’ তোমাকে নমনীয়তার প্রমাণ হিসেবে পাঁচটি গ্রাম আগে দিয়ে দিতে হবে, তারপর সন্ধির কথা। দ্রৌপদী কৃষ্ণকে সাবধান করে দিয়ে বলেছেন—যদি রাজ্য না দিয়ে দুর্যোধন সন্ধি করতে চায়, তবে তুমি যেন সেখানে গিয়ে সন্ধি করে এস না—অপ্রদানেন রাজস্য যদি কৃষ্ণ সুযোধনঃ। সন্ধিমিচ্ছেন্ন কর্ত্তব্যস্তত্র গত্বা কথঞ্চন।

এইবার দ্রৌপদী রাজনীতির তত্ত্ব এবং প্রয়োগের কথায় আসছেন, যে-কথায় এতকাল মহামতি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তাঁর বারবার মতবিরোধ ঘটেছে, এবং যে কথার মীমাংসা এখনও হয়নি। দ্রৌপদী বললেন—ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা যদি ক্রুদ্ধ হয়েও আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে—কারণ, ক্রুদ্ধ হলে শক্তির বৃদ্ধি ঘটে-তবুও সেই শক্তি প্রতিরোধ করার ক্ষমতা পাণ্ডব, এবং পাঞ্চালদের আছে। এতকালের অভিজ্ঞতায় কৃষ্ণকে সম্পূর্ণ সচেতন করে দিয়ে দ্রৌপদী বলেন—তুমি যেন এটা মনে কোরো না, কৃষ্ণ! যে, ভাল ভাল কথা আর নীতির উপদেশ দিয়ে তাকে কিছু করা যাবে ; এমনকী তাদের কিছু ছেড়ে দিয়েও যে লাভ হবে, তাও আমার মনে হয় না—অর্থাৎ ওই ইন্দ্রপ্রস্থ বা রাজ্যের অধাংশের দাবি না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু মাত্র পাঁচখানি গ্রাম নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেও আর সব দাবী যদি আমরা ছেড়ে দিই, তাতেও যে কিছু করা যাবে—তা মনে হয় না—ন হি সাম্না ন দানেন শক্যো’র্থ স্তেষু কশ্চন। দ্রৌপদীর বক্তব্য—তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করেও যদি কিছু না হয়, ত্যাগ স্বীকার বা অন্য কিছু করেও যদি কিছু না হয় তা হলে তাদের ওপর তোমার অত করুণা করার দরকার কী? সত্যি কথা বলতে কি, যদি নিজে বাঁচতে হয়, তা হলে ওদের শাস্তি দিয়েই বাঁচতে হবে—যোক্তব্য স্তেষু দণ্ডঃ স্যাজ্জীবিতং পরিরক্ষতা।

অতএব পাণ্ডবরা দ্রৌপদীর বাপের বাড়ির লোক পাঞ্চালদের সঙ্গে নিয়ে এই মুহূর্তে দুর্যোধনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ুক—এই ছিল দ্রৌপদীর সর্বশেষে সিদ্ধান্ত। এতে পাণ্ডবদের সামর্থ্য তৃপ্ত হবে ক্ষত্রিয়ের ক্ষুধা। দ্রৌপদী বোধহয় এখন জ্যেষ্ঠ-পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরকে কিছু ইঙ্গিত করছেন। তিনি বললেন—ক্ষত্রিয় হোক অথবা অক্ষত্রিয়, সে যদি লোভী হয়, তা হলে উপযুক্ত অথবা নিজের ধর্মে স্থিত ক্ষত্রিয়ের কাজ হল সেই লোভীটিকে মেরে ঠাণ্ডা করা—ক্ষত্রিয়েণ হি হন্তব্যঃ ক্ষত্রিয়ো লোভমাস্থিতঃ। আসলে দ্রৌপদীর মতে—যাকে মারা উচিত নয়, তাকে মেরে ফেলাটা যেমন অন্যায়, তেমনই যে বধযোগ্য, তাকে বাঁচিয়ে রাখাটাও একই রকম অন্যায়।

রাজনীতির দিক দিয়ে নিজের সমস্ত নীতি-যুক্তি উপস্থিত করেও দ্রৌপদী এবার মোক্ষম সেই ঘটনায় এলেন, যেখানে অন্যের যুক্তি-তর্ক হার মানবে, যেখানে তিনি নিরঙ্কুশ—যেখানে শুধু এক যুক্তিতেই কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া যায়। সেই কুরুসভার অপমানের ঘটনা। দ্রৌপদী নিজেই তাঁর বাপের বাড়ির আভিজাত্য, শ্বশুর-কুলের সম্মান, স্বামীদের শক্তি এবং ধর্মজ পুত্রদের অভিমান—সব একত্রিত করে সেই সাংঘাতিক পুরাতন কথাটা তুললেন—শাঁখা-সিঁদুর-পরা আর কোন অভাগিনী এই পৃথিবীতে আছে-কানু সীমন্তিনী মাদৃ—যে তার স্বামীরা বেঁচে থাকতে, ভাইয়েরা বেঁচে থাকতে, এমন কী তুমিও বেঁচে থাকতে, সবার সামনে অন্যের হাতে চুলের মুঠি ধরার অপমান সহ্য করল। ক্রোধলেশহীন, প্রতিকারের চেষ্টাহীন স্বামীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অপমান দেখলেন, আর আমাকে কেঁদে কেঁদে ডাকতে হল তোমাকে—পাহি মামিতি গোবিন্দ মনসা চিন্তিতো’সি মে। বাস, রাজনীতির প্রয়োগ-তত্ত্বের আগুনে এইমাত্র দ্রৌপদীর ঘৃতগন্ধী অভিমান যুক্ত হল।

কৌরব-সভায় দ্রৌপদীর অসহায় ক্রন্দনের সময় সেই অলৌকিক বস্ত্ররাশি দুঃশাসনকে ক্লান্ত করেছিল কিনা, তা আমাদের প্রত্যয়ে আসে না হয়তো। কিন্তু কৃষ্ণের নামে যে কাজ হয়েছিল—তা আমি হলফ করে বলতে পারি। হরিনামের মাহাত্ম্য এই নামের মধ্যে নাও থাকতে পারে—কিন্তু সে যুগের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে কৃষ্ণের কূটনীতির মাহাত্ম্য তখন এতই বহুশ্রুত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত যে, কৃষ্ণনামের মাত্রা তখন রাজনৈতিক দিক দিয়ে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কৃষ্ণ পরে যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন—আমি যদি সেই সময় শুধু দ্বারকায় থাকতাম, তা হলে কৌরবরা না ডাকলেও আমি অনাহূত অবস্থাতেও পাশাখেলার আসরে পৌঁছতাম। প্রথমে ভীষ্ম-দ্রোণ এবং অন্যান্য বড় বড় মানুষদের সঙ্গে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাশাখেলার দোষগুলি বোঝাতাম—আর যদি তাতেও কেউ আমার ভাল কথা না শুনত, তা হলে মেরে বোঝাতাম—পথ্য জিনিসটা কী—পথ্যঞ্চ ভরতশ্রেষ্ঠ নিগৃহ্নীয়াং বলেন তম। হয়তো তাতে অন্য পাশাড়েরা সব ক্ষেপে গিয়ে ওদের পক্ষে জুটত। তাতে কী? ওদেরও মেরে ফেলতাম নির্দ্বিধায়—তাংশ্চ হন্যাং দুরোদরান্।

আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি—কৃষ্ণের এই ক্ষমতা ছিল। তিনি যা বলেন, তা যে করতে পারেন—সেটা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ে শিশুপাল বধের সময়েই দেখা গেছে। কোনও বিরুদ্ধতা তাঁকে কিছুই করতে পারেনি। কৌরব-সভায় পাশাখেলার সময় ভাল কথা অনেকেই বলেছেন, বিদুর তো বিশেষ করে, কিন্তু ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর কারওই ওই মারার ক্ষমতাটা ছিল না। সমগ্র দূতসভায় একমাত্র দ্রৌপদী ছাড়া কৃষ্ণের নাম কেউ মুখেও আনেননি—কৌরবরা তো নয়ই পাণ্ডবরাও নয়, ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরও নয়। আমার ধারণা যে মুহূর্তে এই শায়েস্তা করার লোকটির নাম দ্রৌপদীর মাধ্যমে সবারই স্মরণে এসেছে, সেই মুহূর্তে দুঃশাসন ক্লান্ত বোধ করেছেন, তাঁকে থামতেও হয়েছে। কিন্তু অপমান-মুক্তির মধ্যে দ্রোপদী তাঁর পঞ্চস্বামীকে ত্রাতার ভূমিকায় পাননি—সেই ধর্ষণ, অপমানের মুহর্তেও পাননি, আজ এতকাল বনবাস পর্বের পর যুধিষ্ঠির, ভীম এবং আংশিকভাবে অর্জুনেরও সন্ধিকামুকতা দেখে তিনি এখনও আশ্বস্ত নন। তাই সেদিন সেই অকারণ লাঞ্ছনার মধ্যেও তিনি কৃষ্ণকে স্মরণ করেছিলেন, আজ এই যুদ্ধোদ্যোগের সময়েও তিনি কৃষ্ণেরই স্মরণ নিয়েছেন—বোধহয় একমাত্র তিনিই পারেন ক্ষত্রিয়বধূর কাম্য জয়াশা পূরণ করতে।

বস্তুত এই প্রত্যাশাপূরণের ক্ষেত্রে ভীম এবং অর্জুনও দ্রৌপদীর অবিশ্বাসের মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর এই দুই স্বামীই যাঁর ইচ্ছা বা নীতি-যুক্তি অতিক্রম করতেন না—সেই জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের অমোঘ শাসন দ্রৌপদী কোনওদিনই পছন্দ করেননি, তাঁর নীতি-যুক্তিও সহ্য করতে পারেননি কোনওদিন। লেখক-সজ্জনের মধ্যে আছেন কেউ কেউ, যাঁরা যুধিষ্ঠিরের প্রতি ইঙ্গি পক্ষপাতে দ্রৌপদীকেও তাঁর প্রতি সরসা করে তুলেছেন। স্বয়ং বুদ্ধদেব বসু তাঁর অসাধারণ সংহত ভাষায় যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর প্রায় একক নিষ্ঠা এবং আশ্রয়ের কথাটা প্রকাশ করেছেন। তবে সে মত আমার মতো সাধারণ মহাভারত পাঠকের মনে বড় অনর্থক রকমের জটিল বলে মনে হয়েছে। মহাকাব্যের নায়িকা হিসেবে তথা পঞ্চস্বামীর একমা বধূ হিসেবে দ্রৌপদীর মনের গতি-প্রকৃতি যে অতিশয় জটিল, তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই জটিলতার সুযোগে পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর ‘নিকটতম’ সম্বন্ধ প্রমাণ করে দেওয়াটা আমাদের মতে কিছুটা সংহতিহীন মনে হয়।

আমি প্রথমে প্রয়াত বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্যগুলি উদ্ধার করে তাঁর সার্বিক মতটা দেখানোর চেষ্টা করব, তারপর, আমাদের যৌক্তিকতা আমরা দেখাব। বুদ্ধদেববাবু লিখেছে—(১, ২, ৩ সংখ্যাগুলি আমার দেওয়া)

(১) “কি ‘আসলে’ যেন যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই নিকটতম তাঁর সম্বন্ধ—ঘটনার পর ঘটনা অনুধাবন করতে-করতে এমনি একটা ধারণা হয় আমাদের, যদিও অগ্নিসম্ভবা আগ্নেয়স্বভাব পাঞ্চালীর সঙ্গে মৃদু দৃত্যাসক্ত যুদ্ধবিমুখ যুধিষ্ঠিরের বৈশাদৃশ্য অতিশয় স্পষ্ট।”

(২) ‘বক-যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে তিনি তিনবার উল্লেখ করেছেন ভার্যার—তাঁর ভার্যার, তা বুঝে নিতে আমাদের দেরি হয় না। ‘গৃহে মিত্র ভার্যা’, ‘দৈবকৃত সখা ভার্যা’, আর উপরন্তু ‘ধর্ম অর্থ কাম—এই তিন পরস্পর বিরোধীর সংযোগ ঘটে শুধু ধর্মচারিণী ভার্যার মধ্যে’—এ সব কথা যুধিষ্ঠিরের মুখে ঠিক শাস্ত্রবচনের মতো শোনাচ্ছে না, এদের পিছনে দ্রৌপদীর সঞ্চার আমরা অনুভব করি…”

(৩) “যুধিষ্ঠির সযত্নে লালন করেছিলেন এই সম্পর্কটিকে, এবং বহুভর্তৃকা দ্রৌপদী এর মূল্য বিষয়ে কতটা সচেতন ছিলেন তাও আমরা অনেকবার দেখেছি। স্মর্তব্য, তাঁর পায়ের কাছে যে স্বর্ণপদ্মটি উড়ে এসে পড়েছিলো, দ্রৌপদী সেটি যুধিষ্ঠিরকেই উপহার দিয়েছিলেন, আজ্ঞাবহ ভীমসেনকে নয় (বনঃ ১৪৬)। তাঁর আছে ‘ইন্দ্রের মত পঞ্চস্বামী’—এই বাঁধা বুলিটি দ্রৌপদীর মুখে শুনতে পাওয়া যায়, কিন্তু দ্যূতসভায় অবমানিত হ’য়ে তিনি তীব্র স্বরে ব’লে উঠলেন (সভা : ৬৭) : আমি পাণ্ডবদের সহধর্মিণী, আমি ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের ভাষা।’—যেন বহুবচনের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে ধরানো গেল না, স্বতন্ত্রভাবে তাঁর নাম বলতে হ’লো, যেন পাঁচের মধ্যে একের নাম করতে হ’লে যুধিষ্ঠিরকেই তাঁর মনে পড়ে।”

(৪) “আমরা লক্ষ করি যে সভাপর্বের পরে কাহিনী যত এগিয়ে চলে ততই সত্য হয়ে ওঠে দ্রৌপদীর সেই আর্ত মুহূর্তের ঘোষণা ;—একান্ত ভাবে না হোক, উত্তরোত্তর আরও বেশি সংশ্লিষ্টভাবে, তিনি যুধিষ্ঠিরের ভার্যারূপে প্রতিভাত হতে থাকেন। দ্রৌপদীর অন্য দুই প্রধান স্বামীর উপর ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলছেন ব্যাসদেব—বলা বাহুল্য, নকুল-সহদেব এ প্রসঙ্গে বিবেচ্য নন—দ্রৌপদীর বল্লভ রূপে কখনো অর্জুনকে আর কখনো বা ভীমকে আমরা দেখতে পাই। কিন্তু তাঁর নিত্যসঙ্গীরূপে যুধিষ্ঠিরই ছিলেন একমাত্র—হয়তো ঘটনাচক্রে, যেহেতু অর্জুন ছিলেন অনবরত ভ্রাম্যমাণ আর ভীমসেন প্রধানত এক মল্লবীর হিসেবে উপস্থিত, বা হয়তো অন্তঃস্থিত কোন নিগূঢ় আকর্ষণ ছিলো দুজনের মধ্যে—কেননা বিপরীতেরও আকর্ষণ থাকে, এবং তা প্রবল হবারও বাধা নেই। যে কারণে কান্তিমান দুর্মদ যুবা আলকিবিয়াদেস-এর পক্ষে কুদর্শন বৃদ্ধ জ্ঞানী সক্রেটিস ছিলেন প্রয়োজন, হয়তো সেই কারণেই দ্রৌপদীর যুধিষ্ঠিরকে না হ’লে চলতো না।

(৫) “যাকে বলা যায় সত্যিকার দাম্পত্য সম্বন্ধ, তার দৃষ্টান্ত রূপে যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীকেই মনে পড়ে আমাদের ঠিক মধুর রসে আশ্রিত নয় হয়তো, বলা যায় না রতিপরিমলে অনুলিপ্ত, কিন্তু গভীর ও স্থির ও সশ্রদ্ধ ও প্রীতিপরায়ণ সেই সম্বন্ধ, এবং যা আরো জুরুরি-সমকক্ষতার উপর প্রতিষ্ঠিত।”

বুদ্ধদেব বসু মহাশয়ের সমস্ত কথাগুলি ওখানে উদ্ধার করতে পরলেই ভাল হত, কিন্তু তাতে গ্রন্থের কলেবর -বৃদ্ধির ভয় আছে ; তা ছাড়া যতটুকু আমরা এখানে তুলেছি, তাতেই তাঁর সার্বিক মতটা বোঝা যায়। আমাদের নিবেদন—প্রথম মন্তব্য ‘আসলে’ যেন যুধিষ্ঠিরই তাঁর স্বামী’—এখানে ‘আসলে’ আর ‘যেন’ কথাটি যতই কাব্যগন্ধী গদ্যের সূচনা করুক, এই কথাগুলির মধ্যে কেমন এক অপ্রত্যয় আছে, বোঝা যায়, মহাভারতের সামগ্রিক প্রমাণে এই কথা সম্পূর্ণ প্রমাণ করা যাবে না ভেবেই মন্তব্যের মধ্যে এক পিচ্ছিল অনিশ্চয়তা রেখে দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু ‘যুধিষ্ঠিরের সঙ্গেই নিকটতম তাঁর সম্বন্ধ’ এই কথার সঙ্গেই ‘যদিও’ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৗপদীর ‘বৈশাদৃশ্য অতিশয় স্পষ্ট’—এই আপাত বিরোধিতারও অর্থ আমার কাছে স্পষ্ট নয়— এবং অস্পষ্টতা দিয়ে আর যাই হোক, পঞ্চস্বামীর একতমের সঙ্গে দ্রৌপদীর ‘নিকতম স্মবন্ধ’ প্রমান করা কঠিন।

স্বামীদের সঙ্গে দ্রৌপদীর সম্বন্ধ পূর্বে আমি খানিকটা দেখানোর চেষ্টা করেছি এবং তা অবশ্যই মহাভারতের প্রমাণে। তাতে আমি কোথাও যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ‘নিকটতম সম্বন্ধ খুঁজে পাইনি। তার ওপরে বুদ্ধদেবের ৪ সংখ্যক মন্তব্যে ‘সভাপর্বের পর থেকে দ্রৌপদীকে ‘উত্তরোত্তর’ যুধিষ্ঠিরের সংশ্লিষ্ট অথবা ‘তিনি যুধিষ্ঠিরের ভার্যারূপে প্রতিভাত হতে থাকেন’—এই সিদ্ধান্তের মধ্যেও আমি কোনও বৈয়াসিক যুক্তি খুঁজে পাইনি। বরঞ্চ প্রায় উলটোটাই আমার কাছে সত্য বলে মনে হয়।

দ্রৌপদী যেদিন স্বয়ম্বরা বধূটির লজ্জারুণ চেলি পরে কুম্ভকার গৃহের ভাড়া-করা শ্বশুর-বাড়িতে এলেন, সেদিন গৃহের অন্তরালে থাকা কুন্তীর বচন ছিল—যা এনেছ পাঁচ ভাই ভাগ করে খাও। তারপর দ্রৌপদীকে দেখে তিনি ভীষণ ভয়ে আর্তস্বরে যুধিষ্ঠিরকেই বলেছিলেন—তুমি সেই ব্যবস্থা কর যাতে আমার কথা মিথ্যে না হয়, কৃষ্ণা পাঞ্চালীকে যাতে কোনও অধর্ম না স্পর্শ করে অথবা তাতে তাঁর যেন কোনও বিভ্রান্তিও না হয় অর্থাৎ তিনি যেন কোনও ভুল না বোঝেনন বিভ্রমেচ্চ।

যুধিষ্ঠির মাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, হয়তো ধর্মের সূক্ষ্ম গতিপথ—যা তিনি নিজেও তখন তত বোঝেননি এবং যা তিনি কন্যার পিতা দ্রুপদকেও বোঝাতে পারেননি—সূক্ষ্মো ধর্মো মহারাজ নাস্য বিদ্মো বয়ং গতিম্‌—অথচ তিনি প্রায় আদেশের মতো বলেছিলেন—আমাদের সবারই মহিষী হবেন এই কল্যাণী দ্রৌপদী। মায়ের কথা মিথ্যে হয়নি, হয়তো বৃহত্তর স্বার্থে পঞ্চভ্রাতার সৌহার্দ্যকামনায় ধর্মও লঙ্ঘিত হয়নি, কিন্তু কৃষ্ণা পাঞ্চালীর কোনও বিভ্রান্তি হল কিনা, অর্থাৎ তিনি ভুল বুঝলেন কিনা—সে খোঁজ, যুধিষ্ঠির নেননি। দ্রুপদকেও তিনি ধর্মের গতি বোঝাতে না পেরে শেষ পর্যন্ত মায়েরই আশ্রয় নিয়েছেন, এবং নিজেকে তিনি যথোপযুক্ত প্রয়োগ করেছেন সবাংশে জ্যেষ্ঠের মতো। বলেছেন—মা এইরকম বলেছেন, আমারও তাই মনে হয়—এবঞ্চৈব বদত্যম্বা মম চৈতন্‌মনোগতম্। দ্রৌপদী খুশি হয়েছিলেন কি না আমাদের জানা নেই। নিয়তির মতো পাঁচ স্বামী যখন তাঁর মাথায় চেপে গেল, তখন এই বিদগ্ধা নায়িকা অসাধারণ দক্ষতায় পঞ্চপ্রদীপের তলায় ধৃতিদণ্ডটির মতো পঞ্চস্বামীরই বশবর্তিনী হয়েছেন—বভূব কৃষ্ণা সর্বেষাং পার্থানাং বশবর্ত্তিনী। কিন্তু যুধিষ্ঠিরকে তিনি ক্ষমা করেছেন তো?

তবু এমন পাঁচ স্বামীকে নিয়ে ভরা সুখের মধ্যে অর্জুন এক সামান্য গরুচোর ধরতে গিয়ে বনে চলে যেতে বাধ্য হলেন কিন্তু ফিরে এলেন—যাদবনন্দিনী সুভদ্রাকে নিয়ে। ফিরে আসার পর দ্রৌপদীকে আমরা খণ্ডিতা হতে দেখেছি। অর্জুনের ওপর বড় অভিমান করতেও দেখেছি। উল্লেখ্য, মহামতি যুধিষ্ঠির কিন্তু রীতিমত স্বয়ম্বরে গিয়ে গোবাসন শৈব্যের মেয়ে দেবিকাকে বিয়ে করেছিলেন। এই বিয়েটা দ্রৌপদীর বিয়ের আগে না পরে সুসম্পন্ন হয়েছিল—সে-খবর মহাভারতের কবি দেননি, অকিঞ্চিৎকর বলেই দেননি, আর দ্রৌপদীর কাছেও এ-ঘটনা ছিল বড়ই অকিঞ্চিৎকর। যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর নৈকট্যবোধ তীব্র হলে এই দেবিকার কথা একবারও অন্তত দ্রৌপদীর মুখে শুনতাম, অথবা দেখতাম সামান্যতম ভ্রূকুটি। এই ভ্রূকুটি যেমন যুধিষ্ঠিরের অন্যতরা স্ত্রীর জন্যও কুঞ্চিত হয়নি, তেমনই হয়নি নকুল বা সহদেবের অন্যান্য বধূদের জন্যও। স্বামীর প্রতি একান্ত অধিকার-বোধই এই ভ্রূকুটি-কুটিলতার জন্ম দেয় বলে রসশাস্ত্রে শুনেছি। অথবা যুধিষ্ঠির সেই রসভাব-সমন্বিত বিদগ্ধ ভ্রূকুটি-ভঙ্গের যোগ্য ছিলেন না—অন্তত দ্রৌপদীর কাছে। দ্রৌপদীর মুখে ভীম-হিড়িম্বার সংবাদও সাড়ম্বরে শুনেছি, কিন্তু হিড়িম্বাকে নিয়ে দ্রৌপদীর ঈর্ষা তো ছিলই না, বরং একটু স্বাধিকার-বোধই ছিল যেন—একান্ত অনুগত ভীমের বউ বলেই হয়তো।

তবুও কেউ বলতে পারেন—অন্যান্য পাণ্ডব-বধূদের ব্যাপারে দ্রৌপদীর অন্তরঙ্গ ঔদাসীন্য এমন কিছু দরকারি কথা নয়, যাতে যুধিষ্ঠিরের প্রতি তাঁর নৈকট্য অপ্রমাণ হয়ে গেল। কথাটা যাই হোক, আমিও অত বড় করে কিছু বলছি না, কিন্তু অন্যের ক্ষেত্রে নিস্তরঙ্গতা আর অর্জুনের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়া—এই বৈপরীত্যের মধ্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর সামান্য নৈকট্যের আভাস যতটা, অর্জুনের প্রতি দুর্বলতার ইঙ্গিত তার চেয়ে বেশি।

তবু থাক সে-কথা। অর্জুন-সুভদ্রার বিয়ের পরে দ্রৌপদীকে আমরা একবার অর্জুনের সঙ্গে বেড়াতে যেতে দেখেছি। নিজের ইচ্ছায় নয়। কিন্তু বারো বছর বাইরে-বাইরে থেকে এক যৌবনোদ্ধত যুবক এতকাল পরে বাড়ি ফিরেছে—হতে পারে, তার সঙ্গে সুভদ্রার মতো সুন্দরী সঙ্গিনী আছে—তবু জীবনের প্রথম নারীটিকে স্ববীর্যে জয় করে আনার মধ্যে যে চিরন্তন অধিকার-বোধ থাকে, হয়তো সেই অধিকার-বোধেই, অথবা অর্জুন বাড়ি ফিরেও হয়তো দেখেছিলেন—দ্রৌপদী তখনও দাদা কিম্বা ভাইদের পরকীয়া, হয়তো সেই যন্ত্রণায় অর্জুন যেন দ্রৌপদীর সমস্ত অন্যতর বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে ক্ষণেকের তরে নিজের অধিকারে স্থাপন করেছেন একান্ত এক বিহার-ভূমিতে।

বিবাহের পর দ্রৌপদীর সঙ্গে অর্জুনের সেই প্রথম মধুচন্দ্রিমা। জানি—মহাভারতের কবি কথাটা এমন স্পষ্ট করে বলেননি। কিন্তু ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিঃসংশয় অনুজ্ঞার জন্য অর্জুন হয় বেশ একটু কৌশলই করেছিলেন কিনা—কে জানে! অর্জুন কৃষ্ণকে বলেছিলেন—চল যাই যা দিকটাই ঘুরে আসি-বড্ড গরম এখানে-“উষ্ণানি কৃষ্ণ বৰ্ত্তন্তে গচ্ছাবো যমুনাং প্রতি। কৃষ্ণ বললেন—আমিও মনে মনে এই কথাই ভাবছিলাম, অর্জুন! বেশ বন্ধু-বান্ধব সঙ্গে নিয়ে যমুনার কাছে ফুর্তি করে আসলে দারুণ হত। কে না জানে—ধীর সমীরে যমুনাতীরে কৃষ্ণের উল্লাস বড় বেশি। কিন্তু অর্জুন! কৃষ্ণের ইচ্ছা থাকায় ধর্মরাজের অনুমতি মিলতে দেরি হয়নি। ফুর্তির জন্য বন্ধু-বান্ধব যত না গেছেন তাঁদের সঙ্গে, ফুর্তিবাজ অন্য মেয়েরা গেছে তার চেয়ে বেশি। তারা নাচবে, গাইবে, যা ইচ্ছে করবে—বনে কাশ্চিৎজ্জলে কাশ্চিৎ—স্ত্রিয়শ্চ বিপুল-শ্রোণ্য-শ্চারুপীনপয়োধরাঃ। কৃষ্ণ আর অর্জুনের সঙ্গে এসেছেন সুভদ্রা আর দ্রৌপদী। খাওয়া দাওয়া আর নাচে-গানে ভরে উঠল এই চারজনের অন্তরঙ্গ আসর। নাচনেওয়ালি মেয়েদের রঙ্গ-তামাশায় ভারী মজা পেলেন দ্রৌপদী এবং সুভদ্রা। খুশির মেজাজে তাঁরা সেই মেয়েদের দিকে নিজের গায়ের গয়না ছুঁড়ে দিলেন, ছুঁড়ে দিলেন রঙিন ওড়না—দ্রৌপদী চ সুভদ্রা চ বাসাংস্যাভরণানি চ।

বাড়ির বাইরে আপন ঈপ্সিততমের সঙ্গে দ্রৌপদীকে আমরা কি এত খুশির মেজাজে, এত উচ্ছ্বসিত—আর কখনও দেখেছি? হয়তো নৈকট্যের আরও সংজ্ঞা আছে কোনও, দিন-দিন, প্রতিদিন দাম্পত্য অভ্যাস—সেই বুঝি নৈকট্য! হবেও বা। কৃষ্ণ-অর্জুনের এই যমুনা-বিহার থেকেই সূচিত হয়েছিল খাণ্ডব-দহনের প্রক্রিয়া। পাণ্ডবরা ধৃতরাষ্ট্রের অনুজ্ঞায় খাণ্ডবপ্রস্থে রাজ করতে এসেছেন। শস্যহীন, রুক্ষ জমি এই খাণ্ডব-প্রস্থ। অগ্নিদেবের ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি কঠিন কথা থাক। কিন্তু সমস্ত খাণ্ডববন পুড়িয়ে যে বীর প্রায় একক ক্ষমতায় জায়গাটাকে সবার বাসযোগ্য করে তুললেন, যে শালীনতায় তিনি ময়দানবের মাধ্যমে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজপ্রসাদ বানানোর ব্যবস্থা করলেন—সেই অর্জুনের সব ক্ষমতা, ত্যাগ—দ্রৌপদীর মনে ছিল। খাণ্ডব-দহনের অসাধারণ প্রক্রিয়ায় দ্রৌপদী কতটা মুগ্ধ ছিলেন—তা টের পাওয়া যায় পরবর্তী সময়ে দ্রৌপদীর আক্ষেপে। সেই বিরাট-পর্বে দ্রৌপদী যখন কীচকের উদগ্র কামনায় বিব্রত হচ্ছেন, তখন ভীমের কাছে গিয়ে দ্রৌপদী অর্ধেক অনুশোচনা করেছেন শুধু অর্জুনকে নিয়ে। তাঁর কেবলই কষ্ট—অর্জুনের এই দশা হল কী করে? সেই মানুষ, যে নাকি খাণ্ডব-দহন করে অগ্নিকে তৃপ্ত করেছিলেন—যো’তর্পয়দমেয়াত্মা খাণ্ডবে জাতবেদসম্—সে বিরাটরাজার অন্তঃপুরে নাচনেওয়ালী সেজে থাকে কী করে? এই খাণ্ডব-দহনের প্রসঙ্গ দ্রৌপদীর মুখে আবার এসেছে, যখন তিনি কুমার উত্তরের কাছে বৃহন্নলার সারথি হবার যোগ্যতা-প্রমাণে ব্যস্ত হয়েছিলেন। কাজেই মহাভারতের আদিপর্বেও যুধিষ্ঠিরের স্বামিত্বে যত গৌরবান্বিত ছিলেন দ্রৌপদী, তার চেয়ে অনেক বেশি মুগ্ধ ছিলেন অর্জুনের বীরত্বে। কিন্তু দ্রৌপদীর কাছে অর্জুনের মাহাত্ম্য প্রমাণ করা আমার উদ্দেশ্য নয়, আমার বক্তব্য—আদিপর্বে আমরা এমন কিছু দেখিনি যাতে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর নৈকট্য প্রমাণ করা যায়।

তারপর বুদ্ধদেব যেমন লিখেছেন—‘দূতসভায় অবমানিত হয়ে দ্রৌপদী তীব্র স্বরে বলে উঠলেন—আমি পাণ্ডবদের সহধর্মিনী, আমি ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের ভার্যা!—যেন বহুবচনের মধ্যে যুধিষ্ঠিরকে ধরানো গেল না, স্বতন্ত্রভাবে এবং বিশেষভাবে তাঁর নাম বলতে হ’লো…’—ঠিক এইভাবে কথাগুলি মহাভারতে নেই। দ্রৌপী বলেছিলেন—আমি পাণ্ডবদের ভার্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী, এবং কৃষ্ণের বান্ধবী হওয়া সত্ত্বেও কেমন করে যে এই সভায় সমস্ত রাজাদের সামনে নিয়ে আসা হল—ভাবতে পারি না।

এই হল একটি শ্লোক এবং এই শ্লোকে ‘কথং হি ভার্যা পাণ্ডুনাম্‌’ আমি পাণ্ডবদের ভার্যা —এখানে যুধিষ্ঠিকেও ধরানো গেছে একভাবে। পরের শ্লোকে যুধিষ্ঠিরের নাম আলাদাভাবে উচ্চারণ করেছেন দ্রৌপদী, কিন্তু তার তাৎপর্য বুদ্ধদেব যেমনটি বলেছেন, তেমনটি আমার মনে হয় না। এখানে আবারও শ্লোকটি যেখানে আছে, যে প্রসঙ্গে আছে—সেটা বলি। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে বাজি রেখে হেরেছেন যদিও, তবু তিনি নিজেকে বাজি রেখে হেরেছেন আগে। এ অবস্থায় আইনের মারপ্যাঁচে

দ্রৌপদীকে কোনও ভাবেই কৌরবদের দাসী বলা যায় কিনা—এটাই ছিল দ্রৌপদীর প্রশ্ন। এই প্রশ্নকূ নিয়ে আগেও আলচনা হয়ে গেছে। মহামতি ভীষ্ম এই প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছেন এবং উত্তরের জন্য দেখিয়ে দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকেই। দুঃশাসনের অসভ্যতাও তখন শেষ হয়ে গেছে, কাপড় টেনে টেনে পড়ান তিনি তখন ক্লান্ত। এরই মধ্যে কর্ণ বললেন—দুঃশাসন! ঝিটাকে এবার ঘরে নিয়ে যাও—কৃষ্ণাং দাসীং গৃহান্‌ নয়।

এই মুহূর্তে কৃষ্ণ-পাঞ্চালী আবার কথা আরম্ভ করলেন সমবেত সুধীজনের সামনে। আবার সেই শাশ্বত লোকাচার সাধারণ ধর্মবোধের কথা তুললেন দ্রৌপদী। সেই স্বয়ম্বর সভায় রাজাদের সামনে একবার আমি এসেছিলাম, আর আজও আমাকে আসতে হল! আমার গায়ে হাওয়ার পরশ লাগলেও যেখানে আমার স্বামীরা সইতে পারেন না, ভাবেন বুঝি, পর-পুরুষের ছোঁয়া লাগল সেই পাণ্ডবরাও আমার এই অপমান দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সহ্য করলেন।

ঠিক এইখানেই দ্রৌপদী দুঃখ করে বলেছেন—পাণ্ডবের ভার্যা, ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন এবং কৃষ্ণের বান্ধবী হয়েও আমাকে এই সভায় আসতে হল? এর পরেই যুধিষ্ঠিরের গৌরবে সেই আলাদা শ্লোকটি। দ্রৌপদী বললেন—দেখ হে, কৌরবরা! আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ভার্যা, আমাদের বিবাহ হয়েছে সবর্ণে, ক্ষত্রিয়ে ক্ষত্রিয়ে—তামিমাং ধর্মরাজস্য ভার্যাং সদৃশ বর্ণজাম্‌—এখন ভেবে দেখ তোমরা, আমাকে দাসী বলবে, না, অদাসী বলবে? যা বলবে—তাই করব—ব্রূত দাসীম্‌ অদাসীং বা তৎ করিষ্যামি কৌরবাঃ।

এখানে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ভাষার গৌরবে যে কথাগুলি বলেছেন দ্রৌপদী, তার একটা পৃথক গুরুত্ব অবশ্যই আছে আমার বিবেচনায়, তবে তার প্রসঙ্গটা এখানে খেয়াল করার মতো। মনে রাখা দরকার—দ্রৌপদীকে কোনওভাবেই দাসী বলা যায় কিনা—এই ছিল প্রশ্ন? দ্রৌপদী ধৃতরাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। তিনি কৌরবকুলের পুত্রবধূ, ধৃতরাষ্ট্রের কন্যার মতো—স্নুষাং দুহিতরঞ্চৈব। দ্রৌপদী মনে করিয়ে দিয়েছেন—কুরুকুলের চিরন্তন ধর্মবোধের কথা—যে ধর্মবোধ অতিক্রম করে তাঁরা কোনওদিন কুল-বধূদের অমর্যাদা করেননি, এবং যে ধর্মবোধ এখন বিলুপ্ত। এইবার তিনি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ভার্যার গৌরবে কথা বলছেন।

আবারও মনে রাখতে হবে—বিদগ্ধা দ্রৌপদী, পাণ্ডব-ভাষা দ্রৌপদী, ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী দ্রৌপদী—এই অভিজাত বংশ-সম্বন্ধগুলি কৌরব কুলাঙ্গারদের মনে করিয়ে দিয়ে তবেই দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের প্রসঙ্গে আসছেন। আসছেন এইজন্য যে, এই কয়েক ঘণ্টা আগেও তিনি ছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থের পাটরানি। রাজা যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী। ক্ষত্রিয় যুধিষ্ঠির সমানবর্ণা ক্ষত্রিয়া কুমারীকে বিবাহ করে, তবেই না কুরুকুলের পুত্রবধূর সম্মানে তাঁকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। আর যে কুরুকুল চিরকাল শুধু ধর্মানুসারে কাজ করেছে, সেই কুরুকুলের জাতকেরা আজ ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ধর্মানুসারে বিবাহিতা রানি দ্রৌপদীকে দাসী বানাতে চাইছে। দ্রৌপদীর শাণিত ইঙ্গিত—এতে আভিজাত্যও নেই, ধর্মও নেই।

ধর্ম শব্দটা এখানে ফুল, নৈবেদ্য কিংবা বেলপাতার পুজো বোঝাচ্ছে না, ধর্ম এখানে এক বিশাল নীতিবোধ, সামাজিক ঔচিত্য ; এমনকী যা করা হয়ে গেছে, তা যদি ঠিক না হয়ে থাকে, তবে তার করণীয়তা সম্বন্ধে গভীর কোনও তর্কও হতে পারে। দ্রৌপদী সেই তর্কই করছিলেন, এবং এই সব ক্ষেত্রে যুধিষ্ঠির এতকাল ছিলেন প্রমাণ স্বরূপ। পাশা-ক্রীড়ার এই তাৎক্ষণিক মত্ততা ছাড়া যুধিষ্ঠির নৈতিক এবং উচিত কার্যে সব সময় ব্যক্তিস্বার্থ অতিক্রম করে সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। এমনকী এখনও তিনি পাশা খেলে নিজেকে এবং নিজের স্ত্রীকেও হেরেছেন—এই চরম মুহূর্তেও পাশা-খেলার ন্যায়-নীতি অনুসারে তাঁর মাথার ওপর যে গভীর সংকট নেমে এসেছে—সে সংকট থেকে বাঁচবার জন্য অন্য কোনও সহজ পন্থা অবলম্বন করেননি, অথবা কোনও তর্ক করেননি। কারণ পাশাখেলার নির্ধারিত নিয়মনীতিও তাঁর কাছে ধর্ম। যার জন্য দ্রৌপদী যখন বারবার কৌরবদের ওপরে চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছেন—বল তোমরা, আমি দাসী, না অদাসী, আমি ধর্মানুসারে জিত হয়েছি! না জিত হইনি—তোমরা যা বলবে—আমি তাই করব।

লক্ষণীয় বিষয় হল, কৌরবরা এখানে আজ্ঞাকারীর ভূমিকায় থেকেও তাঁদের সিদ্ধান্ত তাঁরা ঘোষণা করেননি। এই অবস্থাতেও তাঁরা বলেছেন—ধৰ্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের বুদ্ধি ধর্মেই স্থিত এবং পাশাখেলায় হেরে যাবার পর এখনও তোমার ওপর তাঁর স্বামীর অধিকার আছে, কি নেই—এই ইন্দ্রকল্প যুধিষ্ঠিরের কাছেই জেনে নাও—ধর্মে হিতো ধর্মসুতো মহাত্মা স্বয়ঞ্চেদং কথয়ত্বিন্দ্ৰকল্পঃ।

এই কথাটা দুর্যোধন বলেছেন। আপনারা কি মনে করেন না যে, এখানেও ‘স্বতন্ত্রভাবে এবং বিশেষভাবেই’ যুধিষ্ঠিরের নাম করতে হয়েছে। অন্যদিকে এই সংকট কালেও দ্রৌপদী যে ধর্মকেই শেষ অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছেন, সেই বহুমাননা করেও ভীষ্ম কিন্তু আবারও সেই যুধিষ্ঠিরকেই ন্যায়-নীতি বিচারের শেষ প্রমাণ বলে মনে করেছেন—যুধিষ্ঠিরস্ত প্রশ্নে’স্মিন প্রমাণমিতি মে মতিঃ।

যে কারণে ভীষ্ম, এবং এমনকী দুর্যোধনও বার বার ‘স্বতন্ত্রভাবে এবং বিশেষভাবে’, আলাদা করে যুধিষ্ঠিরের নাম করেছেন—আমার বিবেচনায়—দ্রৌপদীও ওই একই কারণে যুধিষ্ঠিরের নাম আলাদা এবং স্বতন্ত্রভাবে উল্লেখ করেছেন। কারণটা ভীষ্ম একবার যুধিষ্ঠির সম্বন্ধে বলেছেন, আবার অন্যত্র দ্রৌপদী নিজেই যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে সে-কথা বলেছেন। ভীষ্ম এই দ্রৌপদীকেই বলেছিলেন—দরকার হলে যুধিষ্ঠির সমস্ত পৃথিবী ও ত্যাগ করতে পারেন, কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করবেন না—ত্যজেত সবাং পৃথিবীং সমৃদ্ধাং, যুধিষ্ঠিরো ধর্মমতো ন জহ্যাৎ। আর বনপর্বে এসে দ্রৌপদী নিজেই তার স্বামীর সম্বন্ধে বলেছেন আমি যা বুঝি তাতে তুমি ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, এমনকী নিজেকেও অথবা আমাকেও ত্যাগ করতে পার, কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করতে পার না—ত্যজেস্তবমিতি মে বুদ্ধি র্ন তু ধর্মং পরিত্যজেঃ।

ধর্মের জন্য যুধিষ্ঠির এতটাই নিরপেক্ষ। এই নিরপেক্ষতা এমন এক প্রাবাদিক পর্যায়ে উন্নীত যে, দ্রৌপদী প্রথম দুঃশাসনের কবলে পড়ে অতিসংকটে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে যে-শব্দ উচ্চারণ করেন—ধর্মে হিতো ধর্মসুতো মহাত্মা—দুর্যোধন তাঁর শত্রুপক্ষ হয়েও তাঁর তর্ক-সংকটে সেই একই প্রবাদ-কল্প ব্যবহার করেন—ধর্মে হিতো ধর্মসুতো মহাত্মা। কাজেই দ্রৌপদীর পক্ষে স্বতন্ত্রভাবে এবং বিশিষ্টভাবে যুধিষ্ঠিরের নাম উচ্চারণের মধ্যে যদি অন্য কোনও মাহাত্ম্য আরোপ করতে হয়, তবে দুর্যোধন বা ভীষ্মের দিক থেকে যুধিষ্ঠিরের নাম পৃথকভাবে উচ্চারণ করার জন্য আমরা তাঁর কোন মাহাত্ম্য স্মরণ করব? বস্তুত ধর্ম, এবং এক অতি পৃথক তথা স্বতন্ত্র ধর্মবোধই যুধিষ্ঠিরকে তাঁর ভাইদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে, যার ফলে দ্রৌপদী, দুর্যোধন একই কারণে যুধিষ্ঠিরের নাম উল্লেখ করেন। এর মধ্যে যদি বুদ্ধদেবের দৃষ্টি-মতো দ্রৌপদীর ‘উত্তরোত্তর আরও বেশি সংশ্লিষ্টভাবে’ যুধিষ্ঠিরের ভার্যায় উত্তরণ দেখতে পাই, তা হলে দুর্যোধন বা ভীষ্মের জন্যও আমাদের আরও সংশ্লিষ্ট কোনও সম্বন্ধ খুঁজে বার করতে হবে।

যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে পৃথক এবং বৃহৎ আলোচনার অবসর যখন আসবে, তখন আরও সূক্ষ্মভাবে এসব কথা ধরবার চেষ্টা করব, তবে শুধু বুদ্ধদেব বসুর মতো মহোদয় ব্যক্তির প্রতিপক্ষতার গৌরবে অল্প হলেও এ-কথা বলতে হবে যে, দ্রৌপদী কোনওভাবেই উত্তরোত্তর আরও সংশ্লিষ্টভাবে যুধিষ্ঠিরের ভার্যারূপে প্রতিভাত হন না। যুধিষ্ঠির স্বক্ষেত্রে এতই বেশি বড়, এতই বেশি মহান এবং সেই কারণেই সুদূর আকাশে-আঁকা ইন্দ্রধনুটির মতো এতই তাঁর দুরত্ব যে, তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে কারও পক্ষে সংশ্লিষ্টতায় উত্তরণ ঘটানো বড় কঠিন বলেই আমি মনে করি।

দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের স্ত্রী তো বটেই, কিন্তু এই জ্যেষ্ঠ-স্বামীর সঙ্গে তাঁর ব্যবহারে একধরনের ‘ডিকটমি’ আছে। একদিকে যুধিষ্ঠির যেখানে তাঁর সুদূর ধর্মমঞ্চে বসে আছেন, সেখানে দুঃশাসন এসে তাঁর চুলের মুঠি ধরলেও, তিনি বলে ওঠেন—আমি ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরের কথার মধ্যে গুণগুলি বাদ দিয়ে অণুমাত্র দোষও দেখতে চাই না, কারণ ধর্মের গতি সূক্ষ্ম এবং নিপুণভাবে তা লক্ষ করতে হয় ; তিনি যা বুঝেছেন, আমি হয়তো তা বুঝতে পারছি না—বাচাপি ভর্তুঃ পরমাণুমাত্রম্‌ ইচ্ছামি দোষং ন গুণান্ বিসৃজ্য। অন্য দিকে এই সুদূর সম্মানিত ব্যবহারের লেশমাত্রও ছিল না, যখন দুঃশাসনেরও আগে প্রতিকামী এসে দ্রৌপদীকে প্রথম রাজসভায় যেতে বলেছিল। দ্রৌপদী সারথি-জাতের প্রাতিকামীর সামনেই রাজা যুধিষ্ঠিরের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে তাঁর দ্যূতাসক্তির ঘৃণ্যতা প্রমাণ করে বলেছিলেন—যাও সভায় গিয়ে সেই জুয়াড়িকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে এসো যে, সে নিজেকে আগে বাজি রেখে হেরেছে, না আমাকে—গচ্ছ ত্বং কিতবং গত্বা সভায়াং পৃচ্ছ সূতজ?

এই মুহূর্তে দ্রৌপদী আপন কুলবধূর সম্মান বাঁচানোর জন্য আইনের ফাঁকে যুধিষ্ঠিরের অধিকার সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন। অর্থাৎ যুধিষ্ঠির যদি আগে কোনওভাবে নিজেকে বাজি রেখে হেরে থাকেন, তবে এই মুহূর্তে তাঁর স্বামিত্বের অধিকার না থাকায় দ্রৌপদী খুশি হতে পারেন। কাহিনী যত এগিয়ে চলেছে, যুধিষ্ঠিরের প্রতি দ্রৌপদীর অধৈর্য আরও বেড়ে চলেছে বলে আমাদের মনে হয়েছে। সামগ্রিকভাবে যুধিষ্ঠির তাতে খারাপ হলেন, না ভাল হলেন—সে তর্কে আমি আপাতত যাচ্ছি না। কারণ, যুধিষ্ঠির এক বিশাল এবং ব্যাপ্ত মহাদ্রুমের মতো। শুধুমাত্র দ্রৌপদীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কে তিনি খারাপ, না ভাল—সে প্রশ্নটির শুধু আলোচনা হতে পারে।

যুধিষ্ঠিরের সূক্ষ্ম ধর্মবোধের মতো বুদ্ধদেবের সাহিত্য-বোধও বুঝি অতিশয় সুক্ষ্ম,—এতটাই সূক্ষ্ম যে, আমার মতো অনধিকারীর পক্ষে তা ধরাও বুঝি মুশকিল। তবে পূর্বাপর-বিচারে আমার যা মনে হয়েছে, তাতে সভাপর্বের পর কাহিনী যতই এগিয়ে চলেছে যুধিষ্ঠির সম্পর্কে দ্রৌপদীর অসহিষ্ণুতা ততই বেড়েছে। ইন্দ্রকল্প পাঁচস্বামীর পিছন পিছন তিনি বনে গিয়েছেন বটে, কিন্তু মনের রাগ তিনি মনে লুকিয়ে রাখেননি। দুঃশাসনের হাতে-ধরা চুল তিনি খুলে রেখে দিয়েছেন সমস্ত অপমানের প্রতীকের মতো। বনে যাবার কিছুদিনের মধ্যে যখন কৃষ্ণ এসে পৌঁছালেন পাণ্ডবদের কাছে, তখন দ্রৌপদী কৃষ্ণের সামনে ধিক্কার দিয়েছেন স্বামীদের। হয়তো অত্যন্ত ক্ষোভে অথবা চরম উদাসীনতায় যুধিষ্ঠিরের নামও তিনি করেননি। ভাবটা এই—তিনি যা করে ফেলেছেন, ফেলেছেন ; কিন্তু কী হল এই ভীম আর জোনের, যাঁদের একজন নিজের বাহুবলে আস্থাবান আর অন্যজন ধনুষ্মত্তায়—ধিক্‌ বলং ভীমসেনস্য ধিক্ পার্থস্য গাণ্ডীবম্? বুদ্ধদেবের অনুকরণে কি এখানে বলব যে, পাঁচজনের মধ্যে যেন এঁদের ধরানো গেল না, স্বতন্ত্র এবং বিশেষভাবে এঁদের নাম করতে হল। যেন দ্রৌপদী নিজের রক্ষার জন্য এই দুই পাণ্ডবের ওপর বেশি নির্ভর করেন, যুধিষ্ঠির কিংবা নকুল-সহদেবের ওপর তাঁর যেন কোনও ভরসাই নেই।