কুন্তী – ৯

এই মুহুর্তে আমার সহৃদয় পাঠকদের কাছে আমিও যে সকরুণ প্রার্থনা জানাচ্ছি, তার কিছু কারণ আছে। আসলে সাধারণ পাঠক গল্প চান, ঘটনার পর ঘটনার বিন্যাস চান। উপন্যাসের চরিত্র যদি একসঙ্গে বেশি কথা বলে, তার বক্তব্য যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে। কুন্তীর চরিত্র বিশ্লেষণের পথে আমরা এখন এমন একটা জায়গায় উপস্থিত হয়েছি, যখন পাঠকের ধৈর্যের ওপরেই আমাদের আস্থা রাখতে হবে। আমার ভরসা একটাই—আমার পাঠক কোনও সাধারণ মামুলি পাঠক নন। মহাভারতের মতো বিশাল এক মহাকাব্যের ততোধিক বিশাল এক নারী চরিত্রের বিশ্লেষণ শোনবার জন্য তিনি পূর্বাহ্নেই প্রস্তুত। এই প্রস্তুতি থাকার জন্যই পাঠক তাঁর উদারতায় কুন্তীর এই বিপন্ন মুহূর্তে তাঁর পাশে থাকবেন, তাঁর কথা মন দিয়ে শুনবেন বলে আশা করি।

ভারতবর্ষের প্রাচীন রাজনীতি-শাস্ত্রের সঙ্গে যাঁদের পরিচয় আছে, তাঁরা উত্থান-শক্তি-সম্পন্ন রাজার কথা শুনে থাকবেন। উত্থান-শক্তি বলতে সাধারণত আমরা উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতাই বুঝি, রাজনীতির পরিভাষাতে ব্যাপারটা প্রায় একই বটে, তবে যে রাজা শত্রুর মোকাবিলা করতে সতত উদ্যোগ নেন, শত্রুর দ্বারা দ্বিধাগ্রস্ত হয়েও যিনি আপন প্রাপ্তির কথা ভুলে যান না, সুযোগ এলেই আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রুর ওপর, প্রাচীন রাজনীতির পরিভাষায় তিনিই উদ্যমী রাজা, উত্থান-শক্তির অধিকারীও তিনিই। তেরোটা বছর ধরে ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির যেভাবে নিশ্চেষ্ট অবস্থায় কষ্ট ভোগ করে চলেছেন কুন্তী তাতে সুখও পাচ্ছেন না শান্তিও পাচ্ছেন না। পাশা-খেলার পণ হিসেবে বনবাসে যাওয়াটা ধর্মের নীতি-নিয়মে যুক্তিসিদ্ধ হতে পারে, কিন্তু রাজ্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে যুধিষ্ঠিরের ধীর চেতনা এই ওজস্বিনী ক্ষত্রিয়া রমণীকে পীড়া দিচ্ছে।

কুরু-পাণ্ডবের রাজনীতির মধ্যে কুন্তী হয়তো প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নেই, কিন্তু এই রাজনীতিটা তিনি হাড়ে হাড়ে বোঝেন। আর বোঝেন বলেই রাজনীতির মধ্যে যুধিষ্ঠিরের নিরন্তর ধর্মৈষণা আর তিনি সহ্য করতে পারছেন না। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠিরকে তিনি তাই খবর পাঠাচ্ছেন—বাবা! তুমি যেমন ধর্ম-ধর্ম করে যাচ্ছ, সেটাই ধর্ম নয়, তোমার ধর্ম প্রজাপালন, সেই ধর্ম তো নষ্টই হয়ে গেল বাবা—ভুয়াংস্তে হীয়তে ধর্মো মা পুত্ৰক বৃথা কৃথাঃ। কুন্তীর কাছে যুধিষ্ঠিরের হেয়তা এইখানেই। ছেলেকে তিনি লজ্জা দিয়ে বলেন—তোমার বুদ্ধিটা প্রায় গোঁ-গোঁ করে বই মুখস্থ করা ছাত্রের মতো। যারা বেদের অর্থ কিছুই বোঝে না অথচ দিন-রাত বেদ মুখস্ত করে ভাবে যে খুব ধর্ম হচ্ছে, তোমার বুদ্ধিও সেইরকম। ধর্মকার্যের আনুষ্ঠানিক কিছু তৃপ্তিতেই তুমি এমন বুঁদ হয়ে আছ যে ভাবছ খুব ধর্ম হচ্ছে—অনুবাকহতা বুদ্ধিঃ ধর্মম্‌ এবৈকমীক্ষতে।

যুধিষ্ঠির পূর্বে রাজা ছিলেন, এখন তিনি রাজ্যহারা, বনবাসী। ব্রাহ্মণোচিত উদার শান্ত ধর্মবুদ্ধির থেকেও তাঁর কাছে এখন রাজ্যোদ্ধারের পরিকল্পনা বড় হওয়া উচিত ছিল। অথচ এই যে কৃষ্ণ কুরুসভায় এলেন শান্তির দূত হয়ে, সেখানে শুধু যুধিষ্ঠির কেন, অর্জুন এমনকী ভীমের মতো লোকের কাছ থেকেও পুরাতন রাজ্যপাটের চেয়ে শান্তির কাম্যতা বেশি দেখা গিয়েছিল। এ জিনিস পঞ্চস্বামিগর্বিত দ্রৌপদীর যেমন সহ্য হয়নি, পঞ্চপুত্ৰগর্বিত এই ক্ষত্রিয়া রমণীরও তা সহ্য হয়নি। যুধিষ্ঠিরের প্রার্থনা ছিল—সম্পূর্ণ রাজ্যপাট নাই পেলাম,, অন্তত পাঁচ গ্রামের পরিবর্তেও যদি যুদ্ধ এড়িয়ে চলেন দুর্যোধন, তবু সেই কলহ-মুক্তিতে বুঝি ধর্ম আছে, শান্তি তো আছেই।

কুন্তীর কাছে অসহ্য এই সব যুক্তি। পূর্বর্তন রাজাদের উদাহরণে কুন্তী প্রকারান্তরে ধিক্কার দিচ্ছেন যুধিষ্ঠিরকে। বলেছেন—কৃষ্ণ! যেটা ধর্ম, অন্তত যুধিষ্ঠিরের কাছে যেটা ধর্ম হওয়া উচিত, সেই ধর্ম সে আপন বুদ্ধিতে নির্মাণ করতে পারে না। জন্মলগ্নেই তার ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন স্বয়ং বিধাতা। ক্ষত্রিয় পুরুষেরা জীবন ধারণ করে বাহুশক্তির ওপর নির্ভর করে। কারণ পরম পুরুষের বাহু থেকেই সৃষ্টি হয়েছে এই ক্ষত্রিয় জাতি। নৃশংস কাজ করতে হলেও তার চরম অভীপ্সিত কাজ হল প্রজাপালন। তার সেই ধর্ম আজ কোথায়! কুন্তী বলেই চললেন। বললেন—বুড়ো মানুষদের মুখে শুনেছি—কুবের নাকি মুচুকুন্দ রাজাকে খুশি হয়ে এই সমস্ত পৃথিবীর রাজত্ব উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জানো কৃষ্ণ! মুচুকুন্দ এই দান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন—আমি চাই, আমার নিজের শক্তিতে আমি আমার প্রার্থিত রাজ্য অধিকার করে নেব, আপনার দান চাই না আমি—বাহুবীর্যার্জিতং রাজ্যম্‌ অশ্নীয়ামিতি কাময়ে।

আসলে কুন্তীও আর এই দান চান না। যিনি রাজরানি ছিলেন তাঁর ছেলেরা বনবাসের দীন প্রকোষ্ঠ থেকে পাঁচখানি গ্রাম ভিক্ষা করবেন আর দুর্যোধন সেই দান করবেন—দুর্যোধনের এই মর্যাদার ভূমিকা কুন্তী সহ্য করতে পারছেন না। কুন্তী মনে করেন—ভাল কথা বলে, রাজ্যের অল্পাংশমাত্র গ্রহণের প্রস্তাব করে দুর্যোধনকে কিছুই বোঝানো যাবে না। পাণ্ডবদের দিক থেকে তার ওপরে চরম দণ্ড নেমে না আসলে ধর্মেরই অবমাননা ঘটবে। কুন্তী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—তুমি যে পূর্বে রাজা হয়েও ঋষিদের মতো পরম ত্যাগের মাহাত্ম্যে নিজেকে বেশ রাজর্ষির কল্পনায় স্থাপন। করেছ, তুমি জেনে রাখো এটা রাজর্ষির ব্যবহার নয়—নৈতদ্‌ রাজর্ষিবৃত্তং হি যত্র ত্বং স্থাতুমিচ্ছসি। তুমি যদি ভেবে থাক যে, কোনও রকম নৃশংসতা না করে নিষ্কর্মার মতো বসে বসেই প্রজাপালনের ফল পাওয়া যাবে, তা হতে পারে না। স্বর্গ থেকে তোমার বাপ-ঠাকুরদারা তোমার এই বুদ্ধি-ব্যবহার দেখে পুলকিত হয়ে আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন—এটা ভেবো না, এমন কী মা হিসেবে আমারও কোনও আশীর্বাদ নেই এ ব্যাপারে—ন হ্যেতাম্ আশিষং পাণ্ডুর্ন চাহং ন পিতামহঃ।

পাঁচ পাঁচটি বীর পুত্র থাকতেও তিনি নিজে অসহায়ভাবে শত্ৰুপুরীতে বসে আছেন। ছেলেদের শুভদিনের জন্য আর কতই বা অপেক্ষা করতে পারেন কুন্তী। এর থেকে দুঃখের আর কীই বা আছে যে রাজরানি এবং রাজমাতা হয়েও তাঁকে জ্ঞাতিশত্রুর বাড়িতে বসে পরের দেওয়া ভাতের গ্রাস মুখে দিতে হচ্ছে। তাঁর বক্তব্য—বাপ-ঠাকুর্দার মান আর ডুবিও না যুধিষ্ঠির, তুমি রাজা ছিলে, অতএব, রাজার মতো শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়াই তোমার একান্ত ধর্ম—যুধ্যস্ব রাজধর্মেণ ম মজ্জয় পিতামহান্।

কৃষ্ণের মাধ্যমে যুধিষ্ঠিরের প্রতি অনন্ত উত্তেজনায় সংবাদ পাঠিয়ে কুন্তী এবার কৃষ্ণকে একটা গল্প বলছেন। বলছেন—এই গল্প শুনে ভালটা কী হওয়া উচিত, করণীয়ই বা কী—সেটা তুমি যুধিষ্ঠিরকে বলতে পারবে। এই গল্পটির মধ্যে একটা বিশেষত্ব আছে। কুন্তীর গল্পে চরিত্র দুটি—মা বিদুলা আর তাঁর ছেলে সঞ্জয়, যে সিন্ধুদেশের রাজার কাছে যুদ্ধে হেরে নিরাশ হয়ে শুয়ে ছিল। এখানে বিদুলা ছেলেকে যা বলেছেন, কুন্তীও ঠিক তাই বলতে চান। বিদুলার গল্পে তাঁর ছেলের যে অবস্থা হয়েছে, কুন্তী মনে করেন—তাঁর ছেলেদেরও সেই একই অবস্থা হয়েছে, বিশেষত যুধিষ্ঠিরের। বস্তুত কড়া কড়া যে সব কথা বিদুলা তাঁর ছেলেকে বলেছেন, সেগুলি বোধহয় মা হিসেবে সোজাসুজি বলা যায় না বলেই কুন্তী বিদুলার জবানে বলছেন যুধিষ্ঠিরকে। এখানে বিদুলার সঙ্গে কুন্তীর এক চুলও তফাত নেই, এমনকী কোনও একপদীভাবে কুন্তীকে বিদুলা-কুন্তী বললেও দোষ হয় না। দোষ হয় না বিদুলার ছেলে সঞ্জয়কেও যুধিষ্ঠির ভেবে নিলে।

বিদুলার গল্পের প্রথম প্রস্তাবে কুন্তী বিদুলার ওরফে নিজেরই পরিচয় দিচ্ছেন কুন্তী বলছেন—জানো কৃষ্ণ! এই বিদুলা ছিলেন রাজচিহ্নে চিহ্নিতা এক ক্ষত্রিয়া রমণী। যেমন বড় বংশ, তেমনই তাঁর নিজের খ্যাতি। অবিনয়ী মোটেই নয়, কিন্তু ব্যক্তিত্বময়ী, রাগী মহিলাও বটে। রাজার সংসদে দাঁড়িয়ে তাঁর কথা বলার ক্ষমতা ছিল, অন্যদিকে তিনি চরম দীর্ঘদর্শিনী, ভবিষ্যতের করণীয় এবং তার ফল সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন।

সন্দেহ নেই, বিদুলার ব্যক্তিত্ব এবং কর্তৃত্ব খ্যাপন করে কুন্তী জানাতে চাইলেন—বংশ, মর্যাদা এবং দীর্ঘদর্শিতার ব্যাপারে বিদুলার সঙ্গে তাঁর পার্থক্য নেই কোনও। অতএব বিদুলার কথা, তাঁরই কথা। কুন্তী বলেছেন—জানো কৃষ্ণ! সিন্ধুরাজের কাছে হেরে গিয়ে বিদুলার ছেলে হতাশায় শুয়ে ছিল নিজের মনে। বিদুলা সেই পেটের ছেলেকে কী বলেছিলেন জানো? বলেছিলেন—কোথাকার এক কুপুত্তুর এসে জন্মেছে আমার পেটে। যে ছেলে শত্তুরের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারে সেই ছেলে হলি তুই। আমার মতো মা তোর জন্ম দেয়নি, তোর বাপও তোর জন্ম দেয়নি, তুই কোত্থেকে এসে জুটেছিস আমার কপালে—ন ময়া ত্বং ন পিত্রা চ জাতঃ ক্কাভ্যাগতো হাসি।

একটু আগে যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে কুন্তী বলেছিলেন, তিনি বাপ-ঠাকুরদার নাম ডোবাচ্ছেন—মা মজ্জয় পিতামহান্। এখন বিদুলার মুখ দিয়ে কুন্তী যা বলছেন তাও যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশেই। অতএব এর পর থেকে আমরা আর ‘বিদুলা বললেন’—এমন করে বলব না, বরঞ্চ বিদুলার একাত্মতায় আমরা বলব—বিদুলা-কুন্তী বললেন। যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে বিদুলা-কুন্তীর বক্তব্য—ক্রোধলেশহীন ক্লীব পুরুষকে কেউ গণনার মধ্যে আনে না। এমন করে নিজেকে ছোট কোরো না, এত অল্পে সন্তুষ্ট হয়ো না—মাত্মানং অবমন্যস্ব মৈনমল্পেন বীভরঃ।

কুন্তী এখানে সেই ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্যপাটের পরিবর্তে যুধিষ্ঠিরের চাওয়া পাঁচখানি গ্রামের দিকে অঙ্গুলি সংকেত করছেন। বিদুলারূপী কুন্তী বলছেন—কাপুরুষ ছেলে কোথাকার, দয়া করে একবার গা তোলো, দুর্যোধনের বুদ্ধিতে পরাজিত হয়ে আর নিষ্কর্মার মতো শুয়ে থেকো না, একবার গা তোলো—উত্তিষ্ঠ হে কাপুরুষ মা শেষ্বৈবং পরাজিতঃ। বনবাস থেকেই লোক পাঠিয়ে পাঁচটি মাত্র গ্রাম ভিক্ষে করছ তুমি। আরে মজা নদী যেমন অল্প জলেই ভরে দেওয়া যায়, ইদুরের প্রার্থিত অঞ্জলি পূরণ করতে যেমন সামান্যই জিনিস লাগে, তেমনই তোমার মতো সন্তুষ্ট কাপুরুষ অল্পেই সন্তুষ্ট হবে।

পঞ্চ গ্রামের প্রার্থনাতেই কুন্তী বুঝি রেগে গেছেন। ভাবটা এই—বনে বসে বসে শান্তির খবর ছড়াচ্ছ, কেন বাপু তুমি এখনও শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়তে পারোনি শত্রুর ওপর! গাব গাছের কাঠ যেমন সহজে জ্বলে ওঠে, চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে স্ফুলিঙ্গের কণা, তেমনি করে একবারও যদি মুহূর্তের জন্য জ্বলে উঠতে তুমি? তা তো নয়, শুধু তুষের আগুনের মতো গুমিয়ে গুমিয়ে জ্বলছ আর ধোঁয়া ছাড়ছ। ওই ধোঁয়াটাই যুধিষ্ঠিরের শান্তির বাণী। আরে, সারা জীবন ওমনি করে গুমিয়ে গুমিয়ে ধোঁয়া ছাড়ার থেকে একবার, অন্তত একবার, মুহূর্তের জন্য জ্বলে ওঠাও অনেক ভাল—মুহূর্তং জ্বলিতং শ্রেয়ো ন তু ধূমায়িতং চিরম্।

ভীমকে বিষ খাওয়ানো হল, তবু যুধিষ্ঠির সবাইকে চুপ করে থাকতে বলেছিলেন, কুন্তীও মেনে নিয়েছেন সে কথা। কিন্তু বারণাবতে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা, রাজ্যের অর্ধেক দিয়ে পাশা খেলার পণে সেটা জিতে নেওয়া, কুলবধূকে রাজসভায় বিবস্ত্র করার চেষ্টা, বারো বছরের বনবাস, এক বছরের অজ্ঞাতবাস, তাও এখন আবার শান্তি কামনা—এইভাবে গুমিয়ে গুমিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বেঁচে থাকা—এটা কুন্তীর সহ্যের বাইরে। তাঁর মত হল—তুমি ক্লীব, তোমার রাজ্যপাট সব গেছে, যশ-খ্যাতি সব গেছে, ভোগ-সুখ সব গেছে, এখন শুধু ধর্মের ধ্বজাটা সামনে রেখে বেঁচে থেকে লাভ কী রে ব্যাটা—ধর্মং পুত্রাগতঃ কৃত্বা কিং নিমিত্তং হি জীবসি। হয় তুমি নিজের বীরত্ব দেখাও, নয় মরো—উদ্ভাবয়স্ব বীর্যং বা তাং বা গচ্ছ ধ্রুবাং গতিম্। আরে সেরকম সেরকম লোক আছে, যারা রণক্ষেত্রে আসন্ন মৃত্যুর সময়ে মাটিতে পড়তে পড়তেও শত্রুর কোমর জড়িয়ে ধরে পড়ে অর্থাৎ সেই অবস্থাতেও তার উদ্যম নষ্ট হয় না। তো সেই রকম একটা পুরুষকার আত্মস্থ করো তুমি, নইলে সে রকম কাজ যদি কিছুই না করতে পারো তবে তো তুমি পুরুষও নও স্ত্রীও নও, তোমার জন্ম হয়েছে শুধু জনসংখ্যা বাড়াবার জন্য—রাশিবর্ধনমাত্রং স নৈব স্ত্রী ন পুনঃ পুমান্।

নিজের পেটের ছেলে যুধিষ্ঠির। এই তেরো বছর ধরে শত্রুর ছিদ্র অন্বেষণ করা তার উচিত ছিল। উচিত ছিল দুর্যোধনের ওপর বিরাগ-গ্রস্ত মন্ত্রী-প্রজাদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলা। তারপর এই বনবাসের শেষে একেবারে বাঘের মতো দুর্যোধনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। অথচ যুধিষ্ঠির এ সব কিছুই করেননি। কুন্তীর ধৈর্য তাই শেষ সীমায় এসে পৌঁছেছে হয়—মার, নয় মরো। মায়ের কাছ থেকে এই সমস্ত কঠিন কথার উত্তরে বনবাসক্লিষ্ট যুধিষ্ঠির বিদুলার পুত্রের মতো তো বলতেই পারেন যে, মা! আজ যদি আমরা মরে যাই, তা হলে এই রাজ্য-পাট, ভোগ-সুখ অথবা তোমার নিজের জীবনেরই বা কী মূল্য থাকবে—কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা?

কুন্তী জানেন যুধিষ্ঠিরের মতো নিরুপদ্রব শান্তিকামী ব্যক্তির কাছ থেকে এইরকম একটা মর্মবিদারী মমতা-মাখা প্রতিপ্রশ্ন হতেই পারে। তিনি বলতেই পারেন—বুঝি বা আকরিক লোহা সব এক জায়গায় করে মা তোমার হৃদয়ে গড়ে দিয়েছেন বিধাতা—কৃষ্ণায়সস্যেব চ তে সংহত্য হৃদয়ং কৃতম্! নইলে, নিজের ছেলেকে পরের মায়ের মতো এমন করে যুদ্ধে নিয়োগ কর তুমি?

কুন্তী এসব আবেগ-ক্লিন্ন প্রশ্নের উত্তর জানেন। তিনি জানেন যে, হ্যাঁ, যুদ্ধে গিয়ে ছেলেগুলি আমার মারাও যেতে পারে। কিন্তু তবু এইভাবে দিন দিন হীনবল হয়ে অতি অদ্ভুত এক পর্যায়মরণ বরণ করা ক্ষত্রিয় রমণীর পক্ষে যেমন উপযুক্ত নয়, তেমনই উপযুক্ত নয় ক্ষত্রিয় পুত্রদের পক্ষেও। উৎসাহহীন, নির্বীর্য কতগুলি পুত্র আপন কুক্ষিতে ধারণ করার জন্য কুন্তী লজ্জা বোধ করেন। দিনের পর দিন পরের ওপর নির্ভর করার মধ্যে যে দরিদ্রতা আছে, সেই দরিদ্রতা স্বামী-পুত্রের মৃত্যুর চেয়েও তাঁর কাছে কষ্টকর বেশি—পতিপুত্রবধাদেতৎ পরমং দুঃখমব্রবীৎ। কেন না, সমস্ত ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এই পরান্নজীবিতার মধ্যে যে লজ্জা, সেই লজ্জা ক্ষত্রিয়া বীর রমণীর সয় না। বিদুলার মতো কুন্তী বলতেই পারেন—আমি ছিলাম বিরাট বৃষ্ণিবংশের মেয়ে, বিয়ে হয়েছিল কুরুদের রাজবাড়িতে, স্বামী আমাকে সমস্ত সুখে রেখেছিলেন, স্বামীর রাজ্যে আমি ছিলাম সব কিছুর ওপর—ঈশ্বরী সর্বকল্যাণী ভর্ত্রা পরমপূজিতা। কুন্তী বলতে পারেন—দাস-দাসী, ব্রাহ্মণ-ঋত্বিক, আচার্য-পুরোহিত—আমরা ছিলাম এঁদের আশ্রয়। আর আজ! কেউ আমাদের ভরসা করে না, আমিই অন্যের আশ্রয়ে বেঁচে আছি, এর চাইতে আমার মরণও ছিল ভাল—সান্যমাশ্ৰিত্য জীবন্তী পরিত্যক্ষ্যামি জীবিতম্‌।

পুত্রস্নেহের থেকে কুন্তীর কাছে আজ ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনেক বড়। কারণ যুদ্ধের জন্যই পুত্রের জন্ম, যুদ্ধ-জয়ের মধ্যেই তার চরম সার্থকতা। যুদ্ধে জয় হোক বা মৃত্যু হোক নিজের, তবু যুদ্ধের মাধ্যমেই ক্ষত্রিয়-পুরুষ হয়ে ওঠে ইন্দ্রের মতো—জয়ন্‌ বা বধ্যমানো বা প্রাপ্নোতীন্দ্ৰসলোকতাম্। বিদুলার মতো এক ক্ষত্রিয় রমণীর জবানে কথা বলতে বলতে কুন্তী দেখছি আর যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশে তাঁর বক্তব্য বিস্তার করছেন না। রাজনীতির মূল উপদেশের সঙ্গে যখন বীরত্ব আর উত্তেজনার সংবাদ পাঠাতে হল পুত্রদের কাছে, তখন এই শেষ মুহূর্তে কুন্তী আর যুধিষ্ঠিরের কথা মনে আনলেন না। বিদুলার গল্প শেষ করেই কুন্তী কৃষ্ণকে বলেছেন—আমার কথায় তুমি অর্জুনকে একটা খবর শুধু মনে করিয়ে দেবে কৃষ্ণ। সেই ছোট্টবেলার কথা, অর্জুনের তখন কেবলই জন্ম হয়েছে। আমি ছেলে কোলে নিয়ে মেয়েদের মধ্যে বসেছিলাম। সেই সময়ে আকাশবাণী হয়েছিল—এই ছেলে তোমার সমস্ত শত্রু হত্যা করে পৃথিবী জয় করবে ভবিষ্যতে, এই ছেলের যশ হবে আকাশ-ছোঁয়া—পুত্রস্তে পৃথিবীং জেতা যশশ্চাস্য দিবং স্পৃশেৎ। ভীমের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে নাকি বাপের সম্পত্তি উদ্ধার করবে।

কুন্তী বললেন—সেই অর্জুনকে জানিয়ো কৃষ্ণ! যে আশায় ক্ষত্রিয় রমণীরা ছেলে ধরে পেটে, সেই সময় এখন এসে গেছে, ভীমকেও জানিয়ে ওই একই কথা—এতদ্‌ ধনঞ্জয়ো বাচ্যো নিত্যোদ্‌যুক্তো বৃকোদরঃ। কুন্তী আবারও তুললেন দ্রৌপদীর সেই অপমানের কথা। বললেন—সেই অপমানের থেকে আর কোনও বড় অপমানের কথা তিনি ভাবতে পারেন না এবং অর্জুনও যেন এই দ্রৌপদীর কথাটা খেয়ালে রাখেন—তং বৈ ব্রুহি মহাবাহো দ্রৌপদ্যাঃ পদবীং চর।

পাণ্ডব-সহায় কৃষ্ণ পিসি কুন্তীর সমস্ত উত্তেজনার আগুন পোয়াতে পোয়াতে রওনা দিলেন বিরাটনগরের উদ্দেশে, পাণ্ডবরা সেইখানেই রয়েছেন এখন। কৃষ্ণ চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কৌরবসভায় ‘রিপোর্ট’ চলে এসেছে কুন্তীর বক্তব্য নিয়ে। ভীষ্ম এবং দ্ৰোণ লাগাম-ছাড়া দুর্যোধনকে শাসন করার চেষ্টা করেছেন মনস্বিনী কুন্তীর চরম যুক্তিগুলি স্মরণ করিয়ে দিয়ে। তাঁরা বলেছেন—কুন্তীর কথার মধ্যে উগ্রতা থাকতে পারে, কিন্তু সে কথাগুলি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত এবং ধর্মসম্মত—বাক্যমর্থবদত্যুগ্রমুক্তং ধর্মমনুত্তমম্। ভীষ্ম-দ্রোণ দুর্যোধনকে জানালেন যে, মায়ের কথা এবার অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে তাঁর ছেলেরা। কৃষ্ণও সেইভাবে তাদের বোঝাবেন।

এতদিন পাণ্ডবরা যা করেননি, এখন তা করবেনই—এই স্পষ্টতা হঠাৎ করে আসেনি। যে ভাষায়, যে যুক্তিতে কুন্তী আজ পাণ্ডবদের যুদ্ধের জন্য উদ্যোগী হতে বলেছেন, তা একদিনের উত্তেজনা নয়। দিনের পর দিন সহ্য করতে করতে শশুর-কুলের বৃদ্ধ-জনের কাছ থেকে আর যখন কোনও সুবিচারের আশা রইল না, কুন্তী যখন বুঝলেন যে, পাণ্ডবদের জন্য তাঁর ভাশুরের অনুভব মমতাহীন মৌখিকতামাত্র, সেইদিন কুন্তী তাঁর সমস্ত সৌজন্য ঝেড়ে ফেলে দিয়ে চরম দিনের জন্য প্রস্তুত হয়েছেন। নইলে, এতদিন তিনি এত কঠিনভাবে কোনও কথা উচ্চারণ করেননি। কুন্তীর সমস্ত ধৈর্য অত্যন্ত সযৌক্তিকভাবে অতিক্রান্ত হয়েছে বলেই যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়ানোর মধ্যেও এখন ধর্মের সম্মতি এসেছে—উক্তং ধর্ম্ম্যমনুত্তমম্।