দ্রৌপদী – ১

ঘটনাস্থল দুর্যোধনের সাতমহলা বাড়ির অন্দরমহল। এখানে দুর্যোধনের স্ত্রী ভানুমতী আছেন। কোনও কারণে আজ সেখানে পঞ্চ স্বামিগর্বিত দ্রৌপদীর আগমন ঘটেছে। ভানুমতী তাঁকে নেমন্তন্ন করেছিলেন, নাকি দ্রৌপদী সেখানে নিজেই এসেছিলেন, সে খবর আমরা রাখি না। কিন্তু ভানুমতী যেহেতু দুর্যোধনের স্ত্রী এবং দ্রৌপদী যেহেতু পাঁচ ভাইয়ের এক বউ, তাই তাঁদের কথাবাতা সোজা খাতে বইছিল না। বিশেষত এই দুই রমণীর স্বামীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক সহজ ছিল না, তাই এঁদের কথাবাতার মধ্যেও কুটিল ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ বিনা কারণেই এসে পড়ছিল। দুর্যোধনের গরবে গরবিনী ভানুমতী শেষ পর্যন্ত চিবিয়ে চিবিয়ে বলেই ফেললেন কথাটা। বললেন—তোমার তো আবার একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা স্বামী। এ বিদ্রপ দ্রৌপদীর গা-সওয়া। কৃষ্ণের পরম-প্রিয়া পত্নী সত্যভামাও মহাভারতের বনপর্বে একই প্রশ্ন করেছিলেন। তবে তাঁর বলার ভঙ্গি ছিল ভাল আর জিজ্ঞাসার সঙ্গে ছিল বিনয়। সত্যভামা বলেছিলেন—পাঁচ-পাঁচটা পাণ্ডব স্বামীকে তুমি কেমন করে তুষ্ট কর দিদি? ব্রত, স্নান, মন্ত্র, নাকি ওষুধ করেছ দিদি! বল না, কী করলে আমার ওই একটা স্বামীই কৃষ্ণ আমার বশে থাকে! কী বুদ্ধিতেই বা তুমি পাঁচ স্বামীকে সামাল দাও—কেন বৃত্তেন দ্রৌপদী পাণ্ডবান অধিতিষ্ঠসি?

হ্যাঁ, সত্যভামার প্রশ্নে আবদার ছিল, জিজ্ঞাসার মধ্যে মিনতি ছিল, দ্রৌপদীও তাই স্বামী হাতে রাখার কেতাকানুন সত্যভামাকে শিখিয়ে দিয়েছিলেন একেবারে বুড়ি মাসিমার মতো। কিন্তু এই ভানুমতীর বলার ঢঙ তো আলাদা, ভানুমতীর কথার মধ্যে যেন মেয়েমানুষের লাম্পট্যের ইঙ্গিত আছে। দ্রৌপদী ছাড়বেন কেন? বিশেষত তিনি বিদগ্ধা মহিলা, সংসার ক্ষেত্রে যথেষ্ট দগ্ধাও বটে। সীতা-সাবিত্রীর আদর্শ দ্রৌপদীর চলে না, মুখ বুঝে সহ্য করার লোকও তিনি নন। সঙ্গে সঙ্গে দ্রৌপদী জবাব দিলেন—আমার শ্বশুরকুলে স্বামীর সংখ্যা চিরকালই একটু বেশি ভানুমতী—পতিবৃদ্ধিঃ কুলে মম।

সরলা ভানুমতী প্রথমে বুঝতেই পারেননি কোপটা কোথায় গিয়ে পড়ল। তারপর যখন দ্রৌপদীর কথাটা বেশ ভেবে দেখলেন, তখন বুঝলেন তাঁর নিজের শ্বশুর, দিদিশাশুড়ি—সবাই জড়িয়ে গেছেন দ্রৌপদীর কথার পাকে। দ্রৌপদীর শাশুড়ি হলেন কুন্তী। পাণ্ডু ছাড়াও আরও পাঁচজন তাঁর অপত্যকারক স্বামী ছিলেন। না হয় ধরেই নিলাম কর্ণ-পিতা সূর্যের কথা দ্রৌপদী জানতেন না। আবার কুন্তীর দুই শাশুড়ি হলেন অম্বিকা আর অম্বালিকা। বিচিত্রবীর্য ছাড়াও এঁদের পুত্রদাতা স্বামী স্বয়ং মহর্ষি ব্যসদেব। এই সুবাদে ভানুমতীর শ্বশুর ধৃতরাষ্ট্র অথবা তাঁর শাশুড়ি মা অম্বিকাও তো ফেঁসে গেলেন। আবার অম্বিকা-অম্বালিকার শাশুড়ি যে সত্যবতী, তাঁর শান্তনু ছাড়াও তো আরেক স্বামী ছিলেন—পরাশর মুনি। এবার দ্রৌপদীর কথার গুরুত্ব বুঝে আর কথা বাড়াননি দুর্যোধন সোহাগী ভানুমতী।

জনান্তিকে বলে রাখি, ভানুমতী-দ্রৌপদীর এই সংলাপের কথা মহাভারতে নেই। এমনকী দুর্যোধনের স্ত্রীর নাম ভানুমতী কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। পণ্ডিতেরা বলেন—বেণীসংহার নাটকের লেখক ভট্টনারায়ণই দুর্যোধন বধূর নামকরণ করেন ভানুমতী। বস্তুত দুর্যোধনের স্ত্রীর নাম ভানুমতী না মাধবী, তাতে কিছু আসে যায় না। এমনকী ওপরের যে সংলাপটি পণ্ডিত অনন্তকাল ঠাকুর আমাকে বলেছিলেন, সেটিও তাঁর মতে লোকপরম্পরায় প্রচলিত শ্লোকের একাংশ। খুব প্রামাণিক না হলেও এই শ্লোকটিকে আমরা অসীম গুরুত্ব দিই, এবং তা দিই এই কারণে যে, দ্রৌপদীর চরিত্র বুঝতে এমন শ্লোক বুঝি আর দ্বিতীয় নেই।

যাঁরা আর্থ-সামাজিক কুতূহলে সেকালের তাবৎ নারীকুলের অন্যায় আর অবিচারের জিগির তোলেন, দ্রৌপদীর চরিত্র তাঁদের কিছু হতাশ করবে। স্বামীদের ভুল বা ভালোমানুষির জন্য দ্রৌপদীর জীবনে দুঃখ-কষ্ট এবং উপদ্রব—কোনওটাই কম হয়নি। তবু কিন্তু কোনও সতীলক্ষ্মীর বিপন্নতা দ্রৌপদীর ছিল না। সতীলক্ষ্মীর মতো স্বামীদের সর কথা তিনি মুখ বুজে সহ্যও করেননি। বরঞ্চ আধুনিক অনেক গোবেচারা স্বামীদের মতোই দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামীকে মাঝে মাঝেই তাঁর মুখঝামটা খেয়ে গোবেচারা হয়ে যেতে হয়েছে। এবং জনান্তিকে আবারও বলি—দ্রৌপদীর পাঁচ পাঁচটি স্বামীই দ্রৌপদীকে রীতিমতো ভয় পেয়ে চলতেন। ভয় পেতেন অন্যেরাও। তবে সে-কথা পরে।

দ্রৌপদী কালো মেয়ে। কালো বলেই তাঁর নাম কৃষ্ণা—কৃষ্ণেত্যেবাব্রুবন্‌ কৃষ্ণাং কৃষ্ণাভূৎ সা হি বর্ণতঃ। মহাভারতীয় রঙ্গভূমিতে যে ক’টি কালো মানুষ মহাভারত মাতিয়ে রেখেছেন তার মধ্যে তিনজনই পুরুষ, আর দুজন স্ত্রীলোক। এই নতুন কথাটা প্রথম শুনি শ্রদ্ধেয়া গৌরী ধর্মপালের কাছে। প্রথম কালো মহামতি ব্যাসদেব, দ্বিতীয় কালো কৃষ্ণ ঠাকুর, তৃতীয় হলেন অর্জুন। আর মেয়েদের মধ্যে ব্যাস-জননী ধীরকন্যা সত্যবতী নিকষ কালো। তাঁর নামও ছিল কালী। কৃষ্ণভগিনী সুভদ্রাকেও কালী বলে ডাকা হত, কিন্তু তার গায়ের রঙ কালো ছিল না। কাজেই গায়ের রঙ এবং নামেও মহাভারতের দ্বিতীয়া যে কালো স্ত্রীলোকটি তার নাম দ্রৌপদী। তবে গায়ের রং কালো হলে কী হবে, সেকালে দ্রৌপদীর মতো সুন্দরী সারা ভারতবর্ষ খুঁজলেও মিলত না। অবশ্য দ্রৌপদীর রূপ যে শুধুমাত্র শরীরকেন্দ্রিক ছিল না, তাঁর রূপ যে দেহের সীমা অতিক্রম করেছিল, সেকথা বোঝা যাবে স্বয়ং ব্যাসের বর্ণনায়। মহাভারতকার দ্রৌপদীর শারীরিক রূপ বর্ণনায় বেশি শব্দ খরচ করেননি। ‘সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোণীপয়োধরা’—দ্রৌপদীর এই বর্ণনা মহাকাব্যের সুন্দরীদের তুলনায় আলাপমাত্র। লক্ষণীয় বিষয় হল—নায়িকার রূপ বর্ণনার ক্ষেত্রে মহাকাব্যকারেরা যেখানে অনুপম শব্দরাশির বন্যা বইয়ে দেন, সেখানে দ্রৌপদীর রূপবর্ণনায় মহাভারতকার যেন একেবারে আধুনিক মানসিকতায় গ্ল্যামারের দিকে মন দিয়েছেন। দ্রৌপদী যে মোটেই বেঁটে ছিলেন না, আবার ঢ্যাঙা লম্বাও ছিলেন না—নাতিহ্রস্বা ন মহতী—সেকেলে কবির কাছে এই বর্ণনা, এই বাস্তব দৃষ্টিটুকু অভাবনীয়। তাও একবার নয়, দুবার এই কথা ব্যাসকে লিখতে হয়েছে, যদিও অন্যত্র হলে নারীদেহের প্রত্যঙ্গ বর্ণনার ঝড় উঠে যেত তাঁরই হাতে। ব্যাস জানতেন দ্রৌপদীর রূপ তাঁর কুঞ্চিত কেশরাশি কিংবা স্তন-জঘনে নয়, তাঁর রূপ সেই দৃপ্ত ভঙ্গিতে—বিভ্রাজমানা বপুষা—সেই বিদগ্ধতায়, যার সঙ্গে তুলনা চলে শুধু নীলাভ বৈদুর্যমণির—বৈদুর্যমণিসন্নিভা। যেখানেই তিনি থাকেন, সেখানেই আলো ঠিকরে পড়ে, প্রতি কথায়, প্রতি কাজে। আর তাঁর মধ্যে আছে এক দূরত্ব, যে দূরত্ব তাঁর জন্মলগ্নেই বিধিপ্রদত্ত, কেননা যজ্ঞীয় বেদীর আগুন থেকে তাঁর জন্ম। তাঁর মানে এই নয় যে, একটি যজ্ঞবেদী থেকে কৃষ্ণার জন্ম হয়েছিল। এমনটি হতেই পারে না। তার কারণ দ্রুপদ রাজার আয়োজিত দ্রোণ-হন্তার জন্মযজ্ঞে পুরোহিত যখন আগুনে ঘি দিচ্ছিলেন তখনই তিনি টের পেয়েছিলেন যে ওই যজ্ঞের আগুন থেকে শুধুমাত্র একটি কুমার জন্মাবে না, উপরন্তু একটি কুমারীও জন্মাবে। দ্রুপদ রাজার স্ত্রীকে তিনি বলেছিলেন—রাজ্ঞি পৃষতি মিথুনং ত্বমুপস্থিতম্‌ তুমি পুত্র এবং কন্যা দুই-ই পাবে রানি। পুরোহিত যাজ যজ্ঞে আহুতি দেওয়া মাত্রই সেই আগুন থেকে জন্মালেন কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন—উত্তস্থৌ পাবকাৎ তস্মাৎ। এর পরে ধৃষ্টদ্যুম্নের একটু বর্ণনা দিয়েই ব্যাস বললেন-কুমারী চাপি পাঞ্চালী বেদীমধ্যাৎ সমুত্থিতা—সেই বেদী থেকেই কুমারী পাঞ্চালীও উদ্ভূত হলেন। ঠিক এখানে আগুন কথাটা সোজাসুজি নেই বটে তবে যজ্ঞীয় বেদীর মধ্যে আগুন ছাড়া আর কী থাকে? বিশেষত পূর্বাহ্নে যে আগুন থেকে কুমার জন্মেছেন। ব্যাস অবশ্য পরে পরিষ্কার লিখেছেন যে দ্রুপদের পুত্রেষ্টি যজ্ঞে পুত্র এবং কন্যার মিথুন জন্মাল—তথা তন্মিথুনং যজ্ঞে দ্রুপদস্য মহামখে।

কাজেই যজ্ঞের বেদীমাত্র নয়, বেদীর আগুন থেকেই তাঁর জন্ম। বস্তুত আগুন তো কৃষ্ণার গায়ের রঙে আসবে না, আগুন যে দ্রৌপদীর চরিত্রে। যাঁরা দ্রৌপদীর নিত্যসঙ্গী—পাঁচভাই—তাঁরা এই আগুনে সোনার মতো পুড়ে পুড়ে শুদ্ধ হয়েছেন। আর যাঁরা দূরের, তাঁরা যতবারই এই যাজ্ঞসেনী আগুনে হাত দিয়েছেন, ততবারই তাঁদের হাত পুড়েছে, কপাল পুড়েছে, গোটা বংশ ছারখার হয়ে গেছে। দ্রৌপদীর আবির্ভাব লগ্নেই তাই দৈববাণী শোনা গেছে—ক্ষত্রিয় কুলের ধ্বংসের জন্যই তাঁর জন্ম, তিনি কৌরবদের ভয়ের নিশান—অস্যা হেতোঃ কৌরবাণাং মহদুৎপদ্যতে ভয়ম্‌। কি অসামান্যতায়, কি রূপে, কি গুণে—দ্রৌপদীর সঙ্গে আমি তাঁর বৃদ্ধা দিদিশাশুড়ি সত্যবতীর খুব মিল খুঁজে পাই। শুধু গাছের রঙ ভাগ করে নিয়ে এঁরা যে একজন কালী আর অন্যজন কৃষ্ণা হয়েছেন তাই নয়, এঁদের দুজনের মধ্যেই ছিল সেই বিরল ব্যক্তিত্ব, যাতে সত্যবতীর হাতে গড়ে উঠেছিল ওই বিরাট কুরুকুল, আর দ্রৌপদীর ক্ষোভে সেই কুরুকুল ধ্বংস হয়ে গেল। সৃষ্টি আর ধ্বংসের মধ্যে তফাত এইটুকুই যে, মহারাজ শান্তনু, পিতামহ ভীষ্ম—এঁরা সত্যবতীর ব্যক্তিত্ব মেনে নিয়েছেন, আর পাণ্ডবেরা দুর্ভাগ্যবশে এবং কৌরবেরা সাহঙ্কারে দ্রৌপদীর ব্যক্তিত্বকে অপমান করেছেন। ফল একপক্ষে বিড়ম্বনা, অন্যপক্ষে ধ্বংস।

দ্রৌপদীর যেদিন বিয়ে অথবা স্বয়ম্বর, তার আগে পাণ্ডবেরা বারণাবতে জতুগৃহের আগুন হজম করে প্রচ্ছন্নভাবে এধার-ওধার ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এ-বন সে-বন দেখে, আর কিছুই করার না পেয়ে পাণ্ডবজননী কুন্তী পর্যন্ত অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। ভিক্ষা-টিক্ষাও ভাল মিলছে না। এরই মধ্যে ব্যাস এসে দ্রৌপদীর জন্মকথা শুনিয়ে গেলেন পাণ্ডবদের। যাবার আগে এও বলে গেলেন, যে সেই রমণীই পাণ্ডবদের বউ হবে। কিন্তু কৌরব-জ্ঞাতির প্রতাড়না আর বন-বনান্তরে ঘুরে বেড়াবার যন্ত্রণায় পাণ্ডবদের মনে তখন স্ত্রীচিন্তা ঠাঁই পায় না। সমস্ত জগৎকে খরতাপে আক্রমণ না করে সূর্য যেমন সন্ধ্যা-বধূকে ভজনা করে না, তেমনি জগতের কাছে আপন শৌর্য প্রকাশ না করে পাণ্ডবেরাই বা রমণীর চিন্তা করবেন কী করে? তবে একাধারে শৌর্য-বীর্য দেখানোর সুযোগ এবং স্ত্রীরত্ন লাভ—দুইয়েরই মওকা এল দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে, যদিও পাণ্ডবেরা এ-কথা সচেতনভাবে বোঝেননি। তাঁরা পাঞ্চালরাজ্যের উদ্দেশে রওনা দিলেন ভাল ভিক্ষে পাবার আশায়। কারণ তাঁরা শুনেছিলেন পাঞ্চাল রাজ্যে ভাল ভিক্ষে পাওয়া যায়—সুভিক্ষাশ্চৈব পাঞ্চালাঃ শুয়ন্তে। তা ছাড়া বনে বনে এতকাল বাস করে নগরে ভ্রমণ করার জন্য পাণ্ডবদের নাগরিক বৃত্তিও কিছুটা উত্তেজিত হয়েছিল বুঝি। কেননা পাঁচ ছেলের মা কুন্তী পর্যন্ত ভেবেছিলেন—নগরে গেলে দারুণ মজা হবে—অপূর্বদর্শনং বার রমণীয়ং ভবিষ্যতি। পাণ্ডবেরা তাই চললেন। রাস্তায় ব্যাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বটে, তবে ব্যাসের কথা, দ্রৌপদীর কথা বুঝি বা তাঁদের ভাল করে মনেও ছিল না।

পাঞ্চাল রাজ্যে পৌঁছে ইস্তক দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের খবর পাণ্ডবদের কানে আসছিল। মনে মনে। তাঁকে বিয়ে করার মানসিক প্রস্তুতি পাণ্ডবদের কারও ছিল না, কিন্তু তাঁরা যে স্বয়ম্বরের জাঁকজমক দেখতে যাবেন, এটা অবশ্য মনে মনে ছিল। পাণ্ডবেরা পাঞ্চালরাজ্যে পৌঁছবেন কি, রাস্তাতেই তাঁরা দেখতে পেলেন দলে দলে ব্রাহ্মণ-সজ্জনেরা চলেছেন দ্রুপদের রাজসভায়। পাণ্ডবেরা তখনও বাড়ি-ঘর বাসস্থান ঠিক করেননি কিছু। তখনও প্রচ্ছন্নচারী ব্রাহ্মণের বেশ। যুধিষ্ঠির কিছু শুধোবার আগেই ব্রাহ্মণেরা স্বজাতির ভ্রমে পাণ্ডবদের জিজ্ঞাসা করলেন—আপনারা আসছেন কোথেকে, যাবেনই বা কোথায়? পুরো পরিচয় পাবার আগেই ব্রাহ্মণেরা বললেন—চল সব দ্রুপদের রাজবাড়িতে, বিরাট উৎসব, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর। আমরা সবাই তো সেখানেই যাচ্ছি। নিষ্কিঞ্চন ব্রাহ্মণেরা দ্রৌপদীর চেহারার একটা লোভনীয় বর্ণনাও দিতে চাইলেন। তাঁরা বললেন—দারুণ দেখতে নাকি দ্রৌপদীকে। ‘দর্শনীয়া’, অনবদ্যাঙ্গী’, পদ্মের পাপড়ির মতো চোখ। এক ক্রোশ দূর থেকেও নাকি তাঁর গায়ের মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যায় (পাঠক! যোজনগন্ধা পদ্মগন্ধী সত্যবতীর সঙ্গে এখানেও দ্রৌপদীর মিল)। ব্রাহ্মণ বলে কথা, তাঁদের মুখে প্রত্যঙ্গ বর্ণনা কেমন শোনায়; তাই বুঝি অতি সংক্ষেপেও কোনও আড়ম্বরের মধ্যে না গিয়ে, অথচ সব কিছুই বুঝিয়ে দিয়ে ব্রাহ্মণেরা বললেন—দ্রৌপদী তনুমধ্যমা। অনবদ্য তার চেহারা, তার ওপরে সুকুমারী মনস্বিনী।’

না, ব্রাহ্মণেরা দ্রৌপদীকে পেতে চান না। তাঁরা ধূমধাম দেখবেন, রঙ্গ দেখবেন। উপরি পাওনা রাজার দান—টাকাপয়সা, গরু, ভোক্ষ্যং ভোজ্যঞ্চ সর্বশঃ। ব্রাহ্মণেরা বললেন—তোমরাও চল আমাদের সঙ্গে, মজা দেখে, দান নিয়ে ফিরে আসবে—এবং কৌতূহলং কৃত্বা দৃষ্ট্ৰা চ প্রতিগৃহ্য চ। চাই কি, তোমাদের পাঁচ ভাইয়ের এক ভাইকে কৃষ্ণা বরণও করতে পারে, কারণ তোমরা সবাই তো দেখতে বেশ সুন্দর। যুধিষ্ঠির বললেন—নিশ্চয়, নিশ্চয়, এই আমরা এলুম বলে।

এক কুমোরের ঘরে পাণ্ডবদের থাকার ব্যবস্থা হল। ভিক্ষা করে আর ব্রাহ্মণের বেশ ধরে পাণ্ডবেরা তাঁদের ছদ্ম ব্রাহ্মণ্য বজায় রাখছিলেন। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে রাজা-রাজড়ারা এবং ব্রাহ্মণেরা অনেক আগে থেকেই উপস্থিত হচ্ছিলেন। পাণ্ডবেরাও নিজেদের ব্যবস্থা করে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে উপস্থিত হলেন। সভা একেবারে গমগম করছে। দ্রুপদ মৎস্যচক্ষুর পণ সমবেত সবাইকে জানালেন এবং প্রায় ‘অলিম্‌পিয়ান’ কায়দায় স্বয়ম্বর ঘোষণা করলেন—স্বয়ম্বরম্‌ অঘোষয়ৎ। ঈশান কোণে বসলে নাকি কোনও কাজে পরাজয় হয় না, তাই রাজারা বসলেন সেদিকটায়, মঞ্চের ওপর সারি সারি। উত্তর দিকটায় সাধারণ লোকেরা। আর ঋষিব্রাহ্মণেরাও বসলেন তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায়।

বিবাহেঞ্চু রাজারা সব বসে আছেন এমনভাবে, যেন মনে হচ্ছে—এ বলে তুই আমায় দেখ, ও বলে তুই আমায় দেখ—স্পর্ধমানা স্তদান্যোন্যং নিষেদুঃ সর্বপার্থিবাঃ। জনতার মধ্যে তখন সাগরতরঙ্গের মতো অবিরাম কোলাহল। প্রত্যেকেই তখন ভাবছেন—কখন সেই দীপ্তিমতী সুন্দরী উদয় হবেন রাজসভায়, কখন কনে দেখব? এরই মধ্যে বাজনাবাদ্যি আরম্ভ হয়ে গেল। সালঙ্কারা দ্রৌপদী রাঙা কাপড় পরে সভায় উদয় হলেন। হাতে সোনার রঙের বরণমালা। কার গলায় মালা দেব, কে সেই বীরপুরুষ—এই চিন্তায় কিছুটা বা বিবশা—আপ্লুতাঙ্গী সুবসনা সুবাভরণভূষিতা। ব্রাহ্মণেরা আগুনে আহুতি দিয়ে স্বস্তিবাচন করলেন, এক লহমায় বাদ্যবাদন থেমে গেল—কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন কথা বলছেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন—এই ধনুক, ওই মীনচক্ষু লক্ষ্যস্থল, আর এই যে বাণগুলি। আপনাদের কাজ—ছিদ্রপথে ওই মৎস্যচক্ষু ভেদ করা। যিনিই এই কষ্টকর কাজটি করতে পারবেন তাঁরই গলায় মালা দেবেন আমার ভগিনী—দ্রৌপদী। কালিদাসের পার্বতীকে সকামে দেখে শিবের তিনটি চোখ যেমন যুগপৎ তাঁর অধরোষ্ঠে পড়েছিল, এখানে সমবেত রাজমণ্ডলীর আতুর চোখগুলিও তেমনি একসঙ্গে দ্রৌপদীর ওপরে গিয়ে পড়ল। প্রত্যেকেই এই ভাবনায় মশগুল যে, দ্রৌপদীকে আমিই জিতব—সঙ্কল্পজেনাভিপরিপ্লুতাঙ্গাঃ—এবং লক্ষ্যভেদ করার আগেই প্রত্যেকে ভাবতে লাগলেন—দ্রৌপদী আমারই—কৃষ্ণা মমেত্যব। আশ্চর্য! যে রাজারা অন্য সময় এক জোট, প্রাণের বন্ধু, তাঁরাও এখন অহংমম ভাবনায় সব আসন ছেড়ে উঠে পড়েছেন, একে অন্যকে গালাগালি দিচ্ছেন, যদিও তাঁদের চোখ, মন এবং রসভাব—সবই এক দ্রৌপদীর দিকে—কন্দর্পৰ্বাণাভি-নিপীড়িতাঙ্গা…কৃষ্ণাগতৈ-র্নেত্রমনঃস্বভাবৈঃ…দ্বেষং প্রচঃ সুহৃদো’পি তত্র।

কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন রাজাদের নাম ঘোষণা আরম্ভ করে দিয়েছেন আগেই—উদ্দেশ্য দ্রৌপদীকে কিঞ্চিৎ পরিচয় করিয়ে দেওয়া। ধৃষ্টদ্যুম্ন বললেন—ইনি দুর্যোধন, ইনি কর্ণ, ইনি জরাসন্ধ, ইনি কৃষ্ণ, ইনি শিশুপাল—আরও কত শত নাম, যার মধ্যে বাংলা দেশের রাজা পর্যন্ত আছেন। বস্তুত বিদর্ভ রাজনন্দিনী রুক্মিণীর পরে আর এমন কোনও স্বয়ম্বরসভা বসেনি, যার সঙ্গে তুলনা চলে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের। সেই সময়ে এই কৃষ্ণা দ্রৌপদীর রূপ-গুণের কথা ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। আমাদের ধারণা—ওই যে বলা হয়েছে দ্রৌপদীর গায়ের মিষ্টি গন্ধ এক ক্রোশ দূর থেকে পাওয়া যেত—এ-কথার আসল তাৎপর্য হল—দূরে দূরান্তরে এই কালো মেয়েটির রূপ-গুণের কথা লোকে জানত। আজ তাই এতগুলি রাজ-ভ্রমর এই কৃষ্ণা পদ্মিনীর মধুলোভে দ্রুপদের রাজসভায় গুনগুন করছে। খেয়াল করতে হবে একই বিবাহ-সভায় বরাত পরীক্ষা করতে মামা—ভাগ্নে-শল্য এবং পাণ্ডবেরা—উভয়েই এসেছেন। বাপ-বেটা—বিরাট এবং তাঁর ছেলে, জরাসন্ধ এবং তাঁর ছেলে—দুয়েই এসেছেন—যার কপালে দ্রৌপদী জোটে তারই লাভ।

আরম্ভ হল ধনুক ভোলা। কলিঙ্গ, বঙ্গ, পুন্ড্রু—সব গেল। জরাসন্ধ, শিশুপাল, শল্য—সব গেল। দূর্যোধন, অশ্বথামা—সব গেল। মহাভারতকার কেবলই এই মহারাজাদের নাম একটি একটি করে বলেন, আর বলেন—না, ইনিও হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছেন—জানুভ্যাম্ অগমন্‌মহীম। এত রাজার মাঝখানে মাত্র একটি দৃঢ় সঙ্কল্পিত মুখ ধনুকখানি তুলে তাতে বাণ লাগিয়ে লক্ষ্যভেদ করে ফেলেছিল আর কী! যাকে দেখে পাণ্ডবেরা পর্যন্ত ধরে নিয়েছিলেন—এই বুঝি লক্ষ্য-বিদ্ধ হল। তিনি কর্ণ, যাঁকে সমবেত সমস্ত রাজমণ্ডলীর সামনে দ্রৌপদী প্রত্যাখ্যান করে বললেন—সুতপুত্রের গলায় মালা দেব না আমি—নাহং বরয়ামি সূতম্। ইতিহাসকে যাঁরা নীচে থেকে দেখেন—History from below—তাঁদের, এই ঘটনাটা মনঃপুত হবে না। হবেই বা কেন—সমাজের পর্যায়ভুক্তিতে কর্ণ সুতপুত্র, কিন্তু স্বয়ম্বর সভায় তার কী? কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন তো প্রতিজ্ঞাই করেছিলেন—যিনিই লক্ষ্যভেদ করবেন, তিনিই পাবেন আমার ভগিনীকে, মিথ্যে বলছি না বাপু—তস্যাদ্য ভার্যা ভগিনী মমেয়ং কৃষ্ণা ভবিত্রী ন মৃষা বদামি। সমাজের উচ্চবর্ণে না জন্মানোর যন্ত্রণা কর্ণকে সাভিমানে সইতে হল শুধু সূর্যের দিকে একবার তাকিয়ে। কিন্তু মশাই! নারী স্বাধীনতা! সে ব্যাপারে কী বলবেন? সমাজের বিচারে স্ত্রীলোকের অবস্থা তো অতি করুণ ছিল বলে শুনি। কিন্তু বাপভায়ের প্রতিজ্ঞায় তুড়ি মেরে উন্মুক্ত সভার মধ্যে দ্রৌপদী যে নিজের পছন্দ-অপছন্দ পরিষ্কার জানালেন, তাতে কি এটাই প্রমাণ হয় না যে, সেকালের নারী সমাজের ওপর অত্যাচারের ইতিহাস একেবারে নিরঙ্কুশ বা সবাঙ্গীন হতে পারে না। অত্যাচার ছিল, এবং এখনও আছে। কিন্তু তারই মধ্যে কোথাও বা ছিল মুক্তির বাতাস, কোথাও বা স্ব-অধীনতাও।

দ্রৌপদীর এই প্রত্যাখ্যানের সঙ্গে কৃষ্ণপ্রেয়সী রুক্মিণীর এক ধরনের মিল আছে। রুক্মিণীর বাবা ভীষ্মক এবং ভাই রুক্মী সেকালের প্রবল পরাক্রান্ত রাজা শিশুপালের সঙ্গে রুক্মিণীর বিয়ে প্রায় পাকাই করে ফেলেছিলেন। রুক্মিণী তার শোধ নিয়েছেন একেবারে পালিয়ে গিয়ে, নিজের পছন্দে বিয়ে করে। দ্রৌপদীও বাপ-ভায়ের প্রতিজ্ঞার মর্যাদা রাখেননি এবং আপন স্বাধীনতার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর, দ্রুপদ-ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতিজ্ঞা এবং কর্ণকে প্রত্যাখ্যান—এ-সব কিছুর মধ্যেই একটা রহস্য আছে, যে রহস্য আগে বোঝা প্রয়োজন। একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে যে, সেকালের স্বয়ম্বর সভায় বীরবরণের ক্ষেত্রে কন্যার ইচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেলেও সব জায়গায় কন্যার ইচ্ছেই শেষ কথা ছিল না। রাজনীতির চাল ছিল। ছিল সামাজিক মান মর্যাদার প্রশ্নও। যেমন ধরুন রুক্মিণীর স্বয়ম্বরের আগেই যে তাঁর বাপ-ভাই শিশুপালকে রুক্মিণীর বর হিসেবে পছন্দ করেছিলেন—এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে, স্বয়ম্বর সভা অনেক সময় প্রহসনে পরিণত হত। অবশ্য রুক্মিণীর বাপ-ভাই যে শিশুপালকে মনস্থ করেছিলেন তার পিছনে রাজনৈতিক কারণ ছিল। কারণ ছিল—শিশুপালের পৃষ্ঠপোষক দুর্ধর্ষ জরাসন্ধকে সন্তুষ্ট রাখার। এ-প্রসঙ্গ অন্যত্র আলোচনা করেছি। এখানে শুধু এইটুকুই প্রয়োজন যে, রাজনৈতিক কারণে পিতা এবং ভ্রাতা অনেক সময়ই তাঁদের মতামত চাপিয়ে দিতেন স্বয়ম্বরা বধূটির ওপর। সৌভাগ্যের কথা, দ্রৌপদীর ক্ষেত্রে তাঁর বাপ ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর মতামতের মিল ছিল এবং সেই কারণেই—এবং এটা অবশ্যই রাজনৈতিক কারণ—দ্রৌপদীর কর্ণ-প্রত্যাখ্যান আমাদের কাছে অপ্রত্যাশিত মনে হয় না।

একটা জিনিস খেয়াল করুন। মহাভারতকার দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের পূর্বাহ্নেই জানিয়েছেন যে, দ্রুপদ রাজার ভারী ইচ্ছে ছিল যাতে পাণ্ডব অর্জুনের সঙ্গেই তাঁর মেয়ের বিয়ে হয়—যজ্ঞসেনস্য কামস্তু পাণ্ডবায় কিরীটিনে। কৃষ্ণাং দদ্যামিতি…। ব্যাস লিখেছেন, দ্রুপদ সবসময় মনে মনে এই ইচ্ছা পোষণ করেও বাইরে এ-কথা কখনও প্রকাশ করেননি। কিন্তু আমরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় এ-কথা জানি যে, অন্য কোথাও প্রকাশ না করলেও পিতার মনোগত ইচ্ছা বউ-ছেলে-মেয়ে ঠিকই জানতে পারে। আমাদের দৃঢ় ধারণা—দ্রৌপদী পিতার ইচ্ছে জানতেন। সৌভাগ্যবশত পিতার ইচ্ছের সঙ্গে দ্রৌপদীর ইচ্ছের মিল ছিল, এবং তার কারণও আছে। আমরা যে ঠিক কথা বলছি তার আরও দুটো কারণ আছে। প্রথমত বারণাবতের জতুগৃহে পাণ্ডবদের মৃত্যুর কথা যথেষ্ট চাউর হয়ে গেলেও দ্রুপদ সেকথা বিশ্বাস করতেন বলে মনে হয় না। বিশ্বাস করতেন না বলেই ব্যাস লিখেছেন যে, পাণ্ডব অর্জুনকে তিনি খুঁজছিলেন—সো’ন্বেষমাণঃ কৌন্তেয়ং—এবং প্রধানত তাঁর কথা মনে রেখেই তিনি স্বয়ম্বরের জন্য সেইরকম অসামান্য একখানি ধনুক তৈরি করিয়েছিলেন। তৈরি করিয়ে ছিলেন সেই রকম কৃত্রিম যন্ত্র যা কেউ ভেদ করতে না পারে। দ্রুপদ জানতেন—তাঁর মেয়ের স্বয়ম্বরে অংশ গ্রহণ করাটা মর্যাদার ব্যাপার—এবং তাঁর বিশ্বাস ছিল অর্জুন যদি কোথাও থাকেন, তাহলে এই বিরাট স্বয়ম্বর উৎসবে তিনি আসবেনই। দ্বিতীয়ত, খেয়াল করুন ধৃষ্টদ্যুম্নের কথা। পিতার ইচ্ছে তিনি নিশ্চয় জানতেন এবং অর্জুনের সমকক্ষ বীর যে একমাত্র কর্ণ—তাও তিনি জানতেন। ঠিক এই কারণেই তাঁর ভগিনী সম্প্রদানের প্রতিজ্ঞার মধ্যে একটু প্যাঁচ ছিল। ধৃষ্টদ্যুম্ন বলেছিলেন-মিথ্যে বলছি না বাপু, আমার ভগিনী তাঁরই ভার্যা হবেন, যিনি এই লক্ষ্যভেদের মতো মহৎ কর্মটি করবেন। তবে তিনি কেমনটি হবেন? যিনি নাকিকুলেন রূপেন বলেন যুক্তঃ—অর্থাৎ সেই মানুষটি, যাঁর বংশ-মর্যাদা, রূপ এবং বীরত্ব—সবই আছে। কাজেই যিনিই লক্ষ্যভেদ করবেন তিনিই আমার বোনের স্বামী হবেন—কুমার ধৃষ্টদ্যুম্নের এই প্রতিজ্ঞার মধ্যেও একটু কথার ফাঁক ছিল, এবং দ্ৰৌপদী যে সূতপুত্রকে মর্যাদার প্রশ্নে প্রত্যাখ্যান করলেন, তাতে আমরা তাই খুব একটা আশ্চর্য বোধ করি না। বিশেষত মহারাজ দ্রুপদ অর্জুনকে খুঁজছিলেন—এই নিরিখে, অপিচ ধৃষ্টদ্যুম্ন লক্ষ্যভেদের ক্ষমতার সঙ্গে লক্ষ্যভেত্তা পুরুষের কুলমর্যাদা এবং রূপও চাইছেন এই নিরিখে—আমরা তো ধারণা করি যে দ্রৌপদী কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য পূর্বাহ্নেই প্রস্তুত ছিলেন। এমন কী তাঁকে শেখানোও হয়ে থাকতে পারে যে কূটনৈতিক কারণে কর্ণকে স্বয়ম্বর-সভায় নেমন্তন্ন করতে হয়েছে বটে, কিন্তু দ্রৌপদীকে এ ব্যাপারটা সভাতেই সামলাতে হবে। দ্রৌপদী সামলে দিয়েছেন, এবং অর্জুন ছাড়া একমাত্র বীর যিনি এই লক্ষ্যভেদ করতে পারতেন, তিনি অসম্মানে বঞ্চিত হলেন।

যাক, বড় বড় বীরেরা যখন হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়লেন, তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন তখন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বসে হাতে সুড়সুড়ি দিচ্ছেন। তিনি আর থাকতে পারলেন না। বসে থাকা সমস্ত ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকে রমণীর বরমাল্যের আশায় হঠাৎ করে উঠে আসতে অর্জুনের সংকোচ হচ্ছিল নিশ্চয়ই। কাজেই তাঁদের কারও বা অস্বস্তি এবং কারও বা বিরক্তি জন্মিয়েই উঠে পড়লেন অর্জুন। ব্রাহ্মণদের মধ্যে এর এক অদ্ভুত মিশ্রক্রিয়া হল। কিছু উদ্যমী ব্রাহ্মণ একেবারে হইহই করে উঠলেন, তাঁরা তাঁদের পরনের অজিন খুলে রুমালের মতো উড়িয়ে—বিধুম্বন্তো’জিনানি চ—অর্জুনকে ‘চিয়ার আপ’ করতে থাকলেন। কিন্তু মধ্যপন্থী ব্রাহ্মণেরা, যাঁরা একটু বে-ভরসা গোছের, তাঁরা বলতে থাকলেন—কর্ণ শল্য রসাতলে গেল, আর এই দুবলা বামুন—প্রাণতো দুর্বলীয়সা—বেটা বলে কিনা ধনুক তুলব। সমস্ত রাজমণ্ডলের সামনে আজ বামুনদের মাথা হেঁট করে দেবে এই বিটলে ছেলেটা—অবহাস্যা ভবিষ্যন্তি ব্রাহ্মণাঃ সর্বরাজ। চিন্তিত ব্রাহ্মণেরা বললেন—ভাল চাও তো চেপে বসে পড় এখানে। অর্জুন থামলেন না দেখে, তাঁরা অন্যদের বললেন-প্রেমানন্দেই হোক, অহঙ্কার বশেই হোক কিংবা চপলতা বশে—ছেলেটা যে ধনুক বাঁকাতে যাচ্ছে ওকে বারণ করুন, যেন না যায়—বার্যতাং সাধু মা গমৎ।

এই যে কথাগুলি বললেন—এঁরা হলেন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বে-ভরসা দলের, মহাভারতকার যাঁদের বলেছেন—বিমনসঃ। কিন্তু অর্জুন উঠতে যাঁরা বেশ খুশি হলেন—মুদান্বিতাঃ—তাঁরা উদ্যমী হয়ে বললেন—মাথাও হেঁট হবে না, মানও খোয়াবে না। ছেলেটার চেহারা দেখেছ; হাতের গোছা আর কাঁধের গুলিগুলো দেখেছ? তার ওপরে ছেলেটার উৎসাহ দেখলে বোঝা যায় যে, এর সম্ভাবনা আছে। ক্ষ্যামতা না থাকলে কি আর এমনি এমনি উঠে গেল—ন হি অশক্তঃ স্বয়ং ব্রজেৎ। রোগা হলেও এই ব্রাহ্মণদের খুব মনের জোর আছে। এঁদের ধারণা বামুনের অসাধ্য কিছু নেই, হোক না বামুন ফলাহারী, উপোসী, ব্রতধারী। জল খায় আর হাওয়া খায় বলে—অব্‌ভক্ষা বায়ুভক্ষাশ্চ—তারা কি সব মরে গেছে নাকি, বামুন নিজের তেজেই বামুন।

ব্রাহ্মণবেশী অর্জুনের ঘাড়ে চেপে রোগা বামুনেরা যতক্ষণ মুখ এবং হস্তব্যায়াম করছিলেন, ততক্ষণে অর্জুন ধনুকের কাছে পৌঁছে গেছেন এবং দ্রুপদের যন্ত্র-লক্ষ্যও ভেদ করে দিয়েছেন। আর যায় কোথা, ক্ষত্রিয়দের লজ্জা দিয়ে ব্রাহ্মণেরা তাঁদের উতলা উত্তরীয়গুলি আকাশে বিজয়ধ্বজের মতো উড়িয়ে দিলেন। দেবতাদের মুগ্ধ পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে সুকুমারী দ্রৌপদী মধুর এক সমর্থনের হাসি হেসে—উৎস্ময়ন্তী—ব্রাহ্মণবেশীর গলায় সাদা ফুলের বরমাল্যখানি দুলিয়ে দিলেন। তখনও তিনি জানেন না—ইনিই তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন—গাণ্ডীবধন্বা। আমাদের ধারণা, বিবাহলগ্নে এই যে তিনি ব্রাহ্মণবোধে জীবনসঙ্গী বেছে নিলেন, এইখানেই তাঁর ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে। সারাজীবনই তাঁর কেটেছে বনবাসিনী ব্রাহ্মণ বধূর মতো। রাজোচিত সুখভোগ তাঁর কপালে জোটেনি, যাও জুটেছে তাও কণ্টকহীন নয়। বনবাস আর অজ্ঞাতবাসে তাঁর যৌবন শুধু ব্রাহ্মণ্যের আদর্শধুলিতে ধূসর। সাময়িকভাবে ভিক্ষাব্রতী ব্রাহ্মণবেশীরা কুটিরে ফিরে গিয়ে তাঁর বধূ-পরিচয় করিয়েছে ভিক্ষার পরিচয়ে। মহাভারতকার এই পরিচয় লগ্নটি লক্ষ করে বলেছেন—পাণ্ডবেরা যাজ্ঞসেনী দ্রৌপদীকে ভিক্ষা বলে পরিচয় দিলেন—ভিক্ষেতি অথাবেদয়তাম। পাণ্ডবেরা সারা জীবন এই ভিক্ষার ঝুলি বয়ে নিয়ে বেড়িয়েছেন, আর যিনি স্বয়ং ভিক্ষা তাঁর সঙ্গে অন্য পাঁচজন ব্যবহারও করেছেন ভিক্ষার মতো।

অথচ দ্রৌপদীর বিবাহলগ্নে ঘটনাগুলি এইরকম ছিল না। এই অসামান্য রমণীর বরমাল্য ভিক্ষার জন্য দূর দূরান্ত থেকে এসেছিলেন সেকালের সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজারা। ঠিক সেই অর্থে পাণ্ডবরা তখনও প্রতিষ্ঠিত নন, কারণ তাঁরা তখনও হস্তিনাপুরের সামান্য দাবিদার মাত্র, রাজা নন। তবে যদি সম্ভাবনার কথা ধরা যায়, তাহলে অবশ্যই বলতে হবে যে, ভীমার্জুনের শক্তিমত্তার কথা তখন সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে গিয়েছিল এবং এই সম্ভাবনাকে মূলধন করেই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দ্রুপদরাজার রাজনৈতিক বুদ্ধি পরিচালিত হয়েছিল। মনে রাখা দরকার যাঁর সঙ্গেই দ্রুপদ-কন্যা দ্রৌপদীর মেলবন্ধন ঘটবে তাঁর সঙ্গে পাঞ্চাল রাজ্যেরও সুসম্পর্ক হবে—এ তো জানা কথা। রাজনৈতিক অবস্থানে দ্রুপদের অবস্থা তখন ভাল নয়। তাঁর অর্ধেক রাজ্য পাণ্ডব-কৌরবের গুরুদক্ষিণার সময়েই দ্রোণের করগত! দ্রোণ কৌরবসভায় গুরুমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত এবং স্বয়ং পিতামহ ভীষ্ম তাঁকে উষ্ণ সম্মানে কুরুকুলের হিতাকাঙক্ষীর আসনে বসিয়ে দিয়েছেন। সেজন্য ভীষ্মের ওপরেও দ্রুপদের ক্ষোভ থাকতে পারে। অন্যদিকে পাণ্ডবেরা যে জ্ঞাতিদের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছেন এবং বারণাবতে তাঁদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টাও হয়েছিল—এ খবর দ্রুপদ রাখতেন। বস্তুত যে বালকবীর অর্জুন তাঁকে বেঁধে এনে দ্রোণাচার্যের কাছে দাঁড় করিয়েছিল, তার ওপরে দ্রুপদের রাগ ছিল না, রাগ ছিল দ্রোণের ওপরেই। কাজেই দ্রুপদ যে মনে মনে দ্রৌপদীকে অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, সেও কিন্তু আরেক প্রতিশোধ স্পৃহা—যে প্রতিশোধ-স্পৃহায় পূর্বে ধৃষ্টদ্যুম্নের জন্ম হয়েছে। খেয়াল করে দেখুন কুরুকুলের বর্ম-আটা দুই প্রধান পুরুষ মহারথ দ্রোণ এবং ভীষ্ম—এই দুজনেরই হন্তা কিন্তু দ্রুপদের ঘরেই জন্মেছে—একজন ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং অন্যজন শিখণ্ডী। একজন যদি দ্রোণবধের নিমিত্তমাত্র হয়ে থাকেন, তো ভীষ্মবধের নিমিত্তও শিখণ্ডী। দুজনকেই নিমিত্ত বলেছি এই কারণে যে, অর্জুন না থাকলে এই দুজনেরই বলবীর্য এমনকী শিখণ্ডীর ক্লীবত্বও বিফলে যেত। কাজেই দ্রোণাচার্যের আদেশ মাত্রে যে ছেলেটির হাতে দ্রুপদ বাঁধা পড়েছিলেন তাঁর সঙ্গে মেয়ের বিয়ে হলে যে রাজনৈতিক দিক দিয়ে দ্রুপদের সুবিধা ছিল, এ-কথা সবাই বোঝে।

আমাদের ধারণা, পাণ্ডবেরা যে বারণাবতে জতুগৃহদাহ থেকে কোনওক্রমে বেঁচে গেছেন, এ-কথা দ্রুপদ কোনও ভাবে শুনেছিলেন, না হলে ধনুক বানাবার আগে তিনি অর্জুনকে খুঁজবেন কেন—সো’ম্বেয়ানঃ কৌন্তেয়ম্‌। দ্বিতীয়ত, দ্রৌপদীর বিয়ের পর ধৃষ্টদ্যুম্ন পাণ্ডবদের কুমোরশালা থেকে লুকিয়ে সব জেনে এসে দ্রুপদকে বললেন—এঁরা নিশ্চয়ই ক্ষত্রিয়, শুধু তাই নয় এঁরাই পাণ্ডব। ধৃষ্টদ্যুম্ন এবার বললেন—পাণ্ডবেরা জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে ফিরেছেন—এই রকম একটা কথা শুনে আমরা যে আশান্বিত হয়েছিলাম—সে আশা আজ সম্পূর্ণ ফলবতী হল—আশা হি নো ব্যক্তমিয়ং সমৃদ্ধা মুক্তান্‌ হি পার্থান শৃণুমো’ গ্নিদাহাৎ। তাহলে পাণ্ডবেরা বেঁচে আছেন—এ রকম এক খবর রাজ্যে রাজ্যে ছিল, এবং হয়তো দ্রৌপদীর সয়ম্বর-সংঘটন এই কারণেই যে, পাণ্ডবেরা এমন খবর শুনে ঘরে বসে থাকবেন না। আর সত্যিই তো তাই। সেই কবে ব্যাসদেব জানিয়ে যাচ্ছেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর হবে, আর পাণ্ডবদের মনে নববধূর নিত্য আসা-যাওয়া ঘটছিল। সেই কবে ধৌম্য পুরোহিতকে তাঁরা বরণ করে নিলেন আর সঙ্গে সঙ্গেই পাণ্ডবদের মনে হল এবার ধৌম্যকে সঙ্গে নিয়ে দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর দেখতে যাব—মেনিরে সহিতা গন্তুং পাঞ্চাল্যাস্তং স্বয়ম্বরম্। এ যেন বরপক্ষের পুরোহিত ঠিক হয়েছে, আর পাণ্ডবেরা চললেন বধূ বরণ করতে।

দ্রুপদের মনে যেমন ধারণা ছিল যে, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সম্ভাবনা ঘটলে পাণ্ডবেরা আর কিছুতেই আত্মগোপন করে থাকতে পারবেন না, ঠিক এই ধারণাটা ছিল আরেকজন মানুষেরও—তিনি কৃষ্ণ। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর তাঁর কাছে রাজনৈতিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল, সে-কথা আমি অন্যত্র বিস্তারিত লিখেছি। এখানে শুধু এইটুকুই বলব যে, কংসকে হত্যা করার পর কৃষ্ণ এবং তাঁর যাদব-সেনার উপর জরাসন্ধের আক্রোশ অত্যন্ত বেড়ে গিয়েছিল, কারণ কংস ছিল জরাসন্ধের জামাই এবং জরাসন্ধ ছিলেন তাঁর কালের অবিসংবাদিত নেতা। হরিবংশে দেখা যাবে, জরাসন্ধের সৈন্যবাহিনীর পুচ্ছভাগে দুর্যোধন ইত্যাদি কৌরবরাও সামিল হয়েছেন কৃষ্ণের বিরুদ্ধে কোনও সমবেত আক্রমণে জরাসন্ধকে সাহায্য করার জন্য—দুর্যোধনাদয়শ্চৈব ধার্তরাষ্ট্রা মহাবলাঃ। অন্যদিকে উদীয়মান নেতা কৃষ্ণ একটু একটু করে জরাসন্ধের দিকে এগোচ্ছিলেন। কারণ, জরাসন্ধের বিনাশ না হলে যাদব-বৃষ্ণি-কুলের কোনও স্বস্তি ছিল না। কৃষ্ণ কৌরব-পাণ্ডবের জ্ঞাতিভেদের কথা জানতেন, বিশেষত পাণ্ডবদের সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সম্বন্ধসূত্র থাকায় তিনি চাইছিলেন হস্তিনাপুরে পাণ্ডবেরাও একটা শক্তি হয়ে দাঁড়ান। হরিবংশে দেখা যাচ্ছে—বারণাবতে পাণ্ডবদের পুড়ে মরার কথা শুনে কৃষ্ণ ছুটে এসেছিলেন সেখানে। যে কোনও কারণেই হোক, তাঁকে হঠাৎ করে দ্বারকায় ফিরে যেতে হল পাণ্ডবদের শ্রাদ্ধ-তর্পণ করেই, যেন ওইটাই তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, শ্রাদ্ধকল্পের পরেও তিনি সাত্যকিকে বলে গেলেন পাণ্ডবদের অস্থি-সঞ্চয় করতে কুল্যার্থে চাপি পানাং ন্যযোজয়ত সাত্যকিম্‌। স্পষ্টতই বোঝা যায় কৃষ্ণ যে ধরনের মানুষ তাতে যাচাই না করে হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেবার লোক তিনি নন। তা ছাড়া পাণ্ডবদের মৃত্যুর কথা তিনি বিশ্বাস করেননি। সাত্যকিকে অস্থি সঞ্চয় করতে বলা মানেই হল—হয় তুমি মৃত পাণ্ডবদের অস্থি সঞ্চয় করে দেখাও, নয়তো জীবিত পাণ্ডবদের পাত্তা লাগাও। মহামতি বিদুর পাণ্ডবদের লাক্ষাগৃহ-মুক্তির খবর শত চেষ্টাতেও চেপে রাখতে পারেননি। কানাঘুসা চলছিলই, এবং মহারাজ দ্রুপদ, কুমার ধৃষ্টদ্যুম্ন যেমন কানাঘুসাতেই সিদ্ধান্ত করেছিলেন যে পাণ্ডবেরা বেঁচে আছেন, সাত্যকিও নিশ্চয়ই এই কানাঘুসার খবর কৃষ্ণকে জানিয়ে থাকবেন। কৃষ্ণও তাই দ্রুপদের মতোই ধারণা করেছেন যে, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরের মতো ঘটনা ঘটলে পাণ্ডবেরা কিছুতেই আত্মগোপন করে থাকবেন না, তাঁদের দেখা যাবেই। কৃষ্ণের অনুমান পুরোটাই ঠিক। পাণ্ডবেরা এসেছিলেন। বিবাহসভা এবং ধনুর্বেধের হই-হট্টগোলের মধ্যেই ছাইচাপা আগুনের মতো ছদ্মবেশী পাণ্ডবদের কৃষ্ণ ঠিকই চিনেছিলেন—ভস্মাবৃতাঙ্গানিব হব্যবাহান্। চেনাটা তাঁর প্রয়োজনও ছিল। কারণ, পাঞ্চালের সঙ্গে পাণ্ডবদের মেলবন্ধন ঘটলে উভয়েই শক্তিশালী হবেন, এবং তাঁর প্রধান শত্রু জরাসন্ধের বিরুদ্ধে সে-জোট কাজে আসবে।

পাণ্ডবেরা কিন্তু কৃষ্ণ-বলরাম কাউকেই চিনতে পারেননি। কারণ এই নয় যে, ভিড়-ভাট্ট কোলাহল। যখন প্রথম দ্রৌপদী স্বয়ম্বর সভায় এলেন, সবাই তখন একযোগে, একদৃষ্টিতে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু কৃষ্ণ সেই অবস্থাতেই পাণ্ডবদের চিনে ফেলেছিলেন, দাদা বলরামকে চিনিয়েও দিয়েছিলেন। অথচ পাণ্ডবেরা স্বরূপে থাকা কৃষ্ণকেও চিনতে পারেননি। দ্রৌপদীর ভাই ধৃষ্টদ্যুম্ন বিভিন্ন রাজ-নাম কীর্তনের সময় কৃষ্ণ-বলরামের কথা বলেও ছিলেন। কিন্তু কে দেখে তাঁদের? কে দেখে রাজাদের? সবাই যেমন তখন দ্রৌপদীকেই দেখছিল, ঠোঁট কামড়াচ্ছিল, পাণ্ডবেরাও তখন প্রায় সেই কাজেই মত্ত ছিলেন। ব্যাসদেবকে তাই লিখতে হয়েছে—দ্রৌপদীকে দেখে পাণ্ডবেরা সবাই একেবারে কামমোহিত হয়ে পড়েছিলেন—তাং দ্রৌপদীং প্রেক্ষ্য তদা স্ম সর্বে কন্দর্পণাভিহতা বভূবুঃ। এই ফুলশরের আঘাতে মুর্হিত অবস্থা চলেছে একেবারে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত।

দ্রুপদ-সভার ঘটনাটা যখন পাণ্ডবেরা মাকে বলেন, তার মধ্যে রসিকতার ভাগই ছিল বেশি। কিন্তু কুন্তী যখন দেখলেন ভিক্ষা বলতে জলজ্যান্ত আগুনপানা এক সুন্দরী, তখন তিনি কী করেন? অন্যদিকে মায়ের ভিক্ষা-ভাগের আদেশ প্রত্যেক ভাইয়ের কাছেই এত ইচ্ছাপূরক ছিল যে, ততক্ষণ দ্রৌপদীকে নিয়ে প্রত্যেক ভাইয়েরই স্বপ্ন দেখা শুরু হয়ে গেছে; মনে মনে পাঁচ ভাই-ই নিশ্চয় খুশি। যুধিষ্ঠির অবশ্য বললেন যে, সুন্দরী কৃষ্ণাকে বিয়ে করার প্রথম হক অর্জুনের, কারণ দ্রুপদের পণ জিতেছেন তিনিই। কিন্তু অর্জুন বীরোচিত ভদ্রতায় যুধিষ্ঠির অথবা ভীমকেই প্রথম সুযোগ দিতে চাইলেন, কারণ তাঁরা বড় ভাই। ঠিক এই মুহূর্তটা ছিল কিন্তু ভীষণ করুণ। পাঁচ পাঁচজন যুদ্ধবীরের চোখ তখন কৃষ্ণা পাঞ্চালীর দিকে। প্রত্যেকে একবার দ্রৌপদীর দিকে তাকান, আরেকবার ভাইদের দিকে। সবার হৃদয়ে তখন সুন্দরী কৃষ্ণা, পৃঞ্চবীর পাণ্ডবেরা তাঁকে হৃদয়ে ধারণ করেছেন—হৃদয়ৈস্তামধারয়ন্‌। মনে মনে বোধ হয় এঁদের একটু ভয়ও ছিল। যে রমণী উন্মুক্ত রাজসভায় সূতপুত্র কর্ণকে অত্যন্ত কটুভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, তিনি যদি এখন বলে বসেন—আমাকে যিনি জিতে এনেছেন, আমি তাকেই চাই, তা হলে কী হবে! পাণ্ডবদের ভাগ্য ভাল, দ্রৌপদী সে-কথা বলেননি। বরঞ্চ পাঁচ ভাইয়ের টেরা চোখের চাউনিতে এবং অর্জুনের বদান্যতায় দ্রৌপদী তখন ক্ষণিক বিব্রত। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন—অর্জুনের উপরোধে এখন যদি জ্যেষ্ঠটির, মানে, ওই ধর্মমাকা যুধিষ্ঠিরের গলায় মালা দিতে হয়, তার চেয়ে একদমে পাঁচজনকে সামলানো অনেক ভাল—অন্তত তার মধ্যে তো অৰ্জুন থাকবেন। সেই অর্জুন, যিনি তাঁর যুবতী হৃদয়ের প্রথম অতিথি, সেই অর্জুন যিনি সবার মধ্যে সবলে জিতে এনেছেন তাঁকে।

যুধিষ্ঠির এতক্ষণ ভাইদের মুগ্ধ চোখগুলি আর মদনাহত চেহারা লক্ষ করে যাচ্ছিলেন। এইবার তাঁর মহর্ষি দ্বৈপায়নের কথা মনে পড়ল। ঋষি না বলেছিলেন—তোমাদের পাঁচজনের স্ত্রী হবেন দ্রৌপদী, এইটাই বিধাতার বিধান—নির্দিষ্ট ভবতাং পত্নী কৃষ্ণা পাত্যনিন্দিতা। কিন্তু কেন এমনটি বলেছিলেন ঋষি—সেকথা পৌরাণিকের দিক থেকে একরকম, যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে অন্যরকম। পৌরাণিক দার্শনিকেরা পোড়ো বাড়ির দরজা আর খ্যাপা হাওয়াকে এমনভাবে মেলান যে, পাঠকের মনে হবে খ্যাপা হাওয়ার জন্যেই বুঝি বা বাড়িটার অমন পড়-পড় অবস্থা। এর অভিশাপ, তার তপস্যা, অমুকের পূর্ব জন্মের সামান্য ঘটনা—সব পুরাণকারেরা মিলিয়ে দেন, এবং কপাল ভাল থাকলে দার্শনিকের সায়-সম্মতিও জুটে যায় তাতে। দ্রৌপদীর বেলাতেও তা জুটেছে। কেমন করে জুটেছে, তার আগে ব্যাসের অনুভবে দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের গল্পটা শোনাই, তারপর দর্শন।

ব্যাস দ্রৌপদীর বিয়ের অনেক আগে পাণ্ডবদের বলেছিলেন যে, পূর্বজন্মে দ্রৌপদী ছিলেন এক ঋষির কন্যা। পরমা রূপবতী; এমনকী এই ঋষিকন্যা সোজা হয়ে দাঁড়ালে তার কোমরের মাঝখানটা যে কোথায় সেঁটে থাকে তা বোঝাই যায় না—বিলগ্নমধ্যা সুশ্রোণী সুভ্রঃ সর্বগুণান্বিতা। এ হেন সুন্দরী মেয়েরও দুর্ভাগ্য হল স্বকৃত কর্মদোষ, যাতে তার বিয়েই হল না, জুটল না মনোমত বর। সে তখন তপস্যা আরম্ভ করল ভগবান শংকরের। তুষ্ট ভগবান বর দিতে চাইলে কন্যা সর্বগুণে গুণী এক পতি চাইলেন। পাছে ভোলেভালা শিব কন্যার আকাঙ্ক্ষা না বোঝেন, তাই সে বারবার ইচ্ছেটি পরিষ্কার করে জানাল। কিন্তু ঈশ্বর, বিশেষত বরদ ঈশ্বরের কাছে বৃথা কথা চলে না। যা বক্তব্য যা ঈপ্সিত তা একেবারেই স্পষ্ট করে তাঁকে জানাতে হয়। অতএব শিব বললেন—তুমি যেহেতু পাঁচবার স্বামী চেয়ে বর মেগেছ, তাই তোমার বরও হবে পাঁচটা। পূর্বজন্মের ঋষিকন্যা এতদিন বিয়ে না করে থাকার ক্ষোভেই যেন বিনা বাক্যব্যয়ে, বিনা আপত্তিতে পঞ্চস্বামী-সম্ভোগের কথা মেনে নিয়ে বললেন—এবম্ ইচ্ছামি—তাই তোক প্রভু, তোমার দয়ায় তাই হোক—এবমিচ্ছাম্যহং দেব ত্বৎপ্রসাদাৎ পতিং প্রভো।

এই যে দ্রৌপদীর পূর্বজন্মে পাঁচবার বর চেয়ে পাঁচ স্বামী লাভ করার ঘটনা ঘটল, তাতে এক মহা সমস্যা হয়েছে দার্শনিকদের। অবশ্য তাঁদের আসল সমস্যাটা আরও গভীরতর। তাঁরা বললেন—যজ্ঞাদির বিনিয়োগে এমন কথা তো পাওয়া যায় যে, ‘সমিধ যজন করছে’, ‘তনুনপাত যজন করছে’—সমিধো যজতি, তনুনপাত্‌ যজতি। এক্ষেত্রে ‘যজতি’ অর্থাৎ যজন করার ব্যাপারটা কি আলাদা আলাদা পাঁচবার বোঝাবে, নাকি একবার? মীমাংসক দার্শনিকেরা কিন্তু বেদের বিনিয়োগমন্ত্রগুলিতে বেশির ভাগ সময়েই আক্ষরিক অর্থে ধরেন এবং সেই নিরিখেই তাঁরা বললেন—যজন করার ব্যাপারটা যখন পাঁচবার উচ্চারণ করা হয়েছে, তখন ওই যজ্ঞের ভাবনা কিংবা যজ্ঞীয় কর্মে ভেদ একটা স্বীকার করতেই হবে। অর্থাৎ একের মধ্যেও একটা বিভিন্নতা আছে। এই প্রসঙ্গে এঁরা ‘পঞ্চেন্দ্রোপাখ্যান’ বলে একটি পুরাকাহিনী স্মরণ করেছেন। কাহিনীটি আর কিছুই নয়, সেই তপস্যা করতে করতে বুড়ো হয়ে যাওয়া দ্রৌপদীর কাহিনী। দার্শনিকদের মতে এখানে দেবতা একটাই, এবং তিনি হলেন প্রধান দেবতা ইন্দ্র।

বেদের কাহিনীতে ত্বষ্টার ছেলেকে বধ করার সময় ইন্দ্রের তেজ ধর্মের মধ্যে প্রবেশ করেছিল, বল প্রবেশ করেছিল বায়ুতে আর তাঁর রূপ প্রবেশ করেছিল দুই অশ্বিনীকুমারের মধ্যে। অর্ধেকটা অবশ্য ইন্দ্রের নিজের মধ্যেই ছিল। অতএব একই ইন্দ্রের ধর্মাংশ কুন্তীর গর্ভে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের জন্ম দিলেন। বল স্বরূপ বায়ু-অংশ মহাবলী ভীমের জন্ম দিলেন। অশ্বিনীকুমার-দ্বয় মাদ্রীর গর্ভে জন্ম দিলেন নকুল আর সহদেবকে। এঁরা দুজনেই ইন্দ্রের রূপ-স্বরূপ অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের সন্তান বলে অত্যন্ত রূপান বলে পরিচিত। ইন্দ্র স্বয়ং তাঁর আপন অপ্রতিম অর্ধ দিয়ে কুন্তীর গর্ভে অর্জুনের জন্ম দিলেন। তা হলে এই পাঁচজনই ইন্দ্রের অবয়ব এবং ইন্দ্র থেকেই জন্মলাভ করায় এক এবং অদ্বিতীয় ইন্দ্রই এঁদের মূল জন্মদাতা—পঞ্চাপীন্দ্রাবয়ব-প্রকৃতিত্বাদ্‌ ইন্দ্রা এবেতি পঞ্চেন্দ্রোপাখ্যানে।

দার্শনিকের এই উদার দৃষ্টিতে অবশ্য দ্রৌপদীর ওপর অসতীত্বের সেই চিরন্তন আরোপ অনেকটাই কমে যায়। এমনকী অর্জুনের লক্ষ্যভেদও অনেক বেশি সযৌক্তিক হয়ে ওঠে এই সুবাদে, কারণ ইন্দ্রের অধাংশই রয়েছে অর্জুনের মধ্যে। কিন্তু দ্রৌপদীর ওপর অসতীত্বের আরোপ যতই কমুক, পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে ভাগ হয়ে ইন্দ্র যদি একাও জন্মে থাকেন, তবু বাস্তবে তাঁর ওই পঞ্চ-অবয়ব-বিশিষ্ট পঞ্চপাণ্ডব ভ্রাতারা কিন্তু কেউই নিজের নিজের অধিকার ছাড়েননি। কাজেই দ্রৌপদীকে বিয়ে করার জন্য যুধিষ্ঠিরের প্রস্তাব অর্জুন যেই প্রত্যাখ্যান করলেন, যেই অর্জুন বললেন অগ্রজদের অনুক্রম নষ্ট করে এখনই তাঁর বিয়ে করা সাজে না; সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু পাঁচ ভাই পাণ্ডবেরা প্রত্যেকে অনিমিখে দেখছিলেন দ্রৌপদীকে—দৃষ্টিং নিবেশয়ামাসুঃ পাঞ্চাল্যাং পাণ্ডুনন্দনাঃ। প্রত্যেকেই একবার চকিতে তাকিয়ে-থাকা দ্রৌপদীকে দেখেন, আরেকবার অন্যভাইদের দেখেন। হ্যাঁ, দ্বৈপায়ন ঋষির বিধান—পাঁচ জনেরই স্ত্রী হবেন দ্রৌপদী—এই অনুজ্ঞা যুধিষ্ঠিরের মনে পড়ল বটে, কিন্তু ভাইদের ভাবগতিক এবং তাঁদের মুখের চেহারায় তাৎক্ষণিক পরিবর্তনই যুধিষ্ঠিরের কাছে বড় হয়ে দেখা দিল—তেষাম্‌ আকারভাবঃ কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। ব্যাসের বচনের থেকেও তাঁর বেশি মনে হল—যদি শেষে সুন্দরী কৃষ্ণার কারণে ভাইতে ভাইতে বিবাদ লাগে! যুধিষ্ঠির ভাইদের মুখগুলি দেখে বুঝলেন—ভাইদের একজনও যদি কৃষ্ণার সঙ্গসুখ থেকে বঞ্চিত হন, তা হলে তাঁদের মনে জন্মাবে সেই অর্ন্তদাহ, যা তাঁদের পাঁচ ভায়ের একজোট ভেঙে দেবে। অতএব ভাই-ভাই ঝগড়া হওয়ার চেয়ে—মিথো ভেদভয়ান্নৃপঃ—যুধিষ্ঠির মায়ের প্রস্তাবই মেনে নিলেন। ঠিক হল পাঁচজনেরই ঘরণী হবেন দ্রৌপদী। অবশ্য প্রথম বাধাটা এল মহারাজ দ্রুপদের দিক থেকেই।

অজ্ঞাতকুলশীল জামাতার খোঁজ ভাঁজ করার জন্যে দ্রুপদরাজা ধৃষ্টদ্যুম্নকে পাঠিয়েছেন। তাঁর কাছে খবর পেয়ে আনুষ্ঠানিক বিবাহপর্বের জন্য তাঞ্জামও পাঠিয়েছেন। সবাই যখন দ্রুপদসভায় উপস্থিত তখন দ্রুপদ বললেন—তা হলে অর্জুন এবার কৃষ্ণার পাণিগ্রহণ করুন। যুধিষ্ঠির বললেন—মহারাজ। আমারও যে একটা সম্বন্ধ ঠিক করতে হয়, আমি সবার বড়। দ্রুপদ থতমত খেয়ে, তা তো বটেই, তা তো বটেই—এমনি একটা ভাবে যুধিষ্ঠিরের ইঙ্গিত বুঝে বললেন—তা হলে আপনিই কৃষ্ণার পাণিগ্রহণ করুন, কিংবা আপনাদের মধ্যে অন্য কেউ…। যুধিষ্ঠির বললেন—কৃষ্ণা আমাদের সবারই ঘরণী হবে। বিশেষত অর্জুন এই মহারত্ন জয় করেছে, আমরা ঠিক করেছি আমরা সবাই এই রত্নের অংশীদার হব—এষ নং সময়ো রাজন্ রত্নস্য সহ ভোজনম্। দ্রুপদ আকাশ থেকে পড়লেন। আরক্ত মুখে বললেন—এক পুরুষের অনেক বউ থাকে শুনেছি, কিন্তু এক বউয়ের অনেক স্বামী—অসম্ভব। এ তোমার কেমন বুদ্ধি বাপু? ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রুপদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে বললেন—এরকমটি হলে ছোট ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে বড় ভাই—যবীয়সঃ কথং ভ্রাতুঃ জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা..উঃ আমি আর ভাবতে পারছি না। ঠিক এই সময়ে রাজভবনে উপস্থিত হলেন ব্যাস। তিনি পুরা-কাহিনী শোনালেন। পাণ্ডবদের অলৌকিক জন্মবৃত্তান্ত প্রকট করলেন। জানালেন দ্রৌপদীর পূর্বজন্ম-কথাও। দ্রৌপদী নাকি পূর্বজন্মে ছিলেন এক ঋষির কন্যা—রূপবতী, পতিপ্রার্থিনী। তিনি তপস্যায় শিবকে তুষ্ট করে পাঁচবার একই কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন, ঠাকুর আমাকে মনের মতো বর দিন। যেহেতু পাঁচবার, অতএব শিব বললেন তোমার পাঁচটা স্বামী হবে। ব্যাস বললেন—শিবের সেই কথা আজ ফলতে চলেছে। ভগবান শংকর, মহামতি ব্যাস—এঁদের ওপরে আর কথা চলে না। শুভলগ্নে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে পাঁচ-সাতে পঁয়ত্রিশ পাকে বাঁধা পড়লেন অনিন্দ্যসুন্দরী দ্রৌপদী।

কুমারিল ভট্ট, যিনি ষষ্ঠ কিংবা সপ্তম খ্রিস্টাব্দের ধুরন্ধর মীমাংসক পণ্ডিত বলে পরিচিত, তিনি তাঁর তন্ত্রবার্তিকে কতগুলি প্রশ্ন তুলেছেন। ক্ষেত্র বিশেষে মহাত্মা পুরুষদের আপন আত্মতুষ্টিও ধর্মবিষয়ে কোনও প্রমাণ হতে পারে কি না, এই নিয়ে কথা হচ্ছিল। সেই প্রসঙ্গে অনেকের সঙ্গে পাণ্ডবদের পাঁচ ভাইয়ের এক বউ দ্রৌপদীর কথা উঠেছে। পাঁচ ভাইকে পর্যায়ক্রমে সেবা করলে, দ্রৌপদী যে স্বৈরিণী বলে পরিচিত হতে পারেন এ প্রশ্ন তো দ্রৌপদীর বাপ-ভাইও তুলেছিলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বারবার সেখানে বলেছেন—আমরা পাঁচজনে বিয়ে করব, এইটাই ধর্ম—এষ ধর্মো ধ্রুবো রাজন্। ব্যাসের সামনেও যুধিষ্ঠির রীতিমতো আস্থা নিয়ে বলছেন—আমার কথা মিথ্যে হতে পারে না। তাই এখানে অধর্ম থাকতেই পারে না—বৰ্ততে হি মনো মে’ত্র নৈষো’ধর্মঃ কথঞ্চন। বোধ করি ধর্মময় যুধিষ্ঠিরের এই আত্মতুষ্টির প্রমাণ দেবার জন্যই কুমারিল তন্ত্রবার্তিকে দ্রৌপদীর কথা তুলেছেন। কিন্তু ঠিক এই কথাটা তোলার সময় আত্মতুষ্টির প্রসঙ্গ গেছে হারিয়ে। কুমারিল সরাসরি প্রশ্ন তুলে বলেছেন—পঞ্চ পাণ্ডবের এক বউ—কথাটা বিরুদ্ধ লাগতে পারে, কিন্তু স্বয়ং দ্বৈপায়ন তো সেকথা পরিষ্কার বুঝিয়েই দিয়েছেন। অর্থাৎ কিনা কুমারিল যুধিষ্ঠিরের আত্মতুষ্টির প্রামাণিকতা বাদ দিয়ে। দ্রৌপদীর জন্যে দৈববাদকেই প্রাধান্য দিলেন বেশি। তাঁর মতে যেখানে স্বয়ং দ্বৈপায়ন ‘বেদিমধ্যাৎ সমুত্থিতা দ্রৌপদীর মাহাত্ম্য খ্যাপন করেছেন, তিনি তো আর সাধারণ মানবী নন যে স্বৈরিণীর প্রসঙ্গ আসবে। তিনি স্বয়ং লক্ষ্মীরূপিণী এবং লক্ষ্মী যদি অনেকের দ্বারা ভুক্তা হন, তা হলে দোষও হয় না—সা চ শ্রীঃ শ্রীশ্চ ভূয়োভি-র্ভুজ্যমানা ন দৃষ্যতি।

আমরা আজকের দিনে দুষ্টুমি করে ভট্ট কুমারিলকে বলতে পারতাম-মহাশয়! তা হলে লক্ষ্মীস্বরূপিণী সীতা রাবণের দ্বারা দু’-একবার ভুক্তা হলে কী ক্ষতি হত, কিংবা লক্ষ্মী রুক্মিণী শিশুপালের অঙ্কশায়িনী হলেই বা কী ক্ষতি হত? তার ওপরে লক্ষ্মীর ভাগ স্বয়ং বিষ্ণুর। পাণ্ডবেরা কেউ তো তাঁর তেজে জন্মাননি? যা হোক, আপাত এইসব বিটকেল প্রশ্ন আমরা ভট্ট কুমারিলকে করতে চাই না, কারণ তিনি আমাদের দারুণ একটি খবর দিয়েছেন। কুমারিল মহাভারতের প্রমাণে জানিয়েছেন যে, সুমধ্যম দ্রৌপদী প্রত্যেক পতিসঙ্গমের পরই আবার কুমারী হয়ে যেতেন—মহানুভবা কিল সা সুমধ্যমা বড়ব কন্যৈব গতে গতে’হনি। পাঠক! আবার আপনি দ্রৌপদীর বৃদ্ধা দিদিশাশুড়ি সত্যবর্তীর সঙ্গে দ্রৌপদীর মিল খুঁজে পেলেন। মহর্ষি পরাশরের সঙ্গে সঙ্গম হওয়ার পর সত্যবতী আবার তাঁর কুমারীত্ব লাভ করেছিলেন এবং তা পরাশরের বরে। দ্রৌপদীর কাহিনী কিন্তু আরও সাংঘাতিক, তিনি প্রতি সঙ্গমের পরেই কুমারীত্ব ফিরে পেতেন। আগেই যে শ্লোকটি উদ্ধার করেছি সেটি কিন্তু ভট্ট কুমারিলের লেখা। তন্ত্রবার্তিকের এই শ্লোকের সূত্র ধরেই মূল মহাভারতীয় শ্লোকটি তন্ত্রবার্তিকের টীকাকার সোমেশ্বর ভট্ট তাঁর ন্যায়সুধায় উদ্ধার করেছেন। এই শ্লোকটি আছে। সেইখানেই, যেখানে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর বৈদিক রীতিতে প্রথামাফিক বিয়ে হল।

ভগবান শংকর বলেছেন—তুমি পাঁচবার যেহেতু একই কথা বলেছ, অতএব তোমার স্বামী হবে পাঁচটি। কিন্তু যিনি পরজন্মে পঞ্চপতির মনোহারিণী হবেন, তাঁর বিদগ্ধতা, তাঁর বাস্তব-বোধই কি কম হবে! পূর্বজন্মের ঋষিকন্যা দ্রৌপদী বললেন—হোক আমার পাঁচটা বর, তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু তা হলে এই বরও দিতে হবে যে, প্রত্যেক স্বামী-সহবাসের পরই কুমারীত্ব লাভ করব আমি—কৌমারমেব তৎ সর্বং সঙ্গমে সঙ্গমে ভবেৎ। বারংবার এই কুমারীত্বলাভের মধ্যেই দ্রৌপদীর দৈবসত্তার সন্ধান পেয়েছেন দার্শনিক কুমারিল। তাঁর ধারণা, প্রধানত দ্রৌপদীর এই অমনুষ্যসুলভ কুমারীত্বের ভরসাতেই কৃষ্ণ কর্ণকে প্রলোভন দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই যখন উদ্যোগপর্বে কৃষ্ণের দৃতীয়ালি বিফল হল, তখন কৃষ্ণ ভাবলেন অন্তত কুরুপক্ষপাতী কর্ণকে যদি পাণ্ডবপক্ষে টেনে নেওয়া যায়, তা হলেও খানিকটা সাফল্য আসে তাঁর অনুকূলে। কৃষ্ণ কর্ণকে তাঁর আসল জন্মরহস্য শোনালেন, এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতা হিসেবে তাঁর রাজসিংহাসন প্রাপ্তির যোগ্যতাও ঘোষণা করলেন। কিন্তু টোপ হিসেবে কৃষ্ণ যাকে ব্যবহার করলেন, তিনি কিন্তু দ্রৌপদী। কৃষ্ণ বললেন—যুধিষ্ঠির তোমার মাথায় সাদা চামর দোলাবেন, ভীম ছাতা ধরে বসে থাকবেন, আর অনিন্দিতা দ্রৌপদী! ছ’ বারের বার যথাকালে দ্রৌপদী উপনীত হবেন তোমার শয্যায়—ষষ্ঠে ত্বাং চ তথা কালে দ্রৌপদ্মপগমিষ্যতি।

ভট্ট কুমারিল বলেছেন—মানুষের মধ্যে এই ধরনের কুমারীত্ব লাভ মোটেই সম্ভব নয় এবং দ্রৌপদীর এই কুমারীত্বের প্রামাণিকতা আছে বলেই কৃষ্ণ কর্ণকে প্রলোভিত করতে চেয়েছেন—অতএব বাসুদেবেন কর্ণ উক্তঃ…ইতরথা হি কথং প্রমাণভূতঃ সন্ এবং বদেৎ। বস্তুত দ্রৌপদীর এই প্রাত্যহিক কুমারীত্ব নিয়ে ভট্ট মহোদয়দের যতই মাথাব্যথা থাকুক না কেন, আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই, এমনকী খোদ পৃঞ্চপাণ্ডবেরও কোনও মাথাব্যথা ছিল বলে মনে হয় না। তাঁরা দ্রৌপদীর অসামান্য রূপে মুগ্ধ মিসেন, গুণে বশীভূত এবং বিদগ্ধতায় গর্বিত। এবং সেই মুগ্ধতা এমনই যে, রসিক সুজন মাত্রেরই চোখে পড়বে, যেমন পড়েছিল নারদমুনির। পাণ্ডবদের ভাবগতিক দেখেই বুঝি তিনি তিলোর জন্য সুন্দ-উপসুন্দের লড়াই সবিস্তারে বর্ণনা করেছিলেন, এই দুই ভাইয়ের এত ভাব অথচ শু: তলোত্তমার রূপে মত্ত হয়ে তাদের ভাব-ভালবাসা সব চলে গেল—তস্যা রূপেণ সন্মত্তৌ বিগতহসৌহৃদৌ। কাজেই তোমরা যদি নিজেদের ভাল চাও, দ্রৌপদীর জন্য যাতে ভাই-ভাইয়ের ঝগড়া-ঝাঁটি না হয়—যথা বোনাত্র ভেদঃ স্যাৎ সর্বেষাং দ্রৌপদীকৃতে, সেজন্য যা হোক একটা ব্যবস্থা কর। পঞ্চপাণ্ডব নারদের সামনেই প্রতিজ্ঞা করলেন—যে ভাই দ্রৌপদীর সঙ্গে থাকবে, তখন অন্য কোনও ভাই তার ধার মাড়াবে না। যদি অমন ঘটনা হয়েই যায়, তবে তাকে বারো বছরের জন্য বনে যেতে হবে। তাই সই, সহবাসের সময়সীমাও বেঁধে দেওয়া হল।

অপরূপা দ্রৌপদীকে যিনি প্রথম প্রেম নিবেদন করার সুযোগ পেলেন তিনি হলেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির। এটি দ্রৌপদীর দুর্ভাগ্য না যুধিষ্ঠিরের সৌভাগ্য—সে আলোচনায় না গিয়েও বলতে পারি, যুধিষ্ঠির, মানে যিনি মহা যুদ্ধকালেও স্থির থাকতে পারেন, তিনি আর কত উতলা হয়ে রমণীর কাছে প্রেম নিবেদন করতে পারেন। বরঞ্চ যিনি তাঁকে লক্ষ্যভেদ করে জিতেছিলেন, যাঁর গলায় তিনি প্রথম বরমাল্য পরিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর সময়-সুযোগ আসার আগেই তাঁকে হারাতে হল। আমি বলি, যে ঘরে যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সঙ্গে বসে আছেন, সে ঘরে অস্ত্র রাখা কেন। তুমি ক্ষত্রিয় মানুষ, ক্ষত থেকে ত্রাণ করাই তোমার ধর্ম, আর সেই ধর্ম রক্ষার জন্য যখন তখন অস্ত্রের প্রয়োজন হতেই পারে। যেমন দরকার হলও। গরিব ব্রাহ্মণের গরু চুরি গেছে, অর্জুনকে এখন তীর-ধনুক নিয়ে চোর তাড়া করতে হবে। এখন উপায়? অস্ত্রাগারে যুধিষ্ঠির এবং দ্ৰৌপদী। এতকাল আমাদের এই ধারণাই ছিল যে, অস্ত্রাগারেই এই নবদম্পতীর আস্তানা ছিল। কিন্তু তা মোটেই নয়। মানুষটি তো যুধিষ্ঠির, তিনি দ্রৌপদীকে একান্তে পাওয়ার জন্য খাণ্ডবপ্রস্থে আর এক খণ্ড জমিও খুঁজে পাননি। বাগান, বনস্থলীর কথা ছেড়েই দিলাম। তিনি সেঁধিয়েছেন গিয়ে নির্জন অস্ত্রাগারে। অর্জুনের সে কী দোটানা অবস্থা। তিনি ভাবছেন—দাদা যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীর সঙ্গে আছেন অস্ত্রাগারে, আর একদিকে ব্রাহ্মণ রক্ষা বিধানের দায়ে পাণ্ডবদের সাহায্য চাইছেন। পরিত্রাতার ভূমিকাই অর্জুনের কাছে বড় হল। তিনি অস্ত্রাগারে ঢুকলেন, ব্রাহ্মণের সম্পত্তি উদ্ধার করলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই বনবাসের অনুমতি চাইলেন অগ্রজের কাছে।

যুধিষ্ঠির বললেন—ছোটভাই দাদার ঘরে ঢুকেছে, তো কী হয়েছে? যদি বড়ভাই ছোটভাইয়ের ঘরে ঢোকে সেইটাই অন্যায়, তুমি বনে যেয়ো না—নিবর্ত্তস্ব মহাবাহো। অর্জুন মানলেন না, বনে চলে গেলেন। আর যাই হোক, ধর্মের সঙ্গে তো আর ছলনা চলে না। সময় না আসতেই দ্রৌপদীর কামনার ধন বনে চলে গেলেন।

একথা ঠিক যে পাঁচ স্বামীর সুবাদে দ্রৌপদী এক থেকে চার ভায়ের বউদি হতেন, আবার কখনও ভাদ্দর বউ। তবে এই ত্রিমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে তাঁর মনে কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল না। ব্যাস লিখেছেন—স্নিগ্ধ বনস্থলীর মধ্যে যেমন অনেকগুলি হাতি একসঙ্গে থাকে তেমনি পঞ্চ স্বামীকে পেয়ে দ্রৌপদী গজদর্পিতা বনস্থলীর মতো অন্যের অধরা হয়েছিলেন। পাণ্ডবরাও তাঁর মধ্যে পেয়েছিলেন বনস্থলীর ছায়া। ব্যাস উপমাটি দিয়েছেন ভারি সুন্দর—নাগৈরিব সরস্বতী। ‘সরস্বতী’ মানে নীলকণ্ঠ লিখেছেন ‘বহু সরোবরযুক্ত বনস্থলী’।