কর্ণ – ৬

পাণ্ডবেরা বনে চলে গেলে ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্যে সামান্য একটা প্রজাবিদ্রোহ হয়েছিল। দ্যুতসভায় পাণ্ডবদের যেভাবে জয় করা হয়েছে এবং যেভাবে কুলবধু দ্রৌপদীকে অপমান করা হয়েছে, তাতে একটা বিরুদ্ধ জনমত অবশ্য তৈরি হয়েছিল। সেকালে ব্রাহ্মণ্য সমাজ, যাঁরা অনেক ক্ষেত্রেই রাজন্য বর্গের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করতেন, তাঁরা যে ধৃতরাষ্ট্রের দুর্বুদ্ধিতায় ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন, সে প্রমাণ তো স্বয়ং ধৃতরাষ্ট্রের বক্তব্যেই রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা হল, এঁরা বুঝতে পারছিলেন যে, হস্তিনাপুরের রাজ্যশাসন ধৃতরাষ্ট্রের হাতে নয়, সে শাসনের যন্ত্রী হলেন দুর্যোধন, শকুনি এবং কর্ণ। একটা সময়ে দেখা যাচ্ছে যে, এই ব্রাহ্মণ্যসমাজের একাংশ কুরুজাঙ্গলের প্রজাদের সঙ্গে নিয়ে কাম্যক বনে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ব্রাহ্মণ, বৈশ্য এবং অন্যান্য সাধারণ লোকেরা, যার সেদিন কাম্যকবনে রীতিমতো বিশাল এক জনসমাগম তৈরি করেছিল—সমবায়ঃ সুমহাদ্ভুতদর্শনঃ—তারা এখন আর কেউ ধৃতরাষ্ট্রকে দোষ দিচ্ছে না, তাদের শ্লোগান ছিল— দুর্যোধন, শকুনি আর কর্ণের অশুভ আঁতাত নিপাত যাক—নিপাত যাক——ধিক্ ধার্ত্তরাষ্ট্রং সুনৃশংসবুদ্ধিং ধিক্ সৌবলং পাপমতিঞ্চ কর্ণম্। শুধু প্রজারা কেন, ধৃতরাষ্ট্রের মন্ত্রিসভার অন্যতম মন্ত্রী বিদুর পর্যন্ত এক সময় ধৃতরাষ্ট্রকে ছেড়ে পাণ্ডবদের কাছে চলে গিয়েছিলেন। তাঁর দোষ ছিল, তিনি ধৃতরাষ্ট্রকে বলেছিলেন—আপনি আপনার ছেলে দুর্যোধন, শালা শকুনি আর ওই সারথির বেটা কর্ণকে বলুন যাতে তারা পাণ্ডবদের অনুগামী হয়ে চলে—দুর্যোধনঃ শকুনিঃ সূতপুত্রঃ প্রীত্যা রাজন্ পাণ্ডুপুত্রান্ ভজন্তু। দেখুন বিদুরের ক্ষোভ যে তিনজনের বিরুদ্ধে, ব্রাহ্মণ-সজ্জন এবং অন্যান্য সাধারণ লোকেরও ক্ষোভ তাদের বিরুদ্ধেই। অতএব পাণ্ডবেরা যে বনেই থাকুন, কাম্যকবনে কি দ্বৈতবনে, দলে দলে ব্রাহ্মণেরা ধৃতরাষ্ট্রের রাজ্য ছেড়ে এসে যোগ দিতে থাকলেন পাণ্ডবদের সঙ্গে—অপেত্য রাষ্ট্ৰাদ্ বসতান্তু তেষাম্/ঋষিঃ পুরাণো’ তিথিরাজগাম। জিনিসটা কৌরবদের পক্ষে ভাল হচ্ছিল না। সমস্ত বনগুলিতে পাণ্ডবদের ধনুষ্টংকার এবং ব্রাহ্মণদের ওঙ্কার নাদ একসঙ্গে মিশে যেতে থাকল—জ্যাঘোষশ্চৈব থানাং ব্রহ্মঘোযশ্চ ধীমতাম্।

কিন্তু মজা হল, এতে কর্ণের কী আসে যায়? দুর্যোধনের কাঁধে ভর রেখে তিনি নিজের বৃদ্ধিবাসনা চরিতার্থ করছেন, হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে কিংবা শান্তনু-ভীষ্মের খানদানে ভাল-মন্দ কী হল, তাতে কর্ণের কিছু আসে যায় না। পাঠক-সাধারণ অনেকেই ভাবেন, কর্ণ যা করেছেন, বন্ধু দুর্যোধনের প্রীতির জন্য করেছেন এবং এই কারণেই কর্ণকে মহাভারতের এক করুণ চরিত্রে রূপান্তরিত করতে কখনওই অসুবিধে হয় না। হ্যাঁ, কর্ণ করুণ চরিত্র বটেই, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখা দরকার যে, দুর্যোধনের সঙ্গে কর্ণের যে বন্ধুত্ব ঘটেছিল সেটা শুধুমাত্র বন্ধুত্বের জন্যই নয়, সেটা যে কোনও ভাবে অর্জুনকে ঢিট করার জন্য। এই যে উন্মুক্ত রাজসভায় দ্রৌপদীকে লাঞ্ছনা করার বিচিত্র কৌশল বার করলেন কর্ণ, সেটা দুর্যোধনের প্রীতির জন্য যতখানি, তার থেকে অনেক বেশি নিজের প্রীতির জন্য। কারণ, দ্রৌপদী হলেন সেই মহিলা যিনি তাঁকেও উন্মুক্ত রাজসভায় ‘সূতপুত্র’ বলে অপমান করেছিলেন ; সেই মহিলা, যিনি তাঁকে ইচ্ছে করে বিয়ে করেননি ; সেই মহিলা, যিনি উলটে বিয়ে করে বসলেন এমন একজনকে যিনি তাঁর চিহ্নিত শত্ৰু, চিরকালের প্রতিদ্বন্দ্বী। এমন একজন মহিলাকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি দুর্যোধনের বন্ধুত্ব-পদ ব্যবহার করেছেন মাত্র। বস্তুত দুর্যোধনের দিক থেকে পাণ্ডবদের প্রতি জ্ঞাতিশত্রুতা থাকার ফলে শত্রুতার অঙ্কে মিল হওয়ায় তিনি কর্ণের দ্বারা বারংবার নিজের অজান্তেই ব্যবহৃত হয়েছেন।

কর্ণ এতকাল দুর্যোধনের সমস্ত ব্যাপারে নাক গলিয়ে দুর্যোধনের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সুখ-দুঃখ, মান-অপমান, ভাবনা—সব বুঝে নিয়েছেন। এই বোঝাটা তাঁকে কুচুটে-স্বভাবের লোকের মতো কৌশলে ভাবনা করে বুঝতে হয়নি, দুর্যোধন এতটাই মোটা দাগের মানুষ এবং কর্ণ এতটাই উচ্চাভিলাষী যে, এই বোঝাটা ছিল নিতান্তই পারস্পরিক। কর্ণ পাশার আসরে বসে সমস্ত কুরুবৃদ্ধদের অপমান করলেন। ঘরের ছেলে দুর্যোধনের পক্ষে এই অপমান করাটা লৌকিকতা কিংবা চক্ষুলজ্জায় বাধত, কিন্তু কর্ণের সেই দায় নেই, কাজেই দুর্যোধন নিজের মতো করে যেটাকে কুরুকুলপতিদের মুখোস বলে মনে করেন, সে মুখোস খুলে দিতে কর্ণের একটুও বাধে না, কারণ কর্ণ কুরুদের কেউ নন। আবার এই অপমান করার মধ্যেও যে সীমা অসীমের দ্বন্দ্ব আছে, সেটাও কর্ণ বোঝেন দুর্যোধনের দৌলতেই। কাকে কতটা অপমান করতে হবে অর্থাৎ দূর্যোধন কাকে কতটা অপমান করতে চান, সেটা দুর্যোধনই এত প্রকট করে ফেলেন যে, কর্ণের পক্ষে কোনও অসুবিধেই হয় না সে দায় বহন করার। এই যে বিদুর ফিরে এলেন বনবাসী পাণ্ডবদের কাছ থেকে, আর দুর্যোধন একেবারে মুষড়ে পড়লেন তার কারণ কী? দুর্যোধন যেখানে নিজেই বলেন যে, এই বিদুরটা হল পাণ্ডবদের বন্ধু, পাণ্ডবদের হিতকামী, তখন কর্ণ আরও বেশি বোঝেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর—এদের সবাইকে যেখানে দুর্যোধন স্বয়ংই পাণ্ডবপক্ষপাতী ঘরের শত্রু বলে মনে করছেন, সেখানে শুধুমাত্র পাণ্ডব-বিদ্বেষের নিরিখেই কর্ণ যে এই মানুষগুলির ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবেন, তাতে আশ্চর্য কী? কিন্তু কর্ণের যেহেতু কোনও সীমাবদ্ধতার দায় নেই, তাই একদিকে তিনি যেমন দুর্যোধনের মানসিকতার মই বেয়ে কুরুসভায় কেউকেটা হয়ে উঠছিলেন, তেমনি অন্যদিকে ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর—এঁদের সবার বড় অপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন।

যাই হোক, বিদুর ফিরে আসায় দুর্যোধন খুব মুষড়ে পড়েছেন বটে কিন্তু কর্ণের মনে সে প্রতিক্রিয়া হয়নি। শকুনি, দুঃশাসন সবার সঙ্গে কর্ণও দুর্যোধনকে বুঝিয়েছেন যে, প্রথমত যুধিষ্ঠির প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে ফিরে আসার লোক নন। আর যদি ফিরে আসেন তবে ফের পাশাখেলায় তাদের হারিয়ে বনে পাঠাব—পুনর্দ্যূতেন তান্ জয়। কর্ণ এ-কথাটা বলেছিলেন শকুনির মুখ চেয়ে কারণ দুর্যোধন শকুনির পরামর্শেই পাশা খেলে সফল হন। কিন্তু এবার কর্ণ দেখলেন যে, দুর্যোধন এই প্রস্তাবে খুশি হলেন না। কারণ একবার নয়, দুবার পাশা খেলার পর সমস্ত জনসাধারণ এবং সমাজমুখ্য ব্রাহ্মণদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তাতে আর যে পাশাখেলা সম্ভব নয় সেটা দুর্যোধন বেশ বুঝেছিলেন। অতএব এ প্রস্তাব তাঁর একটুও ভাল লাগল না—নাতিহৃষ্টমনাঃ…পরাঙমুখঃ। কাজেই কর্ণ এবার দ্বিতীয় প্রস্তাব দিলেন—কর্ণ বললেন—পাণ্ডবেরা এখন বনে আছে, এই আমাদের সুযোগ। কর্ণ চোখ পাকিয়ে বেশ ঝাঁঝালো সুরে বললেন, ঝাঁঝালো এই জন্যে যে তিনি আগেও এ প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু কেউ মানেনি। কর্ণ বললেন—আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বনবাসী পাণ্ডবদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। পাণ্ডবেরা এখন বিশাল ঝামেলার মধ্যে রয়েছে, মনেও শান্তি নেই, বন্ধুবান্ধব রাজন্যবর্গও তাদের সহায় নেই, এই সময়েই তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মেরে ফেলব ওদের। বাস্, দুর্যোধনেরও শান্তি, আমাদেরও শান্তি—নির্বিবাদা ভবিষ্যন্তি ধার্তরাষ্ট্ৰাস্তথা বয়ম্।

‘আমাদেরও শান্তি’ বলতে কর্ণ নিশ্চয়ই তাঁর নিজের এবং শকুনির কথা বলেছিলেন, যাঁরা দুর্যোধনের বাড়িতে বাইরের মানুষ, কিন্তু তাঁর হিতকামিতার অছিলায় স্বয়ং উচ্চাভিলাষী। কর্ণের কথা দুর্যোধনের মনে ধরল। তাঁরা যুদ্ধযাত্রায় বেরলেন বটে কিন্তু কৌরবসভায় মহামতি বেদব্যাস এসে উপস্থিত হওয়ায় যাওয়াটা তাদের হল না। যদিও এই বাধাটা ছিল নিতান্তই সাময়িক। সুযোগ আবার এল যখন এক ব্রাহ্মণ বনে বনে ঘোরা পাণ্ডবদের দুরবস্থার কথা এসে শোনালেন ধৃতরাষ্ট্রকে। সেই মুহূর্তে ধৃতরাষ্ট্রের সভায় দুর্যোধনও ছিলেন না, কর্ণও ছিলেন না, ছিলেন একমাত্র শকুনি। শকুনি প্রথমেই এসে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলেন কর্ণকে—অবোধয়ৎ কর্ণমুপেত্য সর্বম্। পাণ্ডবেরা বিপাকে কষ্ট পাচ্ছেন শুনে কর্ণ খুব খুশি হলেন এবং মনের হরষ বাড়ানোর জন্য তিনি দুর্যোধনকে এক নতুন প্রস্তাব দিলেন। শকুনি তাঁর সঙ্গে ছিলেন বটে কিন্তু সমস্ত ‘প্ল্যানটা’ যে তাঁরই সেটা বেশ বোঝা যায়। কর্ণ বললেন—মহারাজ দুর্যোধন! এই সমস্ত বসুন্ধরা এখন তোমার হাতের মুঠোয়, সামন্ত রাজারা তোমার আদেশের প্রতীক্ষা করছে সব সময়। ধন-সম্পদ, প্রাচুর্য-প্রতিপত্তি যাই তোমার থাকুক, সেগুলি দেখে যদি পাণ্ডবদের কষ্টই না লাগল তা হলে সে সম্পদের মানে কী। তোমার ভর্তি আছে, তাদের কিছু নেই—এই অবস্থাটা, এই বাড়বাড়ন্ত তাদের দেখানো দরকার। সত্যি বলতে কি, রাজ্যপাট, ধনসম্পত্তি—এসব থেকে কিছুই সুখ নেই, যদি না তোমার বাড়বাড়ন্ত দেখে বনবাসী এবং দুর্বিপাকগ্রস্ত পাণ্ডবদের চোখ না টাটায়।

কর্ণ বললেন—তুমি এক কাজ কর। পাণ্ডবেরা দ্বৈতবনে যেখানে কুটির বেঁধে রয়েছে, সেইখানেই যাওয়া যাক। তুমি যাবে দারুণ দামি পোশাক পরে, সঙ্গে থাকবে টাকা-পয়সা দাসদাসী। এই অবস্থায় গাছের বাকল-পরা অর্জুন তোমাকে দেখলে, তোমার কী আনন্দই না হবে—কিং নু তস্য সুখং ল স্যাৎ! কুরুবাড়ির বউরা সব ঘটা করে সেজেগুজে বাকল-পরা দ্রৌপদীর সামনে দিয়ে ঘুরে বেড়াবে। রাজসভার মধ্যে বেচারা দ্রৌপদীর যা অপমান হয়েছিল, সুসজ্জিতা কৌরবস্ত্রীদের দেখলে সে দ্বিগুণ জ্বালায় জ্বলবে। ভাববে, পাণ্ডবদের বিয়ে করে কী হল আমার—সা চ নির্বিদ্যতাং পুনঃ।

সেই অর্জুন, সেই দ্রৌপদী। কী উপায়ে, কী কৌশলে অর্জুন কষ্ট পান, দ্রৌপদী কষ্ট পান কর্ণের কেবল সেই চিন্তা। কর্ণের সুবিধে, তাঁর এই পাণ্ডব নিপীড়নের বাসনা দুর্যোধনের সঙ্গে মিলে যায়। বস্তুত এগুলি সবই কর্ণের মনের ইচ্ছে এবং এই ইচ্ছেগুলি তিনি চাপিয়ে দিয়েছেন দুর্যোধনের ওপর। দুর্যোধন এই কথাগুলি আগে একটুও ভাবেননি, এই মুহূর্তে কর্ণ এত সব বলায়, তাঁরও মনে হল—আরে তাই তো, এভাবে তো পাণ্ডবদের খানিকটা হেনস্থা করা যেতে পারে। সুপ্ত অভিলাষে সুড়সুড়ি লাগার সঙ্গে সঙ্গে দুর্যোধনের মনে হয়—এইরকম একটা দারুণ বুদ্ধি তো আমার মাথাতেই আসা উচিত ছিল। অতএব নিজের অপ্রস্তুত ভাব ঢাকতে বেশি সপ্রতিভ হয়ে দুর্যোধন বলেন—ভাই কর্ণ তুমি যা বলেছ, এসব তো আমার মনেও ছিল, কিন্তু নেহাত পিতা ধৃতরাষ্ট্র সেখানে যেতে অনুমতি দেবেন না বলেই যেতে পারছি না। নইলে আমার কি আর ইচ্ছে করে না যে পাণ্ডবদের একটু মেজাজ দেখিয়ে আসি, গাছের বাকল-পরা দ্রৌপদীকে পর্যাপ্তি দেখিয়ে আসতে আমারই কি ইচ্ছে করে না—দ্রৌপদীং কর্ণ পশ্যেয়ং কাষায়বসনাং বনে। কিন্তু কী উপায়ে সেখানে যাব সেইটাই তো ভেবে পাচ্ছি না। তোমরা যদি একটা উপায় বার করতে।

কর্ণ বুদ্ধিমান মানুষ, তাতে পরজীবী! তিনি বেশ জানেন—এসব দুর্যোধনের মাথায় কিছুই ছিল না, তিনি বলার সঙ্গে সঙ্গে পাণ্ডব-কৌরবের সেই কাল্পনিক দুঃখসুখের অবস্থা বৈষম্য দুর্যোধনের মনে ধরেছে। পরগাছা হওয়ার দরুন কর্ণ বেশ জানেন—কোন গাছের, কোন জায়গায় তাঁর স্বপ্নবীজ ফলবে, যেমন এক্ষুনি যে দুষ্টবীজ উপ্ত হল দুর্যোধনের মাথায়, তাকে সফল করার দায়িত্বও কর্ণেরই।

তাই পরদিন সকালবেলায় উঠেই তিনি চলে এলেন দুর্যোধনের কাছে। প্রসঙ্গত বলা ভাল, দুর্যোধনের রাজকার্যে কর্ণ এতটাই গুছিয়ে বসেছিলেন যে, তাঁর রাজ্যে কোথায় কী ঘটছে সবই তিনি জানেন। সকালবেলায়—এসেই তিনি বললেন-উপায় পাওয়া গেছে। দ্বৈতবনে যেখানে পাণ্ডবেরা থাকে, সেখানেই রয়েছে হস্তিনাপুরের খাস প্রজা গয়লাদের বাড়ি-ঘর। রাজবাড়ির গরুবাছুরদের পালন করে তারাই। সে গয়লারাও বহুদিন ধরে তোমাকে যেতে বলছে—ত্বপ্রতীক্ষা নরাধিপ। আমরা সেই অছিলায় দ্বৈতবনে যাব, পাণ্ডবদেরও মুখোমুখি হব। শকুনিও কর্ণকে সমর্থন করলেন। দুর্যোধন বললেন—বেশ, আমি কালকে যখন রাজসভায় ধৃতরাষ্ট্র এবং অন্যান্য কুরুবৃদ্ধদের সঙ্গে বসে থাকব তখন তোমরা এই প্ল্যান দেবে। আমি সেই মুহূর্তে যা করার করব।

কৰ্ণ-শকুনি অত কাঁচা লোক নন। তাঁরা ইতিমধ্যেই দ্বৈতবনের এক গোয়ালাকে ‘ফিট’ করে এনেছেন, যার প্রসঙ্গ তুলে কর্ণ গলা মিলিয়ে ধৃতরাষ্ট্রকে বললেন—ঘোষপল্লীতে একবার যাওয়া দরকার (যেন দ্বৈতবন তাঁরা চেনেন না), গরুবাছুরদের গণনা করে তাদের গায়ে ছাপ মারারও দরকার—স্মরণে সময়ঃ প্রাপ্তো বৎসানামপি চাংকনম্। তা ছাড়া দুর্যোধন যদি যান তো একটু মৃগয়া-টৃগয়াও হতে পারে, আপনি অনুমতি দিন মহারাজ। ধৃতরাষ্ট্রের কাছে খবর ছিল যে, অর্জুন দেবতাদের তুষ্ট করে অনেক অস্ত্রশস্ত্রও লাভ করেছে, সেখানে ঘোষপল্লীতে গিয়ে যদি কৌরবেরা আবার পাণ্ডবদের বিনা কারণে খোঁচায়, এটা তিনি চাইছিলেন না। শকুনিও অনেক বোঝালেন বটে, তবে নিতান্ত অনিচ্ছায় ধৃতরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত অনুমতি দিলেন। কর্ণ, দুঃশাসন এবং শকুনিকে সঙ্গে নিয়ে দুর্যোধন চললেন দ্বৈতবনে পাণ্ডবদের বাবু-মেজাজ দেখাতে। সঙ্গে থাকল সৈন্য-সামন্ত, রথ, হস্তী। সমস্ত কুলবধূরা সেজেগুজে চলল। গাড়ি-ঘোড়া, দোকান-পাট, বেশ্যা-দাসী সবাই চলল দুর্যোধনের সঙ্গে। দ্বৈতবনে এলাহি ব্যবস্থা হল থাকা-খাওয়া, নাচা-গানার। ঘোষপল্লীতে প্রাথমিক কাজকর্ম সেরেই মৃগয়া চলল কিছুদিন। তারপরেই দুর্যোধন ‘অর্ডার দিলেন—দ্বৈতবনের যে সরোবরের একধারে পাণ্ডবেরা রয়েছেন তারই আরেক ধারে বেশ কিছু বাড়ি বানিয়ে ফেলতে। কারিগরেরা চলল বটে বাগানবাড়ি বানাতে, কিন্তু সে জায়গা আগেই এসে দখল করেছিলেন—গন্ধর্ব চিত্রসেন। একজনকে দেখাতে এসে আরেকজনের সঙ্গে গণ্ডগোল বেধে গেল। রীতিমতো যুদ্ধ, তুমুল যুদ্ধ। পাণ্ডবেরা পরপারেই রয়েছেন, তাঁদের সামনেই যুদ্ধ হচ্ছে, কাজেই দুর্যোধনের তরফে এটা দারুণ ‘প্রেস্টিজে’র ব্যাপার। প্রধান প্রধান সৈনিকদের দিয়ে কিছু হল না, অতএব ‘প্রেস্টিজ’ বাঁচাতে যুদ্ধ করতে এলেন কর্ণ। প্রচণ্ড যুদ্ধ হল। কর্ণ অনেক গন্ধর্বদের মেরে ফেললেন বটে কিন্তু গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন মায়াযুদ্ধ জানেন। দুর্যোধন, দুঃশাসনেরা সবাই কর্ণের ভরসাতেই যুদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়, চিত্রসেন এমন যুদ্ধ করলেন যে, কর্ণ দেখলেন রণক্ষেত্রে প্রায় তিনি একা। গন্ধর্বরাও বুঝেছে যে, কর্ণই আসল যুদ্ধবাজ, তারা সবাই মিলে কর্ণের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করল। কেউ কর্ণের রথ ভাঙে, কেউ ধ্বজা কেটে দেয়, কেউ রথের চাকা নিয়ে পালায়, কেউ বা রথের ঘোড়া মারে, কেউ বা শুধুই বাণ মেরে যাচ্ছে কর্ণের গায়ে। শেষে সমস্ত গন্ধর্বরা মিলে কর্ণকে এমন ব্যতিব্যস্ত করে তুলল যে, কর্ণ রথ থেকে লাফিয়ে পড়ে দুর্যোধনের ভাই বিকর্ণের রথে চড়ে পালাতে বাধ্য হলেন। সেই সুযোগে দুর্যোধন চিত্রসেনের হাতে সস্ত্রীক ভাইদের সঙ্গে বন্দি হলেন এবং তাঁকে মুক্ত হতে হল ভীম এবং অর্জুনের মধ্যস্থতায়। এর থেকে বড় অপমান দুর্যোধনের আর কী-ই বা হতে পারে। গন্ধর্বরাজ চিত্রসেন দুর্যোধনের সমস্ত ‘প্ল্যান’টাও বলে দিলেন পাণ্ডবদের।

দুর্যোধন লজ্জায় মাথা নিচু করে হস্তিনাপুরের দিকে চললেন, নিজের ওপর অশ্রদ্ধায় তাঁর মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করছিল। এরই মধ্যে কর্ণ এসে উপস্থিত হলেন দুর্যোধনের কাছে। অতি আহ্বাদে আটখানা হয়ে কর্ণ বললেন-বাঃ! তোমরা যে গন্ধর্বদের জিতে আবার ফিরে চলেছ, এটা দেখে খুবই ভাল লাগছে। আমাকে তো তোমরা দেখেছ, গন্ধর্বরা কী করল! সবাই মিলে এমন আমার পেছনে লাগল—অহং ত্বভিদ্রুতঃ সর্বৈঃ গন্ধর্বৈঃ পশ্যতস্তব—যে, পালিয়ে যেতে বাধ্য হলাম—ব্যপযাতো’ভিপীড়িতঃ। যেখানে আমারই এই অবস্থা, সেখানে ভাইদের সঙ্গে করে তুমি যে যুদ্ধ জিতে ফিরেছ, এটা তুমি ছাড়া আর কেউ পারত না।

বলা বাহুল্য, এই কথায় দুর্যোধন আপাতত খুবই বিব্রত বোধ করলেন এবং গম্ভীরভাবে জানালেন—তুমি কিছুই না জেনে এসব কথা বললে বলে আমি কিছু মনে করছি না, নইলে জেনে রেখ আমি কিছুই জিতিনি, বরঞ্চ বউ-ঝি, মন্ত্রী-ভাই—সবাইকে নিয়ে আমি তাদের হাতে বন্দি হয়েছিলাম। দুর্যোধন সব খুলে বললেন। কীভাবে তাঁদের সব কৌশল ফাঁস হয়ে গেছে, কীভাবে নিতান্ত উদাসীনতায় অর্জুন চিত্রসেনের হাত থেকে তাঁকে রক্ষা করেছেন এবং কীভাবে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পর্যন্ত তাঁকে ‘লাস্ট ওয়ার্নিং’ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন—মা স্ম তাত পুন কার্ষীরীদৃশং সাহসং ক্কচিৎ। কর্ণ সব শুনলেন, বুঝলেন ভীষণ অপমানবোধে দুর্যোধন জর্জরিত। এই অপমান-পঙ্ক থেকে দুর্যোধনকে কীভাবে উদ্ধার করা যায়, তাও তিনি জানেন। তবু তিনি দুর্যোধনকে বলতে দিলেন। দুর্যোধন এতই ভেঙে পড়েছেন যে, তিনি কর্ণকে বললেন, —তোমরা যাও ভাই সব, দুঃশাসনকে আমি যুবরাজ পদে অভিষিক্ত করছি। দুঃশাসনই কর্ণ এবং শকুনির দ্বারা প্রতিপালিত এই ঋদ্ধা বসুমতীকে শাসন করবে—প্রশাধি পৃথিবীং স্ফীতাং কর্ণসৌবলপালিতাম্।

একটা বিরাট খবর পাওয়া গেল। যে পৃথিবী এইমাত্র দুর্যোধন দিয়ে দিলেন দুঃশাসনকে, দুঃশাসন সেই পৃথিবীর রাজা মাত্র হবেন, বস্তুত সেই পৃথিবী এতদিন সমৃদ্ধ হয়েছে কর্ণ এবং শকুনির চালনা-গুণে, পালনের বুদ্ধিতে—কর্ণসৌবল-পালিতাম্। দুর্যোধন মনে প্রাণে যা বিশ্বাস করেন, আমরাও তাই বিশ্বাস করি। রাজ্যভার নবসেবকের হাতে প্রত্যর্পিত হোক আর নাই হোক, দুর্যোধনের রাজ্য এতকাল কর্ণ আর শকুনির বুদ্ধিতেই চলছে, দুর্যোধন রাজা, কর্ণ রাজ্যপাল। দুর্যোধনের রাজ্যে এত বড় যাঁর সম্মান, সেই কর্ণ জানবেন না কীভাবে দুর্যোধনের অপমান ঘোচাতে হবে? অনেকক্ষণ দুর্যোধনের কথা শুনে, তাঁর আত্মধিক্কার হজম করে কর্ণ একটা সাধারণ উত্তর দিলেন। আগেই বলেছি কর্ণের ওকালতি বুদ্ধি খুব পরিষ্কার। ভীম, অর্জুন এবং যুধিষ্ঠির দুর্যোধনের প্রতি যে উদাসীনতা দেখিয়েছেন, ততোধিক উদাসীনতায় কর্ণ জবাব দিলেন—তোমরা এমন বোকার মতো মনোকষ্ট পাচ্ছ যে কী বলব—বালিশ্যাৎ প্রাকৃতাবিব। পাণ্ডবেরা তাদের কর্তব্য করেছে, করাই উচিত। কারণ তারা তোমার রাজ্যের অন্তেবাসী প্রজা, তো প্রজা রাজাকে বাঁচাবে না? তা ছাড়া জনপদবাসী সাধারণ মানুষেরা সৈনিকদের সাহায্য করবে, রাজার কাজে সহায়তা করবে—এই নিয়ম। পাণ্ডবেরাও তোমার জনপদবাসী। অতএব সাহায্য করেছে, তাতে হয়েছেটা কী? পাণ্ডবেরা অনেককাল আগেই তোমার দাসে পরিণত হয়েছে—প্রেষ্যতাং পূর্বমাগতাং—আমি তো মনে করি তুমি যে সময়ে গন্ধর্বদের বিরুদ্ধে সসৈন্যে যুদ্ধযাত্রা করেছ, সেই সময়েই পাণ্ডবদের উচিত ছিল তোমার সেনাবাহিনীর পেছনে এসে যোগ দেওয়া—স্বসেনয়া সম্প্রয়ান্তং নানুযান্তি স্ম পৃষ্ঠতঃ—কারণ সেটাই ছিল তাদের কর্তব্য। কর্ণের কথায় দুর্যোধনের মনে নিশ্চয়ই কাজ হচ্ছিল, তবুও তিনি ওপরে ওপরে ভীষণ অবসন্ন দেখাচ্ছিলেন। এবারে যখন শকুনিও কর্ণের সমস্ত কথা সমর্থন করলেন—সম্যগ্ উক্তং হি কর্ণেন—এবং দূর্যোধনকে খুব একচোট বকা লাগালেন তখনই কর্ণের কাজ সাঙ্গ হল। দুর্যোধন সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হস্তিনায় ফিরে এলেন।

গন্ধর্বর সঙ্গে যুদ্ধে কর্ণ যে একেবারে জঘন্যভাবে হেরে গেলেন, এর ফল ফলল দুই তিন-ধারায়। যিনি বাস্তবিক অহঙ্কারী পুরুষ, যেমন কর্ণ, তিনি ভাবলেন তাঁর এই পরাজয়টা নিতান্তই আপাতিক এবং অর্জুন যে গন্ধর্বদের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করেছে, সেটাও কোনওক্রমে হয়ে গেছে। দুর্যোধনকে তিনি বুঝিয়েছেন—তুমি অর্জুনের বিক্রম দেখে ভয় পেয়ো না, তেরো বছর বাদে যদি যুদ্ধ হয়, তবে অর্জুনকে আমি প্রাণে মারব—এ-কথা নিশ্চয় জেনো—সত্যং তে প্রতিজানামি বধিষ্যামি রণে’র্জুনম্। দুর্যোধন তো এই কথা বিশ্বাস করতেই চান। যার ওপরে ভরসা করে তিনি এগোচ্ছেন, সে একটা যুদ্ধ হেরে গেলে তার একটা প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হয় বটে। কিন্তু ভরসা করার মতো বশংবদ বীরপুরুষ যদি বিকল্পে না থাকে, তবে তাকেই আবার ভরসা করতে হয়, ভাবতে হয়—পরের বার কর্ণ নিশ্চয় দেখে নেবে অর্জুনকে—এবমাশা দৃঢ়া তস্য ধার্তরাষ্ট্রস্য দুর্মতেঃ। কিন্তু নিরপেক্ষ জন ছাড়বে কেন? যারা আগে একের পর এক অন্যায় করেছে, তারা যখন হেরে যায়, তখন নিরপেক্ষ জনে কটুক্তি করবেই। কাজেই কর্ণ দুর্যোধন যখন লজ্জার মাথা খেয়ে হস্তিনায় ফিরলেন, তখন ভীষ্ম বললেন—দ্যাখো বাপু দুর্যোধন আগেই তোমায় বারণ করেছিলাম দ্বৈতবনে না যেতে, এখন শত্রুর হাতের বন্দি-বাঁধন কেমন লাগল? লজ্জা করল না তোমার যখন পাণ্ডুপুত্রেরা এসে তোমাদের বাঁচাল? আর এই যে সারথির পো, সে তো ভয়ে পালিয়েই গেল যুদ্ধক্ষেত্র থেকে, তোমরা তো ‘কর্ণ কর্ণ’ বলে ডাক ছাড়ছিলে, তবু সে পালিয়ে গেল—‘ক্রোশতস্তব রাজেন্দ্র সসৈন্যস্য নৃপাত্মজ। সূতপুত্রো’পযাদ্ ভীতঃ….। এই তো অবস্থা, তুমি অর্জুনের ক্ষমতাও দেখলে, কর্ণের ক্ষমতাও দেখলে, এত তো ‘কর্ণ’ ‘কর্ণ’ কর, আরে কর্ণ অর্জুনের পায়ের নখের যুগ্যি নয়-ন চাপি পাদভাক্ কর্ণঃ পাণ্ডবানাং নৃপোত্তম। ভীষ্ম বললেন—আমি সারকথা বলি, তুমি সন্ধি করো পাণ্ডবদের সঙ্গে, সেটাই হবে চরম মঙ্গল। দুর্যোধন সপার্ষদ এতক্ষণ ভীষ্মের কথা শুনছিলেন, এবারে সন্ধির কথা শুনে ভীষ্মের মুখের ওপর দারুণ এক অবজ্ঞার হাসি হেসে উত্তরের সৌজন্য না দেখিয়েই হুম হুম করে চলে গেলেন, পেছন পেছন চললেন কর্ণ আর দুঃশাসন।

স্বয়ং কুরুকুলপতি বৃদ্ধ পিতামহের প্রতি একই কুলজাত অধস্তন পুরুষের এই যে ব্যবহার এই ব্যবহারের মধ্যে মন্দবুদ্ধি উচ্চাভিলাষী রাজপুরুষ প্রশ্রয় পাবে। দুর্যোধন সেটা বোঝেন না। আমরা পূর্বেই দেখেছি, দুর্যোধনের প্রশ্রয়ে কর্ণ এতটাই বেড়ে উঠেছেন যে দূতসভার আসরে তিনি কুরুবৃদ্ধদের বিরুদ্ধেও কটুক্তি করতে ছাড়েননি। এখন এই মুহূর্তে স্বয়ং রাজপুত্রই যখন তাঁর পিতামহের মুখের ওপর অবজ্ঞার হাসি হেসে তাঁর সমস্ত সদুপদেশ উড়িয়ে দিলেন—প্রহস্য সহসা রাজন্ বিপ্রতস্থে সসৌবলঃ—সেখানে কর্ণের কী দায় থাকে? বাইরের লোকের সামনে এমনি করে অপমানিত হয়ে ভীষ্ম তো কোনওরকমে নিজের ঘরে মুখ লুকিয়ে বাঁচলেন, কিন্তু আর একটি উচ্চাভিলাষী মুখ তখন দুর্যোধনের দুর্বলতায় ঘা দিয়ে বলল—এই ভীষ্মটা আমাদের একদম দেখতে পারে না। সব সময় ওর মুখে শুনবে পাণ্ডবদের প্রশংসা। বুড়ো তোমাকে দেখতে পারে না, তাই আমাকেও দেখতে পারে না—ত্ব-দেষাচ্চ মহাবাহো মমাপি দ্বেষ্ঠুমর্হতি।

লক্ষ করুন, কর্ণ সব সময় এখানে দুর্যোধনকে জড়িয়ে নিয়ে নিজের কথা বলছেন এবং তিনি যে রেগে যাচ্ছেন, এটা যেন নিজের অপমানে ততটা নয়, যতটা দুর্যোধনের অপমানে। কর্ণ বললেন—দেখবে সব সময় তোমার সামনে আমাকে খাটো করবে। তোমার সামনে আমাকে যে সব কথা বলছে—এ কিন্তু আমি আর সহ্য করব না ; আমাকে তাও যা বলার বলুকগে, কিন্তু সব সময় ওই পাণ্ডবদের প্রশংসা আর তোমার নিন্দা—এ আর আমি সহ্য করতে পারছি না—ন মৃষ্যামীহ ভারত। তুমি যদি আজকে বল তো সমস্ত পৃথিবী তোমায় আমি জিতে এনে দিতে পারি। যে সমস্ত সামন্ত রাজ্য পাণ্ডবেরা এক সময় জিতেছিল, সে সব আমি চতুরঙ্গ সেনা নিয়ে একাই জিতে আনব। দেখুক বেটা দুষ্টুবুদ্ধি ওই কুরুকুলের কুলাঙ্গার ভীষ্মটা—সংপশ্যতু সুদুর্বুদ্ধি ভীষ্মঃ কুরুকুলাধমঃ। কর্ণ বললেন—ভীষ্ম সব সময় যাকে নিন্দে করার নয় তাকে নিন্দে করবে,—যেমন আমাকে, তোমাকে। আর যাকে প্রশংসা করা কখনও উচিত নয় তাকে প্রশংসা করবে যেমনি পাণ্ডবদের। ও এইবার আমার ক্ষমতা দেখবে, আর নিজেই একেবারে কুঁকড়ে যাবে—আত্মানাং তু বিগর্হতু। আমি দিগ্‌বিজয় করে আসব, তুমি অনুমতি দাও।

সত্যি কথা বলতে কি ভীষ্মের প্রতিকূল ব্যবহারে কর্ণ যে আজ হঠাৎ খেপে উঠলেন, তা মোটেই নয় ; ভীষ্ম একটা উপলক্ষ মাত্র। আসল কথা তিনি নিজে যে গন্ধর্বদের হাতে প্রচণ্ড পিটুনি খেয়ে এলেন এবং তিনি থাকতেও দুর্যোধনকে যে অর্জুনের সহায়তায় মুক্তি পেতে হল, এর একটা প্রতিপূরক ব্যবহার করতে চাইছিলেন কর্ণ। এতে যেমন দুর্যোধনের ক্ষোভও একটু প্রশমিত করা যাবে তেমনি দিগ্‌বিজয়ের সূত্রে বেশ কয়েকটা রাজ্য জিতে এলে দুর্যোধন তাঁর ওপর হৃত বিশ্বাস ফিরে পাবেন। বিশেষত যুদ্ধবিদ্যায় তিনি যে কারও চাইতে কম নন এটা যদি অর্জুন বাদে অন্য রাজাদের ওপর দিয়ে পরীক্ষা হয়ে যায়, তার চাইতে সুবিধেজনক আর কী আছে। কিন্তু এই দিগ্‌বিজয়ের কথাটা হঠাৎ করে পাড়তে কর্ণের অসুবিধে হচ্ছিল। দুর্যোধনের সামনে ভীষ্ম তাই যেদিন কর্ণকে কিঞ্চিৎ খাটো করলেন, ওমনি কর্ণ দিগ্‌বিজয়ের কথাটা পেড়ে ফেললেন এবং সেইসঙ্গে কুরুবৃদ্ধ পিতামহকেও যথেচ্ছ গালাগালি করে নিলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য যে মানুষ দুর্যোধনের দাক্ষিণ্যে এত দূর এসেছেন, তাঁরই মুখে আপন পিতামহের কুৎসা শুনেও দুর্যোধন তাঁকে কিছুই বললেন না। ‘ভীষ্ম কুরুকুলের অধম’, ‘ভীষ্ম দুর্বুদ্ধি’—এ-কথা যদি সত্যও হত, তবু কর্ণের মুখে এ-কথা শুনে দুর্যোধনের প্রতিবাদ করা উচিত ছিল, তা তো তিনি করলেনই না বরং উল্টে বললেন—ধন্য হলাম বন্ধু, ধন্যি আমি! তোমার মত মহাবল পুরুষ যে সব সময় আমার হিত চিন্তা করছে, তাতে আজ আমার জন্ম সফল—হিতেষু বৰ্ত্ততে নিত্যং সফলং জন্ম চাদ্য মে। যাও বীর, তুমি বিশ্বভুবন জয় করে ফিরে এস।

পাণ্ডবেরা দিগ্‌বিজয় করতে বেরিয়েছিল, সেই দিগ্‌বিজয় কর্ণ করতে যাচ্ছেন দুর্যোধনের প্রতিনিধি হয়ে—এই গর্বেই দুর্যোধনের বুক ফুলে উঠল। ভীষ্মের অপমান তাঁর মাথাতেই ঢুকল না। বিশ্ব নিখিল জয়ের জন্য কর্ণ জয়রথে উঠলেন এবং অর্জুনের মতো ধনুর্ধারী বীর দ্বিতীয় না থাকার ফলে দিগ্‌বিজয় করে ফিরেও এলেন। কর্ণের সাফল্যে গর্বিত দুর্যোধন, গদগদ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর ভাইবন্ধুদের নিয়ে আরতি করে কর্ণকে নামিয়ে আনলেন জয়রথ থেকে এবং সবার সামনে কর্ণকে মাথায় তুলে দিয়ে বললেন—যে সুখ আমি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ—কারও কাছ থেকে পাইনি, আজ তুমি কর্ণ সেই সুখ দিলে—যন্নভীষ্মান্ন চ দ্রোণাৎ… ত্বত্তঃ প্রাপ্তং ময়া হি তৎ। কর্ণ বুঝলেন, তাঁর বুদ্ধি কাজে লেগেছে, দুর্যোধন তাঁর পুরনো দুঃখ ভুলে গেছেন। আজ তিনি ভীষ্ম দ্রোণের থেকেও বড় ‘হিরো’। দুর্যোধন বললেন—বেশি কথা কী, তোমার জন্যই আজ আমরা অনাথ নই। বেশ বিশ্বাস হচ্ছে, তোমার শক্তির তুলনায় পাণ্ডবদের শক্তি এক ফুটো পয়সাও নয়—ন হি তে পাণ্ডবাঃ সর্বে কলামর্হন্তি ষোড়শীম্। কর্ণ তো এইটাই চেয়েছিলেন, এমন একটা ব্যাপার করা যাতে দুর্যোধন আবার বিশ্বাস করবেন যে, অর্জুনকে তিনি ছাড়া আর কেউই জয় করতে পারবেন না। দুর্যোধন বিশ্বাস করেছেন। কর্ণ আজ সফল এবং এতটাই সফল যে কর্ণকে দুর্যোধন রণবিজেতা জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মর্যাদায় ভূষিত করে বললেন—যাও তুমি আজ দেখা কর পিতা ধৃতরাষ্ট্র, জননী গান্ধারীর সঙ্গে, ঠিক যেমন পুরন্দর ইন্দ্র যুদ্ধ জয় করে এসে দেখা করেন দেবমাতা অদিতির সঙ্গে। কর্ণও বাধ্য ছেলের মতো—পুত্রবচ্চ নরব্যাঘ্র—ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর পাদবন্দনা করলেন। যিনি এতকাল বাইরের লোক ছিলেন সেই কর্ণ আজ দিগ্‌বিজয়ের পর কৌরবকুলে ঘরের ছেলে হয়ে গেলেন। দুর্যোধন আর শকুনি ভাবলেন, কর্ণ বুঝি পাণ্ডবদের জয় করেই ফেলেছেন, শুধু একটা খেলা-খেলা যুদ্ধের অপেক্ষা—জানতে নির্জিতান্ পাথান্ কর্ণেন যুধি ভারত।

হস্তিনাপুরের রাজবাড়িতে কর্ণের প্রেস্টিজ এখন দারুণ বেড়ে গেছে। দুর্যোধন দেখলেন, দিগ্‌বিজয়ও হয়ে গেল, ভেট হিসেবে টাকাপয়সাও অনেক এসেছে, এখন যুধিষ্ঠিরের মতো একটা রাজসূয় করলেই বেশ জাতে ওঠা যায়। জনসাধারণের কাছে দূতক্রীড়ার পরে তাঁর যে একটা সম্মান-হানি হয়েছিল, কর্ণের দিগ্‌বিজয়ের পর সে গ্লানি খানিকটা ঘুচেছে। জনগণ নিশ্চয়ই সুরক্ষিত বোধ করছে, এখন একটা রাজসূয়যজ্ঞ করলেই দুর্যোধনের ভাবমূর্তি একেবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। সময় বুঝে দুর্যোধন তাঁর রাজসূয়ের বাসনা জানালেন কর্ণকে। দুর্যোধন বললেন—পাণ্ডবদের রাজসূয় দেখা অবধি আমার বড় সাধ হয় কর্ণ যে, রাজসূয়যজ্ঞ করব। তুমিই সে ব্যবস্থা কর—তাং সম্পাদয় সূতজ। কর্ণ বললেন—এ আর বেশি কথা কী? সমস্ত ধরণী তোমার বশগত। এখন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে বলে ব্রাহ্মণদের ডাকিয়ে রাজসূয় করলেই হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য! একই বংশের দুই জ্ঞাতি পুরুষ রাজসূয়যজ্ঞ করতে পারে না, সে নিয়ম নেই। যুধিষ্ঠির বেঁচে থাকতে—জীবমানে যুধিষ্ঠিরে—দুর্যোধনের পক্ষে দ্বিতীয়বার রাজসূয় করা সম্ভব নয়। ব্রাহ্মণেরা অনেক ভেবে চিন্তে রাজসূয়ের সমতুল্য বৈষ্ণবযজ্ঞ করার অনুমতি দিলেন। দুর্যোধন ভাবলেন—তাই সই, হাজারো লোকজন তো যজ্ঞের আড়ম্বর দেখে দুর্যোধনের ধন্যধ্বনি দেবে, তাই সই। তা বৈষ্ণবযজ্ঞে ভীষ্ম, দ্রোণ, সবাই সক্রিয় ভূমিকা নিলেন। তাঁরা ভাবলেন ছেলের বুঝি সুমতি হয়েছে, ধম্ম-কম্ম করছে। কর্ণের বিজয়-ঘোযে দুর্যোধনের উদার যজ্ঞপূণ্যের মহিমায় মণ্ডিত হয়ে বৈষ্ণবযজ্ঞ জনগণের মনে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ের স্মরণ ঘটাল। কেউ বা ভাল বলল কেউ বা মন্দ। তুলনা-প্রতিতুলনার দ্বন্দ্বশেষে দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞ যেদিন সমাপ্ত হল সেদিন পরম আহ্লাদিত মনে জনগণের শেষ স্তুতি-চন্দনের চূর্ণ গায়ে মেখে তিনি এসে বসলেন নিজের ঘরে আপন গোষ্ঠীর মধ্যে। সঙ্গে সঙ্গে কর্ণ দাঁড়িয়ে উঠে ঘোষণা করলেন—ঘোষণা করলেন এইজন্যে যে, তিনি আজকের কৌরবগোষ্ঠীতে সবচেয়ে বড় ‘হিরো’ হওয়া সত্ত্বেও বুঝেছেন, দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞের উন্মাদনা যুধিষ্ঠিরের রাজসূয়ের স্মৃতিলোপ ঘটাতে পারেনি ; বুঝেছেন—তাঁর আপন দিগ্‌বিজয় পাণ্ডবদের বলবীর্য ম্লান করে দিতে পারেনি ; বুঝেছেন—দিগ্‌বিজয় এবং বৈষ্ণবযজ্ঞের সমাপ্তির পরেও অর্জুন এখনও জীবিত। তাই কর্ণ ঘোষণা করলেন—আজকের যজ্ঞ শেষ হল বটে। কিন্তু দারুণ যুদ্ধে পাণ্ডবেরা সবাই মারা যাবার পর যেদিন তুমি রাজসূয়যজ্ঞ করবে—-হতেষু যুধি পার্থেষু রাজসুয়ে তথা ত্বয়া—সেদিন আবার আমি তোমার উপযুক্ত সৎকার করব। দুর্যোধন জড়িয়ে ধরলেন কর্ণকে। মনে মনে কল্পনা করলেন কেমন করে নিহত পাণ্ডবদের মৃত্যুক্ষেত্রে রাজসূয়ের উদ্বোধন করবেন তিনি। দুর্যোধন বললেন—কবে সেদিন আসবে যেদিন পাণ্ডবদের মৃত্যুর পথে যাত্রা করিয়ে আমি রাজসূয়ের অনুষ্ঠান করব? সমস্ত উত্তেজনা একসঙ্গে জড়ো করে কর্ণ জবাব দিলেন—তবে আমার কথা শোন দুর্যোধন! যতদিন আমি অর্জুনকে না মারতে পারি, ততদিন আমি নিজে নিজের পা ধোব না, খাব না মাংস, পালন করব ‘অসুরব্রত’, আর এই ব্রতের নিয়ম হিসেবে আজ থেকে কেউ যদি এসে আমার কাছে কিছু চায়, আমি না বলব না। কর্ণ এমনি এক নিশ্চয়তায় অর্জুন বধের প্রতিজ্ঞা করলেন যে দুর্যোধন পুনরায় বিশ্বাস করলেন—পাণ্ডবেরা মরেই গেছে—বিজিতাংশ্চাপ্যমন্যন্ত পাণ্ডবান্ ধৃতরাষ্ট্রজাঃ।

টীকাকার নীলকন্ঠ বলেছেন ‘অসুরব্রত’ মানে অসুরদের কোন ব্রত-ট্রত নয়, সুরা পান না করার ব্রত। কর্ণ মদ, মাংস ত্যাগ করে মলিন হয়ে, দানের পুণ্যে অর্জুনবধের প্রতিজ্ঞা করলেন। যাঁরা ভাবেন কর্ণ সারাজীবন দান-ধ্যান করে ‘দাতা কর্ণ’ হয়েছেন, তাঁরা মনে রাখবেন পাণ্ডবদের বনবাসপর্বের যখন আর এক বৎসর আটমাস মাত্র বাকি, তখন থেকে মৃত্যুর দিন পর্যন্ত কর্ণ তাঁর দানের ব্রত পালন করেছিলেন। নিখুঁত হিসেব করে দেখলে এই সময়ের অঙ্ক খুব বেশি দিনের নয়, যদিও কর্ণের ‘দাতা’ সুনামটিও সময়ের হিসেব ধরে আসেনি, এসেছে নিজের মৃত্যু তুচ্ছ করে আপন অঙ্গ-জাত কবচ-কুণ্ডল দানের ফলে। মহাভারতের অন্যত্র যেখানে কর্ণের গৌরব শোনা যাচ্ছে করুণ সুরে, সেখানে অবশ্য বলা আছে যে, মধ্যদিনে দেব দিবাকরের পূজা সমাপন করার পর কর্ণ কোনও ব্রাহ্মণ প্রার্থীকে ফেরাতেন না। কিন্তু সে-কথা আক্ষরিক অর্থে বিশ্বাস করলে বিপদ বাড়ে। তাতে বৈষ্ণবযজ্ঞের অন্তে দুর্যোধনের কাছে পুনরায় দানব্রত গ্রহণের প্রতিজ্ঞা করার অর্থ থাকে না। বিশেষত দুর্যোধনের রাজবাড়িতে কর্ণের দৈনন্দিন জীবনের যে চিত্র আঁকা আছে তাতেও কোনও দানের কথা কোনওদিন পাওয়া যায় না। যাই হোক, কর্ণ প্রথম থেকেই দান করুন কিংবা তাঁর প্রতিজ্ঞারম্ভের পর, সে-কথা অকিঞ্চিৎকর, বস্তুত এই দানের কাহিনী থেকেই কর্ণের জীবনে অতি কারুণ্যের স্পর্শ লেগেছে, নইলে এতদিন কৌরব সভায় বৃদ্ধ সজ্জনের চোখের ওপর যে ব্যবহার তিনি করে যাচ্ছিলেন তাতে তাঁর জন্মলগ্নের অনিশ্চয়তা থেকে পাঠকের হৃদয়ে যে করুণা জন্ম নিয়েছিল তা প্রায় ধুয়ে মুছে যাচ্ছিল। কিন্তু দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞ সমাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণ যে অর্জুনবধের প্রতিজ্ঞা নিলেন, সেদিন থেকেই কর্ণের জীবনে আরেক অধ্যায় আরম্ভ হল—করুণ অধ্যায়। অস্ত্র প্রতিযোগিতার রঙ্গভূমিতে দুর্যোধনের কাছ থেকে অঙ্গরাজ্যের রাজমুকুট লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে কর্ণের জীবনে ভাগ্যোত্তরণের শুরু। একে আমরা ভাগ্য বলব কিনা জানি না, তবে রাজার ঘরে জন্মালে একজন রাজপুত্রের যা যা লাভ হতে পারত, কর্ণ সে সবই লাভ করেছিলেন দুর্যোধনের বন্ধুত্বের দৌলতে এবং নিজের ক্ষমতায়, বুদ্ধিবৃত্তিতে তথা কৌশলে। হস্তিনাপুরের রাজনীতিতে ক্রমে ক্রমে তিনি এমন এক পদমর্যাদা লাভ করেছিলেন, যা ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ এইসব পুরাতন ব্যক্তিত্বের কাছে ঈর্ষণীয় ছিল। কর্ণের দিগ্‌বিজয় ছিল এই মর্যাদার চূড়ান্ত বিন্দু। কিন্তু দুর্যোধনের বৈষ্ণবযজ্ঞ সমাপনের পর যে দানব্রত গ্রহণ করলেন কর্ণ, সেই ব্রত থেকেই তাঁর যত ক্ষয়-ক্ষতি আরম্ভ হয়, যদিও এই ক্ষয়স্থানগুলি যশের গৌরবে মাঝেমাঝেই ভাস্বর।