1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ১৩

তেরো

দলে রয়েছে চারজন। পরনে সোনালি পাইপিং দেয়া নীল ইউনিফর্ম। মাথায় একটু তুবড়ে নেয়া ক্যাম্পেইন হ্যাট। বুকে সোনালি ব্যাজ, রুপালি কর্ড ও অ্যাকর্ন। সবার ইউনিফর্মের বাহুতে লেখা লুইযিয়ানা স্টেট পুলিশ। তাদের একজন সার্জেন্ট, অন্য তিনজন ট্রুপার। দু’জনের হাতে পাম্প শটগান, বাকিদের কাছে উদ্যত গ্লক। হলওয়েতে পা রেখেই তারা দেখল, এক মহিলার লাশের পাশে পড়ে আছে তাদেরই এক মৃত অফিসার। এটাও চোখে পড়ল, কোমরে রিভলভার গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে অচেনা এক রক্তাক্ত বাদামি চামড়ার লোক। যে-কেউ ধরে নেবে, রানাই খুন করেছে মেঝের দু’জনকে!

রানা ভাবার সুযোগ পেলে বুঝত, ওকে খুনি হিসেবে ধরে নেয়ার জন্যে পুলিশের অফিসারদের দোষ দেয়া যায় না। স্বাভাবিক কারণেই তারা ভাবতেও গেল না, রানাকে খুন করতে এসেছিল তাদেরই সহযোগী অফিসার বিলি এস. কনরাড।

হলওয়ে ভরে উঠল ধমক-ধামক ও চিৎকারে। রানাকে বলা হচ্ছে: হাত থেকে অস্ত্র ফেলো! অস্ত্র ফেলো! দুই হাত মাথার ওপর!

টলতে টলতে ভাবছে রানা, বাজেভাবে আহত হয়েছি। পেট থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে। আগামী পাঁচ সেকেণ্ডেই কিছু করতে হবে, নইলে পরের সেকেণ্ডে গুলি করে ওকে শুইয়ে দেবে চার সশস্ত্র পুলিশ!

ও কি শান্ত স্বরে বলবে, এখানে আসলে কী ঘটেছে?

মনে হয় না তাতে কোনও লাভ হবে!

আমেরিকান পুলিশের বদনাম গোটা দুনিয়া জুড়ে। কেন তারা এখন শুনবে ওর কথা?

তা হলে কি ঝট্ করে বের করবে রিভলভার?

সেক্ষেত্রে অফিসাররা গুলি শুরুর আগেই কাজে নামতে হবে ওকে।

রিভলভারে রয়েছে পাঁচটা গুলি।

টার্গেট চারটা।

ও হয়তো গুলি বেঁধাতে পারবে চার পুলিশের পায়ে।

সেক্ষেত্রে খুন করতে হবে না তাদেরকে।

আরেকটা কাজ অসম্ভব নয়।

অস্ত্র ফেলে আত্মসমর্পণ করতে পারে রানা।

তবে অফিসাররা ধরে নিয়েছে, ওর হাতেই খুন হয়েছে তাদের সঙ্গী। ফলে আইন মেনে চলবে না ওরা।

অ্যাম্বুলেন্স পৌঁছুবার আগেই পিটিয়ে ওর হাড়গোড় ভাঙবে এরা। কিংবা গুলি করে ছোটবড় আটটা ছিদ্র করবে ওর গায়ে।

সুতরাং একমাত্র যৌক্তিক কাজটাই করল রানা। ঘুরেই ঝড়ের বেগে দৌড় দিল। ওর পেটের ক্ষত থেকে দেহের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল প্রচণ্ড ব্যথার ঢেউ।

নীরবতা খানখান হয়ে গেল গুলির আওয়াজে।

একেকবারে তিন ধাপ করে সিঁড়ি টপকে উঠতে উঠতে পিস্তলের বিকট গর্জন শুনছে রানা। বুলেটের আঘাতে পাশের দেয়াল থেকে ছিটকে উঠল একরাশ কাঠের চলটা। খটাখট রেলিঙে বিধল তিনটে বুলেট। সিঁড়ির বাঁক ঘুরে প্রায় উড়ে দোতলায় পৌঁছুল রানা। বুটের ধুপধাপ আওয়াজ তুলে ওর পিছু নিয়েছে তিন ট্রুপার। চতুর্থ অফিসার রয়েছে নিচতলায়। চিৎকার করে রেডিয়োতে নির্দেশ দিচ্ছে। তাদের আরও লোক দরকার।

লিযের বেডরুমের দরজা পাশ কাটিয়ে চিলেকোঠার সিঁড়ির ধাপে পৌঁছুল রানা। ততক্ষণে দোতলায় উঠেছে এক ট্রুপার। কর্কশ আওয়াজে শটগান পাম্প করে ধমকে উঠল সে: ‘সারেণ্ডার করো!’

সরু সিঁড়ি বেয়ে তীর বেগে চিলেকোঠায় উঠল রানা। ঘুরে দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান দিতেই মসৃণ রানারে ভর করে দুই ভাঁজ হয়ে ওপরে উঠে এল সিঁড়ি। নিচ থেকে সিঁড়ি নামিয়ে নেয়ার দড়িটা দ্রুত ওপরে তুলল রানা। পরক্ষণে ধুপ করে আটকে দিল ভাঁজ করা সিঁড়ি। বুজে গেছে পায়ের কাছে মেঝের গর্ত। ওটা দক্ষ কাঠ-মিস্ত্রির তৈরি নিখুঁত ট্র্যাপডোর। বাড়ির ভেতর ক’জন সশস্ত্র লোক ধাওয়া করলে এমন জিনিসই চাই।

অবশ্য হাঁফ ছাড়ার উপায় নেই রানার। একটু পরেই ওকে মুঠোয় পেতে অন্য পথ বের করবে প্রতিপক্ষ। কিছুক্ষণের ভেতর সামনের রাস্তা আর এই বাড়ি ঘিরে ফেলবে স্টেট ট্রুপাররা। সঙ্গে থাকবে সোয়্যাট টিম আর কে নাইন ইউনিট। চিলেকোঠার জানালার দিকে পা বাড়িয়ে নিচ থেকে রেডিয়োর খড়খড় আওয়াজ ও উত্তেজিত কণ্ঠস্বর শুনল রানা। নরম রাবারের মত ভাঁজ হতে চাইছে ওর দুই হাঁটু। দাঁতে দাঁত চেপে ভুলে যেতে চাইল মারাত্মক জখমের ব্যথা। মনে মনে নিজেকে বলল, এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে তোমাকে!

খাটের কাছেই পড়ে আছে ওর ব্যাগ। ওটার ভেতর টুকটাক জিনিসপত্র পুরল রানা। চেয়ারের কাঁধ থেকে নিয়ে গায়ে চড়াল চামড়ার জ্যাকেট। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে চলে গেল জানালার কাছে। একপাশে সরিয়ে দিল কাঁচ। জানালার ফ্রেম ধরে ঢালু ছাতে নামতে গিয়ে ওর মনে হলো, ছিঁড়ে পড়ছে চিরে যাওয়া পেটের আহত মাংসপেশি।

কালো কালির মত আঁধার আকাশে ঝিকমিক করছে লাখো-কোটি নক্ষত্র। রানার ঘামে ভেজা দেহ ও ভুরুতে লেগে বরফের মত ঠাণ্ডা অনুভূতি তৈরি করছে ঝিরঝিরে তল্প হাওয়া। ক’মুহূর্তের জন্যে বিহ্বল বোধ করল ও। আরে হলে পা পিছলে ঢালু ছাত থেকে গিয়ে পড়ত ত্রিশ ফুট নিচে। তবে একেবারে শেষ সময়ে নিজেকে সামলে নিল।

যেভাবে হোক সরে যেতে হবে, নইলে ওকে খুন করবে লোকগুলো!

ঢালু টাইলস বেয়ে টলোমলো পায়ে এগোল রানা। লক্ষ্য গেস্টহাউসের ছাতের শেষ প্রান্ত। একপাশ থেকে রানা দেখল নিচের রাস্তায় শেরিফের ডিপার্টমেন্টের ক্রাউন ভিক্টোরিয়া গাড়ি এবং দুটো সাদা রঙের স্টেট পুলিশ ব্রুযার। চলছে গাড়িগুলোর ইঞ্জিন। ওগুলোর ছাতের বাতির বার থেকে চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে উজ্জ্বল নীল আলো। এখন আরও বেশ কিছু বাড়ির দোতলায় জ্বলে উঠেছে আলো। কী ঘটছে জানতে জানালা দিয়ে উঁকি দিচ্ছে প্রতিবেশীরা। রাস্তার ওদিকে বাড়ির উঠানে বেরিয়ে এসেছেন বৃদ্ধ মিস্টার রবিনসন।

প্রায় দুই ভাঁজ হয়ে ছায়ার ভেতর দিয়ে ঢালু ছাত বেয়ে এগোল রানা। একটু দূরে লিষের বাড়ির ছাত শেষ হলেই ওদিকে সামান্য ব্যবধানে প্রতিবেশীর ছাত। ওই বাড়িতে এখনও কোনও বাতি জ্বলছে না। হয় এত কিছুর ভেতরেও ঘুমিয়ে আছে বাড়ির সবাই, নয়তো ও বাড়িতে কেউ নেই। লিষের ছাতের কিনারার কয়েক ফুট আগে থামল রানা। মনে মনে তৈরি হলো লাফিয়ে মাঝের দূরত্ব পেরোতে। কল্পনায দেখল, উড়ে গিয়ে নামছে পাশের ছাতে। ভাল করেই বুঝতে পারছে, চিরে যাওয়া পেট নিয়ে লাফ দিলে প্রচণ্ড ব্যথা পাবে। আর বেকায়দাভাবে যদি পড়েই যায় নিচের বাগানে, স্রেফ খুন হবে। বড় করে কয়েকবার শ্বাস নিল রানা, তারপর পরের তিন পা দৌড়ে এগিয়ে ঝাঁপ দিল পাশের ছাতের উদ্দেশে।

অনায়াসেই দুই ছাতের ব্যবধান পেরিয়ে ওদিকের ছাতে নামল রানা। তীব্র ব্যথায় খিঁচিয়ে ফেলল দাঁত-মুখ। আরেকটু হলে কাতরে উঠত যন্ত্রণায়। পেছনের ছাতে গাঢ় চিহ্ন দেখে বুঝল, অন্ধকারেও টের পাবে পুলিশ, লিষের বাড়ির ছাতে ও রেখে এসেছে রক্তের মোটা ধারা। রাস্তার দিক থেকে সরে সাবধানে পা টিপে টিপে ঢালু ছাত বেয়ে এগোল রানা। গেস্টহাউসে ওঠার সময় ওদিকটা দেখেছে। ওদিকের বাগানে দেয়ালের কাছে আছে বিশাল এক হিকরি গাছ।

এবার কিন্তু ভয়ঙ্কর ব্যথা লাগবে, নিজেকে জানাল রানা। ছাতের কিনারায় পৌঁছে শূন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল ডানা ভাঙা পাখির মত। মুহূর্তে নেমে গেল দশ ফুট নিচে ঘন পাতা ভরা ডালের ওপর। মুখ ও দেহে আঁচড় কাটছে হিকরির ছোট ছোট শাখা-প্রশাখা। খপ করে মোটা একটা ডাল জাপ্টে ধরে ঠেকাল নিজের পতন। সাবধানে নামতে গিয়ে ব্যয় হলো মিনিটখানেক সময়। তারপর পৌঁছল নিচের ডালপালার কাছে। এবার সরাসরি নামতে হবে অন্তত আট ফুট নিচে ঘাসে ঢাকা মাটিতে। বড় করে ক’বার শ্বাস নিয়ে হিকরির নিচের ডাল ছেড়ে দিল রানা। সাঁই করে মাটি উঠে আসতেই ভীষণ ঝাঁকি খেয়ে মনে হলো, উত্তপ্ত কোনও বর্শা ঢুকে গেছে ওর পেটে। এবারও টু শব্দ না করে ব্যথা সহ্য করল রানা।

প্রতিবেশীর বাগান ঘন ছায়াময়। দম ফিরে পাওয়ার জন্যে গাছের গোড়ায় চুপ করে কিছুক্ষণ কুঁজো হয়ে বসে থাকল রানা। কান পেতেছে। একটু পর বুঝল; কেউ জানে না গেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে এসেছে ও। উঠে একদৌড়ে পৌঁছুল বাগানের পেছনদিকের বেড়ার কাছে। ওটা টপকে নেমে পড়ল পরের বাড়ির বাগানে। দুরুদুরু করছে ওর বুক, এই বুঝি ঘ্যাঁচ করে নিতম্ব কামড়ে ঝুলে পড়বে বাড়ির মালিকের পিট বুল কুকুরটা!

কিন্তু কপাল ভাল, কুকুর নেই এদিকে।

ঝোপের ভেতর দিয়ে দৌড়ে বাগানের পেছনের বেড়ার কাছে পৌঁছুল রানা। দূর থেকে এল একরাশ সাইরেনের আওয়াজ। রানার মনে হলো, লিয়ের গেস্টহাউস লক্ষ্য করে ছুটে আসছে লুইযিয়ানা স্টেটের সবক’জন পুলিশ। তাদের ক্রুয়ারের সঙ্গে ‘অ্যাঁ-ওঁ’ শব্দে সুর মেলাচ্ছে কয়েকটা অ্যাম্বুলেন্স। একটু পর সরিয়ে নেয়া হবে লিযের লাশ। কয়েক দিনের জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হবে বিলি এস. কনরাড। ভালই মজা তার! অথচ, উচিত ছিল তাকে জেলে পুরে রাখা।

বাগান পেরিয়ে পরের বাগানে ঢুকল রানা। ওটার শেষ মাথায় পৌঁছে সামনে পড়ল হেজের নিচু দেয়াল। টপকে ওদিকে নামলেই মাঝারি রাস্তা। এরই ভেতর লিয়ের গেস্টহাউস থেকে অন্তত কয়েক শ’ গজ দূরে সরে এসেছে রানা। এদিকের কোনও বাড়িতেই বাতি জ্বলছে না। কারও জানাও নেই দূরে চলছে বড় ধরনের পুলিশী অভিযান

পেটের টনটনে ব্যথায় ভুরু কুঁচকে গেলেও খুশি রানা। রাস্তায় নেমে হেঁটে চলল দূর থেকে দূরে। পেছনে রয়ে যাচ্ছে রক্তের চকচকে ফোঁটা। তবে আপাতত এ ব্যাপারে কিছু করার নেই। রক্ত হারিয়ে ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝেই বোঁ করে ঘুরে উঠছে মাথা। একবার জ্ঞান হারিয়ে পথের পাশে পড়ে থাকলে অনায়াসেই ওকে খুঁজে নেবে পুলিশবাহিনী।

অবশ্য সিকি মাইল হেঁটে চিটিমাচার কেন্দ্র থেকে অনেকটা সরে এসেছে রানা। আর যখন পারা যায় না, ঠিক এমনি সময়ে একটা বাড়ির সামনে মস্ত এক ওক গাছের নিচে দেখল পুরনো আমলের ফোর্ড পিকআপ গাড়িটা।

গুপ্তচর জীবনে প্রাথমিক ট্রেইনিঙের সময় রানাকে শেখানো হয়েছে গাড়ি চুরির বিদ্যা। পরে ভয়ঙ্কর সব বিপদে পড়ে বহুবার ধচাপচা বা দামি, নতুন বা পুরনো হরেক রকম গাড়ি আপন করে নিয়েছে ও। ভাল করেই জানে, সুযোগ থাকলে সবসময় চুরি করতে হয় পুরনো গাড়ি। অ্যালার্ম, ইমোবিলাইযার বা জিপিএস ট্র্যাকার থাকে না ওগুলোয়।

ঊনত্রিশ সেকেণ্ড পর ফোর্ডের ক্যাবে চেপে বসল রানা। পেটের ক্ষত থেকে কমদামি ভিনাইল সিটে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। ইগনিশনের তার ছিঁড়ে ইঞ্জিন চালু করতে ব্যয় হলো আরও চোদ্দ সেকেণ্ড। পরের দশ মিনিটে লিযের গেস্টহাউস থেকে বহু দূরে চলে গেল রানা রাতের আঁধারে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *