কুন্তী – ৮

মুক্ত হতে চাইলেই কি আর মুক্ত হওয়া যায়? কুন্তী বলেছিলেন—বাপের বাড়ির লোকের কাছেও আমি সুখ পাইনি, শ্বশুরবাড়ির লোকের কাছেও নয়। স্বামী চলে গেলেন অকালে। ভাশুর আপন পুত্রস্নেহে অন্ধ। বারণাবতের আগুন থেকে বেঁচে মহামতি দ্রুপদের আত্মীয়তার সান্নিধ্যে সগৌরবে হস্তিনায় ফিরলেন বটে, কিন্তু পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্যের প্রতিপত্তিও ধৃতরাষ্ট্রের সহ্য হয়নি। মতলববাজ শ্যালক এবং রাজ্যলোভী পুত্র তাঁকে যা বুঝিয়েছে, তিনি হয়তো তাই বুঝেছেন। কুন্তীর ছেলেদের বাড়বাড়ন্ত দুর্যোধনের যেমন সহ্য হয়নি ধৃতরাষ্ট্রেরও নয়। ফল পাশাখেলা, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, পাণ্ডবদের বনবাস।

এই সময় থেকে আমরা অন্য এক কুন্তীকে দেখতে পাব। রাজমাতা হিসেবে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যসুখ—তা কতটুকুই বা ভোগ করলেন তিনি? সারা জীবন কষ্ট করে এসে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যসুখ তাঁকে বড় বেশি উৎফুল্ল করতে পারেনি। তিনি ছিলেনও একান্তে। কিন্তু তার মধ্যে এ কী হল? ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা শকুনির ক্রীড়া কুশলতায় প্রথমে তাঁর ছেলেদের সর্বস্ব জিতে নিত। তাও তাঁর সইত। পাশার পণে ছেলেদের বারো বছর বনবাস হত তাও তাঁর সইত। কিন্তু উন্মুক্ত সভাস্থলের মধ্যে শ্বশুর ভাশুর গুরুজনদের সামনে কুলবধূর লজ্জাবস্ত্র খুলে দেবার চেষ্টা করল দুঃশাসন-দুর্যোধনেরা—এ তিনি সইবেন কী করে?

ঠিক এই জায়গায় কুন্তী দ্রৌপদীর সঙ্গে একাত্ম হয়েছেন। একাত্ম হয়েছেন কুরুকুলের বন্ধুর মর্যাদায়। তাঁর নিশ্চয়ই মনে হয়েছে—পাণ্ডুর স্ত্রী হিসেবে কুরুবাড়িতে যে মর্যাদা তাঁর প্রাপ্য ছিল, সে মর্যাদা তিনি যেমন পাননি, তেমনই তাঁর ছেলের বউও পেল না। তাঁর শ্বশুর কুল তাঁর সঙ্গে যে বঞ্চনা করেছে, সেই বঞ্চনা চলল বধূ-পরম্পরায়। পাশাখেলায় পাণ্ডবরা হেরে গিয়ে যখন বনবাসের জন্য তৈরি হচ্ছেন, তখন কুন্তী তাঁর অবাঙ্‌মুখ ছেলেদের সঙ্গে কথা বলেননি, কথা বলেছিলেন শুধু পুত্রবধূ দ্রৌপদীর সঙ্গে।

পরিস্থিতিটা বলি। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদী আর ভাইদের নিয়ে বিদায় চাইলেন সবার কাছে। কুন্তীও বুঝি ছেলেদের সঙ্গে বনে যাবার জন্যই প্রস্তুত হয়েছিলেন, কারণ পাণ্ডুর বংশধর পুত্রদের যেখানে ঠাঁই হল না, সেই শত্ৰুপুরীতে তাঁর স্থান কোথায়? কাজেই তিনিও বনে যাবার জন্যই প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু ধর্মাত্মা বিদুর যিনি ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রীও বটেন, তিনি পাণ্ডবদের ডেকে বললেন—রাজপুত্রী আর্যা পৃথা বৃদ্ধা হয়েছেন, বেশি কষ্টও তাঁর সইবে না, তিনি আর বনে যাবেন না, তিনি আমারই বাড়িতে থাকবেন আমারই সমাদরে—ইহ বৎস্যতি কল্যাণি সক্তৃতা মম বেশ্মনি। কথাটা বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে শোনালেন অর্থাৎ রাজবাড়ির আনুকূল্য ছাড়াও বিদুরের অধিকারে তিনি বিদুরের ঘরে থাকবেন।

যুধিষ্ঠির নিশ্চিন্ত হয়ে কাকা বিদুরের মত মেনে নিয়েছেন, সম্মত হয়েছেন কুন্তীও। ঠিক এই সময়ে বিদগ্ধা দ্রৌপদী উপস্থিত হয়েছেন মনস্বিনী কুন্তীর কাছে। কুন্তী আর চোখের জল রাখতে পারেননি। সেইকালের শাশুড়ি হয়েও ছেলের বউকে যে কত সম্মান দেওয়া যেতে পারে তার একটা উদাহরণ হতে পারে এই কথোপকথন। সাধারণত শাশুড়িরা সব সময় ছেলের ওপর অধিকার ফলাতে গিয়ে পুত্রবধূর সঙ্গে কোঁদল করেন। পরিবর্তে শাশুড়িরা যদি ছেলের বউদের সম্মান সম্বন্ধে। সচেতন হন, তাহলে যে ছেলেরা আপনিই অধিকারে আসে সেটা বোধহয় কুন্তীর মতো কেউ জানতেন না। অবশ্য দ্রৌপদীও বিদগ্ধা বটে, শাশুড়িকে তিনি বুঝেছেন ভালমতো।

কুন্তা বলেছেন—বাছা! এই বিরাট বিপদের মুহূর্তে কোনও কষ্ট মনে রেখো না তুমি। মেয়েদের কী করা উচিত তা তুমি জানো এবং স্বামীদের সঙ্গে কীভাবে তোমায় চলতে হবে—তাও তোমায় বলে দিতে হবে না। তোমার পিতৃকুল এবং শ্বশুরকুল—দুই কুলেরই তুমি অলংকার। এই কুরুকুলের ভাগ্যি মানি আমি, যে তারা তোমার ক্রোধের আগুনে ভস্ম হয়ে যায়নি এখনও। তোমার মধ্যে স্বামীদের জন্য ভাবনা যতখানি আছে, তেমনই আছে মায়ের গুণ—বাৎসল্য। শীগগিরই ভাল দিন আসবে তোমার।

এই সব শুভকামনার পরে কুন্তী শুধু তাঁর আদরের সহদেবকে বনের মধ্যে ভাল করে দেখে রাখতে বলেছেন দ্রৌপদীকে, এবং সে-কথা আমি আগে বলেছি। বিদগ্ধা দ্রৌপদী রওনা দিলেন, কুন্তীর কান্না দ্বিগুণতর হল। ছেলেদের জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলেন তিনি, অনেক ধিক্কার দিলেন নিজেকে। বললেন—চিরকাল ধরে ন্যায়-নীতি আর সমস্ত উদারতার মধ্যেই ছেলেরা আমার মানুষ হয়েছে, কিন্তু কেউ নিশ্চয়ই ভীষণভাবে খারাপ চেয়েছে আমার-কস্যাপধ্যানজঞ্চেদং—যার ফলে দুর্দৈব উপস্থিত হল। অথবা এ আমারই ভাগ্যের দোষ—আমি তোমাদের জন্ম দিয়েছিলাম; নইলে এত গুণের ছেলে হয়েও এইভাবে দুর্ভোগ পোয়াতে হবে কেন তোমাদের?

কুন্তী এবারে স্মরণ করলেন তাঁর সারা জীবনের কষ্টের কথা, তাঁর স্বামীর কথা, সপত্নী মাদ্রীর কথা, যাঁরা পুত্র-জন্মের সুখে-সুখেই স্বর্গত হয়েছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর পরেও ছেলেদের নিয়ে তিনি যে আশায় বুক বেঁধেছিলেন, স্বার্থপর ভাশুরের আগ্রাসনে সে আশা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। তিনি বলেছেন—আগে যদি জানতাম ছেলেদের সেই বনবাসই জুটবে আবার কপালে, তাহলে পাণ্ডুর মৃত্যুর পর সেই শতশৃঙ্গ থেকে আর হস্তিনায় ফিরে আসতাম না—শৃতশৃঙ্গান্মৃতে পাণ্ডৌ নাগামিষ্যং গজাহ্বয়ম্‌। স্বামী-সতীনের মরণ দেখেও জীবনে বুঝি আমার বড় লোভ ছিল, তাই হয়তো এই কষ্ট—জীবিতপ্রিয়তাং মহং ধিঙ্‌ মাং সংক্লেশভাগিনীম্।

কুন্তীর করুণ বিলাপে সেদিন পাণ্ডবদের বনবাস-দুঃখ আরও গাঢ়তর হয়েছিল। কোনওদিন কুন্তীকে এত আলুলায়িত ভেঙে-পড়া অবস্থায় আমরা দেখিনি। একবার তিনি ছেলেদের আটকে দিয়ে বলেন—ছাড় আমাকে, আমিও বনে যাব তোদের সঙ্গে, একবার নিজের বেঁচে থাকায় ধিক্কার দেন, আরেকবার সহদেবকে চেপে ধরে বলেন—সবাই যাক বাবা, তুই অন্তত আমাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য থাক এখানে, তাতে কী এমন অধর্ম হবে—মৎপরিত্রাণজং ধর্মম্ ইহৈব ত্বমবাপ্নুহি। এত বিলাপের পর শেষে আর কুন্তী শ্বশুর-ভাশুরের উদ্দেশে দুটো কথা না বলে পারেননি। বলেছেন—ভীষ্ম-দ্রোণ-কৃপ এঁরা নাকি ধর্মের নীতি-নিয়ম সব জানেন, এঁরাই নাকি এই বংশের রক্ষক, তা এঁরা থাকতেও আমার এই দুর্দশা হল কেমন করে—স্থিতেষু কুলনাথেষু কথমাপদুপাগতা?

পাণ্ডবভাইরা ঠোঁট চেপে শরীর শক্ত করে পা বাড়ালেন বনের পথে। মহামতি বিদুর বহু কষ্টে দুর্দৈবের যুক্তিতে শান্ত করার চেষ্টা করলেন কুন্তীকে। বিবাহিত পুত্রদের শোকে আকুল এক মাকে তিনি নিজের ঘরে স্থান দিলেন সসম্মানে। শোকে দুঃখে কুন্তী পাথর হয়ে গেলেন। প্রায় তেরো বছর অর্থাৎ যতদিন পাণ্ডবরা বনবাসে আর অজ্ঞাতবাসে দিন কাটিয়েছেন ততদিন মহাভারতের কবি আমাদের কুন্তীর খবর দেননি। হয়তো পুত্রশোকাতুর মাতার দুঃখ কবির মরমী ভাষাতে প্রকাশ করলেও সে বুঝি যথেষ্ট হত না, অথবা সে দুঃখ শুনে শুনে অভিনব-ঘটনা-পিপাসু পাঠকের মনে যদি কুন্তীর দুঃখকষ্টের প্রতি তুচ্ছতা জন্মায়, অতএব মহাভারতের কবি প্রায় তেরো বছর কুন্তীর খবর দেননি আমাদের। বনের মধ্যে পাণ্ডবদের অরণ্য-জীবনের নব নবতর ঘটনা-বিন্যাস করে পাঠকদের তিনি অন্যভাবে আকৃষ্ট এবং নিবিষ্ট রেখেছেন।

এই তেরো বছর যে মহাভারতের কবি কুন্তীকে পাঠক-চক্ষুর অন্তরালে লুকিয়ে রাখলেন, তার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে। মনে রাখা দরকার, কুন্তী ক্ষত্রিয়-রমণী। প্রিয় পুত্রদের বনবাসের কারণে সাময়িকভাবে তাঁর যত কষ্টই হোক, ক্ষত্রিয়-রমণীর হৃদয় বাংলাদেশের নদী-জল আর দুধ-ভাতে গড়া নয়। ক্ষত্রিয়-রমণীর কাছে পুত্রজন্ম সাময়িক রতি-মুক্তির ফল নয়, পুত্রের মাধ্যমে সে জগতের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। এই যে তেরো বছর কেটে গেল—আমরা বেশ জানি—ছেলেদের বিবাসনের দিনটি থেকেই কুন্তীর মনের মধ্যে গড়ে উঠেছে প্রতিরোধ। স্বামীর গুরুজন তাঁর শ্বশুর-ভাশুরের প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর কম ছিল না, কিন্তু তাই বলেই তাঁরা যা করেছেন, তাই ঠিক এমন ভাবনা নিয়ে তিনি বিদুরের ঘরে বসে বসে চোখের জল ফেলে যাচ্ছেন—এমনটি ভাবার কোনও কারণ নেই। তিনি কুরুবাড়িতে আছেন—নিজের ইচ্ছেয় নয়, বিদুরের ইচ্ছেয়, কিন্তু নিজের স্বাতন্ত্র্যে। সেই বিদুরের বাড়িতেই শোকাহত পাথর-প্রতিমা প্রতিরোধের আগুনে সজীব হয়ে উঠল। শ্বশুরবাড়ির মধ্যে বিদুরের দুর্গে বসেই তিনি অন্যায়কারী ভাশুরের বিরুদ্ধে মন শক্ত করে ফেলেছেন।

নিজের ছেলেদের প্রত্যেকের চরিত্র তিনি জলের মতো পড়তে পারেন। অতএব তেরো বছরের মাথায় পিতৃরাজ্যের উত্তরাধিকারের জন্য আবার যখন সময় আসবে, তখন যাতে ছেলেরা তাঁর মিইয়ে না যায় তার—জন্য প্রত্যেক ছেলের মতো করেই উত্তেজনার ভাষা তৈরি করে রেখেছেন কুন্তী। তাঁর বুকে বিঁধে আছে প্রিয় পুত্রবধুটির অপমানের যন্ত্রণা, যে যন্ত্রণার সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে তিনি একাত্ম অনুভব করেন। পুত্রবধুর মনোকষ্ট এবং অপমান তাঁর কাছে পাণ্ডুর কুলবধুদের পরম্পরায় সাধারণীকৃত। তিনি মনে করেন, পাণ্ডুর ঘরের বউরা-কুন্তীই হোন অথবা দ্রৌপদী—তাঁরা কেউ তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা পাননি। অতএব আর তিনি অপেক্ষা করবেন না।

সময় এল। তেরো বছরের শেষে পাণ্ডব-কৌরবের শান্তি-বিনিময়ের চেষ্টা ব্যর্থ হল। পুরুষোত্তম কৃষ্ণ নিজে এসেছেন কুরুদের বাড়িতে পাণ্ডবদের হক বুঝে নেবার জন্য। শান্তি তিনিও চান, কিন্তু পাণ্ডবদের ভাগ তাঁদের বুঝিয়ে দিতে হবে—এই মনোভাবটা তাঁর ছিল। ফলে কুন্তীর পক্ষে নিজের শাণিত বক্তব্যগুলি পেশ করাটা খুব কষ্টকর হয়নি। তা ছাড়া বিশাল ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই ভাইপোটির ওপর তাঁর নির্ভরতা ছিল একান্ত। ভাইপোটিও সেইরকম। কুরুদের সভায় যাবার আগে কৃষ্ণ একবার কুন্তীর সঙ্গে দেখা করেন। তেরো বছর ছেলেদের মুখ না দেখার ফলে কুন্তীর প্রথম প্রতিক্রিয়া হয়েছিল অনর্গল কুশল প্রশ্নে। তারই সঙ্গে ছেলেদের কর্তব্য সম্বন্ধেও তিনি একইভাবে মুখর। বছরের পর বছর যে অন্যায় তাঁদের সইতে হয়েছে, তার বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিক্রিয় হয়ে ওঠা উচিত, সে ব্যাপারে এখন তিনি নিজেই উপদেশ দিয়েছেন কৃষ্ণকে। কৃষ্ণ এখানে নিজে বেশি কথা বলেননি। কিন্তু কুরুদের সভায় কৃষ্ণের শান্তি-সফর যখন ব্যর্থ হয়ে গেল, তখন কিন্তু কৃষ্ণ নিজেই জিজ্ঞাসা করেছেন মনস্বিনী কুন্তীকে—তোমার ছেলেদের কী বলব বলে দাও, পিসি! অর্থাৎ এবার উত্তেজনাটা নিজেই চাইছেন।

প্রথমবার যখন কৃষ্ণ এলেন কুন্তীর কাছে, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে বিদুরের ঘরে খাওয়া-দাওয়া, আলাপ-আলোচনা সেরে কৃষ্ণ পিসির সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ছেলের বয়সী ভাইপোকে দেখে কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। কৃষ্ণকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলেন কুন্তী। বললেন—পাঁচ ভাই, ছোটবেলা থেকে এক-মত, এক-প্রাণ, অন্যায়ভাবে তাদের পাঠানো হল বনে। বাপ নেই, তাদের আমি কত কষ্ট করে মানুষ করেছি—বালা বিহীনাঃ পিত্রা তে ময়া সততলালিতাঃ। সমস্ত রাজ-সুখ ত্যাগ করে দুঃখিনী মাকে রেখে তারা চলে গেল বনে।

ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যসুখের প্রতিতুলনায় পাণ্ডবভাইরা কত কষ্টে বনে বাস করলেন—কৃষ্ণের সামনে তার একটা চিত্র তুলে ধরলেন কুন্তী। কুন্তী বললেন—হয় শঙ্খ-দুন্দুভির শব্দ, নয়তো হাতি-ঘোড়ার ডাকে ছেলেরা আমার সকালবেলায় জেগে উঠত। ব্রাহ্মণেরা পুণ্যাহ ঘোষণা করতেন, বাঁশিতে ভৈরবীর সুর চড়ানো হত, বাছারা আমার সেই শব্দ শুনে জেগে উঠত। আর এখন বিশাল বিশাল বনের মধ্যে জন্তুর ক্রূর-কর্কশ শব্দে ছেলেরা আমার বোধ হয় ঘুমোয়নি এতকাল।

কুন্তী ছেলেদের কথাই বলে চলেছেন—এই যে আমার বড় ছেলে যুধিষ্ঠির। যে নাকি অম্বরীষ-মান্ধাতা অথবা যযাতি-নহুষের মতো বিরাট এক রাজ্যের রাজা হবার উপযুক্ত, সেই যুধিষ্ঠির বনের মধ্যে কেমন ছিল, কৃষ্ণ? আর যার গায়ে হাজার হাতির শক্তি, হিড়িম্ব, বক আর কীচকের মতো লোককে যে শায়েস্তা করেছে, সেই আমার ভীষণ রাগি ছেলে ভীম কেমন করে দিন কাটাল বনে বনে? অর্জুন, আমার অর্জুন। যার ওপর সমস্ত পাণ্ডবভাইরা ভরসা করে থাকে, একেক ক্ষেপে যে একশোটা বাণ ছুঁড়তে পারে, সামনাসামনি যুদ্ধ করে কেউ পারবে না যার সঙ্গে—সেই অর্জুন আমার কেমন আছে কৃষ্ণ? এইভাবে নকুল-সহদেব—পিতৃমাতৃহারা যে ভাই দুটিকে চোখে হারাতেন কুন্তী, জননীর সমস্ত প্রশ্রয়ে যাদের তিনি মানুষ করেছেন, সেই নকুল-সহদেবকে ছাড়া কেমন করে দিন কেটেছে কুন্তীর—তাও তিনি জানালেন কৃষ্ণের কাছে।

সবার শেষে এল কুলবধু কৃষ্ণার কথা। কুলবধূর সমস্ত মর্যাদা একত্র জড় করে শাশুড়ি কুন্তী এবার পুত্রবধুর কথা জিজ্ঞাসা করছেন কৃষ্ণকে। দোষ ধরলে তো কত কিছুই ধরতে পারতেন কুন্তী। পাঁচ ছেলের এক বউ। একে যত্ন করো না, ওকে খেতে দাও না, স্বামীদের সঙ্গে তর্ক করো, পিসতুতে দেওর কৃষ্ণের সঙ্গে অত কিসের বন্ধুত্ব তোমার, অর্জুনের ব্যাপারে তোমার রস বেশি, নকুল-সহদেবকে একটু দেখে রাখতে পারো না, স্বামীদের সঙ্গে একই তালে ঘুরে বেড়াও—এ রকম শত দোষ আবিষ্কার করা কিছুই কঠিন ছিল না শাশুড়ি কুন্তীর পক্ষে। কিন্তু কুন্তী তাঁকে দেখেছেন কুরুবাড়ির বধু-পরম্পরায়। তিনি নিজে কুরুবাড়ির বউ, সেই বউ হিসেবেই তিনি দ্রৌপদীর মর্যাদা রক্ষা করেছেন। বউ হিসেবে কুরুবাড়িতে কষ্ট পেয়েছি, অতএব শাশুড়ি হিসেবে সেটা পুষিয়ে নেব—এই দৃষ্টিতে নয়, দ্রৌপদীর মান-অপমানের কথা কুন্তীর বিলক্ষণ স্মরণে আছে।

তাই সবার কথা শেষ করে কুন্তী এবার আলাদা করে আসছেন দ্রৌপদীর প্রসঙ্গে। বললেন—আমার সবগুলি ছেলের থেকেও অনেক বেশি আমার কাছে আমার পুত্রবধু দ্রৌপদী—সর্বৈঃ পুত্রৈঃ প্রিয়তরা দ্রৌপদী মে জনার্দন। যেমন তার রূপ, তেমনই তার গুণ। নিজের কচি ছেলেগুলিকে বাড়িতে রেখে সে স্বামীর কষ্টের ভাগ নিতে গেছে বনে। আভিজাত্য, ঐশ্বর্য, কৌলীন্য—কিছুই তো কম ছিল না তার, তবু স্বামীদের জন্যই সে বনে গেছে। দ্রৌপদীর জন্য কুন্তী এবার চিরাচরিত ভারতীয় ধর্মদর্শনেও সন্দেহ প্রকাশ করছেন। ধর্মের কর্তা বক্তা এবং অভিরক্ষিতার মতো এক ব্যক্তির নামই হল কৃষ্ণ। তাঁর কাছেই কুন্তী বলছেন—পুণ্য কর্ম করলেই মানুষ সুখ পায়—এমন নিশ্চয়ই নয় কৃষ্ণ, কারণ তা যদি হত তাহলে আমার দ্রৌপদীর সারা জীবন ধরে অক্ষয় সুখ পাওয়ার কথা।

আসলে কুন্তী এবার যেসব মেজাজি কথাগুলি বলবেন তার অন্তঃসূত্র হলেন দ্রৌপদী। ছেলেদের এই চুপ করে বসে থাকা আর তাঁর ভাল লাগছে না। ধর্ম-ধর্ম করে যুধিষ্ঠিরের শুভবুদ্ধি আর তৃপ্ত করছে না এই ক্ষত্রিয় রমণীর মন। কুন্তী বলছেন—দেখ কৃষ্ণ! যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন অথবা নকুল-সহদেব—কেউ আমার কাছে কৃষ্ণা-পাঞ্চালীর থেকে প্রিয় নয়। অমন একটা মেয়েকে রাজসভার মধ্যে এনে অপমানের চূড়ান্ত করা হল, আর এরা কেউ কিচ্ছুটি করল না—এর থেকে দুঃখের ঘটনা আমার জীবনে কখনও ঘটেনি—ন মে দুখঃতরং কিঞ্চিদ্‌ ভূতপূর্বং ততো’ধিকম্‌। রজস্বলা অবস্থায় দ্রৌপদীকে শ্বশুর-ভাশুরের সামনে জোর করে নিয়ে আসা হল, আর ব্রহ্মলগ্ন নির্বিণ্ণ পুরুষের মতো সেটা বসে বসে দেখলেন ধৃতরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কৌরবেরা।

কুন্তী এই প্রসঙ্গে বিদুরের অনেক প্রশংসা করলেন কৃষ্ণের কাছে, কেননা তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দ্রৌপদীকে সভাস্থলে নিয়ে আসার নিন্দা করেছিলেন। কুন্তী কিছুই বাদ দিচ্ছেন না, কুরুবাড়ির সমস্ত বঞ্চনা তিনি একটি একটি করে বলতে থাকলেন। তিনি ভাবছিলেন—মানুষটি কৃষ্ণ বলেই তিনি হয়তো শান্তির প্রস্তাব গ্রহণ করাতে সমর্থ হবেন কুরুসভায়। জুটবে আরও এক রাশ বঞ্চনা। বারবার অসহ্য নিপীড়ন আর মাঝে মাঝে দুই-চার মুদ্রা ভিক্ষা দেওয়ার মতো কিছু সান্ত্বনা পেতে পেতে কুন্তী এখন ক্লান্ত। শান্তিকামী কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে তিনি তাই ঠাণ্ডা মাথায় নিজের জীবনের বঞ্চনাগুলি একটি একটি উপস্থিত করে তাঁর আসল প্রস্তাবের পথ পরিষ্কার করছেন।

আমরা এখন সেই জায়গায় উপস্থিত, যেখান থেকে আমরা কুন্তীর জীবনের কথা আরম্ভ করেছিলাম। জীবনের যে উপলব্ধি থেকে কুন্তী নিজেকে অবহেলিত এবং বঞ্চিত বলে মনে করেছেন, আমরা এখন সেই মুহূর্তে উপনীত। কঠিন এবং জটিল এক মনস্তত্ত্বের শিকার হয়ে কুন্তী যখন নিজের ভাইপোকে বলেছিলেন—বাপের বাড়িতেও বঞ্চনা লাভ করেছি, শ্বশুরবাড়িতেও তাই—আমরা এখন সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।

কুন্তী বলেছিলেন—জীবনে দুঃখ আমি কিছু কম পাইনি, কৃষ্ণ-নানাবিধানাং দুঃখানাম্‌ অভিজ্ঞাস্মি জনার্দন। ছেলেদের এই অজ্ঞাতবাস এবং তারপরে এখনও যে তাদের রাজ্য দেওয়া হচ্ছে না—সবই সহ্য করা যেত যদি আমি ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকতাম। বাপের বাড়ি শ্বশুরবাড়ি সব জায়গাতেই আমি অবিচার পেয়েছি। তবু আমার এই বিধবার জীবন, ইন্দ্রপ্রস্থের সম্পদ-নাশ এবং কৌরবদের এই শত্রুতা—এও আমাকে তত কষ্ট দেয় না, যতটা দেয় ছেলেদের সঙ্গে আমার থাকতে না পারাটা—তথা শোকায় দহতি যথা পুত্রৈর্বিনাভবঃ। এই যে আমি প্রায় চোদ্দোটা বছর ধরে আমার অর্জুন, যুধিষ্ঠির, ভীম অথবা নকুল-সহদেব—কাউকে চোখে দেখতে পারছি না, এর পরেও কি কারও শান্তি থাকতে পারে? আসলে কী জান কৃষ্ণ, মানুষ মারা গেলে তবেই লোকে তার শ্রাদ্ধ করে, আমার কাছে আমার ছেলেরা কার্যত মৃত, আমিও মৃত তাদের কাছে—অর্থতস্তে মম মৃতাস্তেষাং চাহং জনার্দন।

মহাভারতের কবির ব্যঞ্জনাটা এখানে ধরতে পারলেন কি না জানি না। সংস্কৃতে ‘শ্রাদ্ধ’ শব্দটি যে ধাতু থেকে আসছে ‘শ্রদ্ধা’ শব্দটিও সেই ধাতু থেকেই আসছে। পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ-তর্পণ মানে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা-জ্ঞাপন। সামগ্রিকভাবে এখানে কুন্তীর ভাবটা হল—আমার ছেলেরা আমার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর মতো কিছু করেনি এবং আমিও তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা করার মতো কিছু পাইনি। তারা শুধুই আমার কাছে মৃত, আমিও তাদের কাছে তাই; কিন্তু মানুষের মৃত্যু হলে যে শ্রাদ্ধ-তর্পণটুকু করে, অন্তত সেইটুকু তাদের কাছে আশা করা গিয়েছিল। তারা তাও করেনি—জীবনাশং প্রণষ্টানাং শ্রাদ্ধং কুবন্তি মানবাঃ।

এখানে কুন্তীর শ্রাদ্ধ-তর্পণ বলতে যেন আবার আক্ষরিক অর্থে শ্রাদ্ধ বুঝবেন না। এখানে শ্রাদ্ধের মধ্যে কুন্তী তাঁর সন্তানদের তরফে কৌরবদের বিরুদ্ধে যথোচিত প্রতিক্রিয়া আশা করছেন। কুন্তী এর পরেই কৃষ্ণের মাধ্যমে যুধিষ্ঠিরকে জানাচ্ছেন—কৃষ্ণ! সেই রাজা যুধিষ্ঠিরকে বোলো (কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, এককালে তিনি রাজা ছিলেন), সেই ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে বোলো—তুমি যে এত ধর্ম-ধর্ম কর, সেই ধর্মও যে একেবারে ক্ষীণ হয়ে গেল বাছা! ধিক সেই ধর্মপুত্রের জননীকে, যাকে বেঁচে থাকতে হয় পরের ওপর নির্ভর করে—পরাশ্রয়া বাসুদেব যা জীবতি ধিগস্তু তাম্। আর আমার নাম করে সেই ভীম আর অর্জুনকে একবার বলো। বোলো যে, ক্ষত্রিয়-জননীরা যে সময়ের কথা ভেবে সন্তান প্রসব করে, এখন অন্তত সেই সময়টা এসে গেছে—যদর্থং ক্ষত্রিয়া সূতে তস্য কালো’য়মাগতঃ। এই সময়ও যদি বয়ে যায়, তবে এরপর মিথ্যাই সত্যের জায়গাটা অধিকার করে নেবে—মিথ্যা চাতিক্রমিষ্যতি।

যে ছেলের যা। ধর্মপ্রাণ যুধিষ্ঠিরকে ধর্মের শাসনে, আর ভীম-অর্জুনকে ক্ষাত্রবীর্যের মহিমায় উদ্বুদ্ধ করে কুন্তী বলেছেন—সময় যদি সেরকম আসে, তবে জীবনটাও খুব বড় কথা নয়, দরকার হলে জীবন দিতে হবে—কালে হি সমনুপ্রাপ্তে ত্যক্তব্যমপি জীবিতম্‌। আমরা ভাবি চিরাচরিত ক্ষাত্ৰ-নীতি-সিদ্ধির জন্য কোন জননী এমন করে ছেলেদের বলতে পারেন? কুন্তীর বক্তব্য—ভীম-অর্জুনের মতো বীর, যাঁরা নাকি যুদ্ধকালে দেবতাদেরও অন্ত ঘটাতে পারেন, সেই তাঁরা যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সভাস্থলে উপস্থিত দ্রৌপদীর অপমান দেখলেন—এটা তাঁদের লজ্জা—তয়োশ্চৈদ্‌ অবজ্ঞানং যত্তাং কৃষ্ণং সভাং গতাম। দুঃশাসন-দুর্যোধনের সঙ্গে তাঁর প্রথমজাত সন্তান কর্ণও দ্রৌপদীর সঙ্গে জঘন্য ব্যবহারটি করেছিলেন—কুন্তী তা ক্ষমার যোগ্য মনে করেন না। বরঞ্চ তাদের শত অপমান এবং কটূক্তির উত্তরে হঠাৎ-ক্রোধী ভীমসেন যে ক্ষেপে উঠেছিলেন—সেই ক্ষিপ্ততাই অনুমোদন করেন কুন্তী। নিজের ছেলেকে তিনি চেনেন। তাঁর ধারণা—দুর্যোধন ভীমের সঙ্গে যে অপব্যবহার করেছে—তার ফল বুঝবে সে—তস্য দ্রক্ষ্যতি যৎ ফলম্।

এই চরম মুহূর্তে যুধিষ্ঠির এবং অর্জুন যেখানে অসাধারণ ধৈর্য নিয়ে ঘটনার গতির দিকে নজর রাখছেন, সেখানে তাঁর ওই অধীর হঠাৎ-ক্রোধী পুত্রটিই যে প্রধান ভরসা। সে যা করেছে, ঠিক করেছে যেন। কৃষ্ণকে কুন্তী বলেছেন—কৌরবদের এই চরম শত্রুতার মুখে আমার ভীম অন্তত চুপটি করে বসে থাকবে না। ভীম সারা জীবন শত্রুতা পুষে রাখে এবং শত্রুর শেষ না করে সে ছাড়বে না। দ্রৌপদীর অপমানে ভীম একান্তভাবে প্রতিক্রিয় হয়েছিলেন বলেই কুন্তীর আবার মনে পড়ল লজ্জারুণা দ্রৌপদীর কথা। কুন্তী বলেছেন—ছেলেরা পাশা খেলায় হেরেছে, দুঃখ নেই আমার, রাজ্য হারিয়েছে তাতেও দুঃখ পাই না, বনবাসে কষ্টে দিন কাটাচ্ছে—তাও আমি গণ্য করি না। কিন্তু রজস্বলা অবস্থায় কুলবধূকে সভার মধ্যে এসে যে অশালীন কথাগুলি শুনতে হল—সে দুঃখের থেকে বড় দুঃখ আমার কাছে কিছু নেই কৃষ্ণ! কিছু নেই—কিনু দুঃখতরং ততঃ।

দ্রৌপদীর অপমান আজ কুন্তীর কাছে সমগ্র নারী জাতির একাত্মতায় ধরা দিয়েছে, যে নারী জাতির মধ্যে তিনিও একতমা। বার বার তাঁর মনে পড়ে—অমন অসভ্য পরিস্থিতিতে দ্রৌপদী কাউকে সহায় পায়নি, স্বামীদেরও নয়। আজ কৃষ্ণের শান্তি-প্রস্তাবের প্রাক্কালে দ্রৌপদীর একাত্মতায় কুন্তী তাই নিজের লাঞ্ছনা ব্যক্ত করছেন কৃষ্ণের কাছে। বলেছেন—ছেলেপিলেদের সঙ্গে আমার সহায় একমাত্র তুমি কৃষ্ণ! তুমি আছ, বলরাম আছে, তোমার বীরপুত্র প্রদ্যুম্ন আছে। আর আমি! তোমরা থাকতেও, ভীম-অর্জুনের মতো ছেলে থাকতেও আমাকে এই সব লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হল-সো’হম্‌ এবং বিধং দুঃখং সহেয়ং পুরুষোত্তম।

এই ‘পুরুষোত্তম’ শব্দটির মধ্যে যেন একটা খোঁচা আছে। অর্থাৎ লোকে তোমায় যে ‘পুরুষোত্তম’ বলে ডাকে, আমার এই সারা জীবনের লাঞ্ছনা গঞ্জনার নিরিখে ওই নামে বুঝি কলঙ্ক লেগেছে। কৃষ্ণ কুন্তীকে আশ্বাস দিলেন কুন্তীর পিতৃকুলের বিশ্বস্ততায়। বললেন—পিসি! তুমি মহারাজ আর্যক শুরের মেয়ে। এক হ্রদ থেকে আরেক হ্রদে এসে আশ্রয় নেওয়ার মতো বিবাহসূত্রে তুমি এসে পড়েছ কৌরবকুলে। তুমি বীরপুত্রদের জননী বলেই এই আশা আমি রাখি যে, তোমার মতো প্রাজ্ঞ রমণীরাই সাধারণ সুখ-দুঃখের ওপর উঠতে পারবে—সুখদুঃখে মহাপ্রাজ্ঞে ত্বাদৃশী সোঢ়মৰ্হতি। বস্তুত তোমার ছেলেরাও বনবাসের পরিসরে এই সাধারণ সুখ-দুঃখ ক্রোধহর্ষের ওপরে উঠে ধৈর্য অবলম্বন করেছে। বড় মানুষেরা এই রকমই করেন। সাময়িক সুখের থেকে পরিণত কালের অবিচল সুখই তাদের বেশি কাম্য। কৃষ্ণ বললেন—আমার বিশ্বাস—আর খুব বেশি দেরি নেই। শীগগিরই তোমার ছেলেরা তোমার পুত্রবধূ—সবাই এসে নিজেদের কুশল জানিয়ে অভিবাদন জানাবে তোমাকে।

কৃষ্ণের কথায় কুন্তী সাময়িকভাবে শান্ত হয়ে কৃষ্ণের ওপর আস্থা জ্ঞাপন করেছেন। কিন্তু কুরুসভায় দুর্যোধন যখন কৃষ্ণের শান্তির প্রস্তাব নস্যাৎ করে দিলেন, সেই সময়ে সুখ-দুঃখ অথবা ক্রোধ-হর্ষের ঊর্ধ্বতার দার্শনিক মাহাত্ম্য তাঁর কাছে আর তত সত্য ছিল না। তিনি বুঝেছিলেন ধৈর্যের দিন এবারে শেষ। এখন শাস্তি দেবার সময় এসেছে। হস্তিনাপুর ছাড়বার আগে তিনি আবার এসেছেন মনস্বিনী কুন্তীর কাছে। কুন্তীর উত্তেজনা পাণ্ডবদের মধ্যে সংক্রমিত করার জন্য কৃষ্ণই নিজে বলছেন—বলো পিসি কী বলতে হবে পাণ্ডবদের, তোমার নাম করে যা বলতে হবে এইবার তা বলো—কিং বাচ্যা পাণ্ডবেয়াস্তে ভবতা বচনান্ময়া।

কৃষ্ণ এখন শুনতে চাইছেন। কৃষ্ণের মতো অত বড় বীরপুরুষ এবং বাকপটু মানুষ! নিজের ওপর যাঁর অনেক আস্থা ছিল—ভেবেছিলেন—ঠিক পারব, কৌরব-সভায় সবার মধ্যে দুর্যোধনকে ঠিক রাজি করাতে পারব। কিন্তু পারলেন না। দুর্যোধন এবং তাঁর সাকরেদদের ভাব-ভাবনা আগে থেকে জানতেন বলেই কুন্তী কৃষ্ণের মাধ্যমে ছেলেদের যা বলার তা আগেই বলেছেন। এখন কৃষ্ণ নিজেই এসেছেন কুন্তীর কাছে—বিরক্ত, ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ। কুন্তীকে বলেছেন—যুক্তি তর্ক দিয়ে অনেক বলেছি। আমি বলেছি, পণ্ডিত ঋষিরা বলেছেন, একটা কথাও যদি শোনে—ন চাসৌ তদ্‌ গৃহীতবান্‌। কৃষ্ণ বলেছেন—এখন তুমি বলো, তোমার কথা এখন আমি শুনতে চাই—শুশ্রূষে বচনং তব।

এই যে একটা সময়ের তফাত হল, তাতে কুন্তীও তাঁর বক্তব্য আরও শাণিত করার সুযোগ পেলেন। আগে যে ব্যক্তি শান্তিকামী হয়ে নিতান্ত পাঁচখানি গ্রামের বদলেই শান্তি বজায় রাখতে উদ্যত ছিলেন, সেই লোকের অর্থাৎ আমাদের কৃষ্ণের সমস্ত ‘মিশন’ এখন ব্যর্থ হয়ে গেছে। কৃষ্ণের এই ব্যর্থতার সুযোগ, কুন্তীর কাছে এক বড় সুযোগ। বস্তুত কৃষ্ণ যে শান্তিকামী হয়ে কৌরব-সভায় পাণ্ডবদের জন্য পাঁচখানি গ্রাম পর্যন্ত প্রার্থনা করেছিলেন—এই প্রার্থনা কুন্তীর মনোমত হয়নি। এখন কৃষ্ণ ব্যর্থ হওয়ার ফলে তিনি সেই কথাগুলি বলতে পারছেন, যা আগে তিনি বলতে পারেননি। কুন্তী বলছেন—তাঁর নিজস্ব রাজনৈতিক বুদ্ধি, মনস্বিতা এবং মাতৃত্বের গ্লানি একত্রিত করে। পাঠক! অবহিত হয়ে শুনুন!