অর্জুন – ৫

অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবরা যখন বিরাটরাজার রাজ্যে লুকিয়ে আছেন—আপনাদের স্মরণ আছে। নিশ্চয়ই—সেই সময় রাজার শালা কীচক পাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদীর জীবন একেবারে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। রাজার প্রশ্রয় এবং রানি সদেষ্ণার পক্ষপাতে সে বিরাটরাজার সেনাপতি পদ পেয়েছিল এবং এই মর্যাদা চেপে রাখতে না পেরে সে দ্রৌপদীকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে উঠল। এদিকে পাণ্ডবরা তো একেকজন একেক নাম নিয়ে বিভিন্ন ছদ্মবেশে রাজার কাজ করে যাছেন। ভীম রাঁধুনে বামুন সেজে নিজের শৌর্যবীর্য রান্নার সৌকর্যে পরিবর্তিত করেছেন। আর অর্জুন নপুংসকের চিহ্নে রাজ-অন্তঃপুরে প্রবেশ লাভ করে বিরাটরাজার মেয়ে এবং তার সঙ্গীসাথীদের নাচগান শিখিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।

দ্রৌপদী যখন কীচকের অত্যুগ্র, বিকৃত প্রেমের সমস্যায় পড়েছিলেন, তখন তিনি উপায়ান্তর না দেখে মধ্যম-পাণ্ডব ভীমকে এই ঘটনা জানিয়েছিলেন, যাতে তিনি কীচকের ব্যাপারে কিছু ব্যবস্থা নিতে পারেন। কীচক-সমস্যা সমাধানের জন্য দ্রৌপদী নপুংসকের ছদ্মবেশী অর্জুনের কাছে যেতে পারতেন; তাতে অজ্ঞাতবাসে পাণ্ডবদের পরিচয় জানাজানি হয়ে যাবার বিপদও কম থাকত। কারণ, রাজরানির পরিচারিকা সৈরন্ধ্রী একজন নপুংসক নৃত্যশিক্ষকের সঙ্গে কথা বলছে—এতে কারও সন্দেহ হবার কথা নয়। কিন্তু তবু দ্রৌপদী অর্জুনের কাছে যাননি এবং বেশি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে ভীমের কাছেই গেছেন। এর কারণ দুটি। প্রথমত কীচকের অপব্যবহার এবং দ্রৌপদীর লাঞ্ছনা ভীমের আংশিকভাবে জানা ছিল। কীচক একবার দ্রৌপদীর পেছন পেছন ছুটতে ছুটতে রাজসভায় এসে পৌঁছেছিল এবং দ্ৰৌপদী রাজার কাছে নালিশ জানালে সে দ্রৌপদীকে পদাঘাত করেছিল। ঠিক এই মুহূর্তে ভীমসেন নিজের কাজে রাজসভায় এসেছিলেন এবং দ্রৌপদীর এই অপমান দেখেছিলেন।

ফলত কীচকের ব্যাপারে ভীমকে বলে তাঁকে বিশ্বাস করানোটা অনেক বেশি সহজ ছিল দ্রৌপদীর পক্ষে। এবং তততধিক সহজ ছিল ভীমকে এক মুহূর্তে চেতিয়ে ভোলা। কিন্তু দ্রৌপদী যদি অর্জুনকে এই লাঞ্ছনার কথা বলতেন—তা হলে তাঁকে বিশ্বাস করানো যেত না—তা বলছি না, কিন্তু দেরি হত। আর যে তৎপরতায় ভীমসেন কীচকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, এই তৎপরতা অর্জুনের কাছে দ্রৌপদী আশা করেননি, অর্থাৎ কিনা তাঁর সংশয় ছিল। কারণ, অর্জুন মানুষটি স্বভাবতই ধীর, তার ওপরে অজ্ঞাতবাস চলছে, বড়দাদা যুধিষ্ঠির কী মত দেন—এত শত চিন্তা তাঁর মনের মধ্যে হয়তো ক্রিয়া করতই। তা ছাড়া যেটাকে আমরা ভীমের তৎপরতা বলছি—সেটা অর্জুনের কাছে হঠকারিতা বলে গণ্য হবে বলে দ্রৌপদী মনে করেছেন। আর সত্যিই তো ভীম যেভাবে কাজ করেছেন, তাতে দ্রৌপদীর দিক থেকে ব্যাপারটা যতটা বীরজননাচিত এবং স্ত্রীর রক্ষক হিসাবে যতটা স্বামীজনোচিতই হোক না কেন, এ ঘটনায় যে কোনও মুহূর্তে পাণ্ডবদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাবার ভয় ছিল। আবার এও জানি—যদি ভীমের কারণে এই পরিচয় জানাজানি হত এবং আবারও দুর্যোধনের শর্ত মেনে পাণ্ডবদের বনে যাবার প্রশ্ন উঠত, তা হলে যে যাই বলুন, অর্জুনই ভীমকেও যেমন অনুমোদন করতেন তেমনই অন্যদিকে যুধিষ্ঠিরের সত্যনিষ্ঠা রক্ষা করার জন্য পুনরায় বারো বছরের বনবাসের প্রস্তুতিও নিতেন।

যাই হোক ভীমের হাতযশ এবং দ্রৌপদীর সৌভাগ্যে এ সব ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু এও ঠিক দ্রৌপদী অর্জুনকে এ ব্যাপারে ভরসা করেননি। কিন্তু ভরসা করলে ভীমের মতো অৰ্জুন একইরকম তৎপরতায় কীচক বধে উদ্‌যুক্ত হতেন না—এ-কথা আমরা হলফ করে বলতে পারি না। কারণ বিরাট-গৃহে সৈরন্ধ্রীর মুখের এক কথায় তিনি কুমার উত্তরের সারথি হয়ে কৌরবদের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন। উত্তর যখন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাচ্ছিলেন তখন অৰ্জুন বলেছিলেন—উঁহু! সেটি হবে না। সৈরীন্ধ্রী অমন বড় মুখ করে তোমার সারথি হতে বলেছেন, তুমিও সেটা স্বীকার করেছে, এখন তুমি যুদ্ধ না করেই চলে যাবে—সেটি হবে না—স্তোত্রেণ চৈব সৈরন্ধ্র্যাস্তব বাক্যেন তেন চ।

কিন্তু সৈরন্ধ্রীর লজ্জানত মুখের একটি প্রশংসাবাক্য যেমন এই মুহূর্তে অর্জুনকে বিরাট যুদ্ধের সম্মুখীন করেছে, তেমনই এ-কথাও মনে রাখতে হবে—অজ্ঞাতবাসের শেষ পর্যায়ে কৌরবদের সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েই তিনি নিজের শরীরের মধ্যে উপলব্ধি করতে পারছিলেন যে, তিনি আর নপুংসক নেই অর্থাৎ তাঁর অজ্ঞাতবাসের সময়সীমা উত্তীর্ণ। কুমার উত্তরকে তিনি আশ্বস্ত করে বলেছেন—আমি নপুংসক নই, —নাস্মি ক্লীবো মহাবাহো—আজকে আমি আমার অজ্ঞাতবাসের ব্রত থেকে উত্তীর্ণ—সমাপ্তব্ৰতমুত্তীর্ণং বিদ্ধি মাং ত্বং নৃপাত্মজ।

এই যে প্রিয়া পত্নীর সানুরাগ অনুনয় অর্জুন প্রত্যাখ্যান করছেন না, আবার সঙ্গে সঙ্গে সামগ্রিক পরিবারের কল্যাণকল্পে অজ্ঞাতবাসের সময়সীমাটাও মাথায় রাখছেন—এইখানেই তিনি অর্জুন। বোধ করি, কীচকের ব্যাপারে দ্রৌপদী যদি অর্জুনের ওপর ভরসা রাখতেন, তা হলে তিনি নিশ্চয়ই এমন কোনও উপায় বার করতেন যাতে সর্পরূপী কীচকও মরত, অথচ অজ্ঞাতবাসের লাঠিটাও ভাঙত না। কিন্তু যাই হোক দ্রৌপদীও অর্জুনের ওপর ভরসা করেননি, অর্জুনও সে ব্যাপারে নিজেকে জড়াননি। কিন্তু আমি যে পঞ্চপাণ্ডবের বিয়ের পরপরই অর্জুনকে দ্রৌপদীর অংশপতিত্ব দান করেই বিরাটপর্বে দ্রৌপদী কীচক বা দ্রৌপদী-ভীম সংবাদে চলে এলাম—তার কারণ কী? কারণ একটাই। এত বড় স্থিতপ্রজ্ঞ, স্বভাবধীর, ওপর-চাপা মানুষটার মনটা একটু জানতে চাই। জানতে চাই—থির-নিথর জলে ছোট্ট একটি ঢিল ফেললে সামান্যতম ঢেউ দেয় কিনা? জানতে চাই—স্থিতধী ব্যক্তিকেও ভালবাসা এবং প্রেমের না-পাওয়াটুকু ক্ষণেকের তরে উদাস করে কিনা?

কীচকবধ এবং শ্মশানভূমিতে ভীমের হাতে তার ভাইদের মৃত্যু হওয়ার পরপরই পাঞ্চালী অতি সুকৌশলে ভীমের উদ্দেশে প্রণাম জানিয়ে বললেন—গন্ধর্বরাজায় নমঃ। কিন্তু বুক-উজাড় করা এই কৃতজ্ঞতা জানিয়েও, কেন জানি না, দ্রৌপদী সেই নুপূরের শিঞ্জনমুখর নৃত্য-গৃহটির পাশ দিয়ে ঘরে ফিরছিলেন। নূপুর-পরা মেয়েরা সকৌতুকে দ্রৌপদীকে ছেকে ধরল। বলল—ভাগ্যিস সেই অসভ্য লোকগুলোর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছ তুমি সৈরন্ধ্রী! মেয়েদের দেখাদেখি অজ্ঞাতবাসের অভিনয়ে দক্ষ বৃহন্নলাও সোৎসুকে জিজ্ঞাসা করলেন—কেমন করে সেই বদমাশগুলোর হাত থেকে মুক্তি পেলে, সৈরন্ধ্রী! কেমন করেই বা তারা মারা পড়ল? সব গুছিয়ে বললো তো, আদ্যোপান্ত শুনতে ইচ্ছে করছে।

অভিমানিনী পাঞ্চালী এই সুযোগটাই চাইছিলেন। ঠোঁট ফুলিয়ে সৈরন্ধ্রী বললেন—সৈরন্ধ্রীর কী হল না হল তা শুনে তোমার কী কাজ বৃহন্নলা? কাঁচা বয়সের মেয়েদের মাঝে বেশ তো আলো করে সুখে আছ—যা ত্বং বসসি কল্যাণি সদা কন্যাপুরে সুখম্। দ্রৌপদী এইটুকুতেই শেষ করলেন না! বললেন—সৈরন্ধ্রী যে কষ্ট পাচ্ছে, তা তুমি পাও না বলেই পোড়াকপালীকে এমন হাসি মুখে কুশল জিজ্ঞাসা করছ—তেন মাং দুঃখিতামেবং পৃচ্ছসে প্রহসন্নিব। এক মুহূর্তে বৃহন্নলার হাসি উবে গেল। অসহায়ের মতো তিনি বলে উঠলেন—বৃহন্নলাও তোমারই মতো কষ্ট পায়, কল্যাণী! কিন্তু সে যে নপুংসক, তাও কি তুমি বোঝে না! এই কথার মধ্যে সব ছিল। অজ্ঞাতবাসের সমস্যা, নিজের ছদ্মবেশ এবং তাঁর অসহায়তা—সব ছিল। অর্জুন বললেন, তোমার সঙ্গে আমি কোনওকালে থাকিনি—তা তো নয়, আবার ভুমিও আমাদের সকলের সঙ্গে কোনওকালে থাকনি—তাও তো নয়। তুমি তখন কি কোনওদিন দেখেছ—তুমি দুঃখ পেলে তাঁরা দুঃখ পান না?

এ-সব হেঁয়ালির কথা ঝুমুর-তোলা নাচের মেয়েরা বুঝল না। কিন্তু দ্রৌপদীর চোখ চাওয়া এইরকম বিষাদ-ঘন মুহূর্তে নপুংসক বৃহন্নলা, অর্জুনের সমস্ত অন্তরাত্মা প্রকাশ করে ফেলল; প্রকাশ করে ফেলল অর্জুনের ভূত-ভাবী সমস্ত জীবনের অনুভূতি। বৃহন্নলার বহিরঙ্গের মধ্যে থেকে কোনও এক অজানা অর্জুনের অন্তরঙ্গ-হৃদয় হাহাকার করে বলে উঠল—কেউ কোনওদিন কারও মন বুঝতে পারে না, দ্রৌপদী! সেই জন্য তুমিও আমায় বুঝতে পারলে না গো ভাল মানুষের মেয়ে—ন তু? কেনচিদত্যন্তং কস্যচিদ্‌ হৃদয়ং ক্বচিৎ। বেদিতুং শক্যতে ভদ্রে…।

এই মুহূর্তে আমরা যেন আধুনিক কোনও উপন্যাসের চরম কোনও সংলাপ শুনছি। ‘কেউ’—‘কোনওদিন’—‘কারও’—এই কথাগুলি যতই নৈব্যক্তিক কোনও আবহ তৈরি করুক না কেন, অর্জুন যেন অর্জুনের দিকেই অঙ্গুলি-সংকেত করে নিজের একান্তে জমাননা এতকালের হতাশা ক্ষণিকের উত্তেজনায় প্রকাশ করে ফেলেছেন। প্রকাশ করেছেন একটি মাত্র বাক্যে চারটি-পাঁচটি শব্দের নৈর্ব্যক্তিক অর্থগৌরবে—কেউ কোনওদিন কারও মন বোঝে না, ভদ্রে। শব্দগুলির মধ্যে আছে ঝরে-পড়া বকুলের হাহাকার, অনুপভুক্ত বসন্তের মায়া! কী যেন বলিবার ছিল, বলি বলি করিয়া বলা হইল না। অথবা “মনের কথা এ জন্মে বলা হইল না—যদি কোকিলের কণ্ঠ পাই—অমানুষী ভাষা পাই আর নক্ষত্রদিগকে শ্রোতা পাই, তবে মনের কথা বলি।” ‘কেউ’ ‘কারও’ ‘কোনওদিন’—এই ভাষায় অসীম নক্ষত্রলোকের উদ্দেশে আপন ভাব ব্যক্ত করা যায় বটে, কিন্তু এই ভাষার অধিক কোনও শব্দে পঞ্চপাণ্ডবপ্রিয়া দ্রৌপদীর কাছে অন্যতম পাণ্ডবের হৃদয় এইভাবে উন্মোচন কতটা যুক্তিযুক্ত হত? তাও অর্জুনের মতো ধীর, বিবেকী মানুষের পক্ষে?

দ্রৌপদী বিদগ্ধা নায়িকা বটে, তিনি আর একটি কথাও বলেননি। শুধু যা বোঝার বুঝে নিয়ে স্বস্বীকৃতিমুগ্ধা ব্যক্তিত্বময়ী নায়িকাটির মতো আপন ঘরে ফিরে এসেছেন। হয়তো দ্রৌপদীর কাছে স্বয়ম্বর সভার প্রথম বরমাল্য পাওয়া পুরুষের এই হতাশ স্বীকৃতিটুকুই যথেষ্ট ছিল, কারণ পঞ্চস্বামিগর্বিত নায়িকার মনে অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাণ্ডবের এই সাভিমান খেদোক্তি শুধুই তাঁর আত্মবিশ্বাস তৈরি করেনি, বরঞ্চ এটা তাঁর বাড়তি পাওনা। কিন্তু অর্জুনের দিক থেকে ব্যাপারটা কোনওভাবেই আশ্বাসের নয়। তাঁর মন উদভ্রান্ত হয়েছে—সে কতকাল? যে রমণীর হৃদয় তিনি স্বীয় ভুজবলে অধিকার করেছিলেন, যে-হৃদয় একান্তভাবেই তাঁরই সম্পূর্ণ প্রাপ্য ছিল, সে-হৃদয় তিনি না হয় বীরোচিত উদারতায় ভাইদের বিলিয়ে দিয়েছেন, কিন্তু আপন হৃদয়ের আবেগ তিনি অবরুদ্ধ করবেন কী করে? অতএব সে মন তার আপন গতিপথ তৈরি করেছে। এই গতিপথের ভাবনায় মনস্তত্ত্ববিদের অঙ্গুলি-সংকেত আছে কি না জানি না, তবে আমরা আমাদের মতো করে দুটো কথা তো বলতেই পারি।

দ্রৌপদীর সঙ্গে যেই পাঁচ পাণ্ডবের বিয়ে হয়ে গেল, অমনই পঞ্চালের রাজা দ্রুপদ পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এলেন। নিতান্ত রাজনৈতিক কারণে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র খাণ্ডবপ্রস্থ নামে এক রুক্ষ জায়গায় পাণ্ডবদের রাজ্য দিয়ে পুনর্বাসিত করতে বাধ্য হলেন। যুধিষ্ঠিরের সভা তখনও ইন্দ্রপ্রস্থে পরিণত হয়নি; এমনই সময় মহর্ষি নারদ এসে পাঁচ ভাইকে গোপনে ডেকে বললেন—পাঞ্চালী-কৃষ্ণা তোমাদের পাঁচজনেরই পরিণীতা বধূ। যাতে তাঁকে নিয়ে স্বর্গসুন্দরী তিলোত্তমার মতো সুন্দ-উপসুন্দের ঝগড়া না লাগে, তেমন একটা নিয়ম করো। পাঁচ ভাই প্রয়োজন বুঝে নারদকে সাক্ষী রেখে নিজেরাই নিয়ম করলেন—জ্যেষ্ঠের ক্রমানুসারে যে পাণ্ডব যখন দ্রৌপদীর সঙ্গে সহবাসে থাকবেন, সেই সময় যদি অন্য ভাই সেখানে ভুলেও ঢুকে পড়েন, তা হলে বারো বছরের জন্য তাঁকে বনে গিয়ে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে।

নিয়ম তো হল। কিন্তু এই নিয়মের শৃঙ্খলে যুধিষ্ঠির-ভীম কিংবা নকুল-সহদেব—কেউই বাঁধা পড়লেন না। বাঁধা পড়লেন অর্জুনই। সেই যে এক ব্রাহ্মণের গরু চোরে নিয়ে গেল। ব্রাহ্মণ চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলেন। ওদিকে যুধিষ্ঠির প্রথম দ্রৌপদীর সঙ্গলাভ করে বিভিন্ন নির্জন স্থানে তাঁর কাছে প্রেম নিবেদন করে যাচ্ছেন। অর্জুন ব্রাহ্মণের কান্না শুনে কর্তব্যের তাড়না অনুভব করতে লাগলেন বটে, কিন্তু তাঁর অস্ত্র-শস্ত্র, ধনুক-বাণ—সব জমা রয়েছে সেই অস্ত্রাগারে। আর আজই পাণ্ডব-জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির নির্জনতার খোঁজে সেই অস্ত্রাগারে বসেই দ্রৌপদীর সান্নিধ্য অনুভব করছেন। অর্জুন দেখলেন—মহাবিপদ। একদিকে গরিব ব্রাহ্মণের আর্তি, ক্ষত্রিয়ের কর্তব্য, অন্যদিকে যুধিষ্ঠির-দ্রৌপদীর সামনে পৌঁছানো মানেই—বারো বছর বনে। কিন্তু অর্জুনের মতো বীরের কাছে ক্ষত্রিয়ের প্রজা-রক্ষার ধর্মই যে মুহূর্তের মধ্যে বড় হয়ে উঠবে—তাতে সন্দেহ কী?

অর্জুন গেলেন, চোর ধরলেন, ব্রাহ্মণের গরু ব্রাহ্মণকে ফেরত দিলেন। ব্রাহ্মণের সাধুবাদ এবং ভাইদের অভিনন্দনের মধ্যেই অর্জুন যুধিষ্ঠিরের কাছে বনে যাবার প্রস্তাব করলেন। সৌজন্যের চূড়ান্ত করে এবার অর্জুন বললেন—আমি নিয়ম ভেঙেছি। যে সময়ে আপনাকে দর্শন না করলেও চলত, সেই সময়ে আপনাকে বিরক্ত করেছি—সময়ঃ সমতিক্রান্তো ভবৎসর্শনে ময়া। এখন আদেশ করুন, আমি আমার বারো বছরের ব্রতের আয়োজন করি। যুধিষ্ঠির বললেন—দূর! বোকা ছেলে! বড়রা বউয়ের সঙ্গে বসে কথাবার্তা বলছে, সেখানে ছোটরা গেলে কিছু হয় নাকি! বরঞ্চ ছোটভাই যদি বউয়ের সঙ্গে বসে থাকত আর বড়রা উপস্থিত হত সেখানে, সেইটা একটা ব্যাপার হত। এতে তো তোমার কোনও অন্যায়ই হয়নি। অর্জুন বেশ বুঝতে পারলেন—বড়ভাই তাঁর ওপর মায়া করেই এত যুক্তি-তর্ক সাজিয়েছেন। এই করুণা, এই প্রশ্রয় তিনি গ্রহণ করবেন কেন? অতএব সঙ্গে সঙ্গে বললেন—দাদা! আপনার কাছেই না শুনেছি—চালাকি করে কখনও ধর্ম হয় না—ন ব্যাজেন চরেদ্‌ ধর্মং—এখন কেন তবে আমাকে সত্য থেকে সরে আসতে বলছেন? যুধিষ্ঠির আর কথা বাড়াননি। অর্জুন বারো বছরের জন্য ব্রহ্মচারী হয়ে বনবাস করার জন্য দীক্ষিত হলেন।

যেদিন তিনি রওনা হলেন, সেদিন বিদায়-বেলায় রাজবাড়ির অলিন্দের আড়ালে আমরা দ্রৌপদীকে দেখিনি। কারণ অর্জুন ব্রহ্মচারী, তিনি স্ত্রীমুখ দেখবেন না। যাবার সময় তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মধ্যে অজস্র ব্রাহ্মণকে দেখতে পাচ্ছি। বনবাসের প্রথম আবেশে আকাশ-বাতাস, আলো-ছায়া—সবই ভাল লাগে-রমণীয়ানি চিত্রাণি বনানি চ সরাংসি চ। আবার ব্রহ্মচর্যের প্রথম আবেশে ধর্মচর্যা, যজ্ঞ-হোম, গঙ্গাস্নান—এগুলিরও একটা প্রবল আবেগ তৈরি হয় (যাঁরা পৈতে নিয়েছেন, তাঁরা ব্রহ্মচর্যের প্রথম দিনগুলি স্মরণ করুন)। বন, পাহাড়, নদী দেখতে দেখতে অর্জুন গঙ্গাদ্বারে এসে পৌঁছলেন। সেখানে ব্রাহ্মণের সাম্রাজ্যে যজ্ঞ, হোম, অগ্নিহোত্র প্রভৃতি বৈদিক উপচার আর হবিধুমে অর্জুন কিছুদিন বেশ আমোদিত হয়ে জমে রইলেন। তারপর একদিন স্নানের জন্য গঙ্গায় নেমেছেন অর্জুন; স্নানও হয়ে গেছে। জল থেকে উঠতে যাবেন, ওমনি তাঁর কাপড় ধরে কে যেন জলের মধ্যে টানল। সরসর করে তাঁকে টেনে নামানো হল অনেক নীচে জলের তলায়। সেখানে বাড়ি-ঘর সব আছে; এমনকী অর্জুন যে স্নানের পর অগ্নিহোত্র করবেন—সে ব্যবস্থাও আছে। ব্রহ্মচর্যের প্রথম আবেশে অর্জুন আগে অগ্নিকার্য করে নিলেন। তারপর হাসিমাখা মুখে যাঁর দিকে তাকালেন, তিনি নাগ-কন্যা উলূপী। বললেন—কন্যে! বড় সাহস দেখলুম তোমার, কে গো তুমি, কার মেয়ে?

একটু আধুনিক দৃষ্টি থেকে বলি—এই যে নাগকন্যা উলূপীকে দেখছেন—ইনি কোনও সাপিনী-টাপিনী বলে আমাদের মনে হয় না। বস্তুত উত্তর ভারতে বেশ কিছু অনার্য জাতির বাস তখনও ছিল যারা সাপের ‘টোটেম ব্যবহার করত। জলের তলায় অর্জুনকে কতটা হিরহির করে টেনে নামানো হয়েছিল, তা অৰ্জুনই জানেন, তবে আমরা যা জানি তাতে বুঝি—গঙ্গাদ্বারের ব্রাহ্মণ-সমাজ থেকে এই মেয়েটি তাঁর নিজের যৌবন বেগে অর্জুনকে দূরে সরিয়ে নিজের বসতিতে এনে ফেলতে পেরেছিল। অনার্যত্ব-হেতু সে নিজের যৌবন সুখ উপভোগ করার জন্য আচার-বিচারের ধার ধারে না এবং সোজাসুজি সে অর্জুনকে বলেছে—তোমায় গঙ্গায় স্নান করতে দেখেই ভীষণ ভাল লাগল আমার, তোমার সঙ্গ পেতে ইচ্ছে হল তাই-দৃষ্ট্ৰেব পুরুষব্যাঘ্র কন্দর্পেনাভিমূচ্ছিতা। অর্জুন বললেন—সে কী কথা! আমি ব্রহ্মচারী, দাদার কথায় বনে এসেছি, বারো বছর আমার এইভাবে চলতে হবে। এই ব্রত-নিয়মের কথা শুনেও অর্জুন কিন্তু উলূপীকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান করতে পারছে না। কারণ উলূপী ভারতবর্ষের আদিম জাতের মানুষ এবং উলূপী সুন্দরী, আদিম যৌবন তার শরীরে। অর্জুন বললেন—জলকন্যে! তোমার যেটা ভাল লাগছে, আমি তাও করতে চাই—তব চাপি প্রিয়ং কর্ত্তৃমিচ্ছামি জলচারিণি—আবার আমার ব্রতটা যাতে নষ্ট না হয়—সেটাও একটু ভাবো।

হায়! অর্জুন এমন একজনের ওপর তাঁর ব্রতরক্ষার ভার দিলেন, যিনি তাঁর ব্রতভঙ্গ করার জন্যই এতদূর তাঁকে নিয়ে এসেছেন। উলূপীর বাবার ছেলে ছিল না বলে, তিনি মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন তাড়াতাড়ি। কিন্তু উলূপীর সন্তান হবার আগেই তাঁর স্বামীকে হরণ করে নিয়ে গেল সুপর্ণ (যারা হয়তো খগরাজ গরুড়ের টোটেম ব্যবহার করত।) সেই থেকে উলূপীকে সবাই করুণা করে। যৌবনের সুখ সে পায়নি, সব সময় মনমরা হয়ে থাকে—মহাভারতের কবির ভাষায়—কৃপণা দীনচেতনা। সেই উলূপী যখন মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও হরিদ্বারের গঙ্গা আর ব্রাহ্মণসমাজ থেকে অর্জুনকে তুলে নিয়ে এল—সে কি অর্জুনের ব্রতরক্ষার জন্য? আর অর্জুনের মতো মহাবীরের যদি সায় না থাকত এতে, তবে কার সাধ্য তাঁকে এমনি করে অজানা অনার্য জনপদে টেনে আনে? অর্জুন ধরা দিতেই এসেছেন, তবু পুরুষমানুষ বলে কথা, একটু গুমোর দেখাচ্ছেন—এই আর কী। অর্জুনের ব্রতের কথা শুনে উলূপী বলল—আমি সবই জানি গো জানি। তা ওসব ব্রত, নিয়ম, ব্রহ্মচর্য—সবই তো দ্রৌপদীর ব্যাপারে—তদিদং দ্রৌপদীহেতোঃ। ভাইরা মিলে তোমরা যে নিয়ম করেছ, তাতে এক ভাই দ্রৌপদীর সঙ্গাসক্ত হলে অন্য ভাই সেখানে ঢুকবে না। ঢুকলে বারো বছরের বনবাস ব্রহ্মচর্য। তা সে ব্রহ্মচর্য তো বাপু দ্রৌপদীর ব্যাপারে, তার সঙ্গে আমার কী—কৃতবাংস্তত্র ধর্মার্থমত্র ধর্মো ন দুষ্যতি।

এই মনের গতি শুরু হল। মহাবীর অর্জুন দ্রৌপদীকে আপন ভুবলে জয় করেও সম্পূর্ণ পেলেন না, তারপর আবার ব্রাহ্মণের গরু-চুরির ঘটনায় দ্রৌপদী তাঁর কাছে আসবেন আরও বারো বছর পর; হয়তো বা তাও নয়, কারণ তখন তিনি হয়তো অন্য কোনও ভাইয়ের বাহুডোরে আবদ্ধ থাকবেন। স্বয়ম্বর-সভার বরমাল্য হাতেকরা নববধু দ্রৌপদী অর্জুনের চক্ষু এবং হৃদয় থেকে বছরের পর বছর পিছিয়ে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় বাঁধ ভাঙার বিষয় পেলে মনের বাঁধ এমনিই ভেঙে যায়। ধর্মের যুক্তি-তর্কও তখন নিজের মনের মতো করে জুটতে থাকে। উলূপী বললেন—দ্রৌপদীর জন্য নিয়ম। ব্রহ্মচর্যও দ্রৌপদীর ব্যাপারে, তার সঙ্গে আমার কী? ঠিক এই মুহূর্তে অর্জুনেরও কি মনে হয়নি—ঠিক তো, এই কথাটাই তো ঠিক—দ্রৌপদীর জন্য। নিয়ম দ্রৌপদীর জন্য, ব্রহ্মচর্য দ্রৌপদীর জন্য, কিন্তু দ্রৌপদীকে কবে পাওয়া যাবে? এক, দুই, তিন, চার নয়, বারো বছর; তারপরেও স্থিরতা নেই। অর্জুন অনার্য নাগকন্যা, উলূপীর বাহুবন্ধনে ধরা দিলেন। সম্পূর্ণ একরাত্রি ধরে যৌবন-বুভুক্ষু রমণীর প্রিয়তা সম্পাদন করলেন। অর্জুনের মন তির্যক্‌পথে চলতে আরম্ভ করল।

শাস্ত্রকার এবং পুরাণকারেরা একেক জায়গায় টিপ্পনী কেটে দেখিয়েছেন যে, বড় বড় মুনি-ঋষির মন বড় নিদ্বন্দ্ব হয়। বিষয় ভোগে ক্কচিৎ কদাচিৎ তাদের আসক্তি মনুষ্যলোকের মতোই বটে, কিন্তু তাঁদের মনটা টানা আটকা পড়ে থাকে না। মায়ার বাঁধনটাও বড় শিথিল। তাঁরা এ-সব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত সপ্রমাণ করার জন্য পরাশর-সত্যবতীর উদাহরণ দেন, সৌভরিমুনির উদাহরণ দেন। অর্জুন মুনি-ঋষি নন, কিন্তু অর্জুনকেও আমরা উলূপীর বাঁধনে আটকে থাকতে দেখলাম না। উলূপীর শরীর-সাধনের পরের দিনই নবীন সুযোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে অর্জুন আবার গঙ্গাদ্বারে এসে পৌঁছেছেন। উলূপী তাঁকে সেখানে ছেড়ে দিয়ে গেছেন।

এরপর কত তীর্থ, কত নদী, কত রমণীয় বনশোভা দেখতে দেখতে অর্জুন ভারতবর্ষের পূর্বদেশে এসে পৌঁছলেন। বিহার, বঙ্গদেশের সীমানা পেরিয়ে অর্জুন কলিঙ্গের পথ ধরলেন। কলিঙ্গ থেকে সাগরে। এবার তাঁর কী মনে হল, সাগরের তীর দিয়ে উদাস মনে হাঁটতে তাঁর বড় ভাল লাগল। তারপর সাগরের তীরবাহী পথই এক সময় তাঁকে নিয়ে গেল মণিপুরে। তবে এই মণিপুর বোধহয় আমাদের মণিপূর নয়। কারণ মহাভারতে অর্জুনের তীর্থযাত্রার ভৌগোলিক পথ অনুসরণ করলে দেখা যাবে এই মণিপুর দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের কোনও দেশ। টীকাকার নীলকণ্ঠের অনুমান অনুযায়ী জায়গাটা কেরালাতেও হতে পারে। যাই হোক মণিপুর মানেই তো চিত্রাঙ্গদা। মহাভারতের কবির অন্তরজন্ম যে কবি চিত্রাঙ্গদার গীতিনাট্য লিপিবদ্ধ করে আমাদের মুখরতা স্তব্ধ করে দিয়েছেন তাঁর প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা রেখেই বলি, মহাভারতের কবির ভাষ্যে এত জটিলতা, এত কবিকল্পনা নেই। সেখানে তিনি পুরুষের বিদ্যাও শিক্ষা করেননি, ধনুঃশর হাতে কঠিন পাষাণের ধাতুতেও তাঁর হৃদয় তৈরি হয়নি। অর্জুনের কাছে হৃদয় প্রাণ মন—কিছুই তিনি নিবেদন করেননি, অর্জুনও ব্রহ্মচর্যের গর্বে চিত্রাঙ্গদাকে ফিরিয়ে দেননি। ভালবাসার দেবতার বর এবং অভয়—দুই-ই কল্পনা।

তাই বলে মহাভারতের কবির কোনও সুরই কি রবীন্দ্রনাথের অন্তরে বাজেনি? যেটা বেজেছে—সেটা হল, চিত্রাঙ্গদার পিতৃকুলে চিরকালই একটা করে সন্তান জন্মেছে এবং সে সন্তান ছেলেই হয়েছে। শুধু এই এখনকার মণিপুরের রাজা চিত্ৰবাহনের ছেলে নেই, তাঁর একমাত্র মেয়ে—চিত্রাঙ্গদা। হ্যাঁ রাজা তাঁকে একটু প্রশ্রয় দিয়েছেন বেশি, চিত্রাঙ্গদা স্বেচ্ছায় মণিপুরনগরের যেখানে সেখানে বেড়াতে বেরোন। হয়তো এই প্রশ্রয় এবং এক সন্তানের ব্যাপার থেকেই কবিগুরুর কল্পনা প্রসারিত হয়েছে। কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথের যখন ‘চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী’ বলে বিলম্বিতে সুর টানবেন, তখনই আপনাকে মহাভারতের প্রায় অবিকল শব্দগুলি স্মরণ করতে হবে—চিত্রাঙ্গদা চৈব নরেন্দ্রকন্যা। স্মরণ করতে হবে চিত্রাঙ্গদার গায়ের রঙ মহুয়া ফুলের মতো এবং তাঁর কটাক্ষে পঞ্চম-শর এতটাই ছিল যে অর্জুন মণিপুর নগরের রাজপথে তাঁকে দেখামাত্র তাঁর সঙ্গকামনা করেছেন—দৃষ্টৈব’তাং বরারোহাং চকমে চৈত্ৰবাহনীম্‌। বিশেষত উলূপীকে সঙ্গ দেবার পর অর্জুন কোন মুখে বলবেন—বরণযোগ্য নহি বরাঙ্গনে—ব্রহ্মচারী ব্রতধারী।’

যাক, আমি আর তুলনামূলক বিচারের ধারায় নিজেকে জড়াতে চাই না। তবে যাঁরা মহাভারতে অর্জুনের এই সকাম ব্যবহার দেখে তাঁকে ‘ফাইলান্ড্যারার’ ‘টম বয়’ গোছের ভেবে নেন তাঁদের উদ্দেশে আমার বক্তব্য আছে। বক্তব্য আছে তাঁদের উদ্দেশেও যাঁরা চিত্রাঙ্গদার রসে সরস অর্জুনকে চরিত্রগতভাবে দুর্বল বলে মনে করেন। শ্রীযুক্ত সুখময় ভট্টাচার্য মহাশয় লিখেছেন—‘উলূপীর প্রার্থনা পূর্ণ করায় ধৰ্মত অর্জুনের ব্রহ্মচর্য স্খলিত হয় নাই, কিন্তু চিত্রাঙ্গদা ও সুভদ্রাকে তিনি কামার্ত হইয়াই বিবাহ করিয়াছেন। শাস্ত্রানুসারে ইহাতে অর্জুনের ব্রতভঙ্গ হইয়াছে। অরণ্যবাস তো হয়ই নাই, পরন্তু তিনি উভয় শ্বশুরবাড়িতে চারি বৎসরের অধিককাল পরম সুখে বাস করিয়াছেন। ইহাতেও তাঁহার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হইয়াছে বলিয়া মনে করি। এই সকল ঘটনাকে তাঁহার চরিত্রের দুর্বলতা ছাড়া কী বলিব?’

ভট্টাচার্য মহাশয় আমার নমস্য ব্যক্তি। আমার বক্তব্যের সঙ্গে এই মুহূর্তে তাঁর বক্তব্য না মিললেও তিনি আমার শ্রদ্ধাস্পদ। তবে কিনা শাস্ত্র আর নীতির যুক্তিতেই কি সব সময় একজন পুরুষকে বিচার করা যায়, না কি করাটা উচিত হবে? তাও আবার অর্জুনের মতো পুরুষকে? ভট্টাচার্য মহাশয় উলূপীর প্রার্থনা সঙ্গত মনে করেছেন, কারণ উলূপী কামার্ত ছিলেন। কামার্তা নারীর ‘প্রার্থনা পূরণ করায় ধৰ্মত অর্জুনের ব্রহ্মচর্য স্খলিত হয় নাই।’ কিন্তু হায়! অর্জুনের কি কোনও কামনা-বাসনা থাকতে নেই? যৌবনের চরম সম্ভাবনার মুহূর্তগুলিতে তাঁকে ব্রহ্মচর্য নিয়ে থাকতে হবে? শাস্ত্রের বিচারে বহিরঙ্গ শারীরিক সুখের কথা, না হয় ছেড়েই দিলাম। মানসিকভাবে দ্রৌপদীকে না পাওয়ার আকুলতা তাঁকে অন্তরে অন্তরে শূন্য করে রেখেছিল। এই শূন্যতার কথঞ্চিৎ লাঘবের জন্য মানুষের, এমনকী অর্জুনের মতো মানুষেরও বহিরঙ্গে এক ধরনের ছায়াপাত ঘটে। সেই প্রতিক্রিয়াতেই চিত্রাঙ্গদাকে দেখা মাত্র অর্জুনের ভাল লেগেছে এবং সেই প্রতিক্রিয়ার খানিকটা শান্তি হয়েছে সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ে হবার পর। এগুলি তাঁর চরিত্রের দুর্বলতা বলব, না কি তাঁর গুঢ় অন্তদাহ নির্বাপণের বিকল্প বলব—তা শাস্ত্রনিয়মের বাইরে গিয়ে সাহিত্যের বেদনাবোধ থেকে বুঝতে হবে বলে আমরা মনে করি।

অর্জুন চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করে তিন বছর সেখানে কাটিয়ে দিলেন। রাজবাড়ির আদর আপ্যায়নে অর্জুনের বনবাস-ব্রহ্মচর্য মাথায় উঠেছিল। হঠাৎই যেন খেয়াল পড়ল, আর তখনই নিগঢ় অন্তর্ভূষণের চেতনায় দ্বিগুণিতভাবে তীর্থযাত্রায় মন দিলেন। কিন্তু সে কতদিন? হয়তো বেশ কিছুদিন। কিন্তু তারপরেই আবার সেই বিষাদ এসে গ্রাস করে অর্জুনের মন। চিত্রাঙ্গদাই যে তাঁর ক্ষত-হৃদয়ের প্রলেপ—তাই তাঁকে আরও একবার দেখবার জন্য আবারও মণিপুরে ফিরে এলেন অর্জুন! এসে এই প্রথম পুত্ৰমুখ দেখলেন। এরপর আর তো থাকা যায় না। চিত্রাঙ্গদাকে বললেন—তুমি এখানেই থাকো এবং ছেলেকে মানুষ করো!’ যুধিষ্ঠির মহারাজের রাজসূয় যজ্ঞের সময় আবার দেখা হবে। চিত্রাঙ্গদাকে ছেড়ে আসতে অর্জুনের যত না কষ্ট হয়েছে, বোধ করি তার চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট পেয়েছেন বিরহকাতর চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন আবারও বেরিয়ে পড়লেন পশ্চিম সমুদ্রতীরে। কত তীর্থ, কত মন্দির দেখে উপস্থিত হলেন প্রভাসে।

প্রভাস জায়গাটা ভারী সুন্দর এবং সেটা পুরুষোত্তম কৃষ্ণের দ্বারকাবাস থেকে সাংঘাতিক কিছু দূরে নয়। অতএব অর্জুন প্রভাসে যেতেই কৃষ্ণের কাছে খবর চলে গেল। তিনি সোজা এসে উপস্থিত হলেন প্রভাসে এবং জড়িয়ে ধরলেন বন্ধুকে। কাছেই রৈবতক পাহাড়, যেখানে কৃষ্ণ জরাসন্ধের ভয়ে একবার আস্তানা গেড়েছিলেন। বাড়িঘর সেখানে ছিলই। বন্ধুর আগমনে সে ঘর-দোর ধুয়ে মুছে আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছে। কৃষ্ণ জিজ্ঞাসা করলেন—কী জন্য এই বনে বনে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াচ্ছ? অর্জুন সব বললেন—দ্রৌপদীর কথা, যুধিষ্ঠিরের কথা, এমনকী উলূপী এবং চিত্রাঙ্গদার কথাও—সর্বমাখ্যাতবাংস্তদা। সমপ্রাণ সখা কৃষ্ণ সব বুঝলেন; ব্রতভঙ্গ কিংবা ব্রহ্মচর্য-চ্যুতির দোষ তিনি তো দেনইনি, বরঞ্চ বন্ধুর মনের দিকে তাকিয়ে কৃষ্ণ নিজেই অর্জুনের সঙ্গে প্রভাসতীর্থের এখানে ওখানে অনেক ঘুরে বেড়ালেন। তারপর রৈবতক পাহাড়ের ‘গেষ্ট্‌ হাউসে’—যেখানে কৃষ্ণের লোকেরা ঘর সাজিয়ে, খাবার সাজিয়ে বসেছিল—সেইখানে অর্জুনকে নিয়ে এলেন কৃষ্ণ। শাস্ত্রানুসারে অর্জুনের ব্রহ্মচর্য এবং বনবাস যদি অত্যন্ত যুক্তিযুক্তই হত, তা হলে কি সমস্ত ধর্মের কতা, বক্তা এবং অভিরক্ষিতা হওয়া সত্ত্বেও কৃষ্ণ তাঁর বন্ধুর জন্য পান-ভোজন আর আরামের এত ঢালাও ব্যবস্থা করতেন? অর্জুনের উদ্‌ভ্রান্ত মনটা অন্যদিকে ব্যস্ত রাখার জন্য কৃষ্ণ বাসুদেব তাঁর সঙ্গে বসে কত রাত পর্যন্ত নাচ দেখে আর গান শুনে কাল কাটালেন—সহৈব বাসুদেবেন দৃষ্টবান্ নটনর্তকান্‌। তারপর একই সঙ্গে দুজনে শুয়েছেন, গল্প করেছেন। পরের দিন থেকে অর্জুন আর নিজেকে নিজের বশে রাখতে পারেননি। কৃষ্ণ আর তাঁকে ছাড়েননি। পরের দিন সোনার রথে চড়িয়ে অর্জুনকে নিয়ে গেছেন দ্বারকায়। সেখানে রাজকীয় অভ্যর্থনা তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল। বহু অভিবাদন, আলিঙ্গন আর অবলোকনের পর কৃষ্ণ তাঁর সমবয়সী পিসতুতো ভাই বন্ধুকে একেবারে নিজের বাড়িতে এনে তুলেছেন। নির্জন গল্পকথা আর মনের কথায় কত রাত সেখানে কৃষ্ণের সঙ্গে কেটে গেল—উবাস সহ কৃষ্ণেন বহুলাস্তত্র শর্বরীঃ। কৃষ্ণের উপরাধে অর্জুনের বনবাস আপাতত মাথায় উঠল। তিনি কী করবেন? কৃষ্ণকে অতিক্রম করা কারও পক্ষে সম্ভব? তাঁর মনের রিক্ত অবস্থা এবং কৃষ্ণের বন্ধুত্ব—দুটোই এমন পরস্পর প্রতিপূরক হয়ে উঠল যে, অর্জুন কৃষ্ণের ইচ্ছার ওপর নিজেকে ছেড়ে দিলেন।

সেকালের দিন আন্দাজে কৃষ্ণের নিজের জাতি যাদবরা কিন্তু ভীষণ আধুনিক ছিল। যে কোনও একটা উপলক্ষে উল্লাস আর আমোদ করাটা তাঁদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল। অর্জুনের মতো ব্যক্তিকে সামনে রেখে যাদব রাজপুরুষেরা অতি শীঘ্রই একটি ‘পিকনিক’—এর ব্যবস্থা করে ফেললেন। স্থান রৈবতক পাহাড়। নির্দিষ্ট দিনে যাদবের মেয়ে-পুরুষেরা সবাই বাদ্য-বাদক, নাচিয়ে-গাইয়ে সঙ্গে নিয়ে রৈবতকে উপস্থিত হলেন। হলধর বলরাম, কৃষ্ণ, তাঁদের ভাই-বন্ধু, জ্ঞাতি-গুষ্টি, এমনকী বৃদ্ধ রাজা উগ্রসেন পর্যন্ত আজ স্ফূর্তির মেজাজে রয়েছেন। বলরামের দিকটায় একটু মধুমদ্যের ব্যবস্থা আছে, কৃষ্ণের দুই ছেলে প্রদ্যুম্ন আর শাম্ব সময় বুঝে ওদিকটায় ভিড়ে গেছেন। অর্জুন কৃষ্ণের সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, নানা মজাও দেখছিলেন। ঠিক এমনই সময় বন্ধুদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা সুন্দরী সুভদ্রাকে দেখতে পেলেন অর্জুন। তাঁর সাজগোজ, কথাবার্তা এবং রূপের মধ্যে এমন এক আভিজাত্য ছিল যে, অর্জুন তাঁর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। মনের মধ্যে জেগে উঠল তৃষ্ণা, অধিকারের অহঙ্কার আর শরীরের মধ্যে প্রথম কদম ফুলের রোঁয়া।

কৃষ্ণ বহুক্ষণ বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। দেখলেন—তাঁর চোখ সরছে না কোনও দিকে। সম্মতি আর রহস্যের অদ্ভুত এক ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে কৃষ্ণ সহাস্যে অর্জুনকে বললেন—বনবাসী পুরুষের মনটা বড় রসিয়ে উঠেছে মনে হচ্ছে। এ আমারই বোন, পিতা বসুদেবের বড় আদরের মেয়ে—সুভদ্রা! তোমার মন হয় তো বলো—বাবার সঙ্গে আলাপ করতে পারি এ বিষয়ে। অর্জুন বললেন—যে রমণী কৃষ্ণের বোন, বসুদেবের মেয়ে, আর এমন অসাধারণ যাঁর রূপ, সে কাকে মোহিত করবে না বলো—কম্‌ ইবৈষা ন মোহয়েৎ? সত্যি কথা বলতে কি, তোমার এই বোনটি যদি আমার হত—যদি স্যান্ মম বার্ষ্ণেয়ী!

পাঠক-পণ্ডিতজনের কাছে আমার অনুরোধ—তাঁরা যেন অর্জুনের হতাশ বাক্যটুকু খেয়াল করেন—যদি আমার হত—যদি স্যান্ মম—সম্পূর্ণ আমার। বিবাহলগ্নে যিনি স্বামী হন—দোহাই আপনাদের, নারী-স্বাধীনতার প্রবক্তারা আমায় রক্ষা করুন-সেই স্বামীর মধ্যে আপন স্ত্রীর বিষয়ে অহঙ্কার অধিকারিত্বের বোধ থাকেই। বোধ থাকে—এই রমণী একমাত্র আমার। অথচ দ্রৌপদীকে বিয়ে করার পর পাঁচ ভাইয়ের মিশালে অর্জুনের সেই অধিকারবোধ এবং স্বামিজনোচিত অহঙ্কার একটুও তৃপ্ত হয়নি, যা একজন সাধারণ স্বামীরও হয়ে থাকে। উলূপীর সঙ্গে একরাত্রির গভীর পরিচয়ে সাধ্যসাধন যত বড় হয়ে উঠেছে, মোহ ততটা নয়। চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে পরিণয়ে স্বামীর অহঙ্কার তৃপ্ত হতে পারত। কিন্তু চিত্রাঙ্গদার পিতা মেয়ের অধিকার ছাড়েননি। তাঁর পুত্র ছিল না, অতএব তাঁর শর্ত ছিল মেয়ের যে ছেলে হবে, সেই পুত্রিকা-পুত্রই তাঁর রাজ্যে রাজা হবেন। এই অর্ধেক অধিকারের মধ্যে স্বামীর অহঙ্কার তৃপ্ত হয় না। কিন্তু এইবার এবং এই প্রথম কৃষ্ণের বোনটিকে দেখে, তাঁর রূপ, গুণ এবং স্নিগ্ধতা দেখে অর্জুনের মনে হল—এই সেই রমণী যাঁর অধিকার পেলে নিজেকে সার্থক মনে করবেন অর্জুন।

সুভদ্রার ক্ষেত্রে অর্জুন কোনও হঠকারিতা করেননি। কৃষ্ণ যদিও বলেছিলেন—বলো তো পিতা বসুদেবকে বলি, কিন্তু অর্জুন সে পথে যাননি, কেন না সম্পর্কে বসুদেব তাঁর আপন মামা—যদি কোনও বাধা আসে। অর্জুন কৃষ্ণকে একান্তে বললেন—কী করা যায় বলো তো ভাই, একটা উপায় বলো—সে উপায় যদি মানুষের সাধ্যির মধ্যে হয়, তা হলে এ ব্যাপারে আমি তার শেষ পর্যায়ে যেতে রাজি আছি। কৃষ্ণ অর্জুনের একাগ্রতা বুঝে বললেন—দেখো ভাই! এক হতে পারে—আমরা স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করতে পারি, আর তুমি ক্ষত্রিয় রাজকুমার হিসেবে সেখানে থাকতেই পারো।

কৃষ্ণ স্বয়ম্বরের কথা বললেন বটে, তবে এই বিকল্পে তিনি নিজেই খুশি হলেন না, কারণ স্বয়ম্বর-সভায় নির্দিষ্টা রমণী যে নির্দিষ্ট পুরুষটিকেই বিবাহ করবেন, তা তো নয়। নিজের বোন হলেও মেয়েদের স্বভাবের ব্যাপারেও কৃষ্ণের সংশয় আছে। কারণ, বর পছন্দ করার সময় পুরুষমানুষের বীরত্ব-পাণ্ডিত্য—ইত্যাদি বড় বড় গুণই যে স্ত্রীলোকের ব্যক্তি-চিত্তে বড় হয়ে দেখা দেবে—তার কোনও মানে নেই। একেবারেই অপরীক্ষিত অথচ আপাতরমণীয় পুরুষেও স্ত্রীলোকের স্পৃহা বা কামনা অকল্পনীয় নয়। কৃষ্ণ তাই বললেন—স্বয়ম্বরে এসে তুমি আমার বোনের বরমাল্য আদায় করে নিয়ে যাবে—সেটা বড়ই অনিশ্চিত—স চ সংশয়িতঃ পার্থ স্বভাবস্যানিমিত্ততঃ। তার চেয়ে আমি বলি কি—আমরা একটা স্বয়ম্বর-সভার আয়োজন করতেই পারি, কিন্তু তুমি সেখানে এসে জোর করে রথে তুলে নিয়ে যাও সুভদ্রাকে—ক্ষত্রিয়-পুরুষেরা তো এমন বিয়ে করেই থাকে।

মনের যে অবস্থায় অর্জুন সুভদ্রাকে নিজের মতো করে পেতে চেয়েছেন, কৃষ্ণ সেটা বন্ধুজনোচিত বেদনাবোধে অনুভব করেছিলেন। সেই কারণে নিজের বোন হলেও তিনি কোনও ‘চান্স’ নিতে চাননি। আবার অর্জুনের দিক থেকেও সুভদ্রার ব্যাপারটা এত বেশি সংবেদনশীল এবং গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, এটি তাঁর কাছে শুধু বিবাহমাত্র ছিল না। অন্তত এই রমণীটির ক্ষেত্রে তাঁর অনুরাগ এবং মর্যাদাবোধ এতটাই ছিল যে, সুভদ্রা-হরণের বহু আগেই অর্জুন তাঁর করণীয় কার্য প্রস্তাবের আকারে ইন্দ্রপ্রস্থে পাঠিয়েছিলেন রাজা যুধিষ্ঠিরের অনুমোদনের জন্য। যুধিষ্ঠির সঙ্গে সঙ্গেই অনুমোদন করেছেন এবং অর্জুন কাজে নেমেছেন। সুভদ্রার সঙ্গে অর্জুনের বিয়ের যে রাজনৈতিক তাৎপর্য—ত আমি অন্যত্র ‘মহাভারতের ভারতযুদ্ধ এবং কৃষ্ণ’ প্রবন্ধে দেখিয়েছি। কিন্তু সুভদ্রার ক্ষেত্রে অর্জুন যে শুধুই ব্যক্তিগতভাবে নয়, নিজের পরিবারকেও জড়িয়ে নিতে চেয়েছেন তার পেছনে কারণ হল সেই বিশিষ্ট, ব্যক্তিগত মর্যাদাবোধ—যা এই মুহূর্তে দ্রৌপদীকেও অতিক্রম করেছে। দ্রৌপদীরও মন ভাঙতে আরম্ভ করেছে, কপাল পুড়তে শুরু করেছে এই মুহূর্ত থেকেই। সে কথায় পরে আসছি।

দুটি প্রাণী দুটি পৃথক কারণে রৈবতক পাহাড়ে গেছেন। একজন ধনুক-বাণ, ঢাল-তলোয়ার রথে চাপিয়ে রৈবতক পাহাড়ে মৃগয়া করতে গেছেন। তিনি জানেন—তিনি কী করবেন। কোন মৃগীকে তিনি পঞ্চশরের একটি শরে সম্মোহিত করে দেবেন—তিনি জানেন। তিনি অর্জুন। আরেকজন রৈবতক পাহাড়ে দেবতার উদ্দেশে পুজো দিতে গেছেন। তিনি তখনও জানেন না—তাঁর কী হবে। যে দেবতাকে তিনি এইমাত্র পুজো করলেন—সে দেবতা আড়াল থেকে তাঁকে মধু-মৃগয়ার শিকার হবার আশীবাদ দিলেন কি না—তা এই নিঃসন্দিগ্ধা রমণী জানেন না। তিনি সুভদ্রা। পুজো সেরে, ব্রাহ্মণদের দান দিয়ে, দেবশৈল রৈবতক পাহাড় পরিক্রমা করে সুভদ্রা ঘরে ফিরবেন, ঠিক এমন সময় অর্জুন সবেগে রথ চালিয়ে এসে নিঃসন্দিগ্ধা রমণীকে চেপে ধরলেন পেছন থেকে। জোর করে সপৌরুষ আলিঙ্গনে সুভদ্রাকে অর্জুন নিজের রথে তুলে নিলেন। অর্জুনের তখন কী অবস্থা। দ্রুপদের স্বয়ম্বর-সভায় দ্রৌপদীর বরমাল্য লাভ করে অর্জুনের মনে যতখানি বীরোচিত সন্তুষ্টি এসেছিল, রমণীর সরস অধিকার ততটা নয়। আজ শার্দুলবিক্ৰীড়িত ছন্দে বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে যে রমণীকে তিনি সালিঙ্গনে অধিকার করে নিলেন, তাঁর থরথর কুমারীস্পর্শে অর্জুনের প্রতি অঙ্গে সাড়া পড়ে গেল—সুভদ্রাং চারুসাঙ্গীং কামবাণ-প্রপীড়িতঃ। অর্জুনের কাঞ্চনরথ ছুটে চলল ইন্দ্রপ্রস্থের দিকে।

যাদবদের মেয়ে ডাকাতি হয়ে গেল, বিশাল শোরগোল উঠল দ্বারকায়। এই রথ আন্‌, এই তলোয়ার, এই খড়্গ—এই বেটার পেছনে ধাওয়া কর—এই সমস্ত উক্তি-প্রত্যুক্তিতে বিপর্যস্ত দ্বারকাবাসীরা যে যে অবস্থায় ছিল, সেই অবস্থাতেই প্রস্তুত হল। ঠিক এমন একটা মুহূর্তে কৃষ্ণের বড়ভাই বলরাম আরেক পাত্র মদ চড়িয়ে নিয়ে বললেন—মহামতি কৃষ্ণের মুখ দিয়ে যে একটি কথাও বেরুচ্ছে না। সে-কথা বলুক, তার মনের ভেতর কী আছে একটু শুনি। এই কৃষ্ণই তো এই বেটাকে আদর-আপ্যায়ন আর আরতি করে নিজের ঘরে এনে তুলেছে। বলি ওই কুলাঙ্গার কি এত আদরের যোগ্য? বেটা—আমারই বাড়িতে বসে যে থালাটায় খেলি, সেই থালাটাও ভেঙে দিয়ে গেলি—কো হি তত্রৈব ভুক্‌ত্বান্নং ভাজনং ভেতুমর্হতি। আজ আমি ওকে ছাড়ছি না, সে সুভদ্রাকে নিয়ে গেল, না নিজের মৃত্যুকে রথে চাপিয়ে নিয়ে গেল—একবার দেখছি আমি।

এক নিঃশ্বাসে বলরামের কথার ঝড় বয়ে গেলে কৃষ্ণ মুখ খুললেন। বললেন—সুভদ্রাকে জোর কারে তুলে নিয়ে অর্জুন কী এমন অন্যায় করেছে? সমগ্র যাদবকুলই বা এটাকে অপমান হিসেবে নিচ্ছে কেন? এমন তো নয় যে, অর্জুন আমাদের অর্থলোলুপ ভেবেছে—আমরা কি টাকা পয়সার পণ নিয়ে তাকে মেয়ে দিতাম? যদি বলেন—বেশ তো, সুভদ্রার স্বয়ম্বর-সভার আয়োজন হত, অর্জুনও সেখানে আসত। কিন্তু সে ব্যাপারটা সে নিশ্চিত মনে করেনি, কারণ সেখানে সুভদ্রা অন্য কাউকে পতি নিবাচন করলে, অর্জুন সেটা সহ্য করতে পারত না। আর যদি বলেন—বেশ তো, সুভদ্রাকে যদি অর্জুনের এতই পছন্দ, তো আমরা বামুনদের মতো তার বাড়ির গুরুজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে, মেয়ে দেখিয়ে, অর্জুনের সঙ্গে বিয়ে দিতাম—তা হলে বলব—এই দেখাদেখি, বোঝাবুঝি—এত সব ব্রাহ্মবিবাহের ঢঙগুলো অর্জুনের মতো বীরপুরুষেরা ছাগলের মতো মনে করে—প্রদানমপি কন্যায়াঃ পশুবৎ কো’নুমন্যতে।

সবার শেষে কৃষ্ণ সিদ্ধান্ত করলেন—তা ছাড়া এতে হয়েছেটা কী? সুভদ্রা সুন্দরী—সে-কথা সবাই এখন জেনে গেছে, আর সেই সৌন্দর্যের কারণেই সে হৃত হয়েছে। তা ছাড়া ভরত-শান্তনুর বংশে কুন্তীর গর্ভে যে জন্মেছে—সেই অর্জুনও তে এমন কিছু ফেলনা নয়। স্বর্গে-মর্তে তার সমান বীর আমি দেখিনি। এখন যদি দ্বারকাবাসীরা সবাই মিলে বীরদর্পে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে, আর তারপর যদি পরাজিত হয়, তা হলে আমাদের মান-মর্যাদা কিছুই থাকবে না। তা এসব ঝামেলার চেয়ে আমি বলি কি তাকে ফিরিয়ে আনুন। তাতে লজ্জার কিছু নেই। সে আমাদের পিসতুতো ভাই, আমাদের সঙ্গে সেও কোনও শত্রুতা পুষে রাখবে না।

কৃষ্ণের কথা সবাই শুনলেন। অর্জুনকে ফিরিয়ে আনা হল সেই মতো। শুভলগ্নে অর্জুন-সুভদ্রার বিয়ে হয়ে গেল! বিয়ের পর অর্জুন বছর খানেকের বেশি-কিছু দিন থেকে গেলেন দ্বারকায়। বেশ ভালই কাটল। বারো বছর বনবাসের আর যেটুকু বাকি রইল সেটুকু নির্ঝঞ্ঝাটে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য অর্জুন পুষ্কর তীর্থে চলে গেলেন। তীর্থ-ভ্রমণ দিয়ে বনবাস শুরু হয়েছিল। তীর্থেই সে বনবাসের সমাপ্তি। এরই মধ্যে উলূপী, চিত্রাঙ্গদা আর সুভদ্রার প্রণয়-পরিণয়ে ব্রহ্মচর্য এবং বনবাসের ত্রুটি কতটা হল জানি না, কিন্তু মহাভারতের কবিও হয়তো অৰ্জুনের অশান্ত মনের দিকে তাকিয়ে তাঁর ত্রুটি মার্জনা করে দিয়ে মন্তব্য করেছেন—অর্জুন নিজের দেশে ফিরলেন বনবাসের নিয়মে সংযত থেকেই—নিয়মেন সমাহিতঃ—নীলকণ্ঠ লিখেছেন—বনবাসব্রতাচারেণ সমাহিতঃ সংযতচিত্তঃ। এখানে অবশ্য অর্জুনের ব্রহ্মচর্য অথবা বনবাস কতটা রক্ষিত হল—তা নিয়ে অন্তত আমি অত চিন্তিত ই। আমার চিন্তা—অর্জুন বারো বছর পরে ঘরে ফিরলেন এবং ফিরলেন যাদব-সাত্ত্বত-কুলের অনিন্দ্যসুন্দরী সুভদ্রাকে নিয়ে।