ভীম – ১০

১০

যুদ্ধের জন্য ভীমের একখানি রথ ছিল। দূর থেকে দেখে যাতে সেটা ভীমের রথ বলে চেনা যায়, তার জন্য একটা সোনার সিংহ আটকানো ছিল রথের ধ্বজায়—ভীম-বিক্রমের প্রতীক। সিংহের চোখে বসানো হয়েছিল বৈদুর্যমণি—সব সময় জ্বলছে। সিংহের যদি খাবার ইচ্ছে না থাকে, তবে তার সামনে দিয়ে গেলেও সে খায় না। কিন্তু সিংহের চোখ এমনই এক ঐশ্বর্যে চিহ্নিত যে তার সামনে এমনিতেই কেউ ঘুরে বেড়ায় না। কিন্তু যে ভাবছে—আমি তো নিরাপদ দূরত্বেই আছি, তার দিকেও যদি সিংহের হিংসার চক্ষুটি পড়ে তবে আর রক্ষা নেই, সে গেল। কুরুবৃদ্ধ পিতামহ যেদিন যুদ্ধের ঘোষণা করলেন, সেদিন সেই যুদ্ধারম্ভকে স্বাগত জানিয়ে কৃষ্ণের পাঞ্চজন্য, অর্জুনের দেবদত্ত অথবা যুধিষ্ঠিরের অনন্তবিজয় শঙ্খ বেজে উঠেছিল। মহাভারতের কবি এঁদের প্রত্যেকের শঙ্খ-বাদনের জন্য আধখানা করে শ্লোক নির্ধারিত করেছেন। কিন্তু ভীমের কথা যখন এল তখন আর ‘শঙ্খ’ শব্দটা শঙ্খমাত্র রইল না, সেটি মহাশঙ্খে পরিণত হল। যেমন অনার্য নাম সেই শঙ্খের তেমনই বিশাল তার আকৃতি, আর সেটাই বাজাচ্ছেন ভীম—পৌন্ড্রং দধেমী মহাশঙ্খং ভীমকর্মা বৃকোদরঃ।

আমি এই ভীম শঙ্খ-নাদকে সিংহের গর্জন বলে মনে করি। তিনি গর্জনে বুঝিয়ে দিয়েছেন—তাঁর খাদ্যের দিকে তাঁর চোখ পড়েছে, আর মুক্তি নেই। ভীষ্মের সেনাপতিত্বে যেদিন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ আরম্ভ হল, সেদিন ভীষ্মের অসম্ভব রণশক্তি দেখে যুধিষ্ঠির ভয় পেয়েছিলেন। বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন পর্যন্ত সেদিন ছিলেন নিষ্প্রভ। সৈন্যক্ষয় হয়েছে অজস্র। কিন্তু যুদ্ধের সেই প্রারম্ভিক পর্বেও যুধিষ্ঠির স্বীকার করেছেন—একমাত্র, একমাত্র ভীমই ক্ষত্রিয়ের মর্যাদা রেখে যুদ্ধ করতে পেরেছে, আর কেউ নয়—একো ভীমঃ পরং শক্ত্যা যুধ্যত্যেষ মহাভুজঃ। এর মানে অবশ্য এই নয় যে, ভীম ভীষ্ম, দ্রোণ বা কর্ণের কাছে একবারও হারেননি। যুদ্ধে হার-জিতের নিয়মে কখনও তিনি হেরেছেন আবার কখনও বা জিতেছেন। ভীষ্ম, দ্রোণ কি কর্ণ—এঁরা তাঁর লক্ষের মধ্যেও ছিলেন না। কিন্তু ভীমের সিংহচক্ষু যাঁর যাঁর ওপরে নিশ্চিতভাবে পড়েছে তাঁরা, তাঁর হাত থেকে রেহাই পাননি।

যুদ্ধারম্ভের প্রথম দিনে ভীম তাঁর বিক্রম স্পষ্ট করে দিয়েছেন এবং দ্বিতীয় দিনে সেই বিক্রম নিশ্চিত ফল প্রসব করেছে। কলিঙ্গ দেশের রাজা, রাজপুত্র এবং সৈন্যেরা, যাঁরা দুর্যোধনের পক্ষে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের মেরে ফেলাটা ছিল ভীমের যুদ্ধ-বিদ্যার গৌণ ফল। মুখ্য জিনিসটা কী অথবা যুদ্ধটা তিনি কীভাবে করবেন সেই ‘মার্শাল আর্ট’টা তিনি দেখিয়ে দিয়েছিলেন এই যুদ্ধে। ‘স্টেজে’ ‘থিয়েটার’ করা যাঁদের অভ্যাস আছে, তাঁদের কাছে চলচ্চিত্রের অভিনয় যেমন আরও সহজ হয়ে যায়, সেই রকম ভীম প্রধানত মল্লযোদ্ধা বলেই, কৌশলের নানা মারপ্যাঁচের সঙ্গে ‘ইম্‌প্রোভাইজ’ করে গদার বাড়ি বা তরোয়াল চালানোটা তিনি শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। যুদ্ধকালে ভীমের নানান গতি-কৌশল নিয়ে মহাভারতের কবিকেও দু-চার লাইন লিখতে হয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ভীমের ছুটে যাওয়ার মধ্যেও অন্তত তিন-চার রকমের কায়দা ছিল। ‘ভ্রান্তমাবিদ্ধমুদভ্রান্ত’—মল্লযুদ্ধের এইসব পারিভাষিক শব্দ আপনারা নাই বা বুঝলেন। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ছোটা বা লাফানোর ব্যাপারে ভীম যেহেতু ছিলেন অনবদ্য, তাই গদা বা তরোয়াল হাতে তিনি যেমন শেষ মারটি দিতে পারতেন তেমনই প্রতিপক্ষের শেষ মারটি বাঁচাতেও পারতেন। আবার মল্লযুদ্ধে পশ্চাত অপসরণ করাটা যেহেতু লজ্জার নয়, অতএব Two steps forward and one step back—এই গরিলা রণনীতির জোরে হঠাৎ আক্রমণ বা মল্ল পরিভাষায় ‘সম্পাত’-এর কৌশলে তিনি সমস্ত কলিঙ্গ-সৈন্যকে তাঁদের রাজার সঙ্গে যমালয়ে পাঠিয়েছিলেন।

ভীষ্মের সেনাপতিত্ব-কালে যুদ্ধের চতুর্থ দিনেই ভীম ধৃতরাষ্ট্রের আট ছেলেকে মৃত্যুর মুখ চিনিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য ধৃতরাষ্ট্রের এই পুত্রগুলিকে মেরে ফেলাটা তাঁর প্রধান লক্ষ্যগুলিতে পৌঁছবার প্রস্তুতিমাত্র। দুর্যোধনকেও তিনি এর মধ্যে কয়েকবার বাগে পেয়েছেন, তবে সেই যুদ্ধের তেমন গুরুত্ব কিছু ছিল না। সংকল্পও তেমন দৃঢ় ছিল না, ফলে দু’ পক্ষেই পতন ও মুর্ছার মধ্য দিয়ে যুদ্ধগুলি শেষ হয়েছে। তবে এও মানতে হবে যে, ভীম তাঁর শেষ লক্ষ্যে পৌঁছবার প্রস্তুতি হিসেবে ধৃতরাষ্ট্রের অন্তত পঁচিশটি পুত্রকে মহারথী ভীষ্মের সেনাপতিত্ব-কালের মধ্যেই শেষ করে দিয়েছেন। অবশ্য আর আমি এই যুদ্ধের বর্ণনায় যেতে চাই না। তার কারণ, মহাভারতের কবির অমানুষী ভাষা আমার জানা নেই এবং এককালীন ভীম-চরিত্র বর্ণনায় এই যুদ্ধের অন্তহীন বর্ণনা আমার লেখনীতে ক্লান্তিকর হয়ে পড়বে।

তবু ভীষ্মের সময়টা ছেড়ে দিয়ে আমরা যদি একলাফে দ্রোণ-পর্বে চলে আসি, তাহলে দুটো প্রধান ঘটনা আমাদের চোখে পড়বে। একটি অভিমন্যু-বধের পর-পর্যায় এবং অন্যটি দ্রোণ-বধের পর-পর্যায়। সপ্তরথী মিলে অভিমন্যুকে মারার পর পাণ্ডব-শিবিরে তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। অর্জুন জয়দ্রথ-বধের প্রতিজ্ঞা করলেন, কারণ সপ্তরথীর মারণব্যুহের প্রবেশ-পথ জয়দ্ৰথই আগলে রেখেছিলেন। জয়দ্রথকে বাঁচানোর জন্য দ্রোণাচার্য অভেদ্য দুর্গের মতো ব্যুহ রচনা করেছিলেন। কিন্তু ব্যুহ যতই অভেদ্য হোক, পাণ্ডব-পক্ষের প্রধান শক্তি অর্জুন-ভীমও তো কিছু কম নন। দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অর্জুনকে বাধা দেবার জন্য সেদিন সবাই প্রস্তুত ছিলেন, কিন্তু ভীম যে এমন কাণ্ড বাধাবেন, তা কেউ ভাবেননি। কৌরবদের স্বার্থে স্বয়ং কর্ণ নেমে এসেছিলেন ভীমকে বাধা দিতে। কিন্তু ভীমের মেজাজ সেদিন এমন তুঙ্গ পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মহারথ কর্ণ পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ভীমের কাছে।

এই যে জয়দ্রথ-বধের প্রাক্কালে অর্জুনের সহায় হিসেবে যুদ্ধের জন্য তৈরি হলেন ভীম, তখন তাঁর শ্যালক ধৃষ্টদ্যুম্নকে তিনি শুধু একটি কথাই বলেছিলেন—দ্রোণাচার্য আজ দুর্যোধনের কথা মনে রেখে যুধিষ্ঠিরকে জ্যান্ত ধরবেন বলে ঠিক করেছেন। তুমি শুধু এটা মনে রেখো অর্জুনকে জয়দ্রথ-বধে সহায়তা করার থেকেও যুধিষ্ঠিরকে বাঁচানোর কাজটা আমার কাছে অনেক বড়—যাদৃক্‌ সংরক্ষণং দ্রোণাদ্রাজ্ঞঃ কৃত্যতমং হি নঃ। শ্রদ্ধা নয়, ভোলেভালা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে ভীম যে কতখানি স্নেহ করতেন— এই সব মুহূর্তে বোঝা দায়। বড় দাদা হলে কী হবে, ধর্মবুদ্ধি থাকলে কী হবে, দাদা যে যুদ্ধে বড় কাবু, যে কোনও মুহূর্তে শত্রুপক্ষ যে তাঁকে কব্জা করে ফেলবে—এটা ভীমের বোধ ছিল। যাই হোক ধৃষ্টদ্যুম্ন যখন বললেন যে—আমার প্রাণ থাকতে যুধিষ্ঠিরকে ধরার সাধ্য নেই কারও, সেই সান্ত্বনায় নিশ্চিন্ত হয়ে ভীম চললেন অর্জুনকে সাহায্য করতে।

যুদ্ধে যাবার আগে ভীমের কিঞ্চিৎ মদ্যপানের অভ্যাস ছিল। বললে বাড়াবাড়ি হবে না—এ অভ্যাস তাঁর ছোটবেলা থেকেই। তা ছাড়া সে মদও যে ‘গৌড়ী মাধ্বী বা পৈষ্টী’র মতো অভিজাতের মদ নয়, তা বলতে আমার দ্বিধা নেই। সেই ছোটবেলায় দুর্যোধনের বিষমাখা মিষ্টি খেয়ে তিনি যে নাগলোকে পৌঁছেছিলেন, সেখানে জালা-জালা মদ খেয়ে হজম করেছিলেন তিনি। নাগেরা আপন জাতি-মর্যাদায় সে মদকে যতই অমৃতের মার্কা দিন, কিন্তু আমরা জানি নাগেরা অনার্য কৃষ্টি বহন করতেন, অতএব তাঁদের মদও মোটামুটি তাল-মার্কা বা ধেনোজাতীয়ই হবে।

এক্ষেত্রেও ভীমকে দেখছি—দাদা যুধিষ্ঠিরকে আলিঙ্গন করে দেব-দ্বিজের আশীর্বাদ নিয়েই ভালরকম যুদ্ধোন্মাদনার জন্য তিনি খানিকটা মদ্যপান করে নিলেন এবং সে মদ বেশির ভাগ সময় শিকারী ব্যাধেরা খায়—পীত্বাং কৈরাতকং মধু। এই মদ খেয়ে তাঁর শক্তি বাড়ল দ্বিগুণ, চোখটাও হয়ে উঠল যুদ্ধের উপযোগী—লাল টক্‌টকে—দ্বিগুণদ্রবিণে ধীমান্ মদবিহ্বল-লোচনঃ। ভীম যুদ্ধে চললেন।

প্রথমেই ধৃতরাষ্ট্রের দু-একটা ছেলেকে মেরে প্রকৃত যুদ্ধের প্রস্তুতি করতেই মহারথ কর্ণের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ আরম্ভ হল। ভারী আশ্চর্য, ভীম তাঁর প্রধান হাতিয়ার গদা ছেড়ে বাণ-যুদ্ধ আরম্ভ করলেন কর্ণের সঙ্গে এবং আরও আশ্চর্য কর্ণের মতো অসাধারণ যোদ্ধা ভীমের কাছে একেবারে হেরে বসলেন। যুদ্ধ জেতার সিংহ-গর্জন চলল বহুক্ষণ ধরে। ভীম অবশ্য কর্ণকে পরাজয়ের লাঞ্ছনা দিয়েই অর্জুনকে সাহায্য করার জন্য রওনা দিয়েছিলেন। কিন্তু কর্ণ দূর থেকে তাঁকে পালিয়ে যাবার দুর্নাম দিয়ে আবার ফিরিয়ে আনলেন যুদ্ধে। যুদ্ধ আরম্ভ হল এবং আবার সেই বাণ-যুদ্ধ। কর্ণ দ্বিগুণ বেগে বাণ-বর্ষণ আরম্ভ করলেন, তাঁর সুচীমুখ বাণের ফলায় ভীমের শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেল। কিন্তু সেই অবস্থাতেও ভীমের তেজ রইল অম্লান। বসন্তের পুষ্প-সম্ভারের মধ্যে লাল লাল অশোক ফুল যেমন ফুটে থাকে, ভীমের দীপ্র বপুষ্মত্তার মধ্যে রুধির-ক্ষতগুলি সেই অশোক ফুলের রক্তিম অলংকার তৈরি করেছিল—সমৃদ্ধ কুসুমপীড়ো বসন্তে’শোকবৃক্ষবৎ। এই অবস্থাতেও কর্ণ কিন্তু ভীমের শক্তি সহ্য করতে পারলেন না। তিনি পালিয়ে বাঁচলেন। পালালেন বটে, তবে আবার এলেন এবং আবারও পালালেন ঘোড়াগুলিকে জোরে ছুটিয়ে—প্ৰাদ্রবজ্জবনৈরশ্বৈ রণং ত্যক্তা মহাযশাঃ। ভীমের কাছে কোনও ভাবেই দাঁড়াতে পারলেন না কর্ণ।

প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র তো অবাক হয়ে গেলেন, শুধু অবাক নয় খানিকটা আশাহতও। বললেন—কী বাজে কথাটাই না আমাকে বলেছে দুর্যোধন। মাথামোটা কোথাকার। বলে কিনা কর্ণ একাই সমস্ত পাণ্ডবদের জিতে আসতে পারবে। এখন দেখুক সে, কর্ণ যে এইভাবে পালিয়ে গেল, এখন সে কী বলবে? যুদ্ধের রীতিনীতি এক ফোঁটাও বোঝে না দুর্যোধন! নইলে নিজেরা ফড়িং হয়ে এই রকম আগুন ডেকে এনেছে নিজেদের পুড়িয়ে মারবার জন্য—প্রবেশয়দ্ধৃতবহং পতঙ্গমিব মোহিতঃ।

ভীমের নামে ধৃতরাষ্ট্রের ভয়ের কথা আগেই বলেছি। এতদিন যে ভয় কল্পনায় ছিল এখন তা রূঢ় সত্যে পরিণত। প্রায় প্রতিদিনই তাঁর কোনও না কোনও পুত্রের মৃত্যু হচ্ছে এবং কর্ণের মতো বীর যখন আজ বারংবার যুদ্ধ করে পৃষ্ঠ-প্রদর্শন করলেন, ধৃতরাষ্ট্রের ভয় তখন সর্বনাশের আশঙ্কায় চিহ্নিত। তিনি সঞ্জয়কে বললেন—লোকে যমের বাড়ি গিয়েও ফিরে আসতে পারে হয়তো কিন্তু ভীমের হাত থেকে নয়। যা শুনলাম আজকে, তাতে অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ—সব যদি এক জায়গাতেও জোটে তবু ভীমের সঙ্গে পারবে না।

সত্যি কথা বলতে কি, কর্ণ নতুন রথসজ্জা করে আবার ফিরে এসেছিলেন। যুদ্ধও স্থায়ী হয়েছিল অনেকক্ষণ। সময় এসেছিল যখন কর্ণের বিক্রমে ভীমের রথ ভেঙে গিয়েছিল। ভীম এই অবস্থাতেও সুযোগ পেয়েছিলেন খালি হাতে কর্ণকে পিটিয়ে মারার। আবার কর্ণও সুযোগ পেয়েছিলেন নিরায়ুধ ভীমকে মেরে ফেলার। কিন্তু ভীম সুযোগ নেননি—কৰ্ণ অর্জুনের হন্তব্য শত্রু বলে। আবার কর্ণও ভীমকে মারেননি কুন্তীর কাছে কথা দিয়েছিলেন বলে। এই দুই মহাবীর পারস্পরিক হত্যা থেকে বিরত থাকলেও কর্ণকে সাহায্য করতে গিয়ে ধৃতরাষ্ট্রের আরও কতগুলি ছেলে বেঘোরে ভীমের হাতে মারা গেল। ভীমের লাভ এইটুকুই এবং ধৃতরাষ্ট্রের ক্ষোভও সেইখানেই।

দ্রোণাচার্য যখন প্রায় অদম্য হয়ে উঠলেন, তখন কৃষ্ণ বললেন—কৌশল করে এই বৃদ্ধকে যদি তাঁর প্রিয় পুত্র অশ্বত্থামার মৃত্যু সংবাদ দেওয়া যায় তবেই দ্রোণাচার্য থামবেন, নইলে নয়। কথাটা অর্জুনের একেবারেই পছন্দ হল না, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরও নিমরাজি হয়ে এই প্রস্তাবে সায় দিলেন। এবার সেই চরম মিথ্যেটা ঘোষণা করার ভার পড়ল ভীমের ওপর। পাণ্ডবদের নিজস্ব গজ বাহিনীর মধ্যেই অশ্বত্থামা নামে একটি হাতি ছিল। ডাহা মিথ্যা থেকে বাঁচার জন্য ভীম তাঁর গদার বাড়িতে সেই হাতিটিকে মেরে মহানাদে ঘোষণা করলেন—অশ্বত্থামা মারা গেছেন। মারা গেছেন অশ্বত্থামা—অশ্বত্থামা হত ইতি শব্দমুচ্চৈকার হ।

শেষ পর্যন্ত দ্রোণ কীভাবে মারা গেছেন, আপনারা জানেন। কিন্তু মুশকিলটা হল দ্রোণ-বধের পর। দ্রোণকে চুলের মুঠি ধরে ধৃষ্টদ্যুম্ন যেভাবে হত্যা করেছিলেন, তাতে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন অর্জুন। যেমন তিনি গালাগালি করলেন যুধিষ্ঠিরকে, তেমনই গালাগালি করলেন শ্যালক-সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্নকে। অর্জুনের বিলাপ-ধ্বনির সঙ্গে যুধিষ্ঠির এবং ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি যেভাবে ঘৃণা মিশ্রিত হচ্ছিল, তাতে ভীমও জড়িয়ে যাচ্ছিলেন। অর্জুন সরাসরি ভীমের উদ্দেশে কোনও কটুক্তি না করলেও, ভীমই যেহেতু হাতি মেরে মিথ্যাচারের শুরুটা করেছিলেন, অতএব পরোক্ষভাবে তিনিও জড়িয়ে যাচ্ছিলেন ওই চক্রান্তের মধ্যে। এতক্ষণ ঝিকে মেরে বউ-শেখানোর কায়দা দেখছিলেন ভীম। অর্জুন যখন বললেন—এইভাবে যখন আমার আচার্যকে হত্যা করা হল, তখন আর আমার বেঁচে থেকে লাভ নেই।

এসব কথা শুনে ভীম আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বাচিক ভাষায় যাকে বলে ‘ন্যাকামি’, ভীম যেন অর্জুনের মধ্যে সেই ন্যাকামি দেখতে পেলেন। গুরুর প্রতি অর্জুনের শ্রদ্ধাটা যদিও মিথ্যা ছিল না, কিন্তু সেই দুর্বলতায় বারংবার ঘা খেয়ে ভীম সেটাকে কথার জোরে স্তব্ধ করে দিতে চাইলেন। ভীম বললেন—আহা বনবাসী মুনিরা যেমন ধর্মকথা বলে, ক্ষত্রিয়ের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিয়ে তুমিও সেই রকম বলতে আরম্ভ করেছ। মনে রেখো অর্জুন, ক্ষত্রিয়ের ভাবটাই তোমাকে শোভা পায়, কিন্তু সমস্ত ক্ষত্রিয়-গুণের অধিকারী হয়ে আজকে এমন বোকার মতো সব কথা বলছ, এটা তোমাকে মানায় না অর্জুন—অবিপশ্চিদ্ যথা বাচং ব্যাহরন্নাদ্য শোভসে।

এই কটুক্তির পিঠে-পিঠে ভীম অবশ্য অর্জুনের ধর্মবোধ এবং নীতি-যুক্তির প্রশংসাও করলেন যথেষ্ট। কিন্তু সেই প্রশংসার সঙ্গে সঙ্গে ভীম এটাও বলতে ছাড়লেন না যে, অর্জুনের কথাগুলি তাঁর মোটেই সহ্য হচ্ছে না। তিনি বললেন—ধর্মবোধ আমরা কম দেখাইনি অর্জুন। কিন্তু দ্রৌপদীকে ওরা যেভাবে সভায় নিয়ে এসেছিল, আমাদের যেভাবে বনবাসে পাঠানো হয়েছে, গাছের বাকল পরে যেভাবে এই তেরো বচ্ছর সহ্য করেছি—এগুলো কি আমাদের রাগের বস্তু নয়? তবু এসব আমরা সহ্য করেছি এবং এখন তোমাকে সঙ্গে নিয়ে একে একে সেই সব রাগের প্রতিশোধও নিচ্ছি। কিন্তু আজ যেভাবে তুমি আমাদের অপমান করছ তাতে আমাদের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ছে—বপন্‌ ব্রণে ক্ষারমিব ক্ষতানাং শত্রুকর্ষণ। তোমার যদি এত এ হয় তাহলে অন্য ভাইদের নিয়ে চুপ করে বসে থাকো তুমি; আমি একাই আমার গদাটি হাতে নিয়ে বেরব এবং এই যুদ্ধ জয় করে আসব—অহমেনং গদাপাণি-র্জেষ্যাম্যেকো মহাহবে।

ভীমের এই কথাগুলির একটা অন্য মূল্য ছিল। কোনও গুরুতর অপরাধের জন্য কেউ যদি মনে মনে শাস্তি পেতে থাকে, তখন যদি কেউ ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে জবরদস্তি করে অপরাধীর অপরাধ অপ্রমাণ করে দেয়, তাহলে অপরাধী সান্ত্বনা পেতে থাকে। সে ভাবতে থাকে—তা হলে বোধহয় খুব অন্যায় হয়নি। এত যখন কারণ আছে, স্বপক্ষে এত যখন যুক্তি রয়েছে, তা হলে বোধহয়, তা হলে আমি বোধহয় বেশি বেশি ভাবছি। ভীমের কথায় পরোক্ষে অর্জুন শান্তি পেয়েছেন মনে মনে। তিনি এবার সুস্থির হয়ে তাঁর প্রধান শত্রু কর্ণের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। কারণ দ্রোণ মারা যাবার পর কর্ণই ছিলেন কৌরব-সেনাপতি।

দুর্যোধন কর্ণের কাছে বড় বেশি আশা করেছিলেন। কিন্তু কর্ণের সেনাপতিত্ব কালে সবচেয়ে বড় ঘটনা হল ভীমের হাতে দুঃশাসনের মৃত্যু এবং তাঁর রক্তপান। ব্যাপারটা আচম্বিতেই ঘটে গেল। প্রধানত কর্ণের বিরুদ্ধে অর্জুনকে সাহায্য করার জন্যই ভীম তাঁর পৃষ্ঠরক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। এই সময় কোথা থেকে দুঃশাসন ভীমকে দেখতে পেলেন এবং হঠাৎ তাঁর সমস্ত বীরত্ব যেন উথলে উঠল। ভীমের উদ্দেশে তিনি খুব বাণ-টান ছাড়তে আরম্ভ করলেন। আর যায় কোথা। ক্ষুধার্ত সিংহ যেমন হরিণ দেখলে দ্রুত ধাবিত হয়, ভীমও সব ছেড়ে দুঃশাসনকে ধাওয়া করলেন। দুঃশাসন যোদ্ধা কম ছিলেন না। দু-একটা বাণ যা ছাড়লেন, তাতে ভীমের মতো বীরকেও অন্তত একবার মাথায় ঝিম ধরে রথের ওপর শুয়ে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু ঝিম-ঝিম ভাবটা কেটে যেতেই তিনি এমন একটা গর্জন দিয়ে উঠলেন যে, সেটাই ছিল দুঃশাসনের মৃত্যুঘণ্টা। দুঃশাসনের শরে অতিরিক্ত বিদ্ধ হয়ে শেষমেষ তাঁর অষ্টায়সী গদাখানি ঘুরিয়ে ছুঁড়লেন দুঃশাসনের দিকে। গদাটা সোজা গিয়ে আঘাত করল দুঃশাসনের মাথায়।

দুঃশাসন সঙ্গে সঙ্গে রথ থেকে পড়ে গেলেন। ভীম তখন অন্য একখানি গদার বাড়িতে দুঃশাসনের রথ, ঘোভা, সারথি—সব একেবারে চুরমার করে ভেঙে দিলেন। ভুমিলুণ্ঠিত, মৃত্যু যন্ত্রণায় তখনও কম্পমান দুঃশাসনের দিকে তাকাতেই এবার ভীমের মনে পড়ল দ্রৌপদীর কথা। এই সেই দুঃশাসন—যে এক সময় চুলের মুঠি ধরে তাঁর পরান-পুতলী দ্রৌপদীকে রজস্বলা অবস্থায় উন্মুক্ত সভার মধ্যে নিয়ে এসেছিল এবং তাঁর লজ্জাবস্ত্র খুলে দিয়েছিল। ভীমের চোখে আগুন জ্বলে উঠল। তিনি বলে উঠলেন—যার সাধ্যি থাকে এগিয়ে আসুক, এই আমি দুঃশাসনকে মারতে যাচ্ছি, তোদের সাধ্যি থাকে তো বাঁচা। যাঁদের সামনে অথবা যাঁদের উদ্দেশে এই হুঙ্কারটি ছাড়া হল, তাঁর হলেন কর্ণ এবং দুর্যোধন। দুঃশাসন যে ভীমের গদার আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন—এটা তাঁর দেখেছেন। কিন্তু ভীমের আক্রোশ-বাক্য শুনেও তাঁরা যে কেউ সেদিন এগোলেন না, তার কারণ—ভীম সেদিন তাঁর ক্রোধের তুঙ্গবিন্দুতে অবস্থান করছিলেন।

দুর্যোধন-কর্ণের সামনে দিয়েই ভীম সবেগে ধাবিত হলেন দুঃশাসনের দিকে—সুযোধনস্যাধিরথেঃ সমক্ষম্‌। তাঁর চোখটা শুধু দুঃশাসনের দিকে। দুঃশাসনের শরীরে তখনও প্রাণ আছে। গদার আঘাতে মুহ্যমান, দেহের আবরণ বর্ম ভেঙে পড়েছে। যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে পরা পরিধান, গলার মঙ্গল-মালা বিস্ত, হাত দিয়ে শুধু কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছেন, বাঁচবার শেষ সদিচ্ছা—বিধ্বস্ত-বর্মাভরাণাম্বর-স্রক্‌ বিচেষ্টমাননা ভূশবেদনার্তঃ। ভীম দুঃশাসনের সামনে এসে কোষ থেকে ক্ষুরধার তরবারি মুক্ত করলেন। তারপর পা দিয়ে চেপে ধরলেন দুঃশাসনের কণ্ঠদেশ আর স্পন্দমান অসিটি দিয়ে চিরে ফেললেন দুঃশাসনের বুক—উকৃত্য বক্ষঃ পতিতস্য ভূমৌ। ফিনকি দিয়ে দুঃশাসনের কবোষ্ণ রক্ত বেরিয়ে এল পাদ-পিষ্ট দেহ থেকে। ভীম অঞ্জলি পুরণ করে দুঃশাসনের রক্ত ছোঁয়ালেন ঠোঁটে। এই একবার।

সেই মর্মচ্ছিন্ন অবস্থাতেও দুঃশাসন আরও একবার চেষ্টা করলেন ওঠার। এবার উদ্যত তরবারির এক কোপে ভীম দুঃশাসনের মাথাটা আলাদা করে দিলেন ধড় থেকে। এবার দ্বিতীয়বার তাঁর উদগত শোণিত অঞ্জলি-বদ্ধ করে ভীম লেহন করতে লাগলেন রীতিমতো; চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখতে-দেখতে পরম নিশ্চিন্তে লেহন করলেন দুঃশাসনের রক্ত—আস্বাদ্য চাস্বাদ্য চ বীক্ষমাণঃ। রক্তাদের প্রতিতুলনায় সুস্বাদু লেহ্য-পেয়র বর্ণনাও বাদ গেল না এখানে। ভীম বললেন—আহা! ছোটবেলায় মায়ের দুধ খেয়েছি, ভালই লেগেছিল নিশ্চয়। মধু খেয়েছি কত, তাও বেশ ভাল। দইয়ের মাঠা, দুধ, ঘি—সেও বেশ। ফুলের মধু থেকে নানা মশলায় তৈরি করা মদ—মাধ্বীকপানস্য চ সকৃতস্য—তাও আমার বেশ লাগে। কিন্তু যত যাই বল, ঘি-মধু, মধু-মদ—যত রকম সুস্বাদু পানীয়ই আমি পান করে থাকি, সে সবগুলির চেয়ে এই শত্রু-শোণিতের আস্বাদ আমার কাছে অনেক বেশি, অনেক বেশি—সর্বেভ্য এবাভ্যধিকো রসো’য়ং মতো মমাদ্যাহিতলোহিতস্য।

আপনারা বলতেই পারেন—এ একেবারে নৃশংসতার চরম; আর্য সভ্যতার পরিপন্থী এই অসভ্য ব্যবহার। আমি বলি—আপনারা কী বলবেন? পণ্ডিতেরাই তো এ সব কথা কতই বলেছেন। সাহেব-সুজনরা তো মহাভারতের এই জায়গাটা দেখে সদয় হয়ে অন্তত মহাভারতের এই অংশটুকুর রচনাকাল বেশ পুরনো বলে মনে করেন। গবেষণা বড় বিষম বস্তু। মহাভারতের অনেকাংশই তাঁদের মতে অবাচীন, কিন্তু এই জায়গায় তাঁরা ‘ক্যানিবালিজমের’ গন্ধ পেয়ে দয়া করে বলেনা—হ্যাঁএটা ঠিক যে, ভীমের রক্তপানের মধ্যে যেহেতু প্রাগৈতিহাসিক সভ্যেতর মানুষের চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে, অতএব মহাভারতের মূল কিছু অংশ খ্রিস্টজন্মের বহু পূর্বেই রচিত হয়েছিল।

এই সব বিচিত্রবুদ্ধি গবেষকের খুরে আমার দণ্ডবৎ প্রণিপাত জানাই। আরও জানাই যে, সেকালে ক্ষত্রিয়ের কাছে প্রতিজ্ঞা-রক্ষার ধর্ম যে কতটা বড় ছিল, সেটা এই মহা-পণ্ডিতদের বোঝাব কেমন করে? প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য কত ক্ষত্রিয় রাজা-মহারাজা কত হীন কাজ করেছেন, কত ঘৃণিত ব্যবহার করেছেন—সেই ফিরিস্তি যদি মাথায় থাকত, তাহলে এই অপোগণ্ড গবেষণার দরকার হত না। তা ছাড়া ভীমের নৃশংসতা, অক্ষমা এবং বুদ্ধিবৃত্তির পরিবর্তে ‘ইন্‌স্টিংক্টে’ চলাটা সম্পূর্ণ মহাভারত জুড়ে এইভাবে চিত্রিত। মহাভারতের কবি তাঁকে জনমনের ইচ্ছাপূরকভাবেই গড়েছেন। ফলে এই রক্তপানের সময় তাঁর নৃশংসতার চেয়েও, বার বার সারা জীবন ধরে যে প্রতিশোধের কথা বলেছেন, সেইটাই এই নৃশংসতার যুক্তি হওয়া উচিত।

হ্যাঁ, আজকাল সভ্য মানসিকতায় এই রক্তলেহন বর্বরতা বলে মনে হতেই পারে। সেদিনও যারা ভীমের রুধির-ধারা-লাঞ্ছিত মুখখানি দেখেছিল, তারা কেউ ভয়ে পালিয়েছিল, কেউ সীমাহীন বর্বরতার নিরিখে অসহ্য ঘৃণায় চোখ বন্ধ করেছিল, আর কেউ বলেছিল—ব্যাটা মানুষ নয়, রাক্ষস—নায়ং মনুষ্য ইতি ভাষমাণাঃ। পণ্ডিতরাও তাই বলেন। বলেন—ভীমের ব্যবহারটা রাক্ষসের মতো। কিন্তু এটা কেউ ভাবেন না যে, আজকের সভ্য জগতেও কেউ যদি রাজযন্ত্র ব্যবহার করে যে কোনও ছুতোয় সমস্ত লোক-সমক্ষে আপনার স্ত্রীর পরিধান খুলে নেয়, তবে আপনারও সেই দুর্মতিকে হত্যার ইচ্ছা করবে না কি? যদি না করে, তবে হয় আপনি পশু অথবা পশুপতি, বোমভোলা মহাদেব। আজকের সভ্য আইনে সর্বসমক্ষে আপনার স্ত্রীর পরিধেয় বসন খুলে নিলেও আপনি তাকে মারতে পারেন না; আপনাকে থানায় যেতে হবে, আদালতে যেতে হবে এবং তারপরেও বস্ত্র-মোচনের জন্য আপনার শত্রুর শাস্তি কতটুকু হবে বলে আপনি মনে করেন.? বড় জোর কিছুদিনের হাজতবাস অথবা কিছু জরিমানা। কিন্তু আপনার মনে কী থাকবে মশাই? মনে-মনে আপনি এই শত্রুকে খুন না করে থাকবেন কি? গায়ে জোর থাকলে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিপত্তি থাকলে খুন করেও ফেলতেন হয়তো।

কিন্তু মনে রাখবেন—গায়ে অমানুষিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও ভীম তাঁর দাদার রাজনৈতিক শিক্ষায় তেরো বচ্ছর চুপ করে বসেছিলেন। ভাগ্যিস তাঁকে পুলিশ কিংবা জুজ-সাহেবের এজলাসে যেতে হয়নি, অতএব তেরো বচ্ছর পরে তাঁর ক্ষত্রিয়ের বচন সার্থক করে ভীম রক্তপানের যুক্তি দিয়েছেন—তোরা আমাকে প্রমাণকোটির বাগান-বিহারে বিষ খাইয়েছিলি, বারণাবতে লাক্ষা-গৃহে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলি, পাশা খেলে আমাদের রাজ্য কেড়ে বনবাসে পাঠিয়েছিলি, প্রাণপ্রিয় পত্নীর চুলের মুঠি ধরে সভায় অপমান করেছিলি, বিরাটরাজার ঘরে চাকরগিরি করতে বাধ্য করেছিলি—এইরকম, ঘরে-বাইরে যত কষ্ট আছে সব দিয়েছিস আমাকে। আর সেই বনবাসে যাবার আগে আমার হাঁটা দেখে ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে বলেছিলি—গরু চলেছে, ব্যাটা! গরু—আজ তোর রক্ত খেয়ে সেই ‘বলা’টাও ফিরিয়ে দিলাম। আজকে আমি বলছি—ব্যাটা! তোরাই গরু, গরু কোথাকার—তান্ বয়ং প্রতিনৃত্যামঃ পুনগোরিতি গৌরিতি।

ভীমকে কেউ কিচ্ছুটি করতে পারেননি। দুর্যোধন-কর্ণের মতো বীর ভ্রাতৃশোকে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন—এ কথা মানি না। আসলে ভীমের ভয়ঙ্কর উগ্র রূপ দেখে কারও এক পা এগোবার সাহস হয়নি। রক্তপানের উল্লাসের পর কৃষ্ণ আর অর্জুনকে সামনে পেয়ে ভীম বলেছেন—আমি যা বলেছিলাম, তা করেছি, কথা রেখেছি—তদ্‌ বৈ সত্যং কৃতমদ্যেহ বীরৌ। আরও একটা কথা-রাখার কথা ছিল। মহাভারতের কবি সে-কথা আগেও বলেননি। পরেও বলেননি অর্থাৎ ভীম সে প্রতিজ্ঞা মহাভারতের পাতায় করেননি অতএব সে প্রতিজ্ঞা রাখারও প্রশ্ন আসে না। কিন্তু মহাভারতের কাহিনী উপজীব্য করে যাঁরা কাব্য-নাটক লিখেছেন, তাঁরা রুধিরাপ্লুত ভীমকে ছোটাতে ছোটাতে দ্রৌপদীর ভবনে নিয়ে এসেছেন। দুই অঞ্জলিতে রক্তপূর ভীমসেন ক্ষত্রিয়ের আস্ফালনে ছুটে গেছেন ক্ষত্রিয়াণী দ্রৌপদীর কাছে। রক্তের সিঞ্চনে দ্রৌপদীর কুঞ্চিত-কৃষ্ণ কেশদামে আবার বেণী বেঁধে দিয়েছেন ভীমসেন—বেণীসংহার নাটকের পালা জমেছে এইভাবেই।