কুন্তী – ২

মথুরা অঞ্চলে আর্যক শূর যেখানে রাজত্ব করতেন, সে রাজত্ব খুব বড় ছিল না বটে কিন্তু সেখানে গণতান্ত্রিক নিয়ম-কানুন কিছু কিছু চলত। রাজ্যগুলি ছোট ছোট ‘রিপাবলিক’ বা ‘সংঘে’ বিভক্ত ছিল। কারণ যদুবংশের অধস্তন বৃষ্ণি, ভোজ, অন্ধক পুরুষেরা এই সংঘগুলিকেই নেতৃত্ব দিতেন বলে আমরা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পেয়েছি। যাই হোক আর্যক শূর এইরকমই একটা সংঘাধিপতি ছিলেন, আর কুন্তিভোজ ছিলেন অন্য একটি সংঘের অধিপতি। ছোট ছোট রাজা হলেও এঁদের সম্মান কারও কম ছিল না।

বৃষ্ণি, অন্ধক, ভোজ, কুকুর—এইগুলি একই যদুবংশের একেকজন নামী রাজার নাম। অধস্তন পুরুষেরা নিজস্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এই নাম ব্যবহারও করতেন। কুন্তীর পালক পিতা কুন্তিভোজ যেমন ভোজবংশীয়, তেমনই অত্যাচারী কংসও ছিলেন ভোজবংশীয়। কুন্তী হয়তো অভিমান করেই বলেছেন যে, তাঁর পিতা বন্ধুত্বের খাতির রাখতে গিয়ে কুন্তিভোজের কাছে তাঁকে দত্তক দিয়েছিলেন—অদাত্তু কুন্তিভোজায় সখা সখ্যে মহাত্মনে। বাস্তবে কিন্তু আর্যক শূর অর্থাৎ কুন্তীর জন্মদাতা পিতার সঙ্গে কুন্তিভোজের আত্মীয়তার বন্ধন ছিল। অন্তত আমার তাই বিশ্বাস।

রাজা শূরের আপন পিসতুতো ভাই হলেন এই কুন্তিভোজ। খিল হরিবংশ থেকে জানতে পারছি—শূরের প্রথম ছেলে নাকি কৃষ্ণপিতা বসুদেব— বসুদেবো মহাবাহুঃ পূর্বম্‌ আনকদুন্দুভিঃ। তারপর নাকি তাঁর আরও কয়টি ছেলে এবং একেবারে শেষে পাঁচটি মেয়ে জন্মাল—যাঁদের একজন হলেন কুন্তী। সাধারণত মানুষের ঘরে এমন সুশৃঙ্খলভাবে প্রথমে সবচেয়ে গুণশালী পুত্রটি, তারপর কতগুলি এলেবেলে এবং তারও পরে ‘লাইন’ দিয়ে কতগুলি মেয়ে—এরকম হয় না বলেই সন্দেহ হয় যে, হরিবংশের লেখক-ঠাকুর কৃষ্ণের পিতা বসুদেবের মাহাত্ম্যে আর্যক শূরের সন্তানদের সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়েছেন। বাস্তব ছিল অন্যরকম।

হরিবংশের প্রমাণে এটা আমরা প্রথমে স্বীকার করে নেব যে, বৃষ্ণি-সংঘের নেতা-রাজা আর্যক শূর বিয়ে করেছিলেন তাঁদেরই পালটি ঘর ভোজবংশের মেয়েকে। আবার ওই কুন্তিভোজও ছিলেন ভোজদেরই ছেলে। ঠিক এইখানটায় আমাদের মহাভারতের কবিকে স্মরণ করতে হবে। মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ থেকে আমরা জানতে পারি যে, কুন্তিভোজ ছিলেন রাজা শূরের আপন পিসতুতো ভাই। তাঁর ছেলে-পিলে ছিল না এবং হরিবংশ জানাচ্ছে—তাঁর অনেক বয়সও হয়ে যাচ্ছিল—শূরঃ পূজ্যায় বৃদ্ধায় কুন্তিভোজায় তাং দদৌ।

আর্যক শূরের ভোজদের ব্যাপারে একটু টান বেশি ছিল। নিজের স্ত্রী ভোজ-ঘরের, পিসির বিয়ে হয়েছে ভোজ-বাড়িতে আবার তাঁর প্রিয় পুত্র বসুদেব—ভবিষ্যতে যিনি কৃষ্ণের পিতা হবেন—তিনিও লালিত-পালিত হয়েছেন ভোজদের বাড়িতে। ভোজ-কুলের কলঙ্ক মহারাজ কংস এক সময় বসুদেবকে গালাগালি দিয়ে বলেছিলেন—আমার বাবা তোকে মানুষ করেছে—মম পিত্রা বিবর্ধিতঃ। এই যেখানে অবস্থা সেখানে ভোজবংশীয় নিঃসন্তান কুন্তিভোজের সঙ্গে আর্যক শূরের যথেষ্ট দহরম-মহরম ছিল বলেই আমাদের অনুমান।

আসলে সাধারণ গেরস্ত বাড়িতে যা হয় এখানেও তাই হয়েছে। কুন্তিভোজ বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন অথচ এখনও তাঁর ছেলেপিলে কিছুই হল না। হয়তো এই অবস্থায় তিনি শূরকে বলেন—তোমার তো বয়স কম। বাপু হে! আমাকে তোমার একটি সন্তান মানুষ করার সু্যোগ দাও। মায়া পরবশ হয়ে আর্যক শূর তাঁকে বলেন—ঠিক আছে, আমার প্রথম যে সন্তানটি হবে, তাকেই দিয়ে দেব তোমার হাতে। হরিবংশ এ ব্যাপারে কিচ্ছুটি জানায়নি, কিন্তু মহাভারত বলেছে—আর্যক শূর রীতিমতো প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন এই কথা—অগ্ৰমগ্রে প্রতিজ্ঞায়—অর্থাৎ প্রথমে যে জন্মাবে, তাকেই দেব। আর্যক শূরের প্রথম সন্তান হল একটি মেয়ে—পৃথা। নিঃসন্তান কুন্তিভোজের ওপর মায়ায় আর্যক শূর তাঁর প্রথমা কন্যাটিকে তাঁর হাতে তুলে দিলেন—‘অগ্রজাতেতি তাং কন্যাং শূরো’নুগ্রহকাঙক্ষয়া। অদদৎ কুন্তিভোজায়… ৷৷

পরবর্তী সময়ে কুন্তী নিজের মনের জ্বালায় কুন্তিভোজের প্রতি আর্যক শূরের এই অনুকম্পা অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেছেন বটে, তবে নিজের স্বামী পাণ্ডু এবং নিজের সপত্নী মাদ্রীর পুত্রকামনার নিরিখে নিঃসন্তান পুরুষ বা রমণীর জ্বালা তাঁর বোঝা উচিত ছিল। সেটাও যে তিনি বোঝেননি, তার কারণ—সন্তান ধারণের উপায় ছিল তাঁর আপন করায়ত্ত। এতই সহজ, প্রায় খেলার মতো। সে কথা আসবে যথাসময়ে।

বোঝা গেল—কৃষ্ণপিতা বসুদেব তাঁর বাবা আর্যক শুরের প্রথম পুত্র হলেও হতে পারেন, কিন্তু প্রথম সন্তান নন। কুন্তীই সবার বড় এবং তাঁকে যেহেতু দত্তক দেওয়া হয়েছে অতএব হরিবংশে বসুদেবই হয়ে গেছেন শূরের প্রথম ছেলে অথবা প্রথম সন্তানও। মহাভারতে কিন্তু তিনি ‘অগ্রজাতা এবং সে কথা কুন্তী যথেষ্টই জানতেন বলে মনে হয়। কেননা, স্বয়ং কুন্তিভোজও একথা লুকোননি। মহারাজ আর্যক শুরের প্রথম সন্তানের গৌরব, বসুদেবের মতো বিশাল পুরুষের ভগিনী হওয়ার গৌরব—কোনওটাই কুন্তিভোজ পৃথা (কুন্তী)-র কাছে লুকোননি। হয়তো সেই কারণেই কুন্তীর অভিমানটাও থেকেই গেছে। আর্যক শূরের প্রথমা কন্যাটিকে দত্তক নিয়েও রাজা কুন্তিভোজ যে তাঁকে সম্পূর্ণ আত্মসাৎ করেননি বা করতে পারেননি, সেই কারণেই জন্মদাতা পিতা সম্বন্ধে কুন্তীর সচেতনতা এবং অভিমান—দুইই থেকে গেছে।

দত্তক কন্যা হিসেবে পৃথা যেদিন মহারাজ কুন্তিভোজের বাড়িতে এলেন, তখন তিনি নেহাতই শিশু। এই রাজ্যে এসে তাঁর খারাপ লাগার মতো কিছু ছিল না। রাজা কুন্তিভোজ পরম আহ্লাদে তাঁর এই নতুন-পাওয়া মেয়েকে মানুষ করছিলেন। কোনও কিছুরই অভাব নেই এবং আস্তে আস্তে শূর-দুহিতা পৃথা কুন্তীতে পরিণত হলেন। কথাটা বললাম এই জন্য যে, কুন্তিভোজের পালন-পোষণে তাঁর নামটাই শুধু পালটে যায়নি, তিনি কুন্তিভোজের বাড়ির আচার-আচরণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলেন। মেয়েদের যেহেতু শ্বশূরবাড়িতে স্বামীর ঘর করতে হয়, তাই নিজেকে পালটানোর বীজটা তাদের মধ্যে বুঝি থেকেই যায়। আর কুন্তী যেহেতু শিশুকালেই চলে-এসেছেন অন্য এক বাড়িতে তাই পরিবর্তন সইয়ে নিতে তাঁর সময় লাগেনি। শৈশব পেরিয়ে কুন্তীর শরীর থেকে কৈশোরের গন্ধও যখন যাই-যাই করছে, সেই সময়ের মধ্যে ভোজবাড়ির গৃহিণীপনার দায়িত্ব প্রায় সবই তাঁর হাতে এসে গেছে। কুন্তিভোজও তাঁর ওপর অনেকটাই নির্ভর করেন।

নির্ভর করার কারণও আছে। মনু মহারাজ যতই বলুন—মেয়েরা ঘরের কাজ নিয়ে থাকবে, আয়-ব্যয় দেখবে ইত্যাদি,—বুঝলাম, সেসব কথা মেয়েদের খানিকটা ঘরে আটকে রাখার জন্য; কিন্তু মহাভারতের সমাজ মনুর নিয়ম-মতো চলত না। সেখানে মেয়েদের স্বাধীনতা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এত স্বাধীনতা সত্ত্বেও কুন্তী যে অল্প বয়সেই একেবারে ভোজবাড়ির গিন্নিটি হয়ে উঠলেন, সে বুঝি কুন্তিভোজের আস্কারায় আর অত্যধিক স্নেহে। একটা ঘটনা এই সূত্রেই বলে নিই।

কুন্তিভোজের বাড়িতে অতিথি এসেছেন দুর্বাসা মুনির। দুর্বাসা বড় কঠিন স্বভাবের মুনি। প্রখর তাঁর তেজ, বিশাল তাঁর ব্যক্তিত্ব। চেহারাটাও বেশ লম্বা-চওড়া, দর্শনীয়। মুখে দাড়ি, মাথায় জটা। তপস্যার দীপ্তি সর্বাঙ্গে। এহেন দুর্বাসা মুনি কুন্তিভোজের বাড়িতে এসে বললেন—তোমার বাড়িতে কিছুদিন ভিক্ষা গ্রহণ করতে চাই। তুমি বা তোমার বাড়ির লোকজন, আমার সঙ্গে কোনও অপ্রিয় আচরণ কোরো না—ন মে ব্যলীকং কৰ্ত্তব্যং ত্বয়া বা তব চানুগৈঃ।

দুর্বাসা নিজেকে চিনতেন। তাই কেমনভাবে তিনি থাকবেন কুন্তিভোজের বাড়িতে—তার একটা আভাস আগেভাগেই দিয়ে রাখলেন। ঋষি বললেন—আমি যেমন ইচ্ছে বাড়ি থেকে বেরব, যেমন ইচ্ছে ফিরে আসব—যথাকামঞ্চ গচ্ছেয়ম্‌ আগচ্ছেয়ং তথৈব চ—আমার অশন, আসন, শয়ন, বসন—সব কিছুই চলবে আমারই মতে। কেউ যেন আমাকে বাধা দিয়ে অপরাধী না হয়—নাপরাধ্যেত কশ্চন। অর্থাৎ আমাকে যেন কেউ ‘ডিসটার্ব’ না করে।

কেউ যেন অপরাধ না করে—মুনির এই সাবধান-বাণীর মধ্যে তাঁর স্বেচ্ছাময়তার ইঙ্গিত যত আছে, তার চেয়ে অনেক বেশি আছে সেই ব্যক্তির উদ্দেশে তাঁর ভবিষ্যৎ ক্ষমাহীনতার ইঙ্গিত—যে তাঁকে বাধা দেবে। কুন্তিভোজকে তিনি বলেই দিয়েছিলেন—আমি এইরকম স্বেচ্ছাচারে থাকব—এতে যদি তোমার অমত না থাকে তবেই এখানে থাকব, নচেৎ নয়—এবং বৎস্যামি তে গেহে যদি তে রোচতে’নঘ। দুর্বাসা মুনিকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন যে,—যদি তোমার অমত থাকে অথবা তোমার যদি পছন্দ না হয়—এই কথাগুলির কোনও মূল্য নেই। অর্থাৎ দুর্বাসার কথা শুনে কুন্তিভোজ যদি বলতেন—আপনার যেরকম নিয়ম-কানুন শুনছি, তাতে তো একটু অসুবিধেই হবে। মানে আপনি যদি একটু…।

দুর্বাসার কাছে এসব কথার ফল—অভিশাপ। আবার তাঁর কথা মতো চলে যদি অপরাধ ঘটে তারও ফল ওই অভিশাপই। তবু যদি কোনওক্রমে দুর্বাসা তুষ্ট হন এই আশায় অন্যদের মতোই কুন্তিভোজ বললেন—না, না, আপনি এসব কী বলছেন? আপনি যেভাবে থাকতে চাইবেন, সেইভাবেই থাকবেন—এবমস্তু। কুন্তিভোজ কথাটা বললেন বটে, কিন্তু বলেই এই অদ্ভুত সঙ্কটে প্রথম যাঁর কথা স্মরণ করলেন—তিনি তাঁর প্রিয় কন্যা মনস্বিনী কুন্তী। কুন্তিভোজ আগাম দুর্বাসাকে বলে বসলেন—আমার একটি বুদ্ধিমতী কন্যা আছে। নাম পৃথা। যেমন তার স্বভাব-চরিত্র, তেমনই সৎ তাঁর প্রকৃতি, দেখতেও ভারি মিষ্টি—শীলবৃত্তাম্বিতা সাধ্বী নিয়তা চৈব ভাবিনী। কুন্তিভোজ বললেন—আমার এই সর্বগুণময়ী মেয়েটি আপনার দেখাশুনো করবে। আমার ধারণা—সে আপনার অবমাননা না করে তার আপন স্বভাবেই আপনাকে তুষ্ট করতে পারবে। আমার বিশ্বাস—আপনি তুষ্ট হবেন, মুনিবর—তুষ্টিং সমুপযাস্যসি।

হয়ত দুর্বাসা দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবার বসলেন। কুন্তিভোজ মুনির সঙ্গে কথা বলে তাঁকে পা ধোয়ার জল আর বসার আসন দিয়েই মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে এলেন ভিতর-বাড়িতে। কৈশোর-গন্ধী বয়সটাকে বিদায় দিয়ে পৃথিবীর সমস্ত সরলতা নিজের চোখের মধ্যে পুঞ্জীভূত করে ডাগর-চোখে দাঁড়িয়ে ছিলেন কুন্তী-পৃথাং পৃথুললোচনাম্। কুন্তিভোজ বললেন—দুর্বাসা মুনি আমার ঘরে উপস্থিত। আমাদের এখানে তিনি কিছুদিন থাকতে চান। আমি তাতে হ্যাঁ বলেছি।। তাঁর পূজা-আরাধনা এবং তাঁর থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে তুষ্টির চরম আশ্বাস আমি তাঁকে দিয়েছি তোমারই ভরসায়—ত্বয়ি বৎসে পরাশ্বস্য ব্রাহ্মণস্যাভিরাধনম্‌। এখন আমার কথা যাতে মিথ্যে না হয়, তুমি তার ব্যবস্থা করো বাছা।

কুন্তিভোজ এইটুকু বলেই শেষ করতে পারতেন, কিন্তু দুর্বাসা মুনি যেভাবে তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিলেন, তার নিরিখে তিনি আরও কটা কথা কুন্তীকে বলার প্রয়োজন বোধ করলেন। সেকালের সমাজে তপস্যা এবং স্বাধ্যায়নিষ্ঠ ব্রাহ্মণের সম্মান ছিল বিশাল, অতএব সেই ব্রাহ্মণের তুষ্টির জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে—এমন একটা ইতিবাচক অনুজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে কুন্তিভোজ কতগুলি মানুষের অপমৃত্যুর কথা বললেন—যাঁরা ব্রাহ্মণের অবমাননা করে ওই ফল লাভ করেছে। কুন্তিভোজ স্বীকার করলেন যে, হ্যাঁ ওই হঠাৎক্রোধী, অভিশাপ-প্রবণ একজন মুনিকে তুষ্ট করার ভার কুন্তীর ওপর তিনিই ন্যস্ত করেছেন—সো’য়ং বৎসে মহাভাগ আহিতস্ত্বয়ি সাম্প্রতম্।

কুন্তিভোজ জানতেন—ব্রাহ্মণ আর দুর্বাসা মুনিতে তফাত আছে। দুর্বাসার স্বেচ্ছাময় ব্যবহার অপিচ তাঁর সাবধানবাণী সত্ত্বেও কুন্তিভোজ যে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে নিজের মেয়ে কুন্তীকে তাঁর তুষ্টি-বিধানের জন্য নিয়োগ করলেন—এর মধ্যে কিছু কিছু সচেতনতা কাজ করেছে, স্বার্থও কিছু কিছু। একেবারে আপন ঔরসজাতা কন্যাকে তিনি এভাবে নিয়োগ করতে পারতেন কিনা—তাতেও আমাদের সন্দেহ আছে। আর সেইজন্যেই কুন্তিভোজকে মেয়ের কাছে সাফাই গাইতে হচ্ছে, ব্যাখ্যা করতে হচ্ছে, এমনকী চাটুকারিতাও করতে হচ্ছে। কুন্তী বোধহয় সে-কথা বুঝতেও পারছেন। তাঁর অশান্তির বীজ এখানেই।

কুন্তিভোজ বললেন—অতিথি ব্রাহ্মণদের সৎকার করার ব্যাপারে তোমার নিষ্ঠার কথা আমি ছোটবেলা থেকেই জানি। আমার বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন ঘরের ভৃত্যরা—যারাই আছে, সবার প্রতি তোমার প্রীতি-ব্যবহার আমি জানি। তারাও প্রত্যেকে তোমার ব্যবহারে তুষ্ট। লোক-ব্যবহারের এইসব ক্ষেত্রে তুমি সর্বত্র তোমার উপস্থিতি প্রমাণ করেছ অর্থাৎ তুমিই সর্বত্র জুড়ে বসে আছ—সর্বম্‌ আবৃত্য বর্ত্তসে। তবু এখনও তুমি ছোট, এবং তুমি আমার মেয়ে—সেইজন্য ব্রাহ্মণের ক্রোধের ব্যাপারটা মাথায় রেখে আমি তোমায় শুধু খেয়াল রাখতে বলছি।

কুন্তিভোজ এখানেও শেষ করতে পারতেন। কিন্তু তা করলেন না। কিন্তু এইবারে তিনি যে কথাগুলি বললেন তার মধ্যে দত্তক পাওয়া কন্যার মধ্যে তাঁর আত্মীকরণের মাধুর্য যতখানি প্রকাশ পেয়েছে, তার আড়াল থেকে উঁকি দিয়েছে এক ধরনের সংশয়; সামান্যতম হলেও সে সংশয় কুন্তীর মনে অন্য এক প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে—যা সচেতন মনে বোঝা যায় না। একটু বুঝিয়ে বলি কথাটা, একটা বোকা-বোকা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলি।

ধরুন, একটি গৃহস্থ বাড়িতে পুত্রের কৃতিত্ব এবং অকৃতিত্বের ব্যাপার নিয়ে মা-বাবা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন। ধরুন, ছেলেটি ভাল কোনও কাজ করেছে, তখন মা ছেলেটির বাবাকে বলেন—আমার ছেলে বলে কথা, আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম না, ছেলে আমার…ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ মায়ের গলার শিরা ফুলে উঠল, গর্বে মুখ উজ্জ্বল হল। কিন্তু এই ছেলেটি যদি খারাপ কিছু করে আসে, সেদিন তার গর্ভধারিণী স্বামীকে বলবেন—এই যে, তোমার ছেলে কী করেছে শুনেছ? আগেই আমি সাবধান করেছিলাম, তোমার ছেলেকে তুমি মানুষ করো, ইত্যাদি ইত্যাদি। এইরকম একটা কথোপকথন থেকে—বংশের ধারা যাবে কোথায়, যেমন বাপ তেমনই ছেলে—ইত্যাদি অসংখ্য গার্হস্থ্য এবং দাম্পত্য প্রবাদ আমি বহুত্র শুনেছি। অর্থাৎ এক একটা সময় আসে যখন মা কিংবা বাবা পুত্র-কন্যাকে আপোসে ‘disown’ করেন। সাধারণ জীবনে দৈনন্দিনতার গড্ডলিকাপ্রবাহে এইসব কথোপকথন বড় বেশি মনস্তাপ ঘটায় না। বাবা-মার মনেও না, পুত্র-কন্যার মনেও না। কিন্তু পুত্র-কন্যার জীবন যদি সরল না হয়, তা যদি বাঁধাধরা গতানুগতিকতার বাইরে হয়, তবে বাবা-মায়ের সাধারণ কথাও অনাত্মীকরণের বীজ বপন করতে পারে পুত্র-কন্যার মনে। আমরা এবার কুন্তিভোজের কথায় ফিরে আসব।

কুন্তিভোজ বললেন—প্রসিদ্ধ বৃষ্ণিদেব বংশে তুমি জন্মেছ। মহারাজ শূরের তুমি প্রথম মেয়ে মহামতি বসুদেবের ভগিনী তুমি। তোমার জন্মদাতা পিতা শূর প্রতিজ্ঞা করে বলেছিলেন যে, তাঁর অগ্রজাতা প্রথম কন্যাটিকে আমার হাতেই তুলে দেবেন তিনি। তিনি কথা রেখেছেন, তিনি সানন্দে তাঁর কন্যাটিকে আমার হাতে তুলে দিয়েছেন—দত্তা প্রীতিমতা মহ্যং পিত্রা বালা পুরা স্বয়ম্‌—সেই জন্যই আজ তুমি আমার মেয়ে।

বাবা হয়ে সানন্দে নিজের কন্যাকে তুলে দিয়েছেন অন্যের হাতে! যত বন্ধুই হন, তবু সানন্দে? কুন্তীর মনে খট করে বাজল না তো? কুন্তিভোজ বললেন—যেমন প্রসিদ্ধ কুলে তুমি জন্মেছ, তেমনই প্রসিদ্ধ কুলে তুমি বড় হয়েছ। এক সুখ থেকে আরেক সুখ, এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদে এসে পড়েছ— সুখাৎ সুখম্‌ অনুপ্রাপ্তা হ্রদাৎ হ্রদমিবাগতা। এই উপমাটি একেবারে প্রসিদ্ধ মহাকাব্যের উপমা। মহাভারতে এটি বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে— যখন এক রাজবাড়ির মেয়ের বিয়ে হয়েছে আরেক রাজবাড়িতে। কুন্তিভোজ সেই উপমাটি নিজের অজান্তেই ব্যবহার করে ফেললেন। কিন্তু শৈশবের পরিচিত বাবা-মাকে ছেড়ে অন্য বাড়িতে, অন্য বাবা-মার কাছে মানুষ হওয়ার কী সুখ—তা কুন্তীই শুধু জানেন। অন্যদিকে কুন্তিভোজ জানেন শুধু রাজবাড়ির সাজাত্য।

সে যাই হোক, এক কুল থেকে আরেক কুলে, এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদে এসে কুন্তীর না হয় বড় সুখই হল, কিন্তু কুন্তিভোজ এবার কী বলছেন? বলছেন—জান তো, মন্দ এবং নীচ বংশের মেয়েদের যদি খানিকটা আচার-নিয়মের মধ্যে রাখা যায় তবে তারা চপলতাবশত যা করা উচিত নয়, তাই করে ফেলে—দৌষ্কলেয়া বিশেষেণ কথঞ্চিৎ প্রগ্রহং গতাঃ। বালভাবাদ্‌ বিকুর্বন্তি প্রায়শঃ প্রমদাঃ শুভে।

হঠাৎ এই কথাটা কেন? কুন্তিভোজ যা বলেছেন, তার অর্থ যদি একান্তই সরল-সোজা হয় তবে কিছুই বলার নেই। কিন্তু মুশকিল হল, নৈষধের কবি শ্রীহর্ষ লিখেছেন—কাব্য-সাহিত্যে এত যে ব্যঞ্জনার ছড়াছড়ি তার মূল নাকি বিদগ্ধা রমণীদের বাচনভঙ্গী—বিদগ্ধনারীবচনং তদাকরঃ। কাজেই কুন্তিভোজ যতই সোজা-সরলভাবেই কথাটা বলুন না কেন, মহাভারতের অন্যতমা নায়িকা কথাটার মধ্যে একটা ইঙ্গিত খুঁজে পেতে পারেন। ভাবতে পারেন—হঠাৎ করে এই মন্দ বংশের কথাটা এল কেন? নিয়ম আচারের শৃঙ্খলের মধ্যে থেকে চপলতা যদি কিছু ঘটে, তা হলে দোষ হবে বংশের, যে বংশে তিনি জন্মেছেন সেই বংশের দোষ হবে। অর্থাৎ এখন বৃষ্ণিকুলকে যতই ভাল-ভাল বলুন, তেমন তেমন কিছু ঘটলে কুন্তিভোজ অনাত্মীকরণের সুযোগ ছাড়বেন না। অর্থাৎ তিনি ‘disown’ করবেন।

কুন্তিভোজ দুর্বাসাকে তুষ্ট করার জন্য এক লহমার মধ্যে কুন্তীকে স্মরণ করেছেন বটে, কিন্তু আরও একটা সমস্যা তাঁর ছিল, যে সমস্যার কথা তিনি ঘুরিয়ে বলেছেন কুন্তীকে। বলেছেন—পৃথা! রাজকুলে তোমার জন্ম, দেখতেও তুমি ভারী সুন্দর—পৃথে রাজকুলে জন্ম রূপং চাপি তবাদ্ভুতম্‌—তুমি যেন সেই বংশের অভিমান, রূপের অভিমান ত্যাগ করে দুর্বাসার সেবা কোরো। তাতে তোমারও মঙ্গল, আমারও। মুনি যদি ক্রুদ্ধ হন তা হলে আমার বংশ ছারখার হয়ে যাবে—কৃৎস্নং দহ্যেত মে কুলম্।

বোঝা যাচ্ছে, কুন্তিভোজ অনেক দায়িত্ব দিয়ে দিলেন কুন্তীকে, একেবারে শুষ্ক দায়িত্ব। তিনি একবারও বললেন না—অন্যথা কিছু ঘটলে—তুমি আমার মেয়ে, আমার সম্মান যাবে। বললেন—পৃথা! অর্থাৎ সেই শূর বংশের নাম—পৃথা! তোমার জন্ম রাজকুলে অর্থাৎ সেই রাজবংশের মেয়ে হয়েও অন্য কিছু ঘটলে আমার বংশ ছারখার হয়ে যাবে।

কুন্তী সব বোঝেন, সমস্ত ইঙ্গিত বোঝেন। কুন্তিভোজ তাঁকে মহারাজ শূরের মেয়ে, বসুদেবের ভগিনী বলে যতখানি চাটুকারিতা করেছেন, আমি বুঝি—এসব কিছুর থেকেও বড়—তিনি কৃষ্ণের পিসি। নৈষধে-বলা সেই বিদগ্ধা রমণীদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্যা। হায়! কুন্তিভোজ যদি তাঁর কথার ইঙ্গিতগুলি বুঝতে পারতেন? অথবা তিনি সবই বুঝেছেন।

কুন্তী প্রিয়তম সম্বোধনে ‘বাবা’ বলে কথা আরম্ভ করলেন না। কুন্তিভোজের মুখে শূর-নন্দিনী ‘পৃথা’ সম্বোধনের উত্তরে কুন্তীর ভিতর থেকে জবাব দিলেন পৃথা। বললেন—রাজেন্দ্র! এই সম্বোধনের মধ্যে পিতার অভীপ্সাপূরণে কন্যার স্নেহ-যন্ত্রণা নেই, আছে—রাজার আদেশে রাজকর্মচারীর কর্ম-তৎপরতা, রাজার ইচ্ছায় প্রজার ইতিকর্তব্য পালন। এখন এই বয়সে বুঝতে পারি মহাকাব্যের কবিদের এই সব শব্দ-ব্যঞ্জনা কত গভীর করে বুঝেছিলেন কালিদাস। লোক-রঞ্জক রামের আদেশে লক্ষ্মণ যখন সীতাকে রেখে এলেন বাল্মীকির তপোবনে, তখন সীতাও এই সম্বোধনেই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন—লক্ষ্মণ! সেই রাজা রামচন্দ্রকে বোলো—বাচ্যস্ত্বয়া মদ্‌বচনাৎ স রাজা—এই গর্ভাবস্থায় অনুরক্তা স্ত্রীকে যে তিনি বিসর্জন দিলেন, সে কী তাঁর যশেরই উপযুক্ত হল, না বংশ মর্যাদার উপযুক্ত হল?

এখানেও সেই বংশ-মর্যাদা আর যশোরক্ষার প্রশ্ন এসেছে সদ্য যৌবনবতী কুন্তীর তথাকথিত কন্যাত্বের মূল্যে। কুন্তী তাই কন্যাজনোচিত মমতায় জবাব দিতে পারছেন না। তিনি বললেন-রাজেন্দ্র! আচার-নিয়ম-নিষ্ঠ ব্রাহ্মণকে আমি নিশ্চয়ই সৎকার করব। তুমি যেমনটি তাঁকে কথা দিয়েছ রাজা, আমি সেইভাবেই কাজ করব। ব্রাহ্মণ-অতিথি ঘরে এসেছেন, তাঁকে উপযুক্ত মর্যাদায় সৎকার করা আমাদের চিরকালের ‘স্বভাব’। এতে যে তোমার ঈপ্সিত প্রিয় কার্য করা হবে অথবা আমার মঙ্গল হবে, সে আমার বাড়তি পাওনা—তব চৈব প্রিয়ং কাৰ্য্যং শ্রেয়শ্চ পরমং মম। এখানে ‘স্বভাব’ শব্দটি এবং সংস্কৃতে দুটি ‘চ’-এর প্রয়োগ লক্ষণীয়।

কুন্তী রাজা কুন্তিভোজকে সম্পূর্ণ অভয় দিয়ে বললেন—অতিথি ঋষি সকাল, বিকেল, মাঝরাতে যখন ইচ্ছে ঘরে ফিরুন, আমার ওপরে তাঁর রাগ করার কোনও কারণ ঘটবে না। তোমার আদেশমতো বামুন-ঠাকুরকে সৎকার করার সুযোগ পাচ্ছি—এতে তো আমারই লাভ, রাজা—লাভো মমৈষ রাজেন্দ্র। ‘আদেশ’ এবং ‘রাজেন্দ্র’ শব্দটি পুনশ্চ লক্ষণীয়। পাঠক, মাথায় রাখবেন—এর পরের কথাগুলোও।

কুন্তী বললেন—তুমি নিশ্চিন্তে থাকো, ‘রাজা’—বিশ্রব্ধো ভব রাজেন্দ্র—তোমার বাড়িতে থেকে বামুন-ঠাকুরের কোনও অসন্তোষ ঘটবে না। আমি আমার যথাসাধ্য করব, রাজা! অন্তত আমার জন্য তুমি অতিথি-ব্রাহ্মণের কাছ থেকে যে কোনও ব্যথা পাবে না—সে কথা আমি হলফ করে বলতে পারি—ন মৎকৃতে ব্যথাং রাজন্‌ প্রাপ্স্যসি দ্বিজসত্তমাৎ।

কুন্তীর ভাষণ ছিল অনেকটাই। কিন্তু সম্পূর্ণ বক্তব্যের মধ্যে ‘রাজন্‌’, ‘রাজেন্দ্র’, ‘নরোত্তম’, ‘নরেন্দ্র’—এই সম্বোধনগুলি পিতৃসম্বোধনের প্রতিতুলনায় আমার কাছে বড় বেশি লক্ষণীয় মনে হয়েছে। তা ছাড়া শেষ বাক্যে পরম আশ্বস্ত কুন্তিভোজও এই বিদগ্ধা রমণীকে পিতৃত্বের মাধুর্যে অভিষিক্ত করেননি। কুন্তীকে তিনি জড়িয়ে ধরেছেন তাঁর আপন আদেশ সমর্থনের আনন্দে—পরিষ্বজ্য সমর্থ চ। বলেছেন—তা হলে এই করতে হবে, ওই করতে হবে ইত্যাদি। সৌজন্যের চূড়ান্ত করে আরও বলেছেন—ভদ্রে! আমার ভালর জন্য, তোমার নিজের ভালর জন্য এবং আমার বংশের ভালর জন্যও এই যেমন কথা হল, তেমনটিই কোরো—এমবেতৎ ত্বয়া ভদ্রে কৰ্ত্তব্যম্‌ অবিশঙ্কয়া।

কথা শেষ করে কুন্তিভোজ মেয়েকে নিয়ে উপস্থিত হলেন দুর্বাসার কাছে। বললেন—ঋষিমশাই! এই আমার মেয়ে। ভুল করে যদি বা অজ্ঞানে কোনও অপরাধ করে ফেলে, তা হলে মনে রাখবেন না সেটা।

দুর্বাসার জন্য আলাদা ঘর ঠিক হল একটা। রাজার দুলালী পৃথা, নাকি কুন্তী, রাজবাড়ির অভিমান ত্যাগ করে, নিদ্রালস্য ত্যাগ করে সেই বাড়িতেই তাঁর স্নান-আহারের যত্ন-আত্তি করতে লাগলেন। নিজেকে বেঁধে ফেললেন কড়া নিয়মে, অবগুণ্ঠন রইল শুচিতার। মুনিকে নিয়ে জ্বালা কম নয়। এই তিনি বলে গেলেন—আমি সকালে ফিরব, কিন্তু ফিরে এলেন সন্ধ্যাবেলায় বা রাত্রে। হয়তো সারা বেলা কুন্তী তাঁর জন্য খাবার-দাবার সাজিয়ে বসে থাকলেন। মনে রাগ নেই, ক্ষোভ নেই, মুখে নেই অপ্রিয় কোনও শব্দ। এর মধ্যে যেটা বেড়েই চলেছিল, সেটা নিত্যনতুন ব্যঞ্জনের বাহার। দুর্বাসা অবশ্য এতেই ছেড়ে দিতেন না। হয়তো তিনি বাড়ি এসে দুর্লভ কোনও উপকরণের নাম করে বললেন—এই খাবারটার ব্যবস্থা করোনি? জোগাড় করো, তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো—সুদুর্লভমপি হ্যন্নং দীয়তামিতি সো’ব্রবীৎ। তারপর সবিস্ময়ে মুনি লক্ষ করতেন তাঁর বলার আগেই সে খাবার তৈরি আছে—কৃতমেব চ তৎ সর্বম্।

নিজের নাটকে এক চরম মুহূর্তে নাটকীয়তা ঘনিয়ে আনার জন্য মহাকবি কালিদাস দুর্বাসা মুনির ক্রোধের অংশটুকু ব্যবহার করেছেন। নাটকের সখী-নায়িকার মুখ দিয়ে বলিয়েছেন—এই দুর্বাসার ক্রোধ বড় সুলভ, স্বভাবটাও তাঁর বাঁকা—এষ দুর্বাসাঃ সুলভকোপো মহর্ষিঃ। কিন্তু মহাকাব্যের এই অন্যতমা নায়িকার পরিসরে আমরা দেখলাম—কুন্তীর সেবা-পরিচর্যায় দুর্বাসা মুনি পরম সন্তুষ্ট। কুন্তী এই দুৰ্মৰ্ষণ অতিথিকে দেবতার শ্রদ্ধাটুকু দিয়েছেন কিন্তু তাঁর পরিচর্যা করেছেন—প্রিয়শিষ্যার মতো, পুত্রের মতো, বোনের মতো—শিষ্যবৎ পুত্ৰবচ্চৈব স্বসৃবচ্চ সুসংযতা। এই পরিচর্যার মধ্যে খোলা হাওয়ার মতো আরও যে এক সুমধুর অথবা স্বেচ্ছা সম্পর্কের অবকাশ ছিল, সেইখানে কুন্তী ছিলেন স্থির। ব্যাসকে তাই লিখতে হয়েছে-স্বসৃবচ্চ সুসংযতা। জীবনের প্রান্তকালে কুন্তী যখন দেবতাকল্প শ্বশুর ব্যাসদেবের কাছে নিজের সমস্ত স্থলন-পতন-ত্রুটিগুলির স্বীকারোক্তি করছেন, সেদিন আরও একটা অদ্ভুত কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন—সমস্ত শুচিতা আর শুদ্ধতা দিয়ে আমি সেই মহর্ষির সেবা করেছিলাম। আমার দিকে মহর্ষির ওপর রাগ করার মতো বড় বড় অনেক ঘটনা ছিল, কিন্তু আমি রাগ করিনি—কোপস্থানেষ্বপি মহৎস্বকুপ্যন্ন কদাচন।

ভুলে গেলে চলবে না—কুন্তী অসাধারণ রূপবতী ছিলেন। স্বয়ং কুন্তিভোজ তাঁকে তাঁর রূপ সম্বন্ধে সাবধানও করেছেন, আবার দুর্বাসার জন্য সেই রূপ ব্যবহারও করেছেন—হয়তো নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও অথবা ইচ্ছে করেই। কিন্তু একভাবে দিনের পর দিন কাছাকাছি থাকতে থাকতে, সেবা-পরিচর্যার দান-আদানের মাঝখানে দুর্বাসার শুষ্ক রুক্ষ ঋষি-হৃদয় যদি কখনও কুন্তীর প্রতি সরস হয়ে থাকে, যদি অকারণের আনন্দে কখনও চপলতা কিছু ঘটে গিয়ে থাকে তাঁর দিক থেকে—তবে আপন শুদ্ধতা আর সংযমের তেজে কুন্তী হয়তো মুনির সেই সরসতা এবং চাপল্য সযত্নে পরিহার করেছেন, নিজেকে স্থাপন করেছেন প্রিয়শিষ্যা, পুত্র অথবা ভগিনীর ব্যবহার-ভূমিতে। হয়তো ঋষির দিক থেকে এটাও একরকমের পরীক্ষা ছিল, অথবা নিরীক্ষা। অবশেষে দুর্বাসা সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হতে বাধ্য হয়েছেন। সন্তুষ্ট হয়েছেন কুন্তীর চরিত্রবলে এবং ব্যবহারেই—তস্যাস্তু শীলবৃত্তেন তুতোষ মুনিসত্তমঃ।

এক বৎসর যখন এই সেবা-পরিচর্যায় কেটে গেল, তখন মুনি খুশি হয়ে বললেন—না, কুন্তীর মধুর পরিচর্যায় সামান্যতম দোষও আমি খুঁজে পাইনি। তুমি বর চাও ভদ্রে, এমন বর, যা মানুষের পক্ষে পাওয়া দুর্লভ। এমন বর, যাতে জগতের সমস্ত সীমন্তিনী বধূদের লজ্জা দেবে তুমি। কুন্তী বললেন—আমি যা করেছি, তা আমার কর্তব্য ছিল। আপনি খুশি হয়েছেন, খুশি হয়েছেন পিতা কুন্তিভোজ, আমার আর বর চাওয়ার প্রয়োজন কী—ত্বং প্রসন্নঃ পিতা চৈব কৃতং বিপ্র বরৈর্মম। আজ থেকে এক বছর আগে রাজোচিত নির্মমতায় যে আদেশ নেমে এসেছিল কুন্তীর ওপর, তা সম্পূর্ণ নিষ্পন্ন করার পরই কুন্তী বোধহয় কুন্তিভোজকে আবার পিতা বলে ডাকলেন। এমনও হতে পারে মহর্ষির সামনে তাঁর পিতৃত্বের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করতে চাননি কুন্তী।

যাই হোক কুন্তীর নিষ্কাম ব্যবহারে দুর্বাসা বোধহয় আরও খুশি হলেন। বললেন—ঠিক আছে। বর না হয় নাই নিলে। আমি তোমাকে একটা মন্ত্র দিচ্ছি, যে মন্ত্রে যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করতে পারবে তুমি। শুধু আহ্বানই নয় এই মন্ত্রের মাধ্যমে যে দেবতাকেই তুমি ডাকবে, সেই দেবতাই তোমার বশীভূত হবেন। কামনা ছাড়াই হোক অথবা সকামভাবেই হোক এই মন্ত্রবলে যে কোনও দেবতা বাঁধা পড়বেন তোমার বাঁধনে, তিনি ব্যবহার করবেন তোমার ভৃত্যের মতো—বিবুধো মন্ত্রসংশান্তো ভবেদ্‌ ভৃত্য ইবানতঃ।

দুর্বাসার বর, বড় অদ্ভুত বর। পৃথিবীতে যৌবনবতী কুমারীর প্রাপ্য ছিল আরও কত কিছু, কিন্তু সব ছেড়ে কেন যে দুর্বাসা এই দেব-সঙ্গমের বর দিলেন কুন্তীকে—তা ভেবে পাই না। একটা কথা অবশ্য মনে হয়, যা একেবারেই ব্যক্তিগত। মনে হয়—কুন্তীর রূপ ছিল অলোকসামান্য। তার ওপরে তিনি এখন সদ্য যৌবনবতী। দিনের পর দিন একান্তে এই রূপের সংস্পর্শ ঋষি দুর্বাসাকে হয়তো বা যুগপৎ বিপন্ন এবং বিস্মিত করে তুলত, হয়তো বা তাঁর মনে জাগিয়ে তুলত কোনও অকারণ বিহ্বলতা, যাতে করে কুন্তীকে তিনি স্পর্শও করতে পারতেন না, আবার ফেলেও দিতে পারতেন না—এরে পরতে গেলে লাগে, এরে ছিঁড়তে গেলে বাজে।

সংবৎসরের শেষ কল্পে দুর্বাসা যখন বিদায় নেবার কথা ভাবছেন, তখনও কুন্তীর সম্বন্ধে সেই বিস্ময়-ব্যাকুল বিপন্নতা তাঁকে কিন্তু মোটেই উদাসীন রাখতে পারেনি। অশব্দ অস্পর্শ এক মানসিক আসঙ্গের প্রত্যুত্তরে দুর্বাসা চেয়েছেন—হয়তো প্রতিহিংসায় নয়, হয়তো অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম ঈষায় দুর্বাসা চেয়েছেন—কুন্তী যেন কোনও মর্ত্য মানুষেরই সম্পূর্ণ প্রাপণীয় না হন। পরে দেখব, তা তিনি হনওনি। এমন একটা ভাব যদি থেকে থাকে যে—আমি পেলাম না, অতএব অন্য কেউ যেন তাঁকে না পায়, তবেই কুন্তীর প্রতি দুর্বাসার এই বর আমার কাছে সযৌক্তিক হয়ে ওঠে। আরও সযৌক্তিক হয়ে ওঠে মহাভারতের কবির ব্যঞ্জনা। এমন ব্যঞ্জনা যে, শুষ্ক হৃদয় ঋষির বর দেওয়ার সময়েও মনে রাখতে হচ্ছে যে,—এমন একজনকে তিনি বর দিচ্ছেন যিনি রূপে অতুলনীয়া—ততস্তাম্‌ অনবদ্যাঙ্গীং গ্রাহয়ামাস স দ্বিজঃ। দেবলোকের বিভূতি দিয়ে দুর্বাসা কুন্তীকে দেবভোগ্যা করে রাখলেন। কুন্তীর রূপ-মাধুর্য সম্বন্ধে একেবারে নিজস্ব কোনও সচেতনতা না থাকলে এক নবযুবতীর প্রতি দেব-সঙ্গমের এই প্রসঙ্গ উত্থাপন এবং বরদান একজন বিরাগী ঋষির দিক থেকে কতখানি যুক্তিযুক্ত?

একেবারে অন্য প্রসঙ্গ হলেও না বলে পারছি না যে, দুর্বাসা মুনির কাছে সংস্কৃত মহাকাব্যের কবি থেকে নাট্যকার—সবাই যেভাবে ঋণী তাতে অন্যভাবে এই ঋষির আলাদা মর্যাদা হওয়া উচিত ছিল। পরবর্তী কালে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার মাঝখানে শুধুমাত্র দুবার্সার শাপের আমদানি করে কালিদাস যেমন নাটক জমিয়ে দিলেন, তেমনই মহাকাব্যের কবিও দুর্বাসার বরমাত্র ব্যবহার করে কুন্তীর গর্ভে মহাভারতের ভবিষ্যৎ নায়কের সম্ভাবনা তৈরি করে রাখলেন। ভারী আশ্চর্য লাগে ভাবতে—চরম একটা নাটকীয়তার জন্য—অনুকূল অথবা প্রতিকূলভাবে সেই দুর্বাসাকেই কত না ব্যবহার করেছেন মহাকবিরা। এসব কথা বলব এক সময়ে, মুনি-ঋষিদের নিয়ে আলোচনার পরিসরে।