1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৬

ছয়

মাত্র দশ মিনিটে সমস্ত বিল ঢুকিয়ে দিয়ে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইয়ু ইন থেকে বেরিয়ে গাড়িতে চাপল রানা। কয়েক মিনিট পর পেছনে পড়ল ভিলেনিউভ শহর। রানা ভেবেছে, নির্জন কোনও বসতিতে গিয়ে ঠাঁই নেবে। ছত্রিশ ঘণ্টা ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করবে। তারপর গোপনে গিয়ে টিকেট কেটে ঢুকে পড়বে টাউন হলে। ব্যাপারটা খুব কঠিন হবে না। পরদিন ফিরবে নিউ অর্লিন্সে। শেরিফ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পালাবে লুইযিয়ানা ছেড়ে।

রানার ম্যাপে দেখা যাচ্ছে, কাছেই ছোট শহর চিটিমাচা। পশ্চিমে পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ। সহজেই ওখানে লুকিয়ে থাকতে পারবে। আখ আর মিষ্টি আলুর খেতের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা পথে উড়ে চলেছে ওর মার্সিডিয সেডান। মাঝে মাঝে দু’দিকে জলাভূমি, ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ওঅটার ওয়ে আর তেলের পাইপ লাইন। চিটিমাচার কাছাকাছি পৌঁছে নির্জন কোনও মোটেলের জন্যে চোখ খোলা রাখল রানা। তবে তাতে কোনও লাভ হলো না। সড়কের পাশে রয়েছে শুধু ডিক্সি বিয়ারের ভাঙাচোরা বিলবোর্ড। আনমনে ভাবল রানা, এতই জনপ্রিয় এই বিয়ার?

কয়েক মিনিট পর শহরে প্রবেশ করল রানার মার্সিডিয।

ভিলেনিউভকে শহর বলে ধরে নিলে বড়জোর মাঝারি আকারের একটা গ্রাম এই চিটিমাচা। এই বসতি গড়ে উঠেছে সেইন্ট-ম্যারি বাইয়ুর পুবতীরে। পশ্চিম দিয়ে ঢুকতে হলে পেরোতে হবে গৃহযুদ্ধের আমলে তৈরি কাঠের সেতু। নিচে বাইয়ুর সরু অংশ। মাঝ সকালে এরই ভেতর তপ্ত হয়ে উঠেছে পরিবেশ। রানার মনে হলো ঘন, গরম স্যুপের ভেতর সাঁতার কাটছে ও।

বাইয়ুর ওপর এবং দু’দিকের তীরে ঘন হয়ে ধোঁয়ার মত উড়ছে অসংখ্য কীট-পতঙ্গ। চারপাশ দেখে আমায়নের কথা মনে পড়ল রানার। বাতাসে বাইয়ুর বদ্ধ জলের গন্ধ। তার সঙ্গে মিশেছে মাছের পচা, আঁশটে দুর্গন্ধ। দিনের পর দিন পরিষ্কার না করলে অ্যাকুয়েরিয়ামে এমন কুবাস হয়। কাঠের সেতুর নিচে, তীরে যার যার কাজে ব্যস্ত একদল জেলে। ছোট সব জেটিতে উঁচু করে রাখছে লবস্টারের ফাঁদ। ধীর বেগে সরে যাচ্ছে বাইয়ুর কাদাপানি। তারই ওপর মৃদু দুলছে চ্যাপ্টা তলিওয়ালা ডোরিগুলো। তীর থেকে একটু দূরে কিছু দোকান। সাইনবোর্ডে লেখা:

জ্যান্ত কেঁচো পাওয়া যায়।
ভাড়া দেয়া হয় বোট।

চিটিমাচায় আসছে-যাচ্ছে একটা-দুটো গাড়ি। এদিকের অন্যান্য এলাকার মতই প্রতি তিনটে গাড়ির ভেতর অন্তত দুটো হচ্ছে পিকআপ ট্রাক। সেতু পেরোবার পর দু’দিকে কিছু জেলে কুটির দেখল রানা। ওখানে বিক্রি হচ্ছে গাসপারগু আর গার মাছের বড়ি। এ ছাড়া, আর কী পাওয়া যায়, আঁচ করতে পারল না রানা। একবার গতি কমিয়ে প্রায় থামিয়ে ফেলল গাড়ি। এক কুটিরের সামনে বড় একটা হুকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে বিশাল এক মাছ।

অতীতে রানা দেখেছে, কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জে ক’টা টাইগার শার্ক মিলে খেয়ে নিয়েছিল এক লোককে। এই মাছটা ওসব হাঙরের চেয়েও ভয়ঙ্করদর্শন। অনেকটা বিশাল পাইক মাছের মত, আবার মিল আছে অ্যালিগেটরের সঙ্গেও। চোয়াল ভরা গিজগিজে ক্ষুরধার দাঁত।

কে যে ওটা খেতে চাইবে, ভেবে পেল না রানা। একবার হতভাগ্য কোনও জেলে বাইয়ুর পানিতে পড়লে, আর ওই মাছ হামলা করলে কী হবে, ভাবতে গিয়ে গলা শুকিয়ে এল ওর।

চিটিমাচার মাঝামাঝি পৌছে ভিলেনিউভ শহরের মতই ঘাসে ছাওয়া টাউন স্কয়্যার দেখল রানা। কোথাও লোকজনের ভিড় নেই। অবশ্য ব্যস্ততা রয়েছে চারপাশের বাইয়ুতে।

নীরব, নির্জন বসতি পেয়ে খুশিই হলো রানা। মাঝে মাঝে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে একটা-দুটো পিকআপ ট্রাক। রোদে পার্ক করে রাখা হয়েছে ধুলোমাখা কিছু গাড়ি। ওগুলোর বয়স ওর দ্বিগুণ, কোনটা আবার তিনগুণ। এক হার্ডওয়্যার স্টোরের সামনের ডিসপ্লেতে রানা দেখল: ওখানে পাওয়া যায় চেইন স’ অয়েল থেকে শুরু করে ক্রফিশ বয়লার পর্যন্ত প্রায় সবই। একটু দূরের গ্রোসারি স্টোরের রোদে পোড়া প্ল্যাকার্ডে লেখা:

‘বোতল-কে-বোতল কোকা-কোলা পান করুন!
নইলে বাঁচবেন না বেশিদিন!’

ওই দোকানের পাশে আগে ছিল নাপিতের দোকান। সে স্টল এখন ফাঁকা। পরের দোকানটাও বন্ধ। পরিত্যক্ত ক্যাফের চেয়ার ও টেবিল পড়ে আছে রাস্তার ধারে। বসার কেউ নেই।

শহরের সেরা ব্যবসা করছে প্রাচীন এক পেট্রল পাম্প স্টেশন। ওটার ছাতে মনের সুখে জন্মেছে ঝোপঝাড়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও আগের তৈরি দুটো পেট্রল পাম্পের পেছনে, প্রায় ভাঙা এক বেঞ্চিতে বসেছেন তেল-কালি মাখা ওভারঅল পরা এক বৃদ্ধ। শিথিল দুই ঠোঁটের মাঝে ঝুলছে ভুট্টার ডাঁটি দিয়ে তৈরি পাইপ। তাঁকে দেখে রানার মনে হলো, পাথরের ওপর রোদে বসে গা গরম করছে হাজার বছর বয়সী এক বুড়ো গিরগিটি।

একপাশের পাম্পের সামনে গাড়ি রাখল রানা। বেঞ্চি ছেড়ে ট্যাঙ্কে পেট্রল ভরতে লাগলেন বৃদ্ধ। মুখে রা নেই। ঠোঁটে ঝুলছে পাইপ। ওটা জ্বলন্ত কি না, কে জানে!

দপ্ করে আগুনে পুড়ে মরার ভয় পাচ্ছেন না বৃদ্ধ। কাজেই নিজেও ঠিক করল রানা, ওই ব্যাপারে চুপ থাকবে।

‘সিযন এলে ব্যবসা জমে ওঠে, তাই না?’ আলাপের ভঙ্গিতে বলল রানা। জবাবে বিড়বিড় করে কী যেন বললেন বৃদ্ধ। ওটা বিকৃত ফ্রেঞ্চ বলেই মনে হলো রানার। ক্যাজুন উচ্চারণ। আধুনিক ফ্রেঞ্চরা ওটা বুঝবে না, ওর তো বোঝার কোনও উপায়ই নেই। এবার ধীরে ধীরে বলল রানা, ‘চিটিমাচায় কখনও হোটেলের মত কিছু দেখেছেন?’

জিভ দিয়ে চপাস্ আওয়াজে ঠোঁট থেকে পাইপ নামালেন দাদুভাই। ভিজে জবজব করছে পাইপের গোড়া। হড়বড় করে কীসব যেন বললেন তিনি। অনেক মাথা খাটিয়ে একটা দুটো শব্দ বুঝতে পারল রানা। সেগুলোর ভেতর একটা হচ্ছে: পেনশন। ফ্রেঞ্চ ভাষায় ওটার মানে গেস্টহাউস।

পেট্রল ভরে দেয়ার পর টাকা বুঝিয়ে দিল রানা। রওনা হওয়ার আগে বলল, ‘মার্সি, মোসিউ।’

চিটিমাচার রাস্তা ধরে সিকি মাইল যাওয়ার পর দু’দিকে শুরু হলো প্রায় ধসে পড়া বাড়ির সারি। যেদিকে চোখ গেল, ভিলেনিউভ শহরের মতই এখানেও যেন জাল বিছিয়ে দিয়েছে চরম দারিদ্র্য। তবে তারই মাঝে একটা বাড়ি একদম আলাদা। সদ্য রঙ করা হয়েছে নতুন করে। কড়া রোদে রীতিমত ঝকমক করছে। সামনের গেটের এদিকে সবুজ এক হ্যাচব্যাক জিএমসি গাড়ি। ওটাও প্রায় নতুন। যত্ন নেয়া হয় নিয়মিত। গেটের ওপরে হাতে লেখা ফ্রেঞ্চ সাইনবোর্ড। ওখানে বলা হয়েছে: ‘স্বাগতম লিয বাউয়ারের পেনশনে!’ নিচে ইংরেজিতে লেখা: ‘ওয়েলকাম টু লিযে’স গেস্টহাউস।’

জিএমসি গাড়ির পেছনে মার্সিডিয রাখল রানা। ‘ থেকে নেমে খুলল বাড়ির মেইন গেট। সরু পথ পেরিয়ে থামল বাড়ির দরজার সামনে। পাশের কলিংবেল টিপে দেয়ার একমিনিট পর শুনল ভেতর থেকে আসছে পদশব্দ। প্রথমে খুলে গেল ভেতরের দরজা, তারপর সরানো হলো স্ক্রিন ডোর। রানার সামনে দেখা দিয়েছে বিশালদেহী, মোটাসোটা এক কৃষ্ণাঙ্গিনী। তিন শ’ ওয়াটের এলইডি বালবের তিনগুণ বেশি উজ্জ্বল হাসি তার মুখে। আন্তরিক সুরে বলল, ‘হ্যাঁ, খবর কী, শুগাহ্! আমি লিয বাউয়ার। তোমার জন্যে কী করতে পারি, ডিয়ারি?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *