ভীম – ১১

১১

কৃষ্ণের যেমন সুদর্শন চক্র, অর্জুনের যেমন গাণ্ডীব, শিবের যেমন ত্রিশূল, তেমনই ভীমের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল একখানি গদা। শত্রু যাকে বলে, অর্থাৎ ভীম যাঁদের চিরদিন জন্মশত্রু বলে ভেবেছেন, তাঁদের ওপর এই গদার ব্যবহার এখনও তেমন করে হয়নি। এমনকী এই যে দুঃশাসন মারা গেলেন, তাঁর সঙ্গেও গদা-যুদ্ধ যাকে বলে, তা কিছুই হয়নি। ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কর্ণের সেনাপতিত্বকালে ধৃতরাষ্ট্রের শত পুত্রের অধিকাংশই ভীমের হাতে মারা পড়েছেন এবং তার মধ্যে দুঃশাসন প্রধান। শল্য যখন সেনাপতি, তখন বাকি আর পুত্রগুলিও মৃত্যু-বরণ করলেন, কিন্তু তার মধ্যে ভীমের গদার মাহাত্ম্য কিছু ছিল না। দুঃশাসন মারা যাবার পর তাঁর দিকে আঙুল তুলে, ভীম কৃষ্ণ এবং অর্জুনকে বলেছিলেন—আমার এই যুদ্ধ-যজ্ঞের শেষ পশু হল দুর্যোধন, আমার রণদেবতার কাছে তাকে বলি দিয়ে তবেই আমার শান্তি—শান্তিং লন্স্যে কৌরবাণাং সমক্ষম্‌।

সকলেই জানেন—দুর্যোধন গদা-যুদ্ধের আরও এক কারিগর। দুর্যোধনের সঙ্গে ভীমের যে শেষ গদা-যুদ্ধটি হবে, মহাভারতের কবি তার প্রস্তুতি নিয়েছেন শল্যের সেনাপতিত্বের সময় থেকে। মনে রাখা দরকার—ভীম যেমন মল্লবীর, শল্যও তেমনই প্রধানত এক মল্লবীর। ভীম যেমন গদা-যুদ্ধে নিপুণ, শল্যও তেমনই গদা-যুদ্ধে বড়ই নিপুণ। দুর্যোধনের সঙ্গে শেষ-যুদ্ধ হবার আগে মহাভারতের কবি তাই শল্যের সঙ্গে ভীমের একটি গদাযুদ্ধের ব্যবস্থা করেছেন। তুমুল এই গদা-যুদ্ধ অনেকটা শেষ যুদ্ধে যাবার মক-প্র্যাকটিস বলা যেতে পারে। ভীমের গদার চরম মাহাত্ম্য বর্ণনার জন্য কবিকে এখন থেকে বেশি শ্লোক খরচা করতে হচ্ছে এবং সেটাও সেই শেষ যুদ্ধের প্রস্তুতিই বলব।

শল্য যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে যুদ্ধ করছিলেন এবং বাণে বাণে তাঁকে কিছুটা কাবুও করে ফেলেছিলেন-শিতৈ-র্বাণৈ যুধিষ্ঠিরমপীড়য়ৎ। ভীম দাদার এই কাহিল অবস্থা দেখে খানিকক্ষণ ঠোঁট কামড়ালেন রাগে। তারপর ভাবলেন—এঁকে একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। ভাবটা এই যে,—আমার ধর্মপুত্তুর দাদাকে পেয়ে খুব খেলা দেখাচ্ছ, না? দেখছি তোমাকে এবার। রাগ উঠলে ভীমের যা হয়। ভাবলেন—মেরেই ফেলব এটাকে। যোদ্ধারা যখন ভাবেন, তখন চরমটাই ভাবেন। তো, ভীম শল্যকে একেবারে শেষ করে দেবার জন্য তাঁর সেই ভীম-গদাখানি বাগিয়ে ধরলেন হাতে।

বাস্‌! মহাভারতের কবি ভীমকে ছেড়ে এবার তাঁর গদার বর্ণনা আরম্ভ করলেন। বললেন—গদাটা ছিল যমদণ্ডের মতো। প্রহারোদ্যত সেই গদাটি দেখলে মনে হবে যেন কালরাত্রি ঘনিয়ে এসেছে জীবনে। ভীমের কাছে অতি পছন্দের এই গদাটি রাখবার যত্নও কিছু কম নয়। যন্ত্রশিল্পীরা যেমন তাঁদের বাজনার যন্ত্রটি সযত্নে বাক্সের মধ্যে রাখেন, ওস্তাদজিরা যেমন সেতার-সরোদ টাকা দিয়ে রাখেন দামি কাপড় দিয়ে, ভীমের গদার যত্নও সেইরকম। আগেকার দিনে দই-রসগোল্লার হাঁড়ি রাখবার জন্য যেমন বিড়ে বানানো হত, ভীমের গদাটিও তেমনই মোটা-মোটা দড়ি দিয়ে তৈরি করা সাপের কুণ্ডলীর মতো রঞ্জুর আধারে রাখা থাকত, যাতে উঁচু-হওয়া গদা-মুখের কঠিন অংশগুলি ঘষটে না যায়। আগেকার দিনের বেনারসী কাপড়ে যেমন সোনা থাকত, তেমনই এক সোনার কাপড়ে জড়ানো ভীমের গদা।

গদা ‘বজ্রকল্পা লৌহময়ী’ বটে, তবে তার আদর প্রিয়া রমণীর মতো। চন্দন আর অগুরু মাখিয়ে গদাটির মধ্যে এমন সৌগন্ধ্য ঘনিয়ে নেওয়া হয়েছে যে, সে গদা হাতে নিলেই ভীম যেন রমণীর স্পর্শসুখ লাভ করেন—প্রমদাম্‌ ঈপ্সিতামিব। বড় পছন্দের অস্ত্র বলেই এই রমণীয় স্পর্শসুখ, নইলে সেই গদার মধ্যে কোমলতার স্থান নেই কোনও। গদার উচ্চতর লৌহ-কোণ-গুলিতে এখানে ওখানে লেগে আছে শত্রুদেহের মজ্জা-মেদ-রক্ত, গজমস্তক বিদারণের চিহ্ন। যমের জিহ্বার মতো সেই গদাটি হাতে নিয়ে ভীম যখন ঝাঁকুনি দেন, অমনই গদার পরিমণ্ডলের আট কোণে লাগানো ঘণ্টাগুলি বেজে ওঠে—বসামেদো’স্রদিগ্ধাঙ্গীং জিহ্বাং বৈবস্বতীমিব/পটুঘণ্টারববতীম্‌। ভীমের এই গদাখানি যুদ্ধে বহুবার পরীক্ষিতই শুধু নয়, তাঁর বহুকালের সঙ্গীও বটে। দ্রৌপদীর জন্য সৌগন্ধিক পদ্ম আনতে গিয়ে এই গদার ভরসাতেই তিনি যুদ্ধে আহ্বান করেছিলেন শিব-সখা কুবেরকে। এই গদা দিয়েই নিধন করেছিলেন কত শত যক্ষকে! সেই গদা, মদ্ররাজ শল্যকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য সেই বজ্ৰমণিখচিত গদাখানি ভীম তুলে নিলেন হাতে।

যুদ্ধ আরম্ভ হল। সমানে সমানে যুদ্ধ। কারণ মদ্ররাজ শল্য এবং কৃষ্ণাগ্রজ বলরাম ছাড়া ভীমের গদা-ভার সহ্য করেন এমন মানুষ প্রায় নেই—ন হি মদ্রাঘিপাৎ শল্যান্যো বা যদুনন্দনাৎ। আবার ভীম ছাড়া শুল্যের গদা-প্রহার সহ্য করেন এমন লোকও নেই—নান্যো যোধো বৃকোদরাৎ। ভীম আর শল্যের গদার হানাহানিতে চারিদিকে শুধু আগুনের স্ফুলিঙ্গ দেখা গেল। মানুষের চোখের বিষয় হল শুধু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর শ্রবণের বিষয় হল শুধু গদা-ঠোকাঠুকির বজ্ৰশব্দ। একটা সময় এল, যখন দু’জনেই আঘাত পেলেন বুকে এবং দুজনেই পড়ে গেলেন মাটিতে—যুগপৎ পেততু-র্বীরৌ উভাবিন্দ্রজাবিব। কিন্তু এই সুযোগে কৃপাচার্য এসে শল্যকে নিজের রথে চাপিয়ে নিয়ে পালিয়ে গেলেন। ভীম দ্বিগুণ বেগে গদা হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন এবং দেখলেন—শল্য নেই। অনেক ডাকাডাকি করলেন শল্যকে, কিন্তু কোথায় তিনি?

এই যে এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয়ে গেল, এই যুদ্ধ ভীমের শেষ গদাযুদ্ধের মহড়ামাত্র। মহাভারতের কবি শল্যকে রণক্ষেত্র থেকে সরানোর সঙ্গে সঙ্গে ভীমের অতৃপ্ত যুদ্ধ-বাসনাটুকু জিইয়ে রাখলেন। শল্যের মৃত্যুর পর পরই ধৃতরাষ্ট্রের অবশিষ্ট পুত্রেরা ভীমের সাহায্যে যমরাজের দর্শন পেলেন। বাকি রইলেন শুধু দুর্যোধন। এদিকে কৌরব-পক্ষের নিবাচিত সেনাপতি শল্য পূর্বাহ্নেই নিহত হয়েছেন যুধিষ্ঠিরের হাতে! দুরাত্মা শকুনি তাঁর পুত্র উলুক দু’জনেই মারা গেছেন সহদেবের হাতে। কৌরব-সৈন্যেরা অধিকাংশই মৃত। বাকি একা দুর্যোধন পালাবার পথ খুঁজছেন।

যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা ছিল খুব খারাপ। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কৌরব-সৈন্য প্রায় নিঃশেষিত। পাণ্ডবদের অবস্থা তত ভাল না হলেও তাঁদের সৈন্য-সামন্ত তখনও বেশ কিছুদিন যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারত। শকুনি মারা যাবার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্যোধন জয়ের আশা সম্পূর্ণ ত্যাগ করে রণক্ষেত্র থেকে। পায়ে হেঁটে রওনা দিলেন দ্বৈপায়ন হ্রদের দিকে। চিরসঙ্গী গদাখানি নিতে অবশ্য তাঁর ভুল হয়নি। কৌরব-পক্ষের জীবিত মহারথীদের মধ্যে কৃপাচার্য, কৃতবর্মা এবং দ্ৰোণপুত্র অশ্বত্থামা দুর্যোধনের পালিয়ে যাবার খবর জানতেন এবং তাঁরা গোপনে এসে দুর্যোধনের সঙ্গে দেখাও করলেন। বিশেষত অশ্বত্থামা, যিনি অন্যায়ভাবে পিতা দ্রোণের মৃত্যু হতে দেখে শোক সম্বরণ করতে পারছিলেন না, তিনি দুর্যোধনের কাছে তখনও প্রতিজ্ঞা করে যাচ্ছেন যে, অন্তত পাঞ্চালদের শেষ না করে তিনি ছাড়বেন না। ধৃষ্টদ্যুম্ন যেহেতু দ্রোণের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিলেন, অতএব তাঁর ব্যাপারে অশ্বত্থামার ক্রোধ ছিল সাংঘাতিক। তা ছাড়া পাণ্ডবদের সৈন্য বলতে যা অবশিষ্ট ছিল, তাও মোটামুটি পাঞ্চাল-সৈন্য। এইজন্যই অশ্বত্থামার যুদ্ধ করার সদিচ্ছাটা আরও অর্থবহ ছিল।

এই যে দুর্যোধনের সঙ্গে তিন মহারথীর কথাবার্তা চলছিল, ঠিক এই সময়ে একটা ঘটনা ঘটল। কতগুলি ব্যাধ, যারা তৎকালীন সামাজিক নিয়মে নগর-গ্রামের প্রান্তদেশে থাকত, তারা বনে-বনে নানা পশু শিকার করে কাঁধে মাংসভার নিয়ে দ্বৈপায়ন হ্রদের পাশ দিয়েই বাড়ি ফিরছিল। মৃত পশুগুলি তাদের কাঁধের ওপর আরও ভারী হয়ে উঠছিল এবং সেইজন্য তাদের ক্লান্তিও বাড়ছিল। দ্বৈপায়ন হ্রদের পাশে এসে টলটলে জল দেখে তারা কাঁধের মাংসভার নামিয়ে রাখল এবং হাত-মুখ ধুয়ে জল খেতে আরম্ভ করল প্রাণ ভরে। হ্রদের ধারে অশ্বত্থামা এবং দুর্যোধনের যে বাক্যালাপ চলছিল, সেটা পরিষ্কার কানে এল তাদের। ব্যাধেরা দুর্যোধন রাজার নাম জানে এবং পাণ্ডবকুমারদের সঙ্গে যে তাদের মারামারি হচ্ছে, তাও তারা জানে। দুর্যোধন যে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে এসেছেন এবং তাকে অন্য এক মহারথী যে যুদ্ধে উত্তেজিত করতে চাইছে, সেটাও তারা বেশ বুঝতে পারল। ব্যাধেরা ভীমকে খুব ভাল চেনে।

ব্যাধেরা ঠিক করল—যদি এই গোপন খবর তারা মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে অথবা ভীমের কাছে পৌঁছে দিতে পারে, তাহলে প্রচুর পারিতোষিক পাওয়া যাবে তাঁদের কাছ থেকে। ব্যাধেরা নিজেরা-নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল—দিন-রাত শিকারের পিছনে ছুটে বেড়াচ্ছি, এই কি একটা জীবন? শিকার করা আর শুকনো মাংস ঘাড়ে করে প্রতিদিন বাড়ি ফেরা—এই কষ্টে আর আমাদের দরকার কী—কিং নো মাংসেন শুষ্কেণ পরিক্লিষ্টেন শোষিণা? ব্যাধেরা নানা আলোচনা করে যুধিষ্ঠিরের শিবিরের দিকে রওনা দিল।

এইবারে আসল কথাটা বলি। আগেই উল্লেখ করেছি—রীতিমতো আর্যপুত্র হওয়া সত্ত্বেও ভীমের ভাব-সাব, ব্যবহার ছিল একটু অনার্যরীতি-সম্মত। আগে আরও বলেছি—ভীম ছোটবেলা থেকে যে মদ খাওয়া অভ্যাস করেছিলেন, সে মদ খুব অভিজাত নয়। বিশেষত শবর কিংবা কিরাত জাতীয় ধেনো-হাড়িয়াই যে তাঁর পছন্দসই মদ ছিল—পীত্ব কৈরাতকং মধু—সে-কথা আর না বললেও চলবে। এই প্রসঙ্গে এবারে পরিষ্কার জানাই যে, কিরাত-জাতির মদ যখন তাঁর এত পছন্দ, তখন সেই কিরাত বা ব্যাধদের সঙ্গে তাঁর একটা জান-পহেচান থাকবে না, ওঠাবসা থাকবে না—এও কি হয়? বিশেষত নিঃসঙ্গ মদ্যপান কোনও দেশে কোনও মানুষের কাছেই বড় আদরণীয় নয়।

ব্যাপারটা আমি যা বলছি, তার থেকেও গভীরে। ভীম পেটুক মানুষ, খাদ্য-রসিকও বটে। বিচিত্র খাদ্য, কারা কেমন খায়—এই বিচিত্রতা খুঁজতে গিয়েই হয়তো এই ব্যাধদের সঙ্গে ভীমের পরিচয় হয়ে গিয়েছিল। তাদের শিকারে পাওয়া তাজা মাংস অথবা বাড়িতে ‘প্রসেস’ করা শুকনো মাংস ভীমের বেশ পছন্দসই ছিল। ফলে এই ব্যাধেরা প্রতিদিন শিকার করে যা পেত, তার বেশ খানিকটা ভীমকে দিয়ে আসত—তে হি নিত্যং মহারাজ ভীমসেনস্য লুব্ধকাঃ/মাংসভারানুপাজহ্রঃ। বদলে, হয়তো ভীমের কাছে টাকা-পয়সাও পেত ব্যাধেরা। এখানে সংস্কৃত শব্দগুলি লক্ষ করার মতো। কবি বলেছেন ‘ভীমসেনস্য লুব্ধকাঃ’—মানে, ভীমের ব্যাধেরা। ভীমের সঙ্গে তাদের এতটাই পরিচয় হয়ে গিয়েছিল যে তারা এখন ভীমের লোক বলে পরিচিত। তারা দুর্যোধনের খবর নিয়ে চলল ভীমের কাছে।

যুধিষ্ঠির যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষের মুখে অথচ পাণ্ডবদের প্রধান শত্রু দুর্যোধন একেবারে নিপাত্তা হয়ে গেলেন। যুধিষ্ঠিরের চরেরা পর্যন্ত নানা দিক ঘুরে এসে তাদের ব্যর্থতা নিবেদন করেছে। ঠিক এই রকম একটা সময়ে ভীমের মদ্য-মাংসের জোগানদার বন্ধুরা এসে পৌছল ভীমের কাছে। দ্বার-রক্ষকেরা তাদের কিছুতেই ঢুকতে দিতে চায় না। বন্য ব্যাধ, কাঁধে মাংসভার, রাজপুত্র ভীমের সঙ্গে তাদের কীসের রিস্তা? ভীম কিন্তু তাঁর ব্যাধ-বন্ধুদের দেখতে পেয়েই দ্বারবানের বকা-খাওয়া লোকগুলিকে সঙ্গে সঙ্গে আসতে দিয়েছেন—বার্যমাণাঃ প্রবিষ্টাশ্চ ভীমসেনস্য পশ্যতঃ। ব্যাধেরা যা যা দেখেছিল, যা যা শুনেছিল—সব আদ্যোপান্ত বলল ভীমকে।

ভীম তো ভারী খুশি হলেন। এমন অকল্পনীয়ভাবে দুর্যোধনের শেষ অবস্থানের সংবাদ পেয়ে যাওয়ায় ভীম তাঁর পরিচিত লুব্ধক-শবরদের প্রচুর টাকা-পয়সা দিলেন। তারপর নিজে গেলেন যুধিষ্ঠিরের কাছে। তথাকথিত অন্ত্যজ শবরদের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ঘোষণা করার ব্যাপারে ভীম একটুও সংকোচ করলেন না। বললেন—যার জন্যে তুমি এত ভাবনা করছ, সেই দুর্যোধনের সম্বন্ধে আমার ব্যাধ-বন্ধুরা খবর এনে দিয়েছে—অসৌ দুর্যোধনো রাজন্ বিজ্ঞাতো মম লুব্ধকৈঃ। তিনি এখন দ্বৈপায়ন হ্রদের তলায় জলস্তম্ভন করে শুয়ে আছেন।

দুর্যোধন জায়গাটা ভালই বেছেছিলেন। যোগের সাহায্যে জলস্তম্ভন করে কতক্ষণ তার মধ্যে থাকা যায়, আমার জানা নেই। কিন্তু যোগাভ্যাসে অনেকক্ষণ যে থাকা যায়—উত্তমোত্তম যোগি-পুরুষেরা সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ। যাই হোক, ব্যাধদের কাছে খবর পেয়ে পাণ্ডবরা সকলেই তাড়াতাড়ি কৃষ্ণকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে উপস্থিত হলেন। মহামতি যুধিষ্ঠির দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে দুর্যোধনের উদ্দেশে নানা কটুক্তি বর্ষণ করতে লাগলেন। দুর্যোধনের বংশমর্যাদা, তাঁর ক্ষত্রিয়-ধর্ম, যুদ্ধে এত লড়াই করার শখ—এই সব দুর্বল জায়গাগুলি একে একে উল্লেখ করে শেষ পর্যন্ত যুধিষ্ঠির তাঁকে প্ররোচিত করতে সমর্থ হলেন। দুর্যোধন গদা কাঁধে করে জল থেকে উঠে এলেন। স্বয়ং যুধিষ্ঠির তাঁকে যুদ্ধের অন্যান্য উপকরণগুলি—বর্ম, শিরস্ত্রাণ ইত্যাদি দিয়ে সাহস দেখিয়ে বললেন—আমাদের যে কোনও ভাইকে তুমি বেছে নাও যুদ্ধের জন্য।

কুরুক্ষেত্রের বিরাট যুদ্ধ জয় করে যুধিষ্ঠির বোধহয় একটু আবেগ-বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। বুদ্ধিমান কৃষ্ণ তাঁকে বললেন—দাদা এটা একটু বেশি সাহস হয়ে যাচ্ছে না কি? দুর্যোধন এই তেরো বছর ধরে একটি লোহার পুরুষের ওপর গদা চালিয়ে নিজেকে গদাযুদ্ধে অপ্রতিম করে তুলেছে। তুমি তোমার অন্য ভাইদের কথা ছেড়েই দাও, স্বয়ং ভীমেরও দুর্যোধনের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। কেন জানেন? কৃষ্ণ তখন ভীম আর দুর্যোধনের পারস্পরিক বলাবলের একটা চুলচেরা বিচার করলেন। কেননা আজ সেই চরম যুদ্ধ-কাল উপস্থিত, যখন ভীমকে নিজের সর্বাতিশায়িী শক্তির সঙ্গে নিজের দুর্বলতার জায়গাটির খেয়াল রাখতে হবে। এই দুর্বলতা নিজে বোঝা যায় না, কিন্তু নিরপেক্ষ দর্শক অথবা শত্রুপক্ষ সেটা বোঝেন বলেই কৃষ্ণের সাবধানবাণী।

কৃষ্ণ বললেন—প্রথম কথা হল—‘প্র্যাকটিস’। এই তেরো বছর ধরে দুর্যোধন লৌহ-পুরুষের ওপর যে গদা হানার অভ্যাস করেছেন, ভীম সেই অনুশীলনের মধ্যে নেই। এই তেরো বছর বনবাস আর অজ্ঞাতবাসের ঝামেলায় ভীম তার গদার পেছনে সেই পরিশ্রম করতেই পারেননি—স চ নাতিকৃতশ্রমঃ—যা দুর্যোধন করেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, অন্য সময়েও ভীম যে গদার পিছনে খুব পরিশ্রম করেছেন, তা নয়। তার কারণও আছে। ভীমের দৈহিক উচ্চতা, গায়ের অমানুষিক শক্তি, বিশাল দেহের ভার—এই সব কিছুই ভীমকে এমনিতেই এত সুবিধে দিত, যে তার সঙ্গে গদা যোগ হলে সব সময়েই যুদ্ধের ফল হত তাঁর অনুকুলে। গদা-যুদ্ধের কৌশল বেশি করে শেখার কোনও তাগিদই অনুভব করেননি তিনি। কিন্তু দুর্যোধনের যেহেতু দৈহিক দিকে সেই সুবিধে ছিল , তাই তিনি ভারের চেয়ে ধারের দিকে নজর দিয়েছেন বেশি।

কৃষ্ণ ঠিক এই কথাটাই বলেছেন। বলেছেন—ভীম দুর্যোধনের থেকে অনেক বেশি দৈহিক শক্তি ধারণ করেন এবং তাঁর মতো কষ্টসহিষ্ণুও দুনিয়ায় নেই। কিন্তু দুর্যোধন হলেন নিপুণ। কখন, কোন সময় দেহের কোন অংশে মারতে হবে—এটা দুর্যোধন বেশি বোঝেন। বলবান আর শিক্ষা নিপুণের মধ্যে প্রতিযোগিতা হলে, নিপুণ ব্যক্তিরই সুবিধে বেশি—বলবান্ বা কৃতী বেতি কৃতী রাজন্‌ বিশিষ্যতে। আমরা যদি ভীমকে নিয়ে সম্পূর্ণ ন্যায় অনুসারে যুদ্ধ করি তবুও যুদ্ধ-জয়ের ব্যাপারে আমার সন্দেহ থেকে যায়।

ভীম এতক্ষণ সব শুনছিলেন। এবার তিনি নিজে এগিয়ে এলেন কৃষ্ণকে আশ্বস্ত করার জন্য। কৃষ্ণ যেটা বলেননি, সেটা হল জন্মাবধি দুর্যোধনের ওপর তাঁর প্রতিহিংসা-স্পৃহা। দিনের পর দিন দুর্যোধন তাঁকে যে লাঞ্ছনা দিয়েছেন, সেই লাঞ্ছনাই তাঁকে বিপুল শক্তি জুগিয়েছে প্রতিপক্ষকে নির্মল করার জন্য। কৃষ্ণ কি সেটা জানেন? সেই সাংঘাতিক মারণ-প্রতিজ্ঞা মাথায় রেখে ভীম বললেন—তোমার এত ভয় পাবার কিছু নেই কৃষ্ণ! যুদ্ধে আমি দুর্যোধনকে মারবই—অহং দুর্যোধনং সংখ্যে হনিষ্যামি ন সংশয়ঃ। ভীম বললেন—আমার এই গদাটা দেখছ তো? এটা দুর্যোধনের গদার চেয়ে দেড়গুণ ভারী—গদা গুরুতরী মম। তুমি শুধু দেখে যাও, কৃষ্ণ—আমি কী করি। কৃষ্ণ খুশি হলেন। এই যুদ্ধের প্রাক্কালে অখণ্ড মনোবল দরকার, সেটা ভীমের আছে জেনে খুশি হলেন কৃষ্ণ। বার বার ভীমকে তিনি সাবধান করে বলে দিলেন—তবু মনে রেখো দুর্যোধন কিন্তু গদার চালে ভীষণ কুশলী, আর তোমার সেই ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞাটা কিন্তু মনে রেখো—ত্বমস্য সক্‌থিনী ভঙ্‌ত্তা প্রতিজ্ঞা পালয়িয্যষি। অর্থাৎ অন্যায় যুদ্ধের ইঙ্গিতটা এখনই দিয়ে দিলেন কৃষ্ণ, যদিও ভীম সেটা হয়তো সেইভাবে খেয়াল করলেন না।

ভীম-দুযোর্ধনের গদাযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার ঠিক পূর্বমুহূর্ত। দু’জনেই নিজে নিজে গদা ঘুরিয়ে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পারস্পরিক গালাগালিও চলছে যুদ্ধে প্রস্তুতির মধ্যে মধ্যে। এই সময়ে কৃষ্ণাগ্রজ বলরাম এসে উপস্থিত হলেন দ্বৈপায়ন হ্রদের তীরে। ভীম এবং দুর্যোধন দুজনেই তাঁর শিষ্য। তিনি প্রস্তাব দিলেন—যুদ্ধটা ওখানে নয়, খানিকটা এগিয়ে গিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় যুদ্ধ হোক। তাঁর কথামতো সরস্বতী নদীর তীরে একটা পরিষ্কার জায়গা দু’জনেরই বেশ পছন্দ হল—তস্মিন দেশে সুনির্মুক্তে তে তু যুদ্ধমরোচয়ন্।

দু’জনেই গদা হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলেন এবং এই যুদ্ধের লোকোত্তর ব্যাস-বর্ণনায় আমি যাচ্ছি না বা যাওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। রাম-রাবণের যুদ্ধ যেমন রাম-রাবণের মতোই, অন্য উপমান দিলে সে যুদ্ধের যেমন অলংকার-দূষণ ঘটে, তেমনই ভীম-দুর্যোধনের যুদ্ধ ভীম-দুর্যোধনের মতোই। মহাভারতের কবি নানা উপমায় অমোঘ যত শব্দরাশিতে এই দুই মহান যোদ্ধার প্রয়োগ-নিপুণতা দেখিয়েছেন। কিন্তু আমি শুধু বলব—যুদ্ধ হয়েছে মহামতি কৃষ্ণের দুর্ভাবনার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিল রেখে। তবে সুবিধে ছিল এই যে, অসামান্য দক্ষতায় দুর্যোধন যে নিদারুণ গদা-প্রহারগুলি করেছেন—যেগুলি ভীমকে অকস্মাৎ ধরাশায়ী করবে বলে কৃষ্ণ ভেবেছিলেন—সেই আঘাতগুলি ভীম সইতে পেরেছিলেন অসামান্য শারীরিক ক্ষমতায়। দুর্যোধন হঠাৎ করে গদা প্রহার করার পরেও ভীম যে এক পাও নড়লেন না—এটা দুর্যোধনের কাছেও বড় আশ্চর্যের ছিল—নাকম্পত মহারাজ তদদ্ভুতমিবাভবৎ। অন্যদিকে ভীম যখন বিপুল বেগে গদা ঘুরিয়ে দুর্যোধনের দিকে ছুড়ছেন, সেই সময় মাথাটি পুরো ঠাণ্ডা রেখে দুর্যোধন যে শেষ মুহূর্তে সামান্য সরে গিয়েই গদাঘাতটি বাঁচিয়ে নিলেন—এটাও ছিল বড় আশ্চর্যের—তত্রাভূদ্‌ বিস্ময়ে মহান্।

শক্তি ও নিপুণতার বিনিময় এবং অবশ্যই পারস্পরিক আক্রোশে ভীম এবং দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ এমন পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, যাতে মাঝে-মধ্যে উভয় পক্ষেরই ভূমিতে পতন কিংবা সাময়িক ঝিম মেরে যাওয়াটা অস্বাভাবিক ছিল না। কিন্তু ব্যাসের বিশাল এই যুদ্ধ-বর্ণনার মধ্যে যেটা ভীষণভাবে লক্ষণীয়, সেটা হল—অভ্যাসের জন্যই হোক বা নিপুণতার জন্যই হোক, ভীমের গদার বাড়ি বাঁচিয়ে ওপর দিকে লাফিয়ে উঠে আবার মারা অথবা সরে গিয়ে পাশ থেকে বাড়ি কষানোটাই দুর্যোধনের যুদ্ধ-কৌশলের প্রধান অঙ্গের মধ্যে পড়ে—চরত্যুৰ্ব্বঞ্চ তিৰ্য্য চ ভীমসেন-জিঘাংসয়া। ভীমের শরীর অনেক ভারী, তাঁর পক্ষে উঁচুতে লাফিয়ে উঠে গদার বাড়ি বাঁচানোর চেয়ে গদা খাওয়াটা অনেক বেশি সহনীয় ছিল।

এই যে ঊর্ধ্বে উল্লম্ফন এবং সরে গিয়ে পাশ থেকে মারাটা যেমন দুর্যোধনের মস্ত কৌশল কিন্তু এই কৌশলের মধ্যেই ছিল তাঁর দুর্বলতা। যুদ্ধের মত্ততায় ভীমের যেমন ঊরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞাটি মনেই ছিল না, তেমনই দুর্যোধনেরও মনে ছিল না যে, ভীম তাঁর ঊরুতেই আঘাত করবেন। পাণ্ডবদের সঙ্গে নানা অন্যায় অত্যাচার করতে যাঁর বাধেনি, তাঁর মনে রাখা উচিত ছিল যে, ভীম তেরো বছর আগেই তাঁর উরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞাটা, সে যুদ্ধ অন্যায়-যুদ্ধ হলেও, সে প্রতিজ্ঞাটা করে রেখেছেন।

ঘোর যুদ্ধের মধ্যে কৃষ্ণের সঙ্গে আলোচনা করে অর্জুন নিজের ঊরুতে থাপ্পড় মেরে ভীমকে প্রতিজ্ঞার কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন! ঠিক এইসময় থেকে ভীমের যুদ্ধের স্ট্র্যাটিজিটা একটু পালটে গেল। তিনি কখনও বাঁয়ে কখনও ডাইনে থেকে চক্রাকারে দুর্যোধনকে ধাওয়া করতে লাগলেন, কখনও বা ‘গোমূত্রবৎ’ থেমে থেমে হঠাৎ হঠাৎ আক্রমণে যেতে লাগলেন। এই আক্রমণেও দুর্যোধন খুব অসফল হননি এবং এর মধ্যেও ভীম কয়েকবার পদাঘাত সহ্য করেছেন। কিন্তু একটা সময় এল ভীম ধেয়ে যাচ্ছেন দুর্যোধনের দিকে এবং দুর্যোধন দেখালেন যেন তিনি দাঁড়িয়েই থাকবেন। শেষ মুহূর্তে আঘাত হানার আগে ভীমকে ধোঁকা দিয়ে লাফিয়ে উঠলেন উঁচুতে সবেগে। ভীমের দিক থেকে সুবিধে ছিল তিনি তখনও আঘাতটা করে ফেলেননি। করে ফেললে তাঁর গদার আঘাতটা পড়ত গিয়ে মাটিতে এবং ওপর থেকে নেমে আসা দুর্যোধনের বাড়িটা পড়ত তাঁর ঘাড়ে। ওপরে লাফিয়ে ওঠা দুর্যোধনের কায়দাটা বুঝে ফেলেই ভীম নীচ থেকে শেষ এবং চরম গদাঘাত করলেন দুর্যোধনের ঊরুর ওপর।

মরণাস্তিক আর্তনাদ করে উরু-ভাঙা অবস্থায় দুর্যোধন মাটিতে শুয়ে পড়লেন। পাণ্ডবরা দূর থেকে দেখছেন এই অবস্থায় ভীম ত্বরিতে উপস্থিত হলেন দুর্যোধনের সামনে। কোনও মায়া নয়, কোনও মমতা নয়, চরম শত্রুতার চরম প্রতিশোধ নেবার জন্য ভীম ভগ্ন-উরু দুর্যোধনের মাথার ওপর তুলে দিলেন তাঁর বাম চরণখানি। পা দিয়ে দুর্যোধনের মাথা ঘষে ভীম বললেন—আমাকে যারা ভেঙিয়ে ভেঙিয়ে ‘গরু’ বলেছিল, আজ তাদের আমি ‘গরু’ বলে ডাকছি। এই প্রসঙ্গে ভীমের শেষ কথাটা ছিল অপূর্ব। ভীম বললেন—যারা রজস্বলা অবস্থায় একবস্ত্র দ্রৌপদীকে পাশা-খেলার আসরে ধরে এনে বিবস্ত্রা করার চেষ্টা করেছিল, আজ সেই দুর্যোধন ইত্যাদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রেরা দ্রৌপদীর তপস্যার প্রভাবে পাণ্ডবদের হাতে মারা গেল—আপনারা সবাই দেখুন—তান্‌ পশ্যধ্বং পাণ্ডবৈ ধার্তরাষ্ট্ৰান্ রণে হতাংস্তপসা যাজ্ঞসেন্যাঃ।