1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৩০

ত্রিশ

চোখ থেকে বিনকিউলার নামিয়ে আবারও গাড়ির কাছে ফিরল রানা। সংগ্রহ করে নিল জ্যাকেট, রনের দেয়া ধনুক ও তীর ভরা তূণ। কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে মন্টি ডয়েলের। এখন পাগল হয়ে উঠেছে গাড়ির বুট থেকে বেরোতে। ধুপধাপ ঘুষি মারছে ডালার নিচে। সেইসঙ্গে চাপা স্বরে শোনা যাচ্ছে সাহায্যের আর্তি। আপাতত তার জন্যে কিছু করার নেই রানার। বড় গাড়ির বুটের ভেতর যথেষ্ট জায়গা আছে। আরাম করে শুয়ে থাকুক না ব্যাটা!

দরকারি জিনিসগুলো নিয়ে আবারও ঢালু জমির প্রান্তে পৌঁছুল রানা। গাছ বা ঝোপঝাড়ের আড়াল নিয়ে এগোল কম্পাউণ্ডের দিকে। নির্জন এলাকায় নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবলেও একটু পর নোভাকরা হয়তো বুঝবে, কতবড় ভুল হয়েছে তাদের।

কাদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, ভাল করেই জানে এখন রানা। কম্পাউণ্ডে রয়েছে সশস্ত্র গার্ড। গোনায় রাখতে হবে দানব কাঠুরেকে। এ ছাড়া, রয়েছে তিন নোভাক ভাই। জোসেফের কথা অনুযায়ী, তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে বড় ভাই রিচি নোভাক।

ঢালু হয়ে আবারও উঠে পেরিমিটার ফেন্সে গিয়ে মিশেছে ঘন ফার্নে ভরা জমি। তার মাঝ দিয়ে এগোল রানা সতর্ক শিকারি চিতার মত। তারের বেড়ার কাছে পৌছুতে লাগল পুরো দশ মিনিট। ফার্নের মেঝেতে শুয়ে ভালমত দেখল কম্পাউণ্ডের উঠান, গাড়িগুলো আর বড় ঘরটা। চিমনি দিয়ে ওঠা ধোঁয়া ছাড়া কিছুই নড়ছে না। কোথায় যেন উধাও হয়েছে কুঠারওয়ালা দানব। গার্ডের কুটির থেকে আর বেরোয়নি বন্দুকধারী প্রহরী।

পকেট থেকে মাল্টিটুল নিয়ে ওটার কম্বাইণ্ড প্লায়ার্স আর ওয়াএয়ার কাটার খুলল রানা। সাবধানে একে একে কাটতে লাগল মেশ তারের বেড়া। নিজের জন্যে তৈরি করছে ক্রল করে ঢোকার মত জায়গা। পাশ দিয়ে গেলে ছেঁড়া জায়গাটা দেখে সবাইকে সতর্ক করবে যে-কোনও গার্ড। তবে রানা আশা করছে, কেউ এদিকে আসার আগেই ভেতরে ঢুকে কোথাও লুকিয়ে পড়তে পারবে ও।

একটু পর তার কেটে নিজের জিনিসপত্র ভিতরে ঢুকিয়ে রেখে ক্রল করে ঢুকল রানা। উঠে একদৌড়ে পৌঁছুল সবচেয়ে কাছের জংধরা ছাউনির পাশে। কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে কান পেতে অপেক্ষা করল। দূরে ডিযেল জেনারেটরের গর্জন, এ ছাড়া কোথাও কোনও আওয়াজ নেই। পাকা চোরের মত পা টিপে গাড়িগুলোর কাছে পৌঁছুল রানা। থামল কালো মাস্ট্যাং গাড়ির পাশে। মাল্টিটুলের ছোট্ট ছুরি ব্যবহার করে ফাঁসিয়ে দিল পেছনের ডানদিকের চাকা।

হাত রেখেছে ফুটোর ওপর। আহত সাপের মত ফোঁস ফোঁস আওয়াজে টিউব থেকে বেরোচ্ছে প্রেশারাইড্ বাতাস। ধীরে ধীরে ডেবে গেল গাড়ির পেছনের ডানদিক এবার মাস্ট্যাঙের অন্য চাকার বারোটা বাজাল রানা। পরের দশ মিনিটে সর্বনাশ হলো পিকআপ ও ক্যাডিলাকের চাকাগুলোর। রানা নিশ্চিত হয়ে গেল, চট্‌ করে এই কম্পাউণ্ড ছেড়ে বেরোতে পারবে না এখন কেউ।

খোঁড়া সব গাড়ির কাছ থেকে সরে গার্ডের কুটিরের দিকে চলল রানা। ওই ঘরটা ওঅর্কশপ হিসেবেও ব্যবহার হয়। ভেতরে যন্ত্রপাতি ও ভাঙাচোরা জিনিসপত্র। ধুলোভরা জানালার কাঁচের ওদিক দিয়ে দেখা যায় কম্পাউণ্ডের গেট। অবশ্য আপাতত ওদিকে নজর নেই গার্ডের। ঘরের কোণে আর্মচেয়ারে আধশোয়া হয়েছে সে। দেয়ালের পেরেক থেকে ঝুলছে স্লিং বাঁধা বন্দুকটা। অস্ত্রটা আছে লোকটার কাছ থেকে কয়েক ফুট দূরে। গার্ডের পাশের ওঅর্কবেঞ্চে পড়ে আছে একটা ওয়াকি-টকি। রানা ঘরে ঢুকলেও ওটার দিকে হাত বাড়াল না লোকটা, নিদ্রাদেবীর আরাধনায় ব্যস্ত! কনুইয়ের কাছে আধ খালি চোলাই মদের বোতল। শ্বাস থেকে বাজে গন্ধ পেয়ে যা বোঝার বুঝে নিল রানা।

গার্ড চট্ করে জেগে উঠুক তা চায় না, তাই ওঅর্কবেঞ্চের যন্ত্রপাতির মাঝ থেকে মাঝারি একটা হাতুড়ি নিল ও। ওটা দিয়ে খটাস্ করে হালকা এক ঘা বসিয়ে দিল লোকটার মাথার পাশে। মাপা হাতের মার, রানা বুঝল অন্তত দুইটা ঘণ্টা স্বপ্নের জগতে ঘুরে বেড়াবে গার্ড। মোটা পেটসহ খাড়া করে তাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল রানা। বেশ কয়েকটা ইলেকট্রিকাল তার দিয়ে আচ্ছামত বেঁধে ফেলল অচেতন গার্ডের দুই কবজি আর দুই গোড়ালি। কাজটা শেষ করে ঘুরে দেখল ঘরের চারপাশ। মাঝের বেশির ভাগ জায়গা দখল করেছে তামার তৈরি ইয়াজদাহা এক সিলিন্ডার। ওটা ব্যবহার করা হয় তরল রাখার ট্যাঙ্ক হিসেবে। সিলিণ্ডার থেকে খুলে ওঅর্কবেঞ্চে রাখা হয়েছে তামার নানান আকার-আকৃতির পাইপ।

এখানে যে মদ চোলাই হচ্ছে, সেটা বুঝতে তামার সিলিণ্ডারের বেশি আর কিছু দেখতে হবে না। মাতাল হওয়ার আগে চোলাই মদের ট্যাঙ্ক মেরামত করছিল মোটা গার্ড। বেশ ক’টা পাইপে জড়িয়ে নিয়েছে গ্যাফার টেপ। পাতলা তামার ট্যাঙ্কের গায়ে খুদে সব ফুটো। ওদিক দিয়ে দাহ্য লিকার বেরোলে যে-কোনও সময়ে আগুন ধরবে। ফলাফল ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ। বেঞ্চে সোল্ডারিং আয়ার্ন রেখেছে লোকটা। ওটার ডগা এখন ঠাণ্ডা। পাশেই এক রোল স্টিল উল- তামা মসৃণ করার কাজে বা আয়ার্ন পরিষ্কারে ব্যবহার হচ্ছিল।

দারুণ কাজের লোক, মনে মনে বলল রানা। অন্য চিন্তা এল ওর মনে। এই কম্পাউণ্ডে একা ঢুকেছে। জানা নেই ওর বিপক্ষে কতজন লোক। তাদের কেউ কেউ সশস্ত্র, দেখেছে। নোভাকরা চাইবে না ফাঁস হোক কোথায় আছে তাদের গোপন কারখানা। সুতরাং অচেনা কাউকে কম্পাউণ্ডে দেখলেই মরিয়া হয়ে উঠবে তারা। বন্দুক হাতে একা রানা হয়তো সুবিধা করতে পারবে না। তা ছাড়া, রিচি নোভাকের কাছে নানান ধরনের অস্ত্র থাকার কথা। লড়াইয়ের জন্যে শুধু বন্দুক আর একটা ধনুক মোটেও যথেষ্ট নয়। অবশ্য নিজেকে বুঝ দিল রানা, চোলাই মদের কারখানায় বহু কিছুই করা যায় তীর দিয়ে!

যা করার দ্রুত করতে হবে। ওয়াকি-টকির পেছনের ঢাকনি খুলে ব্যাটারি দেখল রানা। নয় ভোল্টের রিচার্জেবল চৌকো ব্যাটারি ওটা, পুরো চার্জ দেয়া। দুই টার্মিনালে আছে স্ন্যাপ কানেক্টর। ব্যাটারিটা খুলে বেঞ্চে রাখল রানা। তূণ থেকে নিল রনের দেয়া একটা তীর। দুই হাঁটুর মাঝে রেখে ওপরে তাক করল তীরের ডগা। রোল থেকে নিয়ে ওখানে জড়াল স্টিল উল। তার ওপর পেঁচিয়ে নিল গ্যাফার টেপ। কাজ শেষে ধনুকের অ্যালিউমিনিয়াম হ্যাণ্ডেলে টেপ দিয়ে আটকে দিল নয় ভোল্টের ব্যাটারি। তীর ছিটকে রওয়ানা হওয়ার আগেই ওটার ধাতব ফলা স্পর্শ করবে বৈদ্যুতিক টার্মিনাল।

রানাকে এত ব্যস্ত দেখলে কেউ হয়তো ভাববে, পাগল হয়েছে যুবক। কিন্তু, সায়েন্সের জ্ঞান আছে তেমন যে-কেউ বুঝবে, ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক মারণাস্ত্র তৈরি করেছে ও। স্টিল উল জড়ানো কয়েকটা তীর তূণে রাখল রানা। দেয়ালের পেরেক থেকে খুলে নিল স্লিংসহ বন্দুক। ওটা পুরনো রেমিংটন ৮৭০ পাম্পগান। পুরো লোড করা হলে পাঁচটা গুলি ছুঁড়বে। নোভাকের লোক চেম্বারে রেখেছে বাকশট। কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের উঠান দেখল রানা। কেউ নেই দেখে নিঃশব্দে বেরোল গার্ডের কুঠরি থেকে। আশপাশে কোথাও নেই দানব কাঠুরে।

বিশাল ঘরের দিকে চলল রানা। চারপাশে চোখ রেখে নিঃশব্দে খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে। এটা অদক্ষ হাতে তৈরি ভেজা প্লাইউডের এক অ্যান্টিরুম। ওদিকে সরু প্যাসেজে বাতিল মাল। এ ছাড়া, একটা হ্যাণ্ড ট্রাকে আছে চিনি আর ভুট্টার দানা ভরা বস্তা এবং এক ব্যারেল পানি। ঘরের ভেতরে ঘন হয়ে ভাসছে চোলাই মদের বাজে দুর্গন্ধ।

প্যাসেজের ওদিকের বড় ঘরে চোলাই হচ্ছে মদ, বুঝতে দেরি হলো না রানার। কিছুক্ষণ কান পেতে দাঁড়িয়ে থাকল। দূরে মানুষের কণ্ঠস্বর। স্থানীয় উচ্চারণে তর্ক জুড়েছে তিনজন লোক। দূরে বলে অর্থ বুঝতে পারছে না রানা। কয়েক মুহূর্ত পর তূণ থেকে একটা স্টিল উল জড়ানো তীর নিয়ে ধনুকের ছিলায় পরিয়ে নিল। পা টিপে চলল কণ্ঠস্বর লক্ষ্য করে। প্যাসেজ ফুরোতেই টের পেল, সামনের ঘরেই আছে লিয বাউয়ারের খুনিরা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *