দ্রৌপদী – ৭

কাহিনী আরও যখন এগিয়ে চলেছে, দ্রৌপদীকে আমরা তখন আরও উত্তপ্ত দেখেছি। দ্বৈতবনের এক অরুণিত সায়াহ্নে দ্রৌপদীকে দেখছি যুধিষ্ঠিরকে নিয়ে বিব্রত, বিরক্ত। তিনি কথা আরম্ভ করেছিলেন দুর্যোধনের দোষ এবং শকুনির কপটতা নিয়েই, যাতে স্বামীদের ওপরে, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের ওপরে তাঁর আক্ষেপ না আসে। ইন্দ্রপ্রস্থে পঞ্চ-স্বামীর সুখোচ্ছবাস এবং এই বনে তাঁদের কষ্টকর জীবনের প্রতিতুলনার উল্লেখেই কথা সমাপ্ত হতে পারত। কিন্তু রাজনীতির বিষয়ে দ্রৌপদীর ভাল রকম পড়াশুনো থাকায় তিনি সর্বংসহ প্রহ্লাদের উক্তি শুনিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। শুনিয়েছেন—প্রহ্লাদের মতো নরম মানুষও সময়কালে দণ্ডের প্রশংসা করেছেন, ক্ষমার নয়। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর কথা শোনেননি, কারণ তাঁর সেই চিরন্তন ধর্মবোধ, সেই চিরন্তনী ক্ষমার মহত্ত্ব। দ্রৌপদী হাল ছেড়ে দিয়েছেন তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামী সম্পর্কে। বলেছেন তুমি ধর্মের জন্য নিজেকে, নিজের সমস্ত ভাইদের, এমনকী আমাকেও ত্যাগ করতে পার—ভীমসেনাৰ্জুনৌ চেমৌ মাদ্রেয়ৌ চ ময়া সহ—কিন্তু ধর্ম ত্যাগ করতে পার না।

দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের এই বিশাল ভারবত্তা এবং মহত্ত্বের দূরত্ব জানেন। কিন্তু সে তাঁর সহ্যের বাইরে—

যত বড় হোক ইন্দ্রধনু সে
সুদূর আকাশে আঁকা,
আমি ভালবাসি মোর ধরণীর
প্রজাপতির পাখা।

ধর্মে চিরস্থিত মহান যুধিষ্ঠিরের বিশালতা দূরে সরিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী তাঁর স্বামীর কাছাকাছি আসতে চেষ্টা করেছেন। ঝগড়া করে বলেছেন—এত সরল, এত মৃদু, এত বদান্য অথবা এত সত্যবাদী তুমি—তা তোমার এই জুয়াড়ির মতো জুয়ো খেলা খেতি ঘটল কেন—কথমক্ষ-ব্যসনজা বুদ্ধিরাপতিতা তব? সময় বুঝে পাঞ্চালী-কৃষ্ণাও কত ধর্মের উপদেশ শুনিয়ে দিলেন যুধিষ্ঠিরকে। তবু যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর মনের কাছাকাছি আসেননি। স্ত্রীর সুমহান উপদেশের মধ্যে নাস্তিক্যের দোষারোপ করে তিনি শেষ আদেশ জারি কুরেছেন—বিধাতার বিধানকে ‘চ্যালেঞ্জ’ কোরো না, খোদার ওপর খোদকারি কোরো না—ঈশ্বরঞ্চাপি ভূতানাং ধাতারং মা চ বৈ ক্ষিপ। আরও শেখো আরও নত হওয়ার চেষ্টা করো, এমন বুদ্ধি ভাল নয় মোটেই—শিক্ষস্বৈনং নমস্বৈনং মা তে ভূদ্‌ বুদ্ধিরীদৃশী।

নিজের কথা একটুও শুনছেন না, এমন মানুষকে দ্রৌপদী গভীর চুম্বনে পবিত্র করে তোলেননি। তিনি অদৃষ্টবাদী নন, অতএব পুনরায় তিনি তাঁকে শত্রুর বিরুদ্ধে জেগে উঠতে বলেছেন। বলেছেন—রাজনীতির ফলের জন্য চেষ্টা প্রয়োজন, যত্ন প্রয়োজন। তোমার মতো যারা বিধাতা আর অদৃষ্ট নিয়ে শুয়ে থাকে, তাদের অলক্ষ্মীতে ধরে আর কিছু নয়—অলক্ষ্মীরাবিশত্যেনং শয়ানম্ অলসং নরম্‌।

দুঃখের বিষয়—দ্রৌপদী এখনও আমার কাছে যথার্থ যুধিষ্ঠিরের ভার্যারূপে প্রতিভাত হচ্ছেন না। অপিচ কোনও ‘নিগূঢ় আকর্ষণ’ও তাঁকে যুধিষ্ঠিরের কাছাকাছি নিয়ে আসছে বলে আমার মনে হয়নি। যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দ্রৌপদীর এই রাজনৈতিক তর্কযুদ্ধের পর-পরই অর্জুন চলে গেলেন তপস্যায় পাশুপত অস্ত্রের সন্ধানে। দ্রৌপদীর মনের অবস্থা তখন কী হয়েছিল—তা পূর্বেই দেখিয়েছি। বছরের পর বছর অর্জুন-হীন জীবন আর দিনের পর দিন যুধিষ্ঠির মুনি-ঋষিদের কাছে পুরাণ-কাহিনী, অধ্যাত্ম-কথা শুনে যাচ্ছেন। এরই অবধারিত ফল—দ্রৌপদী অতিষ্ঠ হয়ে অর্জুনের জন্য একদিন কেঁদে উঠেছেন—আমার কিছু ভাল লাগছে না, অর্জুনকে ছাড়া একটুও ভাল লাগছে না, অর্জুন ছাড়া আমার কাছে সব শূন্য—শূন্যামিব প্রপশ্যামি তত্র তত্র মহীমিমাম্‌।

ঠিক এই ধরনের হাহাকার দ্রৌপদীর মুখে আর দ্বিতীয়বার শুনেছি কিনা সন্দেহ। এই বিলাপোক্তির সঙ্গে ভীম, নকুল এবং সহদেব—তিন ভাইই সুর মিলিয়েছেন, কিন্তু যুধিষ্ঠির নন। অবশ্য তিনি পরে একই কথা বলেছেন, কিন্তু ভাইদের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ সুর মেলাননি। আপন অধ্যাত্ম স্বাতন্ত্র্যে তখনও তিনি স্থিতধী। ভেবেছেন বুঝি—মেয়েরা ওরকম কাঁদেই বটে। কিন্তু কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর সঙ্গে ভাইয়েরা যোগ দেওয়ায় যুধিষ্ঠির কিছু চিন্তিত হলেন—ধনঞ্জয়োৎসুকানান্তু ভ্রাতৃণাং কৃষ্ণয়া সহ। সবার মন ভোলানোর জন্য নারদের পরামর্শে যুধিষ্ঠির সবাইকে নিয়ে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ালেন। ঘুরে ঘুরে দ্রৌপদী শ্রান্ত, ক্লান্ত। কিন্তু এরই মধ্যে খবর এসে গেছে—অর্জুনের অস্ত্রপ্রাপ্তি সম্পূর্ণ, তিনি আসছেন। দ্রৌপদীকে আর রাখা যায়নি, হিমালয়ের কঠিন বন্ধুর পথে তাঁর পা চলে না। তবু তাঁকে রাখা যায়নি। যুধিষ্ঠির বলেছেন—তুমি এখানেই দ্রৌপদীকে নিয়ে থাক ভীম। তোমার গায়ে জোর আছে, তুমি সহদেব, ধৌম্য—এঁদের নিয়ে এখানে থাক, নইলে এত কষ্ট ফুরে কৃষ্ণা-পাঞ্চালী যাবেন কী করে?

দিনের পর দিন নিত্যসঙ্গের ফলে দ্রৌপদীর মন যদি এইভাবে বুঝে থাকেন যুধিষ্ঠির, তাহলে কী করেই বা বলি—পাঁচের মধ্যে একের নাম করতে হলে ‘যুধিষ্ঠিরকেই তাঁর মনে পড়ে।’ আর ভীমসেন, যাকে বুদ্ধদেব ভেবেছেন বড়ই স্থূল, দ্রৌপদীর ‘আজ্ঞাবহ’ অথবা ‘প্রধানত এক মল্লবীর’—তিনি কিন্তু দ্রৌপদীর মতো এক বিদগ্ধা রমণীর মন বোঝেন। এই স্কুল মল্লবীর জানেন—‘অনবরত ভ্রাম্যমাণ’ যুবকটির ওপর এই রমণীর কী গভীর দুর্বলতা। যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাব শেষ হতে না হতেই তিনি জানিয়েছেন— হ্যাঁ, পথশ্রম, কিংবা শারীরিক কষ্ট অবশ্যই হচ্ছে, তবে দ্রৌপদী যে যাবেনই, তিনি যে অর্জুনকে দেখতে পাবেন—ব্রজত্যেব হি কল্যাণী শ্বেতবাহ-দিদৃক্ষয়া। দ্রৌপদী গেছেন, হিমালয়ের কনকনে হাওয়ায় আর পথশ্রমে দ্রৌপদী একবার অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছেন, কিন্তু তবু গেছেন। ভীমের ছেলে ঘটোৎকচের কাঁধে বসে চলতে চলতে শেষে বুঝি তাঁর ভালই লাগছিল। অর্জুন আসবেন, কী ভাল যে লাগছে! এখন আর বন্ধুর পার্বত্য ভূমিতে হাঁটার কষ্ট নেই, শুধু সামান্য অপেক্ষার আনন্দ। হিমালয়ের পর্বত, বিজন অরণ্যানী—সে যেমন এখনও মধুর তেমনই সেদিনও ছিল অপূর্ব। বনভূমি ফল-ফুলের শোভায় উপচে পড়ছে, আর কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর মনে তখন শুধু অর্জুনের দিদৃক্ষা—কতদিন পর তার সঙ্গে দেখা হবে।

ঠিক এই রকম একটা মানসিক পরিমণ্ডলের মধ্যে—মন যখন আপনিই উদার হয়ে যায়—ঠিক তখনই কোথা থেকে উড়ে এসে একটি মাত্র সুর-সৌগন্ধিক, সোনার বরণ পদ্ম দ্রৌপদী পায়ের কাছে এসে পড়েছিল। আনন্দের আতিশয্যে দ্রৌপদীর সেটি উপহার দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠিরকে। বুদ্ধদেবের মনে হয়েছে—যুধিষ্ঠির আর দ্রৌপদীর জীবন-বন্ধনে এই উপহার বুঝি এক বিরাট ঘটনা, বিরাট প্রতীকী ঘটনা—বহুভর্তৃকা দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকেই তাঁর স্বামী হিসেবে মনে মনে এতদিন লালন করতেন বলেই যেন দ্রৌপদীর দিক থেকে এই স্বর্ণপদ্মের উপহার। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের এরকম মনে হয় না। হ্যাঁ, এমন তো হতেই পারে—যে বিদগ্ধা রমণী পঞ্চস্বামী নিচে ঘর করেন এবং যাঁর অন্তরের কেন্দ্রভূমিতে অর্জুনের মতো এক বিরাট স্বপ্ন আছে—তিনি তাঁর জ্যেষ্ঠ-স্বামীটির সম্বন্ধে এমন তো ভাবতেই পারেন—আহা! এই মহান পুরুষটির হৃদয় তো আমি কোনও দিন ভাল করে লক্ষ করিনি, সারা জীবন ধর্ম-ধর্ম করে গেল, শত্রুপক্ষের অন্যায় আচরণের জন্য কতই না গালাগালি দিয়েছি এঁকে! নিজের স্ত্রীর কাছেও কতই না লাঘব সহ্য করতে হয়েছে এই মহান ব্যক্তিটিকে! দ্রৌপদী ভাবতেই পারেন—উদগ্র নীতিবোধ, অতি-প্রকট—এ-সব আমার অপমানের নিরিখে আমার কাছে যতই কষ্টের হোক, যুধিষ্ঠির মানুষটা তো খারাপ নয়।

না, এ-সব কথা মহাভারতের কবি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করেননি। কিন্তু স্বর্ণপদ্মের উপহারে আর যাই হোক, যুধিষ্ঠিরের ভার্যাত্ব-প্রমাণের তাগিদ দ্রৌপদীর ছিল না। বরঞ্চ উদ্ধারতা ছিল। যে বীর স্বামীর সম্বন্ধে মনে মনে তাঁর একান্ত অপ্রাপ্তির বেদনা ছিল, তাঁর সঙ্গে দেখা হবে—এই আনন্দই তাঁকে সেদিন আকস্মিক-ভাবে যুধিষ্ঠিরের প্রতি উদার করে তুলেছিল। এই ঔদার্যের আরও একটা কারণ আছে। সেটা হচ্ছে অনায়ত্ততা। যুধিষ্ঠিরকে তিনি কোনওদিনই ভাল করে আয়ত্ত করতে পারেননি। হ্যাঁ, অর্জুনকেও পারেননি। এমনকী তথাকথিত ভাবনাটি যদি মেনেও নিই, অর্থাৎ একজন ‘নিত্যসঙ্গী’ অন্যজন ‘অনবরত ভ্রাম্যমাণ’। এক্ষেত্রে ভ্রাম্যমাণের ওপর দ্রৌপদীর হৃদয়ের যে দুর্বলতা ছিল, নিত্যসঙ্গীর ওপর তা ছিল না। কিন্তু দুর্বলতা না থাকলেও একজন বলিষ্ঠ পুরুষমানুষ—হোক না তাঁর বলিষ্ঠতা নীতি অথবা ধর্মের দিক থেকেই শুধু প্রবল—তবু তিনি দ্রৌপদীর মতো একজন বিদগ্ধা রমণীর আয়ত্ত হবেন না—এটা কি দ্রৌপদীরই অভিপ্রেত ছিল?

স্বর্ণপদ্মের উপহার যুধিষ্ঠিরের ভাগ্যে জুটেছে দ্রৌপদীর ক্ষণিক-উচ্ছ্বাসের অঙ্গ হিসাবে, অথবা মাঝে মাঝে তিনি নিত্যসঙ্গী যুধিষ্ঠিরের মনের কাছে আসতে চেষ্টা করেছেন, তারই সুফল হিসেবে অথবা—আমাকে যদি আরও স্বাধীনতা দেওয়া যায়, তবে বলব—অনেকদিন পর অর্জুনের দেখা পাবেন বলে সব কিছুই যখন তাঁর কাছে উদার মাধুর্যে ধরা দিচ্ছে, সেই উদার-ক্ষণের উচ্ছ্বাসেই দ্রৌপদী স্বর্ণপদ্মের উপহার দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে।

অন্যদিকে ব্যাপারটা যুধিষ্ঠিরের দিক থেকেও দেখুন। দ্রৌপদী বহু-ভর্ত্তৃকা হলেও আসলে তিনি আমারই—এমন কোনও স্বাধিকার বোধ কি তাঁর দিক থেকে ছিল? স্বর্ণপদ্মের উপহারে তিনি একটুও বিগলিত হননি। মহাভারতের কবি একটি শব্দও ব্যয় করেননি ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে দ্রৌপদীর উপহার দেওয়ার ছবিটি তুলে রাখতে। শুধু একটা সংবাদের মতো আমাদের তিনি জানিয়েছেন—দ্রৌপদী পদ্মফুল নিয়ে গেলেন ধর্মরাজের কাছে—জগাম পুষ্পমাদায় ধর্মরাজায় তত্তদা। ব্যাস্‌, এরপর থেকেই কৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন চলে গেছেন সেই ভীমসেনের বর্ণনায়—যিনি দ্রৌপদীর ইচ্ছামাত্রে আরও স্বর্ণপদ্ম জোগাড় করতে চললেন অথবা দ্রৌপদীর ওপর ভালোবাসায় তিনি কী করলেন, কতটা করলেন—তার অনুপুঙক্ষ বিবরণে। যুধিষ্ঠির এবং স্বর্ণপদ্মের কথা আর একবারও ওঠেনি। উপহার পাওয়ার পর যুধিষ্ঠিরের সামান্য প্রতিক্রিয়াও স্থান পায়নি ব্যাসের লেখনীতে। ভীমের জন্য ব্যাসের এত সহানুভূতি কেন, তার প্রমাণ পাওয়া গেল একটিমাত্র পংক্তিতে। ভীমকে অনেকক্ষণ দেখা যাচ্ছে না, যুধিষ্ঠির উতলা হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন—ভীম কোথায়, পাঞ্চালী! কোথায় সে, কী কাজে গেছে? কৃষ্ণা-পাঞ্চালী বললেন—সেই যে সেই সোনার বরণ পদ্মখানি, মহারাজ!–-যৎ তৎ সৌগন্ধিকং রাজন্‌—সেটা হাওয়ায় উড়ে এসে পড়েছিল বটে কিন্তু সেটা ভীমই আমাকে এনে দিয়েছিল—আমি বলেছি—আরও যদি এমন ফুল দেখ তো নিয়ে এস আমার জন্য।

এইটুকুই। দ্রৌপদীর উপহার পেয়ে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কোনও ভাব-বিকার আমরা দেখিনি। কিন্তু দ্রৌপদ ইচ্ছা, শুধু একটা ইচ্ছার জন্য ভীমসেনকে কত মারামারি, কত গিরি-দরী-গুহা আমরা লঙঘন করলাম। যুধিষ্ঠির ভাইদের আর দ্রৌপদীকে সঙ্গে নিয়ে ভীমকে খুঁজতে খুঁজতে যখন সেই পদ্ম-সরোবরের কাছে এসে পৌঁছলেন, তখন দেখলাম সরোবরের তীরে রক্ষী-প্রতিম যক্ষ-রাক্ষসদের মেরে গদা উঁচিয়ে রেগে অন্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ভীমসেন। যুধিষ্ঠির ভাইকে আলিঙ্গন করে মহাস্থবির ধর্মজ্ঞের মত বললেন—এমন সাহস আর দ্বিতীয়বার কোরো না, যদি আমার মনের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করতে চাও তো দ্বিতীয়বার এমন ব্যবহার কোরো না—পুনরেবং ন কর্ত্তব্যং মম চেদ্‌ ইচ্ছসি প্রিয়ম্।

আর দ্রৌপদী ভীমকে কী বলেছিলেন? যদি আমি তোমার ভালবাসার মানুষ হই, ভীম—তা হলে এইরকম পদ্মফুল আরও আমাকে এনে দাও—যদি তে’হং প্রিয়া পার্থ বহূনীমান্যুপাহর। মনে রাখবেন, ভীমের আনা পদ্মফুল দ্রৌপদী উপহার দিয়েছেন যুধিষ্ঠিরকে। তাতে বিন্দুমাত্র পুলকের প্রকাশ না ঘটিয়ে শুধুমাত্র দ্রৌপদীর প্রীতির জন্য সৌগন্ধিক পদ্মের অম্বেষায় ব্যস্ত ব্যক্তিটিকে যুধিষ্ঠির বলছেন—আমার পছন্দের কথা যদি ধর, তাহলে এমন কাজ যেন দ্বিতীয়বার কোরো না। এতে ভাইয়ের প্রতি যুধিষ্ঠিরের স্নেহ যতই প্রকট হয়ে উঠুক, দ্রৌপদীর উপহারের মর্যাদা এখানে কতটুকু প্রকাশ পেল? বিদগ্ধা প্রণয়িনীর ইচ্ছার মূল্যই বা কতটুকু থাকল?

আসলে এই উপহারের ব্যাপারটা বুদ্ধদেব অনর্থক বড় প্রতীকী করে তুলেছেন। কৃষ্ণা-পাঞ্চালী আর যুধিষ্ঠিরের সম্পর্কে এত জটিলতা কিছু নেই। যুধিষ্ঠির তাঁর আজন্মলালিত ধর্মীয় তথা ন্যায়নীতির সংস্কারেই হোক, অথবা পিতৃবিয়োগের পর জ্যেষ্ঠপুত্র হিসেবে আপন জননী এবং ভাইদের একান্ত-নির্ভর হিসেবেই হোক অথবা শত্রুপক্ষের জটিল ব্যবহারে বার বার অভিজ্ঞ হয়ে ওঠার ফলেই হোক, জগৎ সংসারে তিনি যেন কেমন বুড়ো মানুষটির মতো হয়ে গিয়েছিলেন। দ্রৌপদীর সঙ্গে তাঁর বয়সের যে বড় বেশি ফারাক ছিল, তা নয় ; তবে স্ত্রীর ওপর তাঁর ব্যবহারটি ছিল বয়স্ক স্বামীর মতো! ভাইদের তিনি যে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন, দ্রৌপদীকেও তিনি সেই স্নেহেই দেখতেন। দ্রৌপদী তাঁর কাছে নিতান্তই এক সংস্কারের মতো, ধর্মপত্নীর সংস্কারে বাঁধা, তার বেশি কিছু না। আর ঠিক এই কারণেই বক-যক্ষের প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির যখন বলেন—গৃহে মিত্র ভার্যা, দৈবকৃত সখা ভার্যা, আর উপরন্তু ‘ধর্ম অর্থ কাম—এই তিন পরস্পর বিরোধীর সংযোগ ঘটে শুধু ধৰ্মচারিণী ভার্যার মধ্যে’—এই সব কথার মধ্যে আমরা শুধু শাস্ত্রবচনের নীতিযুক্তই অনুভব করি, দ্রৌপদীর সঞ্চার আমরা অনুভব করি না। মহাভারতে এমন কোনও জায়গা নেই, যেখানে দ্রৌপদীর প্রণয়-সঞ্চারে তিনি কোনও ধর্ম-যুক্তি লঙ্ঘন করেছেন অথবা তাঁর মত পরিবর্তন করেছেন। বক-যক্ষের কূট প্রশ্নের উত্তরে তিনবার ভার্যার প্রসঙ্গ এসেছে বটে, কিন্তু নীতিশাস্ত্রে এবং ধর্মশাস্ত্রে এই কথাগুলি প্রবাদ-প্রবচনের মতো বার বার বলা হয়—যুধিষ্ঠির সেইগুলিই বলেছেন। তা ছাড়া বক-যক্ষের অতগুলি প্রশ্ন এবং যে প্রশ্নগুলির একটারও বেঠিক উত্তর তাঁর স্নেহের ভাই এবং প্রিয়া পত্নীকে মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিতে পারত, সেইখানে সেই বিশাল নীতিশাস্ত্রীয় প্রহেলিকা সমাধানের সময় যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর ব্যক্তিগত সঞ্চার অনুভব করবেন—এমন মানুষই তিনি নন। যক্ষের প্রশ্ন এবং যুধিষ্ঠিরের উত্তরগুলি যদি সেভাবে দেখতে হয়, তাহলে বলতে হবে যুধিষ্ঠির যক্ষের শত-প্রশ্নের উত্তরে শতবার শত-পরিচিত মানুষের ব্যক্তিগত সঞ্চার অনুভব করে থাকবেন। বস্তুত আমাদের চির-পরিচিত সংসারের সাধারণ তুলাদণ্ড দিয়ে দ্রৌপদীর প্রতি যুধিষ্ঠিরের ব্যবহার পরিমাপ করা বড়ই কঠিন। ভারতবর্ষের ধর্ম এবং দর্শন বাদ দিয়ে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকের দৃষ্টিতে যুধিষ্ঠিরের চরিত্র বিশ্লেষণ করা একান্ত অসম্ভব। কারণ তিনি বড় বেশি স্বতন্ত্র, বড় স্বতন্ত্র ভাবে নির্বিণ্ণ।

এত কথা বলেও আমি কিন্তু এটা বলছি না যে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে ভালবাসতেন না, অথবা দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে। বহুভর্ত্তৃকা দ্রৌপদী তাঁর পঞ্চস্বামীর সঙ্গে কখন, কী ব্যবহার করেছেন আমি সংক্ষেপে তার একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি—উদ্যোগপর্বে। কৃষ্ণের দৃতিয়ালির আগে পর্যন্তও দ্রৌপদী তাঁর স্বামীদের কাছে নিজের অসহ্য অপমানের বিষয়ে সুবিচার পাবেন বলে মনে করেননি। কিন্তু যার কাছে সেই সুবিচার পাবেন বলে মনে করেছেন, অথবা যিনি এই বিদগ্ধা রমণীর স্বামী না হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মন বুঝেছেন, সেই ব্যক্তিটির সঙ্গে দ্রৌপদীর সম্পর্কটাও অদ্ভূত—অদ্ভুত সুন্দর। আসছি সে কথায়, দ্রৌপদী তাঁর প্রিয়তম অর্জুনের একান্ত ভালবাসা পাননি, ভীমসেন আজ্ঞাবহ-দ্রৌপদীর প্রেমে তিনি নিয়েই আছেন, যুধিষ্ঠির বৈচিত্র্যহীন—নিত্য সাহচর্যের দৈনন্দিনতায় স্বামীত্বের অভ্যাসমাত্র, তার বাই বাহুল্য, দ্রৌপদীর প্রেমের ক্ষেত্রে নকুল-সহদেব বড় বেশি বিবেচ্য নন।

তাহলে দ্রৌপদী কী পেলেন? তিনি প্রিয়তম অর্জুনের প্রত্যক্ষ ভালবাসা পাননি,পঞ্চস্বামীর অসম রসবোধ তাঁকে ভাগ করে নিতে হয়েছে, তাঁদের সারাজীবনের কষ্টের ভাগের সুঙ্গে। বদলে তিনি পেয়েছেন শুধু সম্মান, ক্ষাত্র-রমণীর সম্মান, বীরপত্নীর সম্মান, শত্রুকুলের সর্বনাশের সম্মান। এমনকী যখন তাঁর প্রিয় পুত্রগুলিও মারা গেছে, তাখনও তাঁর কোনও বৈরাগ্য কিংবা নির্বেদ আসেনি ; তখনও তিনি পুত্রহন্তা অশ্বত্থামার প্রাণ চেয়েছেন। পুত্রহত্যার প্রতিশোধ-স্পৃহায় তিনি সটান উস্থতি হয়েছেন পাণ্ডব-শিবিরে যুধিষ্ঠিরের কাছে। হস্তিনাপুরের ভাবী মহারাজের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী তাঁর বাক্যশূল প্রয়োগ করলেন সমস্ত স্বামীদের হৃদয়েই—শ্রতিশোধ-স্পৃহায়।

তবে হ্যাঁ এখানেও, এই যুদ্ধপর্বের শেষ মুহূর্তেও একটা জিনিস লক্ষ করার মতো। ঝড়ে-পড়া কলাগাছের মতো দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের সামনে এসেই—ন্যপতৎ ভুবি—মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়লেন। তাঁর মুখটি শোকে কালিমাখা। অন্য কোনও কবি হলে দ্রৌপদীর মুখের উপমা দিতেন রাহুগ্রস্ত চাঁদের সঙ্গে। কিন্তু ব্যাস বললেন—তমোগ্রস্ত ইবাংশুমান্‌—অর্থাৎ তাঁর মুখখানি অন্ধকারে ঢাকা সূর্যের মতো। সূর্য ছাড়া এই ভাস্বর মুখের তুলনা হয় না। দ্রৌপদী পড়েই গরেছিলেন, ঠিক সেই মুহূর্তেই ভীম একলাফে তাঁকে ধরে নিলেন বাহুর বন্ধনে—বাহুভ্যাং পরিজগ্রাহ, সম্যুৎপত্য বৃকোদরঃ। কথঞ্চিৎ শান্ত হবার পর দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বললেন—মহারাজ সমস্ত ছেলেগুলোকে কালের গ্রাসে নিক্ষেপ করে বেশ তো রাজ্য-ভোগ করবেন মনে হচ্ছে। সমস্ত পৃথিবীর রাজা হয়ে আজকে সুভদ্রার ছেলেটাকে ভুলে গেলেন কী করে—অবাপ্য পৃথিবীং কৃৎস্নাং সৌভদ্রং ন স্মরিষ্যসি! আপনি আজই যদি ওই পাপিষ্ঠ অশ্বত্থামার জীবন না নিতে পারেন, তা হলে আমি উপোস করে মরব।

যুধিষ্ঠির স্বভাবতই মিন-মিন করা আরম্ভ করলেন। দ্রৌপদী বললেন—ওকে প্রাণে মারা না গেলেও ওর মাথার সহজাত মণিটি আমায় এনে দিতে হবে। দ্রৌপদী বুঝলেন—এরা কেউ এগোবে না, তিনি সোজা হরি বশংভদ, ভীমসেনকে ধরলেন এবং যথারীতি ভীম চললেনও। কাজটা সহজ ছিল না। কৃষ্ণ সঙ্গে সঙ্গে অর্জুনকে পাঠালেন, নিজেও গেলেন। অশ্বত্থামার সমস্ত সম্মানের প্রতীক, মণি আদায় হল এবং শুধুমাত্র নিজের জেদে সেই মণি যুধিষ্ঠিরের মাথায় ঝুলিয়ে শাস্তি পেলেন কৃষ্ণা। তাঁর এই জেদের সাক্ষী মধ্যম পাণ্ডব ভীমসেন কিন্তু মণিটি দেবার সময় কতগুলি কথা বলেছিলেন এবং তার শেষে ব্যঞ্জনাটি ছিল—তাও কি তুমি খুশি হওনি? আর কী চাই? ভীম বলেছিলেন এই নাও তোমার মণি—অয়ং ভদ্রে তব মণিঃ—পুত্রহন্তা অশ্বত্থামা পরাজিত। তোমার কি মনে পড়ে দ্রৌপদী। সেই যখন শান্তির দূত হয়ে কৃষ্ণ যাচ্ছিলেন কৌরবসভায় আর তুমি বলছিলে—যুধিষ্ঠির আজ যেভাবে শান্তির কথা বলছেন, তাতে বুঝি আমার স্বামীরা বেঁচে নেই, আমআর ছেলে নেই, এমনকী তুমিও নেই। দ্রৌপদী! তুমি সেদিন বড় কঠিন কথা বলেছিলে কৃষ্ণকে। মনে রেখ কৃষ্ণকে আমরা পুরুষোত্তম বলে মানি। সেই তাঁকে তুমি কী ভাষাতেই না অপবাদ দিয়েছিলে—উক্তবত্যসি তীব্রাণি বাক্যানি পুরুষোত্তমে। হতে পারে—সেসব কথা ক্ষত্রিয় ধর্মের অনুরূপ। কিন্তু আজ দেখ—দুর্যোধন মৃত, আমি কথা রেখেছি। দুঃশাসনের রুধির পান করেছি। আমি কথা রেখেছি। দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার সমস্ত যশের নিদান এই মণিও তোমাকে এনে দিলাম।

ভীম এইখানে কথা শেষ করেছেন এবং আমার বিশ্বাস—এই বাক্যের অবশেষ দ্রৌপদীকে বলা যায় না। বলা গেলে শেষ কথা ছিল—আর কী চাও? এবার অন্তত যুদ্ধ বন্ধ হোক। ভীম বলেছেন—দ্রৌপদীর কথা নাকি ক্ষত্রিয় ধর্মের অনুরূপ, আমি বলি—আজীবন দ্রৌপদীর ব্যবহার প্রায় পুরুষ-ক্ষত্রিয়ের মতো। তিনি যতখানি রমণী তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষত্রিয়া কিংবা ক্ষত্রিয়াণী। তিনি যতখানি প্রেমিকা, তার চেয়ে পাঁচ স্বামীর জীবনে অনেক বড় ঝটিকা। পাণ্ডবেরা তাঁদের রাজ্যহরণে কিংবা ধন-রত্নহরণে তত দুঃখ পাননি, যতখানি পেয়েছেন অপমানিত কৃষ্ণার বিদ্যুৎসঞ্চারী কটাক্ষে—হৃতেন রাজ্যেন তথা ধনেন রত্নেশ্চ মুখ্যৈ র্ন তথা বভূব। যথা ত্রপাস্মি-সমীরিতেন কৃষ্ণাকটাক্ষেণ বভূব দুঃখম্‌।।

সুন্দরী কৃষ্ণার ক্রোধ-কটাক্ষে শুধু শূজ ন্যুব্জ তাঁর বীর পঞ্চস্বামী, স্বামীর বাইরেও তাঁর এই কটাক্ষের ভক্ত ছিল অগুণতি। কেউ বা প্রতিকূলে থেকে সেই কটাক্ষ হজম করতে পারেননি এবং সারাজীবন তাঁর অপমান সাধনের চেষ্টা করে, অবশেষে মরেছেন—যেম কর্ণ। আর কেউ অনুকূলে থেকে দূর থেকে সেই কটাক্ষের রস তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছেন কিন্তু বেণী ভেজাননি—তিনি কৃষ্ণ। কৃষ্ণার সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ক কী ছিল আমি সে আলোচনায় বিশেষ যাইনি, সে আলোচনার পরিসরও এটা নয়। তবে কৃষ্ণ যে কৃষ্ণার চিরকালের ‘অ্যাড্‌মায়ারার’ সে-কথা কি মহাভারতের উদার পাঠককে বলে দিতে হবে না। পাঁচ পাঁচটি স্বামী-কুপের বাইরেও দ্রৌপদীর আরও একটি নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা ছিল এবং সে-যুগে যা প্রায় অভাবনীয়, কৃষ্ণ ছিলেন দ্রৌপদীর তাই—‘বয়ফ্রেন্ড’। ইংরেজি কথাটা কৃষ্ণ-কৃষ্ণার সম্পর্ক-ব্যাখ্যায় বড্ড অগভীর, কিন্তু এর থেকে গভীর শব্দ প্রয়োগ করতে গেলে কৃষ্ণ কিংবা কৃষ্ণার ওপর যে ধরনের ভালবাসার দায় এসে পড়বে তাতেও স্বস্তি পাওয়া মুশকিল। তার থেকে বলি বন্ধু—কৃষ্ণস্য দয়িতা সখী। সংস্কৃতে ‘সখা’ শব্দটির মধ্যে সমপ্রাণতার মাহাত্ম্য মেশানো আছে, কিন্তু সে সমপ্রাণতা তো হয় পুরুষে পুরুষে, নয়তো মেয়েতে মেয়েতে। কিন্তু পুরুষ মানুষের মেয়ে বন্ধু—কৃষ্ণস্য দয়িতা সখী—তাও সেকালে—ভাবা যায়!

নইলে পঞ্চস্বামীর অতিরিক্তে দ্রৌপদী বারবার অভিমান করে বলেছেন—এমনকী তুমিও—এমন নিঃশ্বাস ফেলার জায়গা ক’জনের থাকে। কৃষ্ণ দ্রৌপদীকে প্রথম দেখেছিলেন পাঞ্চালের স্বয়ম্বর সভায়। না, না, আমি গজেন্দ্রকুমারের পাঞ্চজন্য ফেঁদে বসছি না। সে ক্ষমতাও আমার নেই এবং মহাভারতের প্রমাণে আমার পক্ষে তা প্রমাণ করাও মুশকিল! তবে বলতে পারি—কৃষ্ণ কিংবা কৃষ্ণা কেউই তাঁদের পারস্পরিক ব্যবহারে সীমা অতিক্রম করেননি কোনওদিন। এমনকী আজকের দিনের স্বচ্ছ-দৃষ্টিতেও দুই যুবক যুবতীকে শুধুমাত্র বন্ধু ভাবা যায় না বলেই উপন্যাসের রাস্তা প্রশস্ত হয়। কিন্তু মহাভারতের প্রমাণে তাঁরা কিন্তু শুধুই বন্ধু, প্রাণের বন্ধু এবং এইমাত্র, এর বেশি নয়। পাণ্ডবেরা বনবাসে আসার পর কৃষ্ণ যেদিন সদলবলে বনেই এসে উপস্থিত হলেন সেদিন দ্রৌপদী কৃষ্ণের সামনে তাঁর কমলকলিকার মতো হাত-দুটি দিয়ে মুখ ঢেকে অনেক কেঁদেছিলেন। তাঁর সমস্ত অপমানের কথা সবিস্তারে শুনিয়ে সেই একই কথা বলেছিলেন—আমার যেন স্বামী-পুত্র, ভাই বন্ধু কেউ নেই—এমনকী তুমিও নেই—নৈব ত্বং মধুসুদন। আমি একটুও ভুলতে পারছি না, যাকে আমি শতপুত্র বলে রাজসভায় লক্ষ্যবোধের যোগ্যতা দিইনি, সেই কর্ণও আমাকে দেখে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাছিল কর্ণো যৎ প্রহসৎ তদা।

দ্রুপদের রাজসভায় যেদিন প্রথম কৃষ্ণা-পাঞ্চালীকে দেখেছিলেন কৃষ্ণ, সেদিন তিনি ছিলেন পতিম্বরা বধূটি—আপ্লুতাঙ্গ সুবসনা সর্বাভরণভূষিতা। আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি, কৃষ্ণ সেই স্বয়ম্ভর-সভায় নতুন একটি বিয়ে করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাননি। কেননা সেই বারণাবতে জতুগৃহদাহের খবর শুনে সাত্যকিকে নিয়ে কৃষ্ণের অল্প-স্বল্প গোয়েন্দাগিরির কথা আমি আগেই জানিয়েছি। স্বয়ম্ভর-সভায় অর্জুনের লক্ষ্যভেদ হল। সমবেত রাজাদের আক্রমণ প্রতিহত করে দ্রৌপদীকে নিয়ে ভীম-অর্জুন ফিরলেন কুমোরপাড়ার বাড়িতে। আর তার পিছন পিছন এলেন কৃষ্ণ এবং বলরাম। সেদিন নববধূ কৃষ্ণাকে একটি সম্বোধনও করেননি কৃষ্ণ। কারণ যুধিষ্ঠির, ভীম ইত্যাদি পিসতুতো ভাইদের সঙ্গেও সেই তাঁর প্রথম পরিচয়।

পরিচয়টা কিন্তু বাড়ল দ্রৌপদীর বিয়ের উপলক্ষেই। হস্তিনাপুরে পাণ্ডবরা ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কৃষ্ণ পাঞ্চালেই ছিলেন। দ্রুপদ স্বয়ং এবং হস্তিনাপুর থেকে নিমন্ত্রণ করতে আসা বিদুর দুজনেই কৃষ্ণের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। ফলত বিয়ের পর-পর কৃষ্ণের সঙ্গে পাণ্ডবদের যোগাযোগ আরও বেড়ে গেল। পাণ্ডবরা রাজ্য পেলেন খাণ্ডবপ্রস্থে। ঘন-ঘন যাতায়াতে সমবয়সী অর্জুনের সঙ্গেও কৃষ্ণের যেমন বন্ধুত্ব গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়েছে, হয়তো দ্রৌপদীর সঙ্গেও সেইভাবে তাঁর বন্ধুত্ব গড়ে উঠছে। অর্জুন বনবাস থাকে ফিরে আসার পর কৃষ্ণ-অর্জুন তুর্থা সুভদ্রা-দ্রৌপদীকে আমরা যমুনা-বিহার একান্তে দেখেছি। কিন্তু আগেই বলেছি-সুভদ্রার সূঙ্গে অর্জুনের বিয়েতে দ্রৌপদীর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল সাভিমান প্ররু-বাক্য। কৃষ্ণের ওপর দ্রৌপদী যে সেই মুহূর্তে খুশি হননি তা বোঝা যায় বাচনভঙ্গিতে। তিনি অর্জুনকে বলেছিলেন—তুমি সেই চুলোতেই যাও, যেখানে আছে সেই সাত্ব-বৃষ্ণিকুলের পরমা মহিলাটি—সুভদ্রা।

কৃষ্ণ সাত্বত-কুলের গরবময় পুরুষ। অর্জুন তাঁর ভাই এবং বন্ধু। দ্রৌপদী অর্জুনের পরম-প্রণইয়িনী জেনেও কৃষ্ণ তাঁর দাদা বলরাম এবং অন্যান্য বৃষ্ণি-বীয়দের আপত্তি সত্ত্বেও সুভদ্রাকে প্রায় প্রতেই অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। সামান্যতম আলেও দ্রৗপদীর প্রিয়তম স্বামী অর্জুনের সম্বন্ধে কৃষ্ণের একটু ঈর্ষা ছিল কি না কে জানে? তার দ্রৌপদীকে নিয়ে সম্পূর্ণ সুখী হন এটা অন্তরের অন্তরে চাননি বলেই কি কৃষ্ণ সুভদ্রার ব্যাপারে অর্জুনকে এত সাহায্য করেছিলেন? কে জানে চতুর চূড়ামণির অন্তরে কী ছিল? মহাভারতের কবিকে ধন্যবাদ তিনি দ্বারকাবাসী সেই ধুরন্ধর পুরুষের নাম কৃষ্ণ, এবং দ্ৰৌপদীর নাম কৃষ্ণা রেখেই বুঝেছিলেন ব্যাকরণগতভাবে সম্পর্কটা অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তিনি আর বাড়তে দেননি। তবে অর্জুনের সঙ্গে সুভদ্রার বিয়ে দেওয়ার মতো সামান্যতম ক্ষতি করেই বুঝি কৃষ্ণ অর্জুন এবং এমনকী দ্রৌপদীরও পরম বন্ধু হয়ে গেছেন। সুভদ্রাকে শ্বশুরবাড়িতে রেখে কৃষ্ণ যেদিন দ্বারকায় ফিরে যাবার দিন ঠিক করলেন, সেদিন দ্রৌপদীকে রীতিমত সান্ত্বনা দিয়ে তাঁকে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল। যেদিন থেকে কৃষ্ণের সান্ত্বনায় দ্রৌপদী সুখ পেতে আরম্ভ করলেন, সেদিন থেকেই বোঝা যায়—তিনি মনে-মনে অর্জুনকে একটু একটু করে হারিয়েছেন, আর নিজের অজান্তেই দ্বারকার ওই প্রবাদ-পুরুষটির কাছাকাছি চলে এসেছেন, বাঁধা পড়েছেন সম-প্রাণতার বন্ধনে—বন্ধুত্বের বন্ধনে।

এই বন্ধুত্ব এতটাই যে, যুধিষ্ঠির, ভীম এমনকী অর্জুনও কৃষ্ণকে যতটুকু সম্মান করে কথা বলতেন, দ্রৌপদী তা বলতেন না। শাল্বরাজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে যাওয়ার জন্য কৃষ্ণ কুরুসভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি, কিন্তু সেদিন সেই চরম অপমানের মধ্যে দ্রৌপদী স্বামীদের সুরক্ষায় বঞ্চিত হয়ে এই সমপ্রাণ বন্ধুর জন্যই ডাক ছেড়ে কেঁদেছিলেন —কৃষ্ণঞ্চ বিষ্ণুঞ্চ হরিং নরঞ্চ। ত্ৰাণায় বিক্ৰোশতি যাজ্ঞসেনী। তারপর যেদিন বনবাসে কৃষ্ণের সঙ্গে দ্রৌপদীর দেখা হল, যুধিষ্ঠির অর্জুনের কথা যেই থামল, অমনই দ্রৌপদী অভিমান ভরে দেবল, নারদ আর পরশুরামের জবানীতে ‘ভগবান’ বলে গালাগালি দিলেন কৃষ্ণকে। বললেন—সবাই তোমাকে ঈশ্বর এবং সমস্ত প্রাণিজগতের একান্ত গতি বলে বর্ণনা করেন, কিন্তু এমন বিরাট, সনাতন পুরুষ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সখী হয়ে, পাণ্ডবদের বউ হয়ে, ধৃষ্টদ্যুম্নের বোন হয়ে আমাকে একবস্ত্র রজস্বলা অবস্থায় কৌরব-সভায় দাঁড়াতে হল কেন? কেন আমার চুলের মুঠি গেল দুঃশাসনের হাতের মুঠোয়?

কৃষ্ণ কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি। দ্রৌপদী বলেছিলেন—জান কৃষ্ণ! ওরা আমাকে দাসীভাবে ভোগ করতে চেয়েছিল, অথচ তবু তোমরা সব বেঁচেছিলে। অভিমানের শেষ কল্পে দ্রৌপদী নিজেকে এমন এক করুণ ভূমিকায় স্থাপন করেছেন, যেখানে তাঁর শেষ কথা—আসলে আমার কেউ নেই—স্বামীরা নেই, ছেলেরা নেই, আত্মীয়-স্বজন নেই, বাপ-ভাই নেই, এমনকী তুমিও আমার নও কৃষ্ণ—নৈব ত্বং মধুসূদন। এই যে এত নেই-নেই, তার মধ্যে বিদগ্ধা রমণীর মুখে—এমনকী তুমিও নেই—নৈব ত্বং-এই ‘তুমিও’ শব্দটা যেন সবার থেকে আলাদা। যেন, তেমন দিনে ওঁরা অর্থাৎ আত্মীয়-স্বজন, স্বামী-পুত্তুর বাপ-ভাইও আমায় না দেখতে পারে, কিন্তু তুমি—চিরজনমের সখা হে! কৃষ্ণের মাত্রাটা সবার থেকে যেন আলাদা!

বনপর্বে, উদ্যোগপর্বে এমনকী যুদ্ধ শেষের দিন পর্যন্ত ওই একই কথাই বলেছেন দ্রৌপদী। কৃষ্ণ কেবলই সান্ত্বনা দিয়ে গেছেন, কেননা যুদ্ধের রাজনীতিতে পরপক্ষকে শাস্তি দিতে সময় লাগে। কিন্তু পাঞ্চালী কৃষ্ণার করুণ-কালো জল-ভরা চোখের কথা কৃষ্ণ ভোলেননি। দর্শনের দৃষ্টিতে যগুনির্লিপ্ত পুরুষই তিনি হন অথবা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নাই করুন কোনও সশস্ত্র যুদ্ধ, ভারত-যুদ্ধের সুতোটা যদি তাঁর হাতেই ধরা থেকে থাকে—কেননা তিনি, মহাভারত-সূত্রধারঃ—তা হলে কুরু-পাণ্ডবের পুতুলনাচে পাঞ্চালী-কৃষ্ণাই ছিলেন তাঁর প্রধান নটী। জননী গান্ধারী ভারত-যুদ্ধের সমস্ত দায় কৃষ্ণের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন, এবং সে দায় তিনি বহন করতেও দ্বিধা করেননি। বাহ্যত এই যুদ্ধের কারণের মধ্যে যত রাজনীতির কথা থাকুক, যতই থাক জ্ঞাতি-বঞ্চনা অথবা দুর্যোধনের অহংকার, কৃষ্ণ কিন্তু দ্রৌপদীর চুলের কথা ভোলেননি—সেই সর্পকুটিল, কুঞ্চিত, কেশদাম—মহাভুজগবর্চ্চসম্‌।

উদ্যোগপর্বে মহামতি সঞ্জয় যখন বিরাটরাজ্যে পাণ্ডবদের কাছে ধৃতরাষ্ট্রের বক্তব্য শোনাতে উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন কৃষ্ণও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। সবার কথার শেষে কৃষ্ণ যে-ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন সঞ্জয়কে, সেই ভাষাটা ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেদের পক্ষে নাকি ছিল ‘ত্রাসনী’ অথাৎ লাস্ট ওয়ার্নিং-এর মতো। ভাষার মধ্যে প্রাথমিক মৃদুতা ছিল বটে কিন্তু সেই মৃদুতার মধ্যে ছিল নিদারুণ পরিণতির সতর্কবাণী—ত্রাসনীং ধার্তরাষ্ট্ৰাণাং মৃদুপূর্বাং সুদারুণাম্।।

কৃষ্ণের এই ভাষার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর কথা বলার পরিমণ্ডলটাও একটু বলতে হবে। মনে রাখা দরকার—এই পরিমণ্ডল বর্ণনায় আমার একটু ব্যক্তিগত প্রয়োজন আছে। যাঁরা কৃষ্ণের ভগবত্তায় বিশ্বাসী, তাঁরা যেন এই রাজোচিত পরিমণ্ডল-বর্ণনায় আহত না হন। সঞ্জয় এসেছেন অর্জুনের সঙ্গে কথা বলতে। অর্জুন তখন অন্তঃপুরের শিথিল পরিবেশে বসে আছেন এবং কৃষ্ণও রয়েছেন সেখানেই। আর আছেন দ্রৌপদী এবং সত্যভামা। কিঞ্চিৎ মদ্যপান করার ফলে এই দুই মহাত্মার মন এবং বুদ্ধি—দুইই একটু টান টান হয়ে আছে। প্রগাঢ় বন্ধুত্ব এবং অন্তঃপুরের শৈথিল্যে কৃষ্ণ তাঁর চেয়ার থেকেই দুই পা বাড়িয়ে দিয়েছেন অর্জুনের কোলে। আর অর্জুন তাঁর এক পা রেখেছেন নিজের স্ত্রী দ্রৌপদীর কোলে এবং অন্যটি রেখেছেন কৃষ্ণের প্রিয়া পত্নী সত্যভামার কোলে—অর্জুনস্য চ কৃষ্ণায়াং সত্যায়াঞ্চ মহাত্মনঃ।

একথা ভাবার কোনও কারণ নেই যে, কৃষ্ণ এবং অর্জুন মদের ঘোরে ব্যক্তিগত ব্যবহারের সীমা লঙঘন করেছেন। বরঞ্চ এই মানুষগুলির মধ্যে বন্ধুত্ব এবং হৃদয়ের নৈকট্য এতই বেশি ছিল যে কৃষ্ণ-প্রিয়া সত্যভামার কোলে অর্জুনের পা রাখা দেখে যেমন আমরা আশ্চর্য হচ্ছি না, তেমনই আশ্চর্য হতাম না যদি দ্রৌপদীর কোলে কৃষ্ণের পা-দুটি দেখতাম। তার ওপরে অন্তঃপুরের শিথিলতা তো আছেই। অর্জুন, কৃষ্ণ, দ্রৌপদী, সত্যভামার আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা এতটাই ছিল যে, দ্বৈপায়ন ব্যাস মন্তব্য করেছেন—এঁরা ঘনিষ্ঠভাবে বসে থাকলে অভিমন্যু বা নকুল-সহদেবও সেখানে যেতেন না। ঠিক এইরকম একটা অন্তঃপুরের পরিবেশে সঞ্জয় তাঁর দৌত্যকর্মের তাগিদে অর্জুনের কাছে আসতে বাধ্য হয়েছেন। সঞ্জয় তাঁর বক্তব্য নিবেদন করলে অর্জুন নিজে কথা না বলে, কৃষ্ণকেই বলবার জন্য ইঙ্গিত করলেন।

কৃষ্ণ বললেন। কোনও বড় বড় রাজনৈতিক কথা নয়, কোনও বিশাল দর্শনের কথা নয়, এমনকী কোন মহৎ ধর্মের কথাও নয়। কৃষ্ণ বললেন—যুধিষ্ঠিরের একটু তাড়া আছে সঞ্জয়! ভীষ্ম দ্রোণকে সাক্ষী রেখে তুমি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে বোলো—ভাল করে যজ্ঞ-টজ্ঞ করে নিন, ছেলে-পিলে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে যা আনন্দ করার, তাও করে নিন। সামনে বড় ভয় আসছে—মহদ্‌ বো ভয়ামাগতম্‌। কেন জান, সঞ্জয়! কৃষ্ণ বলে চললেন—দ্রৌপদীর কাছে আমার ঋণ বেড়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। আর সেই কথাটা আমার মন থেকে এক পলের জন্যেও দূরে সরে যাচ্ছে না। আমি দূরে ছিলাম, আর সেই কুরুসভায় সমস্ত রাজন্যবর্গের চোখের সামনে অপমানিতা হতে হতে আমাকে কতই না কেঁদে কেঁদে ডেকেছিল দ্রৌপদী। এই কথাটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না। দিন চলে গেছে অনেক, তাই দ্রৌপদীর কাছে ঋণও আমার বেড়েই চলেছে—ঋণমেতৎ প্রবৃদ্ধং মে হৃদয়ান্নাপসৰ্পতি।

কৃষ্ণ আরও অনেক কথা বলেছিলেন, যার অর্থ একটাই—সামনে বড় ভয় আসছে, তোমাদের—মহদ্‌ বো ভয়মাগতম্! যুদ্ধের উদ্যোগপর্ব চলছে, সেই মুহূর্তে কৃষ্ণের মুখে দ্রৌপদীর জন্য এই পরম আর্তি কৃষা পাঞ্চালীর হৃদয়ে অন্য এক বিশিষ্ট অনুভূতি তৈরি করেছিল নিশ্চয়ই। পঞ্চস্বামীকে নস্যাৎ করে দিয়েও ষষ্ঠ যে পুরুষটিকে তিনি আলাদা করে চিহ্নিত করেছিলেন—এমন কী তুমিও নও, কৃষ্ণ!—সেই মানুষটি যখন তাঁর সামনেই শত্রুপক্ষকে বলেন—আর দেরি নয়, আমাকে পাঞ্চালী-কৃষ্ণার ঋণ চুকোতে হবে, সেদিন নিশ্চয়ই দ্রৌপদীর মনে হয়—পঞ্চস্বামীর বাইরেও আরও এক অন্যতম সম্বন্ধ আছে তাঁর—তাঁর বন্ধু, চিরজনমের সখা হে।

এই সখার অধিকার এতটাই যে, যুধিষ্ঠির-ভীম অথবা অর্জুনও কৃষ্ণের সঙ্গে যে মর্যাদায় কথা বলেন, সেই মর্যাদা সমপ্রাণতার মাহাত্মে স্তব্ধ করে দিয়ে দ্রৌপদী কৃষ্ণেকে সাভিমানে বলতে পারেন—আমি তোমাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিচ্ছি কৃষ্ণ! অন্তত চারটে কারণ হচ্ছে যাতে তুমি নিয়ত আমাকে রক্ষা করতে বাধ্য—চতুর্ভিঃ কারণৈঃ কৃষ্ণ ত্বয়া রক্ষ্যাম্ভি নিত্যশঃ এক, ‘সম্বন্ধাৎ’ অর্থাৎ কিনা আমি তোমার আপন পিসির ছেলের বউ। দুই, ‘গৌরবাৎ’—আমাকে কি তুমি খুব কম ভাব, যজ্ঞের আগুন থেকে আমার জন্ম অতএব ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়েরা যে গার্হপত্য আগ্নি রক্ষা করে সেই গৌরবে আমারও রক্ষা হওয়া উচিত। তিন, ‘সখ্যাৎ’—সব চাইতেন্দব, পাণ্ডববধূর সম্বন্ধ গৌরব ছাড়াও তোমার সঙ্গে আমার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে—তুমি আমার বন্ধু। দ্রৌপদী মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠকে চিনতেন না। চিনলে বলতেন—তুমি বোকার মতো ‘সংখ্যে”র অর্থ বানিয়েছ ভক্তিমতী। আমি কোনওদিনই কৃষ্ণের ভক্ত নই, আমি তাঁর বন্ধু। দ্রৌপদী বলেছেন—আমি পাণ্ডবদের বউ বটে—‘ভার্যা পার্থানাং’, কিন্তু আরও আছে অর্ধেক আকাশ—আমি যে তোমার বন্ধু—তব কৃষ্ণ সখী বিভো। চতুর্থ কারণ হিসেবে দ্রৌপদী কৃষ্ণকে বলেছেন—সবার ওপরে তোমার ক্ষমতা আছে, সামর্থ্য আছে। তাই আমি তোমার ওপর নির্ভর করি—সম্বন্ধাদ্‌ গৌরবাৎ সখ্যাৎ প্রভুত্বেন চ কেশব! কৃষ্ণ এই কথাগুলি ভোলেননি। সম্বন্ধ, গৌরব, সখ্য এবং প্রভুত্ব—এই সবগুলিই তাঁকে দ্রৌপদীর কাছে উত্তরোত্তর ঋণীই করেছে, যে-ঋণ চুকানোর জন্য দ্রৌপদীর সামনেই তিনি সে-কথা অঙ্গীকার করেছেন।

দৌপদীর সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ক এই চার দেওয়ালের বাইরে যায়নি। যখনই মনে হয়েছে স্ত্রী হিসাবে তিনি সুবিচার পাচ্ছেন না, তখনি বন্ধুর কাছে তিনি সাভিমানে মুক্তশ্বাস হয়েছেন। আলগা করে দিয়েছেন তাঁর নিজের মনের গুরুভার! পরিবর্তে কৃষ্ণের কাছে পেয়েছেন সেই আশ্বাস যা তিনি চান। সেই সমপ্রাণতা, যা তাঁর স্বামীরাও তাঁকে দিতে পারেননি। দ্রৌপদীর মনের কথা দ্রৌপদীর মতো করেই যদি কেউ বুঝে থাকেন, তো সে কৃষ্ণ, তাঁর স্বামীরা নন। দ্রৌপদীর সঙ্গে কৃষ্ণের সম্পর্ক এইটুকুই—ভাই, ‘মনের কথা’, ‘তব কৃষ্ণ প্রিয়া সখী’।