অর্জুন – ৬

আগের অধ্যায়ের অর্জুনের মুখ থেকে শুধু একটা কথা শোনার জন্য আমরা বিরাটপর্বের ঘটনাটা বলেছিলাম। অৰ্জুন বলেছিলেন—কেউ কোনওদিন কারও মন বুঝতে পারে না, দ্রৌপদী। আমরা বলেছিলাম—পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেকের প্রতি নীতিগতভাবে সমদর্শিনী হওয়া সত্ত্বেও দ্রৌপদী অর্জুনের মুখে ওই একটি কথা শুনে আশ্বস্ত বোধ করেছেন এবং নিজের অন্তরজাত আত্মবিশ্বাসের শুশ্রূষা করেছেন। ভেবেছেন—মানুষটা একান্তভাবে আমারই। কিন্তু এই মুহূর্তে আজ যখন ইন্দ্রপ্রস্থে যাদবনন্দিনী সুভদ্রার আগমন হল, তখন দ্রৌপদীর জীবনের শেষ মুহূর্তটার কথা আমাদের স্মরণ করতে হচ্ছে। মহাপ্রস্থানের পথে দ্রৌপদী যখন হিমালয়ের পথে চলতে চলতে মৃত্যুর আঘাতে লুটিয়ে পড়লেন ভঁয়ে, তখন ভীম যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করলেন—রাজপুত্রী যাজ্ঞসেনী কোনওদি কোনও অন্যায় করেননি, তিনি কেন এইভাবে মারা গেলেন? যুধিষ্ঠির বললেন—আমাদের সবার মধ্যে অর্জুনের ওপর তাঁর প্রেমের পক্ষপাত বেশি ছিল। এই কারণেই আজ তাঁর মৃত্যু।

দেখুন, সাধারণভাবে মহাভারত পড়ে অথবা দ্রৌপদীর কাজকর্ম, ব্যবহার বিচার করে এই পক্ষপাত বার করা খুব মুশকিল। এমনও নয় যে, তিনি অর্জুনের পাতে আলাদা ঘি দিতেন, কি মাছের মুড়োটি তাঁর জন্য সরিয়ে রেখেছেন আলাদা করে। এই পক্ষপাত বোঝা যাবে দ্রৌপদীর ক্রোধে, অভিমানে, লজ্জায়। এ সব কথা কথঞ্চিৎ সবিস্তারে আমরা ‘দ্রৌপদী’ প্রবন্ধে দেখিয়েছি। কিন্তু আজ অর্জুনের দিক থেকেও ব্যাপারটা বোঝার সময় এসেছে। কারণ আজ তিনি সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে এসেছেন। যে রমণী পঞ্চস্বামীর মধ্যে আপনার প্রেম ভাগ করে দিয়েও তাঁর গোপন গভীর সারাংশটুকু স্বয়ম্বর-সভার লক্ষ্যভেত্তা পুরুষটির জন্য সযত্নে তুলে রেখে দিয়েছেন, সেই অর্জুন আজ সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে এসেছেন। কাজেই দু’জনকেই আজ লক্ষ্য করতে হবে—দ্রৌপদীকেও, অর্জুনকেও। একজন রমণী—যিনি স্বয়ম্বর-সভায় লক্ষ্যভেত্তা পুরুষকে হৃদয়ের বরমাল্য দিয়েও তাঁকে সম্পূর্ণ পেলেন না। আরেকজন পুরুষ—যিনি আপনার প্রাপ্য বীরোচিত উদারতায় ভাইদের মধ্যে বিলিয়ে দিয়ে কপালদোষে বারো বছর বনে কাটিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। এই তাঁদের দ্বিতীয়বার দেখা হল। দ্রৌপদী আগেই জানেন—সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে হয়ে গেছে।

অর্জুন খাণ্ডবপ্রস্থে ফিরেই মহারাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করলেন। এই রাজদর্শনের পরেই অর্জুন ছুটলেন দ্রৌপদীর ঘরে। কেন? তাঁর কি দেখা করবার মতো আর কোনও গুরুজন ছিলেন না? রাজমাতা কুন্তী, মেজদাদা ভীমসেন—এরা কি কিছুই নন? আমরা বলি—গুরুজন বটে, তবে গুরুতর নন ততে। অর্জুন জানেন—তার দ্বিতীয়-বিবাহে এই বিদগ্ধা রমণীর হৃদয়ে কী আঘাত লাগতে পারে। তিনি জানেন—আপন মনোজ্বালায় তিনি যতই দগ্ধ হন না কেন, তিনি যদি অন্যত্র মন দেন, তা হলে দ্রৌপদীর ভালবাসায় যতটুকু আঘাত লাগবে, তার থেকে অনেক বেশি লাগবে তাঁর প্রেমের অহঙ্কারে, অধিকার-চেতনায়। দ্রৌপদীর মনে হবে বুঝি—সিংহীর মুখের গ্রাস শৃগালিনী তুলে নিয়ে গেল। অর্জুন তাই সাত-তাড়াতাড়ি দ্রৌপদীর কাছে এসেছেন।

বিদগ্ধা রমণী বলেই তখনও দ্রৌপদীর ভাষায় প্রণয়ের অভিমান ছিল। অর্জুনকে দেখামাত্রই তিনি বলে উঠলেন—তুমি আবার এখানে কেন, অর্জুন? যেখানে যাদব-কুলের সুন্দরী সুভদ্রা রয়েছেন, সেইখানেই যে তোমার জায়গা, তুমি সেইখানে যাও—তত্রৈব গচ্ছ কৌন্তেয় যত্র সা সাত্ত্বতাত্মজা। শুধু এইটুকু বলার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর অভিমান নিবৃত্ত হয়ে গেছে। দ্রৌপদী বাস্তব বোঝেন অত্যন্ত স্বচ্ছভাবে এবং আপাতত তিনি এটা বুঝতেই পারলেন যে, তাঁর মনের মানুষকে আরও একজন অধিকার করে নিয়েছে। বাস্তবতা বোঝানোর জন্য আমাদেরই দৈনন্দিন জীবনের এমন একটা উপমা তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়েছে, যা দ্রৌপদীর মতো স্পষ্টবক্তার মুখেই মানায়।

দ্রৌপদী বললেন—যে জিনিসটা আগেই ভাল করে বাঁধা ছিল, সেটা যদি আরও ভাল করে দড়ি দিয়ে বাধা যায়, তা হলে আগের বাধনটা আলগা হয়ে যায়। আমারও তাই হয়েছে। আজ সুভদ্রার নতুন প্রেমের বাঁধনে দ্রৌপদীর পুরাতন বাঁধন আলগা হয়ে গেছে। তবে এই সাভিমান স্পষ্টভাষিতার মধ্যেও দ্রৌপদীর বক্রোক্তির ঝাঁঝ বড় কম নয়। অর্থাৎ তাঁর প্রেম যতখানি, তার থেকেও প্রেমের অহঙ্কার বেশি। তিনি যে বাক্যটা বলেছিলেন—তার মধ্যে নতুন-পুরাতন প্রেমের বাঁধনের থেকেও যে-কথাটা বড় বেশি তীক্ষ হয়ে শ্রোতাকে কষাঘাত করে—সেটা হল তাঁর উপমাটি। দ্রৌপদী বলেছেন—সুবদ্ধস্যাপি ভারস্য—অর্থাৎ যে ভার আগে থেকেই ভাল করে বাঁধা হয়েছে। দ্রৌপদী বলতে চাইছেন—তোমাদের মতো পুরুষমানুষেরা অনেকটা যেন ভারী বোঁচকা-বুঁচকির মতো জড়; মনের বিকার নেই তোমাদের। আমি বাঁধন দিলাম আর আমার প্রেমের গ্রন্থিতে মনে হল যেন বেশ শক্ত-পোক্ত হয়েছে, ওমা যেই না আরেকজন এসে আরও একগাছা প্রেমের সূত্রে নতুন বাঁধনে বেঁধে নিল তোমাকে, অমনই তুমি ভারী বোঁচকাটার মতো আরও একটু চুপসে গেলে ভেতরে, নতুন বাঁধন লাগল শক্ত হয়ে, পুরনো বাঁধন শুধু আলগা ফাঁসের মতো পড়ে রইল, তাকে খুলে ফেলাও কঠিন অথচ নতুনটা আছে বলে তার প্রয়োজনও নেই—সুবদ্ধস্যাপি ভারস্য পূর্ববন্ধঃ শ্লথায়তে।

মহাভারতে কবি যে উপমাটা একেবারে ‘ক্রুড্‌ ফর্মে’ ব্যবহার করলেন কবির কবি সে-কথা প্রকাশ করেছেন আপন কাব্য চেতনার সমস্ত গভীরতা মিশিয়ে। বস্তুত নবপ্রেমজালে আটকে পড়া অর্জুনকে দেখে দ্রৌপদীর মুখ দিয়ে যদি নিতান্ত আধুনিকভাবে বা ভাষায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা বেরুত, তা হলে তার রূপ হত এইরকম—

বুঝেছি আমার নিশার স্বপন হয়েছে ভোর

মালা ছিল, তার ফুলগুলি গেছে রয়েছে ডোর।

নেই আর সেই চুপি চুপি চাওয়া,

ধীরে কাছে এসে ফিরে ফিরে যাওয়া,

চেয়ে আছে আঁখি, নাই ও আঁখিতে প্রেমের ঘোর।

বাহুলতা শুধু বন্ধনপাশ বাহুতে মোর॥

দ্রৌপদী অনেক কাঁদলেন। পঞ্চস্বামিগর্বিত দ্রৌপদী একতম পাণ্ডবের দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহে অনেক কাঁদলেন। এ এমন কান্না—যার কারণ বুঝিয়ে দিলে বিদগ্ধা রমণীর কষ্ট হয়। পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেকেরই দ্রৌপদী ছাড়াও অন্য বিবাহ হয়েছিল, কিন্তু দ্রৌপদী তখন তো কাঁদেননি। কিন্তু অর্জুন সুভদ্রাকে বিয়ে করে আনলে দ্রৌপদী অনেক কাঁদলেন। স্বয়ং দ্রৌপদী স্বয়ম্বরা হয়ে যাঁর গলায় বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই অর্জুন দ্বিতীয়বার বিয়ে করে কী করে—এই খেদেই দ্রৌপদী কাঁদছেন। অর্জুন সেটা বোঝেন। অর্জুন বোঝেন—দ্রৌপদীর এই কান্নার মধ্যে তাঁকে সম্পূর্ণ করে পাবার আকুলতা যতখানি, তাঁর চেয়ে অনেক বেশি আছে হেরে যাবার যন্ত্রণা, অহঙ্কারের হানি। অর্জুন তাই দ্রৌপদীকে অনেক বোঝালেন, অনেকবার তিনি ক্ষমা চাইলেন। সান্ত্বয়ামাস ভূয়শ্চ ক্ষময়ামাস চাসকৃৎ। কিন্তু সান্ত্বনা আর ক্ষমায় অগ্নিসম্ভবা দ্রৌপদীর ক্ষোভ দূর হল না। শেষে অর্জুন একটা বুদ্ধি করলেন।

সুভদ্রা তখন দ্বারকা থেকে কেবল ফিরেছেন। বাপের বাড়ির সব সমৃদ্ধি তখনও তাঁর বেশে-বাসে, অলংকারে ছড়িয়ে। বিয়ের লাল-চেলি আর সোনার গহনায় তাঁকে দেখতে লাগছে ঠিক রাজরানির মতো। অর্জুন দেখলেন—পাঞ্চালের সেই খণ্ডিতা রাজবধূ যদি একবার সুভদ্রার এই বিবাহোদ্ধতা মূর্তি দেখেন, তা হলে আর রক্ষে থাকবে না। সেই মুহূর্তে তিনি সুভদ্রার অঙ্গ থেকে বিবাহের অনুরাগ মাখা রক্ত বসনখানি নামিয়ে নিলেন। তারপর বৃন্দাবনের গোপিনীদের মতো সাধারণ একটি ঘাঘরা আর ওড়না দিয়ে সুভদ্রাকে সাজিয়ে দিলেন অর্জুন-বক্তকৌষেয়বাসিনীম্‌। পার্থ প্রস্থাপয়ামাস কৃত্বা গোপালিকাবপুঃ।

সাধারণের সাজে সুভদ্রাকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল; তিনি জননী কুন্তীর কাছে আশীর্বাদ নিয়েই প্রথমে এলেন দ্রৌপদীর কাছে। তাঁর পা জড়িয়ে ধরে অর্জুনের শিক্ষামতো প্রথম কথাটি বললেন সুভদ্রা—আমি তোমার দাসী, দিদি! পঞ্চস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদীর মনে কেমন যেন মায়ার সঞ্চার হল। নববধূর সাধারণ সাজে সুভদ্রতাকে দেখে, তাঁর দৈন্যভরা আর্তির কথা শুনে ক্ষণেকের তরে বুঝি গরবিনীর মনে হল—না তো! আমি যতখানি তাঁকে হারিয়েছি ভেবেছি, ততটা তো নয়, সে তো এখনও আমারই আছে। সঙ্গে সঙ্গে সসম্ভ্রমে নববধূকে পা থেকে উঠিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। সকৌতুকে বুক-ভরা আশীবাদ দিয়ে বললেন—তোমার স্বামীর যেন আমার মতো শত্তুর না থাকে—নিঃসপত্নো’স্তু তে পতিঃ।

অর্জুনের মনশ্চিকিৎসায় দ্রৌপদীর মনে একটু প্রলেপ লাগল বৈকি। এই যে অর্জুন তাঁকে অতিক্রম করলেন না—এই সান্ত্বনাই দ্রৌপদীকে আবারও বয়ে নিয়ে চলল জীবনের পথে—সাধিকারে, সদর্পে। আর কী আশ্চর্য, শুধু আজ নয় অর্জুন কোনওদিনই দ্রৌপদীকে অতিক্রম করেননি। সুন্দরী সুভদ্রাকেও তিনি সেই ভাবে চালিয়েছেন যাতে তিনিও কোনওদিন দ্রৌপদীকে অতিক্রম না করেন। এই অনতিক্রমই মহাপ্রস্থানের পথ পর্যন্ত দ্রৌপদীকে অর্জুনের ব্যাপারে আশ্বস্ত রেখেছে। আসলে নিজের সমস্ত অভিমান, অহঙ্কার সত্ত্বেও যদি দ্রৌপদী কাউকে ভালবেসে থাকেন—তবে তিনি অর্জুন। আর বেচারা অর্জুন, এই ভালবাসা বুঝেও তিনি বোঝেননি, ইচ্ছে করেই বোঝেননি। সারা জীবন দ্রৌপদীকে কেমন যেন এড়িয়ে এড়িয়ে চলেছেন! ভাইদের কাছে সংকোচ—যদি স্বভুজলব্ধা রমণীটির প্রতি আপন অধিকার প্রকাশ পায়। নিজের মন আবর্তিত করেছেন যাদবনন্দিনী সুভদ্রার দিকে, কিন্তু সেও বড় সাবধানে, বড় সতর্কভাবে—যদি কৃষ্ণা পাঞ্চালীর অহঙ্কার আর অধিকারবোধে আঘাত লাগে। কিন্তু এই সংকোচ, সাবধান সতর্কতার সঙ্গে নিজেকে প্রতি পদে প্রতি পলে দ্রৌপদীর কাছে বিশ্বস্ত রেখে তাঁর নিজের মনের কী অবস্থা হয়েছিল? নিশ্চয়ই তা এতটাই করুণ যে, কোনও এক হতাশ্বাস চরম মুহূর্তে তাঁকে নপুংসকের সিদ্ধিতে বলে উঠতে হয়—কেউ কোনওদিন কারও মন বোঝে না দ্রৌপদীন তু কেনচি অত্যন্তং কস্যচিদ্‌ হৃদয়ং কৃচিৎ। বেদিতুং শক্যতে ভদ্রে…।

আমার সহৃদয় পাঠককূল—আপনারা নিশ্চয়ই অর্জুনকে এতক্ষণে খানিকটা বুঝেছেন। রমণীর প্রেম—যা নাকি সাধারণ একটি মানুষও সাহষ্কারে আত্মসাৎ করে, সেখানেও অর্জুনকে কী অদ্ভুত এক ‘ব্যালান্স’ রেখে চলতে হচ্ছে। এই সমতা রাখতে রাখতে এক সময় যখন তিনি ক্লান্ত, বিষগ্ন হয়ে যান, তখনই দেখি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ প্রায় আরম্ভ হতে চলেছে। বিরাট দুই সৈন্যবাহিনীর মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুর্বল, সংকুচিত অর্জুন যেন তাঁর জীবন-রথের সারথির কাছে সারা জীবনের প্রশ্ন করে যাচ্ছেন; আর উত্তর মিলিয়ে দেখছেন—আমি ঠিক করেছি তো? অর্জুন বললেন—তুমি ভো খালি বলছ—সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভ—সব জায়গায় শুধু সমতা রাখতে হবে, ‘ব্যালান্স’ রাখতে হবে, কিন্তু এও কি সম্ভব? আমার মন? মন যে বড়ই চঞ্চল। যতবার ভেবেছি—আমি মনকে সংযত করে রাখব, পারিনি, হয়নি। হাওয়া যেমন আটকানো যায় না ভাই, মনটাও তেমনি আটকানো যায় না—সমস্ত ‘ব্যালান্স’, সমস্ত সমতার বুদ্ধি হাওয়ার দমকে এক মুহূর্তে উবে যায়—তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়োরিব সুদুষ্করম্‌।

অর্জুন মিলিয়ে নিচ্ছেন। যে সমস্ত পণ্ডিত গো-এষণার তত্ত্বে আকুল হয়ে মহাভারতের মধ্যে ভগবদ্‌গীতার অবস্থিতি অসংবদ্ধ বিবেচনা করেন, তাঁদের কাছে আমার অনুরোধ—তাঁরা যেন ‘অপউদ্ধার’ পদ্ধতি বাদ দিয়ে শিল্পীজনোচিত সমবেদনায় সমস্ত মহাভারত মিলিয়ে পড়েন। তাই বলছিলাম—অর্জুনও মিলিয়ে নিচ্ছেন। নিশ্চয়ই তিনি দাদার কথা শুনে বারো বছর ব্রত-নিয়মে থাকবেন ভেবেছিলেন। মন তা হতে দেয়নি, ইন্দ্রিয়গুলি তা হতে দেয়নি। অর্জুনের একমাত্র সান্ত্বনা—কৃষ্ণ পূর্বেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ইন্দ্রিয়গুলি মানুষের মনকে জোর করে উত্তাল করে তোলে-ইন্দ্রিয়ানি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ। অর্জুন তাই এখন স্বস্থ হয়ে বুঝেছেন—আমারও তো এমনই ঘটেছে। নইলে, দাদা যুধিষ্ঠিরের কাছে সংকল্পিত ব্রহ্মচর্য নাগকন্যা উলূপীর সরসতায় এক মুহূর্তে উবে গেল। চিত্রাঙ্গদার বেলায় ইন্দ্রিয়ের গতি আরও শিথিল, দেখা মাত্রই কামনা। আর ‘চারু-সর্বাঙ্গী’ সুভদ্রার কাছে এসে অর্জুনের ব্রত-নিয়ম, সংকল্প ঝড়ের মুখে কুটোটির মতো উড়ে গেল! এই অর্জুনই তো বলবেন—মনের গতি যে ভাই দমকা হাওয়ার মতো, আটকানো অসম্ভব—বায়োরিব সুদুষ্করম্‌। কৃষ্ণ মনুষ্যধর্মের সমস্ত মমত্ব দিয়ে কথা বলবেন—সে-কথা ভাই বড় সত্যি—অসংশয়ং মহাবাহো—মনকে আটকে রাখা বড় দায়! কিন্তু এর জন্য চাই অভ্যাস, স্খলিত হলেও পুনরায় অভ্যাস।

অর্জুনের বুকে বুঝি স্বস্তি আসল কিছুটা। বনবাস-ব্রহ্মচর্যের সমস্ত সদিচ্ছা নিয়েই তিনি স্থলিত হয়েছেন, দ্রৌপদীর জন্য সমস্ত হৃদয়ের অপেক্ষা রেখেও, তিনি মনের অস্থিরতায় সুভদ্রার প্রেমে বন্দি হয়েছেন। এই যে সদিচ্ছার সংকল্পের সঙ্গে বাস্তবের স্থলন-পতন-ত্রুটিগুলি কিছুতেই মিলছে না—এতে অর্জুন বিচলিত, একেবারে দার্শনিকভাবে বিচলিত। অভ্যাস কি তিনি কম করেছেন? আপনার সম্পূর্ণ প্রাপ্য প্রিয়তমা পত্নীকে না পাওয়ার অভ্যাস পর্যন্ত তাঁর রপ্ত হয়ে গেছে। তবু তারই মধ্যে এসেছে অবিশ্বস্ততা, স্বলন—মনের গতিতে তা হলে সবই কি ভুল হয়ে গেল? অর্জুন মিলিয়ে নিচ্ছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আসরে দাঁড়িয়ে পূর্ব জীবন এবং যৌবনের আপাত-বিরোধগুলির জবাব চাইছেন তিনি। কৃষ্ণকে বলছেন—তুমি তো বলেই খালাস। অভ্যাস আর বৈরাগ্যে মন বশ করতে হবে। তা ধরো আমি তো প্রথমে আমার সংকল্পে আর সততায় শ্রদ্ধাবান ছিলুম, কিন্তু মনের জ্বালা বড় জ্বালা। আমি আমার প্রচেষ্টায় যত্নে স্থির থাকতে পারিনি—অতিঃ শ্ৰদ্ধয়োপেতে যোগালিত মানসঃ। দ্রৌপদী, দ্রৌপদীর জন্য বনবাস—এ-সব কিছুতেই তো অর্জুনের প্রাথমিক সততার অভাব ছিল না, কিন্তু মনের গতি তাঁকে সংকল্প থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে দূরে। তাই বলে কি সব তাঁর ব্যর্থ হল! অর্জুন জিজ্ঞাসা করছেন—এসব লোকের কী গতি হয়, কৃষ্ণ? অর্জুনের মনে হচ্ছে—মনের গতিকে সুখ-দুঃখ, লাভ-অলাভের সমতাও আমার হল না, দ্রৌপদীকেও আমি হারালাম—আমার এদিকও গেল, ওদিকও গেল, আকাশে ওড়া ছেড়া মেঘের মতো আমার সিদ্ধির কোনও ঠিকানা রইল না—কচিন্নোভয়বিভ্রষ্ট শ্ছিন্নাভ্রমিব নশ্যতি।

কৃষ্ণ ভগবান সিদ্ধান্ত দিলেন। তিনি যে মানুষের মন, মায়া, মোহ, শ্রদ্ধা, সংকল্প—সব জানেন। কৃষ্ণ বললেন—না, অর্জুন, না। সংকল্পিত অবস্থা থেকে তুমি যতই চূত হও, তবু তুমি হীন নও। তুমি যে ভাল কাজ করতে চেয়েছিলে, ভাল কাজ করেছিলে এটাই অনেক, এমন মানুষের কোনওদিন দুর্গতি হয় না—ন হি কল্যাণকৃৎ কশ্চিদ্‌ দুর্গতিং তাত গচ্ছতি।

আমি জানি—গীতার শ্লোকের গভার দার্শনিক ব্যাখ্যাগুলি থেকে আমি অনেক দূরে সরে এসেছি। তবু জীবনের প্রাপ্য রমণীকে সম্পূর্ণ করে না পাওয়ার পরেও, সুভদ্রাকে নিয়ে তিনি যে সংযমের পরিচয় দিয়েছেন, তাতে নিঃসন্দেহে বলা যায়—সংসার-জগতে অর্জুন সেই দুর্লভ ‘আত্মসংস্থ’ পুরুষদের একজন যিনি রমণীর ভালবাসার ক্ষেত্রে মানুষের মতোই দুর্বল বটে, কিন্তু সেই দূর্বলতাকেও বুদ্ধি আর ধৈর্যের বন্ধনে তিনি এমন এক দার্শনিকের ভূমিতে উন্নীত করতে পারেন যে, তাঁকে সংসার-সন্ন্যাসী না বলে পারি না। মহাভারতের চরিত্রকে গীতার দর্শনে মিলিয়ে নেবার সুযোগ এইখানেই।