অর্জুন – ৩

আমি বেশ জানি—অর্জুনের অস্ত্রশিক্ষা এবং মৌন-মূক বালকটি থেকে ক্রমে ক্রমে তাঁর স্বমহিম আত্মপ্রকাশ নিয়ে আমি বড় বেশি কথা বলে ফেলেছি। অবশ্য এই বিস্তর বিবরণের কারণও আছে। মহাভারতের আলোচক, পাঠক এবং সমালোচকদের মধ্যে তাবড় তাবড় ব্যক্তিরা আছেন। তবে মহাভারতের নায়ক কে—এই প্রশ্ন উঠলে, তাঁরা কেউ মহাভারতের মহত্ত্ব এবং কেউ বা ভারবত্তার প্রসঙ্গ তুলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েন। কেউ বা অতি চতুরতায় মনোরম শব্দব্যুহ সৃষ্টি করে যুক্তির ইন্দ্রজালে যুধিষ্ঠিরকেই নায়ক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। সে যুগের প্রতিস্তরে ধর্মের প্রাধান্য এবং মহাভারতের যুদ্ধান্তিম শান্তরস আপাতত যুধিষ্ঠিরের নায়কত্ব অনেক বেশি সদর্থক করে তোলে। জানি এবং মানি—মোক্ষধর্মের প্রতি যুধিষ্ঠিরের আজীবন আগ্রহ ছিল। এও মানি—সংসারের সমস্ত পঙ্কিলতার মধ্যেও তিনি সংসার থেকে পালিয়ে যাননি। মহাভারতের ধর্মপ্রধান প্রেক্ষাপটে এই না-পালানোটা মোক্ষনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে যুধিষ্ঠিরকে নায়ক বানিয়ে দিতে রসসিক্ত যুক্তির অভাব ঘটার কথা নয়। আর এও তো ঠিক, সংস্কৃত আলংকারিকেরা মহাভারতকে যেখানে শান্তরস-প্রধান মহাকাব্য বলেছেন, সেখানে শম-প্রধান যুধিষ্ঠিরকে নায়ক বলে প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তি-বুদ্ধিরও অভাব ঘটবে না। একই কারণে মহাভারতের শেষাংশে বিরহকাতর পরিবেশ, স্ত্রীলোকের আর্তনাদ এবং আরও পরে সন্তানদের হানাহানিতে ভগবান বলে চিহ্নিত কৃষ্ণের অন্তর্ধান মনুষ্যজীবনের পরিণাম-শূন্যতা প্রকাশ করে বলে সব কিছুর মধ্যে যুধিষ্ঠিরের চিরায়ত মোক্ষভাবনাই শেষ সত্য হয়ে ওঠে। এ-বিষয়ে যুক্তি জাল বুনতে থাকলে যুধিষ্ঠিরের নাযকত্বই তর্কগ্রাহ্য হয়ে ওঠে। কেন না, মহাভারত মোক্ষধর্ম উপদেশক ধর্মশাস্ত্র হিসেবেই অগ্রগণ্য।

কিন্তু আমার সহৃদয় পাঠককুল। আপনারা বুকে হাত দিয়ে বলুন তো—আপনারা যখন মহাভারত পাড়েন, তখন কি এই মহাকাব্যের যুদ্ধান্তিম পটভূমিকায় জাগতিক শুন্যতা হৃদয়ে উপলব্ধি করে শান্তরসে সমাহিত হন? নাকি, সারা জীবন ধরে পাণ্ডবরা যে বঞ্চনার সম্মুখীন হয়েছেন, তার প্রতিশোধ কীভাবে পাণ্ডবেরা নিলেন—তার জন্য আপনাদের আত্যন্তিক ভাবনা থাকে? বলুন তো—সারা মহাভারত জুড়ে যুধিষ্ঠির তাঁর একান্ত ধর্ম-ভাবনায় উপদেশধর্মী যে-সব কথা বলেছেন—তাতে আপনারা বেশি আকৃষ্ট হয়েছেন, নাকি, যে-সব জায়গায় ভীম-অর্জুনের বীরত্ব ব্যঞ্জক কথাগুলি—যা নাকি সব সময় সযৌক্তিক বা পরিণাম-রমণীয় নাও হতে পারত—সে কথাগুলির সঙ্গে আমরা পাঠক হিসেবে বেশি মানসিক যোগ উপলব্ধি করেছি। আমি জানি মানুষের মধ্যে দেবত্ব বড় দুর্লভ কিন্তু দেবোপম মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন ঘর করা অত্যন্ত কঠিন। এই কারণেই মনুষ্যজীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সুখ, ক্ষুদ্র-ক্ষুদ্র দুঃখ এবং দৈনন্দিনতার মধ্যে আমরা যুধিষ্ঠিরেব মতো শম-প্রধান মানুষের ওপর ভীমের মতো, দ্রৌপদীর মতো ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ি। আর এই সব জায়গায় ধৈর্য, সহ্য আর দেবতার গুণে ভারতবর্ষের মতো ধর্মক্ষেত্রে যুধিষ্ঠির ধীরপ্রশান্ত নায়কটি হয়ে ওঠেন। অর্থ, লোভ, কামনা, প্রতিহিংসা—এ-সবের বিরুদ্ধ ভূমিতে দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষ যে ‘কাউন্টার-কালচার’ তৈরি করেছিল, সেখানে বৈরাগ্যপ্রধান ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জয় ঘোষণা করতে অসুবিধে কিছু নেই। অসুবিধে নেই—সেই নিরিখে যুধিষ্ঠিরকে নায়ক বলতেও। কারণ ভারতবর্ষের সর্বজনীন ধর্মবোধ শম-দমসম্পন্ন লোকাতীত ব্যক্তিত্বকে নীতিগতভাবে নায়ক ভেবে নিতে কী-ই বা অসুবিধে আছে?

কিন্তু বলুন তো—অর্জুনের অলোকসামান্য বীরত্ব, ভীমের বলদর্পিতা—এগুলি যদি মহাভারতের নিতান্ত গৌণ-রস হয় এবং স্বয়ং ব্যাসও যদি এই গৌণতাকে নির্মূল করে দিয়ে যুধিষ্ঠিরের স্বভাব-মহিমায় নতুন কোনও মহাভারত লিখতেন, তা হলে সে মহাভারত কে পড়তেন? অথবা পড়তেন যোগী, মুনি, ঋষিরাই। যদি বলেন—ভীম, অর্জুন আছেন শুধু প্রতিতুলনায় যুধিষ্ঠিরকে মহত্ত্ব দান করার জন্য, তাহলে বলব—এ-বিষয়ে দুর্যোধন-দুঃশাসনেরা আরও ভাল কাজ করতেন। আবার দুর্যোধনও যুধিষ্ঠিরের প্রতিনায়ক নন, যাতে করে যুধিষ্ঠিরের নায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। ভীম-অর্জুন দুর্যোধনের থেকে ভাল মানুষ, আর যুধিষ্ঠির আরও ভাল এই যুক্তিই বা কতটা পরিণত?

মহা মহাপণ্ডিতরা—যাঁরা বিশ্বজগতের সাহিত্য মন্থন করে, অপ্রতিম বাকশৈলীতে যুধিষ্ঠিরের নায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন, আমি তাঁদের যুক্তিতে অপ্রতিভ বোধ করি, কিন্তু অভিভূত হই না। অভিভূত হই না, কারণ, এক-কথায় নায়ক শব্দটি সাহিত্য-জগতে যে ভাব, যে অনুভূতির সৃষ্টি করে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। একটি নারীকে আপন গুণরাশিতে মোহিত করা—এ-গুণের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, কিন্তু মহাভারতের বিচিত্র ঘটনা-পরম্পরার ওপরেও তাঁর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। নেই এমন কোনও নিয়ন্ত্রণ বা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা—যাতে বলা যায় তিনি ঘটনাগুলিকে বয়ে নিয়ে চলেছেন এক চরম মুহূর্তের দিকে। এই মুহূর্তটি মহাভারতের যুদ্ধ রূপেও চিহ্নিত হতে পারত, কিন্তু এই যুদ্ধ তিনি ঘটাননি, যতখানি ঘটিয়েছেন মহাভারতের প্রতিনায়ক। যুধিষ্ঠিরের নায়কত্ব খণ্ডন করার জন্য আর বেশি যুক্তি আমার প্রয়োজন নেই, কারণ তাঁর নায়কত্বের যুক্তিগুলি প্রায়ই তকাতীত নয়। আমরা বরং এ-বিষয়ে অর্জুনের কথাটা ভাবতে পারি, অবশ্য তারও আগে আমাকে দু-চারটে কথা বলে নিতে হবে।

অনুভূতিশীল পাঠকদের ধৈর্য শেষ হওয়ার আগেই আমি অর্জুনের চরিত্র-বিশ্লেষণে ফিরে আসব। শুধু তাঁকে বুঝবার জন্য আরও একটু স্থিরতা আমাদের প্রয়োজন। আমি এই মুহূর্তে আপনাদের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে নিয়ে যাব। তবে যুদ্ধ এখনও আরম্ভ হয়নি। যুদ্ধ লাগবে! দুই পাশে দুই পক্ষের অজস্র সেনা সাজানো হয়েছে এবং অর্জুন তাঁর রথের সারথি কৃষ্ণকে বললেন—গোবিন্দ, এই দুই সেনাদলের মাঝখানে আমার রথটি নিয়ে রাখো। আমি একটু দেখে নিই কার কার সঙ্গে আমাকে লড়তে হবে—কৈ র্ময়া সহ যোদ্ধব্যম্ অস্মিন্‌ রণসমুদ্যমে। ভারতবর্ষের হাজার হাজার মানুষের নিত্যপাঠ্য সেই ভগবদ্‌গীতার আরম্ভ এইখানেই। অর্জুন দেখলেন—শিশুকালে যাঁর কোলেপিঠে মানুষ হয়েছেন সেই কুরুবৃদ্ধ পিতামহ সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। গোঁফদাড়ি পাকা, সাদা কাপড় পরা, সত্ত্বের প্রতিমূর্তি যেন। দাঁড়িয়ে আছেন দ্রোণাচার্য, যিনি পুত্রের স্নেহে হাত ধরে শর-সন্ধান শিখিয়েছেন অর্জুনকে। দাঁড়িয়ে আছেন আরও কত পিতৃকল্প মানুষ, অতি আপন জন—কেউ সম্পর্কে মামা, ভাই, শালা, শ্বশুর, অথবা ছেলের মতো। অর্জুন ভাবলেন কী করে এই সমস্ত লোকের গায়ে তীক্ষ ক্ষুরধার অস্ত্র আমূল বসিয়ে দেব? এ-যে অন্যায়, এ-যে একেবারেই মানুষের মতো নয়। অর্জুন কৃষ্ণকে বললেন—আমার রাজ্য চাই না, ধন-সম্পদ চাই না, চাই না শত্রু জয় করতে। অতি আপন নিকটজনের গায়ে হাত তোলার থেকে, ভিক্ষে করে খাওয়া ভাল। অর্জুন ধনুক-বাণ নামিয়ে রাখলেন। বললেন—আমি এই যুদ্ধ করব না—ন যোৎস্যে ইতি।

কৃষ্ণ দেখলেন—মহাবিপদ। প্রধানত অর্জুনের ভরসাতেই পাণ্ডবরা যুদ্ধ করতে নেমেছেন। এতকালের অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনার কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, না হয় অর্জুন যুদ্ধ নাই করলেন, কিন্তু যুদ্ধ তো তবু হবেই। রাজ্যের অংশ নিয়ে পাণ্ডব-কৌরবের গৃহবিবাদ, ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজাদের ব্যক্তিগত ঈষা, আক্রোশ, পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-এইসব কিছুরই চরম নিষ্পত্তি হতে চলেছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। সেই যুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার মুহূর্তে অর্জুন শরাসন ছেড়ে দিয়ে আত্মীয়-স্বজনের জন্য মমতায় ব্যাকুল হলেন। কৃষ্ণ অর্জুনের এই মমতা-মুঢ় মানসিক বিপর্যয় লক্ষ করে নানা উপদেশ দিতে আরম্ভ করলেন। সকলেই জানেন—এই উপদেশের মধ্যে ভারতীয় আস্তিকদর্শনের সমস্ত মূল সূত্রগুলি এসে পড়েছে, যে কারণে গীতাকে উপনিষৎ বলা হয়। আমি কিন্তু আপাতত গীতার দার্শনিক তথ্যগুলি—কর্ম, যোগ, জ্ঞান, ভক্তি—এ-সব কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনায় আগ্রহী নই। আমার বক্তব্য অল্পই।

আমি শুধু আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, ভগবদ্‌গীতা ব্যক্ত করেছেন ভগবান-রূপে বর্ণিত পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ এবং এই গীতা শোনানো হচ্ছে সেকালের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর অর্জুনকে। শোনানো হচ্ছে ধনুঃশর ত্যাগের জন্য নয়, গীতা শোনানো হচ্ছে—হৃদয়ের ক্লীব দুর্বলতা ত্যাগ করে উপযুক্ত ক্ষেত্রে ধনুঃশর ধারণ করার জন্য—ক্ষুদ্রং হৃদয়-দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ! হ্যাঁ গীতার মধ্যে মোক্ষজ্ঞানের উপদেশ আছে। যথেষ্টই আছে সাংখ্য-বেদান্তের চরম এবং পরম-তত্ত্বের সারকথা। ব্রহ্ম, পরমাত্মা, ভগবান—পরম-তত্ত্বের এই ত্রিবিধ স্বরূপ এখানে মনুষ্য-জীবনের সাধ্য হিসেবে নিরূপিত! একেবারে শেষ অধ্যায়ে স্বধর্ম ত্যাগ করে ঈশ্বরে শরণাগতির শ্রেষ্ঠতা আমাদের হাজার হাজার বছর ধরে পরমা ভক্তির মাহাত্ম্য শিখিয়েছে। অথচ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই যে, এই সমস্ত মহান দার্শনিক উপদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ আধার যিনি হতে পারতেন সেই ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে এই উপদেশগুলি দেওয়া হয়নি। উপদেশ দেওয়া হয়েছে অর্জুনকে।

এমন নয় যে, বয়োজ্যেষ্ঠ বলে যুধিষ্ঠিরকে কৃষ্ণ কোনও দিন কোনও উপদেশ দেননি। ছোট হওয়া সত্ত্বেও বহুবার তিনি ধর্মরাজকে বাহু ধর্মের উপদেশ দিয়েছেন এবং যুধিষ্ঠিরও বহুবার কৃষ্ণের বহুদর্শিত তথা ধর্মবোধ নিয়ে চরম প্রশংসা করেছেন। তা ছাড়া ক্ষত্রিয়ের শরসন্ধান এবং প্রজাপালনের থেকেও ধর্মরাজ মোক্ষসন্ধান বেশি পছন্দ করতেন। মোক্ষধর্ম শ্রবণ করার জন্য যুধিষ্ঠির বারংবার মুনি-ঋষিদের কাছে উপনিষগ্ন হয়েছেন। মুমুক্ষুত্ব এবং শমদমাদি সাধন সম্পদ, যা নাকি ব্রহ্মজিজ্ঞাসার প্রধান উপায়, তাতেও তাঁর একান্ত অধিকার ছিল। এই যুধিষ্ঠিরকে কিন্তু ভগবদ্‌গীতার উপদেশ করা হল না, করা হল অর্জুনকে। এমনও নয় যে, যুধিষ্ঠির গীতা শোনেননি। বামদেব গীতা, ঋষভ গীতা, হরীত গীতা—ইত্যাদি কত গীতাই তো তাঁর শান্তির জন্য উপদিষ্ট হয়েছে। কিন্তু ভগবদ্‌গীতা নয়। গীতার মধ্যে যে জ্ঞান যোগ, ভুক্তির কথা কতশতভাবে বলা হয়েছে-সে-সব দর্শন সম্বন্ধে যুধিষ্ঠিরেরই অনুপুঙ্খ জ্ঞান ছিল। তিনি সত্ত্বের প্রতিমূর্তি, ধর্মের আধার। অথচ তাঁকে ভগবদ্‌গীতার উপদেশ দেননি কৃষ্ণ, দিয়েছেন অর্জুনকে। মনে মনে ভাবি—এর মধ্যে কি কোনও রহস্য আছে? যদি থাকে, তা একটু হলেও বোঝা দরকার।

বলতে পারেন—অর্জুন কৃষ্ণের সখা, তাঁর জীবন-রথের সারথিও বটে। তাই হয়তো সময় বুঝে কফ সুহৃৎ-সৃস্মিত উপদেশ দিয়েছেন অর্জুনকে। কিন্তু না, ভগবদ্‌গীতার মধ্যে অর্জুনকে যতখানি সখার মতো কথা বলতে শুনেছি, তার থেকে অনেক বেশি দেখেছি শিষের মতে, পদানত ভক্তের মতো। ভগবদ্‌গীতার আরম্ভে-অর্জুন সে-কথা স্বীকারও করে নিয়েছেন যে, আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাগত, তুমি আমাকে সেই উপদেশ কর যাতে আমার ভাল হয়—শিষ্যস্তে’হং শাধি মাং ত্বং প্রপন্নম্‌। এই মুখের কথাটি ছাড়াও বিশ্বরূপ দর্শনের পর অর্জুনকে আমরা কৃষ্ণের পায়ে সবিনয়ে লুটিয়ে পড়তেও দেখেছি—নমস্কৃত্য ভয় এবাহ কৃষ্ণম্‌, অথবা-তস্মাৎ প্রণম্য প্রণিধায় কায়ং—অর্থাৎ একেবারে দণ্ডবৎ প্রণাম।

তাই বলছিলাম—এ তো সখা-বন্ধুর ব্যবহার নয়। একেবারে ভক্তের ওপর ভগবানের কৃপার মতো গীতার উপদেশ বর্ষিত হচ্ছে অর্জুনের ওপর। আরও আশ্চর্য, অর্জুনের সাময়িক দূর্বলতার সুযোগে অর্জুনের প্রাণপ্রিয় সখা কৃষ্ণও কেমন যেন গুরুর মতো উপদেশ দিচ্ছেন অর্জুনকে। বলছেন—আমি খুশি হয়ে তোমাকে আমার এই বিশ্বরূপ দেখিয়েছি, নইলে তুমি ছাড়া আর কেউ আমার এমন রূপ দেখেনি—যন্মে ত্বদন্যেন ন দৃষ্টপূর্বম্‌! অথবা একেবারে গীতার শেষে কৃষ্ণ বলেছেন—তোমাকে সবচেয়ে গোপন তত্ত্বের কথা বলছি অর্জুন! তুমি আমার ভালবাসার লোক, তাই আবার সেই কথা বলছি, যাতে তোমার ভাল হয়। কিন্তু সেই হিতের কথাটি কী? না, তুমি সব ত্যাগ করে আমার শরণ নাও। তোমাকে সব পাপ থেকে মুক্তি দেব আমি—সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং স্মরণং ব্রজ।

ভালবাসার লোকের কাছে এ কেমন কথা! সব ত্যাগ করে আমার শরণ নাও—এ তো বন্ধুর কাছে বন্ধুর কথা নয়! আসলে আমার যুক্তি দিয়ে আমি যেটা বলতে চাই, তা হল—বন্ধুত্ব অসম হলেও উন্নততর মননের অধিকার নিকৃষ্টতর ব্যক্তির কাছেও নিজের অনুভূত তত্ত্বজ্ঞান ব্যক্ত করতে পারেন। কিন্তু অর্জুনের ক্ষেত্রে কি তাই ঘটেছে? তিনি কি গীতার মতো তত্ত্ব উপদেশের মোগ্য নন? আমার মতে শুধুমাত্র কৃপাপরবশ হয়ে কৃষ্ণ অর্জুনকে গীতা উপদেশ করেননি। অর্জুনের মধ্যে সেই অসাধারণ বীজ ছিল যাতে গীতার উপদেশ করা যায়। আমি এক কথায় উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি না। যদি সেই চেষ্টা থাকত তা হলে প্রথমেই বলতাম—পাণ্ডবভাইদের মধ্যে যুধিষ্ঠির-ভীম কি নকুল-সহদেবের থেকে অর্জুনকে বেশি যোগ্য মনে করেন বলেই কৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার উপদেশ করছেন। এ-কথার যুক্তিও আছে। কারণ, গীতার দশম অধ্যায়ে বিভূতিযোগ প্রকাশ করার সময় এক একটি বিশিষ্ট জাতির মধ্যে শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি বা বস্তুর সঙ্গে কৃষ্ণ নিজের একাত্মতা স্থাপন করছিলেন। বলছিলেন—গাছের মধ্যে আমি অশ্বথ, পাহাড়ের মধ্যে আমি হিমালয়, পশুর মধ্যে আমি সিংহ, ঋতুর মধ্যে আমি বসন্ত। এইরকম আরও শত শ্রেষ্ঠত্বের নিদর্শন। (যাঁরা নজরুলের বিদ্রোহী কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন, তাঁরা লক্ষ করবেন—কবি একান্ত দ্রোহসূচক ব্যক্তি বা বস্তুকেই আপন একাত্মতার জন্য বেছে নিয়েছেন। স্পষ্টতই গীতার বিভূতিযোগ নজরুলের মনে একভাবে কাজ করেছে।)।

আমি শুধু বোঝানোর জন্য নজরুলের কথা তুললাম। কিন্তু এইরকম এক একটা জাতি বা বস্তুর শ্রেষ্ঠতমের সঙ্গে নিজের একাত্মতা ঘোষণার সময় কৃষ্ণ বলেছিলেন—পাণ্ডবদের মধ্যে আমি ধনঞ্জয় অর্জুন—পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ। আমি এক-কথায় বলতে পারতাম—কৃষ্ণ পাণ্ডবদের মধ্যে অর্জুনকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেন বলেই গীতার উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু আমি তা বলব না। আমার বক্তব্য—অর্জুনকে তিনি নানা কারণে শ্রেষ্ঠ, এমনকী ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের থেকেও শ্রেষ্ঠতর মনে করেছেন বলেই গীতার উপদেশ দিয়েছেন। কিন্তু কী সেই কারণগুলি যাতে অর্জুনের শ্রেষ্ঠত্বের দাবি আসে?

পাঠকের কাছে দুঃখের কারণ হবে কি না জানি না, কিন্তু এর উত্তরও খুঁজতে হবে ভগবদ্‌গীতার মধ্যেই! আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি এই মুহূর্তে জ্ঞান, যোগ, ভক্তি অথবা ব্রহ্মতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব প্রকৃতি-পুরুষ—এত সব গম্ভীর আলোচনার মধ্যে যাব না। আমার বক্তব্য অতি সামান্য। গীতা আরম্ভের মোদ্দা কথা হল, অর্জুন যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তে আত্মীয়স্বজন দেখে মমতায় ভেঙে পড়েছেন। আর ‘ভগবান রূপে’ চিহ্নিত মানুষটি তাঁকে তাৎক্ষণিক কর্তব্য উপদেশ করে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করছেন। তাঁর উপদেশের প্রধান তাৎপর্য হল মানুষকে আপন কর্মে প্রবৃত্ত করা। তবে হ্যাঁ, এই কর্মের একটা দার্শনিক তাৎপর্যও আছে। অর্থাৎ কাজটা করতে হবে বটে, তবে তাতে লিপ্ত হওয়া চলবে না। খুব সোজা করে বলতে গেলে ব্যাপারটা এইরকম দাঁড়ায়—যেমন সংসারের নিয়ম অনুসারে তুমি বিয়ে করতে পারে বটে, কিন্তু তাই বলে তুমি রমণীর রমণীয় গুণে মুগ্ধ হয়ে ভোগে লিপ্ত হবে না। সন্তানকে উপযুক্তভাবে মানুষ করা তোমার কর্তব্য বটে, কিন্তু স্নেহে মমতায় তুমি যেন অন্ধ হয়ে যেয়ো না। এইরকম আরও কতই না উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু নির্লিপ্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ দিয়েছেন বোধহয় রামকৃষ্ণদেব—তুমি পাঁকাল মাছের মতো থাকো।

বলতে পারেন—এ বড় ‘প্যারাডক্সিক্যাল কথাবার্তা’। কিন্তু আমাদের দার্শনিক-মন এই ‘প্যারাডক্স’ বুঝতে সাহায্য করে। বস্তুত এই নিষ্কাম কর্মের পরিণতিই হল বিশুদ্ধ জ্ঞান, যোগ, ভক্তি। সব কিছুর মূল ভিত্তি ওই নিষ্কাম কর্ম। আমি আর কোনও কঠিন কথার মধ্যে যাচ্ছি না। কিন্তু জ্ঞান, যোগ, ভক্তি—এত সব বিশিষ্ট দার্শনিক উপদেশের শেষেও একেবারে অষ্টাদশ অধ্যায়ে এসে গীতার শিক্ষককে বলতে হচ্ছে—যিনি সমস্ত বিষয়ে অনাসক্ত, জিতেন্দ্রিয় এবং নিস্পৃহ তিনিই কাজটা করতে পারেন কর্মফলের আশা না করে—অসক্তবুদ্ধিঃ সর্বত্র জিহ্বা বিগতস্পৃহঃ। বস্তুত অনাসক্ত হয়ে আপন কাজটি করার কথাটাই ভগবদ্‌গীতার মূল সুর, যে সুর জ্ঞান, ব্রহ্মতত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, ক্ষেত্ৰ-ক্ষেত্রজ্ঞ—ইত্যাদি বিভিন্ন কূট দার্শনিক-তত্ত্বের মধ্যেও মাঝে মাঝেই আমাদের সচেতন করে বলেছে—তুমি শুধু কাজটাই করতে পারো, কাজের ফলে তোমার যেন আঠা না থাকে। অর্থাৎ সংসারের শত কর্মে আবৃত থেকেও নিজেকে দূরে সরিয়ে আলাদা করে রাখা—এই অসংসৃষ্ট নির্লিপ্ত ভাবটিই গীতার মুখ্য উপদেশ—অসক্তবুদ্ধিঃ সর্বত্র।

অর্জুনের প্রতি গীতার শিক্ষকের এই উপদেশের নিরিখে আমি খুব জোর দিয়ে বলতে চাই যে, অর্জুনের আপন স্বভাবের মধ্যেই গীতার এই নির্লিপ্তবুদ্ধির বীজ ছিল। হয়তো সেইজন্যই গীতার উপদেশের পূর্বাহ্নেই তিনি এই উপদেশের একমাত্র উপযুক্ত আধার বিবেচিত হয়েছিলেন। হ্যাঁ, বিরাট রণক্ষেত্রে আত্ময়স্বজনের সামনে অর্জুনের বুদ্ধি বিচলিত হয়েছিল বটে এবং হ্যাঁ, এইরকম বিচলন তাঁর জীবনে আরও কয়েকবার ঘটেছে। তাতে কিন্তু প্রমাণ হয় না যে, অর্জুনের স্বভাব নির্লিপ্ততার বিরোধী ছিল। অন্তত দার্শনিকভাবে যে নির্লিপ্ততার কথা আমরা বলেছি, মনুষ্যজীবনের নানান সংবেদনশীলতায় অর্জুন হয়তো সেখানে প্রাথমিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছেন। কিন্তু এই দুর্বলতাও তো মানুষের ধর্মে, সমাজের ধর্মে একান্ত কাঙিক্ষত বস্তু। মায়া, মোহ, মমতা, স্নেহ এমনকী চরম শত্রুতাও বড় মানুষকে একান্ত মনুষ্যোচিতভাবেই বিচলিত করে। কিন্তু এই বিচলন-যুক্তির সিদ্ধিতে কাটিয়ে উঠে যিনি দার্শনিকের বিচারে নিজেকে আস্তে আস্তে ঘটনার পরম্পরা থেকে মুক্ত করতে পারেন, তিনি অর্জুন। জীবনের ধর্ম এবং দার্শনিকের নির্লিপ্ততা অর্জুনের জীবনে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে তাঁর দার্শনিক-সত্তাটি খুঁজে বার করা বড় কঠিন হয়ে পড়ে। এই যেমন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাঙ্‌মুহূর্তে যে ঘটনাটা ঘটল—অর্থাৎ অর্জুন যুদ্ধ করতে চাইছেন না—এই ঘটনাটাই আরেকবার ধরুন না।

আত্মীয়স্বজনকে সামনে দেখে তিনি যে ভীষণভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেন, এর মধ্যেও আমার মতে এক চরম নিরাসক্তি আছে। আপনারা ভাবুন, অন্যের তরফ থেকে কত সামান্য বিদ্বেষ, কত সামান্য শত্রুতাও আমরা কত দিন মনে রাখি। অথচ সারা জীবন বঞ্চিত হয়ে—তাও কি অর্জুনের মতো মহাবীর, যিনি ইচ্ছে করলেই অনেক কিছু স্বেচ্ছায় সংগ্রহ করতে পারতেন—সেই অর্জুন সমস্ত জীবন ধরে জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠিরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং দুর্যোধনের দ্বারা চরম-শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হলেন। শত্রুতার লিপ্তি বন্ধুত্বের চেয়ে হাজার গুণ বেশি, যে কারণে নিরবচ্ছিন্ন শত্রু-ভাবনায় ভগবানকে পর্যন্ত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়। আর কে না জানে—জীবনের শত্রুকে হাতের সামনে পেয়ে তাকে চরম তৎপরতায় আঘাত হানাটাই স্বাভাবিক নিয়ম। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে দাঁড়িয়ে অর্জুন কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মের পথে চললেন না। তিনি শত্রুর প্রতি কৃপাবিষ্ট হলেন, তাঁর চোখে জল এল, মন হয়ে উঠল উদাসীন—এই রাজ্য, এই সুখ, এই জীবন নিয়ে আমি কী করব? যাদের জন্য বাঁচা, তাঁরা সবাই তো মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে—কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ, কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।

আমার জিজ্ঞাসা—দুর্যোধন এবং দুর্যোধনপক্ষের প্রতি পাণ্ডবপক্ষের জ্ঞাতি-শত্রুতার নিরিখে অর্জুনের এই ভাবটাও কি চরম নির্লিপ্ততা নয়? শত্রুকে সামনে পেয়েও এই যে উদাসীন আচরণ করছেন অর্জুন—একে দুর্বলতা অথবা মায়া-মমতা না বলে অনাসক্তি বলাই ভাল। পরবর্তীকালে অধ্যায়ের পর অধ্যায় ধরে যে চরম নিরাসক্তির উপদেশ দেওয়া হবে, যুদ্ধকালীন প্রত্যাঘাতের পূর্ব-মুহূর্তে সেই নিরাসক্তি অদ্ভুতভাবে অর্জুনের মধ্যে ফুটে উঠেছে বলেই গীতার কথকঠাকুর তাঁকে গীতার দার্শনিক-তত্ত্ব শ্রবণের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকারী বলে মনে করেছেন। হ্যাঁ, আপাতদৃষ্টিতে আমরা যাকে অর্জুনের দুর্বলতা বা মমতা বলছি, আমাদের সাধারণ মন্দবুদ্ধি প্রসন্ন করার জন্য গীতার শিক্ষকও তাকে ক্লীবত্ব বা হৃদয়ের দুর্বলতাই বলেছেন। কিন্তু অর্জুনের সামগ্রিক জীবনের বিভিন্ন বিষম-পরিস্থিতিগুলি পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে যে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পূর্বাহ্নে অর্জুন কৃষ্ণের কাছে গীতোক্ত ধর্ম শ্রবণের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আধার বলে বিবেচিত হয়েছেন। সেদিন ওই চরম মুহূর্তে অর্জুনের কাছে জয়-পরাজয়, লাভ-অলাভ, সুখ-দুঃখ—এই দ্বন্দ্বাত্মক বস্তুগুলির সমতা সম্পন্ন হয়েছিল বলেই কৃষ্ণ তাঁকে ফলের ভাবনা না করে আপন ক্ষত্রিয়োচিত কর্তব্যে প্রবৃত্ত হওয়ার উপদেশ দিতে পেরেছিলেন।

বেদান্তসূত্রের টীকাকার লিখেছেন—যে বিষয়ে কোনও ধারণাই নেই অথবা যে বিষয়ে পূর্ণ জ্ঞান আছে, সেখানে জিজ্ঞাসা হয় না। জিজ্ঞাসা তখনই হয়, যখন বিষয় সম্বন্ধে খানিকটা ধারণা আছে, কিন্তু সম্পূর্ণ ধারণা নেই—কিঞ্চিদ্‌ জ্ঞাতে, কিঞ্চিদজ্ঞাতে জিজ্ঞাসা ভবতি। অর্জুন যে মুহূর্তে ধনুক-বাণ ছেড়ে দিয়ে কৃষ্ণকে বললেন—আপনি আমাকে শিক্ষা দিন, যাতে আমার ভাল হয়—সেই মুহুর্তেই আমরা জানি গীতোক্ত তত্ত্ব সম্বন্ধে পূর্বাহ্নেই অর্জুনের কিছু জ্ঞান আছে অর্থাৎ তাঁর অধিকার আছে, এখন সম্পূর্ণটা জানার অপেক্ষা।

দেখুন, গীতোক্ত ধর্মের অধিকারী নিয়ে দার্শনিক আলোচনার অবসর আর নেই। আমি এতক্ষণ এই নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি শুধু একটি কারণে। যাঁরা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধ এবং মোক্ষলিপ্সার। মাহাত্ম্য মাথায় রেখে মহাভারতের নায়ক অনুসন্ধান করেন, আমি বেল তাঁদের জানাতে চাই যে, সেটা একমাত্র যুধিষ্ঠিরের কোনও অসামান্য গুণ নয়। বরঞ্চ তাঁর থেকে অনেক বেশি দার্শনিকতা অর্জুনের মধ্যে আছে। সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় এইসব ক্ষেত্রে যে সমতাবোধ দার্শনিকের বোধ তৃপ্ত করে, সাধারণ ভাষায় তাকে একভাবে বলা যায় ‘ব্যালান্স’। অর্জুনের জীবনে প্রায় প্রতিটি কর্মে, প্রতিটি বিষয়ে ‘ব্যালান্স’ জিনিসটা এত বেশি যে, তা অনায়াসে যুধিষ্ঠিরকেও ছাপিয়ে যাবে।

ধর্ম, ধর্ম এবং ধর্ম—এই ধর্মের মাত্রা যে যুধিষ্ঠিরকে প্রতি-মুহূর্তে সোচ্চারভাবে উচ্চকিত করে রেখেছে, সেই ধর্ম অর্জুনের অন্তরেও কা ক্রিয়া করে না, যদিও এ-বিষয়ে তাঁর কণ্ঠস্বর ক্ষীণ এবং ভাষণ অল্প। ধর্মশাস্ত্রকারেরা বলেছিলেন—ধর্ম, অর্থ, কাম—এই ত্রিবর্গের ভাবনার মধ্যে যেন সমতা থাকে। এর যে কোনও একটা নিয়ে যে বেশি মাথা ঘামায় সে ব্যক্তি জঘন্য—ধর্মার্থকামাঃ সমমেব সেব্যাঃ, যো হ্যেকসক্তঃ স জনো জঘন্যঃ। আমি যুধিষ্ঠির মহারাজকে জঘন্য বলছি না, এমনকী ধর্মশাস্ত্রের ধর্ম এবং যুধিষ্ঠিরের ধর্মবোধের তফাত আছে, কিন্তু এই মহামানবের মধ্যে ধর্মানুসন্ধানের মাত্রা হয়তো এতটাই অতিরিক্ত, যা আমার মতে তাঁর নায়কত্ব-পদবীর প্রতিবন্ধক হতে পারে। কিন্তু অর্জুনের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখুন—তার মধ্যে তাঁর বীরত্ব ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত কিছুই নেই, যা তাঁকে কখনও অব্যবস্থিত করেছে। আনন্দ, দুঃখ, ক্রোধ, ঘৃণা—কোনওটাই তাঁর এমন অতিরিক্ত নয়, যা সশব্দে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বস্তুত এই অতিরিক্ততার অভাবই তাঁকে যেমন আমার কাছে মহাভারতের ধীরোদাত্ত নায়কটি করে তুলেছে, অপরদিকে এই অতিরিক্ততার অভাবই অর্জুন-চরিত্রকে দার্শনিক দিক থেকে ফলাকাঙ্ক্ষাহীন কর্মযোগের সবচেয়ে উপযুক্ত পাত্র করে তুলেছে। সম্ভবত এই কারণেই অর্থাৎ অর্জুনের এই ব্যালান্সড স্বভাবের জন্যই ভগবদ্‌গীতার শিক্ষক পর্যন্ত তাঁর শ্রোতা-শিষ্যের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে বলেন—পাণ্ডবভাইদের মধ্যে আমি অর্জুন—পাণ্ডবানাং ধনঞ্জয়ঃ। এবারে আসুন, আমরা আবার আমাদের পূর্ব প্রস্তাবে ফিরে যাই, কারণ অতি অল্পবয়স থেকেই আমরা অর্জুনের মধ্যে সেই সুনিয়ন্ত্রিত আচরণ দেখতে পাব, যা পরিণতিতে একজনকে নায়ক করে তোলে।