নিম্নোক্ত কাব্যগ্রন্থগুলি সাজানো হয়নি

একটি বিনষ্ট নগরের দিকে

অচেনা জ্যোৎস্নায় বুঝি এসে গেছি। চতুর্দিকে ঘোড়ার কঙ্কাল
ঝুলে আছে, দরজায় দরজায় ঊর্ণাজাল; এখানে-সেখানে
বিষণ্ন কাদার মূর্তি এলোমেলো, অসংখ্য বাতিল ট্রাকে, বাসে
এলাহি বল্মীক আর রাশি রাশি উজাড় বোতল সবখানে।
হে পুরুষ, হে মহিলা আপনারা কোথায় এখন, কোন্‌ দূরে?

দশকে চার দিয়ে গুণ করে আমার বয়স আরো কিছু দূর
হেঁটে যায়, কী একাকী পদচিহ্ন পড়ে শহরের পথে পথে
প্রচ্ছন্ন গলিতে।
শহরের সব দুঃখ আমার মুখের ভাঁজে ভাঁজে
গাঁথা; আমি দুঃখের বাইরে চলে যেতে চেয়ে আরো
বেশি গাঢ় দুঃখের ভিতর চলে যাই, যেন কোনো
একা আদি মানবের বেলাশেষে নিজের গুহায়
নিঃশব্দ প্রস্থান।

বারুদমণ্ডিত কাঠিগুলি একে একে পড়ে গেলে দেশলাই
খুব শূন্য থেকে যায়, অনুরূপ শূন্যতায় ভোগে
এ মূক শহর সারাবেলা, ট্রম্বোন দূরের কথা, এমনকি
দিকপ্রিয় পুলিশের বাঁশিও যায় না শোনা কোথাও এখন।

একটি বিনষ্ট নগরের দিকে চেয়ে থাকা কী যে
শিরাবিদারক মুহূর্তের চাপ সয় যাওয়া রুক্ষ
জনশূন্যতায় পথ ফেলে দীর্ঘশ্বাস ঘন ঘন
ঘূর্ণমান পুরনো কাগজ
ল্যাম্পেস্টের নিচে খুব শীতকাতুরে পাখির মতো
পড়ে আছে, গাছগুলি বিধ্বস্ত পাথুরে মূর্তি যেন।
নৈঃশব্দের দীর্ঘ জিভ কেবলি চাটছে বাড়িঘর,
সারি সারি থাম,
যেমন কামুক
তন্ময় লেহন করে মেয়েমানুষের ঊরু। যে-জীবন করিনি যাপন
তারই ছায়া দুলে ওঠে, দুলে ওঠে মহা ব্যালে। কেন মুছে যায়?
নৈঃসঙ্গে বিলুপ্তিবোধ তীব্র হয়, বড়ো তীব্র হয়।

বেসিনে বেসিনে ধুলো পুরু হয়ে জমে নিশিদিন,
রক্তিম আরশোলা ঘোরে মেঝেতে দেয়ালে, ঝাঁক ঝাঁক।
মুরগী রান্না হয়ে পড়ে আছে ঠাণ্ডা রন্ধনশালায়,
খাবার টেবিলে নিঃসঙ্গতা, মেঘের মেরুতে ভাসমান স্মিত
চার্বাকের খুলি!
শুধু একজন কী খেয়ালে দেয়ালের দিকে মুখ রেখে তার
গোসলখানার চৌবাচ্চায় ছিপ ফেলে প্রহরের পর
প্রহর দাঁড়ানো।

বিদঘুটে মরুচারী পাখি দেখি ছাদে ও কার্নিশে, শত শত;
ওদের ক্ষুধার্ত চোখে সিমুমের স্মৃতি আর দীপ্র মরীচিকা।
‘ফুটপাতে কতকাল পড়ে না মানুষী পদচ্ছাপ’ বলে ওরা
শহরের শীর্ষে ওড়ে পাখায় বাজিয়ে অট্রহাসি বারবার।

হঠাৎ অসুস্থ লাগে খুব; তাহলে কি ওরা সব, এলেবেলে
এই শহরের নাগরিকবৃন্দ, মৃত অনুরূপ অসুখেই?