কুন্তী – ১১

১১

একটা কথা করজোড়ে নিবেদন করি। আমি আগে বারংবার বলেছি কুন্তী তাঁর শৈশব থেকেই এক কঠিন মনস্তত্ত্বের শিকার। তার মধ্যে কন্যা অবস্থায় এক শিশুপুত্রকে জলে ভাসিয়ে দিয়ে এবং উপর্যুপরি স্বামীর কাছে, পুত্রদের কাছে সেই পুত্রের জন্মকথা চেপে গিয়ে কুন্তীর মনের মধ্যে এমন এক জটিল আবর্ত তৈরি হয়েছিল যা তাঁর মনকে কঠিন থেকে কঠিনতর করে তুলেছে। স্ত্রীলোকের জীবন-আরম্ভ যাকে বলে, সেই আরম্ভের পূর্বেও কুন্তীর এই যে বিধিবহির্ভূত পুত্রলাভ, সেই পুত্র তাঁর জীবনের প্রথম ভাগ, মধ্যভাগ এবং শেষ ভাগেও অন্তর্দাহ তৈরি করে গেছে।

আমরা কর্ণকুন্তীর সংলাপে এখনই যে পর্যায়টুকু শেষ করলাম, এটাকে মধ্যভাগের শেষ পর্যায় বলা যায়। বলতে পারেন—কর্ণের কথা স্বামীকে তিনি বলেননি, কিন্তু বশংবদ পুত্রদের তিনি বলতেই পারতেন। আমরা বলি—কুন্তী এটাকে নিজের কলঙ্ক বলে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, ফলে স্বামীকে তিনি বলেননি আর স্বামীর মৃত্যুর পরেও এমন কিছু ঘটেনি যাতে করে লজ্জা ত্যাগ করে ছেলেদের সে-কথা বলা যায়। ‘এমন কিছু’ বলতে আপনারা কুন্তীর শাশুড়ি সত্যবতীর কথা স্মরণ করতে পারেন। কন্যা অবস্থায় তাঁর পুত্র হলেন স্বয়ং মহামুনি ব্যাস। কিন্তু মৎস্যগন্ধা সত্যবতী শান্তনুকে ব্যাসের কথা কিছুই বলেননি, ছেলেদেরও বলেননি। কিন্তু কুরুবংশ যখন লোপ হয়ে যেতে বসল, তখন মাত্র সত্যবতী পুত্ৰকল্প ভীষ্মের কাছে ব্যাসের কথা প্রস্তাব করেন কুরুবংশের রক্ষাকল্পে। তাই বলেছি, তেমন কিছু হয়নি যে, কুন্তীকে বলতে হবে। বিশেষত এ সব ক্ষেত্রে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিটাই হল চেপে যাওয়া।

বলা যেতে পারে, এখন এই বিশাল ভারত-যুদ্ধের প্রাক্ মুহূর্তে কুন্তী ছেলেদের কাছে কর্ণের কথা বলতে পারতেন; পাণ্ডব-কৌরবদের যুদ্ধটাই তা হলে লাগত না, হত না অজস্র লোকক্ষয়। কারণ পরের ঘটনা থেকে আমরা জানতে পারব যে, মহামতি যুধিষ্ঠির মায়ের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলেন—আগে যদি জানতাম কর্ণ আমাদের বড় ভাই, তা হলে লোকক্ষয়ী যুদ্ধ হত না। —আলবত জানি, যুধিষ্ঠির যা চাইতেন, কুন্তী তা চাইতেন না। এখানে সেই ক্ষত্রিয়া রমণীর বিচারটুকু মাথায় রাখতে হবে।

মনে রাখা দরকার, রবীন্দ্রনাথের কর্ণ-কুন্তী সংবাদ বাঙালির স্নেহ, মায়া আর মমতার মৃদুতায় তৈরি। এই চিত্র-কবিতায় কর্ণ যতবার কুন্তীকে মা-মা করে ডেকেছেন, মূল মহাভারতে তা একবারও ডাকেননি। কর্ণ কুন্তীকে চিনতেন বলেই তাঁকে প্রথম সম্বোধন করেছেন—‘ক্ষত্রিয়া’ বলে। অন্যত্র আরও কৃত্রিমভাবে—‘যশস্বিনী’ বলে, ‘আপনি’ বলে। বস্তুত ক্ষত্রিয়া রমণীর হৃদয় বাংলার শ্যাম-শীতল নদী আর অন্নের মৃদুতা দিয়ে গড়া নয়। যতদিন কর্ণ দুর্যোধনের ভোগচ্ছায়ায় সুখী ছিলেন, কুন্তীরও ততদিন কিছু বলার ছিল না, কেন না ছেলের এই সুখ তাঁর অভিপ্রেত ছিল। কিন্তু যেদিন থেকে তিনি বুঝলেন তাঁরই ছেলের শক্তিকে উপজীব্য করে দুর্যোধনেরা তাঁর অন্য ছেলেদের বঞ্চিত করছে, সেদিন থেকেই তাঁর হৃদয়ে ক্ষোভ দানা বাঁধছে। বিশেষত কুরুসভায় দ্রৌপদীর চরম অপমানের পর কর্ণকে নামত দায়ী করতেও কুন্তীর বাধেনি। ক্ষত্রিয়া রমণী নিজ পুত্রের অন্যায় সহ্য করে না।

শেষ কথাটা হল—শ্বশুরকুলের বৃদ্ধ-জনেরা তাঁর প্রতি সুবিচার করেননি। পাণ্ডু মারা যাবার পর রাজরানির সম্মান তাঁর দূরে থাক, কুরুবাড়িতে তাঁকে থাকতে হয়েছে ভিখারির মতো। উত্তরাধিকার সূত্রে পুত্রদের প্রাপ্য ভাগও তিনি পাননি। উপরন্তু জুটেছে অপমান। নিজের অপমান, পুত্রবধূর অপমান। এর পরে বিদূলার জবানিতে, পুত্রদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছেন কুন্তী। যে রমণী সারা জীবনের অপমানের শোধ নেওয়ার জন্য প্রিয় পুত্রদের যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতে পারেন, তিনি এখন হঠাৎ কর্ণকে জ্যেষ্ঠ পুত্র বলে ঘোষণা করে যুদ্ধের আগুনে ছাই চাপা দেবেন, এমন মৃদুলা রমণী কুন্তী নন। যুধিষ্ঠির বলেছিলেন—কর্ণকে বড় ভাই জানলে যুদ্ধ করতাম না। আর কুন্তী বলেছিলেন—বাবা তুমিও পাণ্ডবপক্ষে এসো, কৌরবদের বিনাশ করো, যুদ্ধ করো।

অর্থাৎ যুদ্ধ করতেই হবে, ক্ষত্রিয়া রমণীর এই কাঠিন্যের মধ্যে যথাসম্ভব করুণার মতো যেটা কর্ণের জন্য করা সম্ভব, কুন্তী তাই করেছেন। আসলে তাঁর ঈর্ষা হচ্ছিল—আরে আমারই ছেলে ওটা, তার কাঁধে বন্দুক রেখে তোরা যুদ্ধ করবি? কর্ণ নিজেই কুন্তীকে বলেছেন—আমাকে নৌকোর মতো আশ্রয় করে কৌরবরা এই যুদ্ধসাগর পার হবেন—ময়া প্লবেন সংগ্রামং তিতীর্ষন্তি দুরত্যয়ম্। কুন্তীর ঈর্ষা—তোরা যুদ্ধ করবি, কর না, কিন্তু আমার ছেলেটাকে নৌকো ঠাউরেছিস কেন? তুই বাবা চলে আয় তো এই ধারে, দেখি কার ঘাড়ে ক’টা মাথা, দেখুক চেয়ে চেয়ে কৌরব-ঠাকুরেরা—অদ্য পশ্যন্তু কুরবঃ কণার্জুনসমাগমম্‌।

ঠিক এই বুদ্ধি নিয়েই কুন্তী গিয়েছিলেন কর্ণের কাছে। অন্তরের এই মুখ্য ধারার তলায় তলায় ছিল সারা জীবনের পাপবোধ, পুত্রের প্রতি মায়ের কর্তব্য পালন করার দায় এবং অন্য মানসিক জটিলতা। কিন্তু যে মুহূর্তে কর্ণ তাঁকে হাঁকিয়ে দিয়েছেন, সেই মুহূর্তেই তিনি পুনরায় কঠিন সেই ক্ষত্রিয়া রমণী। অন্তরের স্নেহধারা বয়ে চলল অন্তরের পথেই। সম্পূর্ণ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধকাল ধরে একবারের তরেও কুন্তীর দিকে নেত্রপাত করেননি মহাভারতের কবি। শুধু যুদ্ধ, যুদ্ধ এবং যুদ্ধ। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ, শল্য—সব রথী-মহারথীরা যুদ্ধভূমিতে শয্যা গ্রহণ করছেন। কুন্তীর সম্বন্ধে কথাটি নেই কবির মুখে। হয়তো অন্তরালে বসে বসে এই বিভ্রান্ত জননী নক্ষত্রের আলোকে ঘোর যুদ্ধফল পাঠ করছিলেন—এক জন তো যাবেই, হয় কর্ণ, নয় অর্জুন। মহাভারতের কবি যে মুহূর্তে আবারও তাঁর চিত্রপটে কুন্তীর ছবি আঁকলেন, সেই কুন্তীর সঙ্গে যুদ্ধপূর্ব কুন্তীর কোথায় যেন এক গভীর যোগসূত্র আছে।

যুদ্ধের আগে প্রথম পুত্র কর্ণকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিলেন কুন্তী। কর্ণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। আর যুদ্ধের পরে আবারও যখন আমরা কুন্তীর দেখা পেলাম, তখন কর্ণ মারা গেছেন। কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধ চলেছিল মাত্র আঠারো দিন। কুন্তী যখন কর্ণের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন যুদ্ধের উদ্যোগ চলছে। অর্থাৎ আঠারো দিন নাই হোক, মাত্র কুড়ি-বাইশ দিন আগে যে পুত্রের সঙ্গে দেখা করে শেষবারের মতো জড়িয়ে ধরেছিলেন কুন্তী, এখন সে মারা গেছে। কুন্তীকে আমরা যুদ্ধজয়ী পাণ্ডবপক্ষের পুত্ৰগর্বিণী রাজমাতার মতো দেখতে পেলাম না। দেখলাম বিজিত কৌরবপক্ষের স্বামীহারা, পুত্রহারা হাজারো রমণীদের সঙ্গে একাকার, বিষণ্ণা, হাহাকারে সমদুঃখিতা।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যতখানি রোমাঞ্চকর ছিল, যুদ্ধোত্তর কুরুক্ষেত্র ছিল ততখানিই করুণ। এমন কেউ ছিল না, যার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব একজনও মারা যায়নি। যুদ্ধ জয় করে পঞ্চপাণ্ডব বেঁচেছিলেন বটে, তবে তারাও পুত্র হারিয়েছেন, আত্মীয় কুটুম্ব অনেককেই হারিয়েছেন। আরও যা হারিয়েছেন তা তখনও জানতেন না। যুদ্ধশেষের পর যুধিষ্ঠির ভাইদের নিয়ে প্রথম গান্ধারীর কাছে গেছেন, কারণ তাঁর একটি সন্তানও বেঁচে নেই। তা ছাড়া ‘দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে’—সেই নিয়মে ভবিষ্যতের রাজা যুধিষ্ঠির আপন কর্তব্য পালন করে তারপর এসেছেন মায়ের কাছে। দ্রৌপদীও রয়েছেন সেখানেই।

ছেলেরা পাঁচ পাণ্ডবভাইরা মায়ের কাছে এলেন—শুধু এইটুকু বলেই মহাভারতের কবি তুষ্ট হলেন না, বললেন—মাতরং বীরমাতরম্‌—শুধু মায়ের কাছেই নয়, বীরমাতার কাছে। মনে পড়ে কুন্তীর উত্তেজনা—যে সময়ের জন্য ক্ষত্রিয় কামিনীরা সন্তান পেটে ধরে, অর্জুন—সেই সময় এখন এসে গেছে। ব্যাসকে তাই লিখতে হল—সংগ্রামজয়ী বীরপুত্রের জননীর কাছে ফিরে এল তার পুত্রেরা—মাতরং বীরমাতরম্। কতক্ষণ ধরে কুন্তী চেয়ে থাকলেন পুত্রদের মুখের দিকে, কতক্ষণ? নিশ্চয়ই মনে হল—আরও একজন যদি থাকত! প্রিয়পুত্রেরা যুদ্ধ করতে গিয়ে কত কষ্ট পেয়েছে, এই যন্ত্রণা যুদ্ধ জয়ের থেকেও এখন পীড়া দিতে থাকল কুন্তীকে। যুদ্ধজয়ের অন্তিম মুহূর্তে কঠিনা ক্ষত্রিয়া রমণী পরিণত হয়েছেন সাধারণী জননীতে।

আনন্দের পরিবর্তে কুন্তীর চোখ ভরে জল এল। এক ছেলে মারা গেছে—সে দুঃখ কেঁদে জানাবারও উপায় নেই তাঁর। কাপড়ে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন কুন্তী—বাষ্পমাহারয়দ্দেবী বস্ত্ৰেণাবৃত্য বৈ মুখম্। প্রিয় পুত্রদের প্রত্যেকের ক্ষতস্থানে বার বার হাত দিয়ে জননীর স্নেহ-প্রলেপ বুলিয়ে দিলেন তিনি। জ্যেষ্ঠ-পুত্রের শোক ভুলতে চাইলেন জীবিতদের গায়ে হাত বুলিয়ে। স্বামীদের দেখে দ্রৌপদীর দুঃখ তীব্রতর হল। কেঁদে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তিনি বললেন—মা! সুভদ্রার ছেলে অভিমন্যু, আপনার অন্য নাতিরা সব কোথায় গেল? কই, আজকে তারা তো কেউ এল না আপনার কাছে। আমার ছেলেরা কেউ বেঁচে রইল না, আর আমি এই রাজ্য দিয়ে কী করব—কিংনু রাজ্যেন বৈ কাৰ্য্যং বিহীনায়াঃ সুতৈর্মম।

কুন্তী আবারও একাত্ম হলেন দ্রৌপদীর সঙ্গে। দ্রৌপদী তো আর জানেন না যে, তাঁর মতো কুন্তীও আজ পুত্রহারা। সমদুঃখের মর্যাদায় কুন্তী পুত্রবধূকে মাটি থেকে ওঠালেন। তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন মায়ের স্নেহে, সন্তানহারার একাত্মতায়। সবাইকে নিয়ে তিনি চললেন দীর্ঘদর্শিনী গান্ধারীর কাছে। বুঝলেন—যে জননী তার একশোটি পুত্র হারিয়েছে, তার যন্ত্রণা সকলের কষ্ট লঘু করে দেবে। গান্ধারীর দুঃখে কুন্তী নিজে সান্ত্বনা পেতে চেষ্টা করলেন।

কুরুরমণীদের সবাইকে নিয়ে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র উপস্থিত হয়েছেন গঙ্গার ঘাটে। আছেন গান্ধারী, আছেন কুন্তী। পাণ্ডবরা এসেছেন জননীর সঙ্গে। কুরুবাড়ির পুত্রবধূরা জলে নেমে তর্পণ করছেন। এমন সময় মনে মনে বিপর্যস্ত কুন্তী চোখের জলে আপ্লুত হয়ে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেদের উদ্দেশে বললেন—যে মহাবীরকে সকলে সারথির ছেলে বলে ভাবত, সবাই যাকে জানত রাধার ছেলে সেই কর্ণ তোমাদের সবার বড় ভাই। সৈন্যদলের মধ্যে যাকে দেখতে লাগত সূর্যের মতো, দুর্যোধনের সৈন্যবাহিনীর যে ছিল নেতা, যার মতো বীর এই তিন ভুবনে আর দ্বিতীয়টি নেই—যস্য নাস্তি সমো বীর্যে পৃথিব্যামপি কশ্চন—সেই কর্ণ তোমাদের বড় ভাই। এই বিরাট যুদ্ধে সে অর্জুনের হাতে মারা গেছে, তার জন্য এক অঞ্জলি জল দিয়ে গঙ্গায় তর্পণ করিস তোরা। সে তোদর বড় ভাই, সুর্যের ঔরসে আমারই গর্ভে তার জন্ম হয়েছিল তোদেরও অনেক আগে—স হি বঃ পূর্বজো ভ্রাতা ভাস্করান্মময্যজায়ত।

পাণ্ডবরা হঠাৎ করে প্রায় অসম্ভব এই নতুন খবর শুনে একেবারে হতবাক হয়ে গেলেন। কর্ণের জন্য তাঁদের দুঃখ ভ্রাতৃসম্বন্ধের নৈকট্যে তীব্রতর এবং আন্তরিক হয়ে উঠল। যে যুধিষ্ঠির যুদ্ধে পর্যন্ত স্থির থাকেন, তিনি রাগে সাপের মতো ফুঁসতে ফুসতে মায়ের কাছে তাঁর প্রথম পুত্রজন্মের সত্যতা সম্বন্ধে দ্বিরুক্তি শুনতে চাইলেন। মায়ের সঙ্গে যুধিষ্ঠির কখনও এই ব্যবহার করেননি। কিন্তু কুন্তী ওই একবারই যা বলেছেন, তিনি বারবার এক কথা বলেন না। যুধিষ্ঠির মনে আকুল, মুখেও গজর গজর করতে থাকলেন। বার বার বলতে থাকলেন—এ কী আক্কেল তোমার, সব কথা চেপে থাকার জন্য আজ তোমার জন্য আমরা মরলাম—অহো ভবত্যা মন্ত্রস্য গ্রহণেন বয়ং হতাঃ। আগে বললে এই লোকক্ষয়ী যুদ্ধ হত না, কর্ণ পাশে থাকলে এই পৃথিবীতে কী আমাদের অপ্রাপ্য ছিল—এইরকম নানা সম্ভাবিত সৌভাগ্যের কথা বলে ধর্মরাজ দুষতে লাগলেন কুন্তীকে। কুন্তী এ-কথারও জবাব দিলেন না। ভাবটা এই—আমার ছেলে মারা যেতে আমার যে কষ্ট হয়েছে, তার চেয়ে বেশি কষ্ট তোমাদের ভাইদের হতে পারে না বাছা। যুধিষ্ঠির সাময়িক শ্রাদ্ধ-তর্পণ সেরে চলে এলেন বটে। কিন্তু এর কাছে তার কাছে মায়ের এই রহস্য-গোপনের কথা এবং ভ্রাতৃহত্যার শোক বারংবার বলেই চললেন। তবু কুন্তী কিছু বললেন না।

যুধিষ্ঠির কর্ণের নানা খবর পেলেন মহর্ষি নারদের কাছে। গভীর দুঃখে দুঃখিত হয়ে থাকলেন অন্তরে। কুন্তী এবার প্রয়োজন বোধ করলেন যুধিষ্ঠিরকে কিছু বলার। বোঝাতে চাইলেন—তোমার দুঃখের চাইতে আমার দুঃখ কিছু কম নয় বাছা। বললেন—কেঁদো না, মন দিয়ে শোনো আমার কথা—জহি শোকং মহাপ্রাজ্ঞ শৃণু চেদং বচো মম। আমি চেষ্টা করেছিলাম অনেক। তোমরা যে তার ভাই—এ-কথা আমি অনেক করে বলেছিলাম তাকে। আর শুধু আমি কেন, তার জন্মদাতা পিতা সূর্যদেবও তাকে আমারই মতো করে বুঝিয়েছেন। ভগবান সূর্যদেব এবং আমি অনেক যত্নে, অনেক অনুনয় করে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাকে না পেরেছি বোঝাতে, না পেরেছি তোমাদের সঙ্গে তাকে মিলিয়ে দিতে। মেলা তো দূরের কথা, সে তোমাদের ব্যাপারে আরও প্রতিকুল হয়ে উঠল। আমিও দেখলাম—যাকে বুঝিয়ে শাম্য করা যাবে না, তাকে উপেক্ষা করাই ভাল। আমি তাই করেছি—প্রতীপকারী যুস্মাকম্‌ ইতি চোপেক্ষিতো ময়া।

কুন্তীর এই স্বীকারোক্তির পরেও ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির তাঁকে ছাড়েননি। কেন তিনি আগে বলেননি কর্ণের গোপন জন্ম-কথা—এই কারণে অনেক গালাগাল অনেক শাপ-শাপান্ত যুধিষ্ঠিরের কাছে শুনতে হল কুন্তীকে। যুধিষ্ঠির বুঝলেন না—প্রথম পুত্রের মৃত্যুতে অন্য পুত্রদের যুদ্ধ-জয় কুন্তীর কাছে তিক্ত হয়ে গেছে। তাঁর নিশ্চয়ই মনে পড়ে আপন পুত্রবধূর সেই স্মরণীয় বিলাপের ভাষা—আমার ছেলেরা বেঁচে নেই, এই রাজ্য দিয়ে আমি কী করব—কিং নু রাজ্যেন বৈ কার্যং বিহীনায়াঃ সুতৈর্মম। কুন্তী এখন নির্বিণ্ণ, নিরাসক্ত এক বিশাল বৈরাগ্যের জন্য অপেক্ষমান।

দেখা যাচ্ছে—যুদ্ধ কুন্তীও চেয়েছিলেন, দ্রৌপদীও চেয়েছিলেন। যুদ্ধের জন্য উত্তেজনা তৈরি করার ব্যাপারে দ্রৌপদী যতখানি মুখরা ছিলেন, কুন্তীও ঠিক ততটাই। যুদ্ধ লাগলে আত্মীয়, পরিজন, এমনকী প্রিয় পুত্রদেরও কারও না কারও মৃত্যু হতে পারে—এই সত্য তাঁদের জানা ছিল। তবু শাশুড়ি এবং পুত্রবধূ দুজনেই যুদ্ধ চেয়েছেন অন্যায়কারী কৌরবদের শাস্তির জন্য। দ্রৌপদী যুধিষ্ঠিরের ধীরে চলার নীতিতে অতিষ্ঠ হয়ে তাঁকে বলেছিলেন—এত অপমানের পরেও যদি তোমরা চুপ করে বসে থাক, তবে থাক, যুদ্ধ করবে আমার বাপ-ভাই, যুদ্ধ করবে আমার ছেলেরা, আর তাদের নেতা হবে অভিমন্যু। আর কুন্তী কৌরবদের শাস্তির জন্য ছেলেদের বিদুলার উপাখ্যান শুনিয়েছিলেন, যে উপাখ্যানের বিষয়বস্তু—ক্ষত্রিয়ের ছেলেরা যুদ্ধ অথবা মৃত্যুভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকে না। তারা হয় মরে, নয়তো প্রতিশোধ নেয়। কুন্তী-বিদুলার প্রসঙ্গ পরে আরও একবার স্মরণ করতে হবে আমাদের।

শাশুড়ি এবং পুত্রবধু—দুজনেরই এই উত্তেজনার পর তাঁদের এই পুত্ৰশোক মহাভারতের পাঠকদের কেমন যেন সংশয়িত করে তোলে, তাঁদের চরিত্র সম্বন্ধে একটা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেবার পথ যেন রুদ্ধ করে দেয়। বস্তুত এইখানেই ক্ষত্রিয়া রমণী এবং জননীর বিচার। কুন্তীর শ্বশুরকুল, বিশেষত কুরুজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র তাঁর ভ্রাতৃবধূ এবং পুত্রবধূর ওপর যে অন্যায় চালিয়ে গেছেন, তার প্রতিবিধান করাটা কুন্তী এবং দ্রৌপদীর কাছে অনিবার্য ছিল, কারণ স্ত্রীলোক এবং শ্বশুর-ভাশুরের রক্ষণীয়া হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগতভাবে তাঁরা যে অপমান সয়েছেন, সে অপমান বোধহয় পাণ্ডবরাও সননি। কাজেই ক্ষত্রিয়া রমণী হিসেবে একজন পুত্রদের, অন্যজন স্বামীদের যুদ্ধের প্ররোচনা দিয়েছেন। সেই প্ররোচনা যেমন সত্য, আবার এখন পুত্রদের মৃত্যুতে এই দু’জনের কষ্টও ততটাই সত্য। জ্ঞাতি-বান্ধব এবং অতি প্রিয়জনের মৃত্যুর পর দ্রৌপদী রাজরানি হয়ে তবু যতটুকু সুখী হয়েছেন, কুন্তীর মনে কিন্তু রাজমাতা হওয়ার সুখ একটুও নেই। কারণ কুন্তীর বয়স হয়েছে, তিনি সংসারে নির্বিণ্ণ হয়ে উঠেছেন।

লক্ষণীয় বিষয় হল—শ্বশুর-ভাশুর ধৃতরাষ্ট্রের ওপর যে কুন্তীর এত রাগ ছিল, পুত্রদের যুদ্ধজয়ের পর সেই কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের পত্নী গান্ধারীর সেবায় একান্তভাবে আত্মনিয়োগ করলেন। তাঁর ছেলেরা নিযুক্ত হল ধৃতরাষ্ট্রের সেবায়। আরেকভাবে বলা যায় কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের সুখকামনাতেই আত্মনিয়োগ করলেন। পাণ্ডবরা, বিশেষত মহারাজ যুধিষ্ঠির যা কিছু করতেন ধৃতরাষ্ট্রের অনুমতি নিয়েই করতেন, আর এদিকে কুন্তী ধৃতরাষ্ট্রের আত্ম-প্রতিনিধি গান্ধারীর কাজে এমনভাবে নিজেকে নিয়োগ করলেন, যাতে মনে হবে তিনি যেন পুত্রবধূ, স্বামীর পরিজনদের সেবায় নিমগ্ন।

স্বৰ্গত মহামহোপাধ্যায় যোগেন্দ্রনাথ বাগচী মশাই কুন্তীর এই ব্যবহারের মধ্যে দিয়েই মুখ্যত কুন্তী-চরিত্রের মাহাত্ম্য নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে কুন্তী-চরিত্রের এইটাই ‘ফোকাল পয়েন্ট’। কুন্তীর মৃত্যু পর্যন্ত এই ব্যবহারের ব্যাপ্তি। তাঁর মতে কুন্তী স্বামীর ঘর বেশিদিন করতে পারেননি, স্বামী-সেবা যাকে বলে এবং যা নাকি সেকালে স্ত্রীলোকের অন্যতম ধর্ম ছিল, নানা কারণে সেই সেবা-সৌভাগ্যও কুন্তীর কপালে জোটেনি। এখন পুত্রহীন এই বৃদ্ধদম্পতির সেবায় আত্মনিয়োগ করে কুন্তী তাঁর জীবনের সার্থকতা খুঁজে নিয়েছেন। তাঁর সতীত্ব এখানেই, এইখানেই তাঁর সার্থকতা এবং হয়তো বা এই কারণেই পুণ্যবতী প্রাতঃস্মরণীয় পঞ্চকন্যার মধ্যে কুন্তীর নাম—অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা।

মহামহোপাধ্যায়ের বক্তব্য আমার মাথায় রেখে সবিনয়ে জানাই কুন্তীর সতীত্ব নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তিত নই। এমনকী চিন্তিত নই বৈষ্ণবরা যে কারণে কুন্তী সহ ওই রমণীকে সতী-পাতকনাশিনী বলেছেন, তাই নিয়েও। বৈষ্ণবরা বলেন, এই পঞ্চকন্যাই ভগবানকে স্বশরীরে—কেউ রাম-রূপে, কেউ কৃষ্ণ-রূপে দর্শন করেছিলেন বলেই তাঁরা পাতকনাশিনী সতী। বললাম তো যে ভাবেই হোক এই মাহাত্ম্য নিয়েও আমি চিন্তিত নই! কথাটা হল—কুন্তী ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারীর সেবায় আত্মনিয়োগ করেছেন প্রায় পুত্রবধূর অভিমানে—কুন্তিভোজসুতা চৈব গান্ধারীমন্ববর্তত। কেন?

এবার একটা ফালতু কথা বলি! গুণিজনে আমার অপরাধ নেবেন না। ভিড় বাসে একটি সিট খালি হয়েছে। সেই খালি আসনের সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তির দাঁড়াবার কায়দা, তাৎক্ষণিক শারীরিক সংস্থান এবং তৎপরতার কারণে আসনটি কারও কাছে প্রাপ্য হয়, এবং অন্য কারও কাছে প্রাপ্য হয় না। কিন্তু আসনটি অপ্রাপ্য হলেও ক্কচিৎ কেউ শারীরিক নিপুণতা, তৎপরতা এবং বলিষ্ঠতায় সেইখানে বসে পড়ে। তখন ঝগড়া লাগে। আসনটি যার প্রাপ্য স্বাভাবিক কারণেই সে অন্যান্য যুক্তিবাদীদের সমর্থনে এবং ন্যায়তই তর্কে জিতে যায়। অন্যায়ী অনধিকারী তখন আসন ছেড়ে উঠতে চায় এবং অধিকারী ব্যক্তি তখন বদান্য হয়ে বলেন—আরে ছি ছি, বসুন, আপনিই বসুন, একবার শুধু বললেই হত, এই তো দু-মিনিটের মামলা, সবাই তো নেমে যাব। অপ্রস্তুত অনধিকারী তখন সেই আসনে বসতে বাধ্য হন, এবং যতক্ষণ বসে থাকেন ততক্ষণ আপন অপ্রাপ্য অধিকারে মানসিকভাবে ছিন্ন-ভিন্ন হতে থাকেন।

এখানেও তাই। পাণ্ডু ছিলেন রাজ্যের নির্বাচিত অধিকারী। ধৃতরাষ্ট্র তাঁর রাজ্যে বসে পড়েছিলেন। যুদ্ধ হল। যুদ্ধে পাণ্ডুর প্রতিনিধিরা জিতলেন। জিতে বললেন—জ্যাঠামশাই! আপনিই রাজা। আপনি যা বলবেন, আমরা তাই করব—ধৃতরাষ্ট্রং পুরস্কৃত্য পৃথিবীং পর্যপালয়ন্‌। ভিড় বাসে সেই অধিকারীর বদান্যতায় অনধিকারী যেমন শারীরিকভাবে উঠতেও পারে না, আবার মানসিকভাবে বসতেও পারে না, ধৃতরাষ্ট্রও সেইভাবেই পনেরো বছরে কাটালেন। আর কুন্তী! যে ধৃতরাষ্ট্রের অন্যায় আচরণে তাঁর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে গিয়েছিল, তিনি যে এত এখন ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর অনুগত হয়ে পড়লেন, তার কারণ নৈতিকভাবে তাঁর জয় হয়ে গেছে। বিজয়িনীর নম্রতার মধ্যে কোনও লজ্জা নেই, বরং মাহাত্ম্য আছে। অধিকন্তু একশত পুত্রের মৃত্যুতে যে জনকজননী শোক-ক্লিষ্ট হয়ে আছেন, তাঁদের গৌরবে প্রতিষ্ঠা করে নিজে নত হওয়ার মধ্যেও বিজয়িনীর মাহাত্ম্য আছে। ধৃতরাষ্ট্রের প্রিয়া মহিষীর অসংখ্য সেবা করে, বশংবদ হয়ে কুন্তী যেমন একদিকে তাঁদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করেছেন, তেমনই অন্যদিকে ছিল তাঁর স্বাধিকারের বদান্যতা—তুমি আমার অধিকার স্বীকার করেছ, বাস্‌, ঠিক আছে, তুমিই বসে থাক রাজার আসনে, আমি নির্বিন্ন, আমি সিদ্ধকাম।

এই সিদ্ধকাম অবস্থাতেই কুন্তীর বৈরাগ্য এসেছে। তাছাড়া পনেরো বছর ধরে এই অন্ধ ভাশুর এবং তাঁর পুত্রহীনা পত্নীর সঙ্গে থেকে থেকে কুন্তীও ভোগসুখে নির্লিপ্ত হয়ে গেছেন। যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রকে যথাসম্ভবের থেকেও বেশি সম্মান দিয়ে চলতেন। বিলাস, ভোগ-সুখ এবং মর্যাদা কোনওটাই ধৃতরাষ্ট্র কম পাননি যুধিষ্ঠিরের কাছ থেকে। তবে এই সব কিছুর মধ্যে ক্ষুদ্র কণ্টকের মতো একটি মাত্র বস্তুই ধৃতরাষ্ট্রকে বিদ্ধ করত। সবাইকে লুকিয়ে মধ্যম পাণ্ডব ভীম মাঝে মাঝে গঞ্জনা দিতেন ধৃতরাষ্ট্রকে। এ ঘটনা যুধিষ্ঠির, অর্জুন অথবা দ্রৌপদী কুন্তী কেউই জানতেন না। ধৃতরাষ্ট্রও কাউকে বলেননি।

পনেরো বছর যুধিষ্ঠিরের রাজত্বে সুখবাস করে ধৃতরাষ্ট্র এবার বনে যাবার জন্য তৈরি হলেন। বানপ্রস্থের সময় ধরলে ধৃতরাষ্ট্রের একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। যাই হোক, তিনি যুধিষ্ঠিরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সস্ত্রীক বানপ্রস্থে যাওয়ার জন্য তৈরি হলেন। ইচ্ছে—বাকি জীবন সাধন, তপস্যায় কাটিয়ে দেওয়া। যেদিন গান্ধারীকে নিয়ে ধৃতরাষ্ট্র রওনা দিলেন বনের উদ্দেশে, সেদিন রাজ্যের যত নর-নারী রাস্তায় ভেঙে পড়ল তাঁদের দেখতে। বৃদ্ধ রাজা বনে যাচ্ছেন, গান্ধারী বনে যাচ্ছেন, পাণ্ডবরা সবাই তাঁদের পেছন পেছন চলেছেন। কুন্তীও চলেছেন চোখ-বাঁধা গান্ধারীর হাত ধরে। হস্তিনাপুরের সিংহদ্বার ছাড়িয়ে অনেক দূর চলে এসেছেন তাঁরা। পুরবাসীরা ফিরে গেছে অনেক আগেই। এবার যুধিষ্ঠিরও ফিরবেন। আর কত দূরই বা যাবেন তিনি। ধৃতরাষ্ট্রও বার বার বলছেন—এবার ফিরে যাও বাছা, আর কত দূর যাবে তুমি, যাও যাও।

গান্ধারীর হাত-ধরা কুন্তীকে যুধিষ্ঠির এবার বললেন—আপনি এবার ফিরে যান মা, আমি মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রকে আরও খানিকটা এগিয়ে দিই—অহং রাজানমন্বিষ্যে ভবতী বিনিবর্ততাম্‌। যুধিষ্ঠির বললেন—ঘরের বউরাও সব রয়ে গেছে, আপনি এবার তাদের নিয়ে ফিরে যান। আমি আরও কিছু দূর যাই মহারাজের সঙ্গে। যুধিষ্ঠিরের এই কথার পর গান্ধারীর হাতটি আরও শক্ত করে ধরলেন কুন্তী! চোখে তাঁর জল এল। তবু একেবারে আকস্মিকভাবে, যুধিষ্ঠিরের একান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে কুন্তী বললেন—আমার সহদেবকে যেন কখনও বকাঝকা কোরো না বাছা। সে বড় ভাল ছেলে, যেমন আমায় ভালবাসে, তেমনই তোমাকেও। তাকে সব সময় দেখে রেখো।

যুধিষ্ঠির কিছু বুঝতেও পারেননি। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীকে পৌঁছতে নয়, কুন্তীও যে তাঁদের সঙ্গে চলেছেন সব ছেড়ে, কিচ্ছুটি না বলে—সে-কথা যুধিষ্ঠির কিছু বুঝতেই পারেননি। কুন্তী এবার বললেন—আর তোমাদের বড় ভাই কর্ণকে সব সময় স্মরণে রেখো বাবা। আমারই দুর্বুদ্ধিতে তাকে একদিন আমি প্রতিপক্ষে থেকে যুদ্ধ করার অনুমতি দিয়েছিলাম। আর দেখো, আমার হৃদয় নিশ্চয়ই লোহা দিয়ে তৈরি। নইলে কর্ণকে না দেখেও এখনও যে সে হৃদয় আমার খান খান হয়ে যায়নি, তাতে বুঝি এ একেবারে লোহা। ব্যাপারগুলো এমনই হয়েছিল, আমার পক্ষে আরও ভাল করে কী-ই বা করা সম্ভব ছিল, বাছা। তবু সব দোষ আমারই, কেন না আমি কর্ণের সব কথা তোমাদের কাছে খুলে বলিনি—মম দোষো’য়মত্যর্থং খ্যাপিতো যন্ন সুর্যজঃ।

মনে রাখবেন—এই কথাগুলি কুন্তীর সাফাই গাওয়া নয় অথবা বনে যাবার শেষ মুহূর্তের স্বীকারোক্তিও নয় কিছু। কথাগুলি গভীর অর্থবহ। এই কথাগুলি পরে কুন্তী বলেছিলেন—আমার বাকি জীবন আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারীর সেবায় কাটিয়ে দিতে চাই-শ্বশ্রু-শ্বশুরয়োঃ পাদান্‌ শুশ্রূষন্তী সদা বনে। আগেই বলেছি, মহামহোপাধ্যায় যোগেন বাগচী কুন্তীর এই শ্বশুর-শাশুড়ি শুশ্রূষার মধ্যেই কুন্তীর চরিত্র-মাহাত্ম্য খ্যাপন করতে চেয়েছেন।

মহাজনের এই পদাঙ্কিত পথে আমি যে তেমন করে পা বাড়াতে পারছি না, তার একমাত্র কারণ কর্ণ। আমি আগে বলেছি যে, শৈশবে আপন পিতৃ-মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত কুন্তীর মধ্যে এমনিই এক মানসিক জটিলতা তৈরি হয়েছিল। সে জটিলতা আরও বাড়ে কন্যা অবস্থায় তথাকথিত এক অবৈধ সন্তানের জন্ম দিয়ে। বাবা-মার কাছে এ কথা বলতে পারেননি, স্বামীর কাছে বলতে পারেননি, ছেলেদের কাছে তো বলতেই পারেননি। এদিকে শ্বশুরকুল তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিচ্ছে না, অথচ প্রধানত যাঁর ভরসায় তাঁর শ্বশুরকুল তাঁরই প্রতিপক্ষভূমিতে দাঁড়িয়ে আছে, তিনিও তাঁর ছেলে, কর্ণ। তিনি এমনই সত্যসন্ধ যে, তাঁকে বলে কয়েও কিছু করা যায়নি। প্রতিপক্ষে দাঁড়িয়ে আছে তাঁর অন্য ছেলেরা এবং কুন্তী পূর্বাহ্নেই জানতে পারছেন—কর্ণ মারা যাবেন।

যে গভীর জটিলতার সূত্রপাত হয়েছিল যৌবনে, যার বৃদ্ধি ঘটেছিল বিধবার সমস্ত জীবনের অন্তর-গুপ্তিতে, সেই জটিলতা কর্ণের মৃত্যুতেও শান্ত হয়নি, বরং তা বেড়েছে। যে যুধিষ্ঠির জীবনে মায়ের মুখের ওপর গলা উঁচু করে কোনওদিন কথা বলেননি, সেই যুধিষ্ঠির রাগে সাপের মতো কুঁসতে ফুঁসতে জননীকে বলেছেন—তোমার স্বভাব-গুপ্তির জন্য আজ আঘাত পেলাম আমি–ভবত্যা গূঢ়মন্ত্ৰত্বাৎ পীড়িতো’স্মীত্যুবাচ তাম্। যুধিষ্ঠির জননীকে উদ্দেশ করে সমগ্র নারীজাতিকে শাপ দিয়েছিলেন—মেয়েদের পেটে কোনও কথা থাকবে না—সর্বলোকেষু যোষিতঃ ন গুহ্যং ধারয়িষ্যন্তি।

কুন্তী যুধিষ্ঠিরের কথার উত্তর দেননি, প্রতিবাদ করেননি, আপন মনে বকবকও করেননি। যুধিষ্ঠির কুন্তীকে বুঝি তখনও চেনেননি। আমি হলফ করে বলতে পারি—মেয়েদের পেটে কথা না থাকার অভিশাপ শত কোটি প্রগলভা রমণীর অন্তরে যতই ক্রিয়া করুক, মনস্বিনী কুন্তীর তাতে কিছুই হয়নি। এই যে রাজ্য-পাওয়া বড় ছেলে গলা উঁচু করে কর্ণের ব্যাপার নিয়ে অত বড় কথাটা বলল, তার প্রতিক্রিয়া কুন্তী মনের মধ্যে চেপেই ছিলেন। যুধিষ্ঠির রাজ্য পাওয়া মাত্রই তিনি রাজমাতার যোগ্য বিলাস ছেড়ে মন দিয়েছিলেন শ্বশুরকল্প ধৃতরাষ্ট্রের সেবায়। যুধিষ্ঠির বুঝতেও পারেননি নিস্তরঙ্গভাবে পুত্রদের দেওয়া ভোগ-সুখ থেকে অবসর নিলেন কুন্তী। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে দিনের পর দিন অন্তরে বৈরাগ্য সাধন করার ফলেই এত সহজে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বনে যাওয়ার ব্যাপারে। জলপান বা ভাত খাওয়ার মতো অতি সহজেই তিনি বলতে পারছেন—আমিও গান্ধারীর সঙ্গেই বনে থাকব বলে ঠিক করেছি।

লক্ষণীয় বিষয় হল—এই সহজ প্রস্থানের পথে তিনি আবারও সেই কর্ণের প্রসঙ্গ তুলছেন যুধিষ্ঠিরের কাছে, এমন একটা প্রসঙ্গ যা নিয়ে পুত্রের কাছে তিনি উচ্চৈঃস্বরে অভিযুক্ত হয়েছিলেন একদা পনেরো বছর আগে। কুন্তী সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করেননি, ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কাশী কিংবা বনে যাননি। কিন্তু পনেরো বছর তিনি যুধিষ্ঠিরের কথা মনে রেখেছেন, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া চেপে রেখেছেন নিপুণভাবে। যাবার আগে শুধু জবাবদিহির মতো করে কথাটা আবারও তুলছেন কুন্তী। বলেছেন—আমার হৃদয়টা লোহার মতো বাবা, নইলে কর্ণের মরণ সয়েও বেঁচে রইলাম কী করে? তবে ঘটনার প্রবাহ ছিল এমনই যে, আমি কী বা করতে পারতাম সেখানে—এবং গতে তু কিং শক্যং ময়া কর্তুম্‌, অরিন্দম।

কথাটার মধ্যে পনেরো বছরের অর্ত্নদাহ আছে, অভিমান আছে, জবাবদিহিও আছে। যুধিষ্ঠিরের কথাটা যে তিনি সেদিন মেনে নিতে পারেননি, তারই উত্তর দিচ্ছেন আজ পনেরো বছর পরে, বানপ্রস্থে যাবার পথে। অথচ বলার মধ্যে সহজ ভাবটা দেখবার মতো—সবই আমার দোষ, বাছা। তুমি ভাইদের নিয়ে তোমার বড় ভাই কর্ণের কথা সব সময় স্মরণে রেখো। তার মৃত্যু উপলক্ষ করে দান-ধ্যান কোরো।

কুন্তীর যাত্রা এবং বক্তব্যের আকস্মিকতায় যুধিষ্ঠির হতচকিত হয়ে গেছেন। তিনি কথাই বলতে পারছেন না—ন চ কিঞ্চিদুবাচ হ। পনেরো বছর আগে বলা কথার জবাবটা যে এইভাবে মায়ের বনবাস-যাত্রার মুখে এমন হঠাৎ করে ফিরে আসবে—এ তিনি ধারণাই করতে পারছেন না কথা আরম্ভ করার জন্য তাঁকে ভাবতে হল এক মিনিট—মুহূর্তমিব তু ধ্যাত্বা। দুশ্চিন্তায় আকুল হয়ে তিনি উত্তর দিলেন—এ তুমি কী বলছ মা! এ তুমি নিজে নিজে কী ঠিক করেছ? আমি যে কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার ওপর রাগ কোরো না তুমি—ন ত্বামভ্যনুজানামি প্রসাদং কর্তুমর্হসি।

মুহূর্তের মধ্যে যুধিষ্ঠির গুছিয়ে নিলেন নিজেকে। বললেন—মা! তুমিই না এক সময়ে আমাদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছিলে? বিদুলার গল্প বলে তুমিই যেখানে আমাদের এত উৎসাহ দিয়েছিলে, সেই তুমি কিছুতেই আমাদের ছেড়ে যেতে পারবে না—বিদুলায়া বাচোভিস্ত্বৎ নাস্মন্ সন্ত্যক্তুমর্হসি। কৃষ্ণের কাছে তোমারই বুদ্ধি পেয়ে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, রাজ্যও পেয়েছি তোমারই বুদ্ধিতে। সে বুদ্ধি এখন কোথায় গেল মা? আমাদের এত ক্ষত্রিয়ের ধর্ম উপদেশ দিয়ে এখন তুমি নিজেই তো সেই ধর্মের চ্যুতি ঘটাচ্ছ। আমাদের ছেড়ে, এই রাজ্য ছেড়ে, তোমার পুত্রবধূকে ছেড়ে কোথায় তুমি বনের মধ্যে গিয়ে থাকবে?

ছেলের কান্না-মাখা কথা শুনে কুন্তীর চোখে জল এল। তবু তিনি চলতে লাগলেন গান্ধারীর সঙ্গে। কুন্তীও কোনও কথার উত্তর দিলেন না দেখে ভীম ভাবলেন—মা বুঝি একটু নরম হয়েছেন। ভীম বললেন—তোমার ছেলেরা যখন রাজ্য পেল, যখন সময় এল একটু ভোগ-বিলাসে থাকার, তখনই তোমার এই অদ্ভুত বুদ্ধি হল কেন, মা—তদেয়ং তে কুততা মতিঃ! আর যদি এই বুদ্ধিই হবে তবে আমাদের দিয়ে যুদ্ধে এত লোকক্ষয় করালে কেন? বনেই যদি যাবে তবে সেই বালক-বয়সে আমাদের শতশৃঙ্গ পর্বতের বন থেকে কেন টেনে এনেছিলে এখানে? বারবার বলছি মা, কথা শোনো, বনে যাবার কল্পনা বাদ দাও, ছেলেদের উপায়-করা রাজলক্ষ্মী ভোগ করো তুমি, ফিরে চলো ঘরে।

কুন্তী ভীমের কথাও শুনলেন, কিন্তু বাড়ি ফিরবার লক্ষণ একটুও দেখা গেল না তাঁর মধ্যে। দ্রৌপদী-সুভদ্রা কত বোঝালেন কুন্তীকে, ছেলেরা সবাই কত করে বললেন ফিরে যেতে, কুন্তী বারবার তাঁদের দিকে ফিরে তাকান—যেন এই শেষ দেখা, আর চলতে থাকেন। সাশ্রুমুখে পুত্রদের দিকে বারবার তাকানোর মধ্যে কুন্তীর স্নেহানুরক্তি অবশ্যই ছিল—সা পুত্রান্‌ রুদতঃ সর্বান্ মুহুর্মুহুরবেক্ষতী। কিন্তু তাঁর চলার মধ্যে নিশ্চিত সিদ্ধান্তের শক্তি লুকানো ছিল। তিনি তাই থামছিলেন না। বস্তুত ওই শক্তিতে কুন্তী এবার চোখের জল মুছলেন, রুদ্ধ করলেন বাষ্পেদ্ভিন্ন স্নেহধারার পথ। কুন্তী নিজেকে শক্ত করে দাঁড়ালেন বনপথের মাঝখানে। প্রিয় পুত্রেরা তাঁকে যুক্তির জালে আবদ্ধ করেছে। প্রশ্ন করেছে—কেন তুমি পূর্বে আমাদের যুদ্ধে উৎসাহিত করে এখন বনে পালাচ্ছ। ছেলেদের এই প্রশ্নের জবাব দিয়ে যাবেন তিনি। কুন্তী দাঁড়ালেন। মুখে তাঁর সেই তেজ, সেই দীপ্তি।

কুন্তী বললেন—প্রশ্নটা তোমাদের মোটেই অন্যায় নয় যুধিষ্ঠির! সত্যিই তো, আমি তোমাদের চেতিয়ে দিয়েছিলাম। সেই সময়ে, যখন শত্রুর ওপর আঘাত হানায় তোমরা ছিলে কম্পমান—কৃতমুদ্ধৰ্ষণং পূর্বং ময়া বঃ সীতাং নৃপ। কেন অমনি করেছিলাম জান? জ্ঞাতিরা পাশাখেলায় তোমাদের সর্বস্ব হরণ করে নিয়েছে, সুখ বলে যখন কোনও কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তোমাদের, তখনই আমি তোমাদের উত্তেজিত করেছি—কৃতমুদ্ধৰ্ষণং ময়া। আমি তোমাদের উত্তেজিত করেছি এই কারণে, আমার স্বামী পাণ্ডুর ছেলেরা যাতে পৃথিবী থেকে মুছে না যায়, যাতে তাঁর বীর পুত্রদের যশোহানি না হয়।

এই কথাটার মধ্যে ভীমের প্রশ্নের জবাবও আছে। ভীম বলেছিলেন—বনেই যদি যাবে তবে পাণ্ডুর মৃত্যুর পর কেন আমাদের বন থেকে টেনে এনেছিলে এখানে—বনাচ্চাপি কিমানীতা ভবত্যা বালকা বয়ম্? কুন্তী জবাব দিয়েছেন স্বামীর ইতিকর্তব্যতার কথা মনে রেখে। বস্তুত পাণ্ডু অকালে মারা যাবার পর কুন্তী যখন বিধবা হলেন তখন অন্য ব্যক্তিত্বময়ী বিধবা রমণীদের মতো তাঁরও একমাত্র ধ্যান ছিল—কেমন করে তাঁর নাবালক ছেলেগুলিকে জীবনে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া যায়। এর জন্য মুনি-ঋষিদের ধরে পাণ্ডুর মৃতদেহ নিয়ে নাবালকদের হাত ধরে তিনি উপস্থিত হয়েছেন শ্বশুরবাড়িতে! ভূতপূর্ব রাজরানির প্রাপ্য সম্মান তিনি ধৃতরাষ্ট্রের কাছে পাননি, পেয়েছেন শুধুই আশ্রয়। সেই আশ্রয়ও নিরাপদ ছিল না। ভীমকে বিষ খাওয়ানো, বারণাবতে সবাইকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা—সব কিছু কুন্তী সয়েছেন এবং অপেক্ষা করেছেন সুদিনের। ছেলেরা ততদিনে মহাশক্তিশালী বীরের মর্যাদা পেয়েছে। রাজনীতিতে সমর্থন এসে গেছে কুন্তীর আসল বাপের বাড়ি বৃষ্ণি যাদবদের কাছ থেকে এবং বিবাহসূত্রে পাঞ্চাল দ্রুপদের কাছ থেকেও।

ধৃতরাষ্ট্র এই বিধবা মহিলার উচ্চাশা চেপে রাখতে পারেননি। চেষ্টা তিনি কম করেননি। কুন্তীকে যদি একটুও ভয় না পেতেন ধৃতরাষ্ট্র, তা হলে অন্তত বারণাবতে কুন্তী সহ পাণ্ডবদের পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করতেন না। যাই হোক, পাঞ্চালদের সঙ্গে বৈবাহিক যোগাযোগের পর এবং বারণাবতের ঘটনায় নিজের রাজ্যে নিজেরই মান বাঁচাতে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর অবাধ্য ছেলেদের ধৃতরাষ্ট্র রুখতে পারেননি। তাদের প্ররোচনায় পাশাখেলার ছলে পাণ্ডবদের সর্বস্ব নিয়ে বনবাসে পাঠান ধৃতরাষ্ট্র।

কুন্তী এই অন্যায় সইতে পারেননি। বাপের সম্পত্তির ভাগ তারা কিছুই পেল না, উলটে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ছেলেদের পাঠিয়ে দেওয়া হল বনে, কুন্তী এই অন্যায় সইতে পারেননি। স্বামীর অবর্তমানে নিজের কষ্টে প্রতিষ্ঠিত রোজগেরে ছেলেদের দেখে বিধবা মা যে সুখ পান, ঠিক সেই সুখই কুন্তী নিশ্চয়ই পেয়েছিলেন, যখন যুধিষ্ঠির রাজা হয়েছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। কিন্তু দুর্যোধন-ভাইদের জ্ঞাতি চক্রান্তে ছেলেদের যে রাজ্যনাশ হয়ে গেল, তখনও কুন্তী হাল ছাড়েননি। তিনি একা বসেছিলেন শ্বশুরবাড়িতে। বিদূরের কথায় যে তিনি শেষ পর্যন্ত ছেলেদের সঙ্গে বনে যাওয়া বন্ধ করে কুরুবাড়িতেই রয়ে গেলেন, তার কারণ বিদুরের মর্যাদারক্ষা যতখানি, তার চেয়েও বেশি তাঁর অধিকারবোধ—আমার শ্বশুরবাড়ি, আমার স্বামীর ঘর, আমার হক আছে থাকার, আমি রইলাম শুধু পাণ্ডুর উত্তরাধিকারিতার অধিকারে। রাজা পাণ্ডুর বংশ এবং উত্তরাধিকার যাতে মুছে না যায় কুরুবাড়ি থেকে—যথা পাণ্ডোর্ন নশ্যেত সন্ততিঃ পুরুষর্ষভাঃ—সেইজন্যই তিনি কুরুবাড়িতে একা জেগে বসেছিলেন এবং সময়কালে ছেলেদের উত্তেজিত করেছেন চরম আঘাত হানার জন্য—ইতি চোদ্ধৰ্ষণং কৃতম্‌।

কুন্তী বললেন—তোমাদের শক্তি কিছু কম ছিল না। দেবতাদের মতো তোমাদের পরাক্রম। সেই তোমরা চোখ বড় করে চেয়ে চেয়ে জ্ঞাতিভাইদের সুখ দেখবে আর নিজেরা বনে বসে বসে আঙুল চুষবে—সে আমি সইতে পারিনি বলেই তোমাদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছি—মা পরেষাং স্থাতব্যং তৎ কৃতং ময়া। যুধিষ্ঠির! মর্যাদায় তুমি দেবরাজ ইন্দ্রের মতো হয়েও তুমি কেন বনে বাস করবে, সেই জন্যই আমার উত্তেজনা। একশো হাতীর বল শরীরে নিয়েও ভীম কেন কষ্ট পাবে, সেই জন্যই আমার উত্তেজনা। ইন্দ্রের সমান যুদ্ধবীর হয়েও অর্জুন কেন নিচু হয়ে থাকবে—সেই জন্যই আমার উত্তেজনা। আর তোমরা এত বড় বড় ভাইরা থাকতে নকুল-সহদেব আমার বনের মধ্যে খিদেয় কষ্ট পাবে—এই জন্যই আমার উত্তেজনা।

কুন্তী এবার শেষ প্রশ্ন তুললেন সমগ্র রাজনীতির সারমর্মিতায়। বললেন—এই যে এই মেয়েটা, পাণ্ডবদের সুন্দরী কুলবধূ দ্রৌপদী। একে যখন সভার মধ্যে নিয়ে এসে অপমান করল সবাই, সকলে চুপটি করে বসে থাকল। পঞ্চস্বামীগর্বিত হয়েও সাহায্যের আশায় যাকে কাঁদতে হল অনাথের মতো, আমার শ্বশুরকুলের বড় মানুষেরা ব্যথিত হয়েও চুপ করে বসে থাকলেন। দুঃশাসন এসে তার চুলের মুঠি ধরল—এখনও ভাবলে আমার মনে হয় আমি অজ্ঞান হয়ে যাব—এরকম অসভ্যতা দেখেই আমি তোমাদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছি, শুনিয়েছি বিদুলার উদ্দীপক সংলাপ।

কুন্তী বলতে চান—পাণ্ডবদের যুদ্ধে উত্তেজিত করার মধ্যে তাঁর নিজের স্বার্থ কমই। ছেলেরা রাজ্য জিতে ভোগ-বিলাস এনে দেবে তাঁর কাছে আর তিনি বিলাস-ব্যসনে মজে থাকবেন, বসে বসে সুখ ভোগ করবেন—এই আশায় তিনি যুদ্ধের উত্তেজনা ছড়াননি ছেলেদের মধ্যে। কুন্তীর বক্তব্য—যুদ্ধের উত্তেজনার বিষয় এবং কারণ তাঁর ছেলেদের মধ্যেই ছিল, অর্থাৎ ঘটনা পরম্পরা যা চলছিল—যে অন্যায় যে অবিচার, তাতে বহু পূর্বে তাঁর ছেলেদেরই উত্তেজিত হওয়া উচিত ছিল। তাদের দিক থেকে অত্যন্ত উচিত এই প্রতিক্রিয়া যখন কুন্তী লক্ষ করলেন না, তখনই তাঁকে কঠিন কথা বলতে হয়েছে, বিদুলার মরণান্তিক কঠিন সংলাপ শোনাতে হয়েছে ছেলেদের। এর মধ্যে জননী হিসেবে তাঁর পাওয়ার কিছু নেই, যা প্রাপ্য তা তাঁর ছেলেদেরই, ঠিক যেমন যুদ্ধে উত্তেজিত হওয়ার কারণগুলিও ছিল তাদেরই একান্ত।

যুধিষ্ঠির এবং ভীমের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের উত্তরে কুন্তী তাঁর উত্তেজনা চেপে রাখতে পারেননি। যে প্রশ্ন করতে ছেলেদের লজ্জা পাওয়া উচিত ছিল, সেই প্রশ্ন যখন তারা কঠিনভাবেই করল, তখন উত্তর এসেছে অবধারিত কঠিনভাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, কুন্তী ছেলেদের রেখে বনের পথে পা বাড়িয়েছেন জীবনের মতো। কাজেই অভিযোগের উত্তর দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মনে নেমে আসছে প্রশান্তি, বনযাত্রার বৈরাগ্য।

কুন্তী বললেন—তোমাদের যে এত করে যুদ্ধ করতে বলেছিলাম, তার আসল কারণ কী জান? তোমাদের বাবা ছিলেন রাজা। তোমরা রাজার ছেলে। আমারই গর্ভজাত সন্তানদের হাতে পড়ে সেই মহাত্মা পাণ্ডুর রাজবংশ উচ্ছিন্ন না হয়ে যায়, সেই কারণেই আমি তোমাদের উৎসাহিত করেছি। জেনে রেখো, তোমরা নিজেরাই যদি নিরালম্ব অবস্থায় থাকে, তবে তোমাদের ছেলেরা, তোমাদের নাতিরা কোনওদিনই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে না—ন তস্য পুত্রাঃ পৌত্রা বা ক্ষতবংশস্য পার্থিব। কাজেই যা কিছু উৎসাহ-উদ্দীপনা তা তোমাদেরই কারণে, আমার নিজের ভোগসুখের জন্য কিছু নয়। ভাবতে পারেন কি—একটি সমৃদ্ধিশালী, সুপ্রতিষ্ঠিত বংশধারার জন্য কুন্তী কত আধুনিকভাবে লালায়িত!

ভীম বলেছিলেন—তোমার ছেলেরা এখন রাজ্য জিতেছে, সেই রাজসুখ এখন তোমার ভোগ করার কথা—যদা রাজ্যমিদং কুন্তি ডোক্তব্যং পুত্রনির্জিতম্‌—রাজমাতার প্রাপ্য সুখ যখন তোমার কাছে আমাদেরই পৌঁছনোর কথা, ঠিক তখনই তোমার এই বানপ্রস্থের ইচ্ছে হল? কুন্তী এই প্রশ্ন এবং পুত্র-নির্জিত রাজ্য-সুখের ভোক্তব্যতা নিয়ে যে অসাধারণ উক্তিটি করেছেন তা এই অতি বড় আধুনিক সমাজেও আমি অত্যন্ত সযৌক্তিক মনে করি।

কুন্তীর বক্তব্যের আগে আমি দুটো সামান্য কথা নিবেদন করে নিই। আমার সহৃদয় পাঠককুল আমাকে কুন্তীর বক্তব্যের সারবত্তা বোঝানোর সময় দিন একটু। আজকের দিনের অনেক কৃতী ছেলে বলে—পাশ্চাত্য সমাজ বড় ভাল। ওখানে যার যার, তার তার। ছেলে বড় হল, চাকরি করছে বউ নিয়ে আলাদা আছে। বাপ-মাও আলাদা আছে। শাশুড়ি-বউতে দিন-রাত কথা কাটাকাটি নেই, ভ্যাজর-ভ্যাজর নেই। ভারী সুন্দর ব্যবস্থা।

এই সুন্দর ব্যবস্থার মধ্যে আমি কিছু নিন্দনীয় দেখি না। ভারতবর্ষেও আজকাল তাই হচ্ছে। একান্নবর্তী পরিবারগুলি একে একে ভেঙে যাচ্ছে। বস্তুত এতেও আমি কিছু নিন্দনীয় দেখছি না। কারণ এমনটি হবেই। কিন্তু কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক পটভূমিকার দিকে তাকালে অনেক কিছু সহজে বোঝা যাবে। আমাদের অব্যবহিত পূর্বকালে যা দেখেছি, তাতে জমি সম্পত্তি এবং বসতবাড়ির একটা বিশাল ভূমিকা ছিল সমাজে। ছেলেরা বাপের সম্পত্তি পেত। বাবা যদি সম্পত্তির অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতেন, তা হলে শাশুড়ি দাপট দেখাতেন, পুত্র-পুত্রবধু নিগৃহীত বোধ করতেন। জমি-সম্পত্তির যুগ অতীত হয়ে যাবার পর যখন বাপ চাকরি করে, ছেলেও চাকরি করে সেই অবস্থায় শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়ার অনুপাত বোধ হয় সবচেয়ে বেশি। এই কাঠামোতে বাপ মারা গেলে মায়ের অবস্থা বড় করুণ। এই অবস্থায় পুত্রবধূ দাপট দেখায়, শাশুড়ি নিগৃহীতা বোধ করেন।

এখন দেখছি সমাজ অতি দ্রুত এই পারিবারিক ঝগড়াঝাটির নিষ্পত্তি ঘটিয়ে ফেলেছে। এখন বাপ চাকরি করতে করতেই ছেলের পড়াশুনো, তার ব্যবহারিক প্রতিষ্ঠার দিকে যেমন নজর রাখেন, তেমনই তাঁর অবর্তমানে তাঁর স্ত্রীর যাতে কোনও সমস্যা না হয়, তার ব্যবস্থাও করেন। অথবা বাপ যদি বেঁচেও থাকেন, তা হলে অবসরকালীন জীবনে বুড়োবুড়ি পুত্র-পুত্রবধূকে বাদ দিয়েও কীভাবে জীবন কাটাবেন, তার একটা অঙ্ক কষে নেন আগে থেকেই। অর্থাৎ তাঁরা আর পুত্রের উপার্জিত ধনে ভাগ বসাতে চান না। ভাবটা এই—আমরা বেঁচে থাকি, তোমরাও সুখে থাক, ঝগড়াঝাটি যেন না হয়, বাছা। আমরা প্রায় পাশ্চাত্য সমাজব্যবস্থার কাছাকাছি চলে আসছি।।

এতে ভাল হচ্ছে, কি মন্দ হচ্ছে—তা জানি না, তবে এ ব্যবস্থা আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারগুলির মধ্যেই চলতে পারে, অন্যত্র নয়। অন্যত্র সেই একই হাল—রোজগেরে ছেলে, পুত্রবধুর দাপট, বাবা-মা নাজেহাল। এর মধ্যে যদি আবার একজন স্বর্গত হন, তখন অন্যজনের অবস্থা হয়ে ওঠে আরও করুণ। তিনি মনে মনে কষ্ট পান, একান্তে বসে কাঁদেন। পুত্রবধূর তবু মায়া হয় না, অথচ এই অসহায় শাশুড়ি নামের ভদ্রমহিলাটি—কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে শ্বশুরই আগে স্বৰ্গত হন—নিজের ছেলেটিকে রেখে অন্যত্রও চলে যেতে পারেন না। কারণ মায়া-মোহ তো আছেই, সহায়-সম্বলহীনতাও আছে।

ঠিক এইরকম একটা পটভূমিকায় আমি কুন্তীর বক্তব্য পেশ করতে চাই। যদিও এখানে শাশুড়ি-বউয়ের কোনও ব্যাপারই নেই। যা আছে, তার নাম সংসার-চক্র। তবে মনে রাখা দরকার কুন্তীর বক্তব্যের একটা পটভূমিকা আছে। শাস্ত্র, কাব্য এমনকী সাধারণ মানুষের শেষ কথাটির মধ্যেও আমরা বুঝতে পারি যে, ভারতবর্ষ কোনওকালেই ভোগ-বিলাসের প্রশস্তি গায় না, তার প্রশস্তি বৈরাগ্যেই। এখানে অতি ভোগী মানুষেরও এক সময় মনে হয়—চাওয়ার আগুনে ইন্ধন জোগালে তার কোনও শেষ নেই, অতএব একটা কোথাও শেষ করতে হবে। এই দর্শন থেকেই ভারতবর্ষে আশ্রম-ব্যবস্থার জন্ম হয়েছিল। এই আশ্রম কিন্তু ঋষির আশ্রম নয়, আশ্রম-ব্যবস্থা।

চতুর্বর্ণের বিষম ব্যবস্থায় শত দোষ থাকতে পারে, তার অনেকটাই আমরা বুঝে নিয়েছি। এমনকী ব্রহ্মচর্য আশ্রমে ছেলেপিলেদের লেখাপড়ার সময়টা কেমন কাটানো উচিত, সে সম্বন্ধেও মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু এই সেদিনও কবি-ঋষি শান্তিনিকেতনে ছেলেপিলেদের লেখাপড়ার যে আয়োজন করেছিলেন, তার মধ্যে দোষ থাকলেও আনন্দের ভাগটা অন্যরকম। গার্হস্থ ব্যবস্থা নিয়েও আমার কোনও বক্তব্য নেই। কিন্তু মানুষ কতকাল গৃহস্থ অবস্থায় রতি-সুখ, সন্তান-সুখ ভোগ করবে, তার একটা সীমা ছিল। এই সীমার শেষ থেকেই বানপ্রস্থের আরম্ভ।

সাধারণ মতে সময়-সীমাটা পঞ্চাশ, কথায় বলে পঞ্চাশোর্ধ্বে বনং ব্রজেৎ। অর্থাৎ পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত দাম্পত্য এবং বাৎসল্য রস উপভোগ করে বেরিয়ে পড়ো ঘর থেকে। কথাটা বলা সহজ, কিন্তু কাজে খুব কঠিন। কারণ ততদিনে পঞ্চাশোর্ধ্ব বুড়ো-বুড়ির মধ্যে অন্যতর এবং আরও গাঢ়তর এক ঘনিষ্ঠতা জন্মে যায়; দিন যত যায় বাৎসল্যরসও ঘনীভূত হয় ততই। এই অবস্থায় ঘর ছেড়ে বেরনো বড় কঠিন। সেকালেও এটা কঠিন ছিল। স্বয়ং মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রই বেরতে পারেননি এবং পারেননি বলেই নিজের বংশনাশ তাঁকে বড় কাছ থেকে দেখে যেতে হয়েছে। কিন্তু বেরনোর নিয়মটা ‘থিওরেটিক্যালি’ ছিলই। কবিশ্রেষ্ঠ কালিদাস বড় গৌরব করে রঘুবংশীয় নৃপতিদের কথা উল্লেখ করে বলেছেন যে, যৌবনকালে তাঁরা বিষয়-সুখ চাইতেন বটে, কিন্তু বুড়ো বয়স হলেই তাঁরা বনে চলে যেতেন—বার্ধকে মুনিবৃত্তীনাং যোগেনান্তে তনুত্যজাম্।

দেখুন, কবিরও মমতা ছিল। তিনিও পঞ্চাশোর্ধ্বে বনে যেতে বলেননি; বলেছেন বুড়ো বয়সে—বার্ধকে মুনিবৃত্তীনাম্। এইটাই কথা—ঘর থেকে বেরতে হবে। তা একটু বয়স বেশিই হোক, কিন্তু বেরতে হবে। আসলে পুত্র এবং পুত্রবধূকে সংসারে প্রতিষ্ঠিত দেখেই বেরনো ভাল, তাতে পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে সম্পর্ক থাকে মধুর, মনটা থাকে অসুয়াহীন—ভালয় ভালয় বিদায় দে মা আলোয় আলোয় চলে যাই। তা অনেকে পুত্রকে প্রতিষ্ঠিত দেখা মাত্রই বেরতে পারেন না, কারণ নাতি-নাতনির জন্য নিম্নগামিনী স্নেহধারায় আরও কিছু কাল কাটে। বাস্তববাদী কবি-ঋষিরা তাতেও আপত্তি করেননি। ভাবটা এই—যতদিন সম্মান নিয়ে আছ, ততদিন থাকো, কিন্তু সম্মানের অসম্ভাবনা মাত্রেই বেরিয়ে পড়। দুঃখের বিষয়—আজ আর কেউ বনে যায় না। গেলে, অনেক পারিবারিক অশান্তির নিরসন হয়ে যেত।

আপনারা স্বয়ং ব্যাসদেবের কথাটাই স্মরণ করুন। তাঁর মা সত্যবতী কুরুবংশের ধারা রক্ষার জন্য অত্যন্ত বিব্রত ছিলেন। মহারাজ শান্তনুর ঔরসে আপন গর্ভজাত পুত্র দুটির মৃত্যু তাঁকে দেখতে হয়েছে। তারপর অতিকষ্টে পূর্বজাত পুত্র ব্যাসকে বুঝিয়ে দুই পুত্রবধূ অম্বিকা এবং অম্বালিকার গর্ভে দুটি নিয়োগজাত সন্তান পেয়েছিলেন। কুরুবংশের দুই অঙ্কুর—ধৃতরাষ্ট্র এবং পাণ্ডু। অন্ধত্বের জন্য ধৃতরাষ্ট্র রাজা হতে পারলেন না। রাজা হলেন পাণ্ডু। কিন্তু সেই সিংহাসনস্থ পাণ্ডুর মৃত্যুও সত্যবতী দেখতে বাধ্য হলেন। আর কত?

হস্তিনাপুরে যেদিন পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ হয়ে গেল, সেদিন ত্রিকালদর্শী ব্যাস জননী সত্যবতীকে সাবধান করে দিয়ে বললেন—সুখের দিন অতিক্রান্ত হয়ে গেছে মা, যে সময় আসছে তোমার পক্ষে তা মোটেই ভাল নয়—অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ। ব্যাস আরও বললেন—মা! পৃথিবী তার যৌবন হারিয়ে ফেলেছে, সামনের সমস্ত দিনই পাপে আর কষ্টে ভরা—শ্বঃ শ্বঃ পাপিষ্ঠ-দিবসাঃ পৃথিবী গতযৌবনা।

‘পৃথিবী গতযৌবনা’—মহাকবির ব্যঞ্জনা যাঁরা বোঝেন না, তাঁদের কী করে বোঝাব—এটা কত বড় কথা। আসলে প্রত্যেক মানুষের জীবনে যতদিন যৌবনকাল, যতদিন কর্মক্ষমতা, এই পৃথিবীও তার কাছে ততদিন যুবতী। কিন্তু মানুষের প্রৌঢ়ত্বের সঙ্গে পৃথিবীও প্রৌঢ়া হয়ে যায়, মানুষের বৃদ্ধত্বে পৃথিবীও বৃদ্ধা। অর্থাৎ ততদিনে সেই পৃথিবী আমার সন্তান বা সন্তানকল্পদের কাছে যুবতী রূপে ধরা দেয়। ওঁরা বলেন, জেনারেশন গ্যাপ’ আমরা বলি—তুমি যত বুড়ো হবে, তোমার পৃথিবীও তোমার সঙ্গে বুড়ি হবে, তুমি আর মেলাতে পারবে না। তোমার যুবক সন্তানের যুবতী পৃথিবীর সঙ্গে, তোমার বুড়ো বয়সের বুড়ি পৃথিবী মিলবে না। ব্যাস তাই বললেন—পৃথিবী গতযৌবনা। চলো মা এবার বনে গিয়ে মনের সুখে ঈশ্বরচিন্তা করবে।

কুন্তীর মনে আছে এসব কথা। মনে আছে বৃদ্ধা দিদি-শাশুড়ি তাঁর দুই শাশুড়ি অম্বিকা এবং অম্বালিকার হাত ধরে বনে চলে গিয়েছিলেন। যুবতী পৃথিবী রয়ে গেল অন্ধ যুবক ধৃতরাষ্ট্রের হাতে। তারপর কুরুক্ষেত্রবাহিনী গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। কুন্তী তাঁর শ্বশুরের শিক্ষায় নিজেই চলে যাচ্ছেন বনে। যুবতী পৃথিবী রইল তাঁর যুবক পুত্রদের হাতে। তাঁর তো আর কিছু করার নেই। ভীম বলেছিলেন—ছেলেরা তোমার রাজ্য পেয়েছে, সেই রাজ্য তুমি মনের সুখে ভোগ কর। কুন্তী সদর্পে উত্তর দিয়েছেন—রাজসুখ! রাজসুখ আমি অনেক ভোগ করেছি, পুত্র! আমার স্বামীর যখন সুখের দিন ছিল, তখন তাঁর রাজত্বে রাজরানি হয়ে রাজ্যসুখ আমি অনেক ভোগ করেছি—ভুক্তং রাজ্যফলং পুত্র ভর্তুর্মে বিপুলং পুরা। টাকা-পয়সা খরচা করার অজস্র স্বাধীনতা তিনি আমায় দিয়েছিলেন, অনেক অনেক দান করেছি আমি, তিনি কোনওদিন বাধা দেননি। আর আনন্দ! স্বামীর সঙ্গে একত্রে বসে সোমরস পান করেছি—পীতঃ সোমো যথাবিধি। আর কী চাই?

কুন্তীর কথাগুলির মধ্যে যেমন এক বিশাল ব্যক্তিত্ব আছে, তেমনই অধিকার-বোধের মর্যাদা।। বস্তুত কুন্তীর মতো একজন বিদগ্ধা রমণী যে জীবনবোধের কথা বলেছেন, সে জীবনবোধ যদি আমাদের থাকত তা হলে সংসারের অনেক বিপন্নতা এবং অসহায়তা থেকেই আমরা মুক্তি পেতাম। এ-কথাটা আপনারা মানবেন কিনা জানি না, আমি অন্তত মানি যে, স্বামীর অধিকারে স্ত্রীর যত মর্যাদা, পুত্রের অধিকারে তত নয়। পুত্র যদি অনেক গুণে গুণীও হন, তবুও নয়। বৈষ্ণব কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বলা শৃঙ্গার রস ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন—‘দোঁহার যে সমরস ভরতমুনি জানে।’ অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য রসটা হল সমরস, দু’জনেই সে রসের সমান অংশীদার। এই মমতার সূত্রেই স্বামীর জীবিতকালে স্ত্রী যে অধিকার বোধ করেন, স্বেচ্ছায় যা দান-বিতরণ করতে পারেন, স্বামীর অবর্তমানে পুত্রের জমানায় সে অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকে না। সমরস নয় বলেই তখন ব্যবহারে সংকোচ আসে। তা ছাড়া ততদিনে পুত্রের জীবনেও যেহেতু অন্যতরা এক সমরসিকার আবির্ভাব হয়, তাই জননীকে পূর্বতন স্মৃতি নিয়েই কাটাতে হয়। আর কুন্তীর মতো ব্যক্তিত্বময়ী রমণী হলে সেই পূর্বতন স্মৃতি নিয়েই তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন—তাতে মর্যাদা অক্ষুণ্ণ থাকে।

সেকালের ক্ষত্রিয়া রাজমহিষীদের মদ্যপানে বাধা ছিল না। এখানে কুন্তী পাণ্ডুর সঙ্গে একসঙ্গে বসে মদ্যপান করতেন—অথবা সোমকে যদি মদ্য নাই বলেন, তবে একসঙ্গে বসে সোমসুধা পান করতেন—এই কথাটা এখানে খুব বড় কথা নয়। এখানে সোমপানের ব্যঞ্জনাটা হল—তাঁরা একত্রে জীবনের চূড়ান্ত আনন্দও ভাগ করে নিতেন। কুন্তীর আনন্দের ভাণ্ডার সেদিনই পূর্ণ হয়ে গেছে। আজ স্বামীর অবর্তমানে পুত্রনির্ভর আনন্দে কুন্তীর তত ভরসা নেই, বরঞ্চ সংকোচ আছে, কেন না তাঁর কাছে এখন তাঁর পৃথিবী গতযৌবনা। বরঞ্চ ক্ষত্রিয়া বন্ধু এবং রাজরমণীর মর্যাদায় বিদুলার কথা বলে তিনি যে স্বামীর অবর্তমানেও পুত্রদের স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, এইটুকুই ক্ষত্রিয় বিধবার পক্ষে যথেষ্ট। পুত্রদের দেওয়া রাজ্যসুখে আজ আর তাঁর কোনও আকাঙ্ক্ষাই নেই—নাহং রাজ্যফলং পুত্ৰা কাময়ে পুত্র-নির্জিতম্‌। রাজ্যসুখ তিনি স্বামীর আমলেই যথেষ্ট ভোগ করেছেন, এখন কোনও অগৌরবের ছোঁয়ায় সেই পূর্বতন গৌরব যাতে কলুষিত না হয়, সেইজন্যই আজ কুন্তীর এই অপ্রত্যাশিত বানপ্রস্থ।

স্বামীর মৃত্যুর পর কতগুলি অসহায় বালককে নিয়ে তিনি হস্তিনায় এসেছিলেন। সেই দিন থেকে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত কুন্তী তাঁর ভাশুরঠাকুর ধৃতরাষ্ট্রের কাছে করুণা পাননি। আজ যখন বৃদ্ধ অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র, সহায়সম্বল সব গেছে, তখন কুন্তী অসীম করুণায় হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন শাশুড়ি-কল্প গান্ধারীর অসহায় হাতে। তিনি আজ এই দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে নিয়ে চলেছেন হাত ধরে বনের পথে। স্বামীকে তিনি বেশিদিন ইহলোকে পাননি, তাঁর অবর্তমানে স্বামীর রক্ত-মাংস যাঁর দেহে-কোষে আছে, সেই ধৃতরাষ্ট্রের সেবা করে তিনি খানিকটা স্বামীসেবার সান্ত্বনা পেতে চান। ছেলেদের বলেছেন দৃঢ় সংকল্পে—ফিরে যাও বাছারা—নিবর্তস্ব কুরুশ্রেষ্ঠ। জীবনের শেষ কটা দিন ধৃতরাষ্ট্র আর গান্ধারীর মতো শ্বশুর-শাশুড়ির সেবা করে আমি আমার পতিলোকে যাত্রা করতে চাই।

কুন্তী চলে গেলেন। সদর্পে মাথা উঁচু করে চলে গেলেন। যুধিষ্ঠির ভীম—এঁরা যেন একটু লজ্জাই পেলেন—ব্রীড়িতা সন্ন্যবর্তন্ত। ধৃতরাষ্ট্র-গান্ধারী অবশ্য কুন্তীকে ফিরে যাওয়ার জন্য অনেক বোঝালেন, কিন্তু কুন্তী ফিরলেন না। ফিরলেন না, কারণ, আমার ধারণা, সেই শ্বশুর ব্যাসদেবের কথা কুন্তীর মনে আছে—পৃথিবী গতযৌবনা। ফিরলেন না, কারণ কুমার যুধিষ্ঠির পুত্রশোকার্তা ক্ষত্রিয়া জননীকে কর্ণের কথা বলে একবার হলেও অতিক্রম করেছে। এই অতিক্রম যে বারবার ঘটবে না তার কী মানে আছে—পৃথিবী গতযৌবনা। তাঁর সময় চলে গেছে। কুন্তী যে দৃঢ়তা নিয়ে পুত্রদের যুদ্ধে উত্তেজিত করেছিলেন, সেই দৃঢ়তা নিয়েই আজ বনে চলে গেলেন।

অগত্যা যুধিষ্ঠির তার ভাইদের নিয়ে, কৃষ্ণা-পাঞ্চালীকে নিয়ে ফিরে এলেন হস্তিনায়। মা চলে গেছেন, রাজকার্যে তাঁদের মন বসে না। কিছুদিন যাবার পরেই যুধিষ্ঠির লোক-লস্কর সঙ্গে নিয়ে ভাই, বউ আত্মীয় পরিজন সঙ্গে নিয়ে চললেন বনের পথে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। কুন্তীরা তখন সবাই শতযূপ মুনির অরণ্য আশ্রমে থাকেন। পাণ্ডবরা লোকমুখে খবর নিতে নিতে শতযূপের আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। তপস্বী বালকেরা বনের মধ্যে রাজপুরুষ, পাইক-বরকন্দাজ দেখে অবাক হয়ে গেল। যুধিষ্ঠির তপস্বী বালকদের শুধোলেন—আমরা যে শুনেছিলাম এখানেই আছেন তাঁরা। কাউকেই তো দেখছি না। বালকেরা বলল—এই তো যমুনায় গেছেন জল আনতে, পুজোর জন্য ফুল তুলতে।

পাঁচ ভাই পাণ্ডব সঙ্গে সঙ্গে চললেন যমুনার দিকে। দেখলেন—বৃদ্ধা কুন্তী এবং গান্ধারী কলসী কাঁখে জল নিয়ে ফিরছেন যমুনা থেকে। সঙ্গে সুস্নাত ধৃতরাষ্ট্র। মাদ্রীপুত্র কনিষ্ঠ সহদেব তো শিশুর মতো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন কুন্তীকে—সহদেবস্তু বেগেন প্রাধাবদ্‌ যত্র সা পৃথা। আমি আগেই বলেছি—কুন্তী এই সপত্নী পূত্রটিকে কত ভালবাসতেন। সহদেব কুন্তীকে জড়িয়ে ধরে যত কাঁদেন, কুন্তী ও ততই কাঁদেন। সাশ্রুকণ্ঠে সানন্দে আর কোনও বীরপুত্রের কথা না বলে গান্ধারীকে তিনি খবর দেন—আমার সহদেব এসেছে, দিদি, সহদেব এসেছে। পাণ্ডবরা একে একে সবাই কুন্তীর কাছে এলেন, তাঁদের কাঁখের কলসী তুলে নিলেন নিজের মাথায়। সবাই ফিরে এলেন শতযূপের আশ্রমে। মুহূর্তের মধ্যে মুনির অরণ্য আশ্রম হস্তিনাপুরের রূপ নিল। আরও আনন্দের খবর এল—কুরু-পাণ্ডব-বংশের বিধাতা মহাভারতের কবি মহামুনি ব্যাসও যুধিষ্ঠিরের সংবাদ পেয়ে উপস্থিত হয়েছেন শতযূপের আশ্রমে।

মহামতি ব্যাসের আজ অন্যরূপ। নিজেরই পুত্র-প্রপৌত্র, পুত্রবধূরা সব এক জায়গায়। ধৃতরাষ্ট্র-কুন্তী-গান্ধারীকে তপস্যার কুশল জিজ্ঞাসা করে বললেন—কী চাও তোমরা বলো। আজ আমি আমার যোগসিদ্ধির ঐশ্বর্য দেখাব। বলো কী চাও? ব্যাস বুঝতে পারছিলেন—ধৃতরাষ্ট্র এবং গান্ধারী এই নির্জন বনে এসে যত তপস্যাই করুন, তাঁদের মনে এখনও কাঁটার মতো ফুটে আছে শত-পুত্রের শোক। ব্যাসের কথা শুনেই ধৃতরাষ্ট্র কেঁদে ফেললেন। গান্ধারী ধৃতরাষ্টের মনের কথা কেড়ে নিয়ে দ্রৌপদী, সুভদ্রা, সবার মন বুঝে বললেন—এতই যদি আপনার দয়া, তবে আমার মতো অভাগা রমণীদের, যাদের পুত্র গেছে, স্বামী গেছে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধে, তাঁদের স্বামী-পুত্রদের একবার দেখান না দয়া করে।

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কুন্তীর মনের মধ্যে বিদ্যুৎশিখার মতো ভেসে এল কর্ণের প্রতিচ্ছবি, চিরকালের লুকিয়ে রাখা সূর্য-সম্ভবা দীপ্তি—কর্ণ, সেও কি লুকিয়ে রাখা যায়? একবার কি কুন্তী অসাড়ে অস্পষ্টভাবে উচ্চারণও করে ফেলেছিলেন কর্ণের নাম? কেন না ব্যাসের বিশেষণ দেখছি—দূরশ্রবণদর্শনঃ—যিনি দূরের কথা শুনতে পান, মনের ছবি দেখতে পান। ব্যাস কুন্তীকে দেখলেন বড় মনমরা। স্পষ্ট করে জিজ্ঞাসা করলেন—কুন্তী! বলো তুমি। তোমার মনে কীসের কষ্ট; খুলে বলো আমায়।

এই মুহূর্তে কুন্তীকে আমরা দেখছি আত্মনিবেদনের পরম পরিসরে। কুন্তী বললেন—আপনি আমার সাক্ষাৎ শ্বশুর। দেবতার দেবতা। আমার এই চরম সত্যের স্বীকারোক্তি আমার দেবতাদের দেবতাকে আমি শোনাতে চাই——স মে দেবাতিদেবস্ত্বং শৃণু সত্যাং গিরো মম।

আমার সহৃদয় পাঠককুল। আমি আগেই আপনাদের জানাই—কুন্তী কর্ণের কথা বলবেন! মনে রাখবেন—এখানে তাঁর পুত্র যুধিষ্ঠির বসে আছেন, যে যুধিষ্ঠির মাকে মৃদু অভিশাপ দিয়েছিলেন কর্ণের কারণে। মনে রাখবেন, এখানে তাঁর স্বামীজ্যেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্র আছেন, গান্ধারী আছেন, আছেন কুলবধূরা—যাঁরা শাশুড়ির কীর্তি শুনে ছ্যা-ছ্যা করতে পারেন। কুন্তী আজ সবার সামনে, বিশেষত দেবকল্প শ্বশুর ব্যাসের সামনে নিজের চরম স্বীকারোক্তি করছেন। প্রথমজন্মা সূর্যসম্ভব যে পুত্রটি তাঁর সারা জীবনের পুলক-দীপ্তি হয়ে থাকতে পারত, তাকে সারা জীবন লুকিয়ে রাখার যন্ত্রণা তাঁকে পাপের মতো পুড়িয়ে মারে। যে সারা জীবন পাপের মতো করে অন্তরে লুকিয়ে ছিল, তাকেই আজকে কুন্তী দেখতে চান এবং দেখাতে চান সবার সামনে, প্রাণ ভরে, প্রথম পুত্রের সম্পূর্ণ মর্যাদায়।

এই ঘটনাটা আমি কুন্তীর জীবনে অসীম গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। জীবনের আরম্ভে প্রথম যৌবনের রোমাঞ্চের দিনে যাঁকে দিয়ে কুন্তী প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেয়েছিলেন, সারা জীবন তাঁকে মনের মধ্যে লুকিয়ে রেখে আজ তিনি তাঁকে সর্বসমক্ষে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন। পাঁচ ভাই পাণ্ডবকে স্বরাজ্যে প্রতিষ্ঠা করা তাঁর কাছে যতখানি ছিল, এ তার থেকেও বেশি—আপন মাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা, প্রথমজন্মা পুত্রের প্রতিষ্ঠা। কুন্তী যাঁকে দিয়ে জীবন আরম্ভ করেছিলেন আজ শেষের দিনে তাঁকেই দেখতে চাইছেন। পরম প্রিয় স্বামী নয়, পুত্রদাতা দেবতাদের নয়, যাঁকে দিয়ে কুন্তী নিজের গর্ভের মধ্যে দ্বিতীয় সত্তার আনন্দ পেয়েছিলেন প্রথম, কুন্তী তাঁকেই শেষের দিনে দেখতে চাইছেন, দেখতে চাইছেন কর্ণকে। হয়তো এইজন্যই, এই মাতৃত্বের প্রতিষ্ঠার জন্যই কুন্তী পঞ্চ পুণ্যবতী রমণীর মধ্যে একতমা—অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তী তারা মন্দোদরী তথা। এর পরেও কে তাঁকে কুলঙ্কষা বলে তিরস্কার করবে?

কুন্তী বললেন—আপনি তো জানেন, সেই ঋষি দুর্বাসা কেমন করে ছিলেন আমার ঘরে। কেমন করে আমি তাঁর সেবা করেছি। সেই যুবতী বয়সে তাঁর ওপরে রাগের কারণ অনেক ছিল আমার, কিন্তু আমি ক্রুদ্ধ হইনি। আমি যে তাঁর কাছে বর নিয়েছি, তাও তাঁর শাপের ভয়ে, আমি নিজে কোনও বর চাইনি। তিনি দেবতার আহ্বান আর সঙ্গমের মন্ত্র দিলেন আমার কানে। তখন আমার কী বা বয়স, যৌবনের স্পষ্টাস্পষ্ট রহস্য জানতে গিয়ে আমি সেদিন আহ্বান করে বসলাম দেব দিবাকরকে। আমার মূঢ় হৃদয়ের কৌতুহলী আহ্বান সত্য করে দিয়ে হঠাৎ তিনি এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। বিশ্বাস করুন—আমি তখন কাঁপছিলাম। কত কেঁদে পায়ে ধরে বলেছিলাম—তুমি চলে যাও এখান থেকে—গম্যতামিতি। কিন্তু গেলেন না, শাপের ভয়, ধ্বংসের ভয় দেখিয়ে নিজের দীপ্ত তেজে আমাকে আকুল করে আমাতে আবিষ্ট হলেন তিনি—ততো মাং তেজসাবিশ্য মোহয়িত্বা চ ভানুমান্‌। হায়! তারপর সেই গৃঢ় জাত প্রথমজন্মা পুত্রকে আমার জলে ভাসিয়ে দিতে হল। সূর্যের প্রসন্নতায় আমি যেমন অনূঢ়া কন্যাটির মতো ছিলাম, তাই হলাম আবার।

তবু, কিন্তু তবু, সেদিন আমার সেই ছেলেটিকে—যাকে আমি আমার ছেলে বলে জেনেও অবহেলা করলাম, ভাসিয়ে দিলাম জলে, তার জন্য আমার শরীর মন সব সময় জ্বলে-পুড়ে যাচ্ছে। আপনি বোঝেনও সে কথা—তন্মাং দহতি বিপ্রর্ষে যথা সুবিদিতং তব। এতক্ষণ সম্পূর্ণ স্বীকারোক্তি জ্ঞাপন করে কুন্তী এবার তাঁর কৃতকর্মের ন্যায়-অন্যায় যাচাই করতে চাইছেন। কুন্তী জানালেন—সব আপনাকে বললাম। আমার পাপ হয়েছে, না হয়নি, আমি তার কিছু জানি না। আমি শুধু আমার সেই ছেলেকে একবার দেখতে চাই—তং দ্রষ্টুমিচ্ছামি ভগবন্‌—আপনিই তাকে দেখাতে পারেন।

অসামান্য দীর্ঘদর্শিতার কারণে ব্যাস জানেন যে, কন্যা অবস্থায় পুত্রজন্মের জন্য কুন্তীর চরিত্রে পাপের স্পর্শ লেগেছিল কি না—এই প্রশ্ন কুন্তীকে যেমন সারা জীবন কুরে কুরে খেয়েছে, তেমনই এই প্রশ্ন অন্যদের মনেও আছে। কুন্তীর কথার উত্তরে ব্যাস প্রথম বললেন—তোমার কোনও দোষ ছিল না কুন্তী—অপরাধশ্চ তে নাস্তি। আর দোষ ছিল না বলেই পুত্রের জন্মের পরেও তুমি দেবতার আশীর্বাদে পূর্বের সেই কন্যাভাব আবারও লাভ করেছ। আসলে কী জান—দেবতারা ওই রকমই। তাঁদের অলৌকিক সিদ্ধি আছে, অতএব ওইভাবেই তাঁরা মনুষ্যশরীরে আবিষ্ট হন। তাঁদের এই অলৌকিক দেহ-সংক্রমণ সত্ত্বেও তুমি যেহেতু অন্য মানুষের মতোই মনুষ্যধর্মেই বর্তমান, সেই হেতু তোমার কোনও দোষ এখানে নেই। ভাবটা এই—যদি দোষ থাকে তবে সেই দেবতার। তবে সঙ্গে সঙ্গে ব্যাস তাঁর এই ভাব-ব্যঞ্জনা শুদ্ধ করে দিয়ে বলেছেন—আসলে কারওই দোষ নয় কুন্তী—অসামান্য দৈব তেজে বলীয়ান ব্যক্তির দোষ সাধারণের মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না, বড় মানুষের সবই ভাল, সবই শুদ্ধ। আর তোমার কী দোষ, তুমি আগেও যা ছিলে, দেবসঙ্গমের পরেও তাই ছিলে—সেই লজ্জারুণা কন্যাটি—কন্যাভাবং গতা হ্যসি।

প্রশ্নের মীমাংসা হল। মীমাংসা করলেন মহাভারতের হৃদয়-জানা কবি, মীমাংসা করলেন ঋষি-সমাজের মূর্ধন্য-ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত কন্যা-সত্যবতীর জাতক পারাশর কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব। ব্যাস উত্তর দিলেন মানে, প্রশ্নের সমাধান সবারই হয়ে গেছে। এইবার মৃতজনদের সামনে নিয়ে আসার জন্য আপন যোগেশ্বর্য প্রকট করবেন ব্যাস। তিনি ভাগীরথীতে স্নান করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে মৃত প্রিয়জনদের আহ্বান করলেন আবাহন মন্ত্রে। ভাগীরথীর তীরে তুমুল কোলাহল শোনা গেল—কর্ণ, দুর্যোধন, অভিমন্যু, দ্রৌপদীর পাঁচ ছেলে, দুঃশাসন, শকুনি, ঘটোৎকচ সবাই সশরীরে দেখা দিলেন। ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী, দ্রৌপদী, সুভদ্রা—সকলে আনন্দে অভিভূত হয়ে পড়লেন।

লক্ষণীয় বিষয় হল—এই যে মৃত ব্যক্তিরা সব ব্যাসের তপঃসাধনে ভাগীরথী তীরে সশরীরে উপস্থিত হলেন, এঁদের কারও মনে কোনও গ্লানি নেই, ক্রোধ নেই, অসূয়া নেই, ঈর্ষা নেই—নির্বৈরা নিরহংকারা বিগতক্রোধমৎসরাঃ। অত্যন্ত স্বাভাবিক রাজকীয় মর্যাদায় তাঁদের দেখা যাচ্ছে। যেমন তাঁদের বেশ-ভূষা, তেমনই ভাস্বর তাঁদের শরীর-সংস্থান। জীবিত অবস্থায় যে মহাবীরের যেমন বেশ ছিল, যেমন ছিল তাঁদের রথ, বাহন, ঠিক তেমনই রথে চড়ে, ঘােড়ায় চড়ে রাজপুত্তুর সব উপস্থিত হলেন মায়ের সামনে, পিতার সামনে, প্রিয়তমা পত্নীর সামনে।

এমন করে কুন্তী কর্ণকে কোনওদিন দেখেননি। এমনভাবে, এমন সহানুভূতির মহিমায় কোনওদিন কুন্তী কর্ণকে এমন দেখেননি। পুনর্জীবিত অবস্থায় কর্ণকে কুন্তী দেখলেন অন্য এক মূর্তিতে। ভাগীরথীর তীরে কর্ণকে দেখা মাত্রই পাঁচভাই পাণ্ডবরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে ধেয়ে গেলেন তাঁর দিকে—সম্প্রহর্ষাৎ সমাজগ্মুঃ। পরস্পরকে স্বাভাবিক ভ্রাতৃস্থানে পেয়ে ভারী খুশি হলেন তাঁরা—ততস্তে প্ৰীয়মানা বৈ কর্ণেন সহ পাণ্ডবাঃ।

ঠিক এইরকম একটা দৃশ্যই তো কুন্তী সারাটা জীবন ধরে পরম কামনায় দেখতে চেয়েছেন। পাঁচ ভাই নয়, ছয় ভাই যেন এই অনন্ত সৌহার্দে বাঁধা পড়ে—এই তো কুন্তীর চিরকালের বাসনা শ্বশুর ব্যাসের করুণায়—চিত্রং পটগতং যথা—এই পরম ঈঙ্গিত ছয় ভাইয়ের মিলন দেখে কুন্তীর সব আশা পূরণ হয়ে গেল। টীকাকার নীলকণ্ঠ লিখেছেন—এই দৃশ্যকে স্বপ্ন বলা যাবে না, কেন না তা হলে বলতে হবে ব্যাস ‘ম্যাজিক’ দেখাচ্ছেন। মোহ বা ভ্রান্তিও বলা যাবে না, কারণ ঋষি-চূড়ামণি ব্যাস আপন বিদ্যায় এবং তপস্যার মাহাত্ম্যে এই নিস্পাপ প্রত্যক্ষ মনুষ্য-রূপ দেখাচ্ছেন। বস্তুত কুন্তী যে ব্যাসের বিদ্যায় পুত্রকে স্বরূপে দেখতে চেয়েছিলেন, তা শুধু এই অসামান্য দৃশ্যটির জন্য। মহাভারতের কবি এ কথা লেখেননি যে, কর্ণকে দেখামাত্র কুন্তী ছুটে গেছেন তাঁর কাছে। লিখেছেন—ভাইরা সানন্দে ছুটে গেছেন তাঁর কাছে। কুন্তী তো এইটাই দেখতে চেয়েছে সারা জীবন ধরে। তাঁর কন্যা অবস্থার প্রচ্ছন্নজাত পুত্রটি স্নেহের সরণিতে কোনওমতেই যে বিধিসম্মত পুত্রদের থেকে আলাদা নয়, সেই প্রতিষ্ঠাই তাঁর জীবনের প্রতিষ্ঠা।

বস্তুত এই অসম্ভব এবং অসামান্য এক চিত্রকল্পের পর আমার দিক থেকে কুন্তীর জীবনের আর কোনও ঘটনা জানানোর ইচ্ছে নেই। মহাভারতকে পৌরাণিকেরা ‘ইতিহাস’ বলেন। কুরু-পাণ্ডববংশের সার্থক ঐতিহাসিক হিসেবে এরপর ব্যাসকে লিখতে হয়েছে পাণ্ডবদের হস্তিনায় ফিরে যাওয়ার কথা। লিখতে হয়েছে—কেমন করে যাবার সময় পাণ্ডব-কনিষ্ঠ সহদেব কুন্তীকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলেছিলেন—মা! এই অরণ্য আশ্রমে তোমায় ফেলে রেখে কিছুতেই আমি হস্তিনায় ফিরে যাব না। লিখতে হয়েছে—নির্জন বৈরাগ্য সাধনের জন্য কীভাবে কুন্তী সহদেবকে সাশ্রু বিদায় দিয়েছেন। এমনকী লিখতে হয়েছে—প্রজ্জ্বলিত দাবানলে তপোনিষ্ঠ কুন্তীর মৃত্যুর কথাও।

কিন্তু কেন জানি না—ওই ভাগীরথী-তীরে কর্ণকে পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে মিলিত দেখার ঘটনাই আমার কাছে কুন্তীর জীবনের শেষ দৃশ্য বলে মনে হয়। পরেরটুকু মহাকাব্য নয়, ইতিহাস। সমস্ত মহাভারতের মধ্যে প্রায় কোনও অবস্থাতেই কুন্তীকে আমরা নিশ্চিন্ত এবং আনন্দিত দেখিনি। সেই কন্যা অবস্থায় রাজপ্রাসাদের অলিন্দে রক্তিম সূর্যকে দেখে কুন্তীকে আমরা সানন্দ-কুতুহলে যৌবনের আহ্বান জানাতে দেখেছিলাম। আর আজ এই ভাগরথীতীরে তাঁর প্রথমাজন্মা পুত্রের প্রত্যক্ষ প্রতিষ্ঠায় কুন্তীকে আমরা সানন্দমনে তপস্যার পথে পা বাড়াতে দেখলাম। ব্যাসকে তিনি বলেছিলেন—পাপ হোক পুণ্য হোক আমি আমার সেই ছেলেকে একবার দেখতে চাই। কিন্তু কর্ণের ওই ভ্রাতৃমিলনের পর কুন্তীকে এখন আমরা অনন্ত বৈরাগ্যময় এক বিশাল বিশ্রামের মধ্যে পরিতৃপ্ত দেখতে পাচ্ছি, যে দুধের ছেলেটিকে কুন্তী জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সেই জল বাহ্যত অশ্বনদীর হলেও কুন্তীর অন্তরবাহিনী ফল্গু নদীতে কর্ণ চিরকাল ভেসে চলেছেন। আজ ব্যাসের ইচ্ছায় সেই অন্তর-ফল্লুর বালি খুঁড়ে কুন্তী কর্ণকে তুলে আনলেন সবার সামনে। এর পরে আর তাঁর পাবার কিছু নেই। যাঁকে প্রথম দিনে পেয়েছিলেন অসীম কৌতুকে ছলনায়, আজ শেষের দিনে তাঁকেই পেলেন আন্তর প্রতিষ্ঠায়, পরম প্রশান্তিতে। এখন তাঁর কোনও পাপবোধ নেই, জবাবদিহি নেই, শান্ত সুস্থভাবে এখন তিনি ছেলেদের বলতে পারেন—তোমরা প্রকৃতিস্থ হও বাছারা—স্বস্থা ভবত পুত্রকাঃ। তোমরা ফিরে যাও, আমাদের আর আয়ু বেশি নেই—তস্মাৎ পুত্ৰক গচ্ছ ত্বং শিষ্টমল্পং চ নঃ প্রভো।