দ্রৌপদী – ২

দ্রৌপদী যে এক-এক সময়ে এক-এক বীরস্বামীর স্নান সরোবরে পরিণত হতেন এবং অন্য স্বামীকে দিতেন বনস্থলীর ছায়া—তাতে সন্দেহ কী! ব্যাস তাই লিখেছেন—বভূব কৃষ্ণা সর্বেষাং পার্থানাং বশবর্তিনী—একসঙ্গে তিনি সবারই বশবর্তিনী ছিলেন এবং সেইজন্যই সাধারণভাবে বনস্থলীর উপমা। পাঁচ স্বামীর মধ্যে সবার সঙ্গেই দ্রৌপদীর ব্যবহার একরকম ছিল না। কাউকে একটু বেশি ভালবাসতেন, কাউকে বেশি বিশ্বাস করতেন, কাউকে বা যেন মানিয়ে চলেছেন, আবার কাউকে বাৎসল্যও করেছেন।

বাৎসল্যের কথাটা হয়তো বিশ্বাস হচ্ছে না, কিন্তু আমাদের ধারণা এই যে নকুল-সহদেব, এই দুই ভ্রাতার প্রতি দ্রৌপদীর বাৎসল্য রসই বেশি, যতখানি না শৃঙ্গার। সারা মহাভারতে যুধিষ্ঠির, ভীম আর অর্জনের মাহাত্ম্য এত বেশি যে, এই তিন ভ্রাতার চাপে নকুল সহদেবের কথা সংকুচিত হয়েছে। বাস্তব ক্ষেত্রে গাছের ওপরে উঠে জলের খোঁজ করা, একে ডাকা, তাকে বলা—এইসব খুচরো কাজের বেলায় নকুল-সহদেবের ডাক পড়ত। দ্রৌপদীর বিয়ের অব্যবহিত পূর্বেও জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে ফেরবার সময়ে নকুল-সহদেব ভীমের কোলে উঠেছেন। এ হেন নকুল-সহদেবের সঙ্গে তিনটি নাম করা বীর স্বামীর রসজ্ঞা দ্রৌপদী কী ব্যবহার করবেন। বিশেষত কনিষ্ঠ সহদেবের সঙ্গে?

বনে যাবার সময় জননী কুন্তী দ্রৌপদীকে বলেছিলেন—স্বামীদের সঙ্গে কখন কীরকম ব্যবহার করতে হবে—আমি জানি—সে তোমায় বলে দিতে হবে না মা। তোমার পাতিব্ৰত্য গুণ যেমন আছে, তেমনি আমার মতো—মদনুধ্যানবৃংহিতা—মায়ের গুণও তোমার মধ্যে যথেষ্ট। বনের মধ্যে তুমি বাপু আমার সহদেবকে একটু দেখে রেখো—সহদেবশ্চ মে পুত্রঃ সহাবেক্ষ্যো বনে বসন্‌। মা-মরা ছেলে যেন আমাকে ছেড়ে মা হারানোর দুঃখ না পায়—যথেদং ব্যসনং প্রাপ্য নায়ং সীদেন্‌ মহামতিঃ। বস্তুত জননী কুন্তী সহদেবকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন বলেই দ্রৌপদীর মধ্যেও সহদেবের প্রতি বাৎসল্য জন্মেছিল হয়তো।

মহাভারতের বিরাট পর্বেও এই তত্ত্বের সমর্থন আছে। বিরাটের রাজবাড়িতে কীচকের তাড়নায় অতিষ্ঠ হয়ে দ্রৌপদী যখন ভীমের কাছে নালিশ জানাতে এসেছিলেন, তখনও এই সহদেবের জন্য মায়ায় তাঁর বাক্য অবরুদ্ধ হয়ে গেছে। সত্যি কথা বলতে কি, সহদেবের জন্য দ্রৌপদীর মমতা প্রায় কুন্তীর মতোই। বাস্তবে সহদেবের স্বামিত্বের নিরিখে অতিরিক্ত মায়া দেখানো যেহেতু খারাপ দেখায়, দ্রৌপদী তাই সহদেবের ওপর তাঁর অসীম মমত্ব প্রকাশ করেন কুন্তীর জবানীতেই। বিরাটপর্বে ভীমের কাছে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন—আমার মনে শান্তি নেই একটুও। সহদেবের কথা ভেবে ভেবে রাতে আমার ঘুমই আসে না, তায় শান্তি—ন নিদ্রাম্ অভিগচ্ছামি ভীমসেন কুতো রতিম্। দ্রৌপদী বললেন—বনে আসবার আগে জননী কুন্তী আমার হাত ধরে বলেছিলেন—দ্রৌপদী। রাত-বিরেতে আমার সহদেবকে একটু দেখে রেখো, তুমি নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দিও—স্বয়ং পাঞ্চালি ভোজয়েঃ।

এসব কথা থেকে বোঝা যায়, সহদেব হয়তো ঘুমের ঘোরে গায়ের চাদর ফেলে দিতেন, হয়তো তিনি নিজহাতে জুত করে খেতে পারতেন না, অতএব জননী কুন্তীর সমস্ত মাতৃস্নেহ দ্রৌপদীর। বধূহৃদয়ে এক মিশ্ররূপ নিয়েছিল। যার জন্য মুখে তিনি সহদেবকে ‘বীর’ ‘শূর’—এইসব জব্বর জব্বর বিশেষণে ভূষিত করলেও মনে মনে ভাবতেন—আহা ওই কচি স্বামীটার কী হবে—দৃয়ামি ভরতশ্রেষ্ঠ দৃষ্ট্বা তে ভ্রাতরং প্রিয়ম্। দ্বৈতবনে এসে দ্রৌপদী যখন নির্বিকার যুধিষ্ঠিরকে বেশ পাঁচ-কথা শুনিয়ে দিলেন, তখন ভীম আর অর্জুনের কথা উল্লেখ করে দ্রৌপদী বলেছিলেন—এঁরা এইরকম মহাবীর, তবুও এঁদের বনে থাকতে হচ্ছে। কিন্তু নকুল-সহদেব, বিশেষত সহদেবের কথা যখন উঠল, তখন দ্রৌপদী বললেন—সহদেবকে বনের মধ্যে দেখেও তোমার মায়া লাগছে না, তুমি নিজেকে ক্ষমা করছ কী করে? নকুল-সহদেব, যারা নাকি জীবনে কষ্টের মুখ দেখেনি, তাদের দুঃখ দেখেও কি তোমার রাগ হচ্ছে না?

ভীম-অর্জুনের বেলায় বীরতা, আর নকুল-সহদেবের বেলায় তাদের দুঃখই দ্রৌপদীর কাছে বড় হয়ে উঠেছে। ভাবে বুঝি, এই যমজ ভায়ের ওপর দ্রৌপদীর রসাপ্লতি যতখানি ছিল, তার চেয়ে মায়া এবং বাৎসল্যই ছিল বেশি। অন্যদিকে সহদেব কিন্তু দ্রৌপদীকে আপন গিন্নি বলে বড়ই গর্বিত বোধ করতেন। ছোট বলে সহদেবের অনেক ছেলেমানুষি ছিল, নিজেকে ছেলেমানুষের মতো একটু প্রাজ্ঞও ভাবতেন তিনি—আত্মনঃ সদৃশং প্রাজ্ঞং নৈষো’মন্যত কঞ্চন। ঠিক এই কারণেই বুঝি কুরুসভায় পাঞ্চালীর যে অপমান হয়েছিল, তার প্রতিশোধের ভার তিনি একা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণ যখন পাণ্ডবদের হয়ে কুরুসভায় দূতীয়ালি করতে যাচ্ছিলেন, তখন সমস্ত পাণ্ডবেরা, এমনকী ভীম পর্যন্ত বারবার শান্তির কথা বলেছিলেন। এই লোকক্ষয়কর যুদ্ধ যাতে না হয় তার জন্য সমস্ত পাণ্ডবেরা ছিলেন উদগ্রীব। কিন্তু যখন সহদেবকে বলতে বলা হল, তখন তিনি আচমকা বলে উঠলেন—যুধিষ্ঠির যা বলেছেন তাই সনাতন ধর্ম বটে, কিন্তু কৃষ্ণ! তুমি সেই চেষ্টাই করবে যাতে যুদ্ধ বাধে। এমনকী যদি কৌরব নায়কেরাও পাণ্ডবদের সঙ্গে শান্তি স্থাপনে আগ্রহী হন, তবু কিন্তু যুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা করবে। কুরুসভায় পাঞ্চালীকে যে অপমান আমি সইতে দেখেছি, দুর্যোধনকে না মেরে তার শোধ তোলা অসম্ভব। কৃষ্ণ! যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন এঁরা ধার্মিক মানুষ, তাই তাঁরা যুদ্ধশান্তির কথা বলছেন, কিন্তু আমি ধর্মের বাঁধ ভেঙে দিয়ে একাই যুদ্ধ করতে চাই—ধর্মম্‌ উৎসৃজ্য তেনাহং যোদ্ধুমিচ্ছামি সংযুগে।

যে কনিষ্ঠ ছেলেটি দ্রৌপদীর অপমানে উত্তেজিত, ধর্মের বাঁধ ভেঙে যুদ্ধে একাই প্রাণ দিতে চায়, তার প্রেমরহস্য যতই একতরফা হোক না কেন, দ্রৌপদী তাকে বাৎসল্যে বন্দি করেছিলেন, যে বাৎসল্যকে সে প্রেম বলে ভুল করেছিল। অন্যথায় দ্রৌপদীর প্রেম বড় সহজলভ্য নয়। যে বিশালবপু বৃষস্কন্ধ মানুষটি দ্রৌপদীর জন্য কত শতবার প্রতিজ্ঞা করেছেন, সেই মধ্যম-পাণ্ডব ভীমও যে দ্রৌপদীর প্রেমের স্বাদ সম্পূর্ণ পেয়েছেন তা আমরা মনে করি না। অথচ দ্রৌপদী ভীমের কাছে মাঝে মাঝে এমনভাবে আত্মনিবেদন করেছেন যে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যেন ভীমের মধ্যে তিনি মনের মানুষ খুঁজে পেয়েছে। মসলে এই মধ্যম-পাণ্ডব নিজেই দ্রৌপদীকে এত ভালবাসতেন যে দ্রৌপদীকে মাঝে মাঝেই তাঁর কাছে আত্মনিবেদন করতে হয়েছে। এত বড় বিশাল মাপের মানুষকে তো আর সহদেবের মতো বাৎসল্যরসে সিঞ্চিত করা যায় না। তবে এই যে আত্মনিবেদন, এ কিন্তু প্রেমের আত্মনিবেদন নয়, এ শুধু বিশ্বাস। চিরমুগ্ধ মধ্যম পাণ্ডবকে তিনি মাঝে মাঝেই কাজে লাগিয়েছেন, এমন কাজ যা অন্যের দ্বারা হবে না। আর দ্রৌপদীর লাবণ্যে, বৈদগ্ধ্যে আত্মহারা ভীম বারবার সেই দুরূহ কর্মগুলি করেছেন প্রিয়ার মন পাবেন বলে।

আপন স্বয়ম্বর লগ্নে দ্রৌপদী নিশ্চয়ই লক্ষ করেছিলেন যে, লক্ষ্যভেত্তা পুরুষটির সঙ্গে আরও একজন শক্তিধর পুরুষ সমস্ত রাজমণ্ডলকে একেবারে নাজেহাল করে তুলেছে। সেই মানুষটি অন্যের মতোই তাঁকে দেখে মুগ্ধহৃদয়ে বরণ করেছিল। অথচ দ্রৌপদী পাঁচভাগ হয়ে গেলেন। কিন্তু এই মুগ্ধতার কথা মনে রেখেই বিদগ্ধা দ্রৌপদী তাঁর এই পরম বিশ্বস্ত পতিটিকে এমন কোনও কর্মভার দিতেন, যাতে ভীম ভাবতেন—দ্রৌপদীর পক্ষপাত বুঝি তাঁর ওপরেই। এর মধ্যে অর্জুন নামক উদাত্ত পুরুষটির মধ্যে যে ঈর্ষা জাগানোর ব্যাপার আছে, তা ভীম বুঝতেন না। তার ওপরে অর্জুন যখন তপস্যা ইত্যাদি নানা কারণে বাইরে গেছেন, তখন দ্রৌপদী এমন ভাব করতেন যেন ভীমই তাঁর মালঞ্চের একমাত্র মালাকর।

মনে করুন সেই দিনটির কথা। অর্জুন গেছেন দেবলোকে, অস্ত্র সন্ধানে। বহুদিন হয়ে গেল তিনি ফেরেন না। লোমশ মুনির কথায় অন্য পাণ্ডবেরা গন্ধমাদন পর্বতে এলেন যদি অর্জুনের সঙ্গে দেখা হয়। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই ভাঙতে গিয়ে পথশ্রান্তা দ্রুপদরাজার দুলালী কৃষ্ণা হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। তবু টাল রাখতে পারলেন না, একেবারে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে। তাঁকে প্রথমে দেখতে পেলেন নকুল। কোনওমতে তাঁকে ধরে ফেলেই নকুল অন্য ভাইদের ডাকতে লাগলেন। দৌড়ে এলেন যুধিষ্ঠির, ভীম, সহদেব। নিজের কোলে দ্রৌপদীর মাথা রেখে ধর্মরাজ খানিকক্ষণ বিলাপ করলেন—সাত-পুরু বিছানায় যার শুয়ে থাকার কথা, আমার জন্যে তার কী। অবস্থা—ইত্যাদি ইত্যাদি। বারবার পাণ্ডবেরা ঠাণ্ডা হাতে তাঁকে স্পর্শ করে, মুখে জলের ছিটে দিয়ে হাওয়া করে—জলমিশ্রেণ বায়ুনা—দ্রৌপদীর জ্ঞান ফিরিয়ে আনলেন। কিন্তু জ্ঞান ফিরলেই দেখা গেল ধর্মরাজ তাঁর কোলে-মাথা-রাখা দ্রৌপদীকে অনেকভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন—অর্থাৎ কিনা, এখন কেমন লাগছে, একটু ভাল বোধ করছ কি–-পার্যাশ্বাসয়দ্‌ অপ্যেনাম্‌। অন্যদিকে নকুল-সহদেব সেই তখন থেকে দ্রৌপদীর রক্ততল পা-দুখানি টিপেই চলেছেন—তস্যা যমৌ রক্ততলৌ পাদৌ পূজিতলক্ষণৌ…সংববাহতুঃ। হ্যাঁ, অসুখে পড়লে স্ত্রীর পা টিপলে দোষ কী, কিন্তু আমাদের ধারণা, অসুখে না পড়লে, মানে সুখের দিনেও নকুল-সহদেবের ওই একই গতি ছিল। এদিকে মাথা আর পা-দুখানি তিন পাণ্ডবের মধ্যে ভাগ হয়ে যাওয়ায় ভীমের পক্ষে যেহেতু আর কোনও অঙ্গসংবাহন সম্ভব ছিল না, অতএব হতচকিত হয়ে তিনি দাঁড়িয়েই ছিলেন। ধর্মরাজ মুখ তুলে বললেন—এই বন্ধুর গিরিপথ দ্রৌপদীর পক্ষে আর অতিক্রম করা সম্ভব নয়, ভীম! ভীম বললেন, এ ব্যাপারে আপনি কোনও চিন্তাই করবেন না, সব ভার আমার। আমি বরং আমার পুরনো ছেলে ঘটোৎকচকে স্মরণ করছি। সে হাওয়ার গতিতে সবাইকেই নিয়ে যেতে পারবে। ব্যবস্থা হল, পাণ্ডবেরা অর্জুনকে রাস্তায় ধরে ফেলার আশায় নিসর্গরাজ্য গন্ধমাদনে প্রবেশ করলেন।

হিমালয়ের বিচিত্র মনোরম পরিবেশে পাণ্ডবেরা এবং দ্রৌপদী বিমলানন্দে দিন কাটাচ্ছেন। এমনই এক দিনে না-জানা দিঘির এক সহস্রদল পদ্ম হাওয়ায় উড়ে এসে দ্রৌপদীর পায়ের কাছে মাটিতে পড়ল। সূর্যের কিরণ-মাখা সে পদ্মের যেমন রঙ, তেমনই তার গন্ধ। দ্রৌপদী বায়না ধরলেন, ভীমের কাছে বায়না ধরলেন—দেখেছ কী সুন্দর পদ্ম, যেমন রঙ, তেমনই গন্ধ। আমাকে যদি তুমি ভালবেসে থাক—যদি তে’হং প্রিয়া পার্থ—তা হলে এই পদ্ম আরও অনেক, অনেক আমায় এনে দিতে হবে, ভীম! আমি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সেই পদ্ম উপহার দেব—ইদঞ্চ ধর্মরাজায় প্রদাস্যামি পরন্তপ। বুঝুন অবস্থা, মেজস্বামী ভীমসেন কোথায় মাঠ-ঘাট খুঁজে দিব্যগন্ধ পদ্ম নিয়ে আসবেন, আর সেই পদ্মগুলি যাবে জ্যেষ্ঠ স্বামী যুধিষ্ঠিরের ভোগে। অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার সময় দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের কোলে শুতে পেরেছিলেন বলেই নাকি—অঙ্কমানীয় ধর্মাত্মা—জানি না, দ্রৌপদী দ্যুতসভার অপমান ভূলে ধর্মরাজকে সৌগন্ধিক উপহার দিতে চাইলেন এবং সে উপহারের ব্যবস্থা করবেন ভীম। শুধু তাই নয় দৌপদীর ইচ্ছে—দু-পাঁচটা পদ্মফুলের গাছ যদি গোড়াশুদ্ধ উপড়ে আনা যায় তবে সেগুলি কাম্যক বনে পুঁতেও দেওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, কাম্যক বন পাণ্ডবদের বনবাস লগ্নে প্রথম অরণ্য, প্রথম প্রথম বনবাসে দ্রৌপদীর বুঝি সে অরণ্য ভারী ভাল লেগেছিল। ভীমের কাছে বায়না ধরে দ্রৌপদী ছুটলেন ধর্মরাজের কাছে। যে একগাছি পদ্ম হাওয়ায় উড়ে এসেছিল, সেটিও তিনি নিবেদন করতে চান ধর্মরাজের হৃদয়ে। এদিকে ভীম প্রিয়ার ইচ্ছে পূরণ করার জন্যে—প্রিয়ায়াঃ প্রিয়কামঃ—চলে গেলেন সেই সহস্রদল পদ্ম জোগাড় করার জন্য।

সে কি সোজা কথা। গিরি-দরী, নদ-নদী পেরিয়ে, হাজারো বনস্থলী তছনছ করে, শেষে পূর্বজন্মের দাদা হনুমানের উপদেশ নিয়ে ভীমসেন গন্ধমাদনের বিশেষ বিশেষ জায়গায় সূর্যবরণ পদ্ম খুঁজে চললেন। তাঁর সদা সজাগ চোখ দুটি ছিল শুধু পর্বতসানুদেশে ফোটা ফুলের রাশির ওপর, আর পাথেয় ছিল দ্রৌপদীর বাক্য। দ্রৌপদী যে বলেছেন—যদি তুমি আমাকে একটুও ভালবাস, ভীম, আমাকে পদ্ম এনে দিতেই হবে। ভীম আরও তাড়াতাড়ি চললেন—দ্রৌপদীবাক্যপাথেয়ো ভীমঃ শীঘ্রতরং যযৌ। শেষে এক হরিণ-চরা বনের ধারে, হাঁস আর চখাচখীর শব্দ-মুখর নদীর মধ্যে ভীম দেখলেন সেই পদ্ম—হাজার, হাজার, যেন পদ্মের মালা সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে নদীর মধ্যে। পদ্মগুলি দেখার পরেই মহাবলী ভীমের যে প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, সেটি ভারী সুন্দর করে লিখেছেন ব্যাসদেব। ভীমের প্রতিক্রিয়ায় তাঁর একান্ত প্রেমের সঙ্গে করুণা মাখিয়ে দিয়েছেন চরিত্রচিত্রী ব্যাসদেব। পদ্মগুলি দেখেই ভীম যেন সব পেয়েছির দেশে পৌঁছে গেলেন—তদ্‌ দৃষ্ট্বা লব্ধকামঃ সঃ। পুষ্পদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে ভীমের মন যেন প্রিয়া দ্রৌপদীর সান্নিধ্য লাভ করল, যে দ্রৌপদীর রাজার দুলালী হয়েও বনবাসের কষ্টে মলিন—বনবাসপরিক্লিষ্টাং জগাম মনসা প্রিয়াম্‌। তাঁরই কষ্টার্জিত ফুল দিয়ে কৃষ্ণা ধর্মরাজের প্রিয় সাধন করবেন, এই কুটিলতা ভীমের মনে ছিল না। কৃষ্ণ মুখ ফুটে ফুল চেয়েছেন—এইটেই তাঁর কাছে বড় কথা ছিল। যার জন্য ফুল পাওয়া মাত্র তিনি লব্ধকাম, দ্রৌপদীর উষ্ণ সান্নিধ্য লাভ করেছেন মনে মনে। ভীম নিজে সরল মানুষ, তাঁর ভালবাসাও সরল। বিশেষত পদ্ম পাওয়া মাত্রেই তাঁর মনে যে কৃষ্ণার মলিন মুখখানি ভেসে উঠেছে তাতে বোঝা যায় নিজে সঙ্গে থাকলেও দ্রৌপদীর বনবাস তিনি কোনওদিন সহ্য করতে পারেননি।

ভীম যে দ্রৌপদীর জন্য পদ্মবনে গেছেন সে-কথা যুধিষ্ঠির জানতেন না। কাজেই ভীমকে বহুক্ষণ না দেখে তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে দ্রৌপদীকেই ভীমের কথা জিজ্ঞেস করলেন। তখন কিন্তু এই বিদগ্ধা মহিলা—তোমায় সাজাব যতনে কুসুম-রতনে—ইত্যাদি প্রেমালাপ যুধিষ্ঠিরকে উপহার দেননি। তিনি বললেন—ওই যে অপূর্ব পদ্মফুল, সেইগুলিই অনেকগাছি আমি ভীমকে আনতে বলেছি। আমার প্রিয় সাধনের জন্য—প্রিয়ার্থং মম পাণ্ডবঃ—তিনি বোধহয় গেছেন আরও উত্তরে। ঠিক কথাটাই দ্রৌপদী মুখ ফসকে বলে ফেলেছেন। ভীমকে তিনি কত ভালবাসতেন, সে বিসংবাদে কাজ নেই, তবে তাঁর ভাল লাগবে বলে, শুধুমাত্র তাঁর ভাল লাগবে বলে কত দুঃসাহস যে তিনি দেখিয়েছেন তা বলবার নয়। আর ঠিক এই সব জায়গায় মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিপ্রতীপ আচরণও লক্ষ করার মতো। ভীমের সঙ্গে দ্রৌপদীর সম্পর্ক যাই থাকুক, তার সঙ্গে যুধিষ্ঠিরের সম্পর্কটিও খেয়াল করে যেতে হবে।

আমাকে পুনশ্চ সেই বিবাহ-সভায় ফিরে যেতে হবে। সেখানে সমস্ত রাজপুরুষের মুখে চুনকালি দিয়ে যে পুরুষসিংহ দ্রৌপদীকে জিতে নিয়েছিলেন, মানসিকভাবে দ্রৌপদী যে তাঁকেই চিরজনমের সাথী হিসেবে পাবার স্বপ্ন দেখেছিলেন তাতে সন্দেহ কী? কিন্তু পাঁচজনের সঙ্গে কুটীরে ফিরে ভিক্ষা ভাগের প্রশ্ন যখন এল, তখন কি নববধূর কিছুই মনে হয়নি! যুধিষ্ঠির একবারই মাত্র অর্জুনকে এই বিবাহের ব্যাপারে ‘অফার দিয়েছেন। কিন্তু অর্জুন তা প্রত্যাখ্যান করলে যুধিষ্ঠির লক্ষ করলেন যে তাঁর অন্য তিন ভাই, প্রত্যেকেই যেন কৃষ্ণাকে আপন হৃদয়েই বসিয়ে ফেলেছে—হৃদয়ৈস্তামধারয়ন্‌। ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির তো তাঁর আপন ভাইগুলির দিকে সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন, কিন্তু তাঁর নিজের হাল কী হয়েছিল, তার দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি রেখেছিলে স্বয়ং মহাভারতকার ব্যাসদেব। এই জন্য তাঁকে দ্বিতীয় একটি শ্লোক লিখে বলতে হল—দ্রৌপদীকে দেখে তাদের সবার—সর্বেষাং—অর্থাৎ কিনা পাঁচ ভাইয়ের সমস্ত ইন্দ্রিয়-রন্ধ্র শিথিল হয়ে পড়েছিল, তাঁরা সবাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন কামনায়—সংপ্রমথ্য ইন্দ্রিয়গ্রামং প্রাদুরাসীৎ মনোভবঃ। আর এর ঠিক পরেই যুধিষ্ঠির দ্বৈপায়ন ব্যাসের বাক্য উদ্ধার করে দ্রৌপদীকে সবাই মিলে বিয়ে করা ঠিক করলেন। যেহেতু যুধিষ্ঠির এখানে প্রধান এবং প্রবক্তার ভূমিকায়, অতএব দ্রৌপদীর মত বিদগ্ধা মহিলা কি তাঁর এই ভূমিকা সহজ মনে গ্রহণ করেছেন। পরবর্তী সময়ে দ্রুপদের কাছে, ব্যাসের কাছে তিনি বারবার মাতৃবাক্য পালনের কথাই বলেছেন, কারণ তাতে সবারই সুবিধে। শেষে কিন্তু নিজের অবচেতন মনের কথাও তিনি চেপে রাখতে পারেননি। বলেছেন পাঁচভাই তাঁকে বিয়ে করুক—এ যেমন জননী কুন্তী বলছেন, এ তেমনি আমারও মনের —এবং চৈব বদত্যম্বা মম চৈতন্‌মনোগতম্।

এ আমারও ইচ্ছে—মনোগতম্‌—এই ইচ্ছেটুকুর মধ্যে ব্যক্তিত্ব আছে ঠিকই। কিন্তু সেই মুহূর্তে, যখন নাকি লজ্জানম্রা বধূটির পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব ছিল না, যেখানে তাঁর লক্ষ্যভেত্তা পুরুষসিংহ অর্জুন দাদাদের জন্য নিজের হক ছেড়ে দিয়েছেন, সেই কালেও দ্রৌপদী কি তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামীকে ক্ষমা করতে পেরেছেন! আমার তো মনে হয় যুধিষ্ঠিরকে সেই থেকে তিনি মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারেননি। মহাভারতকার স্পষ্ট করে এই ব্যাপারে স্বকণ্ঠে কিছু ঘোষণা করেননি, তবে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর ব্যবহার লক্ষ করার মতো। তার ওপরে পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে থাকা অর্জুনকে যদিও বা কোনও পর্যায়ে লাভ করা যেত, তাঁকেও তিনি পরম লগ্নে হারিয়ে বসলেন সেই যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে অস্ত্রাগারে রসালাপ করে। দ্রৌপদী নিজেকেই বা কী করে ক্ষমা করবেন! যুধিষ্ঠিরের কথা তো ছেড়েই দিলাম, যদিও এর ফল ভুগতে হয়েছে যুধিষ্ঠিরকেই, অন্য সময়ে, অন্যভাবে।

অবশ্য যুধিষ্ঠিরের দোষ কম ছিল না। যুধিষ্ঠিরের স্বামিত্বে খুব অল্পদিনই কৃষ্ণার ভাগ্যে সু জুটেছিল—ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্যলাভের পর রাজসূয় যজ্ঞের রমরমা পর্যন্ত। তারপরেই যুধিষ্ঠিরের মাথায় ভূত চাপল ; তিনি কৌরবদের আহ্বানে শকুনির সঙ্গে পাশা খেলতে বসলেন। মহামতি বিদুর তাঁকে বারণ করেছিলেন, তবু তিনি পাশায় হাত লাগালেন। শকুনির সঙ্গে পাশার দান দিতে দিতে যুধিষ্ঠির একে একে সব হেরে বসলেন—ধন-জন, রাজ্য, সম্পত্তি সব। শেষে ভাইদের সঙ্গে নিজেকেও পণ রেখে হারলেন। তাঁর পণ রাখার মতো যেন কিছুই রইল না। শেষ পণে যখন যুধিষ্ঠির নিজেকেই হারালেন, তখন কূটবুদ্ধি শকুনি বললেন—এ ভারী অন্যায় কাজ করলে রাজা, নিজেকে তুমি হেরে বসলে? তোমার ঘরে অমন ভাল জিনিসটা থাকতেও তুমি…? সর্বহারা যুধিষ্ঠির তবুও যখন কোন জিনিসটা ভেবে পাচ্ছেন না, ঠিক তখুনি শকুনি তাঁকে মনে করিয়ে দিলেন—ঘরে আছে তোমার প্রিয়া পত্নী পাঞ্চালী, তাকে পণ রেখে, তুমি অন্তত নিজেকে জিতে নাও, অর্থাৎ কিনা নিজেকে অন্তত ফের পাশার দান দেওয়ার উপযুক্ত রাখ। যুধিষ্ঠিরের একটুও স্থিরবুদ্ধি কাজ করেননি, তিনি দ্রৌপদীকেই পণ রেখে বসলেন! প্রত্যেকবার হারার পর যুধিষ্ঠির যখন আবার পণ রাখছিলেন, তখন সেই পণ-রাখা বিষয়ের বিশেষ গুণগুলিও বলছিলেন। এবারে তা বাদেও তিনি নির্লজ্জের মতো উন্মুক্ত সভায় তাঁর রূপরাশি বর্ণনা করলেন—যে রূপের কথা শুনলে অন্যের কামনার উদ্রেক হয়, সেই রূপ-বর্ণনা। যুধিষ্ঠির বললেন—সেই ক্ষীণমধ্যা দ্রৌপদীকে এবার পণ রাখলাম। সভায় সকলে ধিক ধিক করে উঠল। শকুনি পণ জিতে নিলেন, কিন্তু নিজেকে জয়-করা যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে আর খেললেন না। তাঁর কাজ শেষ হয়ে গেছে।

দ্রৌপদীকে পণে জেতার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধন আদেশ দিলেন দ্রৌপদীকে সভার মধ্যে নিয়ে আসতে। সারথি ক্লাসে’র এক লোক—প্রাতিকামী বলে তাকে ডাকা হয়েছে মহাভারতে—সে চলল দুর্যোধনের আদেশ পালন করতে। সিংহের গুহায় ঢোকা কুকুরের মতো প্রাতিকামী পাণ্ডবদের প্রিয়া মহিষীকে বলল—যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় মত্ত, মহারাজ দুর্যোধন তোমায় জিতে নিয়েছেন, দ্রৌপদী। তুমি চল এখন ধৃতরাষ্ট্রের ঘরের কাজে নিযুক্ত হবে। —নয়ামি ত্বাং কর্মণে যাজ্ঞসেনি। দ্রৌপদীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। “এ তুমি কী বলছ প্রাতিকামী?”—দ্রৌপদী বললেন। সীতা-সাবিত্রীর আদর্শ তাঁর চলে না, অতএব তাঁর বক্তব্যে কোনও স্বামী-সোহাগ নেই। সোজা বললেন—রাজার ঘরের কোনও ভদ্র ছেলে বউকে পণ রেখে পাশা খেলে? পাশা খেলায় মজে গিয়ে রাজার যুক্তি বুদ্ধি সব গেছে, নইলে পণ রাখার মঙ্গো শিনিস আর কি কিছু ছিল না? প্রতিকামী বলল—থাকবে না কেন? ধন সম্পত্তি তাঁর আগেই গেছে। তারপর ভাইদের বাজি রেখেছিলেন তারপর নিজেকে, অবশেষে তোমাকে। দ্রৌপদী বললেন—ওরে সারথির পো, তুই আগে গিয়ে জুয়াড়িকে জিজ্ঞাসা কর যে, সে আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরেছে, না, আগে আমাকে বাজি রেখে হেরেছে?

এই বিপন্ন মুহূর্তে এর থেকে ভাল জবাব আর কিছু হতে পারে না। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের অধিকারের প্রশ্ন তুলেছেন। কোন অধিকারে, কার অধীশ্বর ভেবে ধর্মরাজ দ্রৌপদীকে বাজি ধরেছেন—কস্যেশো নঃ পরাজৈষীরিতি ত্বামাহ দ্রৌপদী। ধর্মনন্দন কোনও জবাব দিতে পারেননি, ভাল মন্দ কিছু না—বচনং সাধ্বসাধু বা। দুর্যোধন বললেন—এসব প্রশ্নোত্তরের মীমাংসা দ্রৌপদী সভায় এসেই করুক না। প্রাতিকামী আবার এসে বলল। দ্রৌপদী আবার কুরুবংশের সভাসদদের মতামত চেয়ে প্রাতিকামীকে ফিরে পাঠালেন। কিন্তু এ যেহেতু দুর্যোধনের ইচ্ছে, অতএব কুরুকুলের বৃদ্ধেরা কিছু বলার চেয়ে অধোমুখে থাকাই বেশি সুবিধে মনে করলেন। এই অবস্থায় যুধিষ্ঠিরই স্বয়ং দূত পাঠালেন কৃষ্ণার কাছে, তাঁর বক্তব্য ছিল—পাঞ্চালী যেন সভায় আসেন। যে কাপড় পরে আছেন, সেই কাপড় পরেই, একবস্ত্রা অন্য আচ্ছাদনহীন। পরনের কাপড়টি নাভির ওপরে বেঁধে তিনি যেন আসেন। তিনি যেন শ্বশুর ধৃতরাষ্ট্রের সামনে আসেন কাঁদতে কাঁদতে—অধোনীবি রোদমানা রজস্বলা।

যার তখন এমনিই কান্নায় ভেঙে পড়তে ইচ্ছে করছে, সেই দ্রৌপদীকে কি কান্নার অভিনয় করতে উপদেশ দিচ্ছেন ধর্মপুত্র! যে সংযম নিজের হাতের মুঠোয় ছিল, সেটা বাদ দিয়ে যুধিষ্ঠির এখন শ্বশুরের সামনে কান্নাকাটি করার জন্য দ্রৌপদীকে শিক্ষা দিচ্ছেন। এনি স্বামীকে তিনি কী করে ক্ষমা করবেন! বরঞ্চ হঠাৎ-ক্রোধী ভীমসেন দ্রৌপদীর আছে অনেক লাভ, কেননা সে অন্তত রাগের সময় রাগ করা জানে। আমি বলি, ভীমের সংযম নেই কে বলেছে! যুধিষ্ঠির এত কর্ম করে চলেছেন। ভীম তো কিছুই বলেননি। দুর্যোধন বললেন—এই প্রাতিকামী সূতের বেটাকে দিয়ে কাজ হবে না, ও বোধহয় ভীমকে ভয় পাচ্ছে! অথচ ভীম তখনও কিছুই বলেননি। দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন গেলেন এবার দ্রৌপদীকে ধরে আনতে। তার চোখ লাল, নিজের ওপরে তার কোনও শাসন নেই—সেই দুঃশাসন গিয়ে খলনায়কের দ্রৌপদীকে বললেন—এস গো, এস এস! তোমায় আমরা জিতে নিয়েছি! লজ্জা কীসের সুন্দরী! একবার দুর্যোধনের দিকে তাকাও—দুর্যোধনং পশ্য বিমুক্তলজ্জা। এবার পাণ্ডবদের ছেড়ে কৌরবদের আত্মদান কর—কুরূন্ ভজস্বায়ত-পদ্মনেত্রে। দৌপদী রাজবালা, এসব শোনা তাঁর অভ্যাস নেই। বিবর্ণা, হাতে মুখ ঢেকে কেবল পিছু হঠছেন, কুরুস্ত্রীদের মধ্যেও তাঁর আশ্রয় মিলল না। দুঃশাসন এবার তাঁর চুলে হাত দিল। যে চুল একদিন রাজসূয়ের যজ্ঞজলে অভিষিক্ত হয়েছিল, যে চুলের মধ্যে রাজেন্দ্রানী হবার জল্পনা মেশানো ছিল, দুঃশাসন সেই চুলে হাত দিল। পাঁচ স্বামীর সাহচর্যে নাথবতী হয়েও অনাথের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললেন—ছোটলোক, অনার্য! রজস্বলা অবস্থায় এক কাপড়ে বসে আছি আমি। এ অবস্থায় আমাকে তুমি সভার মধ্যে নিয়ে যেতে পার না। খলহাসি হেসে দুঃশাসন বলল—তুমি রজস্বলাই হও আর, এক কাপড়েই থাক অথবা গায়ের কাপড় গায়ে নাই থাকুক—রজস্বলা বা ভব যাজ্ঞসেনি একাম্বরা বাপ্যথবা বিবস্ত্রা—সভায় তোমাকে যেতেই হবে। তুমি আমাদের কেনা বাঁদী, আমরা যেমন খুশি ব্যবহার করব।

দ্রৌপদী সভায় এলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর অপমান বাড়তে থাকল, বাড়তে থাকল দুঃশাসনের দুঃশাসন হাসি, কর্ণের ‘দাসী, দাসী’ চিৎকার (ভাবটা এই, স্বয়ম্বর সভায়—‘সুতের ছেলেকে বিয়ে করব না বলেছিলি, এবার ঠেলা সামলা)। কেউ কিছু বলছে না, শুধু অপমান, কাপড় ধরে টানাটানি, হাসি, ‘দাসী’ আরও হাসি। এই কতক্ষণ চলল। কথা বলছেন শুধু দ্রৌপদী, ন্যায়, যুক্তি, ধর্মের কথা। যাদের উদ্দেশে বলছেন তারা সবাই চুপ। মাঝে মাঝে শুধু আগুন-পানা কটাক্ষ হানছেন পাণ্ডবদের দিকে। এক-একটি কটাক্ষে পাণ্ডবদের অন্তরাগ্নি যেন জ্বলে উঠতে লাগল—সন্দীপয়ামাস কটাক্ষপাতৈঃ। ভীম তবু কিছু বলেননি। এরপরে যখন একবার উত্তরীয় বসন, মানে দ্রৌপদীর উত্তমাঙ্গের বসন টেনে খোলার চেষ্টা করলেন দুঃশাসন, তখন ভীম আর থাকতে পারলেন না। থাকা সম্ভবও নয়। তিনি অপরকে কী গালাগালি দেবেন, যার জন্যে আজ নিজেদের এবং দ্রৌপদীর এই দুর্দশা সেই বড়ভাই যুধিষ্ঠিরের হাত দুটিই তিনি পুড়িয়ে দেবেন ঠিক করলেন। সহদেবকে বললেন—আগুন নিয়ে এস তো। ভীম বললেন—দেখ যুধিষ্ঠির, জুয়াড়ি পাশাড়েদের বাড়িতে যদি বেশ্যারা থাকে, জুয়াড়িরা তাদের পর্যন্ত খেলায় রাজি রাখে না, বেশ্যাদের ওপরেও তাদের দয়ামায়া আছে। তোমার সেটুকুও নেই। তুমি এতক্ষণ ধরে আমাদের ভাইদের নিয়ে যথেচ্ছ ফাটকাবাজি খেলেছ, কিন্তু কিছুই বলিনি, তুমি এবার দ্রৌপদীকে বাজি রেখেছ, আর তোমায় ছাড়ব না। তোমার জন্যেই এই সুকুমারী কুলবধূর এত লাঞ্ছনা। যা রাগ হচ্ছে, এবার তোমার হাত দুটোই আমি পুড়িয়ে দেব। সহদেব! আগুন নিয়ে এস তো—বাহু তে সংপ্রধক্ষ্যামি সহদেবাগ্নিমানয়। অর্জুনের চেষ্টায় শেষ পর্যন্ত ভীমের এ দাহনেচ্ছা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু লাঞ্ছনার সময়ে অন্তত ভীমের এই ব্যক্তিত্বটুকু নিশ্চয়ই বড় মধুর লেগেছিল দ্রৌপদীর কাছে। দুঃশাসনের অপমান চরমে উঠলে এই ভীমই আবার তার রক্তপান করার প্রতিজ্ঞা নিলেন। দুর্যোধন নিজের উরুর কাপড় সরিয়ে দ্রৌপদীকে অধম ইঙ্গিত করার পর সেই ভীমই কিন্তু উরু ভেঙে দেবার সংকল্প নিয়েছেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, ভীম কিছুই করতে পারছেন না, শুধু একের পর এক ধবংসের প্রতিজ্ঞা নিয়ে যাচ্ছেন।

এইগুলি দ্রৌপদীর স্ত্রীহৃদয়ে কাজ করেছে, কাজ করেছে স্বামীর সঙ্গে ব্যবহারেও। নকুল, সহদেব, অর্জুন, যুধিষ্ঠির সবাই চুপ, শুধু ভীম একের পর এক প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিয়ে যাচ্ছেন। দ্যুতসভার মাঝখানে অসহায় দ্রৌপদী এবার বোধহয় বুঝতে পারলেন যাকে তিনি ভালবাসেন, সে বুঝি তাঁকে ভালবাসে না। কই গাণ্ডীবধম্বার মুখ দিয়ে একটি আওয়াজও তো বেরল না, কিছু করতে নাই পারুন, অন্তত প্রতিবাদ। স্বামী আত্মসার, নাকি সে আপন স্ত্রীর গৌরবে মহিমান্বিত, তার রক্ষা বিধানে তৎপর, তা বোঝবার এই তো সময়। দ্রৌপদী স্বামীদের চিনে নিলেন। এরপর তিনি যতবারই বিপদে পড়েছেন, তিনি ভীমের কাছেই তা জানিয়েছেন, মহাভারতের উদাত্ত নায়ক অর্জুনকে নয়। উদ্ধত ব্যক্তিত্ব দ্রৌপদীর ভাল লাগে, ধীরোদাত্ত নায়কত্ব নয়। এই দূতসভায় অকর্মণ্য অক্ষম অর্জুনকে তিনি যেমন চিনলেন তেমনি চিনলেন যুধিষ্ঠিরকে—ক্রোধহীন, আপন স্ত্রী-রক্ষায় অপারগ, প্রতিবাদহীন—শুধু ধর্মসার। পতিধর্মের জন্য যদি স্ত্রীধর্ম ত্যাগ করতে হয় তা হলে স্ত্রীলোকের কী রইল, বিশেষত যে নারী নিজেই অত ব্যক্তিত্বহীন নন। আগুন থেকে তাঁর জন্ম, আগুন তাঁর স্বভাবে রয়েছে। সেই আগুনে যিনি চিরকাল সর্বনাশের হাওয়া লাগিয়েছেন, তিনি বায়ুপুত্র ভীম, অন্য কেউ নন। দ্বিতীয়বার পাশা খেলায় হেরে পাণ্ডবদের যখন বনে যাওয়া ঠিক হল, তখন দুঃশাসন দ্রৌপদীকে বলেছিল—তুমি আবার বনে যাচ্ছ কেন, সুন্দরী! তোমার বাবা কী পুণ্যের কাজ করেছেন এই নপুংসক পাণ্ডবদের সঙ্গে তোমার বিয়ে দিয়ে। দেখ না কেমন জ্যালজেলে পাতলা কাপড় পরে বনে চলেছে তোমার স্বামীরা—টাকা নেই, পয়সা নেই, প্রতিষ্ঠা নেই, কিছুই নেই। বনে গিয়ে তোমার কী সুখ হবে সুন্দরী! তার চেয়ে এই কৌরবদের মধ্যেই কাউকে তুমি বরং স্বামী বেছে নাও। কৌরবদের কত ধন-জন, টাকা-পয়সা। এদের যে কোনও একজনকে তুমি পতিত্বে বরণ করতে পার—এষাং বৃণীস্ব একতমং পতিত্বে। চাল ছাড়া যেমন ধানের খোসা, পশুর চামড়াপরা খেলনা যেমনটি, পাণ্ডবরাও ঠিক তেমনি—এদের সেবা করে তুমি কী করবে?

কেউ এসব কথার প্রতিবাদ করেননি। সুকুমারী কৃষ্ণারও আর দুঃশাসনের সঙ্গে কথা বলার প্রবৃত্তি ছিল না। সিংহ যেমন শেয়ালের দিকে ধেয়ে আসে, তেমনি ভীম এবার ধেয়ে এলেন দুঃশাসনের দিকে। আবার সেই প্রতিজ্ঞা—বুক চিরে রক্ত খাব। একেবারে শেষে বুঝি সবাই এবার ক্ষেপে উঠলেন, অর্জুন, নকুল, সহদেব—সবাই। সবাই এবার ভীমের সঙ্গে গলা লিখে প্রতিশোধের প্রতিজ্ঞা নিলেন। কিন্তু প্রথমে ভীম। কৃষ্ণা আবার তাঁকে চিনলেন।

একটা কথা এখানে বলে রাখাই ভাল। রামায়ণের সীতা এবং মহাভারতের দ্রৌপদী—এই দুজনেরই একমাত্র মিল হল যে তাঁরা অযোনিসম্ভব—অর্থাৎ কিনা তাঁদের জন্মে অলৌকিকতার গন্ধ আছে। কিন্তু এই দুই মহাকাব্যের নায়িকা-চরিত্র এত বিপরীত যে ভয় হয়—একের পরিস্থিতিতে আরেকজন পড়লে কী করতেন। কল্পনা করতে মজা পাই—যদি দণ্ডকবনে লক্ষ্মণের গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে এসে দ্রৌপদী ভিক্ষা দিতেন রাবণকে, তবে হয় তাপসবেশী রাবণের দাড়ি-গাছি উপড়ে নিতেন দ্রৌপদী ; আর সীতা যদি শ্লথবাসা হতেন উন্মুক্ত রাজসভায় তবে তিনি তক্ষুনি ধরণী দ্বিধা হবার মন্ত্র পড়ে চিরতরে ঢুকে পড়তেন পাতালে ; মহাভারত কাব্যখানাই অর্ধসমাপ্ত রয়ে যেত। যদি বলেন রাজসভায় দ্রৌপদীই বা এমনকী করেছেন যে, আমরা তাঁর গুণপনায় মুগ্ধ হচ্ছি। আমি বলব অনেক কিছু করেছেন, যা সর্বংসহা সীতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। সীতাকে যদি রামচন্দ্র বলতেন যে তুমি সভায় এসে শ্বশুরের সামনে কান্নাকাটি কর তা হলে তাই করতেন। তাঁর পক্ষে কি রামচন্দ্রকে ‘জুয়াড়ি’ সম্বোধন করে এই প্রশ্নটা করা সম্ভব হত যে, পাশাখেলায় আগে নিজেকে বাজি রেখে হেরেছেন, না আগে তাঁকে বাজি রেখেছেন—কিং নু পূর্বং পরাজৈষীরাত্মানাম্‌ অথবা নু মাম্?

এ তো রীতিমতো ‘ল-পয়েন্ট’। সভাসদদের কারও পক্ষে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়নি। প্রাতিকামী, যে দ্রৌপদীকে নিতে এসেছিল, সেও বুঝতে পেরেছিল প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে গেছে দুর্যোধনও, যার জন্যে প্রাতিকামী দ্বিতীয়বার বলেছে—তা হলে আমি রাজকুমারী কৃষ্ণাকে কী বলব—উবাচ কৃষ্ণাং কিমহং ব্রবীমি? দুর্যোধন বলেছেন—প্রাতিকামী ভীমকে ভয় পাচ্ছে। তা মোটেই নয়। সে দ্রৌপদীকেই ভয় পাচ্ছিল—স্ত্রীলোকের কাছে এমন সাংঘাতিক আইনের প্রশ্ন শুনেই সে দ্রৌপদীর ওজন বুঝেছে—ভীতশ্চ কোপাদ্‌ দ্রুপদাত্মজায়াঃ। দ্রৌপদীর মুখে আইনের প্রশ্ন শুনে সভাসদ কুরুবৃদ্ধেরা যে চুপ করে গেলেন তার কারণ একটাই। বাপের বাড়িতে দ্রৌপদী কিছু কিছু শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁর বাবা দ্রুপদ বাড়িতে পণ্ডিত রেখে ছেলে ধৃষ্টদ্যুম্নের লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। দ্রৌপদী যে তাঁর কাছ থেকে এবং ভাইয়ের কাছ থেকেও বিদ্যা শিখে নিতেন সে-কথা দ্রৌপদী নিজেই কবুল করেছেন মহাভারতের বনপর্বে। আর আইনের ব্যাপারে দ্রৌপদীর আগ্রহ ছিল বিশেষ রকম। তখনকার দিনে আইনের বই বলতে বৃহস্পতিসংহিতা, শুক্ৰসংহিতা—এই সবই ছিল। ঘরে রাখা সেই পণ্ডিতের কাছে বৃহস্পতি-নীতির পাঠ নিতেন প্রধানত দ্রুপদ রাজা : কিন্তু আইনের ব্যাপারে দ্রৌপদীর এত আগ্রহ ছিল যে ওই পাঠ-গ্রহণের সময় তিনি কোনও কাজের অছিলায় চলে আসতেন সেইখানে, যেখানে গুরুজি বৃহস্পতি পড়াচ্ছেন। দ্রৌপদীর আগ্রহ দেখে গুরুজিও তাকে সস্নেহে বৃহস্পতি-নীতির উপদেশ দিতেন এবং বাবার আদরের দুলালী সঙ্গে সঙ্গে বাবার কোলে বসে যেতেন বৃহস্পতির লেখা আইন বোঝবার জন্য—স মাং রাজন্ কর্মবতীম্‌ আগতামাহ সান্ত্বয়ন্। শুশ্রুষমাণাম্‌ আসীনাং পিতুরঙ্কে যুধিষ্ঠির।

বাপের ঘরে শেখা এই আইনের পাঠ যে দ্রৌপদীর জীবনে কত কাজ দিয়েছে তা আমরা পদেই পদেই দেখতে পাব। সভায় এসে এত কাপড় টানাটানি আর চুলের মুঠি পাকড়ানোর মধ্যে দ্রৌপদী আর কুলবধূর প্রণাম-আচারে মন দেননি। তিনি সোজা কুরুপ্রধান সভামুখ্যদের উদ্দেশ করে বললেন—এঁরা তো সব শাস্ত্রজানা, শাস্ত্রের প্রয়োগ-জানা মানুষ—উপনীতশাস্ত্রাঃ ক্রিয়াবন্তঃ—সবাই আমার গুরুস্থানীয় অথবা গুরু। আপনাদের সামনে আমার এমনিভাবে দাঁড়াতেই ইচ্ছে করছে না। দ্রৌপদীর ইঙ্গিতটা হল, তাঁকে যে সভার মাঝখানে এসে দাঁড়াতে হল, তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব এই কুরুমুখ্য সভাসদদের। কারণ দুর্যোধন তো রাজা নন, তা হলে রাজসভায় তাঁকে ধরে আনা হয়েছে কার আদেশে? ওই মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের ওপর হাজার রাগ থাকলেও দ্রৌপদী তাঁকে ‘ডিফেন্ড’ করে বললেন—ধর্মরাজ সত্য বলেছেন, তাঁর কথার গুণটাই আমি ধরব, দোষটা নয়। হ্যাঁ ধরেই নিলাম তিনি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। গুলী এবার দুঃশাসনকে বলার ছলে গুরুস্থানীয়দের উদ্দেশে বলল—এই যে কুরুবীরদের মধ্যে অসহায় রজস্বলা এক কুলবধূকে নিয়ে তুমি টানাটানি করছ, দুঃশাসন! এবং এই ব্যাপারে যে কেউ এক বর্ণ নিন্দাও করছেন না তোমার, তাতে বুঝি এ-বিষয়ে কুরুবৃদ্ধদের অনুদান লাভ করেছ তুমি—ধ্রুব তবেদং গতমভ্যূপেতঃ! হায়! প্রসিদ্ধ ভরতবংশর আজ কী গতি হয়েছে। আজকে ধর্ম দাঁড়িয়ে আছে লুপ্তি-রেখার ওপর, ক্ষত্রিয় চরিত্রহীন, নইলে কুরুবংশীয়া সভায় দাঁড়িয়ে কুলবধূর ধর্ষণ দেখছেন—প্রেক্ষন্তি সর্বে কুরবঃ সভায়াম্‌? ভীষ্ম, দ্রোণ, ঐবং বিদুর—এঁদের কি কোনও অস্তিত্ব আছে, না এঁরা মারা গেছেন? মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের অস্তিত্বে সন্দিহান আমি, নইলে এই কুরুবৃদ্ধ এবং প্রধানেরা কিছুই কি লক্ষ্য করছেন না!

মহামতি ভীষ্ম এবার মুখ খুললেন কিন্তু তিনিও কোনও সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না। এতকালের রাজনীতির অভিজ্ঞতায় তাঁর শুধু দ্রৌপদীর আইনের প্রশ্নটি মনে আছে। উকিলের জেরা শুনে জজসাহেবের যে প্রাথমিক দ্বন্দ্ব হয়, ভীষ্মের অবস্থাও ঠিক সেইরকম। বস্ত্রাকর্ষণে তাঁর মাথাব্যথা বেশি নেই, কিন্তু বিদগ্ধা মহিলার চতুর প্রশ্নে তিনি বেশি বিচলিত। তিনি বললেন—যিনি পূর্বাহ্নেই নিজেকে বাজি রেখে হেরেছেন তিনি পরের ধন বাজি রাখতে পারেন না। দ্রৌপদী তো যুধিষ্ঠির ছাড়া অন্য চারজনেরও বউ। আবার ভাবছি স্ত্রী মাত্রেই তো স্বামীর অধীন, সেখানে তোমার প্রশ্নের যৌক্তিকতা কী? কথা আছে আরও। ভীষ্ম বলে চললেন—শকুনি যখন যুধিষ্ঠিরকেও পণে জিতে নিলেন, তখন যুধিষ্ঠির বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি বিজিত হলাম—জিতো’স্মি। এ-কথায় বোঝা যায় তিনিই পরাজিত হয়েছেন, তাঁর স্ত্রী নন। অন্যদিকে শকুনি হল ধুরন্ধর পাশাড়ে। ভীষ্ম বললেন—যুধিষ্ঠিরকে জয় করলেই যে তাঁর স্ত্রীও সেই জয়ের ভাগে পড়েন না, একথা শকুনি বিলক্ষণ জানেন। জানেন বলেই শকুনি যুধিষ্ঠিরকে জয় করার পরেও দ্রৌপদীকে পণ রাখার জন্য যুধিষ্ঠিরকে নিজেই বলেছেন ; যুধিষ্ঠির নিজে সে পণ রাখেননি। কিন্তু শকুনির বুদ্ধিতে যে তোমাকে পণ রাখা হল—এ কথা শকুনি স্বীকার করবেন না। কিন্তু যুধিষ্ঠির স্বেচ্ছায় এই ধুরন্ধর শকুনির সঙ্গে পাশা শেলছেন—সেখানেই বা বা আমি কী বলি।

দ্রৌপদী আবার ‘ল-পয়েন্ট’ ধরলেন—‘স্বেচ্ছায়?’ অনার্য দুষ্টবুদ্ধি লোকেরা যারা দিনরাত পাশা খোল ছল-চাতুরি সব তাতেই হাত পাকিয়েছে, তারা গিয়ে নবিশী করা ‘অ্যামেচার’—‘নাতিকৃতপ্রযত্ন’, ‘অনভ্যস্তদ্যুত’—যুধিষ্ঠিরকে আহ্বান করে সভায় নিয়ে এসে নিজেদের কার্যসিদ্ধি করলেন—সেখানে যুধিষ্ঠির ‘স্বেচ্ছায়’ পাশা খেলতে এসেছেন এটা কেমন কথা হল—কস্মাদয়ং নাম নিসৃষ্টকামঃ? ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির এ কথা বুঝতে পারেননি যে, এই বদমাশ লোকগুলো পাশা খেলার নামে জুয়াচুরি করে। সবাই মিলে ছল করে তাঁকে হারানো হয়েছে। এখন তিনি বুঝতে পারছেন যে, খেলার নামে এটি জুয়োচুরি—পশ্চাদয়ং কৈতবমভ্যুপেতঃ। যা হোক ছাড়ুন এসব কথা, এখানে তো কুরুরা সবাই আছেন তাদের ঘরে নিজেদের ছেলে আছে, ছেলের বউও আছে, তাঁরা আমার একটি প্রশ্নের জবাব দিন।

কী প্রশ্ন দ্রৌপদীর দিক থেকে হতে পারে, তা সবাই বুঝতে পারছিলেন, এবং এই মোক্ষম প্রশ্ন করার আগেই তাই দুঃশাসনের টানা-হ্যাঁচকা বেড়ে গেল। দ্রৌপদীর আর প্রশ্ন করা হল না। বিবসনা হবার ভয়ে তখন তিনি মন্ত্র আউড়ে চলেছেন—গোবিন্দ দ্বারকাবাসিন্‌ কৃষ্ণ গোপীজনপ্রিয়। অলৌকিক উপায়ে দ্রৌপদীর আব্রু-রক্ষা হল বটে, কিন্তু দুঃশাসন, কর্ণ, দুর্যোধন—এঁদের কটুক্তি, অধম ইঙ্গিত থেকে রেহাই পেলেন না তিনি। কৌরবদের যা তা বললেন দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণ। একমাত্র তিনিই দ্রৌপদীর যুক্তির সারবত্তা মেনে নিয়ে দ্রৌপদীকে সম্মান করেছেন। শেষরক্ষা করেছেন বিদুর, যিনি রাজনীতি জিনিসটা গুলে খেয়েছিলেন। তিনি পরিষ্কার জানালেন—দ্রৌপদী পণজিতা নন, কারণ পণ রাখার সময়ে যুধিষ্ঠিরের আপন স্বত্বই ছিল না। এখন যা ঘটছে তার সবটাই শকুনির চালাকি।

দ্রৌপদীর একটা প্রশ্নের মধ্যে যে গাম্ভীর্য ছিল—তা বোঝা যায় সমবেত কুরুবীরদের মাথা চুলকানি দেখে! শেষ পর্যন্ত যখন বিদুর আর গান্ধারীর চাপ আসতে লাগল অন্ধ রাজার ওপর, তখন ধৃতরাষ্ট্রের চৈতন্যোদয় হল যেন। তিনি এবার দ্রৌপদীকে বর দিতে চাইলেন। প্রথম বরেই দ্রৌপদী যেন ঝাঁটা কষিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরের মুখে। দ্রৌপদী বললেন—ধর্মের অনুগামী যুধিষ্ঠিরকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিন প্রথমে। যুধিষ্ঠির মনস্বী, বিদ্বান মানুষ, ভাবনা-চিন্তা করে কাজ করেন তিনি, সেই মনস্বী মানুষটাকে ছেলে-ছোকরারা, মানে, আপনার ছেলেরা যেন আবার দাস বলে না ডাকে। তা ছাড়া যুধিষ্ঠিরের থেকেই আমার ছেলে—প্রতিবিন্ধ্য ; রাজার ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তাকে সবাই দাসপুত্র বলবে—এও কি হয়? মুক্ত হলেন যুধিষ্ঠির। দ্বিতীয় বর। মুক্ত হলেন ভীম, অর্জন, নকুল-সহদেব। ধৃতরাষ্ট্র বললেন—আমার ঘরের সব বউদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ তুমি। তুমি তৃতীয় বর চাও। বীরোচিত বিদগ্ধতায় ধৃতরাষ্ট্রের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন তিনি। বললেন—ক্ষত্রিয়ের বউকে দুই বরের বেশি বর চাইতে নেই। তা ছাড়া আমার স্বামীরা এখন দাসত্ব থেকে মুক্ত, তাঁদের ভাল এখন তাঁরা নিজেরাই করতে পারবেন—বেৎস্যন্তি চৈব ভদ্রাণি রাজন্ পুণ্যেন কর্মাণা।

ভাল করাটা কিছুই হয়ে ওঠেনি আর। রাস্তায় বেরতে না বেরতেই আবার তাঁদের পাশাখেলার ডাক পড়ল। শকুনির মায়াপাশার ডোরে আবার তাঁরা বাঁধা পড়লেন ; ফল—বনবাস এবং অজ্ঞাতবাস। গাছের ছাল পড়ে দ্রৌপদীকে নিয়ে পাণ্ডবেরা এলেন বনে। বন তাঁদের কাছে কিছু নতুন নয়, এমনকী ভিক্ষা করাও নয়—দুয়েরই স্বাদ তাঁরা জানেন।

চলছিলও ভালই। ব্রাহ্মণেরা যুধিষ্ঠিরকে নানা উপদেশ দিচ্ছেন, দ্রৌপদী সূর্যমার্কা থালার দৌলতে ঝালে-ঝোলে-অম্বলে সবাইকে খাওয়াচ্ছেন, চারভাই বনে বনে ঘোরেন, আর যুধিষ্ঠির ধর্মকথা শোনেন। এই গড্ডলিকা দ্রৌপদীর যেন আর সহ্য হচ্ছিল না। বীর ক্ষত্রিয় পুরুষেরা নিষ্কর্মার মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে আর যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণ-সম্মেলন করে যাচ্ছেন। ওদিকে শত্রুর বৃদ্ধি ঘটছে। দুর্যোধন ভালই রাজ চালাচ্ছেন, সে খবরও দ্রৌপদীর কাছে আছে। এই অবস্থায়, যুধিষ্ঠির যদি দুঃখ দুঃখ মুখ করে দ্রৌপদীকে স্তোক দিতেন কিংবা কোমর বাঁধতেন পরবর্তী প্রতিশোধের জন্য—তাও বুঝি কিছু সান্ত্বনা থাকত। কিন্তু তিনি নির্বিকার, অনুৎসাহী—ব্রাহ্মণোচিত ধর্মচর্চায় আবদ্ধ। ফেটে পড়লেন দ্রৌপদী।

যুধিষ্ঠিরের ওপর তাঁর রাগ জমা ছিল বহুদিনের। যে যাই বলুক, দ্রৌপদী জানতেন—তাঁর এ দুরবস্থা যুধিষ্ঠিরের জন্যই। সকলের সম্মানিত ধর্মরাজ স্বামীকে তিনি বারবার শ্রদ্ধা করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু একই সঙ্গে পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরের অত্যাসক্তি তাঁকে তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামীর ওপর সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল হতে বাধা দিয়েছে। যে দূতাসক্তি একদিন তাঁকে পণ্য করে তুলেছিল, যে দ্যুতাসক্তি একদিন তাঁকে রাজসভায় বিবস্ত্রা করার সুযোগ এনে দিয়েছিল শত্রুপক্ষের কাছে, তিনি যতই ধর্ম-উপদেশ করুন না কেন, ঘা-খাওয়া রমণীর কাছে তা ধর্মধ্বজিতা বলে মনে হয়। সত্যিই যে দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে এই ধারাতেই ভাবতেন তার প্রমাণ পাব সেই বিরাট পর্বে, কীচক যেখানে দ্রৌপদীর পেছন পেছন ঘুর-ঘুর করছেন। অপমানিতা দ্রৌপদী তাঁর চিরদিনের বিশ্বাসী ভীমের কাছে সেদিন বলেছিলেন—তোমার বড়ভাই যুধিষ্ঠিরকে তুমি নিন্দা করতে পার, যার পাশা খেলার সখ মেটানোর জন্য আমাকে এই অনন্ত দুঃখ সইতে হচ্ছে। পৃথিবীতে এক জুয়াড়ি ছাড়া এমন আর কে আছে যে রাজ্য হারিয়ে, নিজুক হারিয়ে, শেষে বনবাসের জন্য আবার পাশা খেলে—প্ৰবজ্যাগৈব দীব্যেত বিনা দুর্দ্যূত-দেবিনম্‌।

দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে কর্ম করতে পারেননি, কোনওদিনও পারেননি। বনবাসে কিছুদিন কাটার পরেই তিনি রাগে ফেটে পড়লেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। না, এ ঝগড়াটা নেহাত সাধারণ স্তরের ছিল না। বিবাহ এবং ছেলেপুলে হবার পর কতা-গিন্নির যে গার্হস্থ্য কলহ-এ তাও নয়। ঝগড়ার পূর্বাহ্নেই ব্যাসকে দ্রৌপদীর সম্বন্ধে বলতে হয়েছে—প্রিয়া চ দর্শনীয়া চ পণ্ডিতা চ পতিব্রতা, অর্থাৎ কিনা বারবার এই ‘চ’ শব্দ দিয়ে ব্যাসকে দ্রৌপদীর প্রশংসায় ‘ক্যাটিগোরিক্যাল’ হতে হয়েছে। বিশেষ করে তৃতীয় বিশেষণে এক কুলবধূ রমণীকে ‘পণ্ডিত’ বলে সম্বোধন করায় বুঝতে পারি দ্রৌপদীর কথাগুলি যে ঠিক—তার পেছনে ব্যাসেরও সমর্থন আছে।

দ্রৌপদী বললেন—তোমাকে এমনকী আমাকে যে তোমার সঙ্গে গাছের ছালের কোপনী পরিয়ে বনে পার করেছে দুর্যোধন, তাতে তার মনে অনুতাপ তো হয়ইনি, বরঞ্চ সে রয়েছে আনন্দে—মোদতে পাপপূরুষঃ। তা ছাড়া তোমার অবস্থা দেখে আমার করুণা হচ্ছে মহারাজ…

পাঠক! দ্রৌপদীর এই করুণার নমুনাগুলি আমি মহাভারতকারের ভাষায় উপস্থাপন করতে চাই না। মহাভারতের ঠিক এই জায়গাটি অবলম্বন করে মহাকবি ভারবি তাঁর কিরাতাৰ্জনীয় মহাকাব্যে দ্রৌপদীর জবানী তৈরি করেছেন। এক মহাকবি আরেক মহাকবিকে যেমন বুঝেছেন তারই মূৰ্ছনা ভারবির দ্রৌপদীর রসনায়। দ্রৌপদী বললেন—তোমার অবস্থা দেখে আমার করুণা হচ্ছে মহারাজ! সময় ছিল যখন বন্দীরা বিচিত্র রাগিণীতে বন্দনা গান গেয়ে তোমার ঘুম ভাঙাত, এখনও গানে গানেই তোমার ঘুম ভাঙে মহারাজ, তবে সে বন্য শেয়ালের অমঙ্গল গানে। সুময় ছিল, যখন দ্বিজোচ্ছিষ্ট অন্নে প্রতিদিনের ভোজন আরম্ভ করতে তুমি, এখনও তাই হয় তুমি, তবে এ দ্বিজ ব্রাহ্মণ নয়, এ দ্বিজ দুবার জন্মানো অণ্ডজ পাখি, যাদের ঠুকরে খাওয়া ফলের প্রসাদ পাও তুমি। সময় ছিল, যখন প্রণতমস্তক রাজা-রাজড়াদের মুকুটমণিতে রক্তলাল হয়ে উঠত তোমার পা-দুখানি, হ্যাঁ, এখনও তোমার পা-দুখানি রক্তলাল, তবে তা একেবারেই রক্তেই—ব্রাহ্মণদের তুলে নেওয়া আধেক-ছাঁটা ধারালো কুশাঙ্কুরে বিদ্ধ হয় তোমার চরণ আর আক্ষরিক অর্থেই সেগুলি রক্তে রাঙা হয়ে ওঠে।

বস্তুত দ্বৈপায়ন ব্যাসের মহাভারতে দ্রৌপদীর অধিকারের সীমানা দেখে ভারবির দ্রৌপদী আরও বেশি মুখর হয়ে উঠেছেন প্রতিবাদে। তিনি বললেন—মহারাজ! এ জগতে তুমি ছাড়া আর কে আছে যে তার মনোরমা কুলবধূর মতো রাজলক্ষ্মীকে অন্যের দ্বারা অপহরণ করায়, কারণ আমাকেও যেমন তুমি পাশা খেলে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিলে, তেমনি রাজলক্ষ্মীকেও তুমি পাশা খেলেই অন্যের হাতে তুলে দিয়েছ,—পরৈস্ত্বদন্যঃ ক ইবাপহারয়েন্‌ মনোরমাম্ আত্মবধূমিব শ্রিয়ম্‌। তোমার পূর্বতন রাজপুরুষেরা ইন্দ্রের মতো যে-রাজ্য শাসন করে গেছেন, সেই রাজ্য তাঁরা তুলে দিয়েছিলেন তোমার হাতে। আর তুমি! হাতির শুঁড়ে মালা পরিয়ে দিলে সে যেমন যথেচ্ছভাবে সে মালা একদিকে ছুঁড়ে ফেলে মনি তুমিও রাজলক্ষ্মীর বরমাল্যখানি ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছ, যা লুফে নিয়েছে কোরবেরা। তা ছাড়া তোমার জোয়ান জোয়ান ভাইগুলিকে দেখে তোমার মায়া হয় না মহারাজ? এই যে ভীম, যে এককালে রক্তচন্দন গায়ে মেখে সগর্বে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াত—পরিভ্রমল্‌-লোহিতচন্দনাৰ্চিতঃ—সে এখনও চন্দনের মতো লাল রঙ গায়ে মেখেই ঘুরে বেড়ায়, তবে তা গিরি-গুহার গৈরিক ধুলোর লাল—পদাতিরন্ত গিরিরেণুরুষিতঃ। তারপর, এই যে দেখছি অর্জুন, যে এককালে উত্তর দিক জয় করে থরে থরে ধনরত্ন এনে দিয়েছিল তোমার রাজসূয় যজ্ঞের ভাণ্ডার পূর্ণ করতে, সেই বীরপুত্র এখন গাছের বাকল খুঁজে বেড়ায় কোনটা পরিধানের উপযুক্ত, কোনটা নয়, এই বাছাই করার বীরকর্মে সে এখন নিযুক্ত।