1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৩১

একত্রিশ

বিশাল গুহার মত ঘরের প্যাসেজের শেষমাথায় দাঁড়িয়ে আছে রানা। বার্নের সমান জায়গায় পুরোদমে চলছে মদ চোলাইয়ের কাজ। ঘরের কংক্রিটের মেঝে লাল রঙের। বেশিরভাগ জায়গা শস্যের বস্তা, পানির ড্রাম আর জ্বালানী কাঠে ভরা। ঘরের মাঝে বৃত্তাকারভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে ড্রামের মত এক ডজনেরও বেশি ভাটি। প্রতিটা আট ফুট উঁচু, চার ফুট ব্যাস। বৈদ্যুতিক আলোয় চকচক করছে তামার সিলিণ্ডার। একই জিনিস দেখেছে গার্ডের কুঠরিতে মেরামতের জন্যে খুলে রাখা। প্রতিটা সিলিণ্ডারের ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত নানান ধরনের পাইপ

প্রতিটা সিলিণ্ডারের সঙ্গে একটা করে পানির ড্রাম আর কালেক্টর ভেসেল। শেষের পাত্রে ফোঁটা ফোঁটা করে জমছে ডিসটিল করা অ্যালকোহল। প্রতিটা স্টিল বসানো রয়েছে আলাদা কাঠের চুলার ওপর। ওগুলো থেকে উঠে ধোঁয়া আর আগুনের তাপ ঢুকছে লোহার তৈরি বিশাল এক ঢেউ খেলানো ঢাকনির ভেতর। ওই ঢাকনি গিয়ে মিশেছে ছাতের চিমনির সঙ্গে। ঘরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেশি। রীতিমত শ্বাস আটকে আসতে চাইছে রানার। ধোঁয়া আর আগুনের তাপের সঙ্গে যোগ দিয়েছে ধুকধুক আওয়াজের শক্তিশালী ডিযেল জেনারেটর। ঝাঁঝাল বাষ্প উঠছে চিমনির দিকে। বিশাল এক প্যানেলে নড়ছে নানান ইকুইপমেন্ট আর গজের কাঁটা।

কথা বলছে তিন ভাই। লম্বায় প্রত্যেকে ছয় ফুটের বেশি হলেও বামন হয়ে গেছে দানবাকৃতি সিলিণ্ডারগুলোর মাঝে।

টাকার হিসেব কষতে গিয়ে জুড়েছে তর্ক। এখন কথা বলছে প্যাট্রিক। সানগ্লাস খুলে দুই বড়ভাইয়ের দিকে তাকাল সে, নার্ভাস। কড়কড়ে কণ্ঠে বলল, ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো। আগেই বলেছি ব্র্যাডলি ঠকাবে না। কথা দিয়েছে দুই সপ্তাহের ভেতর সব শোধ করে দেবে। আজ পর্যন্ত কখনও মিথ্যা বলেনি সে।’

‘ব্র্যাডলির পোঁদে লাথ মারি! হারামজাদাকে এক সেন্ট দিয়েও বিশ্বাস করি না। তুমি কি গাধা নাকি, প্যাট্রিক?’

‘হ্যাঙ্ক, বললাম তো ঠকব না।’

‘এবার শুয়োরটাকে গিয়ে বলবে, আগামী দু’দিনের ভেতর টাকা না দিলে সোজা অ্যালিগেটরের পেটে যাবে সে।’

তর্ক-বিতর্ক নিয়ে মাথাব্যথা নেই রানার। নীরবে দেখছে তিন নোভাককে। বুকের ভেতর শীতল অনুভূতি। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিকের চেয়ে কম। দরকারি প্রমাণ পেয়েছে। প্যাট্রিকের বড় দুই ভাইকে চিনতে দেরি হয়নি। সে রাতে এরাই গিয়েছিল লিযকে খুন করতে। ডানদিকের লোকটার চুল বেণী করা। কুঁচকে রেখেছে ভুরু। সে ছিল মাস্ট্যাং গাড়ির ড্রাইভার। ওরই নাম হ্যাঙ্ক। বয়স বত্রিশ মত। তারের মত প্যাচানো পেশি। বাহু আর ঘাড়ে উল্কি। ওগুলো আঁকিয়ে নিতে গিয়ে লেগেছে অন্তত কয়েক হাজার ডলার। জিন্সের প্যান্টের ওয়েস্ট ব্যাণ্ডে গুঁজে রেখেছে বাঁটে মুক্তা বসানো বেরেটা পিস্তল। তার ডান পাশে বড়ভাই রিচি। তাকে দেখে রানা বুঝেছে, হলওয়েতে গুরুতর আহত লিযকে মেঝেতে রেখে গেস্টহাউস থেকে ছুটে বেরিয়ে গিয়েছিল এই লোকই।

রিচিই খুন করেছে লিযকে!

এখন তার পরনে সাদা টি-শার্ট আর কালো রঙের কমব্যাট ট্রাউজার। হ্যাঙ্কের চেয়ে অন্তত দু’বছরের বড় হবে রিচি। নিয়মিত ব্যায়াম করা শরীর। শরীরে উল্কি না থাকলেও ডানহাতে দেখা যাচ্ছে ফ্যাকাসে নীল স্বস্তিকা চিহ্ন। ওটার কথা বলেছিল জোসেফ। ছোট দুই ভাইয়ের মতই রিচির মাথায়ও লালচে চুল। মিলিটারিদের মত কদম ছাঁট দিয়েছে। দু’ভাইকে নরম সুরে বলল রিচি, ‘আগেও বলেছি, কাউকে সুবিধা নিতে দিয়ো না, ঠকে যাবে।’ তার কথার ভেতর বিষের মত খারাপ কিছু আছে।

‘আমিও তা-ই বলছি, ব্রো,’ জোর দিয়ে বলল হ্যাঙ্ক। ‘নিয়মের বাইরে গেলেই ডুবব। মাথায় রাখতে হবে, শেষ হিসাবে দুনিয়ায় সবচেয়ে দরকারি জিনিস ওই টাকাই!’

হার মেনে নিয়েছে প্যাট্রিক। দুই কাঁধ ঝুলে গেল তার। বদমেজাজি মেয়েমানুষের দালাল এখন বড়ভাইদের বকা খাওয়া ছোট্ট ভাইটি। ‘ঠিক আছে, ওকে বলব দুই দিনের ভেতরই সব শোধ দিতে হবে।’

‘তুমি গিয়ে দেখবে নেব্রাস্কার পথে অর্ধেক রাস্তা পেরিয়ে গেছে শুয়োরের বাচ্চা, ধমকের সুরে বলল হ্যাঙ্ক নোভাক ‘আর তখন… হঠাৎ করেই মুখ বুজে ফেলল সে। তার দিকে অবাক চোখে তাকাল রিচি ও প্যাট্রিক। পরক্ষণে হ্যাঙ্কের দৃষ্টি অনুসরণ করে প্যাসেজের দিকে চাইল তারা।

এইমাত্র প্যাসেজ পেছনে রেখে তামার দুই সিলিণ্ডারের মাঝ দিয়ে বৃত্তাকার জায়গাটায় পা রেখেছে রানা। নোভাকরা টু শব্দ করার আগেই কানের কাছে টেনে নিয়েছে তীর পরানো ধনুকের ছিলা। শেষবার সাপ মারতে যাওয়ার সময় খুব দুর্বল ছিল রানা। ভীষণ ব্যথা ছিল পেটে। সেই তুলনায় এখন নিজেকে অনেক সুস্থ লাগছে ওর। যে-কোনও পরিস্থিতির জন্যে তৈরি। রিচির দিকে তাক করেছে বিপজ্জনক তীরটার তীক্ষ্ণ ফলা। তিন নোভাকের চেহারা দেখছে রানা।

রাগে বেগুনি হয়েছে প্যাট্রিক। আরেকটু গরম হলে সারাশরীরে বোধহয় ফোস্কা উঠবে। রানাকে দেখছে হ্যাঙ্ক। বিস্ফারিত চোখে সতর্কতা আর হামলার প্রস্তুতি। তবে রিচির দিকে বিশেষ নজর রানার। একদম নিস্পৃহ তার চেহারা। কিছুতেই যেন অবাক হওয়ার কিছু নেই। লিযকে খুন করেছে বলে চোখে অপরাধ বোধের লেশমাত্র চিহ্ন নেই। রানা বুঝে গেল, এ সত্যিকারের সাইকোপ্যাথিক কিলার। লিযকে খুন করার সময়েও বিন্দুমাত্র দ্বিধা ছিল না তার মনে।

তিন নোভাক তিন ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখালেও সবচেয়ে বোকা প্যাট্রিকও পিস্তলের দিকে হাত বাড়াল না।

আরও এক পা সামনে বাড়ল রানা।

‘তুমি আবার কোথাকার কোন্ হারামজাদা?’ তর্জনী তাক করে ওর কাছে জানতে চাইল প্যাট্রিক।

‘তুমি ভাল করেই জানো আমি কে,’ শান্ত স্বরে বলল রানা। ‘আমাকে খুনের দায়ে ফাঁসিয়ে দিয়েছ তোমরা। আর এখন ভাবছ আমি কেন এখানে?’

প্রথমবারের মত মুখ খুলল রিচি। মসৃণ কণ্ঠ তার। ‘খুব চালাক লোক বলে মনে হচ্ছে। নইলে শহর থেকে এতটা দূরে আমাদেরকে খুঁজে নিতে পারতে না।’

‘এর মধ্যে চালাকির কিছু দেখি না, তবে পথ দেখিয়ে এখানে পৌছে দেয়ার জন্যে ধন্যবাদ দেব বেশ্যার দালাল তোমাদের আদরের ছোটভাই প্যাট্রিককে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। ‘মনে হচ্ছে নোভাক পরিবারের মগজটা পায়নি বেচারা। আর ওর এই যে ঘাটতি, তার মূল কারণ তুমি। তুমি একটু বেশি মগজ পেয়ে গেছ, রিচি।’

শীতল হাসি ফুটল রিচির মুখে। ‘কথাটা মিথ্যা নয়।’

‘তবে তুমিও আবার যথেষ্ট বুদ্ধিমান নও,’ বলল রানা। ‘লিয বাউয়ারকে খুন করে মস্তবড় ভুল করলে। তার চেয়েও বড় গাধামি করলে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে। জানোও না কীসে জড়িয়ে গেছ।’

কর্কশ স্বরে হেসে উঠল হ্যাঙ্ক নোভাক। ‘তুমি নিজেই তো জন্মের হাঁদা! ভেবেছ একটা ধনুক নিয়ে এখানে হাজির হলেই যা খুশি করতে পারবে? মাত্র একবার তীর ছোঁড়ার সুযোগ পাবে। আর এদিকে আমাদের বাকি দু’জনের কাছে থাকবে অন্তত চল্লিশটা গুলি। দ্বিতীয় তীর ছিলায় পরাবার আগেই চালুনির মত ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।’

‘গুলির চেষ্টা করো,’ বলল রানা, ‘প্রথম তীর ঢুকবে তোমার কপালে। হ্যাঙ্কের দিকে তীর তাক করল ও।

মুখ থেকে হাসি নিভে গেল হ্যাঙ্ক নোভাকের। ঘট্ শব্দে ঢোক গিলল।

‘আমার মনে দুটো প্রশ্ন আছে,’ বলল রানা। ‘প্রথম: বহুকাল আগে ঘটে যাওয়া একটা ব্যাপারে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে দেড় শ বছর পর কেন নিরীহ এক মহিলাকে খুন করলে তোমরা? দ্বিতীয় প্রশ্ন: এত বছর পর কীভাবে লিয বাউয়ারকে খুঁজে পেলে? অবশ্য এটা না জানলেও চলবে আমার। পুলিশকে বরং সব খুলে বোলো।’

বাঁকা হাসল প্যাট্রিক। ‘ও, তা হলে এজন্যে এসেছ? গ্রেফতার করে নিয়ে যাবে আমাদেরকে?’

‘সেটাই আমার ইচ্ছে,’ বলল রানা, ‘অবশ্য, তোমরা এখানে খুন হলে আর পুলিশের হাতে তুলে দিতে পারব না।’

‘আচ্ছা?’ রানার কথা শুনে তেতে উঠছে প্যাট্রিক। ‘তাই?’

‘এক্কেবারে সত্যি কথা,’ বলল রানা।

‘তো এই যে আমাদেরকে ধরতে এলে, নিশ্চয়ই সঙ্গে করে আর্মি এনেছ?’ বলল হ্যাঙ্ক নোভাক।

‘না, একাই এসেছি,’ নরম সুরে বলল রানা। ‘ভাবছ তোমাদের মত ক’টা গেঁয়ো ছুঁচোকে ধরতে আরও লোক লাগবে? মাথা খাটাও। তোমাদের মা যে নয়টা বদমাস জন্ম দেয়নি, সেজন্যে রীতিমত দুঃখ লাগছে আমার। তা হলে সমানে সমানে লড়া যেত।’

‘যত বড় মুখ, তত বড় মানুষ তুমি নও, ‘ থুহ্ করে মেঝেতে থুতু ফেলল প্যাট্রিক।

নিস্পৃহ চেহারায় নীরবে দাঁড়িয়ে আছে রিচি নোভাক। শিথিল হাতদুটো ঝুলিয়ে রেখেছে দুই উরুর পাশে।

‘এবার শুনে নাও কী করবে,’ মোলায়েম স্বরে বলল রানা। ‘এক এক করে সাবধানে বের করবে পিস্তল। সেজন্যে ব্যবহার করবে বুড়ো আঙুল আর তর্জনী। তাড়াহুড়ো করবে না। আস্তে করে মেঝেতে অস্ত্র রেখে পা দিয়ে ঠেলে দেবে আমার দিকে। এরপর তোমাদেরকে অনুরোধ করব, যাতে আণ্ডারপ্যান্ট ছাড়া আর কিছুই না থাকে শরীরে। গোপন অস্ত্র লুকিয়ে রাখতে যেয়ো না, বেমক্কা খুন হবে। তারপর মেঝেতে কাছাকাছি হয়ে বসে পুলিশের জন্যে অপেক্ষা করবে। ঘণ্টাখানেকের ভেতর পৌঁছুবে আমার জানের জান দোস্ত শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। সে আবার তোমাদেরকে নিয়ে রাখবে চমৎকার কোনও সেলে। ওখানে বসে অপরাধের স্বীকারোক্তি দেবে তোমরা। মাফও চাইতে পারো। আদালত তাতে শাস্তি কমাতেও পারে। শুনেছি লিথাল ইঞ্জেকশন ফুরিয়ে যাওয়ায় লুইযিয়ানার কর্তৃপক্ষ গত কয়েক বছর মৃত্যুদণ্ড দিচ্ছে না। অর্থাৎ, বুঝতেই পারছ, মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের আগে বছরের পর বছর সময় পাবে ভেবে নেয়ার জন্যে: ঠিক কোন্ নরকের আগুনে পুড়তে চাও।’

‘বড় বেশি কথা বলো,’ বলল হ্যাঙ্ক নোভাক। ‘তোমার প্রস্তাবে রাজি হতে পারছি না।’

‘এর চেয়ে ভাল প্রস্তাব আমার কাছে নেই,’ বলল রানা।

‘ধরো, আমরা রাজি নই, তখন কী করবে?’ মুখ খুলল রিচি নোভাক।

‘তা হলেই তো সমস্যা,’ মৃদু মাথা নাড়ল রানা। ‘ধরে নাও খুন হয়েছ তোমরা। আর সেটাই আমার বড় একটা সমস্যা। তোমরা মরলে স্বীকারোক্তি দেবে কে? আমি আর নিজেকে নিরপরাধ বলে প্রমাণ করতে পারব না। সেক্ষেত্রে নিজেও খুন হব। তবে আগের কাজ আগে, মেঝেতে পিস্তল রাখতে তোমরা প্রত্যেকে পাচ্ছ পুরো পাঁচ সেকেণ্ড করে। এর ভেতর নির্দেশ মেনে না নিলে তীর মেরে উড়িয়ে দেব গোটা ডিসটিলারি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *