কুন্তী – ৭

পাঁচটি অনাথ পিতৃহীন বালক পুত্রের হাত ধরে কুন্তী স্বামীর রাজ্যের রাজধানীতে এসে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে আছেন ঋষিরা। তাঁরাই এখন একমাত্র আশ্রয় এবং প্রমাণ। এই পাঁচটি ছেলে যে পাণ্ডুরই স্বীকৃত সন্তান, তার জন্য ঋষিদের সাক্ষ্য ছাড়া কুন্তীর দ্বিতীয় গতি নেই। পাণ্ডু এবং মাদ্রীর মৃতদেহ ঋষিরাই হস্তিনাপুরে বয়ে নিয়ে এসেছেন বটে, কিন্তু মৃত স্বামীর রাজ্যপাট অথবা সম্পত্তির উত্তরাধিকার পেতে হলে ‘সাকসেশন সার্টিফিকেট’টা যে আর্যবাক্যেই প্রথম পেশ করতে হবে—এ-কথা কুন্তীর ভালই জানা ছিল।

পুরনো আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আবার কতকাল পরে দেখা হবে—এই অধীরতায় কুন্তী খুব দ্রুত হেঁটেছিলেন। পাঁচ ছেলে, রাজার শব আর ঋষিদের সঙ্গে কুন্তী যখন হস্তিনার দ্বারে এসে পৌঁছলেন তখন সকাল হয়েছে সবে। এর মধ্যেই রটে গেল—কুন্তী এসেছেন, রাজা মারা গেছেন, পাঁচটা ছেলে আছে কুন্তীর সঙ্গে। পুরবাসী জনেরা হুমড়ি খেয়ে পড়ল হস্তিনার রাজসভার কাছে। মনস্বিনী সত্যবতী, রাজমাতা অম্বালিকা, গান্ধারী—সবাই কুন্তীকে নিয়ে রাজসভায় এলেন। ঋষিরা পাণ্ডুর পুত্র-পরিচয় করিয়ে দিলেন কুরুসভার মান্যগণ্য ব্যক্তিদের কাছে, মন্ত্রীদের কাছে এবং অবশ্যই প্রজ্ঞাচক্ষু ধৃতরাষ্ট্রের কাছে।

পাঁচটি পিতৃহীন পুত্রের হাত ধরে কুন্তী যখন কুরুসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন, তখন ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা দামি কাপড় পরে, সর্বাঙ্গে সোনার অলঙ্কার পরে রাজপুত্রের চালে জ্ঞাতি ভাইদের দেখতে এসেছিল। কুন্তীর কাছে এই দৃশ্য কেমন লেগেছিল? বনবাসী তপস্বীরা কুন্তীর পাঁচটি ছেলের সামগ্রিক পরিচয় দিয়ে বলেছিলেন—মহারাজ! পাণ্ডু আর মাদ্রীর দুটি শব-শরীর এই এখানে রইল। আর তাঁর প্রথমা স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর পাঁচটি অসাধারণ ছেলে দিয়ে গেলাম আপনারই হেফাজতে। আপনি মায়ের সঙ্গে এই ছেলেদের দেখভাল করুন অনুগ্রহ করে— ক্রিয়াভিঃ অনুগৃহ্যতাম্‌। তখন কুন্তীর কি মনে হয়নি—হায়! কে কাকে অনুগ্রহ করে। তাঁর স্বামীই রাজা, ধৃতরাষ্ট্র তাঁরই রাজত্বের কাজ চালাচ্ছিলেন মাত্র। কিন্তু আজকে শুধুমাত্র রাজধানীতে মৃত্যু না হওয়ার কারণে আসল রাজপুত্রদেরই প্রার্থীর ভূমিকায় প্রতিপালনের অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে হচ্ছে!

ধৃতরাষ্ট্র খুব ঘটা করে পাণ্ডুর শ্রাদ্ধ করলেন বটে, কিন্তু কুন্তী বা তাঁর ছেলেদের রাজকীয় মর্যাদা তিনি দেননি। রাজবাড়িতে তাঁদের আশ্রয় জুটেছিল বটে, কিন্তু থাকতে হচ্ছিল বড় দীনভাবে, বড় হীনভাবে। ভীমকে যেদিন বিষ খাইয়ে গঙ্গায় ফেলে দিলেন দুর্যোধন, সেদিন ওই অত বড় ছেলেকে হারানোর ঘটনার পরেও ধৃতরাষ্ট্রকে কিছু বলতে পারেননি কুন্তী। সমস্ত কুরুবাড়ির মান্য-গণ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কুন্তীর একমাত্র বিশ্বাসের ব্যক্তি ছিলেন তাঁর দেওর বিধুর। দুই-একজন অতিপক্ক বুদ্ধিজীবী কুন্তী আর বিদুরের সম্পর্ক নিয়ে কথঞ্চিৎ সরসও হয়ে পড়েন দেখেছি। তবে তাঁদের কথাবার্তার মধ্যে মহাভারতীয় যুক্তি-তর্কের থেকে আত্ম-হৃদয়ের প্রতিফলনই বেশি। এই একই ধরনের প্রতিফলন দেখেছি আরও কতগুলি বুদ্ধিজীবীর নব নব উন্মেষশালিনী প্রজ্ঞার মধ্যেও। তাঁরা আবার কুন্তীর ছেলেগুলিকে ধর্ম-বায়ু বা ইন্দ্রের ঔরসজাত না ভেবে দুবার্সার ঔরসজাত ভাবেন। আমি বলি—ওরে! সেকালে নিয়োগ প্রথা সমাজ-সচল প্রথা ছিল। পাণ্ডুর ছেলে ছিল না বলে কবি যেখানে ধর্ম, ইন্দ্র বা বায়ুকে কুন্তীর সঙ্গে শোয়াতে লজ্জা পাননি, সেখানে দুর্বাসার সঙ্গে শোয়াতেও কবির লজ্জা হত না—যদি আদতে ঘটনাটা তাই হত।

থাক এসব কথা। ভীমকে বিষ খাওয়ানোর পর কুন্তী একান্তে বিদুরকে ডেকে এনেছেন নিজের ঘরে। সুস্পষ্ট এবং সত্য সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রাজ্যলোভী দুর্যোধন সম্পর্কে। কিন্তু কোনওভাবেই নিজের সন্দেহের কথা ধৃতরাষ্ট্রকে জানাতে পারেননি। কারণ তিনি বুঝে গিয়েছিলেন—চক্ষুর অন্ধতার থেকেও ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহান্ধতা বেশি। ভীম যখন নাগলোক থেকে ফিরে এসে দুর্যোধনের চক্রান্তের কথা সমস্ত একে একে জানিয়েছেন, তখনও আমরা কুন্তীকে কোনও কথা বলতে দেখিনি। মহামতি যুধিষ্ঠির এই নিদারুণ ঘটনার প্রচার চাননি। পাছে আরও কোনও ক্ষতি হয়। কুন্তীকে আমরা এই সময় থেকে যুধিষ্ঠিরের মত মেনে নিতে দেখছি, যদিও বুদ্ধিদাতা হিসেবে বিদুরের মতামতই এখানে যুধিষ্ঠিরের মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে।

আসলে কুন্তী যা চেয়েছিলেন, মহাভারতের কবি তা স্বকণ্ঠে না বললেও বোঝা যায়, অন্য সমস্ত বিধবা মায়ের মতোই তিনি তাঁর সন্তানদের ক্ষত্রিয়োচিত সুশিক্ষা চেয়েছেন। চেয়েছেন তাদের মৃত পিতার রাজ্যের সামান্য উত্তরাধিকার ছেলেরা পাক। তার জন্য তিনি হঠাৎ করে কিছু করে বসেননি, এতদিন পরে ফিরে এসে হঠাৎ করে ছেলেদের জন্য রাজ্যের উত্তরাধিকার চাননি। তিনি সময় দিয়ে যাচ্ছেন, ছেলেদের সম্পূর্ণ উপযুক্ত হওয়ার অপেক্ষাও করছেন।

ভীষ্মের ইচ্ছায় দ্রোণাচার্যের তত্ত্বাবধানে কৌরব-পাণ্ডবদের একসঙ্গেই অস্ত্রশিক্ষা আরম্ভ হল। আর এই অস্ত্রশিক্ষার সূত্র ধরেই তাঁর কনিষ্ঠপুত্র অর্জুন সর্বশ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর হিসেবে বেরিয়ে এলেন। কুন্তী এই দিনটিরই অপেক্ষায় ছিলেন। যেদিন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সামনে দ্রোণাচার্যের অস্ত্রপরীক্ষার আসর বসল, সেদিন অর্জুনের ধনুকের প্রথম টংকার-শব্দে ধৃতরাষ্ট্র চমকে উঠেছিলেন। বিদুরকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—ভাই! কে এল এই রঙ্গস্থলে? সমুদ্রের গর্জনের মতো এই শব্দ কীসের? বিদুর বললেন—তৃতীয় পাণ্ডব এসেছে রঙ্গস্থলে, তাই এই শব্দ। ধৃতরাষ্ট্র সগৌরবে বললেন, যজ্ঞের সময় শমীবৃক্ষের কাঠ ঘষে ঘষে যেমন আগুন জ্বালাতে হয়, আমাদের কুন্তী হলেন সেই আগুন-জন্মানো শমীকাঠের মতো। কুন্তীর গর্ভজাত এই তিনটি পাণ্ডব-আগুনে আজ আমি নিজেকে সবদিক থেকে সুরক্ষিত মনে করছি—ধন্যো’স্মি অনুগৃহীতো’স্মি রক্ষিতো’স্মি মহামতে।

কুন্তী এই দিনটিরই অপেক্ষা করেছেন। বিধবা মা যেমন করে অপেক্ষা করেন—ছেলে পড়াশুনো করে পাঁচজনের একজন হয়ে মায়ের দুঃখ ঘোচাবে, কুন্তীও তেমনই এত দিন ধরে এই দিনটিরই অপেক্ষা করেছেন। কিন্তু পোড়া-কপালির কপালের মধ্যে বিধাতা এত সুখের মধ্যেও কোথায় এক কোণে দুঃখ লিখে রেখেছিলেন। কুন্তীর কনিষ্ঠ পুত্র অর্জুন যখন নিজের অস্ত্রশিক্ষার গুণে সমস্ত রঙ্গস্থল প্রায় মোহিত করে ফেলেছেন, সেই সময়েই সু-উচ্চ রঙ্গমঞ্চ থেকে কুন্তী দেখতে পেলেন—বিশাল শব্দ করে আরও এক অসাধারণ ধনুর্ধর তাঁর তৃতীয় পুত্রটিকে যেন ব্যঙ্গ করতে করতে ঢুকে পড়ল রঙ্গস্থলে।

কুন্তীর বুক কেঁপে উঠল—সেই চেহারা, সেই মুখ। সেই ভঙ্গি। বুকে সেই বর্ম আঁটা। কানে সেই সোনার দুল–মুখখানি যেন উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে—কুণ্ডল-দ্যোতিতাননঃ। কুন্তী দেখলেন—কত শক্তিমান, আর কত লম্বা হয়ে গেছে তাঁর ছেলে। হেঁটে আসছে যেন মনে হচ্ছে, সোনার তালগাছ হেঁটে আসছে, যেন কঠিন এক পাহাড় পা বাড়িয়েছে রঙ্গস্থলের দিকে—প্রাংশুকনকতালাভঃ…পাদচারীব পর্বতঃ। কুন্তীর মনের গভীরে কী প্রতিক্রিয়া হল, মহাভারতের কবি তো লেখেননি। তবে নিরপেক্ষ একটি মন্তব্য করেই যখন কবি রঙ্গস্থলের খুঁটিনাটিতে মন দিয়েছেন, তখন ওই একটি মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় কুন্তীর মনে কী চলছিল। কবি বললেন—সুর্যপুত্র কর্ণ অর্জুনের ভাই হয়েও তাঁকে ভাই বলে বুঝলেন না—ভ্রাতা ভ্রাতরমজ্ঞাতং সাবিত্রঃ পাকশাসনিম্।

যাঁকে অমর জীবনের আশীর্বাদ দিয়ে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন, সে যে এইভাবে কোনওদিন ফিরে আসবে, তা কুন্তীর কল্পনাতেও ছিল না। যাঁকে জননীর প্রথম বাৎসল্যে কোলে তুলে নিতে পারেননি, সেই তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান আজ ফিরে এল তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে, প্রায় যুদ্ধোদ্যত অবস্থায়। প্রকৃতির প্রতিশোধ কি এমনতর হয়! এখন এই মুহূর্তে পাঁচটি প্রায় যুবক ছেলের সামনে এই বিধবা রমণীর পক্ষে তাঁর কন্যা অবস্থার জননীত্ব স্বীকার করা সম্ভব ছিল না। বলতে পারেন, স্বীকার করলে কীই বা এমন হত? কী হত তা কুন্তীই জানেন। তবে নিজের স্বামীর প্রচণ্ড উপরোধেও যিনি লজ্জা আর রুচির মাথা খেয়ে যে কলঙ্কের কথা স্বীকার করতে পারেননি, আজ বিধবা অবস্থায় বড় বড় ছেলেদের সামনে সে কথা কি স্বীকার করা সম্ভব ছিল? তা ছাড়া রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে কুন্তীর মনে যে দুশ্চিন্তা ছিল, কর্ণের পুত্রত্ব প্রতিষ্ঠায় সেই উত্তরাধিকারে নতুন কোনও ঝামেলা তৈরি হত কি না সেটাই বা কতটা নিশ্চিত ছিল। কুন্তীকে যে কুরুকুলের কলঙ্কিনী বধূ হিসেবে নতুন বিপত্তির মুখ দেখতে হত না, তারই বা কী স্থিরতা ছিল?

অতএব নিজের মান, মর্যাদা এবং রুচির নিরিখে যাঁর বাৎসল্য-বন্ধন জন্মলগ্নেই তিনি ত্যাগ করেছেন, আজ আর তাঁকে আগ বাড়িয়ে সোহাগ দেখাতে চাননি কুন্তী। বরঞ্চ যে মুহূর্তে তিনি দেখেছেন তাঁর জ্যেষ্ঠ-পুত্র তাঁর কনিষ্ঠটিকে যুদ্ধের আহ্বান জানাচ্ছে, সেই মুহূর্তে মূর্ছাই ছিল তাঁর একমাত্র গতি। তিনি তাই অজ্ঞান হয়ে বেঁচেছেন। কিন্তু অজ্ঞান হয়েও কি বাঁচবার উপায় আছে। মহামতি বিদুর তাঁর অবস্থা দেখে দাসীদের দিয়ে কুন্তীর চোখে-মুখে চন্দন-জলের ছিটে দেওয়ালেন। জ্ঞান ফিরে দেখলেন বড়-ছোট—দুই ছেলেই মারামারি করার জন্য ঠোঁট কামড়াচ্ছে। কুন্তী কষ্টে লজ্জায় কী করবেন ভেবে পেলেন না—পুত্রৌ দৃষ্‌ট্বা সুসংভ্রান্তা নাম্বপদ্যত কিঞ্চন।

বাঁচালেন কৃপাচার্য। কৃপাচার্য কর্ণকে তাঁর বংশ-পরিচয় জিজ্ঞাসা করে সবার সামনে চরম অপমানের মধ্যে ফেলে দিলেন বটে, কিন্তু কুন্তীর কাছে এও বুঝি ছিল বাঁচোয়া। বংশ-পরিচয়ের কথায় কর্ণের পদ্ম-মুখে বর্ষার ছোঁয়া লাগল, তাঁর কান্না পেল—বর্ষাম্বুবিক্লিন্নং পদ্মমাগলিতং যথা—তবু কর্ণের এই অপমানেও শুধুমাত্র দুই ভাইয়ের মধ্যে যুদ্ধ বন্ধ হল দেখে কুন্তী স্বস্তি পেলেন। এর পরেও কর্ণকে নিয়ে মুখর ভীমসেন আর দুর্যোধনের মধ্যে বিশাল বাগ্‌যুদ্ধ, অপমান পালটা অপমান চলল বটে, তবু এরই মধ্যে প্রতিপক্ষ দুর্যোধন যখন কর্ণের মাথায় অঙ্গরাজ্যের রাজার মুকুট পরিয়ে দিলেন, সেই সময়ে দুর্যোধনের ওপর কুন্তীর চেয়ে বেশি খুশি বোধহয় কেউ হননি।

বাৎসল্যের শান্তি কুন্তীর ওইটুকুই। চাপা আনন্দে তাঁর বুক ভরে গেল—পুত্রম্ অঙ্গেশ্বরং জ্ঞাত্বা ছন্না প্রীতি-রজায়ত। কেউ বুঝুক আর না বুঝুক কুন্তী বুঝলেন—তাঁর বড় ছেলেই প্রথম রাজ্য পেল এবং সবার কাছে সে হীন হয়ে যায়নি। এও এক আনুষ্ঠানিক তৃপ্তি, যার ব্যাখা দেওয়া সহজ নয়। কুন্তী যেটা বুঝলেন না, সেটা হল—এই যুদ্ধের রঙ্গমঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ এবং কনিষ্ঠ পুত্র—দুজনেই জন্মের মতো শত্রু হয়ে গেল। এখন যদিও যুদ্ধ কিছু হল না, তবু দুই সমান মাপের বীর দুজনের প্রতিস্পর্ধী হয়ে রইলেন—এ-কথাটা কুন্তী বোধ হয় মায়ের মন নিয়ে তেমন করে বুঝতে পারলেন না। কিন্তু বুঝতে না পারলেও জননীর প্রথম সন্তান হিসাবে কর্ণ যে বেঁচে আছেন, তিনি যে সুষ্ঠু প্রতিপালন লাভ করে এত বড় ধনুর্ধর পুরুষটি হয়ে উঠেছেন—এই তৃপ্তি তাঁকে জননীর দায় থেকে খানিকটা মুক্ত করল অবশ্যই।

যাই হোক, দ্রোণাচার্যের সামনে এই অস্ত্র-প্রদর্শনীর পর এক বছর কেটে গেছে। কুন্তীর দুটি পুত্র, ভীম এবং অর্জুনের অসামান্য শক্তি এবং অস্ত্রনৈপুণ্যের নিরিখেই—অন্তত আমার তাই মনে হয়—মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র যুধিষ্ঠিরকে হস্তিনাপুরের যুবরাজ করতে বাধ্য হলেন। পাণ্ডবজ্যৈষ্ঠের এই যৌবরাজ্য লাভের পর ভীম আর অর্জুনের প্রতাপ আরও বেড়ে গেল। তাঁরা এমনভাবে সব রাজ্য জয় করে ধনরত্ন আনতে আরম্ভ করলেন এবং তাঁদের খ্যাতি এত বেড়ে গেল যে, ধৃতরাষ্ট্রের মন খুব তাড়াতাড়িই বিষিয়ে গেল—দূষিতঃ সহসা ভাবো ধৃতরাষ্ট্রস্য পাণ্ডুষু। তার মধ্যে ইন্ধন যোগালেন রাজ্যলোভী দুর্যোধন। ধৃতরাষ্ট্রকে তিনি বোঝালেন—যেভাবে হোক, পাণ্ডবদের একেবারে মায়ের সঙ্গে নিবার্সন দিতে হবে—সহ মাত্রা প্রবাসয়।

ধৃতরাষ্ট্রের মনেও ওই একই ইচ্ছে ছিল, তিনি শুধু বলতে পারছিলেন না, এই যা। পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে তাদের মাকেও যে বারণাবতের প্রবাসে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন দুর্যোধন, তার কারণ একটাই—কুন্তীর বুদ্ধি এবং ব্যক্তিত্ব। পাণ্ডবরা গিয়ে যদি শুধু কুন্তী রাজবাড়িতে থাকতেন, তা হলে বারণাবতের লাক্ষাগৃহে আগুন লাগানোর ‘প্ল্যান’ ভেস্তে যেতে পারে—এই দুশ্চিন্তাতেই দুর্যোধন কুন্তীকেও পাণ্ডবদের সঙ্গে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। তিনি বোঝেননি যে, কুন্তীর বা পাণ্ডবদের ভাল চাওয়ার মতো লোক কুরুবাড়িতে আরও ছিল। মহামতি বিদুরের বুদ্ধিতে কুন্তী এবং পাণ্ডবভাইরা সবাই বারণাবতের আগুন-ঘর থেকে বেঁচে গেলেন।

কুন্তীকে এই সময় ছেলেদের সঙ্গে বনে বনে ঘুরতে হয়েছে বটে, তবে তিনি খারাপ কিছু ছিলেন না। ছেলেরা এখন লায়েক হয়ে উঠেছে। বিশেষত ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির, তাঁর স্থিরতা, ব্যক্তিত্ব এবং নীতিবোধ এতই প্রখর যে, তাঁর ওপরে নির্ভর না করে কুন্তীর উপায় ছিল না। যে কোনও বিপন্ন মুহূর্তে যুধিষ্ঠিরের কথা তিনি মেনে চলতেন এবং যুধিষ্ঠিরের কথার মর্যাদা তাঁর কাছে ছিল প্রায় স্বামীর কাছাকাছি। মেজ ছেলে ভীমের ওপরে তাঁর স্নেহটা একটু অন্যধরনের। তিনি জানেন—এ এক অবোধ, পাগল, একগুঁয়ে ছেলে। ভীমের গায়ের জোর সাংঘাতিক। কাজেই বনের পথে ভীমের কাঁধে চেপে যেতেও তাঁর লজ্জা করে না। সব ছেলের সমান পরিশ্রমের পর, অথবা ভীমের যদি অন্য ছেলেদের চেয়ে বেশি পরিশ্রমও হয়ে যায় তবু যেন তাঁকেই ইঙ্গিত করে কুন্তী একটা কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিতে পারেন—পাঁচ ছেলের মা হয়ে, আজ এই বনের মধ্যে তেষ্টায় গলা ফেটে যাচ্ছে আমার। মায়ের এসব কথার প্রথম প্রতিক্রিয়া ভীমের মনেই হবে। তিনি জল আনতে যাবেন এবং কুন্তীও তা জানেন।

এই গর্ব তাঁর অর্জুনের বিষয়েও ছিল। তবে অর্জুনের থেকেই কিন্তু কুন্তীর মাতৃস্নেহে প্রশ্রয়ের শিথিলতা এসেছে। হাজার হোক, ছোট ছেলে। মায়ের কনিষ্ঠ পুত্রটি অসাধারণ লেখা-পড়া শিখে অসম্ভব কৃতী পুরুষ হয়ে উঠলে মায়ের মনে যে শ্রদ্ধামিশ্রিত নিরুচ্চার প্রশ্রয় তৈরি হয়, অর্জুনের ব্যাপারে কুন্তীরও সেই প্রশ্রয় ছিল। যদিও এই প্রশ্রয়ের মধ্যে মায়ের দাবিও ছিল অনেক। সে দাবি মুখে সচরাচর প্রকাশ পেত না, কিন্তু সে দাবির চাপ কিছু ছিলই। অর্জুনও তা বুঝতেন। সে-কথা পরে আসবে।

প্রশ্রয় বলতে যেখানে একেবারে বাধা-বন্ধহীন অকৃত্রিম প্রশ্রয় বোঝায়, যার মধ্যে ফিরে পাওয়ার কোনও তাগিদ নেই, যা শুধুই নিম্নগামী স্নেহের মতো, দাদু-দিদিমা বা ঠাকুমার-ঠাকুরদার অন্তর-বিলাস—কুন্তীর সেই প্রশ্রয় ছিল নকুল এবং সহদেবের ওপর, বিশেষত সহদেবের ওপর। মাদ্রী যে কুন্তীকে বলেছিলেন—তোমার ছেলেদের সঙ্গে আমার ছেলেদের আমি এক করে দেখতে পারব না—এই কথাটাই কুন্তীকে আরও বিপরীতভাবে স্নেহপ্রবণ করে তুলেছিল নকুল এবং সহদেবের প্রতি। পিতৃ-মাতৃহীন এই বালক দুটিকে কুন্তী নিজের ছেলেদের চেয়ে বেশি স্নেহ করতেন। আবার এদের মধ্যেও কনিষ্ঠ সহদেবের প্রতি তাঁর স্নেহ এমন লাগামছাড়া গোছের ছিল যে, তাঁকে বোধ হয় তিনি বুড়ো বয়েস পর্যন্ত খাইয়ে দিতেন অথবা ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। পাণ্ডবরা যখন বনে গিয়েছিলেন, তার আগে কুন্তী সহদেবের সম্বন্ধে দুনিয়ার মাতৃস্নেহ উজাড় করে দিয়ে দ্রৌপদীকে বলেছিলেন—বনের মধ্যে তুমি বাপু আমার সহদেবকে একটু দেখে রেখো—সহদেবশ্চ মে পুত্রঃ সহাবেক্ষ্যা বনে বসন্। দেখো ওর যেন কোনও কষ্ট না হয়। কুন্তীর মানসিকতায় দ্রৌপদীকেও তাঁর এই কনিষ্ঠ স্বামীটির প্রতি বাৎসল্য বিতরণ করতে হয়েছে।

যাই হোক, প্রশ্রয় আর লালনের মাধ্যমে যে ছেলেদের কুন্তী বড় করে তুলেছিলেন, দেওর বিদুরের বুদ্ধিতে সেই পাঁচ ছেলেই তাঁর বেঁচে গেল। এখন তাঁদের সঙ্গেই তিনি বনের পথে চলতে চলতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লেন। মেজ ছেলে ভীম মায়ের কষ্ট দেখে জল আনতে গেল। আর এরই মধ্যে পথের পরিশ্রমে ঘুম এসে গেল সবার। যে বনের মধ্যে এই ঘুমের আমেজ ঘনিয়ে এল সবার চোখে সেই বন ছিল হিড়িম্ব রাক্ষসের অধিকারে। সে তার বোন হিড়িম্বাকে পাঠিয়ে দিল ঘুমন্ত মানুষগুলিকে মেরে আনতে।

ততক্ষণে ভীমের জল আনা হয়ে গেছে। তিনি মা-ভাইদের পাহারা দিচ্ছিলেন। হিড়িম্বা ভীমকে দেখে তাঁর প্রেমে পড়ে গেল। সে ভীমের কাছে হিড়িম্ব রাক্ষসের নরমাংসভোজনের পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়ে সবাইকে বাঁচাতে চাইল। ভীমের এই করুণা পছন্দ হয়নি। অদূরেই হিড়িম্ব রাক্ষসের সঙ্গে তাঁর যুদ্ধ লাগল এবং এদিকে কুন্তী পাণ্ডবভাইদের সঙ্গে জেগে উঠলেন। হিড়িম্বা মনুষ্যরমণীর ছাঁদে যেমনটি সেজে এসেছিল, তাতে কুন্তীর ভারী পছন্দ হয়ে গেল তাঁকে। সরলা হিড়িম্বা কুন্তীর কাছে তার পছন্দের কথাও গোপন করল না। সে পরিষ্কার জানাল ভীমকে সে বিয়ে করতে চায়।

ওদিকে ভীমের হাতে হিড়িম্ব মারা গেল এবং কুন্তী ছেলেদের প্রস্তাব-মতো পা বাড়ালেন এগিয়ে যাওয়ার জন্য। কারও অনুমোদনের অপেক্ষা না করেই অনাকাঙিক্ষতের মতো হিড়িম্বা কুন্তী এবং তাঁর ছেলেদের পিছন পিছন চলতে লাগল। হিড়িম্বের ওপর তখনও ভীমের রাগ যায়নি। সেই রাগেই বোধ হয় তিনি হিড়িম্বাকেও মেরে ফেলতে চাইলেন। অবধারিতভাবে বাধা আসল যুধিষ্ঠিরের দিক থেকে। কিন্তু এই মুহূর্তে কুন্তীর কাছে হিড়িম্বার আত্মনিবেদন বুঝি ভোলার নয়।

হিড়িম্বা কুন্তীকে তার স্বভাব-সুলভ সরলতায় জানাল—মা! ভালবাসার কত কষ্ট, সে তুমি অন্তত বোঝো। তোমার ছেলের জন্য আমি এখন সেই কষ্ট পাচ্ছি। তুমি আর তোমার এই ছেলে দুজনেই যদি আমাকে এখন প্রত্যাখ্যান করো—বীরেণাহং তথানেন ত্বয়া চাপি যশস্বিনি—তাহলে আমি আর প্রাণে বাঁচব না।

হিড়িম্বা এবার আসল লোকটিকে ধরেছে। সে জানে, এই মায়ের কথা ফেলার সাধ্য কারও মধ্যে নেই। হিড়িম্বা সমস্ত লোকলজ্জা ত্যাগ করে কুন্তীর কাছে অনুনয় করে বলল—তুমি আমাকে দয়া করো মা। তোমার ছেলের সঙ্গে মিলিয়ে দাও আমাকে। আমি এই ক’দিনের জন্য তাঁকে নিয়ে যাব, আর যখনই তুমি বলবে আবার ফিরিয়েও দিয়ে যাব তোমার ছেলেকে, তুমি বিশ্বাস করো।

যুধিষ্ঠির বুঝলেন—মা একেবারে গলে গেছেন। মায়ের মতেই যুধিষ্ঠির ভীমকে ছেড়ে দিয়েছেন হিড়িম্বার সঙ্গে এবং তাঁদের পুত্র-জন্ম পর্যন্ত সময় দিয়েছেন বাইরে থাকার। যথা সময়ে ভীম এবং হিড়িম্বার ছেলে জন্মাল এবং দুজনেই এলেন কুন্তীর কাছে। কুন্তী এই সময়ে রাক্ষসীর গর্ভজাত এই পুত্রটিকে যে মর্যাদা দিয়েছিলেন, তাতে শাশুড়ি হিসেবে তাঁর ঔদার্য প্রকাশ পেয়েছে অনেক আধুনিকা শাশুড়ির চেয়ে বেশি।

আজকের দিনে, তথাকথিত এই চরম আধুনিকতার দিনেও নিজের ছেলের সঙ্গে তথাকথিত নিম্নবর্ণের কোনও মেয়ের বিয়ে হলে শাশুড়িরা আধুনিকতার খাতিরে যথেষ্ট সপ্রতিভ ভাব দেখালেও কখনও বা মনে মনে কষ্ট পান, আবার কখনও বা পুত্রবধূ বা তাঁর বাপের বাড়ির লোকের সামনে সোচ্চারে অথবা নিরুচ্চারে নিজের সম্বন্ধে তুলনামূলকভাবে উচ্ছ্রিত বোধ করেন। কিন্তু সেই মহাভারতের যুগেও কুন্তীর মতো এক মনস্বিনী রাজমাতা নিজের ছেলেকে শুধু রাক্ষসীর সঙ্গে একান্ত বিহারে পাঠিয়েও তৃপ্ত হননি, রাক্ষসীর বিকট চেহারার ছেলের বিলোম মস্তকে হাত বুলিয়ে তিনি অসীম মমতায় বলে উঠেছেন—বাছা! প্রসিদ্ধ কুরুবংশে তোমার জন্ম, আমার কাছে তুমি ভীমের সমানই শুধু নও, এই পঞ্চপাণ্ডবের তুমি প্রথম পুত্র, সব সময় আমরা যেন তোমার সাহায্য পাই—জ্যেষ্ঠঃ পুত্রো’সি পঞ্চানাং সাহায্যং কুরু পুত্রক।

এমন অসীম মর্যাদায় একটি রাক্ষসীর পুত্রকে যে মনস্বিনী কুরুবংশের মাহাত্ম্যে আত্মসাৎ করেন, শাশুড়ি হিসেবে সেই মনস্বিনীর ধীরতা এবং বুদ্ধিকে আমাদের লোক-দেখানো আধুনিকতার গৌরবে চিহ্নিত না করাই ভাল। শাশুড়ি হিসেবে কুন্তীর বিচক্ষণতা এবং মমত্ব এর পরেও আমরা দেখতে পাব। কিন্তু এই মমত্ব কোনওভাবেই বাংলাদেশের জল-ভাত আর নদী-নীরের মতো নম্র কোনও মমত্ব নয়। এই মমত্বের মধ্যে জননীর সরসতা যতটুকু, ক্ষত্রিয় জননীর বীরতাও ততটুকুই। বরঞ্চ বীরতাই বেশি। ক্ষত্রিয় জননীর স্নেহের সঙ্গে বীরতা এমনভাবেই মিশে যায় যে এর জন্য আলাদা করে তাঁর ভাবার সময় থাকে না। এই বীরতা আগে তিনি নিজের ছেলের ব্যাপারে প্রমাণ করেছেন, তারপর তা প্রমাণ করেছেন শাশুড়ি হিসেবেও। সে-কথা পরে হবে। আসলে ভীমের অমানুষিক শক্তি এবং লোকোত্তর ক্ষমতার ওপরে কুন্তীর এত বিশ্বাস ছিল যে, এর জন্য তিনি অনেক ঝুঁকি নিতেও পিছপা হতেন না। জতুগৃহের আগুন থেকে বেঁচে উঠে পাণ্ডবরা বনের পথে ঘুরতে ঘুরতে একচক্রা নগরীতে এলেন। সেখানে বামুনের ছদ্মবেশে এক বামুন বাড়িতেই আশ্রয় নিয়ে বাস করতে আরম্ভ করলেন। এখানেই দুরন্ত বক-রাক্ষস থাকত। রাক্ষস মানে, সে যে মানুষ ছাড়া অন্য কোনও বৃহত্তর প্রাণী তা আমার মনে হয় না। তবে আর্য-সমাজের বাইরে এরা এমন কোনও প্রজাতি যাদের নরমাংসে অরুচি ছিল না। একচক্রা নগরের রাজা বক-রাক্ষসের সুরক্ষা ভোগ করতেন। বদলে বক রাক্ষসের নিয়ম ছিল—নগরের এক একটি বাড়ি থেকে তার খাবার জোগান দিতে হবে এবং যে ব্যক্তি ওই খাবার-দাবার নিয়ে বকরাক্ষসের অপেক্ষায় বসে থাকতেন, তিনিও বক-রাক্ষসের খাদ্য-তালিকায় একটি খাদ্য বলেই গণ্য হবেন। কুন্তীরা একচক্রাতে যে ব্রাক্ষণ বাড়িতে ছিলেন, কোনও এক সময় সেই বাড়ির পালা এল বক-রাক্ষসের খাবার জোগাড় করার। বামুন বাড়িতে কান্নার রোল উঠল। বাড়ির বদান্য গৃহকর্তা যদি বলেন—আমি খাবার নিয়ে যাব, ব্রাহ্মণী তাতে বাধা দিয়ে বলেন—না আমি। ছেলে বলে—আমি যাব তো মেয়ে বলে—আমি।

বামুনবাড়িতে যখন এই আত্মদানের অহংপূর্বিকা এবং অবশ্যই কান্নাকাটি যুগপৎ চলছে, তখন কুন্তী ভীমকে জানিয়ে সেই বামুনবাড়িতে ঢুকলেন। কুন্তীর মাতৃহৃদয় তথা স্নেহ-মমতা এই ঘটনায় কতটা উদ্বেলিত হয়েছিল—সেটা বোঝানোর জন্য মহাভারতের কবি বেশি কথা খরচ করেননি। কিন্তু এমন একখানি জান্তব উপমা দিয়েছেন ব্যাস, যাতে কুন্তীর স্নিগ্ধ হৃদয়খানি পাঠকের কাছে একেবারে সামগ্রিকভাবে ধরা পড়েছে। কবি লিখেছেন—ঘরের মধ্যে বাছুর বাঁধা থাকলে তার ডাক শুনে গরু যেমন ধেয়ে গোয়ালের মধ্যে ঢোকে, সেই রকম করে কুন্তী ঢুকলেন সেই বামুনবাড়িতে—বিবেশ ত্বরিতা কুন্তী বদ্ধবৎসেব সৌরভী।

কুন্তী সব শুনলেন। বামুনের সব কথা ধৈর্য ধরে শুনলেন। শুনে বললেন—আমার পাঁচ ছেলে। তাদের একজন যাবে বক-রাক্ষসের উপহার নিয়ে। কুন্তী অবশ্যই ভীমের কথা মনে করেই তাঁর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। বামুন তো অনেক না-না করলেন, কিন্তু কুন্তী বললেন—আমার ছেলেকে আপনি চেনেন না। সে বড় সাংঘাতিক। অনেক রাক্ষস-ফাক্ষস জীবনে সে মেরেছে। সে রাক্ষসকে মেরে নিজেকেও বাঁচিয়ে ফিরবে। স্বয়ং যুধিষ্ঠির পর্যন্ত কুন্তীর এই পুত্র-বিতরণের উদারতায় খুশি হননি। ভয়ও দেখিয়েছেন অনেক। কিন্তু বীরমাতা তাঁর ছেলেকে চিনতেন। বিশেষত হিড়িম্ব-বধের পর ভীমের উপর তাঁর প্রত্যয় অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এই প্রত্যয়ের সঙ্গে ছিল ক্ষত্রিয়-জননীর উপকারবৃত্তি। সিংহ-জননী যেমন শিশুসিংহকে শিকার ধরার জন্য বেছে বেছে নরম শিকার ধরতে পাঠায় না, শিকারের উন্মুক্ত ক্ষেত্রে তাকে যেমন ছেড়ে দেয়, কুন্তীও তেমনই ব্রাহ্মণের প্রত্যুপকারবৃত্তির সঙ্গে তাঁর ক্ষত্রিয়-জননীর গর্বটুকু মিশিয়ে দিয়েছেন ভীমকে রাক্ষসের সামনে ফেলে দিয়ে।

একচক্ৰায় সেই বামুনবাড়িতেই ছিলেন কুন্তী আর পাণ্ডবরা। এরই মধ্যে এক পর্যটক ব্রাহ্মণ এসে পাঞ্চাল-রাজ্যে দ্রুপদের ঘরে ধৃষ্টদ্যুম্ন আর দ্রৌপদীর জন্মবৃত্তান্ত গল্প করে বলে গেলেন। কুন্তীর মনে বোধ হয় দীপ্তিময়া দ্রোপদী সম্বন্ধে পুত্রবধূর কল্পনা ছিল। কিন্তু মনে মনে থাকলেও সে-কথা একটুও প্রকাশ করলেন না। বরঞ্চ বেশ কাব্যি করে ছেলেদের বললেন—এখানে এই ব্রাহ্মণের ঘরে অনেক কাল থাকলাম আমরা—চিররাত্রোষিতা স্মেহ ব্রাহ্মণস্য নিবেশনে। এখানকার বন-বাগান—যা দেখবার আছে অনেকবার সেগুলি দেখেছি। বহুকাল এক জায়গায় থাকার ফলে ভিক্ষাও তেমন মিলছে না। তার চেয়ে চল বরং আমরা পাঞ্চালে যাই—তে বয়ং সাধু পাঞ্চালান্‌ গচ্ছামো যদি মন্যসে।

বলা বাহুল্য, পাণ্ডবরা জতুগৃহের ঘটনার পর দুর্যোধনের চোখে ধূলো দেবার জন্য ব্রহ্মচারী মানুষের বেশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। মায়ের কথায় পাঁচ ভাই পাণ্ডবেরা সবাই পাঞ্চালে যাবার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন। এই উপক্রমের মধ্যেই একচক্রার সেই বামুন বাড়িতে উপস্থিত হলেন ব্যাসদেব! যত বড় নিরপেক্ষ মুনিই তিনি হন না কেন, কুরুবংশের প্রতি এই ঋষির অন্য এক মমতা ছিল। বিশেষত পাণ্ডু ছিলেন তাঁরই ঔরসজাত সন্তান। তিনি মারা গেছেন, তবুও তাঁর স্ত্রী এবং ছেলেরা আপন জ্যাঠতুতো ভাইদের চক্রান্তে বনে বনে ঘুরে বেড়াচ্ছে—এই অন্যায় তাঁর সহ্য হয়নি। একচক্রার যে বামুন বাড়িতে কুন্তী আর পাণ্ডবরা ছিলেন, সে বাড়িতে তাঁদের বসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং বেদব্যাস—এবমুক্তা নিবেশ্যৈতান্‌ ব্রাহ্মণস্য নিবেশনে। কুন্তীকে আশীবাদ করে বলে গিয়েছিলেন—তোমার ছেলেরা ধার্মিক। রাজা হবে তারাই। পুত্রবধু কুন্তীকে অনেক আশ্বস্ত করে সেদিন তিনি চলে গিয়েছিলেন-কুন্তীমাশ্বায়ৎ প্রভুঃ—আজ যখন কুন্তী নিজেই আবার পাঞ্চালে যাবার প্রস্তাব করেছেন, তখন সেই বেদব্যাস আবার এসে কুন্তীকে তাঁর সমর্থন জানিয়েছেন এবং পাঞ্চালী দ্রৌপদীর কথাটাও বলেছেন এমন করে যাতে পাঁচ ভাইয়ের এক বউ হবেন দ্রৌপদী।

স্বয়ং পাণ্ডবভাইরাও ব্যাসের মর্ম-কথাটা তেমন করে বোঝেননি যেমন করে বুঝেছিলেন কুন্তী। পাঞ্চালে এসে কুন্তী আর পাণ্ডবভাইরা কুমোরপাড়ার একটি বাড়িতে বাসা বাঁধলেন। দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে যাবার দিনও তাঁরা ভিক্ষা করতেই বেরিয়েছিলেন। কিন্তু পথে ব্রাহ্মণদের মুখে স্বয়ম্বরের আয়োজন এবং ঘটা শুনে তাঁরাও গিয়ে উপস্থিত হলেন দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায়। এর পরের ঘটনা সবার জানা। অর্জুন লক্ষ্যভেদ করে দ্রৌপদীর বরমাল্য লাভ করলেন—অপিচ দ্রৌপদীর পাণিপ্রার্থী অন্যান্য রাজাদের সঙ্গেও তাঁকে এবং ভীমকে অনেক লড়তে হল। অবশ্য তাঁরা জিতেই ফিরলেন।

মহাভারতের জবান অনুযায়ী ভীম আর অর্জুনের সঙ্গে প্রতিপক্ষ রাজাদের লড়াই লাগবার সঙ্গে সঙ্গেই যুধিষ্ঠির, নকুল এবং সহদেব—এই তিনজন স্বয়ম্বর সভার বাইরে চলে এসেছেন, কিন্তু কোনওভাবেই বাড়িতে মায়ের কাছে ফিরে আসেননি। ভীম আর অর্জুন নববিবাহিতা বধূটিকে মায়ের কাছে নিয়ে এসে বলেছিলেন—মা, ভিক্ষা এনেছি। কুন্তী উত্তরে বলেছিলেন—যা এনেছ, তা সবাই মিলে ভোগ করো। এই কথার পর দ্রৌপদীকে দেখে কুন্তীর ভুল ভাঙে এবং তিনি যুধিষ্ঠিরের কাছে গিয়ে মীমাংসা চান, যাতে করে তাঁর কথাও থাকে, আবার পাঞ্চালী দ্রৌপদীও যাতে ধর্ম-সংকটে না পড়েন।

একটা মীমাংসার জন্য এই যে কুন্তী যুধিষ্ঠিরের কাছে ছুটে গেলেন, এইখানে মহাভারতের পাঠক-পণ্ডিতেরা কিছু কিছু অনুমান করেন। তাঁরা বলেন—কুন্তীর কথাটা কোনও হঠোক্তি নয়। কুন্তী বলেছিলেন—যা এনেছ, তা সবাই মিলে ভোগ করো। অনেকের ধারণা—স্বয়ম্বর সভার ফল-নিষ্পত্তি, যা দ্রৌপদীকে লাভ করার ফলে অর্জুনের সপক্ষেই ঘটেছিল—সে ঘটনাটা কুন্তীর জানা ছিল। এবং জানা ছিল বলেই ভাইদের মধ্যে যাতে এই নিয়ে কোনও বিভেদ না হয়, তাই তিনি ইচ্ছে করেই অমন কথাটা বলেছিলেন—যা এনেছ সবাই মিলে ভোগ করো।

মহামহোপাধ্যায় হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ এই কথাটা প্রথম এইভাবে বলার চেষ্টা করেন। যুধিষ্ঠিরের কাছে কুন্তী মীমাংসার জন্য গেলেন, আর সিদ্ধান্তবাগীশ লিখলেন বোঝা যাচ্ছে, যুদ্ধ শেষ হয়েছে শুনেই যুধিষ্ঠির, নকুল আর সহদেব (যাঁরা যুদ্ধের আরম্ভেই বাইরে এসেছিলেন) চলে আসেন কুম্ভকারগৃহে মায়ের কাছে। অর্থাৎ তাঁরাই বলে দেন—দ্রৌপদীকে লাভ করেছেন অর্জুন। তারপর যখন ভীম-অর্জুন দ্রৌপদীকে নিয়ে এলেন, তখন কুন্তী জেনে বুঝে অমন একটা হঠোক্তি করলেন—যা এনেছ সবাই মিলে ভোগ করো।

ঠিক এইখানে সিদ্ধান্তবাগীশের এই মত অথবা যে পণ্ডিতেরা এই মত পোষণ করেন তাঁদের সঙ্গে আমার মত-পার্থক্য হবার ভয় করি। কারণ মহাভারতে দেখছি—স্বয়ম্বর সভার জের টেনে যুদ্ধ-বিগ্রহ শেষ হতে হতে বেলা গড়িয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য দিন ছেলেরা যে সারাদিনের ভিক্ষা সেরে কুন্তীর কাছে ফিরে আসত—তারও একটা মোটামুটি সময়-সীমা নির্ধারিত ছিল। কিন্তু কোনওদিনই এমন দেরি হত না যাতে কুন্তী দুশ্চিন্তায় পড়তেন। কিন্তু এখানে দেখছি—তিনি মহা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন—ছেলেরা ফিরছে না, ভিক্ষা নিয়ে আসার সময়টাও পেরিয়ে গেছে—অনাগচ্ছৎসু পুত্ৰেষু ভৈক্ষ্যকালে’ ভিগচ্ছতি। কুন্তী এতটা ভাবছেন যে, ধৃতরাষ্ট্রের ছেলেরা হয়তো তাদের চিনে মেরে ফেলেছে। অথবা মায়াবী রাক্ষসেরা ধরে নিয়ে গেছে ছেলেদের।

দেখা যাচ্ছে, ছেলেরা বাড়ি ফেরেনি এবং ছেলেরা বাড়ি না ফিরলে মায়েদের যে দুশ্চিন্তা হয়, তাই কুন্তীর হচ্ছে। তার মানে যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব স্বয়ম্বর সভা থেকে বেরলেও বাড়ি ফেরেননি। সিদ্ধান্তবাগীশ পরে যা লিখেছেন (যা আমরা আগে বলেছি) তার একান্ত স্ববিরোধে এইখানে কুন্তীর দুশ্চিন্তার টীকা রচনা করে বলেছেন—যুধিষ্ঠির, নকুল আর সহদেব বাড়ি ফেরেননি। তাঁরা স্বয়ম্বরের যুদ্ধ রঙ্গ থেকে বেরিয়ে গিয়ে কুম্ভকারগৃহে আসবার পথে কোথাও অপেক্ষা করছিলেন। যদি এই যুদ্ধ বিগ্রহ দূরে তাঁদের বাড়ি পর্যন্ত ছড়ায়, যদি মায়ের কোনও বিপদ হয়, তাই রাস্তাতেই তাঁরা গার্ড দিচ্ছিলেন—যুধিষ্ঠির-নকুল-সহদেবাঃ মাতৃরক্ষার্থং রঙ্গান্নিষ্ক্রম্য তৎকুম্ভকারভবনাক্রমণপথে প্রতীক্ষন্তে স্ম ইতি প্রতীয়তে। দেখা যাচ্ছে, সিদ্ধান্তবাগীশ আগে এক রকম বলেছেন, পরে আরেক রকম বলেছেন।

বস্তুত আমরাও এই অনুমানটাই মানি। হয়তো বাড়তি এইটুকু বলি যে, মায়ের বিপদ হবে—এই ভয়ে নয়, তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন ভীম আর অর্জুনের আশঙ্কাতেই। যুদ্ধিষ্ঠির, নকুল-সহদেব—যুদ্ধবিগ্রহের ব্যাপারে যত ল্যাঙপ্যাঙাই হন না কেন, তাঁরা পালিয়ে যাবার মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন না। তাঁরা অপেক্ষা করছিলেন যদি বাইরে থেকেও কোনও আক্রমণ হানতে হয়। ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধনীতিতে পাঁচজন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে কেউ যুদ্ধ করে না। ভীম অর্জুন যুদ্ধ করছেন, সেখানে দরকার হলে বাইরে থেকে আক্রমণ শানানোর সুবিধে বেশি। হয়তো সেই কারণেই তাঁরা রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন। এবং ভীম-অর্জুন যুদ্ধ জিতে দ্রৌপদীকে নিয়ে রাস্তায় নামামাত্রই তাঁরাও এসেছেন একই সঙ্গে। যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব—কেউই ভীম-অর্জুন ফেরার আগে বাড়ি ফিরেছিলেন—কুন্তীর দুঃশ্চিন্তার নিরিখে সে-কথা বিশ্বাস হয় না। সিদ্ধান্তবাগীশ একবার রাস্তায় অপেক্ষা করার কথা বলে পরে নিজেকে বাঁচানোর জন্য লিখেছেন—যুদ্ধের শেষ খবর শুনেই তাঁরা বাড়ি ফিরেছেন। আমি বলি—যুদ্ধ শেষ হলে তার প্রতিক্রিয়া হবে ভাইদের সঙ্গে মিলিত হওয়া। প্রায় এক বয়সের ভাইয়েরা আগে নিজেরা একসঙ্গে মিলবে, তারপর হই হই করে মায়ের কাছে যাবে। এই রকম হয়।

অবিশ্বাসী পণ্ডিতেরা বলেন—অন্য ভাইরা যদি আগে না ফিরেই থাকেন, তবে ভীম আর অর্জুনকেই শুধু মায়ের কাছে গিয়ে ভিক্ষা এনেছি বলে দাঁড়াতে দেখলাম কেন? আমি বলব লজ্জা, এর কারণ, লজ্জা। যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব যুদ্ধ-টুদ্ধ কিছুই করেননি, অথচ নতুন বউকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের সামনে গিয়ে বেশ দালালি করে একটা কথা বলবেন—এটা তাঁদের ক্ষত্রিয়বুদ্ধিতে লজ্জা দিয়েছে। তা ছাড়া নতুন বউটিই বা কী ভাববে? তিনি স্বয়ম্বরের রঙ্গস্থলে অর্জুনকেও দেখেছেন, ভীমকেও দেখেছেন। অতএব তাঁরা যে কথাটা বলতে পারেন, যুধিষ্ঠির, নকুল বা সহদেবের সে-কথা বলা মানায় না। তাই তাঁরা কিছু বলেননি এবং মায়ের সঙ্গে বউ-পরিচয়ের চরম লগ্নে তাঁরা একটু আড়ালেই থেকেছেন।

কিন্তু যে মুহূর্তে ভুল ভেঙেছে, যে মুহূর্তে তিনি বুঝেছেন—ফস করে নতুন বউয়ের সামনে অমন কথাটা বলা ভুল হয়ে গেছে, অমনই কুন্তী তাঁর বড় ছেলের কাছে দৌড়ে গেছেন। নব-পরিণীতা দ্রৌপদীকেও দেখাতে চেয়েছেন–ক্ষত্রিয়ের বাড়িতে যুদ্ধ জিতে বউ নিয়ে আসাটা যেমন বড় কিছু কথা নয়, তেমনই যুধিষ্ঠির যুদ্ধ না করলেও তাঁর মতের মূল্য কিছু কম নয়। কারণ ক্ষত্রিয়ের কাছে যুদ্ধবৃত্তি যত বড়, ধর্মবুদ্ধি তার থেকেও বড়। তিনি একটা কথা ভুল করে বলে ফেলেছেন, তার মীমাংসার ভার তিনি দিয়েছেন বড় ছেলে যুধিষ্ঠিরের হাতে। দেখাতে চেয়েছেন—ভীম-অর্জুন যত বড় যুদ্ধবীরই হোক, আমার অন্য ছেলেগুলিও কিছু ফেলনা নয়। সঙ্গে নতুন বউটির সুকুমার মনোবৃত্তির কথাটাও কুন্তী ভুলে যাননি। যুধিষ্ঠিরকে তিনি বলেছেন—এমন একটা মীমাংসা কর, যাতে আমার কথাটাও মিথ্যে হয়ে না যায়, আর কৃষ্ণা পাঞ্চালীরও যেন কোনও বিভ্রান্তি না হয়—ন চ বিভ্রমেচ্চ।

যুধিষ্ঠির সিদ্ধান্ত দেবার আগে অর্জুনকে যাচিয়ে নিয়েছেন। বলেছেন—তুমিই দ্রৌপদীকে জয় করেছ। তুমিই তাঁকে বিবাহ করো। অর্জুন সলজ্জে বলেছেন—না দাদা, আগে তোমার বিয়ে হোক, ভীমের বিয়ে হোক, তারপর তো আমি। মনে রাখবেন কথাটা অর্জুনকে বলা হয়েছে, অর্জুনই তার উত্তর দিয়েছেন। কুন্তীর এখানে কোনও পার্ট নেই। রসজ্ঞ মানুষেরা বলতে পারেন—কুন্তীর এ বড় অবিচার। কই হিড়িম্বা যখন ভীমকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, তখন তো কুন্তী বলেননি—আগে আমার বড় ছেলে যুধিষ্ঠির বিয়ে করবে, তারপর ভীম।

আমি বলি—ভীমের জন্য হিড়িম্বা লজ্জা ত্যাগ করে যে সব কথা বলেছিলেন, সে সব কথা যদি বিদগ্ধা রাজনন্দিনীর মুখ দিয়ে বেরত, তাহলে যুধিষ্ঠির-কুন্তী নিশ্চয়ই অন্যভাবে ভাবতেন। তা ছাড়া ভীম স্বয়ং তো একবারও বলেননি যে, দাদা! এই রাক্ষসী-সুন্দরীকে আগে তুমি বিয়ে করো, তারপর তো আমার বিয়ের কথা আসবে। ভীম সরল লোক। দেখলেন—হিড়িম্বাও জোরজার করছে, মাও বলছেন। তিনি নির্দ্বিধায় হিড়িম্বাকে নিয়ে চলে গেছেন অন্য জায়গায়। কিন্তু অর্জুন যে মহাভারতের নায়ক। যুধিষ্ঠির প্রস্তাব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মায়ের বিপাকের কথা ভেবেছেন, দ্রৌপদী সম্বন্ধে ব্যাসদেবের ভবিষ্যৎ-বাণী স্মরণ করেছেন এবং নব-পরিণীতা বধূর সামনে নিজের চারদিকে নায়কোচিত দূরত্বের আড়াল ঘনিয়ে নিয়ে বলেছেন—দাদা, আগে তোমার বিয়ে হোক, তারপর ভীমের বিয়ে হোক, তারপর তো আমি। আমাকে দিয়ে অধর্ম করিয়ো না।

কুন্তী এখানে কী করবেন? এখানে তাঁর কৃত্য কিছু নেই। বিদগ্ধা দ্রৌপদীও কিছু বলেননি। অতএব সমস্ত সিদ্ধান্তটাই চলে গেছে যুধিষ্ঠিরের হাতে। বলতে পারেন—যুধিষ্ঠির যখন—‘দ্রৌপদী আমাদের সবারই মহিষী হবেন’—বলে সিদ্ধান্ত দিলেন, সেটাতে কুন্তী আপত্তি করেননি কেন? করেননি, কেননা এতে তাঁর হঠোক্তির দায়টাও চলে গেছে, আর পাঁচ-জনের এক স্ত্রী হলে ভাইদের মধ্যে ভেদ-বিভেদ হবে না—এই সুন্দর যুক্তিটা তাঁর পরম ঈপ্সিত ছিল। কিন্তু এটা তিনি জেনে বুঝে করেছেন তা মনে হয় না। তা ছাড়া এই বিয়ে নিয়ে পরেও কম লড়তে হয়নি। মহামতি দ্রুপদের সঙ্গে, ধৃষ্টদ্যুম্নের সঙ্গে সবার সঙ্গে এই মায়ের বচন নিয়ে যুধিষ্ঠিরকে তর্ক করতে হয়েছে। আর কুন্তী যে জেনে বুঝে পাঁচ ছেলের সঙ্গে এক রূপসীর বিয়ের ব্যবস্থা করার জন্যই ফস করে একটা মিথ্যার মতো সত্য কথা বলেছেন, তা মনে করি না। আরও মনে করি না এই কারণে যে, দ্রুপদের সভায় অত বড় ঋষি-শ্বশুর স্বয়ং ব্যাসদেবের কাছে কুন্তী অত্যন্ত বিপন্নভাবে আর্জি জানিয়েছেন—ছেলেপিলেদের কাছে আমার কথাটা একেবারে মিথ্যে হয়ে যাবে বলে আমি বড় ভয় পাচ্ছি, আমি কী করে এই মিথ্যা থেকে মুক্তি পাব বলুন—অমৃতান্মে ভয়ং তীব্ৰং মুচ্যে’হম্‌ অনৃতাৎ কথম্? আর যাই হোক, বেদব্যাসের সঙ্গে কুন্তী চালাকি করবেন না।

শেষমেশ যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্তে এবং ব্যাসদেবের অনুমোদনে কুন্তীর হঠাৎ বলা কথাটাই পাঁচ ছেলের একত্রে বিবাহের মঙ্গলে সমাপ্ত হল। বিয়ে হলে স্বামীহারা কুন্তী নববধূ দ্রৌপদীকে স্বামীদের কাছে আদরিণী হবার আশীর্বাদ করলেন প্রথমে। তারপরই প্রবাসিনী রাজমাতা ছেলেদের রাজ-সৌভাগ্যের সম্ভাবনায় কল্যাণী বধূকে বললেন—কুরুদের রাজ্যে তুমি স্বামীর সঙ্গে রাজ-সিংহাসনে অভিষিক্ত হও। ভাষাটা ছিল—তুমিই তোমার আপন ধর্ম-সৌভাগ্যে স্বামীকে বসাবে রাজার আসনে-অনু ত্বম্‌ অভিষিচ্যস্ব নৃপতিং ধর্মবৎসলা। কুন্তীর তৃতীয় আশীর্বাদ ছিল কুরুবংশের গর্ভধারিণী জননীর একাত্মতায়। তিনি বলেছিলেন—আজকে যেমন বিবাহের পট্টবস্ত্র পরিহিত অবস্থায় তোমাকে অভিনন্দিত করছি, তেমনই তোমার ছেলে হবার পর পুত্র-সৌভাগ্যবতী তোমাকে আবারও অভিনন্দিত করব।

এই তিনটি আশীর্বাদের মাধ্যমে কুন্তী একদিকে যেমন নববধূ দ্রৌপদীকে কুলবধূর স্বতন্ত্র মার্যাদায় প্রতিষ্ঠা করেছেন, তেমনই তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন প্রসিদ্ধ ভরত-বংশের পরম্পরার মর্যাদা। দ্রৌপদীর সৌভাগ্যেই হোক অথবা পাণ্ডবদের ধৈর্য এবং বীর্যে, মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত পাণ্ডবদের অর্ধেক রাজ্য দিয়ে দিতে বাধ্য হলেন। রাজমাতা হওয়া সত্ত্বেও যে অপমান এবং বঞ্চনার গ্লানি নিয়ে কুন্তীকে ঘর ছাড়তে হয়েছিল, কুন্তী সেই ঘরে ছেলে এবং ছেলের বউ নিয়ে ফিরে এলেন সগৌরবে। যুধিষ্ঠির রাজ্য পেলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। ঘটা করে রাজসূয়যজ্ঞ করলেন। আর কুন্তী! নববধূ দ্রৌপদীর হাতে সমস্ত গৌরবের সম্ভাবনা ছেড়ে দিয়ে নিজে সরে রইলেন রাজমাতার দূরত্বে। ভাবটা এই—স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা মাতা হিসেবে ছেলেদের আমি রাজত্বে প্রতিষ্ঠিত দেখলাম। এইবার তোমরা সুখে থাকো। আমি দায়মুক্ত।