যুধিষ্ঠির – ৪

পাঞ্চাল পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গেই দ্রৌপদীব স্বয়ম্বর-মহোৎসবের ঘটা টের পাওয়া গেল। দলে দলে ব্রাহ্মণেরা চলেছেন উৎসবে যোগ দিতে। সেখানে পাণ্ডবরাও চলেছিলেন ব্রহ্মচারী ব্রাহ্মণের বেশে। গমনোৎসুক ব্রাহ্মণরা পাণ্ডবদের তেমন করে চেনেন না। তাঁরা বললেন— কোথা থেকে আসছেন আপনারা। যুধিষ্ঠির জবাব দিলেন— আমরা একচাকা থেকে আসছি। সঙ্গে মা আছেন। ব্রাহ্মণরা খুব লোভ দেখালেন— দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর হবে। ভারী লক্ষ্মীমতী আর সুন্দরী সেই মেয়ে। দ্রুপদের আয়োজনও বিশাল। খাওয়া-দাওয়া তো আছেই, সঙ্গে প্রচুর দক্ষিণা টাকা-পয়সা, গরু—প্রদাস্যন্তি ধনং গাংশ্চ ভক্ষ্যং ভোজ্যঞ্চ সর্বশঃ। চলুন আমাদের সঙ্গে। আপনার ওই ভাইটিকে তো বেশ শক্তপোক্ত মনে হচ্ছে, চাই কি পণ জিতে দ্রৌপদীকে পেয়েও যেতে পারে। যুধিষ্ঠির অনেকক্ষণ ব্রাহ্মণদের কথা শুনে শেষে মন্তব্য করলেন— নিশ্চয়ই। আমরাও এই এলাম বলে।

বস্তুত স্বয়ম্বর-সভা যুধিষ্টিরের কিছুই করার ছিল না। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করলেন, দৌপদীকে লাভ করলেন এবং সমবেত দ্রৌপদীকামী রাজাদের সঙ্গে ভীম-অর্জুনের যুদ্ধ আরম্ভ হল। সেই মুহূর্তেই যুধিষ্ঠির এলং নকুল-সহদেবকে আমরা দ্রুপদ-সভা ত্যাগ করে চলে যেতে দেখছি। মহামতি কৃষ্ণ সুনির্দিষ্টভাবে লক্ষ করে দেখলেন যে, এক গোরকান্তি বিনীত যুবক, পদ্মা-পাতার মতো দীর্ঘ তাঁর চোখ, লম্বা একটি নাক— গৌরঃ প্রলাম্বোজ্জ্বলচারুঘোণঃ— এক বিশাল দীর্ঘদেহী পুরুষ সভাকক্ষ ত্যাগ করে চলে গেল— বিনিঃসৃতঃ সো’প্যুত ধর্মপুত্রঃ।

মানুষের টিপ্পনী কাটার এই তো সুযোগ। কী অক্ষম একটি মানুষ! বিশাল বিশাল রাজাদের সঙ্গে দুটি মাত্র ভাই যুদ্ধ করছে, আর কী স্বার্থপরের মতো যুধিঠির বেরিয়ে এনে রাজসভা ছেড়ে! সঙ্গে আবার নকুল-সহদেবকেও নিয়ে এলেন। মহাভারতে ভাল করে খেয়াল করে দেখবেন— যুধিষ্ঠির যখন দ্রুপদের রাজসভা ছেড়ে চলে এসেছেন, তখন যুদ্ধ-বিগ্রহের নাম-গন্ধও ছিল না। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করার সঙ্গে সঙ্গে সমবেত ব্রাহ্মণেরা তাঁদের স্কন্ধস্থিত জীর্ণ উত্তরীয়গুলি উড়িয়ে দিয়েছিলেন হাওয়ায়। দ্রুপদ-সভার বাদ্যকারেরা তুরা-ভেরী-শতঙ্গের শব্দে আকাশ মুখরিত করে তুলেছিল। হর্যিত রাজা দ্রুপদ সবাগ্রে এগিয়ে এলেন অর্জনের দিকে, রাজসভার বাজনা-বাদ্যি আরও বেড়ে উঠল, আর এই প্রবল শব্দের মধ্যেই যুধিষ্ঠির নকুল সহদেবকে নিয়ে সভা ত্যাগ করলেন— তস্মিংস্তু শব্দে মহতি প্রবৃদ্ধে যুধিষ্ঠিরো ধর্মভৃতং বরিষ্ঠঃ। আবাসমেবোপজগাম শীঘ্রম্‌…।

যুদ্ধ-বিগ্রহ এখন লাগেইনি, তখই নকূল-সহদেবকে নিয়ে সভাত্যাগের কারণ একটাই। বিবাহ মানেই পরিচয়-জ্ঞাপনের সময়। বংশ-গোত্র জানান দেবার সময়। ধরে নিলাম— এঁরা বলতেন— আমরা ব্রাহ্মণ, একচক্রা থেকে আসছি। তাহলে প্রশ্ন উঠত। পঞ্চপাণ্ডব ততদিনে বিখ্যাত হয়ে গেছেন। মহামতি কৃঃ যে পাণ্ডব-ভাইদের পূর্বে দেখেননি, তিনি কিন্তু দ্রুপদসভায় পাণ্ডবদের ব্রাহ্মণবেশে বসে থাকতে দেখেই চিনে গিয়েছিলেন! একশোটা বাঙালির মধ্যে পাঁচজন শিখ কিংবা রাজস্থানী ক্ষত্রিয় দেখলে হাবে-ভাবে ঠিকই যেমন চেনা যায় তেমনই একইভাবে অতগুলি শুষ্করুক্ষ ব্রাহ্মণের মধ্যে পঞ্চ-পাণ্ডবকে কৃষ্ণ আলাদা করে ফেলেছিলেন চেহারা দেখেই— দৃষ্ট্বা তু তান্‌ মত্তগজেন্দ্ররূপান্‌।

কৃষ্ণ অন্যতর মানুষের থেকে বেশি বুদ্ধিমান, এ কথা ধরে নিয়েও বলা যায় পাণ্ডবদের পঞ্চত্বের সংখ্যাটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, হয়তো যুধিষ্ঠির সেই কারণেই সভাকক্ষ ত্যাগ করেছেন নকুল-সহদেবকে নিয়ে। কারণ ব্রাহ্মণের মেলে এতক্ষন এরা কেউই তাদের খেয়াল করেননি, দ্রৌপদীর বরমাল্য-দনের পর সেই পঞ্চপাণ্ডব একত্র হলে চিনে ফেলা এবং চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার খুবই সুবিধে। নকুল-সহদেবকে নিয়ে যুধিষ্ঠিরের চলে যাবার কারণ সেইটাই। এর মধ্যে যুধিষ্ঠিরের অক্ষমতা খোঁজার চেষ্টা অথবা আরও উর্বরভাবে যাঁরা এর মধ্যে যুধিষ্ঠিরের ঈর্ষার খবর পান, তাঁদের শুধু যুধিষ্ঠিরের মৌলিক চরত্রটি স্মরণে রাখতে বলি।

ঈর্ষা-অসুয়ার মতো ক্ষুদ্রতা যুধিষ্ঠিরের চরিত্রে কোথাও নেই। যদি যুদ্ধ লাগে, তবে ভীম আছেন; কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধ ছাড়া যুদ্ধ-ক্ষেত্রে ভীমার্জুন থাকতেও তাঁকে যুদ্ধ করতে হয়েছে, এমন হয়নি। দ্রোণাচার্যের দক্ষিণা দেবার সময় অর্জুন যুধিষ্ঠিরকে যেতে বারণ করেছিলেন এবং এখানেও যুদ্ধ লাগবার সময় অর্জুনের সেই একই ইঙ্গিত ছিল— অর্জুন ব্রাহ্মণদের বলেছিলেন আপনারা শুধু পাশে দাঁড়িয়ে দেখুন— আমি কী করি— উবাচ প্রেক্ষকা ভূত্বা যূয়ং তিষ্টত পার্শ্বতঃ। কাজেই যুধিষ্টির চলে এসেছেন, তা ছাড়া যুদ্ধে রক্তক্ষয়ের পরিণতি তাঁর এত বেশি মধুর লাগত না, যে তিনি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেটা উপভোগ করবেন। তিনি চলে এসেছেন।

দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর-সভায় যুধিষ্ঠির যুদ্ধ করলেন না, অথবা নেমে এলেন পথে— এগুলো কোন বড় কথাই নয়। বড় কথা হল— স্বয়ম্বরের পরবর্তী পর্বে একজন অতি-অভিজ্ঞ মনস্তত্ত্ববিদের মতো যুধিষ্ঠিরের নিপুণ আচরণ। ভীম-অর্জুন দু’জনে দ্রৌপদীকে নিয়ে এসে চিন্তাক্লিষ্ট জননীকে বলেছিলেন,—মা! কী ভিক্ষা এনেছি দেখো। জননী কুন্তী মুখ না ফিরিয়ে জবাব দিয়েছিলে— যা এনেছ সকলে মিলে ভাগ করে নাও। তারার মুখ ঘুরিয়ে কুন্তী যখন দ্রৌপদীকে দেখলেন, তখনই তিনি বুঝলেন, তিনি কত বড় ভুল করেছেন। কিন্তু এই পরম বিপন্নতার মধ্যে কুতীর চোখের সামনে মুশকিল-আসান যে ছবিটি ভেসে উঠল, সেটা যুধিষ্ঠিরের ছবি। সাংসারিক সমস্যা সমাধান করার জন্য একজন সুগৃহিণী যে তাড়না নিয়ে স্বামীর কাছে দরবার করতে যান, প্রায় সেই তাড়নাতেই কুন্তী যুধিষ্ঠিরের কাছে দৌড়লেন। তাঁর স্বামী নেই, কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মতো সর্বাপদহর একটি পুত্র আছে।

আর যুধিষ্ঠিরও সেইরকম। বাড়ির কতটি যেমন বহিবাটীর চৌকির ওপর পাকা মাথাটি নিয়ে হুকো হাতে বসে থাকেন, যুধিষ্ঠিরও প্রায় তেমনই বসেছিলেন। কুন্তী নববধু দ্রৌপদীর হাত মুঠো করে ধরে উপস্থিত হলেন সংসারের গুরুঠাকুর যুধিষ্ঠিরের কাছে—পানৌ গৃহীত্বোপজগাম কুন্তী/যুধিষ্ঠিরং বাচমুবাচ কুন্তী। কুন্তী জানালেন তাঁর সমস্যার কথা—আমি বলে ফেলেছি, এখন কী উপায়?

যুধিষ্ঠির এই কৃষ্ণোজ্জ্বল অগ্নিপুঞ্জের মতো রমণীকে পূর্বাহ্নেই দ্রুপদসভায় দেখেছেন। তিনি জানেন—অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে তাঁকে জিতেছেন। আরও জানেন—অর্জুনের মতো মহাবীরের গলায় মালা দেওয়ার সময় এই পরম ব্যক্তিত্বময়ী বিদগ্ধা রমণীটি কত মুগ্ধ হয়েছিলেন। যুধিষ্ঠির সব দেখেছেন। কিন্তু মা যখন বলেছেন, তাঁর কথার সত্যতা রাখার চেষ্টা করতে হবে, এটা যেমন বড় কথা, তেমনই যুধিষ্ঠিরেব আরও একটি চিন্তা হল—মায়ের সত্য-রক্ষার মধ্য দিয়ে যেন একটি সামগ্রিক মঙ্গল সূচিত হয়।

কুন্তীর প্রস্তাবেব সঙ্গে সঙ্গে যুধিষ্ঠির খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন। চিন্তার প্রথম সূচনাতেই যুধিষ্ঠিরের মনে এল—ব্যক্তি অর্জনের বীর্য-লব্ধ মুগ্ধ দ্রৌপদীর কথা। তিনি জানেন এই সম্মানটুকু অর্জুনকে দিতে হবে এবং তিনি এও জানেন যে, দ্রৌপদীকে বিবাহ কবার জন্য অর্জুনকে অনুরোধ করলে তিনি প্রত্যাখ্যান করবেন। অর্জুনকে তিনি চেনেন। পাণ্ডবভাইদের মধ্যে অর্জুনই বোধহয় একমাত্র ব্যক্তি যিনি যুধিষ্ঠিরকে সমর্থন করেন শিষ্যের মতো, যুধিষ্ঠিরের মনও তিনি বোঝেন শিষের মতো। যাই হোক, যুধিষ্ঠির অর্জুনকে বললেন—তুমিই লক্ষ্যভেদ করে এই রাজপুত্রীকে স্বয়ম্বরে লাভ করেছ, অতএব ইনি তোমারই, তোমার সঙ্গেই এঁকে সবচেয়ে ভাল মানাবে—ত্বয়া জিতা ফাল্গুন যাজ্ঞসেনী ত্বয়ৈব শোভিয্যতি রাজপুত্র।

একটি ভদ্র পরিবারের বাড়ির বড়রা যদি নিজস্ব প্রয়োজনে একটি সুকুমারমতি বালকের জিনিস-পত্র ব্যবহার করার জন্য বালকের অনুমতি প্রার্থনা করেন, তা হলে সেই বালক যেমন জগতের সমস্ত গৌরব নিজের উদ্ভাসিত মুখে প্রকট করে তোলে, অর্জুনও সেইরকমভাবে যুধিষ্ঠিরকে বললেন,—কেন দাদা, মিছিমিছি আমাকে পাপের ভাগী করছেন। একে তো আর ধর্ম বলা যায় না। আগে আপনার বিয়ে হোক, ভীমেব বিয়ে হোক তারপর তো আমি। আমার এই সিদ্ধান্ত শুনে যেটা আপনার ধর্মসম্মত মনে হয় এবং যেটা আমাদের যশের কারণ হবে—আপনি সেটাই স্থির করুন।

অর্জুন তাঁর একক অধিকার ছেড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত পাণ্ডবভাই দ্রৌপদীর দিকে একযোগ দৃষ্টিপাত করলেন। এতগুলি বীর-চক্ষুর একত্র সন্নিবেশে দ্রৌপদী কতটা স্বস্তিতে ছিলেন জানি না, কিন্তু যুধিষ্ঠির সবার চোখমুখের ভাব দেখে সম্পূর্ণ বুঝতে পারলেন যে, দ্রৌপদীর জন্য তাঁর সব ভাইই লালায়িত। তাঁর মনে পড়ল বাসের কথা। পাঞ্চালে আসবার আগে ব্যাসদেব তাঁদের দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের কাহিনী শুনিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন—পূর্বজন্মে দ্রৌপদী নাকি মহাদেবের কাছে বর পেয়েছিলেন যে তাঁর পতি হবে পাঁচটি এবং তাঁরা সবাই ভরতবংশীয়—পঞ্চ তে পওয়ো ভদ্রে ভবিষ্যন্তীতি ভারতাঃ।

তবে শুধুই কি ব্যাসের আশ্বাস! তিনি এতক্ষণ ধরে দ্রৌপদীর প্রতি ভাইদের সকাম লোলুপ দৃষ্টি লক্ষ করেছেন—তেষামাকার-ভাবজ্ঞঃ কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ। কিন্তু মহাভারতের কবি জানাননি যুধিষ্ঠিরের নিজের কোন দৃষ্টি ছিল দ্রৌপদীর প্রতি। মহাভারতের বক্তা, নিরপেক্ষ দর্শক বৈশম্পায়ন সাধারণভাবে বলেছিলেন—পাণ্ডবগণ সকলেই দ্রৌপদীর দিকে তাকালেন—দৃষ্টিং নিবেশয়ামাসুঃ পাঞ্চাল্যাং পাণ্ডুনন্দনাঃ। এঁদের মধ্যে তো যুধিষ্ঠিরও আছেন। কৃষ্ণা-দ্রৌপদীকে দেখে সমস্ত পান্ডবই তাঁকে হৃদয়ে ধারণ করলেন—এর মধ্যেও তো যুধিষ্ঠির আছেন। কিন্তু যাঁর ওপরে সমস্ত সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে, তিনি নিজের কথা বেশি ভাবতে পারেন না, ভাবা উচিত নয়। আর ঠিক সেই কারণেই দ্রৌপদীর আকর্ষণ কার হৃদয়ে কত বেশি, সেই ব্যক্তি-হৃদয়ের হিসেব-নিকেশ না করে। মহাভারতের কবি একেবারে সবার মেলে যুধিষ্ঠিরের হৃদয়টাও মিশিয়ে দিলেন।

যুধিষ্ঠির ব্যাসের কাছে দ্রৌপদীর পঞ্চ স্বামী লাভের কথা যেমন শুনেছিলেন, তার থেকেও বড় এক সামগ্রিক স্বার্থ তাঁর মনে কাজ করছিল। দ্রৌপদী অসাধারণ রূপবতী; পঞ্চপাণ্ডবের প্রত্যেকটি ভাই তাঁকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে আরম্ভ করেছেন। এখন যদি অর্জুনের সঙ্গেই এই রমণীর বিবাহ হয় তবে অন্যান্য ভাইদের মনে ক্ষোভ নাই থাকুক, হতাশা থাকবে দুঃখ থাকবে। একটি রমণীকে নিয়ে যদি শেষ পর্যন্ত পাঁচ ভাইয়ের এক জোটের মধ্যে বিভেদ উপস্থিত হয়, তবে পাণ্ডবদের পিতৃরাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার স্বপ্ন তো দূরের কথা, নিজেদের মধ্যেই এক দারুণ অশান্তির সৃষ্টি হবে। প্রধানত সেই ভয়েই— মিথো ভেদভয়ান্নৃপঃ— যুধিষ্ঠির তাঁর অসাধারণ সিদ্ধান্ত জানালেন— সুন্দরী সুলক্ষণা দ্রৌপদী আমাদের সকলেরই পত্নী হবেন। এই সিদ্ধান্ত যে ভাইদের কাছে কতটা স্বাগত ছিল— তা তাঁদের পরবর্তী আচরণেই বোঝা যায়। যুধিষ্ঠিরের মতামত শুনে ভাইরা সঙ্গে সঙ্গে দ্রৌপদীকে নিয়ে ভাবতেই থাকলেন, ভাবতেই থাকলেন— তমেবার্থং ধ্যায়মানা মনোভিঃ/সর্বে চ তে তস্থুরদীনসত্ত্বাঃ।

যুধিষ্ঠিরের এই সিদ্ধান্ত সমস্ত ভাই-এর কাছে যতই মনোগ্রাহী হোক কিন্তু দ্রৌপদীর কাছে এই সিদ্ধান্ত যে কতটা সুখপ্রদ ছিল, সে খবর এখনও পাওয়া যায়নি এবং তা বোঝানোর সময়ও এখন আসেনি। দ্রৌপদী পাণ্ডববাড়িতে নতুন বউ হয়ে এসেছেন, এই মুহূর্তে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানাও মুশকিল। কিন্তু পাঁচ ভাই একসঙ্গে একটি রমণীকে বিবাহ করবেন— এই অসম্ভব কথাটা দ্রুপদরাজা এবং তাঁর পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্নকে বোঝানোও তো যথেষ্ট কঠিন হয়ে পড়ল। দ্রুপদরাজা পাণ্ডবদের প্রচ্ছন্ন পরিচয় পেয়ে তাঁদের রাজসভায় ডেকে আনলেন এবং পরম সম্মানে তাঁদের জন্য আতিথেয়তা সম্পন্ন করলেন। কিন্তু যে মুহূর্তে দ্রুপদ দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণ করার প্রস্তাব করলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে, সেই মুহূর্তেই যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্ত শুনে দ্রুপদ তো আকাশ থেকে পড়লেন।

দ্রুপদ বললেন— এমন কথা তো জীবনে শুনিনি, বাবা! একজন পুরুষমানুষ অনেকগুলি স্ত্রীর স্বামী হতে পারেন, এমন নিশ্চয়ই দেখেছি। কিন্তু একটি রমণীর অনেকগুলি স্বামী— এমন খবর তো জীবনে শুনিনি বাপু— নৈকস্য বহবস্তাত শ্রূয়ন্তে পতয়ঃ ক্কচিৎ। লৌকিক আচারই বলো আর বৈদিক আচারই বলো— তোমার মতো একজন ধর্মজ্ঞ পুরুষের পক্ষে অধর্মের কাজ করা কখনও ঠিক হবে না। দ্রুপদের কথা শুনে যুধিষ্ঠিরের মনে যেন একটা ধাক্কা লাগল। তিনি অধর্ম করছেন? মায়ের কথা রাখতে হবে— এই যুক্তি যদি নিতান্ত স্বার্থপরের মতোও হয়, তবু কি এর মধ্যে অন্য কোনও ধর্ম-যুক্তি ছিল না?

দ্রুপদের কথার উত্তরে যুধিষ্ঠির যা বললেন, তা নিতান্ত এক অহঙ্কারীর বক্তব্য বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তবু তার মধ্যে ধর্মের যুক্তিও আছে। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন— অধর্মের কথা বলবেন না, মহারাজ! ধর্মের গতি বড় সূক্ষ্ম— সূক্ষ্মো ধর্মো মহারাজ নাস্য বিদ্মো বয়ং গতিম্‌— আমরা সেই সূক্ষ্ম ধর্মের গতিপথ ভাল করে বুঝতে পারি না। অর্থাৎ সে ধর্ম এতটাই সুক্ষ্ম, যে আপাতত তা অধর্ম বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু তবু তা ধর্ম, কেন না যুধিষ্ঠির বলছেন— আমার তাই মনে হচ্ছে। আমার মুখ দিয়ে মিথ্যা কথা বেরয় না, অধর্মে আমার প্রবৃত্তি হয় না— ন মে বাগনৃতং প্রাহ নাধর্মে ধীয়তে মতিঃ।

বলতে পারেন— কে এমন বড়-মানুষ হে তুমি? অধর্মের দিকে তোমার মনই যায় না, অসত্যের দিকে কখনও তোমার মন টলে না— এসব ডম্ফাই করলেই কি তোমার সিদ্ধান্তটা প্রমাণসহ বলে মানতে হবে? আমরা বলি— সত্যিই মানতে হবে। যুধিষ্ঠির বলছেন বলেই মানতে হবে। যুধিষ্ঠির বলেছেন— ধর্মের গতি বড় সূক্ষ্ম। সত্যি কথা বলতে কি, ভারতবর্ষের দর্শন এবং ধর্মতত্ত্বের নিরিখে ধর্ম শব্দটা যে কত বিচিত্র অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, তা এই ক্ষুদ্র পরিসরে বলে বোঝানো সম্ভব নয়। ঘি জিনিসটা খেতে কেমন— এটা যেমন ‘স্পেসিফিক্যালি’ ব্যাখ্যা করে বোঝানো কঠিন, ভারতবর্ষের জীবনযাপনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচিত্র পরিবেশে ধর্মের সূক্ষ্ম গতি বোঝানোও ঠিক ততখানিই কঠিন। আগে একটা উদাহরণ দিই। কারণ ধর্ম ব্যাপারটা সামান্যভাবে না বুঝলে যুধিষ্ঠিরকে অন্তত বোঝা যাবে না। বসন্তের রহস্য কিছুই না বুঝলে কোকিলকে বুঝবেন কী করে?

আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়— কুরু-পাণ্ডবদের যিনি বাবা হতে পারতেন, সেই বিচিত্রবীর্য যখন মারা গেলেন তখন জননী সত্যবতী শান্তনুর গঙ্গাগর্ভজাত পুত্র ভীষ্মকে বললেন— বাবা! বিচিত্রবীর্য আমার ছেলে, তোমার ভাই— তা সে তো অল্প বয়সেই মরে গেল। রেখে গেল দুটি বিধবা বউ। তাদের ছেলেপিলেও নেই। তা তুমি বাপু তাদের গর্ভে উপযুক্ত সন্তানের জন্ম দাও। এই বিশাল ভরত-বংশ উৎসন্ন হতে দিয়ো না, বাবা। আমার কথা শোনো, তুমি এই দুই বিধবাকে বিয়ে করো, পুত্রের জন্ম দাও— এটাই ধর্ম– মন্নিয়োগান্ মহাবাহো ধর্মং কর্তুমিহার্হসি।

বিখ্যাত ভরতবংশে পুত্র জন্মাল না, অতএব সেকালের সমাজ-সচল নিয়োগ-প্রথায় বিচিত্রবীর্যের বিধবা স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করার কথা বলা হল ভীষ্মকে এবং সত্যবতীর মতে এটাই ধর্ম। যাঁকে এই ধর্ম করার উপদেশ দেওয়া হচ্ছে নিরপেক্ষ কথকঠাকুরের ভাষায় সেই ভীষ্ম হলেন ধর্মাত্মা এবং তিনি যে উত্তর দিচ্ছেন, সেটাও ধর্মের বিধি-নিয়ম সম্মত— উবাচাথ ধর্মাত্মা ধর্ম্যমেবোত্তরং বচঃ।

সত্যবতীর সঙ্গে ভীষ্মের বয়সের খুব বেশি ফারাক ছিল না বলেই আমার মনে হয়, কিন্তু পিতা শান্তনুর সম্পর্কে তিনি ভীষ্মের জননীকল্পা। ভীষ্ম জননীর কথা প্রথমেই মেনে নিয়ে বললেন— মা! তুমি যা বললে, সেটা যে পরম ধর্ম— তাতে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু তুমি তো জানোই মা, তোমার সঙ্গে পিতা শান্তনুর বিয়ের আগে তোমারই জন্য আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম— আমি কোনওদিন বিয়েই করব না। আজকে সেই সত্য-প্রতিজ্ঞা থেকে আমি সরে আসতে পারি না। কারণ সেটা ধর্ম নয়।

সত্যবতী বললেন— আমার জন্য তুমি যা করেছিলে, যা বলেছিলে, তা সবই আমার মনে আছে। তবে কিনা এ হল বিপদের সময়, আপৎকাল। ভরত-কুরুদেব কুলতন্তু ছিন্ন হয়ে গেছে। তাই আপদ্ধর্মও তো একটা আছে বাবা— আপদ্ধর্মং ত্বমাবেক্ষ্য— সেটা বুঝে এমন একটা কিছু করো যাতে এই কুলতন্তুও অবিচ্ছিন্ন থাকে, আবার তোমার ধর্মও থাকে। ভীষ্ম বললেন যে, দুটো কাজ তাঁর দ্বারা হবে না। সত্যবতীকে বললেন— তুমি ধর্মের দিকে তাকাও মা, আমাদের সবাইকে ডুবিও না। শান্তনুর সন্তান-পরম্পরা যাতে পৃথিবীতে থাকে, সেটা আলাদা করে আমি ভাবব এবং সে বিষয়ে কথাও বলব। কিন্তু আমি প্রতিজ্ঞা-ভঙ্গ করতে পারি না কারণ সত্য-প্রতিজ্ঞা থেকে চ্যুত হওয়া ক্ষত্রিয়ের ধর্ম নয়— সত্যাচ্চুতিঃ ক্ষত্রিয়স্য ন ধর্মেষু প্রশস্যতে।

লক্ষ করে দেখেছেন নিশ্চয়ই— এই সামান্য সংলাপের মধ্যে অন্তত তিন-চার রকমের ধর্মের কথা বলা হল। প্রথমটির বিষয়ে পারিবারিক চাহিদা আছে অর্থাৎ বংশ-রক্ষা করতে হবে, পিতা-পিতামহের কাছে যে ঋণ, তা শোধ করতে হবে। সত্যবতী বলেছেন— ভীষ্ম! তুমি পুত্রের জন্ম দাও, বাপ-ঠাকুরদাদের ডুবিও না— মা নিমজ্জীঃ পিতামহান্‌। এই কথার উত্তরে ভীষ্মের সশ্রদ্ধ উত্তর কিন্তু একেবারে বিপরীত। অর্থাৎ বাপ-ঠাকুরদার বংশ-রক্ষার ধর্ম করতে গিয়ে তুমি আবার আমাদের ডুবিও না। অর্থাৎ আমারও একটা ব্যক্তিগত ধর্ম আছে— আমি প্রতিজ্ঞা করেছি।

ভীষ্মের প্রতিবাদে সত্যবতীর বংশধর্ম, পারিবারিক ধর্ম যে মুহর্তে আপদ্ধর্মে পরিণত হয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তেই ভীষ্মের ব্যক্তিগত প্রতিজ্ঞাও ক্ষত্রিয়ের জাতি-ধর্মে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত ধর্মের বিপরীতে ব্যক্তিগত ধর্ম। আবার আপদ্ধর্মের মতো একটা ‘সামান্য’, নিয়মের বিপরীতে এখানে জাতিধর্মের মতো অন্য আরও একটা ‘সামান্য’ নিয়ম দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সবগুলোই ধর্ম। এখানে প্রত্যেকটি বাক্য শাস্ত্রের যুক্তিতে সমর্থন করা যায়।

বস্তুত এই রকম কোনও ধর্ম হলেও হত। ক্ষত্রিয়ের প্রতিজ্ঞা অথবা বংশ-রক্ষার ধর্ম। যুধিষ্ঠির এখানে দ্রুপদকে যা বলেছেন, সেটাকে কিন্তু এইরকম কোনও ব্যক্তিনীতি, সমাজনীতি, পারিবারিক নীতি— কোনও ভাবেই সমর্থন করা যায় না। শুধু— মা এইরকম বলেছেন এবং আমি মায়ের কথাই সমর্থন করি— এবঞ্চৈব বদত্যম্বা মম চৈতন্মনোগতম্‌— শুধুমাত্র এই যুক্তিতে এক সুচিরপ্রোথিত সামাজিক প্রত্যয় প্রত্যাখ্যান করে পাঁচ ভাই মিলে একই রমণীকে বিবাহ করাটা আপাতদৃষ্টিতে সমর্থনীয় নয় বলেই যুধিষ্ঠির বলেছেন—ধর্মের গতি বড় সুক্ষ্ম, মহারাজ। আমরা সেই সূক্ষ্মতা বুঝতে পারি না। অর্থাৎ যুধিষ্ঠির যে সুক্ষ্মতার কথা বলছেন, সেটা দ্রুপদকে যেমন বোঝানো সম্ভব নয়, তেমনই যুধিষ্ঠিরের পক্ষেও সেটা বলা সম্ভব নয়। কেন বলা সম্ভব নয়, সেটা জানাই।

জৈমিনীয় মীমাংসা-সুত্রের প্রসিদ্ধ টীকাকার কুমারলি ভট্ট তাঁর তন্ত্রবার্তিকের মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন যে, কোনও সিদ্ধান্ত ধর্মসম্মত হল কি না তা বিচার করতে হলে প্রমাণ বলে কাকে মানতে হবে? এই প্রশ্নের মীমাংসায় স্বভাবতই বেদ এবং বেদমূলক শাস্ত্রগুলি ধর্ম এবং বিদ্যার আধার হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে৷ বেদমূলক শাস্ত্রের মধ্যে পুরাণ, ন্যায়, মীমাংসা, ধর্মশাস্ত্র এইগুলিই প্রধান। এখন প্রশ্ন হল—এই সব শাস্ত্র-যুক্তি ছাড়াও সমাজে আরও অনেক কিছু চলে যেগুলিকে আমরা ধর্ম-সঙ্গত বলে মনে করি। দেশকাল সমাজ ভেদে বিশিষ্ট ব্যক্তির অনুমত সদাচারও তো ধর্মের আধার। এইখানে কুমারিলভট্ট মনু-যাজ্ঞবল্কা ইত্যাদি ধর্মশাস্ত্রকারদের প্রমাণ দিয়ে স্বীকার করে নিয়েছেন যে—হ্যাঁ, শুধু সদাচার কেন, কোনও বিতর্কিত বিষয়ে বিশিষ্ট ধার্মিক ব্যক্তির আত্মতুষ্টিও একটা প্রমাণ। কারণ মনু-যাজ্ঞবল্ক্য সেই রকমই লিখেছেন—শ্রুতিঃ স্মৃতিঃ সদাচারঃ স্বস্য চ প্রিয়মাত্মনঃ। (যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা)।

বলতে পারেন আত্মতুষ্টি—আত্মনন্তুষ্টিরেব চ—এও কি ধর্ম বিষয়ে কোনও প্রমাণ হতে পারে, না হওয়া উচিত? নিজের ভাল লাগা, নিজের তুষ্টি তো আরও স্বার্থ বাড়িয়ে তুলবে, সেখানে ধর্ম কোথায়? আর সদাচার? সেও বড় গোলমেলে কথা। বিশিষ্ট এবং মহান ব্যক্তি এমন সব গণ্ডগোল করে রেখেছেন, যা অনুসরণ করতে গেলে বিপদ হবে—সদাচারেষু দৃষ্টো ধর্মব্যতিক্রমঃ সাহসং চ মহতাম্‌…৷ কুমারলি ভট্ট এই প্রসঙ্গে ইন্দ্রাদিদেবতা থেকে আরম্ভ করে মহামতি রামচন্দ্র পর্যন্ত সকলেরই কোনও না কোনও দুঃসাহসের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সেগুলি মোটেই সদাচার নয়। লক্ষণীয় যুধিষ্ঠির যে ছোটভাইয়ের বউকে নিজের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন—এই দুঃসাহসের কথাও সেখানে সযত্নে উল্লিখিত হয়েছে—যুধিষ্ঠিরস্য কনীয়ো’র্জিত-ভ্রাতৃজায়া-পরিণয়নম্‌।

ভট্টের আশয়টি পরিষ্কার। অর্থাৎ এগুলি বড় মানুষের সাহস। তাঁদের অপার ধারণ ক্ষমতা আছে। অতএব একটা-দুটো অন্যায় আচরণ করলেও সেগুলি সাধারণের আচরণীয় নয়। আমাদের চিন্তা কিন্তু অন্য জায়গায়। কোনও অন্যায় আচরণ করার পর সেটাকেই যদি বিশিষ্ট মানুষের আত্মতুষ্টির জায়গা বলে ধরে নিই তাহলে তো সমাজ এবং ধর্মের সর্বনাশ হয়ে যাবে। কুমারিল বলেছেন—ব্যাপারটা অত সোজা নয়। প্রথমত বড় মানুষেরা যেখানে ধর্ম অতিক্রম করেন, সেখানে যদি শ্রুতি-স্মৃতির সামান্য প্রচ্ছন্ন ‘সাপোর্ট’ও থাকে, তবে তা কাজে লাগিয়ে তথাকথিত কালিমালিপ্ত মহান পুরুষটিকে তো উদ্ধার করতেই হবে। তাতেও না হলে, তাঁদের অতিমানুষ তেজ এবং অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের নিরিখে আমাদের চেষ্টা করতে হবে যাতে তাঁরা লোক-সমাজে অশ্রদ্ধেয় না হয়ে পড়েন—

শ্রুতিসামান্যমাত্রাদ্বা ন দোষো’ত্র ভবিষ্যতি।

মনুষ্যপ্রতিযেধাদ্‌বা তেজোবলবশেন বা॥

যথা বা ন বিরুদ্ধত্বং তথা তদ্‌গময়িষ্যতি॥

যুধিষ্ঠিরের দ্রৌপদী-পরিণয় বিষয়ক সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা দেখানোর জন্য কুমারিল তাই প্রথমে স্বয়ং ব্যাসদেবের প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। আমরা জানি—দ্রুপদরাজা যখন কিছুতেই যুধিষ্ঠিরের দেওয়া দ্রৌপদীর পঞ্চ-পতিত্বের প্রস্তাব মেনে নিতে পারছেন না, তখন স্বয়ং ব্যাসদেব এসে দ্রৌপদীর পূর্বজন্মের সংবাদ অপিচ মহাদেবের বরদানের কথা বলে দ্রুপদরাজাকে সম্পূর্ণ শান্ত করার চেষ্টা করেন। ব্যাসের প্রতিপাদিত অর্থ কুমারিল ভট্টের কাছে পুরাণ-বচনের মর্যাদা ধরে বলেই তিনি সেটাকে ধর্মের যুক্তি বলেই মনে করেছেন—পাণ্ডুপুত্ৰাণামেকপত্নীবিরুদ্ধতা। সাপি দ্বৈপায়নেনৈব বুৎপাদ্য প্রতিপাদিত।

কুমারিল কিন্তু জানেন যে, ব্যাসের অলৌকিক যুক্তিগুলি সাধারণের কাছে নিশ্চয়ই তত গ্রাহ্য হবে না, যদি না সেখানে লৌকিক মঙ্গলের প্রশ্ন থাকে। যুধিষ্ঠিরের ভয় ছিল—অসামান্যা দ্রৌপদী একটি মাত্র ভাইয়ের কপালে স্ত্রী হিসেবে জুটলে ভাইতে-ভাইতে ঝগড়া লাগবে, পাঁচ ভাইয়ের জোট ভেঙে যাবে—মিথো ভেদভয়ান্নুপঃ। কুমারিল এই কথাটা মনে রেখে বলেছেন—রমণীকুলের রত্নভূতা লক্ষ্মীস্বরূপিণী দ্রৌপদী পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বিভক্ত হয়েছেন পৈত্রিক উত্তরাধিকারের মধ্যে রত্নের মর্যাদায়, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হল—যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তে সবরকম বিভেদ দূরীভূত হওয়ায় ভাইদের মধ্যে সংঘাতটাও তো এড়ানো গেছে—পরম্পরং সংঘাতাবিষয়ং চ ভেদপ্রয়োগানবকাশর্থং দর্শয়িতুং সাধারণপ্রখ্যাপনম্‌।

এটাও না হয় বোঝা গেল, কিন্তু আত্মতুষ্টির কথাটা এখনও বাকিই রয়ে গেল। যুধিষ্ঠির কেন বললেন—অধর্মের দিকে যেহেতু আমার মন যায় না, অতএব এইটাই ধর্ম। কুমারিল ভট্ট এই জায়গাও ধরেছেন, তবে যুধিষ্ঠিরের নাম তিনি এই প্রসঙ্গে করেননি। কুমারিল বলেছেন—যে সমস্ত পুরুষ শ্রুতি-স্মৃতির নির্দিষ্ট পথেই সবসময় বিচরণ করেন, বেদবিহিত সংস্কারে যাঁদের অন্তর সর্বদা পরিশীলিত তাঁরা এমন কিছু করতেই পারেন না, যার মধ্যে উন্মার্গগামিতার চিহ্ন আছে বহুকালাভ্যস্ত-বেদতদর্থজ্ঞানাহিত-সংস্কারাণাং বেদনিয়তমাগানুসারিপ্রতিভানাং নোম্মার্গেন প্রতিভানং সম্ভবতি।

সব কিছুর পরে কুমারিলের দার্শনিক মন্তব্য—বহুদিন ধরে যাঁদের মনপ্রাণ ধর্মের আচার-নিয়মেই সংস্কৃত হয়ে আছে, তাঁদের মন ধর্মসম্মত বিষয় ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে লিপ্তই হবে না, অধর্মের কাজে তাঁদের আত্মতুষ্টিও ঘটবে না কিছুতেই—বহুদিনাভ্যস্তধর্মব্যাপ্তাত্মনো হি ন কথঞ্চিদ্‌ ধর্মকরণরূপাত্মতুষ্টি-রন্যত্র সম্ভবতীতি। পরিষ্কার ভাষায়—এইরকম পর্যায়ের একটি মানুষ যদি তথাকথিত অন্যায়ের মধ্যেও নিজে সেই কাজ করে বা সিদ্ধান্ত দিয়ে তুষ্ট হন, তবে বুঝতে হবে সেইটাই ধর্ম—ধৰ্মত্বেনাভ্যনুজ্ঞায়তে। বৈদিকবাসনাজনিতত্বাদ্‌ বেদ এব স ভবতি।

এবার আমাদের মহাভারতের মূল প্রতিপাদ্যে ফিরে এসে বলি—যুধিষ্ঠিরের পক্ষে তো আর এটা বলা সম্ভব নয় যে—-মহারাজ! আমার মন শম-দমাদি সাধনে সংস্কৃত হয়ে গেছে, আমি একজন বৈদিক সংস্কার-সম্পন্ন আর্য পুরুষ, অতএব আমি যা বলব তাই ধর্ম। সত্যি কথা বলতে কি, যুধিষ্ঠির যা বলেননি অথবা অহঙ্কার দেখানাের ভয়ে যা তিনি বলতে পারেননি, যুধিষ্ঠির সেই রকমই একজন শম-দম-সম্পন্ন বিরাট পুরুষ। এবং আমরা যেরকম বিষম পরিস্থিতিতে অথবা সঙ্কটকালে প্রায়ই বলে থাকি—আমার মন বলছে—এই রকমটা করা উচিত—সেই রকম পরিস্থিতিতে যুধিষ্ঠিরের মতো উচ্চ-সংস্কার-সম্পন্ন মানুষ যদি সামগ্রিক পরিবারে মঙ্গলের জন্য এমন একটা সিদ্ধান্ত দেন যা আপাতদৃষ্টিতে লোক-বেদবিরুদ্ধ, তবুও সেটাই ধর্ম। কারণ ধর্মের অবিষয়ে যুধিষ্ঠিরের প্রবৃত্তিই হতে পারে না।

আমরা ধরেই নিলাম—অন্যান্য ভাইদের মতো কৃষ্ণা-দ্রৌপদীর রূপ-লাবণ্য যুধিষ্ঠিরকেও আকর্ষণ করেছিল। এই বিদগ্ধা রমণীর অলৌকিক উজ্জ্বলতায় যুধিষ্ঠিরও ভাইদের মতো একইরকম বিদ্যুৎ-স্পৃষ্ট ছিলেন—ধরেই নিলাম। কিন্তু দ্রৌপদী-বিজেতা তাঁকেই তো প্রথম প্রস্তাব দিয়েছিলেন দ্রৌপদীকে বিবাহ করবার জন্য ভবান্‌ নিবেশ্যঃ প্রথমম্‌। এমনকী দ্রুপদরাজাও যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন—তা হলে আপনিই যথাবিধানে আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করুন। —ভবান্‌ বা বিধিবৎ পাণিং গৃহ্নাতু দুহিতুর্মম। কিন্তু না, স্বার্থ সিদ্ধ করার সুযোগ থাকতেও তা একটুও ব্যবহার করেননি যুধিষ্ঠির। তিনি মায়ের কথা শুনে সংসারের প্রথম-প্রাপ্ত মহার্ঘ রত্নটি পাঁচ ভাই মিলে ভাগ করে নিয়েছেন। দ্রুপদরাজাকে তিনি বলেছেন—মহারাজ! আমাদের এইরকমই নিয়ম। একের দ্বারা প্রাপ্ত রত্ন আমরা সকলে একসঙ্গেই গ্রহণ করি এবং ভোগ করি—এষ নঃ সময়ো রাজন্‌ রত্নস্য সহ ভোজনম্‌।

এরই মধ্যে স্বয়ং বেদব্যাসের যুক্তিতন্ত্র ব্যাখ্যাত হল যুধিষ্ঠিরেরই অনুকুলে। দ্রুপদ স্ত্রীজাতির রত্নভুতা দ্রৌপদীকে সানন্দে তুলে দিলেন পাঁচ ভাইয়ের হাতে। দ্রৌপদীর সঙ্গে পাণ্ডবদের বিয়ে হওয়ার পর-পরই পাণ্ডব-কৌরবদের জ্ঞাতি-সম্বন্ধ রাজনৈতিক সম্বন্ধে পরিণত হল। পাঞ্চালরাজ্যের রাজা দ্রুপদ হস্তিনাপুর-নিবাসী কৌরবদের বিরোধী গোষ্ঠীর নেতা। দ্রোণাচার্যের কারণে তাঁর রাজ্যের অর্ধেকটা চলে গেছে এবং দ্রোণাচার্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন হস্তিনাপুরের রাজা ধৃতরাষ্ট্র। দ্রোণাচার্যের প্রার্থিত গুরুদক্ষিণা দেওয়ার সময় পাণ্ডব-মধ্যম অর্জুনই যদিও দ্রুপদকে জীবিত ধরে এনেছিলেন, তবু অর্জুনের মর্যাদাবোধ এবং অমানুষী শক্তির নিরিখে দ্রুপদ তাঁর ওপরে মোটেই ক্ষুব্ধ হননি। বরঞ্চ দ্রৌপদীর বিবাহের সূচনায় তিনি মনে মনে অর্জুনকেই পাত্র হিসেবে চেয়েছিলেন। আজ এই বিবাহের সূত্রে দ্রুপদের সঙ্গে পাণ্ডবদের নতুন এক সম্পর্ক হয়ে যাওয়ায় দ্রুপদের একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে।

অন্য দিকে দেখুন, পাণ্ডবরাও এক বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী, যাঁদের নেতা হলেন যুধিষ্ঠির। তাঁর দিক থেকে সমস্ত সততা থাকা সত্ত্বেও কৌরবরা পদে পদে তাঁদের বিরোধিতা করছেন। তাঁদের জ্ঞাতি-বিরোধ এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে, বিষ দেওয়া, আগুন লাগানো ইত্যাদি কোনও অপকর্মেই তাঁদের কোনও দ্বিধা নেই। কৌরবদের আরেক বিরুদ্ধ-গোষ্ঠী হিসেবে পাণ্ডবপক্ষের মুখপাত্র যুধিষ্ঠির হাত মেলালেন দ্রুপদের সঙ্গে। যুধিষ্ঠিরকে যাঁরা বোকা ভাবেন, তাঁদের জানাই—দ্রৌপদীর সঙ্গে বিবাহ হওয়ার প্রাক্কালে দ্রুপদ যখন প্রথম পাণ্ডবদের পরিচয় পেলেন, তখনই তাঁদের সসম্মানে রাজবাড়িতে নিয়ে এলেন। রাজবাড়িতে নিজেদের পরিচয় দ্রুপদকে নিশ্চিতভাবে জানানোর পর-পরই যুধিষ্ঠির রাজনৈতিক প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন।

রাজনৈতিক প্রসঙ্গের প্রথম সূচনায় যুধিষ্ঠির দ্রুপদকে বলেন—আপনার কাছে সব কথাই সত্য বলছি। তার কারণ বৈবাহিক-সম্বন্ধে আপনি শুধু আমাদের গুরুই নন, আপনি আমাদের আশ্রয়—ভবান হি গুরুরস্মাকং পরমঞ্চ পরায়ণম্। দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরের কথা শুনে আপ্লুত বোধ করেছেন— হর্ষ-ব্যাকুল-লোচনঃ। যুধিষ্ঠির এবার আস্তে আস্তে জানিয়েছেন—কীভাবে কৌরবরা তাঁদের পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং কীভাবে পাণ্ডবরা জতুগৃহের আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছেন। সব ঘটনা যুধিষ্ঠির আনুপূর্বিকভাবে দ্রুপদকে জানালেন—স তস্মৈ সর্বমাচখ্যৌ আনুপূর্ব্যেণ পাণ্ডবঃ। যুধিষ্ঠিরের বক্তব্য শোনার পর আমরা দেখছি—দ্রুপদ কৌরব-শ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রের সম্বন্ধে নিন্দায় মুখর হয়ে উঠলেন। অর্থাৎ দ্রুপদ এবং যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আপন স্বার্থে একাত্ম হলেন। পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ এর পরে দ্রৌপদীর বিবাহের সূত্র ধরে যুধিষ্ঠিরের পুরো পরিবারের সঙ্গে প্রথাগতভাবে পরিচিত হবেন। কিন্তু তার আগে একটা ছোট্ট রাজনৈতিক চুক্তি হয়ে গেল যুধিষ্ঠির আর দ্রুপদের মধ্যে। দ্রুপদ যুধিষ্ঠিরকে সমস্ত রাজনৈতিক আশ্বাস দিয়ে পাণ্ডবরা যাতে তাঁদের রাজ্য ফিরে পান, সে বিষয়ে আপন প্রতিজ্ঞা জানালেন যুধিষ্ঠিরকে—প্রতিজজ্ঞে চ রাজ্যায় দ্রুপদো বদতাং বরঃ।

যুধিষ্ঠিরের রাজনৈতিক আশ্বস্ততা বাড়ল আরও একটি কারণে। যদুবংশীয় কৃষ্ণ-বলরাম তাঁর সঙ্গে দেখা করে গেছেন এবং যুধিষ্ঠিরকে তাঁরা নিজের দাদার মতোই সম্মান করেন। এমনিতেই তাঁদের মধ্যে আত্মীয়-সম্বন্ধ আছে—কৃষ্ণের পিতা এবং যুধিষ্ঠিরের মাতা আপন ভাই-বোন। পাণ্ডবরা কৌরবদের হাতে বারবার বিপন্ন হওয়ায় কৃষ্ণ এবং অন্যান্য যাদবরা এমনিতেই যুধিষ্ঠিরের পক্ষপাতী ছিলেন। দ্রৌপদীর বিবাহ-সূত্রে পাঞ্চালদের সঙ্গে পাণ্ডবদের যখন একটা ‘আঁতাত’ হয়ে গেল, তখন মহাভারতের বক্তা বৈশম্পায়ন নিরপেক্ষ মন্তব্য করলেন—পাঞ্চালরাজ দ্রুপদের সঙ্গে পাণ্ডবদের এই যে সংযোগটি ঘটল—পাণ্ডবৈঃ সহ সংযোগং গতস্য দ্রুপদস্য হ—এতে পাণ্ডবদের আর কোনও ভয়ই রইল না, এমনকী শক্তিমান দেবতাদের থেকেও তাঁদের আর ভয় রইল না বলে মনে হল।

পাণ্ডব-পাঞ্চালদের এই জোটের বিষয় কুরুসভাতেও প্রচুর আলোচিত হল। ধৃতরাষ্ট্র অনুভব করলেন যে, দ্রুপদরাজাকে সবান্ধবে আত্মীয় হিসেবে পেয়ে পাণ্ডবরা লাভবান হয়েছেন, তাই শুধু নয়, তাঁদের রাজনৈতিক শক্তিমত্তা অনেক বেড়ে গেছে। কুরুবাড়ির বৃদ্ধদের চাপ, পাণ্ডবদের পিছনে পাঞ্চাল-যাদবদের জোট বাঁধা এবং পাণ্ডবদের পৈতৃক অধিকার—সব কিছু বিচার-বিবেচনা করে প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের কুরুরাজ্যের একাংশ ফিরিয়ে দিতে রাজি হলেন। রাজ্যের জন্য যেখানে জমি-জায়গা দিলেন ধৃতরাষ্ট্র, সেটা জায়গা হিসেবে খুব ভাল নয় বটে, তবে শত হলেও সেটা পাণ্ডবদের প্রথম স্বাধিকার, আর পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির সেখানে রাজা হবেন। রাজ্য লাভ করার ফলে যুধিষ্ঠিরের মনে যে খুব ব্যক্তিগত উন্মাদনা ছিল, তা মোটেই নয়। তবে জননী কুন্তী এতকাল রাজরানি ছিলেন, ভাইরা পৈতৃক অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং সেই ছোটবেলা থেকে বিবাহের বয়স পর্যন্ত একটি রাজপরিবারের অকারণ দুর্দশা—এই সমস্ত কিছুই যুধিষ্ঠিরের অন্তরে ক্রিয়া করে থাকবে। অতএব উচ্চাবচ ভূমি, শষ্যহীন এক প্রান্তর যুধিষ্ঠিরের জন্য নির্ধারিত হলেও যুধিষ্ঠির বিমনা হলেন না। রাজধর্মের আদর্শে স্থিত হয়ে ভাইদের সঙ্গে সানন্দে ইন্দ্রপ্রস্থের রাজ্য পরিচালনা করতে লাগলেন যুধিষ্ঠির—পালয়ামাস ধর্মেণ পৃথিবীং ভ্রাতৃভিঃ সহ।