ভীম – ৯

বনপর্বে দ্রৌপদী যখন জয়দ্রথকে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন—তাঁর কোন স্বামীর চরিত্র কেমন, আমরা তখন একটি স্ত্রীর মুখে তাঁর পঞ্চ স্বামীর আচার ব্যবহারের এক এক রকম মূল্যায়ন লক্ষ করেছি। আজ যখন কৌরব-পাণ্ডবের যুদ্ধ প্রায় লাগো-লাগো, তখন আরও একবার ভীমের মূল্যায়ন শুনতে পাচ্ছি এবং তা শুনতে পাচ্ছি এক প্রবল পরাক্রান্ত শত্রুর পিতার মুখে। আমরা অনেক আগে বলেছিলাম যে, দুর্যোধন সমস্ত পাণ্ডবদের মধ্যে একমাত্র ভীমকে বেশি মূল্য দিতেন এবং তাঁর এই ভাবনা পরম্পরাক্রমে নেমে এসেছে তাঁর পিতার কাছ থেকে। কথাটা সত্যি কি না, তা এখন যাচাই করে নেবার মতো সময় এসেছে।

সঞ্জয় পাণ্ডবদের কাছ থেকে ঘুরে এসে যুধিষ্ঠিরের পক্ষে যেসব শক্তিশালী নরপতি যোগ দিয়েছেন, তাঁদের বলাবল সম্পর্কে ধৃতরাষ্ট্রকে অবহিত করলেন। পাণ্ডবদের সম্মিলিত শক্তির কথাও বাদ গেল না। ধৃতরাষ্ট্র সব ধৈর্য ধরে শুনলেন। তারপর ভেবেচিন্তে বললেন—সঞ্জয়! তুমি যাঁদের নাম করলে এঁরা যদি সব একদিকেও দাঁড়ান আর ভীম আর এক দিকে—তবুও বলব আমার ভয় ভীমকেই—ভীমসেনাদ্ধি মে ভুয়ো ভয়ং সঞ্জায়তে মহৎ। বাঘের থেকে যেমন হরিণের ভয়, এ ভয় তেমনই। তুমি জানো সঞ্জয়! শুধু ভীমের জন্য রাতে আমার ঘুম হয় না—জাগর্মি রাত্রয়ঃ সর্বাঃ। আমার পক্ষে একটা লোকও নেই, যে ভীমের শক্তি সহ্য করতে পারে।

ধৃতরাষ্ট্র এবারে যা বললেন, সে কথাগুলি আমাদের জানা। দ্রৌপদী ঠিক এই কথাগুলিই বলেছিলেন জয়দ্রথকে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন—ভীম কখনও ক্ষমা করতে জানে না আর শত্রুতা মনে রাখে চিরকাল। হাসির সময়েও ভীম হাসে না, সব সময় তাকায় বাঁকা ভাবে, স্বভাবে ভীষণ উদ্ধত আর কথা বলে গম্ভীর স্বরে—অনৰ্মহাসী সোন্মাদ-স্তির্যক্‌প্রেক্ষী মহাস্বনঃ। এমন যে ভীম, সে আমাদের বদমাশ ছেলেগুলিকে শেষ না করে ছাড়বে না। ধৃতরাষ্ট্র ভয় পাচ্ছেন, ভীষণ ভয় পাচ্ছেন ভীমকে। এই বিরাট যুদ্ধের আগে দুর্নিবার ভীম-ভয় তাঁকে ভীমের বাল্যকালের কথাও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ধৃতরাষ্ট্র বললেন—সঞ্জয়! ভাবলে আমার বুক কেঁপে ওঠে—উদ্বেপতে মে হৃদয়ম্। ছোটবেলাতেও তার তেজ ছিল সাংঘাতিক। যেমন খেতে পারত, তেমন ছিল নিষ্ঠুর। আমার ছেলেগুলিকে সেই ছোটবেলাতেও সে হাতির মতো পিষে দিত। সব সময় আমার ছেলেরা ভীমের কাছে কষ্ট পেত, সঞ্জয়! আর জানো তো, এই কষ্ট থেকেই কৌরবের শত্রুতা বদ্ধমূল হয়ে গেল পাণ্ডবদের ওপর—স এব হেতুর্ভেদস্য ভীমো ভীমপরাক্রমঃ।

কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। খেলার ছলে ভীম ছোটবেলাতেও যে পীড়া সৃষ্টি করেছেন কৌরবদের ওপর, সেই পীড়া দুর্যোধন কখনও ভোলেননি। সেই ছোটবেলাতেই দুর্যোধন ভীমকে বিষ খাইয়ে মারতে চেয়েছেন? যাতে তাঁর পথে কোনও কাঁটা না থাকে। অন্য দিকে ভীমও দুর্যোধনের কাছে উপর্যুপরি লাঞ্ছনা লাভ করে তাঁর শত্রুতাটাই শুধু মাথার মধ্যে রেখে দিয়েছেন। কোনওভাবেই তিনি তাঁদের ক্ষমা করতে পারেন না। কুরুক্ষেত্রের বিরাট যুদ্ধে তাই ভীমও নিজে ব্যক্তিগতভাবে একটি কারণ—স এব হেতুর্ভেদস্য। তবে সেই কারণে দুর্যোধন তালি বাজানোর কাজ করেছেন। বিষপান, অগ্নিদান থেকে আরম্ভ করে সভায় দ্রৌপদীকে এবং ভীমকে ব্যক্তিগতভাবে অপমান করে সেই যুদ্ধের কারণ গভীরতর করে ফেলেছেন।

মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র এসব জানেন। আর জানেন বলেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের প্রাক্কালে তাঁর ভয়ও গভীর হয়ে উঠছে। সঞ্জয়কে তিনি বলেছেন—সেই পাশাখেলার সময়েই যে সে আমার ছেলেগুলিকে মেরে ফেলেনি, এই আমার পরম লাভ—অতিলাভন্তু মন্যে’হম্। ভীম ছোটবেলাতেও আমার কথা শোনেনি, তার ওপরে আমার বদমাশ ছেলেগুলো তাকে নানাভাবে কষ্ট দিয়েছে। অতএব সে কেন এখন আমার কথা শুনবে—কিং পুনর্মম দুষ্পুত্রৈঃ ক্লিষ্টঃ সম্প্রতি পাণ্ডবঃ।

মনে রাখা দরকার—ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে মায়ের হাত ধরে পাঁচ ভাই পাণ্ডব যেদিন হস্তিনাপুরে এসে উপস্থিত হয়েছিলেন, সেদিন থেকেই সম্পূর্ণ রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় তাঁদের ওপর একের পর এক যে অত্যাচার হয়েছে, ভীম ছিলেন সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে এক মূর্ত প্রতিবাদ। হয়তো সেদিন থেকেই তাঁর মুখ থেকে হাসি চলে গেছে, কোনও কিছুই তিনি আর সোজা চোখে দেখতে পান না। যুধিষ্ঠির-অর্জুনরা শুধু এই পাগলা ঘোড়ার রাশ টেনে রেখেছেন। কিন্তু আজ কালের পরিণতিতে যে যুদ্ধ ঘনিয়ে উঠেছে, সেখানে কাল-রাত্রির অস্পষ্ট নক্ষত্র-আলোকে প্রজ্ঞাচক্ষু দিয়ে ধৃতরাষ্ট্র দেখতে পাচ্ছেন—তালগাছের মতো লম্বা গৌরবর্ণ এক যুবকের হাতে আটকোণা অথবা ছয়কোণা, চার হাত পরিমাণ একটি গদা, চারদিকে তার লোহার শিক লাগানো, আর সেই গদা এসে ঘুরে ঘুরে পড়ছে তাঁর ছেলেদের মাথায়—ভীমসেনো গদাপাণিঃ সুদয়িষ্যতি মে সুতান্। রাগে চোখ দুটি লাল, জিহ্বার সমস্ত রস আক্রোশে শুষে নিয়ে অসহনীয় বেগে ভীম ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাঁর সৈন্যদের মধ্যে—ধৃতরাষ্ট্র যেন চোখের সামনে এই দৃশ্য দেখতে পাচ্ছেন—পশ্যামীব অতিতাম্ৰাক্ষম্ আপতন্তং বৃকোদরম্।

ভীমের এই সাংঘাতিক রূপ যা ভেবে শত্রুপক্ষের সবাই আতঙ্কিত, এই রূপের হঠাৎ এক পরিবর্তন আমরা লক্ষ করব। যদিও এই পরিবর্তন হঠাৎ উল্কার মতো এসে ধূমকেতুর মতো চলে গেছে, তবুও এই পরিবর্তনের কারণ একটা আছে বলে আমরা মনে করি। পাণ্ডব-কৌরবের পক্ষ থেকে সন্ধি-শান্তির প্রস্তাব যখন ব্যর্থ হল, তখন কৃষ্ণ শেষ চেষ্টা করার জন্য ‘পিস মিশন’ নিয়ে হস্তিনায় যাবেন ঠিক করলেন। এই প্রসঙ্গে যুধিষ্ঠির অর্জুন ভীম—সবাই একবাক্যে শান্তির ওপরেই গুরুত্ব দিলেন বেশি—কৃষ্ণ জানতেন সন্ধি-শান্তি কিছুতেই হবে না, অন্তত দুর্যোধন বেঁচে থাকতে হবে না। কিন্তু দুর্যোধনকে শেষ বারের মতো শান্তির চেষ্টা প্রত্যাখ্যানের সুযোগ দিয়ে তিনি যুদ্ধের দায়টা সম্পূর্ণ দুর্যোধনের ওপর চাপাতে চাইছিলেন, কারণ তাতে পাণ্ডবদের রাজনৈতিক ফায়দা বেশি।

যাই হোক, শান্তির প্রস্তাব নিয়ে যখন আলোচনা চলছে, তখন যুধিষ্ঠির তাঁর মতামত জানালেন। আশ্চর্য হল, যুধিষ্ঠির অন্য সময় যত ‘কম্‌প্রোমাইজিং অ্যাটিচুড’ দেখিয়েছেন, এই সময়ে ততটা দেখাননি। ভাল কথায় হলে ভাল, না হলে যুদ্ধ—এইটাই ছিল যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য। সবার ওপরে অবশ্য শান্তির দিকে যুধিষ্ঠিরের ঝোঁক ছিল স্বভাবতই বেশি। কিন্তু বড় বিপ্রতীপভাবে যুধিষ্ঠিরের থেকেও এখানে আশ্চর্য ছিল ভীমের ব্যবহার। যে ভীম ছোটবেলা থেকে আজকের দিনটির জন্য মুখিয়ে ছিলেন, সেই ভীম কৃষ্ণকে বললেন—তুমি শান্তির কথাই বোলো, কৃষ্ণ! শুধু শুধু যুদ্ধের কথা বলে ওদের ভয় পাইয়ে দিয়ো না—মাস্ম যুদ্ধেন ভীষয়েঃ। অসহিষ্ণু উদ্ধত দুর্যোধনের সঙ্গে তুমি মিষ্টি করে কথা বোলো।

ভীম দুর্যোধনের চরিত্র জানেন, ঠিক যেমন দুর্যোধনও সবচেয়ে ভাল জানেন ভীমের চরিত্র। অতিক্ৰোধী মানুষকে যে মেজাজ দেখিয়ে কার্যোদ্ধার করা যাবে না—সেটা ভীম বোঝেন বলেই দুর্যোধনের মতো ‘অদীর্ঘদর্শী নিষ্ঠুরী’ মানুষের সঙ্গে ভীম শান্ত সুরে কথা বলবার উপদেশ দিচ্ছেন কৃষ্ণকে। বললেন—দুর্যোধন মরবে, তবু নিজে যা বুঝবে, সে মত ছাড়বে না—নৈব জহ্যাৎ স্বকং মতম্। কাজেই তুমি যা বলবে, কৃষ্ণ তা দুর্যোধনের ভাব বুঝে বোলো। ধীরে ধীরে বোলো, আস্তে আস্তে বোলো, রুক্ষভাবে খবরদার বোলো না—তস্মামৃদু শনৈর্ব্রূয়াঃ…নোগ্ৰমুগ্ৰপরাক্রম।

ভীমের হল কী? এ যে একেবারে উলটো গাইছেন। দুর্যোধন, দুঃশাসন, কর্ণ, শকুনি—যাঁদের নাম শোনামাত্র যিনি শতবার হত্যার প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করেন—সেই ভীম শান্তি চাইছেন, সেই ভীম দুর্যোধনের সঙ্গে ধীরে-মধুরে কথা বলার উপদেশ দিচ্ছেন এবং সেই ভীম বলছেন—আমরা না হয় দুর্যোধনের কাছে নিচু হয়েই থাকব—সর্বে বয়মধশ্চরাঃ।

ভীমের মুখে এই শান্তির বাণী যে কতটা অপ্রত্যাশিত, তা মহাভারতের নিবিষ্ট পাঠকমাত্রেই জানেন। ভীমের এই উলটো গাওয়ার একটা কারণ মহাভারতেই স্পষ্ট বলা আছে, সেটা পরে বলছি। আগে জানাই যে, কারণটা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আপনারা দুর্গাপুজোর ভাসানের সময় বিভিন্ন সমিতির আয়োজক যুবক-পুরুষদের রাস্তায় নাচতে-নাচতে যেতে দেখেন। সবাই এখানে নাচে না, কতিপয় নাচে। কোমর দুলিয়ে, বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে, নানা ছাঁদে নাচে। এইসব উৎসব-প্রিয় যুবক-শ্রেণীর মধ্যে অনেক মুখচোরা যুবক আমি দেখেছি, যারা সহজে নাচতে চায় না, কিন্তু সঙ্গ দেয়, হাততালি দেয়। কিন্তু এক-একটা তুঙ্গ মুহূর্তে আসে ; কোনও চতুস্পথের মিলন-স্থানে যখন তাসা-পার্টির বাজনা বেদম জমে ওঠে, দলের সমস্ত নাচিয়েরা উদ্দাম নাচতে-নাচতে মুখচোরার হাত ধরে টানাটানি করে, তখন সে আর থাকতে পারে না, সে নেচে ফেলে, ভালই নেচে ফেলে।

তুলনাটা কিন্তু এখানে উৎসবপ্রিয়তা বা আনন্দের সঙ্গে নয়, অথবা নয় মুখচোরা যুবকের সঙ্গেও। তুলনাটা হল অধিকাংশের চাপে পড়ে নেচে ফেলার সঙ্গে। বিরাটের রাজধানীতে বসে যাঁরা যুদ্ধের উদ্যোগ করছিলেন, তাঁদের মধ্যে পাকা-মাথা যাঁরা, তাঁরা সবাই মোটামুটি শান্তির প্রস্তাবে সামিল হয়েছিলেন। কৃষ্ণ-বলরাম, যুধিষ্ঠির, অর্জুন—এঁরা সকলেই চেষ্টা করছিলেন যাতে যুদ্ধটা অন্তত এড়ানো যায়। যুদ্ধে লোকক্ষয়ের ভাবনাটাই শুধু নয়, এঁদের বড় ভয় ছিল যে, যুদ্ধ লাগলে প্রসিদ্ধ কুরুবংশটাই একেবারে নষ্ট হয়ে যাবে। যে বংশে পুরু, দুষ্মন্ত, ভরত, কুরুর মতো রাজারা জন্মেছেন, সেই বংশ ঈর্ষা-দ্বেষে, জ্ঞাতিবিরোধে নষ্ট হয়ে যাবে—এটা যুধিষ্ঠির, অর্জুন, কৃষ্ণ—কেউই চাইছিলেন না। সবাই যখন ভরত-বংশ যাতে নষ্ট না হয়, কুলের মর্যাদা-ভঙ্গের কারণ যেন আমাদের ওপর না বর্তায়—এই ভাবনায় মরছিলেন, তখন এই উদার বৈরাগ্যময় ভাবনার মধ্যে—আমি দুঃশাসনের রক্ত খাব, দুর্যোধনের ঊরু ভাঙব—ভীমের এই সব আসুরিক এবং রাজসিক প্রতিজ্ঞা নিতান্তই বেমানান হয়ে যায়। বরঞ্চ সবাই যেখানে ওই একই কথা বলে উত্তম হওয়ার চেষ্টা করছেন, সেখানে ভীমই বা অধম হয়ে থাকবেন কেন? অতএব তিনিও বলে উঠলেন—আমরা বরং অবনত হয়ে দুর্যোধনের কথাই মেনে চলব, আমাদের ভরতবংশটা যেন নষ্ট না হয়—নীচৈর্ভূত্বা অনুযাস্যামো মাস্ম নো ভরতা নশন্। কৌরবদের সঙ্গে বরং কোনও সংস্রব না রেখেই আমরা চলব, কিন্তু এই বিখ্যাত কুরুবংশের গায়ে যেন কালি না লাগে—ন কুরূন্‌ অনয়ঃ স্পৃশেৎ।

একই কথা এর আগে যুধিষ্ঠিরও বলেছেন। কিন্তু আজ ভীম যে যুধিষ্ঠিরের তালে নেচে ফেললেন, অনেকের সঙ্গে মত মেলালেন—এটা সেই বিরাটসভার মধ্যে এতটাই বেসুরো লাগল যে, মহামতি কৃষ্ণ রীতিমতো কটাক্ষ করে বসলেন ভীমকে। বললেন—হল কী দাদা! এরপর যে শুনব—ওজনদার পাহাড়ও বড় হালকা ; শুনব—আগুন তো গরম নয়, বড় ঠাণ্ডা—গিরেরপি লঘুত্বং তচ্ছীতত্বমিব পাবকে। চিরটাকাল ধরে তুমি দাদা—‘হ্যান্ করেঙ্গা ত্যান্ করেঙ্গা’ বলে যুদ্ধের প্রশংসা করে এসেছ। কৌরবদের ওপর রাগে তুমি ভাল করে ঘুমোও না পর্যন্ত, যদি বা ঘুমোও, তো উবুত হয়ে শোও। ঘুমের মধ্যেও তুমি কত না বকর-বকর করো, আর লোকে তোমাকে পাগল বলে। এক সঙ্গে অনেক লোকের সঙ্গে তুমি থাকতেও ভালবাস না। তোমার রাগ তোমাকে নির্জনে বসিয়ে রাখে। কখনও হাস, কখনও কাঁদ, কখনও বা মাথাটা হাঁটুর মধ্যে গুঁজে চোখ বন্ধ করে বসে থাক। তুমি ভুরু কুঁচকে থাক সব সময়, ঠোঁট কামড়াও যখন তখন। আমি কি বুঝি না? এগুলো সব তুমি কর রাগে, দুর্যোধনের ওপর রাগে—সর্বং তৎ মনুকারিতম্। এত যে গদা স্পর্শ করে দুর্যোধনের ঊরু ভাঙার প্রতিজ্ঞা করেছিলে সেই তোমার বুদ্ধি হঠাৎ বড় শান্ত হয়ে গেল। হয়, এমনই হয়—যুদ্ধ যখন সামনে এসে পড়ে, তখন হাঁক-ডাক করা অনেক মানুষেরই ভয় হয়। তোমারও তাই হয়েছে। নইলে তোমার মতো লোক শান্তির কথা বলছে মানে, স্থাবর পর্বতও চলমান হয়েছে বলে বিশ্বাস করতে হবে—ইদং মে মহদাশ্চর্যং পর্বতস্যেব সর্পণম্।

কৃষ্ণের কথা শুনে ভীমের এত রাগ হল যে, তিনি ঘোড়ার মতো খানিকটা এদিক-ওদিক ছুটে নিলেন—সদশ্ববৎ সমাধাবৎ। বললেন—তুমি অন্তত আমাকে ভালই চেন কৃষ্ণ! অনেককাল আমাকে দেখছ, ভালই চেন তুমি আমাকে—বেৎসি দাশার্হ সত্যং মে দীর্ঘকালং সহোষিতঃ। তুমি যা বলছ, বলে যাও। নিজের ঢাক নিজে পেটাতে নেই তাই; নইলে জেনে রেখো—আমার এই পাথরের মতো হাত দুটো দেখছ না, আর এই যে হাতের মাঝখানে মুগুরের মতো দুটো গুলি—এই হাতের জাঁতাকলে পড়েও কেউ বেরিয়ে যাবে, এমন লোক তো দুনিয়ায় দেখি না—য এতৎ প্রাপ্য মুচ্যেত ন তৎ পশ্যামি পূরুষম্। এর আগে যারা আমার পাল্লায় পড়েছে, তাদের আমি কী করেছি, তা তুমি জানো না, এমন তো নয়—ন হি ত্বং নাভিজানাসি—কাজেই সময় এলে দেখতেই পাবে। তুমি শুধু শুধু কটাক্ষ করছ আমাকে। যুদ্ধে আমার শরীরে ক্লান্তি আসে না, বুক কাঁপে না একটুও। বস্তুত আমি আমার নিজের সম্বন্ধে যতটুকু বললাম, আমি তার থেকে একটু বেশিই বটে—বিদ্ধি মামধিকং ততঃ। আর এতক্ষণ যে আমি শান্তির কথা শুনালাম, সে শুধুই এই প্রখ্যাত ভরতবংশের ওপর ভালবাসায়, আর অবশ্যই খানিকটা দয়ায়—কিন্তু সৌহৃদমেবৈতৎ কৃপয়া মধুসুদন।

মহামতি কৃষ্ণ আর কথা বাড়াননি। বললেন—রাগ কোরো না, দাদা। তোমাকে উসকে দিয়ে একটু মজা করছিলাম মাত্র—প্রণয়াদিদমব্রুবম্। আসলে—কৃষ্ণ জানতেন যে, যুদ্ধ লাগবেই। বিরাটের সভায় বসে সবার মতো তিনিও সবার কথা শুনছিলেন। তিনি জানতেন—কারা যুদ্ধের কথা বলবেন, আর কারা শান্তির প্রস্তাব দেবেন। ভীম যা বলেছিলেন, সেটা কৃষ্ণের কাছে অপ্রত্যাশিত ছিল। শান্তির পত্র-পুষ্প সমারোহে শেষ পর্যন্ত যদি অবধারিত যুদ্ধের মেজাজটুকু আগে থাকতেই নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে যুদ্ধ লাগলে যে অপ্রস্তুত হতে হবে—সেটা কৃষ্ণ জানতেন বলেই ভীমের অপ্রত্যাশিত শান্তির বাণীতে তিনি খানিকটা বিব্রতই হয়েছেন। তিনি মজা করেননি মোটেই, তিনি ভীমের আসল ভাবটা সভার মধ্যেই যাচাই করে নিলেন—তস্মাদাশঙ্কমানো’হং বৃকোদর মতিং তব।

ভীমের মুখে ধর্ম-কথা শুনে আরও একজন বড় আঘাত পেয়েছিলেন মনে। তিনি দ্রৌপদী। ক্রোধে তিনি চিৎকার করে বলেছিলেন—আমি যদি দুঃশাসনের কালো হাতখানা কাটা অবস্থায় মাটিতে ধুলো-ময়লায় মলিন হয়ে যেতে না দেখি—দুঃশাসনভুজং শ্যামং সংচ্ছিন্নং পাংশুগুণ্ঠিতম্—তাহলে আমার কীসের শান্তি? আজকে এই ভীমের মুখে শান্তি-সন্ধির কথা শুনে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। আজকে ভীমও ধর্মের কথা শোনাচ্ছেন—যো’য়মদ্য মহাবাহু ধর্মং সমনুপশ্যতি। ‘কালো হাত’ ভেঙে দেবার প্রবাদ আজকের নয়, বহুকালের—দুঃশাসনভুজং শ্যামং।

সত্যি কথা বলতে কী, ভীম তো এরকম নন। কিন্তু ওই যে বললাম, তিনি সবার সঙ্গে নেচে ফেলেছেন। মহামতি কৃষ্ণ অবশ্য দ্রৌপদীর সামনে ভীমের কথাটা খানিকটা ‘মেক-আপ’ করে দিয়েছেন এবং সেইটাই যা ভীমের বাঁচোয়া। ভীম স্বরূপে ফিরে এলেন কৃষ্ণের দৌত্যকর্ম ব্যর্থ হবার পর। কৌরব সভায় কৃষ্ণ যখন সন্ধি-শান্তির কথা বলছিলেন, তখন তাঁর অনুক্রমে ভীষ্ম-দ্রোণরা দুর্যোধনকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এবং তার মধ্যে ভীমের ভয় দেখাতেও তাঁরা ছাড়েননি। কৃষ্ণ ফিরে আসবার সময় জননী কুন্তীও বারবার ভীমের উদ্দেশে জানিয়েছেন যে, সে যেন দ্রৌপদীর অপমানের কথাটা খেয়াল রাখে। কুন্তীর বিশ্বাস ছিল অর্জুনের মতো ধনুর্ধরের সঙ্গে যদি একবার ভীমের যোগ হয়, তবে কৌরব কুলের ধ্বংস অনিবার্য—ভীমসেন-দ্বিতীয়শ্চ কুলমুদ্ৰবৰ্তয়িষ্যতি।

যুদ্ধের ঠিক আগে আগে শকুনির ছেলে উলূক পাণ্ডবদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন দুর্যোধনের দূত হয়ে। অবধ্য দূত দূর্যোধনের জবানীতে যেসব কথা পাণ্ডবদের বলেছিল, তা শুনে ভীম দাঁতে দাঁত ঘষে যেভাবে তাঁর বাহু দুটি উত্তোলন করেছিলেন, তাতে তার মৃত্যু আসন্ন ছিল। শুধুমাত্র অর্জুনের হস্তক্ষেপে উলূক তার বিপন্ন অবস্থা থেকে বেঁচে যায় বটে, কিন্তু দুর্যোধনের কাছে ফিরে যাবার সময় কৃষ্ণ তাকে পরিষ্কার বলেই দিলেন যে,—বাপু! দুর্যোধন যদি মনে করে থাকেন—ভীমের প্রতিজ্ঞা মাঠে মারা যাবে, তবে সেটা চরম ভুল হবে। দুর্যোধন যেন নিশ্চিত ধরেই নেন যে, দুঃশাসনের বুক চিরে রক্তপান করার কাজটা আজই হয়ে গেছে—দুঃশাসনস্য রুধিরং পীতমদ্যাবধারয়।

আসলে এ সবের কোনও প্রয়োজন ছিল না। ভীম এমনিতে বেশি কথাই বলেন না, কিন্তু কী করতে হবে সেটা তিনি জানেন। কুরুক্ষেত্রের সম্পূর্ণ যুদ্ধখণ্ডে ভীম কী করেছিলেন, কত যুদ্ধ করেছিলেন, কটা হাতিকে গদার ঘায়ে ধরাশায়ী করেছিলেন—সে সব তথ্যপঞ্জীতে আমার খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ভীম যে প্রায় অনন্য—সেই সব চিত্র যদি দু-একটা তুলে না ধরি, তা হলে ভীম যে কারণে ভীম—সেই যুক্তিটাই নষ্ট হয়ে যাবে। তা ছাড়া সম্পূর্ণ যুদ্ধ-খণ্ডের মধ্যে ভীমকে যেমন আমরা মাঝে মাঝেই জ্বলে উঠতে দেখব, তেমনই নানান জায়গায় তাঁর স্থিরতাও আমাদের আন্দোলিত করবে। সবচেয়ে বড় কথা—যুদ্ধের মধ্যে যে ‘টোটাল্’ ব্যাপারটা আছে, যেখানে প্রতিনিয়তই অহং-মম এবং ব্যক্তিগত মায়া-মোহের ওপরে উঠতে হয়—সেই ‘প্রোফেশনালিজম্’ অত্যন্ত আধুনিক অর্থেই আমরা ভীমের মধ্যে লক্ষ করব।