দ্রৌপদী – ৩

রাজসভায় মুখলালিত পাণ্ডবদের বনবাসমলিন অবস্থাটি প্রতিতুলনায় বড় করুণ করে ধরবার চেষ্টা করেছেন ভারবি। দ্রৌপদীর জবানীতে তার বক্তব্য হয়ে উঠেছে বক্রোক্তির সংকেতে অলংকৃত। মহাভারতকার অলংকারের ধার ধারেন না, সহজ কথা তিনি এত সহজেই বলেন যে দ্রৌপদীর বক্তব্য যেন আরও ক্ষুরধার হয়ে ওঠে। মহাভারতের দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের কাছে রাগে ফেটে পড়েন—তোমার শরীরে কি রাগ বলে কোনও জিনিস নেই মহারাজ! তোমার জোয়ান জোয়ান ভাইয়েরা সব ঘুরে-বুলে বেড়াচ্ছে। যাদের খাওয়াবার জন্য পাচকেরা শতেক ব্যঞ্জনে রান্না করে দিত, তাদের এখন বন্য খাবার ছাড়া গতি নেই। এই ভীমকে দেখে তোমার রাগ হয় না মহারাজ! যার পথ চলার সুখের জন্য দুয়ারে গোটা কতক রথ, হাতি, ঘোড়া প্রস্তুত থাকত, যে একাই সমস্ত কৌরবদের ধ্বংস সাধনে সমর্থ, তাকে দুঃখিত অন্তরে বনের বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে দেখে তোমার রাগ হয় না মহারাজ! যে অর্জুনের তুলনা শুধু অর্জুনই, অস্ত্রসন্ধানে যে যমের মতো সমস্ত রাজার মস্তক নত করে ছেড়েছিল, সেই বাঘের মতো মানুষটাকে দেখে তোমার রাগ যে কেন বেড়ে যায় না—তাই ভেবে আমার মুচ্ছো যেতে ইচ্ছে করে—ন চ তে বর্ধতে মন্যুস্তেন মুহ্যামি ভারত। তারপর আছে নকুল, অমন সুন্দর চেহারা, অমন বীরত্ব—দর্শনীয় শূরঞ্চ, আছে সহদেব, কোনওদিন কোনও দুঃখ সইতে হয়নি বেচারাকে—আহা তাদের দেখেও কি তোমার রাগ বেড়ে যায় না মহারাজ! একেবারে শেষে আমার নিজের কথাও বলি, বড়মানুষের ঘরে আমার জন্ম, মহারাজ পাণ্ডুর পুত্রবধু, মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নের ভগিনী আর পাঁচ পাঁচটা বীর স্বামীর ঘরণী আমি—এমন আমাকে বনে বনে ঘুরতে দেখে তুমি সেই লোকগুলোকে ক্ষমা কর কী করে? বেশ বুঝি রাগ বলে কোনও জিনিসই তোমার শরীরে নেই, ভাইদের এবং বউকে দেখে মনে কোনও পীড়াও হয় না তোমার। জান তো লোকে বলে যাদের গায়ে ক্ষত্রিয়ের রক্ত আছে তারা কখনও ক্রোধহীন হয় না—ন নির্মন্যুঃ ক্ষত্রিয়ো’স্তি লোকে নির্বচনং স্মৃতম্‌। ভারবি কবি মহাভারতের এই কথাটাকে আরও একটু টেনে নিয়ে দ্রৌপদীর মুখে বলেছেন—ক্ষমার দ্বারা শান্তি চায় মুনিরা, রাজারা নয়। আর তোমার যদি হৃদয়ে অত ক্ষমা থাকে, তবে মাথায় জটা ঝুলিয়ে হোমকুণ্ড সাজিয়ে মুনিদের মত মন্ত্র পড় গিয়ে—জটাধরঃ সন্‌ জুহুবিহ পাবকম্‌।

পূর্ণ এক অধ্যায়ে দ্রৌপদীর মুখে যে ধ্রুবপদ বেঁধে দিয়েছেন মহাভারতকার তা হল—তবু তোমার মাথায় রাগ চড়ে না যুধিষ্ঠির-কস্মান্‌ মন্যু-র্ন বর্ধতে। যুধিষ্ঠিরের কিছুই হয়নি, কোনও বিক্রিয়া নয়, প্রতিক্রিয়াও নয়। দ্রোপদী সর্বসহ প্রহ্লাদের উক্তি পর্যন্ত উদ্ধার করে যুধিষ্ঠিরকে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে, দৈত্যকুলের প্রহ্লাদের মতেও মাঝে মাঝে ক্রোধের প্রয়োজন আছে, অন্তত রাজনীতিতে, শত্ৰু-ব্যবহারে। কিন্তু যুধিষ্ঠির তবু সেই মিন-মিন করে সেই অক্রোধ, ক্ষমা, আর শান্তির বাণী পুনরুক্তি করতে থাকলেন। এবার রাগের বদলে দ্রৌপদীর ঘেন্না ধরে গেল যেন। যে ধর্ম মানুষকে এমন করে ডোবায়, সেই ধর্মের প্রবক্তার ওপরেই তাঁর ঘেন্না ধরে গেল যেন। লজ্জায় ঘৃণায় ক্ষুব্ধ হল তাঁর রসনা। বললেন—

ঠাকুর তোমার পায়ে নমো নমঃ, যে ঠাকুর তোমায় এমন করে গড়েছে—নমো ধাত্রে বিধাত্রে চ যৌ মোহং চতুস্তব। শুনেছি ধর্মের রক্ষাকারী রাজাকে ধর্মই রক্ষা করে, নিজেও সে রক্ষিত হয়, কিন্তু সেই ধর্ম তোমাকে রক্ষা করছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আমি জানি—এই যে ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, এমনকী আমি—এদের সবাইকে তুমি ধর্মরক্ষার জন্য ত্যাগ করতে পার। ছায়ার মতো তোমার বুদ্ধি সবসময় ধর্মেরই অনুগামিনী। জানি, এই সসাগরা পৃথিবী লাভ করে ছোট বড় কাউকে তুমি অবমাননা করনি, কিংবা বলদৰ্পে তোমার শিংও গজায়নি দুটো—ন তে শৃঙ্গম্‌ অবর্ধত। কিন্তু যে তুমি অশ্বমেধ, রাজসূয়, পুণ্ডরীক যজ্ঞ করে এত দানধ্যান করলে, সেই তোমার ধর্মরাজের পাশা খেলার মতো বিপরীত বুদ্ধিটা কী করে হল শুনি? সব তো খুইয়েছিলে, রাজ্য, ধন, অস্ত্র, ভাই এমনকী পরিণীতা স্ত্রীকেও। তুমি তো সরলতা, মৃদুতা, বদান্যতা, লজ্জাশীলতা, সত্যবাদিতা—এত সব ধর্মগুণের পরাকাষ্ঠা, সেই তোমার মতো লোকের জুয়ো খেলার মতো উল্টো বুদ্ধি হল কী করে—কথম্‌ অক্ষব্যসনজা বুদ্ধিরাপতিতা তব।

দ্রৌপদী আরও অনেক কথা বলেছেন, দর্শনশাস্ত্রও বাদ যায়নি। বেশ বোঝা যায় শান্তরসের নায়ক যুধিষ্ঠিরের ধর্মকথা তাঁর কাছে সময়কালে ধর্মধ্বজিতাই মনে হয়েছে। যুধিষ্ঠির ‘পণ্ডিতা’ দ্রৌপদীর যুক্তি-তর্ক মেনে তাঁর বচন বিন্যাসভঙ্গির ভূয়সী প্রশংসা করেছেন—বল্‌গু চিত্রপদং শ্লক্ষ্ণং যাজ্ঞসেনি ত্বয়া বচঃ। কিন্তু এই প্রথম বাক্যটি বলেই যুধিষ্ঠির হৃদয়ে কোনও জটিলতা বোধ করলেন বোধহয়। দ্বিতীয় বাক্যেই তিনি বললেন, যত ভালই বলে থাক, কিন্তু যা বলেছ, নাস্তিকের মতো বলেছ। তর্কাহত ধর্মিষ্ঠ মানুষের শেষ অস্ত্র তর্কজয়ী মানুষকে নাস্তিক বলা। যুধিষ্ঠির কি পণ্ডিতা ঘরণীর সারকথা বুঝতে পেরেই তাঁকে নাস্তিক প্রতিপন্ন করলেন। অনেক কথা যুধিষ্ঠির বললেন, তাতে ব্রাহ্মণ-সজ্জন, মুনি-ঋষিদের ধর্ম প্রমাণসিদ্ধ হল, কিন্তু রাজধর্ম, যা নিয়ে মহাভারতেরই অন্যত্রও বিশদ আলোচনা আছে এবং যে আলোচনা দ্রৌপদীর সপক্ষে যাবে, কই যুধিষ্ঠির তো তার ধারও মাড়ালেন না! তিনি স্ত্রীকে নাস্তিক বললেন এবং তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় দ্রৌপদীও ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু এই ক্ষমা চাওয়া তাঁর হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত নয়। বস্তুত দৈবাধীন হয়ে বসে থাকা এবং সময়ের অপেক্ষা করা—যুধিষ্ঠিরের এই অলস নীতিতে দ্রৌপদীর আস্থা ছিল না। তাই ক্ষমা চেয়েও দ্রৌপদী বললেন—হঠকারিতা করে শত্রুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যেমন বোকামি, তেমনি দৈবের দোহাই দিয়ে অনির্দিষ্ট কাল অপেক্ষা করাও এক ধরনের বোকামি। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে ইঙ্গিত করেই ব্যঙ্গ করলেন—যে নাকি দৈব মাথায় নিয়ে নিশ্চেষ্টভাবে সুখে নিদ্রা যায়, তার বুদ্ধি বলে কিছু নেই। জলের মধ্যে সদ্য নির্মিত কাদার ঘটখানি রাখলে সে যেমন আপনিই গলে গলে জলের মধ্যে মিশে যায়, দৈবাধীন পুরুষের অবস্থাও তেমনই—অবসীদেৎ স দুর্বুদ্ধিঃ আমো ঘট ইবাম্ভসি।

দ্রৌপদী, বীরস্বামিগর্বিতা দ্রৌপদী, পুরুষকারে বিশ্বাস করেন। যুধিষ্ঠিরকে তিনি বলতে চান—তুমি আমার জ্যেষ্ঠ স্বামী হলে কী হয়, তুমি যে হলে চাষারও অধম যুধিষ্ঠির। দেখ না, ক্ষেতের চাযিরাও লাঙল দিয়ে মাটি ফেড়ে বীজ বপন করে—পৃথিবীং লাঙ্গলেনেহ ভিত্ত্বা বীজং বপন্ত্যুত—তারপর কৃষক চুপটি করে বসে থাকে দৈবাধীন বৃষ্টিপাতের অপেক্ষায়। কৃষক ভাবে, যতটুকু আমার পুরুষকারে কুলোয়—লাঙল দিয়ে মাটি ফাড়া—সেটুকু আমি করেছি, তারপরেও যদি বৃষ্টিপাতের দৈব সাহায্য না পাই তা হলে আমার দিক থেকে অন্তত ত্রুটি নেই কোনও—যদন্যঃ পুরুষঃ কুর্যাৎ কৃতং তৎ সকলং ময়া। তেমনি ধীর ব্যক্তিরা তাঁর পৌরুষের কর্তব্যটি আগে সম্পন্ন করেন, তারপরেও যদি দৈব তার সহায়তায় হাত বাড়িয়ে না দেয়, তখন তিনি আত্মতুষ্ট থাকেন এই ভেবে যে তাঁর তো কোনও দোষ নেই। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের এই উত্তাপহীন অলস-দশা সহ্য করতে পারেন না। যুধিষ্ঠিরকে তিনি মুখের ওপর শুনিয়ে দিয়েছেন যে, শুয়ে পড়ে থাকা অলস ব্যক্তিকে অলক্ষ্মীতে ধরে—অলক্ষ্মীরাবিশত্যেনং শয়ানমলসং নরম্। কিছু তো কর, কিছু করলে তবে তো তুমি বলবে—আমি চেষ্টা করেছি, হয়নি—কৃতে কর্মণি রাজেন্দ্র তথানৃণ্যমবাপ্নুতে।

যুধিষ্ঠির কিছু করেননি, অন্তত সেই সময়ে কিছু করেননি। ঘরের বউ পণ্ডিতদের মতো বৃহস্পতির রাজনীতি উপদেশ দেবে, এ বোধ হয় তাঁর সহ্য হল না। কিন্তু তিনি যে দ্রৌপদীকে আরেক দফা নাস্তিক-টাস্তিক বলে বসিয়ে দেবেন সে উপায়ও রইল না, কারণ মধ্যম-পাণ্ডব ভীমসেন ততক্ষণে বেশ একটু রাগত স্বরেই এগিয়ে এলেন দ্রৌপদীর পক্ষে—ক্রুদ্ধো রাজানম্‌ অব্রবীৎ। নরমে গরমে অনেক কিছুই বলে গেলেন ভীম, তাঁর সমস্ত কই দ্রৌপদীর ভাষণের পাদটীকা মাত্র। সত্যি বলতে কি, ভীম দ্রৌপদীকে এতটাই ভালবাসেন যে, কখনও, কোনও সময়ে তাঁর কথার যৌক্তিকতা নিয়ে বিচার করেননি বেশি। যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে যতখানি বুঝি ভালবাসেন তার থেকেও বুঝি ভয় পান ; আর ভয় পান বলেই তাঁর ভালবাসার মধ্যে শুকনো কর্তব্যের দায় যেন বেশি করে ধরা পড়ে। পাঠক। খেয়াল করবেন, অজ্ঞাতবাসের আগে সব পাণ্ডবেরা যখন ভাবছেন কীভাবে, কোন কর্ম করে বিরাট রাজার রাজ্যে নিজেদের লুকিয়ে রাখবেন, তখন যুধিষ্ঠির বলছেন—এই আমাদের প্রাণের চেয়েও ভালবাসার পাত্রী দ্রৌপদী। মায়ের মতো এঁকে প্রতিপালন করা উচিত এবং বড়বোনের মতো ইনি আমাদের পূজনীয়াও বটে—মাতেব পরিপাল্যা চ পুজ্যা জ্যেষ্ঠেব চ স্বসা। অজ্ঞাতবাসের সময় অন্য মেয়েদের মতো দ্রৌপদী কি কিছু কাজকর্ম করতে পারবেন—ন হি কিঞ্চিৎ বিজানাতি কর্ম কর্তৃং যথা স্ক্রিয়ঃ।

কিন্তু দ্রৌপদীর কাছে যুধিষ্ঠিরের এই কথাগুলি বাণী দেওয়ার মতো মনে হয়। মূলত, যুধিষ্ঠিরের কারণেই তাঁকে সমাজবহির্ভূত ভাবে পঞ্চস্বামী বরণ করতে হয়েছে। একথা একভাবে তাঁর মুখ দিয়ে প্রকাশও হয়েছে এবং তা প্রকাশ হয়েছে মহাভারতের যুদ্ধ-মেটা শান্তিপর্বে যখন তাঁর জীবনেরও শেষ পর্ব উপস্থিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ভাই, বন্ধু, জ্ঞাতিরা সব মারা যাওয়ায় যুধিষ্ঠিরের বৈরাগ্য উপস্থিত হয়েছে। যুধিষ্ঠিরের এই বৈরাগ্যই তো দ্রৌপদীর দু-চক্ষের বিষ। অথচ এই বৈরাগ্যই দ্রৌপদীকে সারা জীবন তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ব্যাপারটা মহাভারতকার ব্যাসের নজর এড়ায়নি। দ্রৌপদী যে যুধিষ্ঠিরকে খুব ভাল চোখে দেখতে পারেন না, সে-কথা ব্যাসও রেখে ঢেকে পিতামহের মতো লঘু প্রশ্রয়ে প্রকাশ করেছেন। বলেছেন—দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের ব্যাপারে চিরকালই একটু অভিমানবতী-অভিমানবতী নিত্যং বিশেষেণ যুধিষ্ঠিরে।

কিন্তু অভিমানের কথাগুলি কেমন? দ্রৌপদী বললেন, অনেক কথাই বললেন, ‘ক্লীব’-টিব ইত্যাদি গালাগালিও বাদ গেল না। রাজনীতি, দণ্ডনীতির মধ্যে দ্রৌপদীর অভিমানও মিশে গেল। বললেন—আজকে আমার এতগুলো স্বামী কেন—কিং পুনঃ পুরুষব্যাঘ্র পতয়ো মে নরর্ষাভাঃ। আমার তো মনে হয় তোমাদের মধ্যে কেউ একজন আমার স্বামী হলেই আমার যথেষ্ট সুখ হত। একোপি হি সখায়ৈষাং মম স্যাদিতি ম মতিঃ। (দ্রৌপদী শুধু অর্জুনকে ব্যঞ্জনা করেননি তো?)। কিন্তু কপালের ফের, শরীরে যেমন পাঁচটা ইন্দ্রিয় থাকে তেমনি তোমরা পাঁচজনই আমার স্বামী। দ্রৌপদী ভুলে যাননি যে মূলত যুধিষ্ঠিরের পাশা-পণের চাপেই কৌরবসভায় তার চরম অপমান এবং পাশার দৌরাত্ম্যেই আবার অজ্ঞাতবাস। যুধিষ্ঠির নিজেও এ-কথা সবিনয়ে স্বীকার করেছেন। কিন্তু স্বীকার করলেই কী? এই ব্যবহারগুলির মধ্যে দ্রৌপদী ‘মা’ কিংবা ‘বড়বোনে’র সম্মান পাননি। পরবর্তীকালে দেখেছি, এতকাল বনবাস-যুদ্ধ এবং সত্যি সত্যি যুদ্ধের পর যখন আবার যুধিষ্ঠিরের বৈরাগ্য এসেছে, তখন দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন—‘তুমি উন্মাদ’ এবং তোমার পাগলামির জন্যেই তোমার পাঁচ ভাইও আজ পাগল হতে বসেছে—তবোন্মদান্মহারাজ সোম্মাদাঃ সর্বপাণ্ডবাঃ। দ্রৌপদী বললেন—জননী কুন্তী বলেছিলেন, সমস্ত শত্রুশাতন করে যুধিষ্ঠির তোমায় সুখে রাখবে। ছাই—তদ্‌ ব্যর্থং সুংপ্রপশ্যামি। তুমি উন্মাদ, ডাক্তার ডাকিয়ে চিকিৎসা করাও। ধূপ, কাজল আর নস্যির ব্যবস্থা নিয়ে কবিরাজ আসুন—ভেষজৈঃ স চিকিৎস্যঃ স্যাৎ…ধূপৈরঞ্জনযোগৈশ্চ নস্যকর্মভিরেব চ।

সত্যিই যুধিষ্ঠিরের ব্যবহারে এই দ্বিমাত্রিকতা আছে। যিনি আজকে দ্রৌপদীকে মায়ের মতো, বড়বোনের মতো প্রতিপাল্যা মনে করেন, তিনিই পূর্বে তাঁকে পাশা খেলায় পণ রাখেন কী করে? ভীমের তো এইটেই খারাপ লেগেছে। তাঁর মতে পাশাখেলায় ধন-সম্পত্তি হেরে যাই, রাজ্য হারাই—দুঃখ নেই। কিন্তু এটাই যুধিষ্ঠিরের বাড়াবাড়ি যে, তিনি দ্রৌপদীকে পণ রেখেছেন—ইমং ত্বতিক্রমং মন্যে দ্রৌপদী যত্র পণ্যতে। বস্তুত যুধিষ্ঠির ছাড়া ভীম, অর্জুন কারও ব্যবহারেই দ্রৌপদী বৈষম্য খুঁজে পাননি। বিশেষত দ্রৌপদীর সম্বন্ধে ভীমের গৌরববোধ এতই বেশি যে, তিনি বিশ্বাসই করতে পারেন না যে—অজ্ঞাতবাসে দ্রৌপদীকে লুকিয়ে রাখা যাবে। যুধিষ্ঠির অজ্ঞাতবাসের সাজ নিয়ে চিন্তা করেছেন অজ্ঞাতবাসের আগে। কিন্তু ভীম তো সেই প্রথম বনবাসে দ্বৈতবনে বসেই ভাবছেন দীপ্তিমতী দ্রৌপদীকে লুকিয়ে রাখবেন কী করে? অজ্ঞাতবাসের আবরণে ফুলটি না হয় লুকোনোই রইল, কিন্তু পাণ্ডবঘরণীর উদীৰ্ণ গন্ধ লুকোবেন কী করে? সেই বনপর্বেই ভীম বলছেন—এই যে ‘পুণ্যকীর্তি রাজপুত্রী দ্রৌপদী’, ইনি এতই বিখ্যাত যে লোকের মধ্যে অপরিচিতার মতো থাকবেন কী করে—বিশ্রুতা কথম্‌ অজ্ঞাতা কৃষ্ণা পার্থ চরিষ্যতি।

গর্বে বুঝি কৃষ্ণার বুক ফুলে উঠেছিল সেদিন। বুঝেছিলেন এই মানুষটিই তাঁর একমাত্র নির্ভর কৌরবসভায় প্রিয়া মহিষীর অপমানে বারংবার যে মানুষটি সভাস্তম্ভের দৈর্ঘ্য মেপে মেপে দেখছিলেন, সেই মানুষটিই তাঁর একান্ত নির্ভর। তাঁর এই আস্থার প্রমাণ দিয়েছেন ভীম, দ্রৌপদীর মুখের এককথায় হিমালয় থেকে পদ্মফুল কুড়িয়ে এনে। বস্তুত দ্রৌপদীর ব্যাপারে ভীমের এই যে গৌরববোধ তা একেবারে মিথ্যে ছিল না। ধরে নিতে পারি যজ্ঞবেদী থেকে উঠবার সময়েই যে কুমারী—তাম্রতুঙ্গনখী সুভ্রুশ্চারুপীনপয়োধরা,—তিনি বিবাহসময়ে নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ যৌবনবতী, পুস্পবতী। বিবাহের পর বনবাসের সময় পর্যন্ত দ্রৌপদীর অনেক বছর কেটেছে। এতদিনে পঞ্চবীর স্বামীকে পাঁচ পাঁচটি বীর সন্তানও উপহার দিয়েছেন তিনি—প্রতিবিন্ধ্য, সুতসোম, শ্রুতকর্মা, শতানীক এবং শ্রুতসেন—এই পঞ্চপুত্রের জননী দ্রৌপদী। বনবাসপর্বে কৃচ্ছ্রতায় মালিন্যে বারো বছর কেটেছে, তবুও দ্রৌপদীর দেহজ আকর্ষণ বোধহয় একটুও কমেনি। ভীমের ভালবাসার ভয় তাই মিথ্যে নয়—বিশ্রুতা কথম্‌ অজ্ঞাতা কৃষ্ণা পার্থ চরিষ্যতি। বিশেষত অন্য মানুষের কাছে দ্রৌপদীর আকর্ষণ এতই বেশি যে, ভীমের দায়িত্ব বারবার বেড়ে গেছে এবং বারবার তিনিই দ্রৌপদীর আস্থাভাজন হয়ে উঠেছেন, অর্জুন নন, যুধিষ্ঠির তো ননই।

স্মরণ করুন সেই দিনটির কথা। পাণ্ডবেরা সবাই দ্রৌপদীকে ঘরে একলা রেখে চারদিকে বেরিয়ে পড়েছেন মৃগয়ায়, নিজেদেরও খেতে হবে, ব্রাহ্মণদেরও খাওয়াতে হবে। কিন্তু এই সময়ে সিন্ধু-সৌবীর দেশের রাজা জয়দ্রথ মনে মনে বিয়ের ভাবনা নিয়ে উপস্থিত হলেন শাল্বরাজার নগরীতে। জয়দ্রথের বিয়ে হয়ে গেছে, প্রথিতযশা ধৃতরাষ্ট্রের তিনি জামাই, দুঃশলাকে বিয়ে করে স্বয়ং দুর্যোধনকে তিনি সম্বন্ধী বানিয়েছেন। কিন্তু জয়দ্রথের আবার বিয়ে করার ইচ্ছে হয়েছে, তাই আবার বরের সাজে বেরিয়ে পড়েছেন, তবে ছাতনাতলাটি ঠিক কোথায় এখনও ঠিক জানেন না শাল্বনগরী থেকে আরও রাজা-রাজড়াদের বরযাত্রী নিয়ে তিনি কাম্যক বনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন। পাণ্ডবরাও তখন কাম্যক বনে এবং একলা ঘরে দ্রৌপদী। নির্জন বন। নতুন মেঘে বিদ্যুতের ছটা লাগলে যে শোভা হয়, দ্রৌপদীর আগুন-রূপের বিজলী লেগে বনস্থলীরও সেই দশা। তিনি কুটিরের দ্বারেই বসেছিলেন এবং চোখে পড়ে গেলেন জয়দ্রথের। শুধু জয়দ্রথ কেন, উপস্পিত সকলেই দ্রৌপদীকে না দেখে পারছিলেন না। ইনি অপ্সরা না দেবকন্যা—এইসব গতানুগতিক তর্কে অন্যেরা যখন ব্যস্ত, তখন কিন্তু জয়দ্রথের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেছে—দৃষ্ট্বা তাং দুষ্টমানসঃ। অব্রবীৎ কামমোহিত। বন্ধুকে ডেকে জয়দ্রথ দ্রৌপদীর সমস্ত খবর নিতে বললেন। মহাভারতকারের মতে ব্যাপারটা ছিল—ঠিক শেয়াল যদি বাঘের সুন্দরী বউয়ের খবরাখবর জানার চেষ্ট করে—সেইরকম—ক্রোষ্টা ব্যাঘ্রবধূমিব।

আহা! জয়দ্রথের দিক থেকেও ব্যাপারটা একটু চিন্তা করুন পাঠক! নির্জন অরণ্যে একাকিনী সুন্দরী, যাঁর প্রতি অঙ্গসংস্থানে এখনও কোনও খুঁত নেই—‘অনবদ্যাঙ্গী’—তাঁর দিকে যুবক পুরুষের তাকাবে না, বিশেষত যে যুবক বিবাহার্থী! আমি বেশ জানি, জয়দ্রথ জ্ঞাতি-সম্বন্ধে পাণ্ডবদের পূর্বপরিচিত হলেও পাণ্ডব ঘরণীকে তিনি চিনতেন না। নির্জন অরণ্যে একচারিণী সুন্দরীকে দেখে বিবাহার্থী যুবকের মনে এই ইচ্ছে হতেই পারে যে, এই সুন্দরীকেই বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে যাই—এতামেব অহামাদায় গমিষ্যামি স্বমালয়ম্‌। তবে সন্দেহ এই—এমন চেহারা, ভুরু, দাঁত, চোখ, কোনও কিছুতেই খুঁত নেই, উত্তমাঙ্গ অধমাঙ্গ অনালোচ্য, শুধু বলি তনুমধ্যমা ইনি—আমাকে পছন্দ করবেন তো? জয়দ্রথ বন্ধুকে খোঁজ করতে পাঠালেন।

আমি বলি, দ্রৌপদীরও দোষ ছিল। না হয় তিনি পঞ্চস্বামিগর্বিতা রাজপুত্রী। কিন্তু সুন্দরী সোমির মধ্যে বিশেষত যেখানে তাঁর পাঁচ স্বামীই বাইরে গেছেন—সেখানে এই খ্যাপা হাওয়ার-ব্যাধূয়মানা পবনেন সুভ্রু—কুটির দুয়ারে দাঁড়িয়ে থাকার প্রয়োজন কী? দ্রৌপদীর আরও দোষ—এমন আগুনপানা রূপ যখন—দেদীপ্যমানাগ্নিশিখেব নক্তং—সেখানে দুয়ার থেকে নেমে এসে (দ্রৌপদী বিলক্ষণ জানতেন—রাজপুরুষেরা তাঁকে দেখছিলেন, সর্বে দদৃশুস্তাম্ অনিন্দিতাম্‌, জয়দ্রথ তাকে দেখে বন্ধুর কাছে গুনগুন করছিলেন এবং বন্ধু কোটিকাস্য তাঁর দিকে আসছে দেখেও)—দুয়ার থেকে নেমে এসে চিরকালের প্রেমের প্রতীক কদমগাছের একখানি অবাধ্য ডাল নুইয়ে ধরেছিলেন কেন—কদম্বস্য বিনাম্য শাখাম্‌ একাশ্রয়ে তিষ্ঠসি শোভমানা। দ্রৌপদী কি বুঝতে পারছিলেন না, এই শাখা নোয়ানোর আয়াসে, আন্দোলিত শরীরে, খ্যাপা হাওয়ায় তাঁকে আরও মোহিনী, আরও সুন্দরী লাগছিল!

দ্রৌপদী গাছের ডাল ছাড়লেন। যখন নাকি জয়দ্রথের বন্ধু তাঁর সহগামী সমস্ত রাজপুরুষের একে একে পরিচয় দিয়েছেন, তখন দ্রৌপদী কদম্বের ডাল মুক্ত করলেন। যখন জয়দ্রথের পরিচয় দিয়ে বন্ধু জিজ্ঞাসা করলেন—তুমি কার বউ, কার মেয়ে—তখন দ্রৌপদী গাছের ডাল ছাড়লেন। সেই তখনই দ্রোপদী মন্দ ভাবনায় উত্তমাঙ্গের ক্ষৌম বনবাসখানি আরও একটু টেনে নিলেন—অবেক্ষ্য মন্দং প্রবিমুচ্য শাখাং সংগৃহ্নতী কৌশিক উত্তরীয়ম্। সংরক্ষণশীলেরা বলবেনই—দ্রৌপদীর দোষ ছিল। কিন্তু মহাশয়! দ্রৌপদীর ব্যবহারে লুকানো আছে চিরকালের বিবাহিতা রমণীর মনস্তত্ত্ব। বিবাহিতা বলে কি নিজের যৌবন অন্য পুরুষের চোখের আলোয় একটুও পরীক্ষা করবে না রমণী! একটুও পরখ করবে না, এই বেলাতেও তার আকর্ষণ আছে কিনা? দ্রৌপদী এতক্ষণ কদমগাছের শাখা টানাটানি করে এই পরীক্ষাই চালিয়েছেন। কিন্তু পরীক্ষায় সফল হওয়া মাত্রেই ঈষৎ-স্রস্ত উত্তরীয় টেনে নিয়েছেন। নিশ্চয় বিপদ বুঝে—অবেক্ষ্য মন্দম্।

আমরা কি দ্রৌপদীর মনস্তত্ত্ব-চিন্তায় প্রসঙ্গ হারিয়ে ফেলেছি? আমরা দ্রৌপদীর প্রতি ভীমের স্বামি-ব্যবহার নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কিন্তু দ্রৌপদী যেমন স্বামী থাকতেও নিজের অস্তিত্ব, নিজের আকর্ষণ যাচাই করে নিলেন, আমরাও তেমনি একটু অন্য প্রসঙ্গ থেকে ঘুরে এলাম। বলা বাহুল্য, দ্রৌপদী বিদগ্ধা রমণী, ঠারে-ঠোরে আপন মাধুর্যের পরীক্ষা শেষ হতেই বিদগ্ধা বিবাহিতার পতিগৌরব ফিরে আসে। দ্রৌপদীরও তাই হয়েছে, অতএব আমরাও প্রসঙ্গে উপস্থিত। জয়দ্রথের বন্ধু দ্রৌপদীর মুখে পঞ্চপাণ্ডবের বৃত্তান্ত শুনে এসে জয়দ্রথকে জানাল। জানাল সে পাণ্ডবদের প্রিয় পত্নী।

মধুলম্পট যে ভ্রমর একবার মল্লিকা ফুলে বসেছে, তার আর অন্য ফুল ভাল লাগে না, এ-কথা রসিক আলংকারিকেরা বলেছেন। জয়দ্রথের অবস্থায় এখন তাই। সে বললে—বিবাহিতা রমণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতমা এই মহিলাকে দেখে আর ফেরার পথ নেই—সিমস্তিনীনাং মুখ্যায়াং বিনিবৃত্তঃ কথং ভবান্‌। বস্তুত দুর্যোধনের বোন দুঃশলা, যে তার পূর্ব-পরিণীতা বধুও বটে, সেই দুঃশলাকেও বুঝি দ্রৌপদীর তুলনায় বানরী বলে মনে হচ্ছিল জয়দ্রথের কাছে—যথা শাখামৃগস্ত্রিয়ঃ। জয়দ্রথ মনের বেগ আর সহ্য করতে না পেরে সোজা উপস্থিত হল দ্রৌপদীর কাছে। বলল—সব ভাল তো, তুমি, তোমার স্বামীরা?

ঠাকুরজামাই বাড়ি এলেন। দ্রৌপদী বললেন—ভাল আছি গো ঠাকুরজামাই, সবাই ভাল আছি। যুধিষ্ঠির, তাঁর ভাইয়েরা এবং আমি—সবাই ভাল। এই নাও পা ধোবার জল, এইখানটায় বোস। আজকে তোমায় পাঁচশো হরিণের মাংস দিয়ে প্রাতরাশ খাওয়াব, ঠাকুরজামাই—মৃগান্ পঞ্চশতঞ্চৈব প্রাতরাশান্‌ দদানি তে। জয়দ্রথ বললে—তোমার প্রাতরাশ মাথায় থাকুক—কুশলং প্রাতরাশস্য—এখন আমার রথে ওঠ। রাজ্যহীন বনচারী পাণ্ডবদের উপাসনা করার যোগ্য নও তুমি। তুমি হবে আমার বউ-ভার্যা মে ভব সুশ্রোণি। দ্রৌপদীর বুক কেঁপে উঠল। ভ্রুকুটি-কুটিল কটাক্ষে একটু সরে গিয়ে দ্রৌপদী বললেন—লজ্জা করে না তোমার, কী সব বলছ? বিপদ বুঝে বিদগ্ধা রমণী অপেক্ষা করতে লাগলেন স্বামীদের, আর মুখে নানা মিষ্টি কথা বলে রীতিমতো ভুলিয়ে দিলেন জয়দ্রথকে—বিলোভয়ামাস পরং বাক্যৈর্বাক্যানি যুঞ্জতী। পাঁচ পাঁচটা জোয়ান মরদকে যিনি হেলায় ভুলিয়ে রেখেছেন, তাঁর পক্ষে কিছু সময়ের জন্য জয়দ্রথকে ভোলানো অসম্ভব নয়। কিন্তু সে যে দুষ্ট মানুষ, কামার্ত। দ্রৌপদীকে আবার রেগে উঠতে হল। ইন্দ্ৰকল্প স্বামীদের কুৎসা তিনি আর সইতে পারছিলেন না। স্বামীদের বল-বীর্য সম্বন্ধে তিনি কিছু বলাও প্রয়োজন বোধ করলেন।

স্বামীদের প্রসঙ্গে দ্রৌপদীর ভাব-ভাবনার কথায় এই অংশটুকুই আমার প্রয়োজন ছিল, কিন্তু দুষ্টজনের কাছে স্বামি-গৌরব করতে হলে সব স্বামীরই গৌরব করতে হয়। সেই সাধারণীকরণের সভ্যতার মধ্যে থেকে স্ত্রী-হৃদয়ের নির্ভরতা বের করে আনা কঠিন। এখানে যুধিষ্ঠিরকেও সংগ্রামী ভূমিকায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে দ্রৌপদী জয়দ্রথকে বললেন—তুমি ভাবছ যুধিষ্ঠিরকে জয় করে আমায় নিয়ে যাবে। এটা কেমন জান—কেউ যদি হাতে একটা ছুড়ি নিয়ে ভাবে, ‘আমি হিমালয়ের পাহাড়ি হাতি মেরে ফেলব’, সেইরকম। তা ছাড়া রেগে যাওয়া ভীমকে কি তুমি দেখেছ? দেখনি। পালিয়ে যেতে যেতে যখন দেখবে, তখন মনে হবে ‘ঘুমিয়ে থাকা মহাবল সিংহের দাড়ি ধরে টেনেছি, এখন উপায়—সিংহস্য পক্ষ্ণানি মুখাল্লুনাসি’।

দ্রৌপদী অর্জুনের বেলাতেও সিংহের উপমা দিলেন। নকুল-সহদেবেরও কম প্রশংসা করলেন না। কিন্তু জয়দ্রথ ছাড়বেন কেন, তিনি পাণ্ডবদের নিন্দা করেই চললেন এবং প্রচুর ছুঁয়ো-না, ছুঁয়ো-না’র মধ্যেও দ্রৌপদীর আঁচল ধরে টান দিলেন। টানের চোটে দ্রৌপদী জয়দ্রথের কাছে এলেন বটে, কিন্তু তিনি তো সীতা-সাবিত্রী নন কিংবা অত ‘স্পর্শকাতর’ও নন, কাজেই নিজের আঁচলের উল্টো টানে জয়দ্রথকে তিনি ফেলে দিলেন মাটিতে—সমবাক্ষিপৎ সা। পাঞ্চালী-মেয়ের ঠেলা জয়দ্রথ সামলাতে পারল না, কিন্তু পড়ে গিয়েও সে দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে উঠে এল। আঁচল ধরে সে যখন টানতেই থাকল, তখন দ্রৌপদী ধৌম্য পুরোহিতকে জানিয়ে উঠে পড়লেন জয়দ্রথের রথে। আমি নিশ্চয় জানি, অনুরূপ পরিস্থিতিতে দণ্ডক-গতা সীতার সঙ্গে দ্রৌপদীর তফাত হল—নিজের অনিচ্ছায় পুরুষের স্পর্শমাত্রেই তিনি কাতর হন না—তার পরীক্ষা দুঃশাসনের টানাটানিতেই হয়ে গেছে। দ্রৌপদী যদি ব্যাসের না হয়ে বাল্মীকির হতেন, তা হলে হয় তাঁকে এখন ‘সুইসাইড’ করতে হত নয়তো মায়া-দ্রৌপদী হয়ে জয়দ্রথের সঙ্গে যেতে হত। দ্বিতীয়ত, দুঃশাসনের অভিজ্ঞতায় তিনি স্বেচ্ছায় রথে উঠেছেন—সাকৃষ্যামাণা রথম্ আরুরোহ। তৃতীয়ত, দ্রৌপদীর সুবিধে ছিল, তাঁর ‘রাম’ একটি নয়, পাঁচটি ; তাঁর অবিচল ধারণা ছিল—পাঁচটি যখন পাঁচ দিকে মৃগয়া করতে গেছে, তখন তাঁর চিৎকারে একটা না একটা স্বামীকে বনপথেই পাওয়া যাবে। দ্রৌপদী স্বেচ্ছায় রথে উঠলেন।

সত্যিই পাণ্ডবেরা এসে গেলেন। ঘরে ফিরে ঘটনা শুনেই তাঁরা জয়দ্রথের পিছু নিলেন। একসময়ে জয়দ্রথ তাঁদের দেখতে পেলেন এবং ভয়ে তার প্রাণ উড়ে গেল। আমি আগেই বলেছি, জয়দ্রথ পাণ্ডব এবং দ্ৰৌপদী কাউকেই ভাল চিনতেন না। সে দ্রৌপদীকে স্বামি-পরিচয় দিতে বলল এবং ঠিক এইখানটায় শত সাধারণীকরণের মধ্যেও দ্রৌপদী কোন স্বামীকে কেমনটি দেখেন তার একটা দ্বিধাহীন বর্ণনা আছে। প্রত্যেক স্বামী সম্বন্ধে দ্রৌপদীর গৌরবের মধ্যেও কোথাও যেন তাঁর পক্ষপাতের বিশেষ আছে। ঠিক এই বিশ্লেষণটায় পৌঁছনোর জন্যই আমাকে জয়দ্রথের পথটুকু অতিক্রম করতে হল।

ভীত ত্রস্ত জয়দ্রথ বললেন—ওই এলেন বুঝি তোমার স্বামীরা। একটু বুঝিয়ে বলবে সুন্দরী, কার কেমন ক্ষমতা? দ্রৌপদী বললেন, তোমার আয়ু শেষ হয়ে এসেছে—এখন আর ওসব বলেই বা কী হবে? তবে কিনা মৃত্যু পথের পথিক যে, তার শেষ ইচ্ছে পূরণ করা ধর্ম, তাই বলছি। ওই যে দেখছ—চোখ দুটো টানা টানা, ফরসা চেহারার মানুষটি—ইনি কুরুবংশের শ্রেষ্ঠ পুরুষ যুধিষ্ঠির, কি যাঁকে ধর্মপুত্র বলে ডাকে। শত্রুও যদি শরণাগত হয়, তবে তাকেও ইনি প্রাণদান করেন।

লক্ষণীয়, যুধিষ্ঠিরের বল, বীর্য, যুদ্ধক্ষমতা—এইসব বীরসুলভ গুণের দিকে দ্রৌপদীর আর কোনও নজর নেই, তাঁর দৃষ্টিতে যুধিষ্ঠির শরণাগত শত্রুরও পালক অর্থাৎ নিজের কিংবা আপনজনের ক্ষতি স্বীকার করেও তিনি শত্রুকে বাঁচান। দ্রৌপদী এবার ভীমের প্রসঙ্গে এলেন, বললেন—ওই যে দেখছ শাল খুঁটির মতো লম্বা চেহারা, বড় বড় হাত ; ভ্রুকুটি-কুটিল চোখ আর দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে যাচ্ছে, ইনিই আমার স্বামী ভীম। লোকে ওকে ভীম বলে কেন জান—ওর কোনও কাজই সাধারণ মানুষের মতো নয়। তৃতীয় ব্যক্তির চোখ থেকে সরে এসে একান্ত আপন এবং নিবিড় দৃষ্টিতে ভীমকে যেমন লাগে, দ্রৌপদী এবার তাই বলছেন—অন্যায় করে এই মানুষটির কাছে বাঁচবার আশা কম। তা ছাড়া শত্রুতার একটি শব্দও ইনি ভোলেন না—নায়ং বৈরং বিস্মরতে কদাচিৎ—এবং শত্রুর প্রাণ না নেওয়া পর্যন্ত তাঁর মনে শান্তি থাকে না।

দ্রৌপদী যা বলেছেন, তার প্রমাণও তিনি পেয়েছেন। কৌরবদের পাশাখেলার আসরে একমাত্র ভীমই চুপ করে থাকতে পারেননি। বারংবার তাঁর ভীষণ প্রতিজ্ঞায় সভাগৃহ কেঁপে উঠেছিল, এবং ভবিষ্যতে দ্রৌপদীর এই ধারণা প্রমাণিত করেছে যে, ভীম কখনও শত্রুতা ভোলেন না। অথচ দেখুন, যে অর্জুনের সঙ্গে দ্রৌপদীর মালাবদল হয়েছিল এবং যাঁর মতো বীর সমকালে প্রায় কেউ ছিল না, তাঁর অনেকগুনের পরিচয় দিয়ে দ্রৌপদী বললেন—ইনি যুধিষ্ঠিরের শুধু ভাইই নয়, শিষ্যও বটে—ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য। ছোটভাই বড়ভাইয়ের কথায় ওঠেন বসেন, অন্য মানুষের কাছে এর থেকে বেশি পারিবারিক গরব আর কী আছে। কিন্তু দ্রৌপদীর ব্যক্তিজীবনেও তাঁর এই বিশ্লেষণের গুরুত্ব আছে। সেই যেদিন কুন্তী-যুধিষ্ঠির দ্রৌপদীকে ভিক্ষা ভেবে ভাগ করে নিলেন, সেদিনও এই মানুষটি কিছু বলেননি। তারপর দিন গেছে, রাত গেছে, কৌরবসভায় সেই চরম অপমানের দিন এসেছে, অর্জুন কিছুই বলেননি, কেননা ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির সত্যবদ্ধ এবং তিনি যদি কোনও উচ্চবাচ্য না করেন অর্জুনও করবেন না, কারণ ইনি ‘ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য’। এই ব্যবহার বোধহয় দ্রৌপদীর ভাল লাগেনি, এমনকী ভীম যখন যুধিষ্ঠিরের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে রুখে ওঠেন, তখন তাঁকেও শান্ত করে দেন এই অর্জুন। দ্রৌপদীর চোখে তিনি তাই যুধিষ্ঠিরের ভাই এবং ভাবশিষ্য।

জয়দ্রথের সেনাবাহিনী এবং পঞ্চপাণ্ডবের যুদ্ধ বাধল। প্রথমেই যাকে নির্ভীক ভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা গেল—তিনি ভীম। অবশ্য স্ত্রীরক্ষার জন্য এখানে যুধিষ্ঠির থেকে সহদেব সবাই যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে জয়দ্রথ দ্রৌপদীকে ছেড়ে বনের মধ্যে পালালেন এবং যে মুহূর্তে ভীম জানতে পারলেন, সেই মুহুর্তেই ধর্মরাজকে তিনি বললেন—সবাইকে নিয়ে আপনি কুটিরে ফিরে যান এবং দ্ৰৌপদীকে দেখা-শোনা করুন। জয়দ্রথকে আমি দেখছি, তার আজকে বেঁচে ফেরা কঠিন। যুধিষ্ঠির জানেন তাঁর অনুপস্থিতিতে জয়দ্রথ যদি ভীমের হাতে পড়ে, তাহলে দলাপাকানো মাংসপিণ্ড ছাড়া জয়দ্রথকে আর চেনা যাবে না। যুধিষ্ঠির অনুনয় করে বললেন—ভগিনী দুঃশলা বিধবা হবে, জননী গান্ধারীর একমাত্র কন্যা বিধবা হবে। এই দুঃশলা আর গন্ধিারীর কথা মনে রেখে অন্তত তাকে প্রাণে মেরো না—দুঃশলামভিসংস্মৃত্য গান্ধারীঞ্চ যশস্বিনীম্।

দ্রৌপদী প্রথমেই ব্যাকুল হয়ে ডেকে উঠলেন ভীমকে—ভীমম্‌ উবাচ ব্যাকুলেন্দ্রিয়া। তারপর দেখলেন অর্জুনের মতো সম্মানিত পুরুষও সেখানে দাঁড়িয়ে। তখন দুজনকেই যেন উদ্দেশ করে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের কথার প্রতিবাদ জানালেন দ্রৌপদী। তিনি বললেন—যদি আমার ভাল লাগার কথা বল, তাহলে মানুষের অধম সেই জয়দ্রথকে কিন্তু মারাই উচিত—কর্ত্তব্যং চেৎ প্রিয়ং মহং বধ্যঃ স পুরুষাধমঃ। জনান্তিকে বলি—‘আমার ভাল লাগবে’ এই কথাটা কিন্তু অবশ্যই ভীমের উদ্দেশে, কারণ তিনিই এ-ব্যাপারে একমাত্র উদ্যোগী ছিলেন এবং দ্রৌপদীর ভাল লাগার মূল্যও তিনিই সবচেয়ে বেশি দেন। সেইজন্যেই বুঝি ভীমকে তিনি প্রথমে বলতে আরম্ভ করেছিলেন। দ্রৌপদী বললেন—যে পরের বউ চুরি করে এবং যে রাজ্য চুরি করে সেই অপরাধী বারবার যাচনা করলেও তাকে ছেড়ে দেওয়া উচিত নয়।

আমার ধারণা, এই রাজ্য চুরির কথাটা যে হঠাৎ দ্রৌপদীর মুখে এল, তা এমনি এমনি নয়। ব্যাস এই মুহূর্তে দ্রৌপদীর বিশেষণ দিয়েছেন ‘কুপিতা, হ্রীমতী, প্রাজ্ঞ’। প্রাজ্ঞা দ্রৌপদী এ-কথাটা অর্জুনের উদ্দেশে আকাশে উড়িয়ে দিয়েছেন। ভাবটা এই—যারা রাজ্য চুরি করেছে তাদের তো ছেড়েই দিয়েছ, এখন বউ-চুরির ব্যাপারে কী কর দেখি—পুরুষ মানুষেরা তো এই দুটি বস্তুকেই জমি বলে ভাবে। ভীম-অর্জুন ঝড়ের বেগে গিয়ে জয়দ্রথকে ধরে ফেললেন এক ক্রোশের মাথায়। তিনি তখন বনের পথে পালাচ্ছেন। অর্জুন নায়কের মতো বললেন—এই ক্ষমতায় পরের বউ চুরি করতে আস? পালিয়ে যেয়ো না, ফিরে এসো বলছি। কিন্তু জয়দ্রথ কি আর সেখানে থাকে! এবারে ভীম হঠাৎ করে ছুট লাগালেন জয়দ্রথের পেছনে—দাঁড়া ব্যাটা, যাস কোথায়—তিষ্ঠ তিষ্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে ধর্মরাজের শিষ্য বিবেকরূপী অর্জুন চেঁচিয়ে বললেন—প্রানে মেরো না ভাই—মা ব্যধীরিতি।

ভীম প্রথমেই জয়দ্রথের চুলের মুঠি ধরে তার মুখটা একটু বনের মাটিতে ঘষে নিলেন। তারপর দু-চার ঘা চড়ালেন মাথায়। তারপরের ব্যাপারটা অনেকটা হিন্দি সিনেমার মতো। খলনায়ক মাটিতে পড়ে গেছে, আর নায়ক বলছে ‘উ্‌ঠ উঠ্‌’, তারপর আবার মার। তেমনি জয়দ্রথ যেই একটু সামাল দিয়ে মাটি থেকে উঠতে চায়—পুনঃ সঞ্জীবমানস্য তপস্যোৎপতিতুমিচ্ছতঃ—অমনি ভীমের লাথি। এবার থামালেন অর্জুন। কিন্তু ভীম কি থামতে চান! তিনি অর্জুনের তূণ থেকে একখানি আধা-চাঁদের মতো বাণ দিয়ে জয়দ্রথের মাথাটা পাঁচ জায়গায় চেঁছে নিলেন, তারপর তাকে নিয়ে এলেন সেই বনের কুটিরে, যেখানে দ্রৌপদী আছেন, যুধিষ্ঠির আছেন। যুধিষ্ঠির জয়দ্রথের অবস্থা দেখে বললেন—এবার ছেড়ে দাও ভাই—মুচ্যতামিতি চাব্রবীৎ।

দ্রৌপদী জয়দ্রথকে পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন—ভ্রাতা চ শিষ্যশ্চ যুধিষ্ঠিরস্য—ইনি যুধিষ্ঠিরের শিষ্য অর্জুন। জয়দ্রথের ঝুঁটি-ধরা মানুষটি যদি সেই অর্জুন হতেন, তাহলে যুধিষ্ঠিরের কথা মুখ দিয়ে বেরনো মাত্রেই তিনি মুক্ত হতেন। কিন্তু ইনি তো অৰ্জুন নন, ভীম। কাজেই যুধিষ্ঠিরের কথায় কাজ হল না। কৌরবের রাজসভায় দ্যূতক্রীড়ায়, এবং দুঃশাসনের হাতে দ্রৌপদীর যে অপমান হয়েছিল, তার সমমর্মী যুধিষ্ঠিরও নন, অর্জুনও নন। তার ওপরেও জয়দ্রথকে ধরতে যাবার আগে দ্রৌপদী যে ভীমকেই প্রথম ডেকে উচ্চ করে বলেছিলেন—যদি আমার ভাল লাগার কথা বল—কৰ্ত্তব্যং চেৎ প্রিয়ং মহ্যং বধ্যঃ স পুরুষাধমঃ—তাহলে জয়দ্রথকে শেষ করে দেবে। সবার মধ্যে দ্রৌপদীর এই আকুল আবেদন ভীম ভুলে যাবেন কী করে? হন না তিনি ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির। ভীম সোজা বললেন—আপনার কথায় ছাড়ব না, আপনি দ্রৌপদীকে বলুন—রাজানং চাব্ৰবীদ্‌ ভীমো দ্রৌপদ্যাঃ কথ্যতামিতি। যুধিষ্ঠিরের কথা মিথ্যে হয়ে যায়। তাঁর কাতর অবস্থা দেখে দ্রৌপদীর বুঝি মায়া হল। জয়দ্রথের ওপরে যতখানি, তার চেয়েও বেশি বোধ হয় যুধিষ্ঠিরের ওপর। হাজার হোক জ্যেষ্ঠ স্বামী বটে, যুধিষ্ঠিরের মুখ চেয়েই—অভিপ্রেক্ষ্য যুধিষ্ঠিরম্‌-দ্রৌপদী বললেন—যাক্‌ এর মাথাটা তো কামিয়ে নিয়েছ, এবার এটা পাণ্ডবদের দাস হয়ে গেছে, একে এবার ছেড়েই দাও। ছাড়া পেল দুর্যোধনের ভগ্নীপতি জয়দ্রথ। দ্রৌপদী আবার চিনলেন ভীম, অর্জুন এবং যুধিষ্ঠিরকেও।

বারো বছর বনের পথে চলে-ফিরে পুরো এক বছরের অজ্ঞাতবাসের সময় হয়ে গেল। ভীম তো সেই কবেই যুধিষ্ঠিরকে শাসিয়ে রেখেছেন—অজ্ঞাতবাসে দ্রৌপদীর এই আগুনপানা রূপ আপনি লুকিয়ে রাখবেন কী করে—বিশ্রুতা কথম্ অজ্ঞাতা কৃষ্ণা পার্থ চরিষ্যতি। কিন্তু বনের ফল আর মধু-খাওয়া গতানুগতিক মুখে অজ্ঞাতবাসের নতুনত্ব সব পাণ্ডবদের মুখেই বোধ হয় তেঁতুলের চাটনির কাজ করল, দ্রৌপদীর তো বিশেষত। যুধিষ্ঠির, ভীম—সবাই একে একে ‘আমি এই সাজব’, ‘আমি সেই সাজব’—এমনি করে নতুন ঘরের কল্পলোক তৈরি করলেন। সেখানে দ্রৌপদীও পেছিয়ে থাকবেন কেন! যুধিষ্ঠির অবশ্য বিরাটরাজার সঙ্গে আবার নতুন করে পাশার ছক পাতার গন্ধে দ্রৌপদীর বনবাসের কষ্টটা ভুলেই গেছিলেন। তিনি বেশ কর্তাঠাকুরের মতো বলেলন—আমরা সবাই তো এটা-ওটা করব ঠিক করলাম, কিন্তু দ্রৌপদীর তো অন্য বউদের মতো কাজকর্ম তেমন কিছু জানে না—ন হি কিঞ্চিদ্‌ বিজানাতি কর্ম কর্ত্তুং যথা স্ত্রিয়ঃ। ছোটবেলা থেকে যখন যেখানে গেছেন, দ্রৌপদী তো গয়না, কাপড়, এসেন্স আর বেণীতে ফুল গোঁজা ছাড়া আর কিছু জানেন না—মাল্যগন্ধান্‌ অলংকারাণ্‌ বস্ত্রাণি বিবিধানি চ। এতান্যেবাভিজাতি যতো যাতা হি ভাবিনী। বিরাটরাজার ঘরে ইনি কি কিছু করতে পারবেন?

কীই বা বলার আছে! জ্যেষ্ঠ-স্বামী, বড় মুখ করে বলছেন। দ্রৌপদী আর কী বা বলেন। হ্যাঁ বনবাসের কৃচ্ছ্রতার মধ্যেও দ্রৌপদীর দাস-দাসী প্রচুর ছিল, কিন্তু তাই বলে দিন রাত শাড়ি-গয়নার চিন্তা করার মতো অবিদগ্ধা নন দ্রৌপদী। হয়তো তাঁর মনে পড়ল—বিয়ের নববধূকে পাণ্ডবেরা কুমোরশালায়পরের বাড়িতে এনে তুলেছিলেন। হয়তো মনে পড়ল—সুখের মুখ দেখেছিলাম দুদিন বই তো নয়—সেই খাণ্ডবপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞের পরে। তারপরেই তো আবার পাশার আসর বসল আর কপালে জুটল বারো বছরের বনবাস, এক বছরের অজ্ঞাতবাস। তবু দ্রৌপদী এসব কথায় কথা বাড়ালেন না। বরঞ্চ অজ্ঞাতবাসের নতুন সাজের কথায় যেন বেশ মজাই পেয়েছেন, এমনি মেজাজে বললেন—লোকে তো ঘরে শিল্পকর্মের জন্য দাসী রাখে, যদিও ভদ্রঘরের মেয়ে-বউরা সে কাজ করেন না—একথা সবাই জানে —ইতি লোকস্য নিশ্চয়ঃ। আমি বিরাটরাজার রানির বাড়িতে সৈরন্ধ্রীর কাজ করব, তাঁর চুল বাঁধব, তাঁকে সাজিয়ে দেব।

দ্রৌপদী ‘সৈরন্ধ্রী’ কথাটার একটা বিশ্লেষণ করেছিলেন তাঁর বক্তব্যের প্রথম লাইনে। সৈরন্ধ্রীকে লোকে দাসীকর্মের জন্য রাখে এবং যে রাখে সে তাকে পালন করে। টীকাকার নীলকণ্ঠ দেখিয়েছেন—সৈরন্ধ্রী পরের ঘরে থাকে, কিন্তু সে স্বাধীনও বটে। সে দাসী হলেও খানিকটা অরক্ষিতা অর্থাৎ কিনা স্ত্রী-পুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে গৃহকর্তার যে দায়িত্ব থাকে, দাসীর ব্যাপারে তা থাকে না। আবার এই দাসীর চাকরিটা যেহেতু দাসীর নিজের হাতেই, তাই সে খানিকটা স্বাধীনও বটে অর্থাৎ তার অরক্ষণের ভাগ দিয়ে যদি কোনও বিপদ আসে, তাহলে সে চাকরি ছেড়ে দিতে পারে। কিন্তু মজা হল কাজের লোক যদি অতি সুন্দরী হয়, তবে তাকে নিয়ে গৃহকর্ত্রীর বিপদ আছে, বিশেষত সেকালের পুরুষ মানুষের কাছে মা আর বোন ছাড়া আর সবাই বুঝি গম্যা ছিলেন। যা হোক সবাই যখন নানা বেশে নানান ছাঁদে বিরাট রাজ্যে ঢুকে নিজের নিজের কাজ বাগিয়ে নিলেন, তখন দ্রৌপদীও কাজের লোকের মতো একটি ময়লা কাপড় পরে নিলেন। কিন্তু ময়লা কাপড় পড়লে কি হয়, তিনি যেহেতু বড় ঘরে চুল বাঁধার কাজ করবেন, তাই নিজের চুলেই যত পারেন বেশ খানিকটা কায়দা করে নিলেন। শুধু এপাশের চুল ওপাশে নিয়ে ক্ষান্ত হলেন না, কালো চুলে চিকন-মৃদু, দীর্ঘ-হ্রস্ব গ্রন্থি তুলে বড়ো বাহারি সাজে সাজলেন দ্রৌপদী। অ্যাডভারটাইজমেন্ট।

ময়লা কাপড়ের মধ্যে থেকে যে আগুনপানা রূপ চোখে পড়ছিল, আর কথাবার্তায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল এমনি বিদগ্ধতা যে, বিরাট-নগরের স্ত্রী-পুরুষ কেউই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে, পেটের দায়ে দ্রৌপদী খেটে খেতে এসেছেন—ন শ্রদ্ধধত তাং দাসীম্‌ অন্নহেতোরুপস্থিতাম্‌। বিরাটরাজার রানি সুদেষ্ণা পাঞ্জাব-ঘেঁষা কাশ্মীর অঞ্চলের মেয়ে। ছাদে আলসে থেকে অমন আলো-ছড়ানো রূপ দেখে তিনি দ্রৌপদীকে ডেকে আনলেন। বললেন, “কে গো তুমি মেয়ে, কী চাও”? “কাজ চাই, যে কাজে লাগাবে, তার বাড়িতেই থাক”—দ্রোপদী বললেণ। সুদেষ্ণা বললেন—এই কি কাজের লোকের চেহারা—নৈবংরূপা ভবন্ত্যেব যথা বদসি ভাবিনি? তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি নিজেই মাল্‌কিন। নইলে এমন চেহারা, হাত, পা, নাভি, নাক, চোখ—সবই সুন্দর, সুকেশী সুস্তনী শ্যামা পীনশ্রোণিপয়োধরা। কথা বলার ঢঙও তো একেবারে হাঁসের মতো—হংসগদ্‌গদভাষিণী। এক কথায় তুমি হলে দারুণ ‘স্মার্ট’, যেন কাশ্মীরি ঘোড়া—কাশ্মীরীব তুরঙ্গমী—আর লক্ষ্মীর মতো রূপ তোমার।

সুদেষ্ণা দ্রৌপদীর তুলনায় উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, সবাইকেই স্মরণ করলেন। দ্রৌপদী সলজ্জে বললেন—ওসব কিছুই নয়, নাস্মি দেবী ন গন্ধর্বী। আমি সৈরন্ধ্রী, খোঁপা বাঁধার কাজটি জানি ভাল, কুমকুম-চন্দনের আঙ্গরাগ তৈরি করি আর চাঁপা-মল্লিকার বিচিত্র মালা গাঁথতে পারি। ঘুরে ঘুরে বেড়াই, যেখানে যেখানে ভাল খাওয়া-পরা পাই—বাসাংসি যাবচ্চ লভে লভমানা সুভোজনম্‌—সেখানে সেখানেই নেই আমি থাকি। সুদেষ্ণা বললেন—তোমাকে মাথায় করে রাখতে পারি—মূধ্নি ত্বাং বাসয়েইয়ং, কিন্তু ভয় হয়, স্বয়ং রাজা যদি তোমার রূপ দেখে তোমার প্রেমে পড়ে যান। দেখ না, রাজকুলের মেয়েরাই তোমাকে কেমন ড্যাব্ ড্যাব করে দেখছে, সেখানে পুরুষমানুষের বিশ্বাস আছে—পুমাংসং কং ন মোহয়ে—তারা তো মোহিত হবেই। এখন যদি বিরাটরাজা তোমার রূপ দেখে আমাকে ছেড়ে তোমাকে ধরেন—বিহায় মাং বরারোহে গচ্ছেৎ সর্বেণ চেতসা। না, না, বাপু, তুমি এস, যেই তোমাকে দেখবে, তারই মাথা পাগল হবে, প্রেমে নয়, কামেই। তোমার মতো মেয়েমানুষকে ঘরে ঠাঁই দেয়া গাছের চুড়োয় উঠে আত্মহত্যা করা সমান।

দ্রৌপদী বললেন—কি বিরাটরাজা, কি আর কেউ, অন্য কোনও পুরুষ আমার ধারে কাছেও ঘেঁষতে পারবে না। আমার পাঁচটি গন্ধর্ব স্বামী আছে, তাঁরা আড়াল থেকে অদৃশ্যভাবেই আমাকে রক্ষা করেন শুধু একটা শর্ত—আমাকে উচ্ছিষ্ট খেতে দেবেন না অথবা কাউকে পা ধুইয়ে দিতে বলবেন না। এতেই আমার স্বামীরা সন্তুষ্ট। আমার রূপ দেখে কোনও পুরুষ যদি আমার পেছনে ছোঁক ছোঁক করে—যো হি মাং পুরুষো গৃধ্যেৎ—তাকে পরপারে যেতে হবে সেই রাত্রেই। অতএব আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমাকে সতীধর্ম থেকে টলানো অত সস্তা নয়, আমার অদৃশ্য স্বামীরা আছেন না! দ্রৌপদীর বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়ে বিরাটরানি সুদেষ্ণা দ্রৌপদীকে প্রধান পরিচারিকার স্থান দিলেন।

পঞ্চ গন্ধর্ব স্বামীর মধ্যে প্রধানত যাঁর ভরসায় দ্রৌপদী এত কথা বললেন, সেই মধ্যম পাণ্ডব ভীম কিন্তু দ্রুপদের পাকশালায় রাঁধার কাজে ব্যস্ত। ভাল খাইয়ে বলে ভীমের নাম ছিল, কাজেই রন্ধনশালায় ভীমের দিন খারাপ কাটছিল না। মাঝে মাঝে রাজার সামনে কুস্তির লড়াইতেও অংশ নিচ্ছিলেন তিনি। দ্রৌপদীরই একটু কষ্ট হচ্ছিল বুঝি, একমাত্র যুধিষ্ঠির ছাড়া আর সবারই পরিশ্রমের কাজ, সবাই রাজাকে কাজ দেখিয়ে তোষানোর চেষ্টা করছেন। দেওরপানা নরম-স্বামী নকুল-সহদেবের গরু-ঘোড়ার তদারকি দ্রৌপদীর স্ত্রীহৃদয়ে মমতা জাগাচ্ছিল। আবার ধরুন ভারতের ‘চিফ্‌ অব্‌ দ্য আর্মি-স্টাফকে’ যদি রবীন্দ্রভারতীর কলা বিভাগে কুচিপুড়ি শেখাতে হয়, তাহলে তার বউয়ের যে মর্মপীড়া হয়, বৃহন্নলাবেশী অর্জুনকে দেখে দ্রৌপদীর সেই পীড়াই হচ্ছিল—নাতিপ্রীতিমতী রাজন্‌।

যাই হোক সুখে দুঃখে দশ মাস কেটে গেল। দ্রৌপদী সুদেষ্ণার চুল বেঁধে, মালা গেঁথে ভালই দিন গুজরান করছিলেন। অজ্ঞাতবাসের পাট প্রায় চুকে এসেছে, এমনি এক দিনে সুদেষ্ণার ভাই কীচক এলেন বোনের খবর নিতে। তখনকার দিনে শালাবাবুদের খাতির ছিল এখনকার দিনের মতোই। বিশেষত সংস্কৃত কাব্যসাহিত্যে রাজার শালার একটি বিশেষ সুনাম আছে। আলংকারিকেরা দেখিয়েছেন, রাজার শালা মানেই সে অকালকুষ্মান্ড, কিন্তু শুধু রাজার শালা বলেই শাসন-বিভাগে তার ভাল কাজ জোটে এবং সেই জোরে সে নানা কুকর্ম করে বেড়ায়। এই নিয়মে বিরাটের শালাও কিছু ব্যতিক্রম নন। বোনের পাশে সুন্দরী দ্রৌপদীকে দেখেই তিনি বেশ তপ্ত হয়ে উঠলেন। সুদেষ্ণাকে বললেন—কে বটে এই মেয়েটা, আগে তো দেখিনি! এ যে একেবারে ফেনানো মদের মতো, আমাকে মাতাল করে তুলছে। কীচক বলল—তুমি একে দিয়ে দাসী-কর্ম করাচ্ছ, এই কি এর কাজ? এ হবে আমার ঘরের শোভা, আমার যা আছে তা সব দেব একে। কীচক আর অপেক্ষা করল না, অধৈর্য হয়ে সোজা দ্রৌপদীকেই সে কাম নিবেদন করল। কীচক প্রেম নিবেদন জানে না, তাই তার কথাই শুরু হল দ্রৌপদীর প্রত্যঙ্গ-প্রশংসায়। তার মধ্যেও আবার স্তন-জঘনের প্রশংসাই বেশি, এই জায়গাগুলোতে হার অলংকার না থাকায় রাজার শালা সেগুলো গড়িয়ে দেবার দায়িত্ব অনুভব করে। বারবার সে তার উন্মত্ত কামতপ্ত ভাব সোজাসুজি জানাতে থাকে। পাঁচ ছেলের মা এবং অন্তত আঠারো বছর বিবাহিত জীবন-কাটানো দ্রৌপদী কীচকের কাছে কাঁচা বয়েসের তিলোত্তমা—ইদঞ্চ রূপং প্রথমঞ্চ তে বয়ঃ। হয়তো শরীরের বাঁধন দ্রৌপদীর তেমনি ছিল এবং সেই কারণেই কীচক দ্রৌপদীর কাছে প্রতিজ্ঞা করে বসল—আমার পুরনো সব বউগুলোকে আমি ঘর থেকে বিদায় করে দেব, নয়তো তারা তোমরা দাসী হবে—ত্যজামি দারান্‌ মম যে পুরাতনাঃ/ভবন্তু দাস্যস্তব চারুহাসিনি। এমনকী আমাকেও তুমি যা বলবে তাই করব, আমিও তোমার দাস।

জয়দ্রথের অভিজ্ঞতায় দ্রৌপদী আর কথা বাড়ালেন না। নিজের প্রতি ঘৃণা জাগানোর জন্য দ্রৌপদী কীচককে বললেন—খুব খারাপ ঘরে আমার জন্ম, তা ছাড়া আমি অন্যের বউ। তোমার এই দুর্বুদ্ধি ত্যাগ কর। এ-সব সাধুভাষায় কি আর কামুককে ভোলানো যায়! নানা অকথা কুকথায় দ্রৌপদীর কান ভরিয়ে কীচক বলল—আমাকে প্রত্যাখ্যান করলে দারুণ বোকামি করবে তুমি, পরে তোমায় কাঁদতে হবে—পশ্চাত্তাপং গমিষ্যসি। তারপর, ক্ষমতা পেলে জামাইবাবুর করুণায় চাকরি-পাওয়া শালাবাবুদের যে অবস্থা হয় আর কি! কীচক বলল—জান, আমি এ-সমস্ত রাজ্যের হর্তা কর্তা-বিধাতা। বিরাটরাজার কথা একটুও না ভেবে কীচক জানাল যে, সেই সবার আশ্রয়দাতা—প্রভুর্বাসয়িতা চাস্মি—তার সমান বীরও কেউ নেই। দ্রৌপদী এবার তাঁর অদৃশ্য পঞ্চস্বামীর কথা শুনিয়ে কীচককে একটু ভয় দেখাতে চাইলেন, নিজেও খানিকটা রেগে গিয়ে বললেন—তোমার মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। মায়ের কোলে শুয়ে বাচ্চা ছেলে যেমন চাঁদ ধরতে চায়, তোমার অবস্থাও সেইরকমই কীচক—কিং মাতুরঙ্কে শয়িতো যথা শিশু শ্চন্দ্ৰং জিঘৃক্ষন্নিব মন্যসে হি মাম্‌।

কীচক গরবিনী বধূকে আর ঘাঁটালেন না, কিন্তু বোনটিকে সকাতরে বলে এলেন—যেমন করে পার তোমার পরিচারিকার মন আমার দিকে ভজিয়ে দাও—যেনোপায়েন সৈরন্ধ্রী ভজেন্মাং গজগামিনী। অতি প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে বোনেদের যে অবস্থা হয়, বিরাটরানি কীচককে বললেন—একটা ভাল পরব দেখে তুমি অনেক কিসিমের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা কর, মদের ব্যবস্থাও রাখবে। সেই দিন, আমি তোমার ঘর থেকে সুরা নিয়ে আসবার ছলে সৈরন্ধ্রীকে পাঠিয়ে দেব। নির্জন ঘরে, বিনা বাধায়—বিজনে নিরবগ্রহে—তাকে বোঝাবার চেষ্টা কোরো, তবে যদি তোমার দিকে মন ফেরে—সামানা রমেৎ যদি। সুদেষ্ণার ‘প্ল্যান’ মতো একদিন মাংস-ব্যঞ্জন অনেক রান্না হল, ব্যবস্থা হল উত্তম সুরার। কীচক খবর পাঠালেন সুদেষ্ণাকে, আর অমনি তিনি দ্রৌপদীকে ডেকে পাঠালেন। বললেন, বড়ো সুরার তিয়াস লেগেছে সৈরন্ধ্রী, তুমি একবার কীচকের ঘরে যাও, সেখান থেকে মদ নিয়ে এসো।

দ্রৌপদী সব বুঝলেন, সুদেষ্ণার উদ্দেশ্য এবং কীচকের উদ্দেশ্য—সব বুঝলেন। দ্রৌপদী বললেন—আমি যাব না রানি, তুমি বেশ ভালই জান তোমার ভাই লোকটা কীরকম বেহায়া—যথা স নিরপত্রপঃ। আমাকে দেখলেই সে উল্টোপাল্টা বলবে, অশোভন ব্যবহার করবে। আমি যাব না রানি, তুমি অন্য কাউকে পাঠাও—অন্যাং প্রেষয় ভদ্রং তে স হি মাম্ অবমংস্যতে। সুদেষ্ণা বললেন—আমি পাঠাচ্ছি জানলে সে তোমায় অপমান করতে পারে না। উত্তরের অপেক্ষা না করে সুদেষ্ণা পানপাত্রখানি দ্রৌপদীর হাতে ধরিয়ে দিলেন। দৌপদী চললেন। এই প্রথমবার বুঝি পঞ্চস্বামিগর্বিতা পাণ্ডববধূ ভয় পেলেন। প্রশস্ত রাজপ তে যেতে তাঁর কান্না পেল। কী হবে, কী হবে—সা শঙ্কমানা রুদতী। পাঁচ পাঁচটা জোয়ান স্বামী থাকতেও এই মুহূর্তে দ্রৌপদীর অবস্থা—যা হয় হবে—দৈবং শরণমীয়ুষী। ভীতা ত্ৰস্তা হরিণী কীচকের ঘরে উপস্থিত হল। আর অগাধ কামসাগরের পারে দাঁড়িয়ে কীচকের মনে হল—এই বুঝি তার তাপ-তরণের নৌকা—নাবং লব্বেব পারগঃ। কীচক লাফ দিয়ে উঠল।

প্রথমে তো বৈষ্ণব পদাবলীর ভঙ্গিতে—আজু রজনী হম ভাগে পোহায়নু—সুব্যুষ্টা রজনী মম—ইত্যাদি আবাহন চলল কীচকের দিক থেকে। দ্বিতীয় দফায় চলল মণি-রত্ন আর বেনারসীর লোভ দেখানো। পরিশেষে বিছানাটি দেখিয়ে কীচক বলল—এসব তোমার জন্য, এসো, বসে বসে একটু সুরাপান কর—পিবস্ব মধুমাধবীম্। দ্রৌপদী বললেন—রানি সুরা পিপাসায় কাতর, তিনি সুরা চেয়েছেন। বলেছেনসুরা নিয়ে এসো। আমার তাড়া আছে। কীচক এবার দ্রৌপদীর ডানহাতটি ধরলেন চেপে, তারপরেই আঁচলখানি। পাঠক জানেন, আঁচলে টান পড়লেই দ্রৌপদীর কিঞ্চিৎ ‘অ্যালার্জি’ হয়, দুঃশাসন, জয়দ্রথের কথা মনে পড়ে। তা দ্রৌপদী প্রথমে জয়দ্রথকে দেওয়া প্রথম ওষুধটি প্রয়োগ করলেন—ধাক্কা, জোর একখানা ধাক্কা। কীচক মাটিতে পড়ল এবং সেই অবসরে দ্রৌপদী বিরাটের রাজসভায় উপস্থিত। কিন্তু কীচকই বা ছাড়বে কেন, সে রাজার শালা, প্রশ্রয় পেয়ে মাথায় উঠেছে, রাজা কিংবা রাজসভাকেই বা তার ভয় কীসের? সেও উপস্থিত হল বিরাটের রাজসভায় এবং সবার সামনে দ্রৌপদীকে উল্টো লাথি কষাল।

রাজসভা থেকে রান্নাঘর আর কতদূর। রাজাকেও পান ভোজন মাঝে মাঝেই জোগাতে হয়। কাজেই সেই ছলে ভীমও ততক্ষণে রাজসভায় উপস্থিত। দ্রৌপদীর অপমান দেখে ভীমের দাঁত কড়মড়ি আরম্ভ হল, ঘাম ঝরতে থাকল আর বারবার উঠব কি উঠব না—এই ভঙ্গিতে বসে থাকলেন। যুধিষ্ঠির দেখলেন মহা বিপদ, ভীম একটা মারামারি বাধিয়ে দিলে লোক জানাজানি হয়ে যাবে, তখন আবার বারো বছর বনে কাটাও। কোনও মতে তিনি ভীমকে আঙুলের খোঁজ মেরে মেরে বাইরে পাঠালেন। দ্রৌপদী আগুন চোখে বিরাটরাজাকে যেন দগ্ধ করে দিলেন। প্রথমে তো দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরকে উদ্দেশ করে তাঁর অলক্ষ্য স্বামীদের খানিকটা অবোধ্য গালাগালি দিয়ে বিরটিকে বললেন—তুমি রাজা না দস্যু। নইলে তোমার সামনে নিরপরাধিনীর অপমান দেখেও চুপ করে বসে আছ—দুস্যনামিব ধর্মস্তে ন হি সংসদি শোভতে। অথবা কীই-বা বলব, যেমন এই কীচক, তেমনি এ-দেশের রাজা, আর তেমনি তোমার মোসাহেব সভাসদেরা (শেষ টিপ্পনীটির অন্তরে যুধিষ্ঠিরও আছেন)।

বিরাট কিছুই জানতেন না, কী ব্যাপার, কেন এই মারামারি, কিছুই জানতেন না। সভাসদেরা সব খবর নিল এবং তারা কীচকের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করে দ্রৌপদীকে খুব প্রশংসা করল। যুধিষ্ঠিরের আর সহ্য হচ্ছিল না। সবার সামনে কুলবধুর হেনস্থা, সভাসদদের খবরাখবর নেওয়া, বিচার, প্রস্তাব—এত সব কসরত যুধিষ্ঠিরের আর সহ্য হচ্ছিল না। রাগে যুধিষ্ঠির ঘামতে থাকলেন। এতটা সময় সভায় থেকে দ্রৌপদীও বুঝলেন—তিনি কিঞ্চিৎ কাঁচা কাজ করেছেন। যুধিষ্ঠির বললেন—তুমি সুদেষ্ণার ঘরে যাও সৈরন্ধ্রী। যে স্বামীদের কথা তুমি বললে বোঝা যাচ্ছে, তাদের রাগ দেখাবার সময় এখনও আসেনি। তুমি সময় বোঝ না, সৈরন্ধ্রী, শুধু শুধু এই রাজসভায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটুকে মেয়েদের মতো কাঁদছ। রাজসভায় তরল জলে মাছের মতো সভাসদেরা যে খেলা করে, এ কান্না তাদের স্পর্শ করে না, শুধু খেলার বিঘ্ন ঘটায় মাত্র—অকালজ্ঞাসি সৈরন্ধ্রী শৈলুষীব বিরোদিষি। বিঘ্নং করোষি মৎস্যানাং দীব্যতাং রাজসংসদি। তুমি যাও, তোমার গন্ধর্ব স্বামীরা নিশ্চয়ই এই অপমানের বিহিত করবেন।