কর্ণ – ৮

কর্ণের কবচ-কুণ্ডল দানের মাহাত্ম্যে আমরা আপাতত কিঞ্চিত আপ্লুত বটে, তবে সঙ্গে সঙ্গে এও মনে রাখতে হবে যে, যিনি প্রতিহিংসাপরায়ণ বীর তিনি সাময়িকভাবে ধর্মে-কর্মে মন দিলেও তাঁর মৌলিক চরিত্র একেবারে পালটে যায় না। দেবালয়ে দেবমূর্তির সামনে দাঁড়ালে অতি ক্রুর মানুষেরও যেমন চক্ষুদুটি শিবায়িত হয়, তেমনি এই দানব্রতের সত্যরক্ষার তাগিদে কর্ণের চুড়ান্ত দানও কর্ণকে খানিকটা গম্ভীরতা দিল বটে, কিন্তু এতে তাঁর মূল স্বভাব সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হল না। হবেই বা কেন? রাজসভার রাজনীতিও রয়েছে, দুর্যোধনও রয়েছেন, পরম শত্রু অর্জুনেরাও বেঁচে আছেন। বরঞ্চ রাজসভায় ‘টেনশন’ এখন অনেক বেশি। পাণ্ডবদের অজ্ঞাতবাস শেষ হয়ে আসছে, অথচ গুপ্তচরেরা এ বন, সে বন তন্ন তন্ন করে খুঁজে এসে খবর দিল যে পাণ্ডবদের কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্যোধন যদি বা চরদের কথা শুনে, তাদের নিষ্ঠা সত্ত্বেও অসহায়তার কথা বুঝে বিমনা হয়ে পড়ছিলেন, কিন্তু এই অবস্থাতেও কর্ণ দমে যাবার পাত্র নন। তেরো বছর পরে পাণ্ডবেরা ফিরে এসে আবার রাজ্য চাইবে এবং তা পেয়েও যেতে পারে—এ যেন কর্ণেরই দুশ্চিন্তা। তাঁর ধারণা, আরও ভাল করে খোঁজা দরকার পাণ্ডবদের। পাঠানো দরকার আরও ধূর্ত গুপ্তচর, যারা নদীর তীর থেকে আরম্ভ করে পর্বতের গুহা, সব একেবারে চষে ফেলবে। কর্ণের মতো যে দুর্যোধনের যুবগোষ্ঠী সম্পূর্ণ মেনে নেবে, তাতে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু ভীষ্ম দ্রোণেরা পাণ্ডবদের ফিরিয়ে আনার পক্ষেই রায় দিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে নতুন একটা ঘটনা ঘটল।

দুর্যোধনের চরেরা পাণ্ডবদের খবর দেবার সঙ্গে সঙ্গে ‘সুখবর’ মনে করে আরও একটা খবর দিয়েছিল। তারা বলেছিল বিরাটরাজার প্রবল পরাক্রান্ত সেনাপতি কীচক কোন এক গন্ধর্বদের হাতে মারা গেছে। এই কীচক যেহেতু দুর্যোধনের বন্ধুরাজ্য ত্রিগর্তদেশের রাজাকে বারবার যুদ্ধে নাকাল করেছে, তাই কীচক মারা যেতে বিরাটরাজার ওপর প্রতিশোধ নেওয়াটা এখন সুবিধেজনক। কাজেই ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ যখন পাণ্ডবদের প্রত্যাবর্তনের তর্কে নানা মতামত ব্যক্ত করছেন, তখন ত্রিগর্তের রাজা স্বয়ং সে-কথাগুলি চাপা দিয়ে বিরাটরাজ্য আক্রমণের প্রস্তাব দিলেন। কীচকহীন অসহায় বিরাটরাজাকে আক্রমণ করে কী পরিমাণ ধন-রত্ন, অশ্ব-গজ, গোধন পাওয়া যেতে পারে, সেই সম্ভাবনার কথাই ত্রিগর্তরাজ তুলে ধরলেন। মতামত চাইলেন দুর্যোধন প্রভৃতি ভাইদের এবং কর্ণের—কৌরবানাঞ্চ সর্বেষাং কর্ণস্য চ মহাত্মনঃ। প্রস্তাবের অনুকূলেও যিনি প্রথম কথা বললেন, তিনি কর্ণ। নতুন এক যুদ্ধোদ্যোগের হঠাৎ সুযোগ আসায় কর্ণ পাণ্ডবদের বিষয়ে তাঁর দৃঢ় মত পালটালেন। বললেন—সেই ভাল, বিরাটরাজ্য আক্রমণ করে ভালমন্দ ধনরত্ন আহরণ করাই ভাল। পাণ্ডবদের কথা পরে ভাবা যাবে, অথবা এখন অর্থহীন, বলহীন, সহায়হীন পাণ্ডবদের কথা ভেবেই বা আমাদের কী হবে—কিঞ্চ নঃ পাণ্ডবৈঃ কার্যং হীনার্থবলপৌরুষৈঃ।

কর্ণের কথা শোনা মাত্রই দুর্যোধন বিরাটরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যাত্রার আদেশ দিলেন—বৈকৰ্ত্তনস্য কর্ণস্য… বাক্যম্ আদায় তস্য তৎ। কর্ণ জানতেন, এটা পাণ্ডবদের ব্যাপার নয় বলেই অন্তত বিরাটরাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রায় ভীষ্ম-দ্রোণ প্রভৃতি বৃদ্ধদের অমত হবে না এবং সেইজন্যই এই বিষয়ে তিনি তাঁদের মতো চেয়েওছেন। একটা গোটা রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে—সেই সিদ্ধান্তটা কিন্তু শুধুমাত্র কর্ণের সমর্থনবাক্যেই ‘পাস’ হয়ে গেল। ত্রিগর্তরাজ প্রথমে বিরাটরাজ্য আক্রমণ করলেন কিন্তু সে যুদ্ধে ছদ্মবেশী পঞ্চপাণ্ডব এমন যুদ্ধ করলেন যে তাঁর যুদ্ধবাসনা ঘুচে গেল। কিন্তু তিনি যেতে না যেতেই কৌরবেরা সবাই মিলে আক্রমণ করলেন বিরাটরাজ্য। বিরাটের প্রায় অজ্ঞাতেই, কুমার উত্তরের সঙ্গে রণক্ষেত্রে চলে গেলেন বৃহন্নলাবেশী অর্জুন। অর্জুনকে স্পষ্ট চিনে স্বয়ং দ্রোণাচার্য কৌরবদের উন্মাদনায় ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে নানা দুর্লক্ষণ দেখে আজ তিনি অর্জুনের হাতে হার একেবারে অবধারিত মনে করলেন।

কিন্তু এইখানে একটা কথা বলে নেওয়া দরকার। কুরু-পিতামহ ভীষ্ম, আচার্য দ্রোণ, কৃপ—এইসব বৃদ্ধদের সম্বন্ধে সকলের সামনেই অনেক অপমানজনক কটুক্তি করেছেন কর্ণ। বারংবার অপমানে এই বৃদ্ধেরা যেমন একদিকে নিজেদের মধ্যে গুটিয়ে যাচ্ছিলেন, অন্যদিকে কর্ণের সম্বন্ধে তাঁদের অসন্তোষও বাড়ছিল। কর্ণ মনে করেন, এই বৃদ্ধেরা আসলে পাণ্ডবদের পক্ষপাতী। ধৃতরাষ্ট্রের অন্ন খাওয়া সত্ত্বেও এঁরা যে তাঁর গুণমুগ্ধ হয়ে দুর্যোধনের সকল ক্রিয়াকলাপ নির্বিচারে প্রশংসা করেন না—এটা তাঁর মনে লাগে। নিরপেক্ষ বিচার, নীতি, যুক্তি—এগুলিও যে কখনও কাউকে পাণ্ডবদের পক্ষপাতী করে তুলতে পারে—এটা কর্ণের মাথায় আসে না। ফলে কর্ণ বারংবার বৃদ্ধদের অপমান করেছেন এবং খোদ কুরুসভাতেই এই ঘটনা বার বার হওয়ায় কুরুবৃদ্ধদের অসন্তোষ এখন প্রগাঢ় হয়েছে। কর্ণের কবচ-কুণ্ডল খোয়া যাবার পর থেকে এখন আর সে অসন্তোষ তাঁরা চেপেও রাখেন না। তাঁরা ভাবেন— কর্ণের প্রতিপত্তি দিন দিনই বেড়ে চলেছে স্বয়ং দুর্যোধনের আস্কারায়। তাঁদের যখন এমনিও সম্মান নেই, অমনিও নয়, তখন তাঁরাই বা সুযোগ পেলে এই পুরুষটিকে ছেড়ে দেবেন কেন? বিরাটরাজ্যের প্রত্যন্ত প্রদেশে উন্মুক্ত মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে গুরু দ্রোণ যখন মহাদেবের বর-পাওয়া, স্বর্গ-ফেরত অর্জুন সম্বন্ধে তাঁর আপন শঙ্কার কথা ব্যক্ত করলেন, তখন আবারও একবার অপমানের ভাষা বেরিয়ে এল কর্ণের মুখ থেকে। কর্ণ বললেন—অর্জুনের ওপর আপনার এত সোহাগ যে, সব সময় আমাদের খাটো করে দেখেন—সদা ভবান্ ফাল্গুনস্য গুণৈরস্মান্ বিকত্থসে। আরে! আমার সামনে কিংবা দুর্যোধনের সামনে অর্জুন পুরোপুরি দাঁড়াতেই পারবে না।

দুর্যোধন কিন্তু এইসব শৌর্যবীর্যের তুলনায় না গিয়ে কর্ণের কথার ধুয়া ধরে বললেন—দেখ বাপু! এ যদি অর্জুন হয়, তা হলে আমার পোয়া বারো। অজ্ঞাতবাসের সময় শেষ হয়নি। আবার বনে পাঠাব পাণ্ডবদের। আচার্য দ্রোণকে উদ্দেশ করে ভীষ্ম, কৃপ সবাইকে শুনিয়ে দুর্যোধন বললেন—আচার্য! আমি আর কর্ণ আগে বার বার বলেছি—ময়া কর্ণেন চাসকৃৎ—যে, অজ্ঞাতবাসের সময় পাণ্ডবদের খোঁজ পেলে তাদের আবার বনে যেতে হবে। তা ছাড়া এই সময়ে যুদ্ধ করতে যেই আসুন, বিরাটরাজা, কি অর্জুন, যুদ্ধ তো আমাদের করতেই হবে। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, এঁদের এত ত্রস্ত দেখাচ্ছে কেন? আপনারা খেয়াল রাখবেন যুদ্ধ ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই আমাদের। দুর্যোধনের এইটুকু আস্কারাতেই কর্ণ সরাসরি দ্রোণকে উপহাস করতে আরম্ভ করলেন। বললেন—বন্ধু ওই আচার্য দ্রোণকে বাদ দিয়ে যুদ্ধের নীতি-নিয়ম ঠিক কর। তুমি এঁদের মতো জান। এঁদের সবারই অর্জুনের ওপর বড় বেশি সোহাগ, আর সেইজন্যেই আমাদের তখন থেকে ভয় দেখাচ্ছেন—জানাতি হি মতং তেষামতস্ত্রাসয়তীহ নঃ। কীরকম সোহাগ বোঝ যে, অর্জুন সামনে আসতে না আসতেই তার প্রশংসা আরম্ভ হয়ে গেল। যেখানে শত্রুপক্ষের ঘোড়াব চিঁহি চিঁহি ডাক শুনেই—হ্রেষিতং হ্যুপশৃন্বানে—আচার্যগুরুর সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে, সেখানে আমাদের সৈন্যদের মনোবল না ভেঙে যায়, সেই ব্যবস্থাটা আগে কর, দুর্যোধন।

কর্ণের বক্রোক্তিতে মনে হল—দ্রোণাচার্য যেন সাধারণ সৈনিকের চেয়েও খারাপ। তাঁর যে ব্যক্তিগতভাবে উপযুক্ত শিষ্যের প্রতি শ্রদ্ধা থাকতে পারে, এটা তিনি বোঝেন না। কর্ণ সোজাসুজি দ্রোণকে অভিযুক্ত করে বললেন—এঁরা সবাই, বিশেষত এই আচার্য দ্রোণ, চিরটাকাল পাণ্ডবদের হয়ে গান গেয়ে গেলেন। এঁদের আপন পর বুঝ বলতে কিচ্ছুটি নেই, নইলে, ঘোড়ার ডাক শুনে কেউ শত্রুর প্রশংসায় মেতে ওঠে। আরে, এই যে সব দুর্লক্ষণ দেখা যাচ্ছে বলে দ্রোণ মন্তব্য করছেন, এর সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্ক কী, তাকে প্রশংসা করারই বা কী আছে? আসল কথা এই—যে সব দুর্লক্ষণ-ফুর্লক্ষণের কথা তখন থেকে বলে যাচ্ছেন দ্রোণ, এর মূলে আছে ওদের ওপর সোহাগ আর আমাদের ওপর জন্মের রাগ-অন্যত্র কামাদ্ দ্বেষাদ্ বা রোষাদ্ বাশ্মাসু কেবলম্। এই মুহুর্তে দ্রোণের ওপর কর্ণের এত রাগ হয়েছে যে, তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে দ্রোণকে কথা শোনালেন, যদিও তাঁর সামনে আছেন দুর্যোধন। কর্ণ বললেন—দুর্যোধন! এই আচার্যদের বড় মায়ার শরীর (ভাবটা এই—ব্যাটা যুদ্ধ-ফুদ্ধ কিস্‌সু বোঝে না—যুদ্ধধর্মানভিজ্ঞত্বমুক্তম্), এঁদের হিংসাবৃত্তি বলতে কিচ্ছুটি নেই। কাজেই তোমার সামনে যখন ভয় এসে উপস্থিত হবে, তখন অন্তত এই সমস্ত প্রাজ্ঞ-পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে যুদ্ধনীতি ঠিক কোরো না—নৈতে মহাভয়ে প্রাপ্ত সংপ্রষ্টব্যঃ কদাচন।

কর্ণ এবার ঘুরিয়ে দ্রোণাচার্যকে গালাগালিই দিতে আরম্ভ করলেন। তাঁর মতে দ্রোণের মতো লোকের যুদ্ধক্ষেত্রে কথা বলাই শোভা পায় না। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ হওয়ার দরুন দ্রোণাচার্যকে এবার সেইসব কথা শুনতে হল, যা তাঁকে এ পর্যন্ত কেউ বলেনি। কর্ণ বললেন—দুর্যোধন! এসব লোকের পণ্ডিতি কথা কোথায় মানায় জান? বড় বড় লোকের বড় বড় বাড়িতে, যেখানে অলসে আড্ডা চলে। সভাস্থলে, যেখানে বড় বড় কূট তর্ক হচ্ছে, নিদেনপক্ষে ধনীদের বাগানবাড়িতে, যেখানে রসের আলোচনা চলছে, সেখানে এই দ্রোণের মতো পণ্ডিত লোকের কথা বললে মানায়—কথা বিচিত্রাঃ কুর্বানাঃ পণ্ডিতাস্ত্রত্র শোভনাঃ। অথবা জনসমাজে যদি অলৌকিক ক্রিয়াকলাপ দেখাতে হয়, এই বামুনগুলোকে মানায় সেখানে। যজ্ঞ, অস্ত্রশিক্ষা, সন্ধি করার নিপুণতা—এসব ব্যাপারে এই বামুন-পণ্ডিতেরা খুব উপযুক্ত। তা ছাড়া পরের দোষ বার করতে দাও, মনুষ্য চরিত্রে কোথায় স্থলন ঘটল, সেটা বার করতে দাও, কোন বামুন কার বাড়িতে ভাত খেয়ে নিজের অন্নদোষ ঘটাল, সেটা বার করতে দাও—এই সব পণ্ডিত খুব পারবে—পরেষাং বিবরজ্ঞানে মনুষ্যচরিতেষু চ। অন্নসংস্কারদোষে পন্ডিতাস্তত্র শোভনাঃ।

কর্ণের শেষ প্রস্তাব ছিল দ্রোণের মতো লোককে সোজা উপেক্ষা করে—পণ্ডিতান্ পৃষ্ঠতঃ কৃত্বা—নিজের মতো চাপানো। ব্যাপারটা পুরানো। কর্ণ দুর্যোধনের মনস্তত্ত্ব বোঝেন। যে দ্রোণাচার্য আপন সরসতায় অর্জুনের প্রশংসা করে ফেলেছেন, তাঁকে এই মুহূর্তে গালাগালি দিয়ে নিজের মত, সে মতো যত উদ্ধতই হোক, চাপিয়ে দিতে যে কর্ণের অসুবিধে হবে না, সে তিনি ভালই জানেন এবং জানেন বলেই কর্ণ নিজের মতটা কী সুকৌশলে উপস্থাপন করলেন দেখুন। কর্ণ বললেন-আরে! আমাদের সেনারা সব ভিতুর মতো দাঁড়িয়ে আছে কেন—ভীতান্ সুন্দ্রস্তান্ ইব লক্ষয়ে। আরে অর্জনই আসুক আর বিরাটই আসুক—সমুদ্রের উে এসে যেমন তীরভূমিতে আটকে যায়—তারাও তেমনি আমার সামনে এসে থমকে দাঁড়াবে ; আমি একা তাদের সামাল দেব—অহম্ আবারয়িষ্যামি বোলেব মকরালয়ম্। সাপের বিষ যেমন ব্যর্থ হয় না, আমার বাণও তেমনি ব্যর্থ হবার নয়, সব সুতীক্ষ্ণ শরগুলি একেবারে ঘিরে ধরবে অর্জুনকে। এই তেরো বৃচ্ছর ধরে অর্জুন নিশ্চয়ই অপেক্ষা করে আছে। আমাকে সে মারবারও চেষ্টা করবে প্রচুর। শুনেছি বটে যে তিনি ভুবনের সেরা বীর, কিন্তু আমিও তো কিছু কম যাই না—অহঞ্চাপি নরশ্রেষ্ঠআদ্ অর্জুনান্নাবরঃ ক্কচিৎ। এদিক ওদিক থেকে আমার বাণ যখন অজস্রধারায় চলবে, আর শকুনের পাখার মতো শন শন শব্দ হবে, তখন অর্জুনের বোধ হবে যেন আকাশ ভরে গেছে জোনাকের আলোতে। আরে যুদ্ধে আমার সামনে দাঁড়াবে এমন পুরুষ এখনও স্বর্গে-মর্ত্যে পয়দা হয়নি। আজকে আমি অর্জুনকে মেরে দূর্যোধনকে যে কথা দিয়েছিলাম, সেই কথা রাখব এবং ঋণমুক্ত হব।

দুর্যোধনের প্রতি বশ্যতায় কর্ণ এখন নিজেকে এত বড় ভাবছেন যে, অর্জুনের মতো মহাবীরকে তিনি ভাবছেন গরুড়ের কাছে সাপের মতো, প্রবল বারিবর্ষণের মুখে জ্বলন্ত অগ্নির মতো। নিজের বুক বাজিয়ে কর্ণ বলছেন—আমি সেই পরশুরামের শিষ্য। তাঁর শিক্ষা, আর আমার ক্ষমতা—এই দুটোর জোরে আমি অর্জুন কেন, অর্জুনের বাবাকেও ঠাণ্ডা করে দিতে পারি—যুধ্যেয়মপি বাসবম্। অর্জুনের কপিধ্বজ রথের মাথায়-বসা কপিটি আজকে কাঁদতে কাঁদতে কাটা পড়বে, অর্জুনকে আজ আমি রথ থেকে মাটিতে ফেলে ছাড়ব—বীভৎসুং পাতয়ন্ রথাৎ। কৌরবেরা দেখুক আজকে, কেমন করে সেই অর্জুন তার ভাঙা রথ থেকে নেমে অকর্মণ্য দাম্ভিকের অক্ষম চেষ্টায় শুধু আহত সাপের মত ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে—নিঃশ্বসন্তং যথা নাগমদ্য পশ্যন্তু কৌরবাঃ।

কর্ণ যা বললেন এতক্ষণ, তা নিজেদের সৈন্যদলের মনোবল উত্তেজিত করতে যতখানি, তার চেয়ে অনেক বেশি আপন অহমিকা প্রকাশ করতে ; বিশেষত অর্জুন যেখানে প্রতিপক্ষ, সেখানে এইরকম একটা কাল্পনিক মাহাত্ম্যে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে কর্ণের ভাল লাগে। কিন্তু তাঁর এই উত্তেজনা বা অহমিকা অন্যেরা কতদিন সহ্য করবেন? আগেই বলেছি, সেই পাশাখেলার আসর থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ক্রমাগত অপমানিত হতে হতে এখন আর বৃদ্ধেরা কর্ণের সব কথাবার্তা চুপ করে মেনে নিতে পারছেন না। অতএব কর্ণের এই মৌখিক আড়ম্বরের উত্তরে কৃপাচার্য আর চুপ করে থাকতে পারলেন না। বস্তুত কৃপাচার্যের কথাই ছিল কর্ণের বিরুদ্ধে বৃদ্ধদের প্রথম সংহত প্রতিবাদ। কৃপ বললেন—এই যে রাধামায়ের ছেলে কর্ণ! কূটযুদ্ধে তোমার যে খুব বুদ্ধি খেলে সে আমরা বেশ বুঝি। (কৃপ কপট পাশা খেলার দিকে ইঙ্গিত করলেন)। তবে এই ক্রুর যুদ্ধের মূলও তুমি বোঝো না, পরিণামও বোঝ না। তোমার শকুনি মামার শাস্ত্রমতে যেসব কপট যুদ্ধ করেন, সে কপটতা আরও অনেক কিসিমে করা যায় ; তবে কী জান, ভদ্রলোকেরা ওই ধরনের যুদ্ধকে বড়ই জঘন্য মনে করেন। কোথায় যুদ্ধ করছি, তা বুঝলাম না, কোন সময়ে যুদ্ধ করছি, তা বুঝলাম না, যুদ্ধ করলেই হল? দেশ-কাল বুঝে যুদ্ধ করলেই তবে না জয় আসে, নইলে উলটো ফল হবে যে। ব্যাপারটা কী জান কর্ণ! যুদ্ধের জন্য যে রথ বানায়, সে যোদ্ধা পুরুষকে অতিশয়োক্তি করে বলে যে, এই রথে চড়ে যুদ্ধ করলে আপনি দেব্‌তাদেরও ঠাণ্ডা করে দিতে পারবেন, কিন্তু রথকারের অতিশয়োক্তির ওপর নির্ভর করে তো আর বুদ্ধিমান লোকেরা কাজ করে না, তেমনি তোমার ওই বড় বড় আত্মম্ভরি ‘হ্যাঁন্ করেঙ্গা ত্যান্ করেঙ্গা’র ওপর আস্থা রেখে, দেশ-কাল এবং আপন বলাবল কিছুই না বুঝে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে নেমে পড়ব, এটা হয় না।

কৃপ কর্ণের আত্মম্ভরি বক্তৃতা অনেকক্ষণ শুনেছেন। এবার তাই তিনি একটা তুলনা-প্রতিতুলনার জায়গায় এসে বলতে থাকলেন—দেখ কর্ণ! তুমি বেশি সাহস দেখিয়ো না—কর্ণ মা সাহসং কৃথাঃ। একটু চিন্তা করে দেখলেই বুঝতে পারবে যে, আমরা গুষ্টি-শুদ্ধু একা অর্জুনের সঙ্গে নাও এঁটে উঠতে পারি—পরিচিন্ত্য তু পার্থেন সন্নিপাতো ন নঃ ক্ষমঃ। অর্জুন একসময় একাই সমগ্র কুরুদেশ রক্ষা করেছে, একাই খাণ্ডব বন পুড়িয়েছে, একাই সুভদ্রাকে হরণ করে কৃষ্ণকে পর্যন্ত দ্বৈরথে আহ্বান জানিয়েছে এবং একাই তুষ্ট করেছে কিরাতরূপী মহাদেবকে। তারপরেও একটু ভেবে দেখ। অর্জুন একাই সম্পূর্ণ জয়দ্রথের বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে অপহৃতা দ্রৌপদীকে ফিরিয়ে এনেছে। বেশি দূরে নয়, এই বনেই। সমগ্র উত্তর দিকটা অর্জুন একাই দিগ্‌বিজয়ে জিতে এসেছিল। কৃপাচার্য এই কথাটা বলেই ভাবলেন কর্ণ হয়তো এবারে উত্তর দিতে পারেন যে, দিগ্‌বিজয় তো তিনিও করেছেন। তাই কৃপাচার্য এবার কর্ণকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলতে লাগলেন—কর্ণ! গন্ধর্ব চিত্রসেনের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে তুমি পালিয়ে বেঁচেছিলে, সেই চিত্রসেনের সঙ্গে অর্জুন কিন্তু একাই লড়ে গেছেন। তাঁর সেনাবাহিনীকেও অর্জুন একাই পর্যুদস্ত করেছিলেন অথচ সেই সেনাবাহিনীই তোমার রথ ভেঙে, ঘোড়া মেরে তোমাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে অনেক দূরে তাড়িয়ে ছেড়েছিল।

কৃপাচার্য এবার কর্ণের দিকে প্রতিতুলনার আঙুল তুলে বললেন—তুমি কি বলতে পার, কর্ণ, কোন কাজটা তুমি এমন একা একাই করেছ—একেন হি ত্বয়া কর্ণ কিন্নামেহ কৃতং পুরা। একা একা যুদ্ধ করব। এমন আশ কোরো না। এ যেন হাতের আঙুল দিয়ে ক্রুদ্ধ সাপের বিষদাঁতে আক্রমণ করা। পাণ্ডবদের অপমান আর ক্রোধের ঘি মাখা রয়েছে তোমার শরীরে, কাজেই তোমার পক্ষে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করা মানে—গায়ে চপচপে করে ঘি মেখে, সূক্ষ্ম কাপড় পরে অর্জুন নামে সেই জ্বলন্ত আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলা। তুমি আর বেশি সাহস দেখিয়ো না, গলায় পাথর বেঁধে হাত দিয়ে সাঁতার কেটে অর্জুন-সমুদ্র পার হবার চেষ্টা কোরো না। আমাদের দ্বারা এই তেরো বচ্ছর অপমানিত হয়ে অর্জুন এখন বাঁধন-ছাড়া সিংহের মতো ফুঁসছে, সে আমাদের অবশেষ রাখবে না। তাই বলি কি, তুমি আর অর্জুনের সঙ্গে একা একা যুদ্ধ করার সাহস দেখিয়ো না। আমরা সবাই মিলে যুদ্ধ করব, দ্রোণ, ভীষ্ম, অশ্বথামা, দুর্যোধন, তুমি, আমি—সবাই মিলে সেই যুদ্ধশূর অর্জুনের সঙ্গে লড়াই করি—সহ যুধ্যামহে পার্থম্। তুমি যে বলেছিলে—কৌরবেরা সব গোধন নিয়ে চলে যাক, আর আমার একার যুদ্ধ দেখুক কৌরবেরা—যুদ্ধং পশ্যত মামকম্-ওই বড়াইটা আর না করলে, বেশি সাহস দেখিয়ো না-কর্ণ মা সাহসং কৃথাঃ।

দ্রোণের ছেলে অশ্বত্থামা কৃপের কথাও শুনেছেন, কর্ণের কথাও শুনেছেন। এই অশ্বত্থামাকে আগে আমরা দুর্যোধনের যুবগোষ্ঠীতে কর্ণ, দুঃশাসনের সঙ্গে অনেকবার নানা আলোচনায় অংশ নিতে দেখেছি। কিন্তু পাশাখেলায় পাণ্ডবদের সস্ত্রীক চরম অপমানের পর অশ্বত্থামা বোধহয় দুর্যোধন এবং কর্ণের সব যুক্তি মেনে নিতে পারছিলেন না। বিশেষ করে তাঁর বাবা দ্রোণাচার্য কর্ণের কাছে বারবার যেভাবে অপমানিত হচ্ছিলেন, তাতে মাঝে মাঝেই অশ্বত্থামার ধৈৰ্য্যচ্যুতি ঘটছিল। অশ্বত্থামা নিজে বড় মাপের বীর, কর্ণও তাই। কিন্তু যে কষ্ট তাঁর পিতাকে অপমান করছেন বারংবার, যে কর্ণ সর্বজনবন্দিত আচার্যগুরুকে অভিযুক্ত করছেন নিমকহারামির দায়ে, তাঁর সঙ্গে অশ্বত্থামা থাকেন কী করে? তিনি তাই কর্ণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেন। অশ্বত্থামা বললেন—তোমার লজ্জা জিনিসটা বড় কম, কর্ণ। যুদ্ধবীরেরা অনেক যুদ্ধ জিতেও পরের ধন নিজের নগরে নিয়ে গিয়েও এত বকবক করে না, আর এখানে তো তুমি এখনও বিরাটরাজার গরুগুলিও জিতে আননি, তাঁর রাজ্যের সীমাও পেরোওনি, হস্তিনাপুরেও এখনও ফিরে যাওনি, অথচ কী হামবড়াইটাই না তখন থেকে করে যাচ্ছ। দেখ, আগুন মেলা বকবক না করেও •শরীর পুড়িয়ে দেয়, সূর্যদেব বিনা বাক্যেই তাপ দান করেন। এঁরা যখন বিনা কথায়, নিশ্চুপে এত বড় বড় কাজ করে ফেলতে পারছেন, সেখানে তুমি কিন্তু বকেই যাচ্ছ, অথচ তুমি এখনও কিছুই করনি। বীর পুরুষেরা ন্যায় অনুসারে, সারা পৃথিবী জয় করে এসে, গুণহীন গুরুকেও সৎকার করার চেষ্টা করে, আর তোমরা অন্যায় পাশাখেলায় পাণ্ডবদের জয় করেছ, তাতেও হয়নি, এখন আবার গুরুকেও নিন্দা করছ। পাশাখেলার বাজিতে রাজ্যসম্পদ জয় করে কোনও ভদ্র ক্ষত্রিয় কি সন্তুষ্ট থাকতে পারে? আর তেমনি হয়েছে এই নচ্ছার নির্লজ্জ ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেগুলো, যারা নাকি ব্যাধের মতো শঠতায় শুধু ফাঁদ পাতার জন্য বসে আছে—নিকৃত্যা বঞ্চনাযোগৈশ্চরন্ বৈতংসিকো যথা।

পিতৃনিন্দায় অশ্বত্থামা এতই রেগে গেছেন যে, মাতুল কৃপাচার্যের কথার সূত্র ধরে তিনি কর্ণকে ‘চ্যালেঞ্জ’ জানিয়ে বললেন—একটা, মাত্র একটা যুদ্ধের কথা বলতো, যেখানে অর্জুনকে তুমি একা জয় করেছ—কতমদ্ দ্বৈরথং যুদ্ধং যত্রাজৈষীদ্ ধনঞ্জয়ম্। ওই নকুল, সহদেব—যাদের তুমি একরত্তি পোঁছ না, সেই তাদেরই বা তুমি কী করতে পেরেছ, কী করতে পেরেছ ভীমকে, কি যুধিষ্ঠিরকে? খুব তো দিগ্‌বিজয় করেছ বলে বড়াই করে বেড়াও, বলতে পারবে, অর্জুনেরা থাকতে কবে তুমি যুদ্ধ করে তাঁদের রাজধানী ইন্দ্রপ্রস্থ জয় করেছ—ইন্দ্রপ্রস্থং ত্বয়া কস্মিন্ সংগ্রামে বিজিতং পুরা? এই যে পঞ্চস্বামীর সোহাগিনী কৃষ্ণা, তাঁকেও কোনওদিন ক্ষাত্রবীর্যে যুদ্ধজয় করে জিতে আনতে পেরেছ? স্বয়ম্বর সভার পর যে যুদ্ধ হয়েছিল, তাতেও জেতনি, অন্য কোনও যুদ্ধও জেতনি। মাঝখান থেকে কুলবধূকে রজস্বলা অবস্থায় এক কাপড়ে রাজসভায় টেনে এনে ন্যায়-ধর্মের মুলটাই দিয়েছ উপড়ে। বেটা সারথির জাত! বদমাশ—দুষ্টকর্মন্—তুই কি ভেবেছিস দ্রৌপদীর সঙ্গে ওই জঘন্য ব্যবহারের পরেও অর্জুন তোকে ছেড়ে দেবে? তুই যে পণ্ডিতের মতো বড় বড় বাত দিয়ে যাচ্ছিস—ত্বং পুনঃ পণ্ডিতো ভূত্বা বাচং বক্তৃমিহেচ্ছসি—তোর সঙ্গে কি অর্জুনের তুলনা? দেবতা, মানুষ, গন্ধর্ব—এমন কেউ নেই যাকে অর্জুন ডরায়। দ্রোণ, কৃপ যে এতক্ষণ অর্জুনের প্রশংসা করেছেন, ঠিক করেছেন। সে তোর থেকে অনেক বড় যোদ্ধা—ত্বত্তো বিশিষ্টো বীর্যেণ। সত্যি কথা বলতে কি, অর্জুনের মতো এত বড় যোদ্ধা আর কে আছে—কো’র্জুনেন সমঃ পুমান্?

অশ্বত্থামা যে কর্ণকে এতটা গালাগাল করলেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়েও অর্জুনের এত প্রশংসা করলেন, এর কারণ আছে কতগুলো। অশ্বত্থামা জানতেন, তাঁর পিতা দ্রোণাচার্য পুত্রের পরেই কিংবা পুত্ৰাধিক যাকে স্নেহ করেন, তিনি হচ্ছেন ওই তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুন। অশ্বত্থামা সেটা বলেও ফেললেন। বললেন এইজন্যে যে, দ্রোণ যা কিছুই আগে বলে থাকুন সেটা প্রিয়ত্বের সম্বন্ধে বলেছেন, যুদ্ধের ভয়ে নয়। বস্তুত দ্রোণ, কৃপ এঁরা অনেক আগে থেকেই পাণ্ডবদের ওপর অন্যায় অত্যাচারে দুর্যোধনের পক্ষ থেকে মানসিকভাবে সরে এসেছিলেন। আজকে যে দুর্যোধনের গোষ্ঠীরই একজন, সেই গোষ্ঠীরই অন্যতম আরেকজনকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করলেন, তাঁর কারণ অশ্বত্থামাও কোনওভাবেই পাণ্ডবদের গ্লানি আর সহ্য করতে পারছিলেন না এবং ওই গ্লানির অন্যতম হাতিয়ার যে কর্ণ, এটাও তাঁর বুঝতে দেরি হয়নি। অশ্বত্থামার পক্ষে নিরপেক্ষ ভূমিকায় কর্ণকে গালাগাল দেওয়ার কোনও অসুবিধেও নেই, তার কারণ তিনি কৌরবকুলের কেউ নন, আবার কর্ণের মতো কৌরবকুল আশ্রয় করে আত্মোন্নতির প্রয়োজনও তাঁর নেই। তাই অতি কুটিল পরিহাসে, দূতসভার অসভ্যতা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অশ্বত্থামা কর্ণকে বললেন—যেমন করে পাশা খেলা করেছিলে, যে বুদ্ধিতে পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ চুরি করেছিলে, যে অভব্যতায় দ্রৌপদীকে রাজসভায় নিয়ে এসেছিলে, কর্ণ! সেই কায়দায় অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করে দেখ না, কী হয়? কর্ণ! তোমার ক্ষাত্রধর্মের গুরু হল তোমার মামা শকুনি, সেই ‘গ্র্যান্ড মাস্টার’কে এখন যুদ্ধ করতে বলো—দুর্দ্যুতদেবী গান্ধারঃ শকুনি যুধ্যতামিহ। তবে মনে রেখ, অর্জুনের গাণ্ডীব ধনু থেকে ‘কচে বারো’, ছয়, চার—পাশার দান পড়ে না, সেখান থেকে ক্ষুরধার বাণের ধারাপাত ঝরে পড়ে। তুমি কুরুরাজের রাজসভায় শকুনির সাহায্যে যে খেলা খেলেছিলে, এখনও সেই শকুনির দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ কর। তবে মনে রেখ, এই যুদ্ধে তোমার মতো অন্য যোদ্ধারা যত ইচ্ছে যুদ্ধ করতে যাক, আমি অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধ করব না, সেটা বলে দিচ্ছি—যুধ্যন্তাং কামতো যোধা নাহং যোৎস্যে ধনঞ্জয়ম্।

কর্ণের বিরুদ্ধে অশ্বত্থামার এই প্রতিবাদও অর্জুনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ভয়ে নয়, প্রতিবাদের জন্যই প্রতিবাদ। বৃদ্ধদের প্রতি কর্ণের অবমাননাকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে শুভ যুবচেতনার প্রতিবাদ। শক্তিধর, আত্মপরায়ণ পরগাছার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ জনের প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদে ভাঙনের ভয় ছিল, কুরুকুলের চিরন্তন হিতৈষীদের মধ্যে ভাঙনের ভয় ছিল এবং সে ভয় এসেছিল কর্ণের অন্যায় আস্ফালনের দ্বারা। স্বয়ং পিতামহ ভীষ্মকে এইজন্যে সাময়িকভাবে অশ্বত্থামার ক্রোধমুক্তির জন্য চিন্তা করতে হয়েছে, তাঁকে সাময়িকভাবে নামতে হয়েছে কর্ণকে ‘জাস্টিফাই’ করার জন্য। মধ্যপন্থী হয়ে ভীষ্মকে বলতে হয়েছে—কর্ণ যা বলেছে, তা হয়তো সকলের মনোবল বাড়ানোর জন্য বলেছে। কিন্তু সেই সূত্রে দ্রোণের বিরুদ্ধে যে সব কথা এসেছে, সে জন্য আচার্য তাঁকে ক্ষমা করুন, কৃপাচার্যও ক্ষমা করুন, ক্ষমা করুন আচার্যপুত্র অশ্বত্থামা—কারণ অর্জুন সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেছে, এখন নিজেদের মধ্যে বিরোধের সময় নয়—নায়ং কালো বিরোধস্য কৌন্তেয়ে সমুপস্থিতে। ভীষ্ম অশ্বত্থামাকে সানুবন্ধে নিজেদের মধ্যে ভাঙন বাঁচিয়ে চলার কথা বলেছেন। বৃদ্ধ হয়েও যুবক অশ্বত্থামাকে তিনি হাত জোড় করে বলেছেন—আচার্যপুত্র! ক্ষমা করুন, এখন নিজেদের মধ্যে বিরোধের সময় নয়—আচার্যপুত্র ক্ষমতাং নায়ং কালঃ স্বভেদনে।

ভীষ্মের কথার সূত্র ধরে দুর্যোধন এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে, অশ্বত্থামার এই রাগ যতখানি নিজের কারণে, তার চেয়ে অনেক বেশি দ্রোণের কারণে। কাজেই সময় বুঝে ভীষ্ম, কৃপ, দুর্যোধন এবং সবার ওপরে কর্ণ—সবাই মিলে আচার্য দ্রোণকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন—সহ কর্ণেণ ভীষ্মেণ কৃপেণ চ মহাত্মানা। অবস্থার গতিকে কর্ণ কিছু অপ্রস্তুত হলেন বটে কিন্তু বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ সহজেই ক্ষমাপ্রবণ, অতএব যুদ্ধের তোড়জোড় আরম্ভ হল। যুদ্ধের ‘স্ট্র্যাটিজি’ ঠিক করার ভার ছিল ভীষ্মের ওপরে। কর্ণকে বাঁচানোর জন্য দ্রোণ-কৃপের সামনে কিঞ্চিৎ ওজর দেবার চেষ্টা করেও ভীষ্ম কিন্তু এমন একটি প্যাঁচ কষলেন যাতে কর্ণকেই বেশিরভাগ অর্জুনের মুখোমুখি হতে হয়। ভীষ্ম বললেন—দ্রোণ থাকুন সেনাবাহিনীর মধ্যভাগে, অশ্বত্থামা বাঁদিকে আর কৃপ ডান দিকে। সামনে থাকুন কর্ণ, আর আমি সবার শেষে থেকে চারিদিক রক্ষা করব। ভীষ্মের কথামতো দুর্যোধন বিরাটরাজার গোধন হরণ করে পালাচ্ছিলেন। স্বাভাবিকভাবে অর্জুন প্রথমে দুর্যোধনের পিছু নিলে সমস্ত কৌরববাহিনী একযোগে এসে পড়লেন অর্জুনের সামনে। প্রথমে কয়েকজন মধ্যমান বীরের মান হরণ করার পরেই অর্জুনের সঙ্গে কর্ণের যুদ্ধ আরম্ভ হল। কর্ণ প্রথমে যেভাবে যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন এবং অর্জুনের রথ আর তাঁর সারথি উত্তরের যে অবস্থা করেছিলেন, তাতে অর্জুনকে অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। কর্ণ এবং অর্জুন দুজনেই এমন সমানে সমানে যুদ্ধ করছিলেন যে, মহাভারতের কবিকে প্রশংসা করে বলতে হয়েছে—কেউ কম যান না। সমস্ত ধনুর্ধরদের মধ্যে ইনিও উত্তম, উনিও উত্তম। দুজনেই মহাবল, দুইজনেই সমস্ত শত্রুর পক্ষে বিপজ্জনক—তাবুত্তমৌ সর্বধনুর্ধরাণাং মহাবলৌ সর্বসপত্নসাহৌ। কৌরবেরা সবাই মিলে কর্ণ এবং অর্জুনের এই আশ্চর্য যুদ্ধ দেখছিলেন।

কৌরবেরা যে দেখছিলেন, তার কারণও আছে। আমাদের ধারণা, কৌরবদের একাংশ, যাঁরা কর্ণের ওপর ভরসা রাখেন, তাঁরা দেখছিলেন যে, কর্ণ কতটা হারেন, কারণ তাঁরা জানতেন তেরো বছরের যুদ্ধ-উপবাসী অর্জুন সেদিন ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। অর্জুন এবং কর্ণ—দুজনেই সেদিন অপূর্ব যুদ্ধ করেছিলেন, এতটাই অপূর্ব যে, কবির বাণীতে নতুন ছন্দ লেগেছে, ভাষা হয়ে উঠেছে দীপ্তিময়ী। যুদ্ধক্ষেত্রে যতবারই অর্জুনের কেরামতি বানচাল করে দিয়েছেন কর্ণ, ততবারই তিনি কৌরবদের অসংখ্য হাততালি কুড়িয়েছেন—ততস্তু অভুদ্ বৈ তুলতালশব্দঃ, কিন্তু অর্জুন এ সুযোগ পাননি। তবু সেদিনকার যুদ্ধে দুজনেই ছিলেন এত উজ্জ্বল, এত ভাস্বর যে, হাজারো বাণবর্ষার মধ্যে দুজনকে দেখাচ্ছিল যেন বৃষ্টির আকাশে চাঁদ আর সূর্যের উদয় হয়েছে—রথে বিলগ্নাবিব চন্দ্ৰসুর্যৌ, ঘনান্তরেণানুদদর্শ লোকঃ। কিন্তু হায়, শেষমেশ এই দ্বৈরথ যুদ্ধের ফল কর্ণের কপালগুণে এবং অর্জুনের হাতযশে-কর্ণের অনুকূলে যায়নি। হাতে, গলায়, ঊরুতে, মাথায় বিভিন্ন রকমের চোট-আঘাত নিয়ে কর্ণকে কোনওক্রমে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাতে হল। কিন্তু কবি লিখলেন—বনের মধ্যে এক হাতি যেমন আরেক হাতির কাছে হেরে গিয়ে সাময়িকভাবে পালায়, তেমনি অর্জুনের বাণের আঘাতে কর্ণকেও যুদ্ধ থেকে পালাতে হল। কর্ণ তবু আবার ফিরে এসেছিলেন, কিন্তু সেটা এমন একটা সময়ে যখন ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধন সবাই প্রায় অর্জুনের হাতে পর্যুদস্ত। সমস্ত আঘাতের ওপর অর্জুনের বাণ কর্ণের দুই কানে গিয়ে লাগল। তাঁর রথ, অশ্ব, সারথি সব গেল। কর্ণ আবার দৌড়লেন নতুন সাজানো রথের জন্য।

এতক্ষণ সবার সঙ্গে যুদ্ধে কর্ণ একজন মাত্র ছিলেন। এবার একক সংগ্রাম আরম্ভ হল। কৃপাচার্য এবং দ্রোণাচার্য দুজনেই হেরে গেলে প্রচুর বাগাড়ম্বরের পর আবার অর্জুনের সঙ্গে কর্ণের যুদ্ধ আরম্ভ হল। মনে রাখা দরকার এই বিরাট-যুদ্ধে প্রথম থেকেই বেশির ভাগ যুদ্ধটা করতে হয়েছে কর্ণকে, তাঁকেই সইতে হয়েছে প্রথম সমরাঘাতগুলি। কাজেই তৃতীয়বার যুদ্ধে এসে তাঁকে অর্জুনের কাছে শুনতেই হল যে, তিনি যুদ্ধ থেকে পালিয়েছিলেন, কিংবা তাঁর ভাই মারা পড়েছে এই যুদ্ধে। তবু আবার যুদ্ধ আরম্ভ হল এবং স্বাভাবিকভাবেই ক্লান্ত মহাবীরকে বিরথ অবস্থায় অর্জুনের বাণে মুচ্ছিত হয়ে পড়তে হয়েছে, তাঁকে আবারও পালাতে হয়েছে। তেরো বছর পর কর্ণ-জয়ের আনন্দে হাসি ফুটেছে অর্জুনের মুখে।