কুন্তী – ৬

কুন্তী স্বামীকে ভালবাসার চেষ্টা করেছিলেন অনেক। কিন্তু স্বামীসুখ তাঁর কপালে ছিল না। দুর্বাসার কাছে স্বেচ্ছা-বিহারের মন্ত্র শেখা সত্ত্বেও তাঁর মনে ছিল অসাধারণ সংযম এবং তার চেয়েও বেশি ব্যক্তিত্ব। ইচ্ছে করলেই কামুকের স্থূলতায় তাঁকে ভালবাসা যায় না। তাঁকে ভালবাসতে হলে পুরুষের দিক থেকে যে ব্যক্তিত্ব, যে সংযম থাকা দরকার, সেই ব্যক্তিত্ব বা সেই সংযম পাণ্ডুর ছিল না। কুন্তীর অন্তর বুঝতে হলে স্বামী নামক পুরুষটির যে পরিশীলিত চিত্তবৃত্তি বা যে মার্জিত রুচিবোধ থাকা দরকার পাণ্ডুর তা ছিল না। ছিল না বলেই চতুর্থবার তিনি কুন্তীকে দেব-পুরুষ ভজনার কথা বলতে পেরেছিলেন। ছিল না বলেই মাদ্রীর মাধ্যমে তিনি নিজের বিকার চরিতার্থ করার চেষ্টা করেছিলেন। কুন্তী তাঁকে অপমানও করেননি, কিন্তু তাঁর কথা শোনেনওনি। বস্তুত সেখানে তিনি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যেখানে পাণ্ডু রুচির সীমা অতিক্রম করেছেন অথবা যেখানে রুচি কামুকতার স্থূলচিহ্নে চিহ্নিত হয়েছে।

স্বামীসুখ কুন্তীর কপালে ছিল না। তার কারণ পান্ডু নিজেই। আরও এক কারণ তাঁর সতীন মাদ্রী। পুত্র উৎপাদনের শক্তি না থাকলেও পাণ্ডুর কামুকতা ছিল যথেষ্ট। যদি কিন্দম মুনির অভিশাপের গল্পটি বিশ্বাস করতে হয়, তবে বলব—পাণ্ডু যে মৈথুনরত অবস্থায় মৃগ-মুনিকে হত্যা করেছিলেন, তার পিছনে পান্ডুর ক্ষত্রিয়ের যুক্তি যাই থাক, আসলে তিনি নিজের কাম-পীড়ন সহ্য করতে পারেননি বলেই মৃগের মৈথুনও সহ্য করতে পারেননি। পরে অভিশাপগ্রস্ত হয়ে তিনি স্ত্রীদের কাছে সানুতাপে নিজের সম্বন্ধেই বলেছেন—ভদ্র বংশে জন্মেও সংযমের লাগাম-ছাড়া কামমুগ্ধ লোকেরা নিজের দোষেই এমন বাজে কাজ করে যে তার দুর্গতির সীমা থাকে না—প্রাপ্নুবন্ত্যকৃতাত্মানঃ কামজালবিমোহিতাঃ।

মৃগ-মৈথুনের মধ্যে কোনও ইন্দ্রিয়পীড়ন অনুভব না করলে পান্ডু নিজের সম্বন্ধে এই কথাটা বলতেন না। এই মুহুর্তে স্মরণে আনতেন না পিতা বিচিত্রবীর্যের কথা, যিনি অতিরিক্ত স্ত্রীসম্ভোগে শরীরে যক্ষ্মা ধরিয়ে ফেলেছিলেন। পান্ডুর অবস্থাও প্রায় একই রকম। তবে তাঁর এই সম্ভোগ-প্রবৃত্তির ইন্ধন হিসেবে কুন্তীকে ব্যবহার করাটা পাণ্ডুর পক্ষে কঠিন ছিল। কারণ সেই সংযম, সেই ব্যক্তিত্ব। কিন্তু মদ্ররাজকন্যা এ বিষয়ে পাণ্ডুর মনোমত ছিলেন এবং তাঁর অনিয়ত শৃঙ্গার-বৃত্তিতে প্রধান ইন্ধন ছিলেন তিনিই। যথেষ্ট শৃঙ্গারে সাহায্য করার কারণেই স্বামীর প্রণয় ছিল তাঁর বাড়তি পাওনা। বস্তুত কুন্তী এর কোনওটাই পছন্দ করতে পারেননি। স্বামীর প্রণয়ের জন্য অসংযত রুচিহীনতাকে তিনি প্রশ্রয় দিতে পারেননি, নিজেকেও বল্গাহীন ভাবে ভোগে ভাসিয়ে দিতে পারেননি।

মৃগ-মুনির অভিশাপের পর পাণ্ডু যে হঠাৎ বড় ধার্মিক হয়ে উঠলেন জপ-যজ্ঞ-হোমে দিন কাটাতে লাগলেন—তার পিছনে তাঁর ধর্মীয় সংযম যত বড় কারণ, শাপের ভয় তার চেয়ে অনেক বড় কারণ। মৃগ মুনির অভিশাপ ছিল—মৈথুনে প্রবৃত্ত হলেই তোমার মরণ ঘটবে।

এই অভিশাপের পর কুন্তী স্বামীর ব্যাপারে আরও কড়া হয়ে গিয়েছিলেন। কোনওভাবেই যাতে তাঁর প্রবৃত্তির রাশ-আলগা হয়ে না যায়, সেদিকে তিনি দৃষ্টি রাখতেন সতত। বস্তুত স্বামীর ব্রত-ধর্ম পালনে তিনি বরং খুশিই ছিলেন। সাময়িকভাবে পান্ডুও শান্ত হয়ে ছিলেন বটে, তবে পুরুষাস্তরের সংসর্গে নিজের স্ত্রীর গর্ভে বারংবার পুত্র-প্রার্থনার মধ্যে তাঁর আপন কাম-বিকারই শান্ত হচ্ছিল। কিন্তু যেই তাঁর পুত্রলাভ সম্পন্ন হয়েছে, বলা ভাল—কুন্তীর ব্যক্তিত্বে পুরুষান্তরে তাঁর শৃঙ্গার-নিয়োগ যেই বন্ধ হয়ে গেছে, অমনই পাণ্ডুর ধর্ম-কর্ম চুকে গেছে, এমনকী শাপের ভয়, মৃত্যুর ভয়—সব তিনি অতিক্রম করতে পেরেছেন আপন শৃঙ্গার-লালসায়।

অবশ্য সময়টাও ভাল ছিল না। ছেলেরা বড় হচ্ছিল। এদিকে চৈত্র এবং বৈশাখের সন্ধিতে বসন্তের হাওয়ায় পলাশ-চম্পকের মাতন শুরু হয়েছিল শতশৃঙ্গ পর্বতের বনে বনান্তে। এই উতলা হাওয়ায় পান্ডুর মনে মাঝে মাঝেই বাসনার শিখা জ্বলে উঠছিল। দূরে তাঁর ধর্ম-বালকরা খেলা করছিল, কুন্তী তাঁদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু মাদ্রী রাজাকে একা উতাল-চিত্তে ঘুরতে দেখে তাঁর পিছু নিলেন এবং তাও একাকিনী।

তিনি দুটি বালকের হাত ধরে রাজার সঙ্গে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। মহাভারতের কবি পর্যন্ত তাঁর এই ভঙ্গি নাপছন্দ করে লিখেছেন—মাদ্রী তাঁর পিছন পিছন গেছেন একা—তং মাদ্রী অনুজগামৈকা। তাও যদি বা তিনি সাবগুণ্ঠনে জননীর প্রৌঢ়তায় অনুগমন করতেন স্বামীর। না, তিনি তা করেননি। একটি শাড়ি পরেছেন যেমন সুন্দর তেমনই সূক্ষ্ম। তাও পুরো পরেননি অর্ধেকটাই কোমরে জড়ানো। সূক্ষ্ম শাড়ির অনবগুণ্ঠনে গায়ের অনেক অংশই বড় চোখে পড়ছিল। মাদ্রীকে তরুণীর মতো দেখাচ্ছিল। পাণ্ডু দেখছিলেন, কেবলই দেখছিলেন—সমীক্ষমাণঃ স তু তাং বয়স্থাং তনুবাসসম্।

পাণ্ডুর হৃদয়ে দাবানল ছড়িয়ে পড়ল। তিনি জড়িয়ে ধরলেন মাদ্রীকে। মাদ্রী শুধু স্বামীর মৃত্যু-ভয়ে তাঁকে খানিক বাধা দিলেন বটে, কিন্তু সূক্ষ্ম বস্ত্রের পরিধানে আগুন লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে রক্ষা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। মৈথুন-লিপ্সায় পাণ্ডুর তখন এমন অবস্থা যে, অত বড় একটা অভিশাপের কথাও তাঁর মনে ছিল না। যদিবা মাদ্রীর কথায় তাঁর মনে হয়েও থাকে তবু—ধুর শাপ—শাপজং ভয়মুৎসৃজ্য—এইরকম একটা ভঙ্গিতে তিনি মৃত্যুর জন্যই যেন কামনার অধীন হলেন—জীবিতান্তায় কৌরব্যো মন্মথস্য বংশগতঃ। সঙ্গম-মুহূর্তেই পাণ্ডু মারা গেলেন। মাদ্রীর উচ্চকিত আর্তনাদ শোনা গেল। পাঁচটি কিশোর বালককে সঙ্গে নিয়ে কুন্তী ছুটে এলেন পাণ্ডুর কাছে।

মাদ্রী এবং পাণ্ডু এমন অবস্থায় ছিলেন যে সেখানে কিশোর পুত্রদের কাছাকাছি যাওয়াটা বাঞ্ছনীয় ছিল না। কাজেই দূর থেকে কুন্তীকে দেখেই মাদ্রী চেঁচিয়ে বললেন—ছেলে-পিলেদের নিয়ে এখানে যেন এসো না দিদি। তুমি ওদের ওখানেই রেখে, একা এসো—একৈব ত্বমিহাগচ্ছ তিষ্ঠন্ত্বত্রৈব দারকাঃ। কুন্তী এলেন এবং দেখলেন—জীবনে যাঁকে তিনি একান্তই আপনার করে পেতে চেয়েছিলেন, তিনি মারা গেছেন।

কুন্তী আর থাকতে পারলেন না। বললেন—রাজা যথেষ্ট বুঝেশুনেই চলছিলেন। আমি তাঁকে সব সময় এসব ব্যাপার থেকে আটকে রেখেছি—রক্ষ্যমাণে ময়া নিত্যং বনে সততম্ আত্মবান্। সেই লোক তোমাকে হঠাৎ আক্রমণ করার সুযোগ পেলেন কী করে? এই দুর্ঘটনার জন্য কুন্তী মাদ্রীকে দোষারোপ করতে ছাড়লেন না। বললেন—মাদ্রী! তোমারই উচিত ছিল রাজাকে সামলে রাখা। এই নির্জন জায়গায় এসে তুমি রাজাকে প্রলুব্ধ করেছ—সা কথং লোভিতবতী বিজনে ত্বং নরাধিপম্। আমি সব সময় যে রাজাকে অভিশাপের কথা মনে করে বিষণ্ণ থাকতে দেখেছি—এখানে এই নির্জনে সে তোমাকে পেয়েই তো অতিরিক্ত সরস হয়ে উঠল—ত্বাম্‌ আসাদ্য রহোগতাং…প্রহর্ষঃ সমজায়ত?

মাদ্রীর ওপরে যতই রাগারাগি করুন, তাঁর স্বামীটিও যে সমান দোষে দোষী—এ-কথা কুন্তী মনে মনে অনুভব করছিলেন। নিজের সম্বন্ধে সচেতনতাও তাঁর কম ছিল না। শাস্ত্রের নিয়মে তিনি জানেন যে, প্রথমা স্ত্রী হলেন ধর্মপত্নী। আর মাদ্রী যতই প্রলুব্ধ করুক তাঁর স্বামীকে, তাঁর বিয়ের মধ্যেই কামনার মন্ত্রণা মেশানো আছে। দ্বিতীয় বিবাহটাই যে কামজ। এত কামনা যে স্বামীর মধ্যে দেখেছেন এবং যাঁর মৃত্যুও হল কামনার যন্ত্রণায়—তাঁকে আর যাই হোক শ্রদ্ধা করা যায় না, ভালওবাসা যায় না। মাদ্রীকে গালাগালি করার পরমুহূর্তেই কুন্তী তাই শুষ্ক কর্তব্যের জগতে প্রবেশ করেছেন। বলেছেন—মাদ্রী! আমি জ্যেষ্ঠা কুলবধূ এবং তাঁর ধর্মপত্নী, কাজেই রাজার সহমরণে যেতে আমাকে বাধা দিয়ো না মাদ্রী। তুমি ওঠো। এই ছেলেগুলিকে তুমি পালন করো।

জীবনের এই চরম এবং অন্তিম মুহূর্তে মাদ্রী কুন্তীর কাছে কতগুলি অকপট স্বীকারোক্তি করে বসলেন। সেকালের পারলৌকিক বিশ্বাস অনুযায়ী মাদ্রী বলে চললেন—স্বামীর সঙ্গে আমিই সহমরণে যাব দিদি। এই সামান্য জীবনে সীমিত স্বামীসুখে এবং সীমিত শারীরিক কামোপভোগে আমার তৃপ্তি হয়নি—নহি তৃপ্তাস্মি কামানাম্‌। আর রাজার কথা ভাবো। আমার প্রতি শারীরিক লালসাতেই তাঁর মৃত্যু হল। এই অবস্থায় আমি মৃতলোকে গিয়েও তাঁর সম্ভোগ-তৃষ্ণা মেটাব না কেন—তমুচ্ছিন্দ্যামস্য কামং কথং ন যমসাদনে?

কুন্তী আবার এসব কথা বেশিক্ষণ শুনতে পারেন না। রুচিতে বাধে। হয়তো বা মনে হল—এই রকম একটি স্বামীর জন্য সহমরণের মতো এত বড় আত্মবলি কি বড় বেশি ত্যাগ নয়। কিন্তু এখনও তাঁর শোনার বাকি ছিল। দুটি সন্তানের জন্ম দিয়েও মাদ্রী যতখানি মা হতে পেরেছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি তিনি নায়িকা। ফলত স্বামীকে চিরকাল সম্ভোগের প্রশ্রয়ে তিনি শুধু কুক্ষিগতই করেননি, সন্তানের স্নেহের থেকেও সম্ভোগ-তৃষ্ণা ছিল তাঁর কাছে বড়। আর কুন্তী যে সেই কন্যা অবস্থাতেই সন্তানকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে মায়ের স্নেহ-যন্ত্রণা ভোগ করে চলেছেন, সেই স্নেহ ব্যাপ্ত হয়েছিল তাঁর পরিবারের সর্বত্র। এমনকী অভিশপ্ত স্বামীকেও যে তিনি সমস্ত মৈথুন-চেষ্টা থেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখতেন, সেও বুঝি একরকম পুত্রস্নেহে—মানুষটা বেঁচে থাকুক—আর কিসের প্রয়োজন রক্ষ্যমাণে ময়া নিত্যম্। কিন্তু স্বামী যে এত ভোগী, তা তিনি এত বোঝেননি।

মাদ্রীর সেই অসফল সম্ভোগ-বাঞ্ছা ছাড়াও মাদ্রী এবার যা বললেন, তাতে তো কুন্তীর কোনওভাবেই আর মৃত্যুর পথে নিজেকে ঠেলে দেওয়া চলে না। সেটাও যে এক ধরনের স্বার্থপরতা হবে। শুষ্ক কর্তব্যের জন্য, সম্ভোগ-রসিক স্বামীর অনুগমনের জন্য নিজের সন্তানদের বলি দেওয়া সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। মাদ্রী বলেছিলেন—শুধু অসফল কাম-তৃষ্ণাই নয়, আমি তোমার ছেলেদের সঙ্গে আমার নিজের ছেলেদের এক করে দেখতে পারব না—ন চাপ্যহং বর্তয়ন্তী নির্বিশেষং সুতেষু তে। এই কথা শোনার পর কুন্তী আর দ্বিতীয়বার অনুরোধ করেননি, সহমরণের কথাও আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করেননি। নিষ্কম্প দৃষ্টিতে, সুগভীর ব্যক্তিত্বে তিনি সন্তান-পালনের দায়িত্বটাই বেশি বড় মনে করেছেন। স্বামী আর সতীনকে তাঁদের অভিলাষ-পূরণের অবসর দিয়েছেন আপন মূল্যে—ইহজন্মেও-পরজন্মেও।