কর্ণ – ২

মথুরা থেকে রাজা কুন্তিভোজের রাজ্যটা খুব দূরে নয়। রাজপ্রাসাদের কাছ দিয়েই বয়ে যাচ্ছে অশ্বনদী, যে নদী শেষ পর্যন্ত স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে না পেরে মিলে গিয়েছে চর্মনবতীর সঙ্গে, তারপর দুটিতে একাকার হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যমুনায়। ঠিক কুন্তীর মতো। কুন্তী কৃষ্ণের বাবা বসুদেবের নিজের বোন। কৃষ্ণের ঠাকুরদাদা শূরের সঙ্গে কুন্তিভোজের খুব বন্ধুত্ব ছিল। সেই জন্য শুরের খুব আদরের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও—শূরস্য দয়িতা সূতা—শূর কুন্তীকে খুশি মনে প্রতিজ্ঞা করে দত্তক দিয়েছিলেন কুন্তিভোজের কাছে। কাজেই বৃষ্ণিকুলের জাতিকা পৃথা, অশ্বনদীর মতো গিয়ে পড়লেন কুন্তীতভাজের ধারায়—চর্মনবতীর জলে। তারপর দুই বংশধারা একাকার হয়ে কুন্তী গিয়ে পড়লেন ভরত-বংশের বিরাট প্রবাহে, ঠিক যেন চর্মগ্বতীর মতো—যমুনায়।

আমি যে খুব কায়দা করে কুন্তীর জীবন-ধারার সঙ্গে একে একে তিনটি নদীর উপমা টেনে দিলাম, মহাভারতকার ব্যাস এতে খুশি হননি। তিনি জানতেন—যত তেজস্বিনী হন, স্ত্রী মাত্রেরই বুঝি স্বাতন্ত্র্য থাকে না। এই যে কুন্তী, রাজবংশের মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কুন্তিভোজের কাছে তাঁকে বালিকা বয়সেই দত্তক দিয়ে দেওয়া হল, তাঁর করার কিছুই ছিল না। আবার মেয়ে হয়ে জন্মানোর দরুন সমাজ-বিধি, লোকলজ্জা এগুলি যেহেতু তাঁকে মেনে চলতেই হবে, অতএব বাপের বাড়ি হোক, চাই শ্বশুরবাড়ি, নদীর মত কূল উপচানোর ক্ষমতা কুন্তীর ছিল না। তাই নদীর সঙ্গে কুন্তীর উপমা দিয়ে মহামতি ব্যাসের কাছে আমি অপরাধ করেছি। আসলে ব্যক্তিজীবনের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ যেহেতু কবির মনে জানাই আছে, তাই উপমা দেওয়ার সময়ে কবিকে সতর্ক থাকতেই হয়। আমার সে সতর্কতার দায় নেই, কিন্তু ব্যাসের আছে। অতএব বৃষ্ণিকুলের পৃথা যখন কুন্তিভোজের কুন্তী। হলেন, তখন ব্যাস বললেন, তুমি এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদে এসে পড়েছ—হ্রদাৎ হ্রদম্‌ ইবাগতা। আসলে হ্রদ গভীর হলেও, তার সীমাবদ্ধতা আছে, সে কূল উপচে পড়ে না, ঝোড়ো হাওয়া লাগুক, ক্ষণিকের বৃষ্টি হোক, প্রকৃতির বিকার তাকে নির্বিকারে সহ্য করতে হবে, ঠিক যেমন কুন্তীকে করতে হয়েছে সারা জীবন ধরে। তাঁর জীবনে কুমারী কালেই যে ঝোড়ো হাওয়া উঠেছিল, সারা জীবন ধরে সকলে অজান্তে তাঁকে যে চোখের জল ফেলতে হয়েছে, তবু তিনি হ্রদের মতো স্ত্রীসমাজের বাঁধ ভাঙতে পারেননি। কর্ণ যে কোনওকালে তাঁর নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে বেরতে পারেননি, তার কারণ কর্ণের জন্মকালে কুন্তীও তাঁর কুমারীত্বের গণ্ডী কেটে বাইরে যেতে পারেননি। এ ব্যাপারে কর্ণের অসহায়তা যতখানি, কুন্তি অসহায়তাও ততখানি। কুন্তীকে তাই যুধিষ্ঠিরের মতো দোষ দিয়ে লাভ নেই বরং তার অসহায়তার কারনটা বুঝে নিই।

ব্রাহ্মণ এসে কুন্তিভোজের রাজবাড়িতে—অমিততেজা ব্রাহ্মণ। লম্বা চেহারা, মুখে দাড়ি, মাথায় জটা, হাতে, সন্ন্যাসীর দণ্ড। দেখলে কেমন ভয় ভয় করে। ব্রাহ্মণ বললেন—তোমার ঘরেই কিছুকাল ভিক্ষে করব, রাজা। ‘তোমার বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া করব’—এই অর্থে ভিক্ষে করার কথাটা খুব বেশি পাবেন চৈতন্যচরিতামৃতে মহাপ্রভুর দৈনন্দিন খাওয়া-দাওয়ার প্রসঙ্গে। তার মানে মুনি বললেন—তোমার বাড়িতে থেকেই কিছুকাল চালাব। তবে মুনির শর্ত আছে। রাজা কিংবা তাঁর অনুচরেরা মুনির কোনও কাজে ঝামেলা করতে পারবেন না। মুনি বললেন—আমি যেমন খুশি বাইরে যাব, যেমন খুশি আসব—যথাকামঞ্চ গচ্ছেয়মাগচ্ছেয়ং তথৈব চ। কিন্তু আমার শোয়া-বসার ব্যাপারে কোনও অসুবিধে হলে চলবে না। রাজা বললেন—এবমস্ত। আমার একটি কন্যা আছে, সে সব সময় আপনার কাছে কাছে থাকবে—নিয়তং চৈব ভাবিনী। সে এমনভাবে আপনার সেবা করবে যে, আমার ধারণা—আপনি খুব খুশি হবেন—তুষ্টিং সমুপযাস্যসি। ব্রাহ্মণকে আমন্ত্রণ জানিয়ে কুন্তিভোজ এবার মেয়ের কাছে গেলেন। বললেন—মা, আমি কথা দিয়েছি তুমি এই মহাতেজস্বী ব্রাহ্মণের দেখাশোনা করবে। আমি বেশ জানি—আমার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এমনকী ঝি-চাকরকে পর্যন্ত তুমি কীরকম বশ করে রেখেছ। কাজেই এই কোপনস্বভাব মুনির কাছে যে একমাত্র তোমাকেই পাঠানো যেতে পারে কিংবা তাঁর কাজে যে একমাত্র তোমাকেই লাগানো যেতে পারে, এ ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ।

এরপরে, কী জানি কী মনে করে, কুন্তিভোজ বললেন—তুমি হলে গিয়ে বৃষ্ণিবংশের মেয়ে, আমার ঘরে এসে পড়েছ। রাজবাড়ির মেয়ে বটে, তার ওপরে যথেষ্ট সুন্দরী—রূপং চাপি তবাদ্ভুতম্‌। ব্যাপারটা কী হয় জান, বালিকাসুলভ চপলতায় মেয়েরা অনেক সময় নানান দুষ্টুমি করে বসে—বালভাবাদ্‌ বিকুর্বন্তি প্রায়শঃ প্রমদাঃ শুভে। তুমি বাপু নিজের রাজকুলের দম্ভ-মান ত্যাগ করে, রূপের গরিমা ত্যাগ করে মুনির সেবা কর। তোমার কল্যাণ হবে। কুন্তী বললেন—তুমি নিশ্চিন্ত থাক, বাবা! যেমনটি বললে, তাই হবে। ব্রাহ্মণ রাতে, দিনে, সকাল, সন্ধ্যায় যখন খুশি আসুন, আমার ওপর তিনি রাগ করার সুযোগই পাবেন না। রাজা কুন্তিভোজ পৃথাকে এবার নিয়ে গেলেন খ্যাপা দুর্বাসার কাছে। বললেন—এই আমার মেয়ে ; এই আপনার সেবা করবে। যদি কোনও অপরাধ হয়ে যায় কার্যবশে, তো আপনি সে-কথা মনে রাখবেন না—ন কাৰ্য্যঃ হৃদি তৎ তৃয়া। সুন্দরী পৃথাকে কাজের লোক পেয়ে দুবাসার পছন্দ হল। রাজা তাঁকে হাঁসের পাখনা-বোয়া, চাঁদের জ্যোৎস্না-ধোয়া একখানি শুচিশুভ্র বাড়ি দিলেন থাকার জন্যে, আর পৃথাকে দিলেন সেবাদাসী—পৃথাং পুরিদদৌ তস্মৈ দ্বিজায় দ্বিজবৎসলঃ।

সেবা আরম্ভ হল। সকালে আসব বলে দুর্বাসা বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যায় অথবা রাত্রিতে। জ্যোৎস্না-ধোয়া রাজবাড়িতে খাবার-দাবার সাজিয়ে একাকিনী পৃথা বসে থাকেন। মুনি যত ঝামেলা করতে থাকেন, খাবার-দাবার, শোয়া-বসার, তরবত তত বাড়তে থাকে। ব্রাহ্মণ গালাগালি দেন, তিরস্কার করেন, পৃথা কিছু বলেন না। এমন সময়ে এসে, এমন ঝকমারি খাবারের আয়োজন করতে বলেন দুর্বাসা যে, অন্য কেউ হলে প্রমাদ গণত—সুদুর্লভমপি হ্যন্নং দীয়তামিতি সো’ব্রবীৎ। কুন্তী বলেন—এই সব প্রস্তুত, আপনি খেতে বসুন। ব্যাসদেব, মহামতি ব্যাসদেব অত্যন্ত খেয়াল করে সম্বন্ধবিচার করে বলেছেন যে, কুন্তী পুরোদস্তুর শিষ্যের মতো, ছেলের মতো, মেয়ের মতো দুর্বাসার সেবা করে যাচ্ছিলেন। এবং তাও কীরকম? না—‘সুসংযতা’। অর্থাৎ কোথাও শিষ্য, পুত্র বা বোনের সীমা লঙ্ঘিত হয়নি—শিষ্যবং পুত্ৰচ্চৈব স্বসৃচ্চ সুসংযতা। কিন্তু সীমা লঙ্ঘনের ঘটনা হয়তো মুনির দিক থেকেই ঘটেছিল। পিতা তাঁকে দুষ্টুমি করতে বারণ করেছিলেন, কিন্তু ইন্দুধবল গৃহমধ্যে একাকিনী সেবাপরা রমণী ‘দেখিয়া’ খ্যাপা দুর্বাসা কোনও খ্যাপামি করেননি তো? কুন্তী সে কথা পরিষ্কার করে কোথাও ভাঙেননি, কিন্তু সেই একেবারে আশ্রমিক পর্বে গিয়ে কুন্তী যেখানে শ্বশুর ব্যাসের কাছে মৃত কর্ণকে একবার চোখের দেখা দেখতে চাইলেন, তখন কিন্তু প্রথমেই বলেছিলেন—আমি অত্যন্ত শুদ্ধমনে, একটুও রাগ না করে দুর্বাসার সেবা করেছিলাম, যদিও আমার দিক থেকে রাগ করবার অনেক বড় বড় কারণ ছিল অর্থাৎ ‘পয়েন্ট ছিল—কোপস্থানেষ্বপি মহৎসু।

না, আমরা এই ব্যাপার নিয়ে আর গোয়েন্দাগিরি করতে চাই না, কারণ তার চেয়েও বড় ব্যাপার ততক্ষণে ঘটে গেছে। দুর্বাসা খুশি হয়েছেন এবং বর দিতে চাইছেন। কুন্তী সবিনয়ে বললেন—আপনি খুশি হয়েছেন, বাবা খুশি হয়েছেন, আমার আর কিছু চাই না। ব্রাহ্মণ বললেন—বরই যদি না নেবে, তবে একটা মন্ত্র দেব তোমায়। এই মন্ত্রে যে দেবতাকেই তুমি কাছে ডাকবে, সেই দেবতাই তোমার বশে আসবেন, তাঁর সঙ্গে থাকতেও পাবে তুমি—তেন তেন বশো ভদ্রে স্থাতব্যং তে ভবিষ্যত! সেই দেবতা অকামই হন আর সকামই হন অর্থাৎ তাঁর ইচ্ছে থাকুক চাই না থাকুক, তোমার বশে তাঁকে থাকতেই হবে—অকামো বা সকামো বা স সমেষ্যতি তে বশে। দুর্বাসা কুন্তীর কানে মন্ত্র দিলেন। তারপর রাজাকে ডেকে বললেন—বেশ সুখেই দিন কাটল হে তোমার ঘরে, তোমার মেয়ে আমায় সুখী করেছে। মুনি চলে গেলেন।

কুন্তীর বুঝি তখন বয়ঃসন্ধির কাল। কুমারী মনের চপলতাটুকু তখনও তাঁর মন থেকে যায়নি হুমাবার যৌবনের অনুসন্ধিৎসাগুলিও জেগে উঠেছে। কুন্তী জানতেন যে, দুর্বাসার মন্ত্র আসলে ছেলে হওয়ার মন্ত্র। কিন্তু তাঁর ভিতরে যুবতী বলল—দেবতা পুরুষ নাকি তোমার বশে থাকবে। কেমন লাগে পুরুষকে বশে রাখতে? মুনি বললেন—মস্ত্র। মন্ত্র খাটে কি না খাটে, কে জানে? পরীক্ষা করে দেখলেই হয়, এক্ষুনি বোঝা যাবে—মন্ত্ৰগ্রামবলং তস্য জ্ঞাস্যে নাতিচিরাদিতি। মন্ত্রের কথা এমন করে চিন্তা করতে করতেই কুন্তী রজস্বলা হলেন—তাঁর লজ্জা হল কন্যাভাবে রজস্বলা। রাজপ্রাসাদের বিরাট ঘরে পালঙ্কের ওপর শুয়ে ছিলেন কুন্তী। জানলা দিয়ে দেখা কঠিন সকালবেলার রাঙা সূর্য, একটুও চোখে লাগে না। রাত্রি আর দিনের সন্ধিলগ্নে সন্ধ্যার লালিমা-মাখানো সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে তাঁর ভাল লাগছিল। নিমেষে তাঁর মন প্রাণ এবং দৃষ্টি একসঙ্গে নিবদ্ধ হল প্রভাতসূর্যের দিকে, তাঁর চোখের পাতা পড়ছিল না—ন চাতপ্যত রূপেণ ভানোঃ সন্ধ্যাগতস্য সা। কী যে হল প্রাতঃসন্ধ্যার মায়ায় কুন্তী বুকে হাত দিয়ে সূর্যকে কাছে ডাকলেন দুর্বাসার মন্ত্রে।

অমনি সূর্য দ্বিধা হলেন। তাঁর এক ভাগ যেমনটি পৃথিবীকে আলো দিচ্ছিল, তেমনি দিতে থাকল। আরেক ভাগ পুরুষরূপের সঙ্গে সূর্যের কিরণ মেখে মাথায় আলোর মুকুট পরে যেন দূর থেকে ডাক-পাওয়া প্রেমিকের মতো ছুটতে ছুটতে এসে পৌঁছলেন কুন্তীর কাছে—ত্বরমাণো দিবাকরঃ! হাসতে হাসতেই যেন মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে দিয়ে সূর্য বললেন—তোমার বশীকরণের ডাক শুনে তোমার বশ হতে এসেছি রানি। নাকি অবশ হতে? আগতো’ স্মি বশং ভদ্রে তব মন্ত্রবলাৎকৃতঃ। বল এখন কী করব?

কুন্তী এবার ভয় পেলেন। যৌবনের অনুসন্ধিৎসার সঙ্গেই যে ভয় মেশানো থাকে। কুন্তী বললেন—না গো, তুমি যেখান থেকে এসেছিলে সেখানে চলে যাও-গম্যতাং ভগবংস্তত্র যত এবাগতো হ্যসি। শুধু কৌতূহলে, শুধুই কৌতূহলে তোমাকে একবারের তরে কাছে ডেকেছিলাম—কৌতুহলাৎ সমাহূতঃ। তাই বলে এমন করতে হয়? তুমি চলে যাও লক্ষ্মীটি—প্রসীদ ভগবন্নিতি। সুর্যের সংলাপে এবারে একটু ‘ভিলেন’-এর কায়দা জুড়ে গেল যেন। তিনি বললেন—আমি চলে যাব ঠিকই, তবে তুমি যেভাবে বলছ, এটা ঠিক হচ্ছে না সুন্দরী। তুমি আমায় কাছে ডাকলে, অথচ এখন আমার প্রাপ্যটুকু না দিয়েই ফিরিয়ে দিচ্ছ সেটি হবে না বাপু। তা ছাড়া তোমার অভিসন্ধি আমার জানা আছে। তুমি চেয়েছিলে—সূর্যের থেকে একটি পুত্র, শৌর্যে বীর্যে তুলনাহীন এক পুত্র। তা বেশ তো, ছেলে চেয়েছ, ছেলে পাবে, কিন্তু তার আগে তো তোমার নিজেকে নিঃশেষে আমার কাছে ছেড়ে দিতে হবে সুন্দরী—সা ত্বয়া আত্মপ্রদানং বৈ কুকস্ক গজগামিনি। সত্যি কথা বলতে কি, তোমার সঙ্গে সঙ্গম সেরে, তবেই আমি যাব—তুয়া সঙ্গম্য সুস্মিতে। কুন্তী অনেক কাকুতি মিনতি করলেন, কিন্তু কুন্তীর রূপ দেখেই হোক কিংবা দুর্বাসার মন্ত্রবলে—সূর্য তখন এতই বিবশ যে, বারেবারেই তিনি এক কথা বলতে থাকলেন—নিজেকে তুমি আমার কাছে ছেড়ে দাও কন্যে—‘আত্মপ্রদানং কুরু কুন্তি কন্যে’, নইলে তোমার বাবাকে এবং তোমার সেই মন্ত্রদাতা মুনিকে—দুটোকেই ভস্ম করব আমি—ব্রাহ্মণং পিতরঞ্চ তে।

সূর্য এবার কুমারী কুন্তীকে যৌবনের রসবিলাস সম্বন্ধেও উপদেশ দিলেন কিছু। কুন্তী বুঝলেন মিলন অবশ্যম্ভাবী, পুত্র-জন্মও অবশ্যম্ভাবী। এবারে বুঝি ভাবী পুত্রটির জন্যই তাঁর মায়া হল। সমাজের নিয়মকানুন যা, তাতে যে ছেলেটিকে বিসর্জন দিতেই হবে, এ ব্যাপারেও তিনি তখনই নিশ্চিত। এবারে যে সন্তানটি তাঁকে প্রথম মাতৃত্বের আস্বাদ দেবে সেই অনাগত শিশু-জীবনের রক্ষা কল্পনায় কুন্তী সূর্যকে বললেন—তুমি যখন একান্তই মানবে না তবে হোক সেই মিলন—অস্ত মে সঙ্গমো দেব। কিন্তু সে যদি জন্মাবেই তাহলে তার জীবনরক্ষার বর্ম দাও তাকে। সে যেন বেঁচে থাকে। সূর্য বললেন—তাই হবে। সূর্যের তেজে অথবা মিলনে কুন্তী যেন এবার বিহ্বল হয়ে পড়লেন—ততঃ সা বিহবলেবাসীৎ। মিলন সেরে সূর্য বললেন—আসি তাহলে এবার। সূর্য নাকি বিনা স্পর্শেই তার সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। অথচ আমরা দেখছি, মিলনশ্রান্তা কুন্তী বিছানায় শুয়ে আছেন বিবশা লতার মতো—ভজ্যমানা লতেব। কুন্তীর সাদর মাহ্বানের মধ্যে সামান্য সাময়িক অনাদর মিশ্রিত থাকলেও সূর্য প্রেমিকের মতো অভীপ্সিত পুত্র জন্মানোর আশীর্বাদ জানিয়ে বিদায় নিলে কুন্তী ভারী লজ্জা পেলেন বারবার যাচনা করলেন—যাচমানা সলজ্জা—ঠিক তোমার মতোই যেন ছেলে হয়, তোমার মতোই রূপ, তোমার মতো শক্তি, তোমারই মত গুণ—ত্বদীয়রূপসত্ত্বৌজা ধর্মযুক্তো ভবেৎ স চ।

কুন্তীর গর্ভদশা আরম্ভ হল। তিনি কেবলই লুকিয়ে বেড়াতে লাগলেন যাতে কেউ টের না পায়। প্রতিপদের চাঁদের মত গর্ভ—এদিক ওদিক কাপড় টেনেটুনে, আলগায় আলসে কুন্তী গর্ভ লুকিয়ে রাখেন অন্যের দৃষ্টি থেকে—গর্ভং তং বিনিগূহতী। জানল শুধু একজন, রাজবাড়ির ধাই—সে ঠিক বুঝে ফেলেছে। তবে কুন্তীর কাছে সব কথা শুনে সেও কুন্তীকে রক্ষা করতে থাকল। ঠিক সময়ে কুন্তীর ছেলে হল। সোনার রঙের বর্মপরা, সোনার কুণ্ডল কানে নিয়েই কর্ণ জন্মালেন। ছেলের কাঁধটা এখনই বেশ চওড়া, চোখটা যেন সিংহের মতো একটু কটা গোছের তবে কুন্তী খুশিও হলেন খুব—ছেলে হয়েছে ঠিক বাবার মতো—যথা অস্য পিতরং তথা। এক লহমার মধ্যেই সমস্ত বিচার, তুলনা—সব শেষ। ধাত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে বেশ বড় একটি পেটিকার মধ্যে শিশু কর্ণকে শুইয়ে দিলেন কুন্তী। পেটিকার চারপাশে যেখানে সেখানে লাগিয়ে দেওয়া হল মধু, যদি কখনও একটু মুখে যায়। গভীর স্নেহে আরও একবার শিশু পুত্রের মুখ দেখে পেটিকার ঢাকনা বন্ধ করে দিলেন। তারপর ধীরে ধীরে সেই পেটিকা ভাসিয়ে দিলেন রাজ অন্তঃপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া অশ্বনদীর জলে।

নদীর জল কুন্তীর মনের সঙ্গে তাল দিয়ে চলল না। তরঙ্গে তরঙ্গে পেটিকা যতই দূরে যেতে থাকল, কন্যাকালে পুত্রজন্মের অন্যায় জেনেও কুন্তী ততই কাঁদতে থাকলেন, কারণ যে রমণী একবার পুত্ৰমুখ দেখেছে সে কন্যা হোক, সধবা হোক আর বিধবা—সে শুধু জননীর পরিচয় দিতে ভালবাসে। কিন্তু চিরকালের সমাজ যেহেতু কন্যা-জননীর হৃদয় বোঝে না, তাই অশ্বনদীর নির্জন তীরে দাঁড়িয়ে কুন্তীকে জননীর আশীর্বাদ জানাতে হয়—বাছা আমার! জন্মলগ্নেই তোকে জলে ভাসিয়ে দিলাম, জলের দেবতা তোকে বাঁচিয়ে রাখেন যেন—পাতু তুং বরুণো রাজা সলিলে সলিলেশ্বর। সর্বগামী প্রাণশক্তি বায়ু যেন তোকে নিঃশ্বাস দেয়। যে আমার কন্যাকালে মাতৃত্বের আস্বাদ দিল, তোর সেই পিতা যেন তোকে সব জায়গায় বাঁচিয়ে রাখেন। আমার কোলে ছেলে দিয়েও তোর বাবাই আজ ধন্য —তিনি আকাশ থেকে সব সময় তাঁর কিরণের চোখে দেখতে পাবেন তোকে। তুই যেখানেই থাকিস বাছা! আমি তোকে ঠিক চিনব, ওই কবচ কুণ্ডল দেখে ঠিক চিনব। অশ্বনদীর ধারায় শায়িত কর্ণের পেটিকাখানি যতই নজরের বাইরে যেতে থাকল, মাতৃত্বের দায় ততই বিদ্ধ করতে থাকল কুন্তীকে। তিনি হাহাকার করে বলতে থাকলেন—ধন্য সেই রমণী, যে তোকে পুত্র বলে কোলে তুলে নেবে। ধন্য সেই জননী, তৃষ্ণার ব্যগ্রতায় যার স্তনের দুধ খাবি তুই—যস্যাসত্বং তৃষিতঃ পুত্রঃ স্তনং পাস্যসি দেবজ। জানি না, সেই রমণী কোন চাঁদ-চুয়ানো ছেলের মুখ দেখেছিল স্বপ্নে, যে এই সূয্যিবরণ ছেলে কোলে তুলে নেবে। শিশু বয়সেই এই টানা টানা চোখ, এই প্রশস্ত ললাট, এই চুল কোনও জননীর পুত্র-কল্পনায় ছিল কি? অথচ সেই ভাগ্যবতী তোকে লালন করবে—পুত্ৰত্বে কল্পয়িযাতি। কুন্তীর মধ্যে যে জননী ছিল, সে বারবার ঈর্ষাকাতর হয়ে উঠল সেইসব রমণীদের প্রতি, যারা ধূলায় ধর এই শিশুটিকে হামাগুড়ি দিতে দেখবে—ভূমৌ সংসর্পমাণকম্‌। কুন্তী বললেন-ধন্যি তারা, যারা তোর ব্যাকুল হাসি-ভরা শিশুমুখের আধো আধো কথা শুনতে পাবে, ধন্যি তারা, যারা তাকে আস্তে আস্তে যুবকে পরিণত হতে দেখবে।

জননীমাত্রই, তাঁর বয়স যাই হোক, একইভাবে কাঁদে, একই ভাবে দুঃখ পায়, একই কল্পলোকে বাস করে। সমাজের রোষ থেকে বাঁচবার জন্য কুন্তী অনেক কেঁদে, অনেক দুঃখ বয়ে নিয়ে রাজভবনে প্রবেশ করলেন। তাঁর মন একেবারে ভারী হয়ে রইল। ওদিকে সোনার পেটিকা অশ্বনদী পেরিয়ে চর্মনবতীর জলে এসে পড়ল। চম্বলের শিলাভূমি অতিক্রম করে চমৰ্ধতী কর্ণকে পৌঁছে দিল যমুনায়। তারপর গঙ্গা। ব্যাস লিখেছেন—সোনার পেটিকাখানিই যেন মাতৃগর্ভের মতো, যে গর্ভ ধারণ করে রইল নদীমাতা—স মঞ্জষাগতো গর্ভ স্তরঙ্গৈরুহ্যমানকঃ। গঙ্গার তীরে হস্তিনাপুর কিংবা কুরুক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে চম্পা নগরী। ভাসতে ভাসতে কর্ণের গেটিকা এসে ঠেকল সেইখানে! চম্পা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী। এই সমস্ত রাজ্যই তখন হস্তিনাপরের অন্তর্ভুক্ত। তার মানে কুন্তী হস্তিনাপরে নববধু হয়ে ঢুকবার আগেই কুন্তীর ছেলে এসে পৌঁছলেন হস্তিনাপুরের এলাকায়। কর্ণের ভাবটা এই-মাগো! জলে ভাসিয়ে দেবার সময় তুমি না বলেছিলেন বাছা আমার! তোর এই কবচ আর কুণ্ডল দেখেই বিদেশেও তোকে চিনে নেব আমি—বেৎস্যামি ত্বাং বিদেশে’পি কবচেনাভিসূচিতম্‌। তা কবচ-পরা কর্ণ তোমার এইখানেই রইল, যেখানে একদিন তুমি বউ হয়ে আসবে। পিতা না হোক, যা তাঁর পিতৃভূমি হতে পারত, সেই পিতৃভূমির কুলে এসে ঠেকলেন কর্ণ—মায়ের বদলে।

ধৃতরাষ্ট্রের বন্ধু সূত অধিরথ সস্ত্রীক এসেছিলেন গঙ্গাস্নানে। সারথি জাতের মানুষ হলে কী হয় অধিরথের স্ত্রী কিন্তু সুন্দরী, দারুণ সুন্দরী—রূপেণাসদৃশী ভূবি। তাঁর নাম রাধা। যাগ-যজ্ঞ, তীর্থ, কবচ—অনেক সাধ্যসাধনা করেও রাধার ছেলে হয় না। সেই রাধা গঙ্গায় স্নান করতে নেমে দেখেন, একখানি পেটিক ভেসে আসছে ঢেউয়ের টানে, যেখানে তাঁর কাছেই। পেটিকাটি স্নান করার সঙ্গীদের দিয়ে ধরালেন তিনি, তারপর একেবারে জালাজেন স্বামী অধিরথকে, কেন না পেটিকার মধ্যে কী আছে কেউ জানে না—ভাল জিনিস যেমন থাকতে পারে, মন্দ কিছুও তেমনি থাকতে পারে। স্বয়ং অধিরথ এসে জল থেকে তুললেন পেটিকাটি, পির এটি যন্ত্র দিয়ে খুলে ফেললেন পেটিকার ঢাকনা। দেখলেন পেটিকার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে শিশু—অপশ্যত্তএ বালকম্‌। অধিরথ নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না—নতুন সূর্যের মতো গায়ের রঙ, সোনার বর্ম-পরা, সোনার কুণ্ডল-পরা দিব্য শিশু। ছেলেটিকে কোলে নিলেই এতদিনের রুদ্ধ বাৎসল্য যেন মুখর করে তুলল অধিরথকে। অধিরথ বললেন—জন্মে অবধি এমন অদ্ভুত কাণ্ড দেখিনি, পুত্রহীনকে পুত্র দিয়েছেন ভগবান। তিনি আজ মুখ তুলে চেয়েছেন। সূত অধিরথ এবার পুত্রকে তুলে দিলেন স্নেহাতুরা জননী রাধার কোলে। সূতপিতা আর সূতজননী পরম আদরে পুত্রকে লালন পালন করতে থাকলেন। ব্রাহ্মণেরা ছেলের গায়ে জন্ম থেকেই সোনার বর্ম আর কুণ্ডল দেখে অধিরথের ছেলের নামকরণ করলেন বসুষেণ। বসু মানে সোনা, সোনার ছেলে।