1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ২৮

আটাশ

ঘাড় ধরে মন্টি ডয়েলকে গাড়ির দিকে নিল রানা। একমিনিট পেরোবার আগেই তাকে বসিয়ে দিল স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে। ঘুরে গিয়ে প্যাসেঞ্জার ডোর খুলল। সিট সামনে ঠেলে পেছন সিটে রাখল নিজের জিনিসপত্র। তারপর নিজেও বসল ওগুলোর পাশে। জ্যাকেটের ভাঁজ থেকে নিল রনের দেয়া একটা হান্টিং তীর। ওটার ফলা ক্ষুরের মত ধারালো। ডয়েলের ঘাড়ের নরম অংশে ঠেকাল ওটা।

‘সাবধানে গাড়ি চালাবে, ডয়েল। কড়া ব্রেক করবে না। আমি সিট বেল্ট বাঁধিনি। হুমড়ি খেলে আমার হাতের তীর খচ্ করে ঢুকবে তোমার মগজে। ঠিকভাবে চলাফেরা করতে আর কথা বলতে সাহায্য করে মগজের নিচের এই অংশটা।’

ফায়ারবার্ডের ইঞ্জিন চালু করল ডয়েল। ওঅর্কশপ ভরে গেল ঘড়ঘড়ে আওয়াজে। আড়ষ্ট হয়ে বসে খুব সাবধানে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল যুবক। তার ঘাড়ের ওপরের দিকে হালকা খোঁচা মারছে তীরের চোখা ফলা। ধীর গতি তুলে গুড়গুড় আওয়াজে রাস্তায় বেরোল ভারী গাড়িটা। ‘এবার ডানদিকে যাবে,’ নির্দেশ দিল রানা।

একটু পর পেছনে পড়ল কাঁচা বাজার। ওখান থেকে সদাই কিনে রানাকে গাম্বো রান্না করে খাইয়েছিল লিয।

ব্যাঙের বেসুরো ডাকের মত বলে উঠল মণ্টি ডয়েল, ‘বুঝতে পারছি না কী চাও, ডিউড। আমরা কোথায় যাচ্ছি?’

‘তা হলে তোমাকে খুলেই বলি,’ বলল রানা। ‘গতবার যখন দেখা হলো, নিশ্চয়ই মনে আছে কী বলেছিলে?’

‘আমি আবার কী বলেছি? কিচ্ছু বলিনি!’

‘বলেছিলে, গরিলাটাকে যেন খাবার বেশি না দিই। অন্তর থেকে বর্ণবাদী বলেই ওসব বলতে পেরেছিলে। একদিন লাথি মেরে তোমার পাছায় আরেকটা ফাটল তৈরি করে দেবে কোনও ভদ্রলোক। তবে আজ সেজন্যে আসিনি।’

‘তা হলে কী করতে এসেছ?’ করুণ সুরে জানতে চাইল ডয়েল। মনে হচ্ছে, এখুনি কেঁদে ফেলবে বীরপুরুষ।

‘আমি এসেছি তোমার দোস্ত জর্জি ডানের ব্যাপারে দুয়েকটা বিষয়ে আলাপ করতে,’ বলল রানা। ‘তোমার কথা থেকে জেনেছি, ভাল করেই চেনো তাকে। তোমরা একই জাতের পাখির পালক। তা ছাড়া, আমার ধারণা, এদিকের লোক সবাই সবাইকে ভাল করেই চেনে।’

কাঁধ ঝাঁকাতে গিয়েও ঘাড়ে তীরের খোঁচা খেয়ে থমকে গেল ডয়েল। ‘তা ঠিক। আমি জর্জি ডানকে চিনি। দু’চারবার একসঙ্গে মদও গিলেছি। টুকটাক ব্যবসাও করেছি দু’জনে। কিন্তু আসলে কুকুরের পোঁদের ফুটোর চেয়েও নোংরা ওই লোকটা।’

‘এ-ব্যাপারে দ্বিমত নেই আমার,’ বলল রানা। ‘তবে তুমিও কম যাও না। এবার বলো দেখি, কী ধরনের ব্যবসা করেছ। ড্রাগস্?’

‘অস্ত্র, ম্যান। নল কাটা বন্দুক। পাম্প গান, সেমি অটোমেটিক, দোনলা বন্দুক… এসবই আর কী। কমে পেলে ওগুলো কিনে ব্যারেল কেটে বিক্রি করি আমরা।’

‘তার মানে তোমরা জড়িত ডাকাতির সঙ্গে। খুশি না হয়ে পারছি না।’ তীরের ডগা দিয়ে ডয়েলের ঘাড়ে সামান্য খোঁচা দিল রানা।

‘কিন্তু ওসব তো বহুদিন আগের কথা! আমি তো বললাম: ওই শুয়োরের বাচ্চা আসলে কুকুরের পোঁদের ফুটোর চেয়েও খারাপ! আসলে কী চাও তুমি? অস্ত্র কিনবে?’

‘না, অস্ত্র ছাড়াও নানানভাবে মানুষ খুন করার কায়দা জানা আছে আমার। আর তাতে সামান্য আওয়াজও হয় না। এই কথাটা ভাল করে মনে রেখো, ডয়েল।’

‘মনে রেখেছি, ভুলে যাব না,’ শুকনো গলায় বলল ডয়েল। রানা বুঝল, একফোঁটা মিথ্যা নেই বর্ণবাদী যুবকের কথার ভেতর। স্টিয়ারিং হুইলে মৃদু কাঁপছে তার হাত। কাঁপুনি বেড়ে গেল শহর পেছনে পড়তেই।

‘জর্জি ডানের সঙ্গে অনেক দিন ধরেই মেলামেশা করছ, ‘ বলল রানা, ‘তাই মনে হচ্ছে, ক্লোভিস প্যারিশে একই সার্কেলের অনেককেই চেনো। আমি কি ঠিক বললাম?’

দীর্ঘ মুহূর্ত দ্বিধা করল ডয়েল, তারপর বলল, ‘ওদের দু’চারজনকে চিনি।’

‘যেমন তিন নোভাক ভাই, তাই না?’ বলল রানা। রিয়ার ভিউ মিররে ডয়েলের চোখ দেখছে। নোভাকদের নাম নেয়ার ফলে অনিশ্চয়তা আর ভয় ভর করেছে যুবকের দুই চোখে।

‘আ…. আমি জানি না কী বলতে চাইছ। কীসের ভাই?’

‘মিথ্যা বলে বাঁচবে না, ডয়েল। আমি বলছি রিচি, হ্যাঙ্ক আর প্যাট্রিকের কথা। আমার জানা আছে, ক্লোভিস প্যারিশের প্রত্যেকটা হারামি যুবক চায় নোভাকদের দলে ভিড়ে যেতে। আর তুমিও তার বাইরে নও। সেদিন গ্যারাজে বন্ধুদের সামনে বাহাদুরি দেখাতে গিয়েছিলে, মনে নেই? সেই মুহূর্তে সত্যিই প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিলাম। তোমরা আমার হাতে খুন হয়ে গেলে পুলিশী ঝামেলায় জড়িয়ে যেতাম।’

‘স-সত্যি বলছি, আমি ওদেরকে চিনি না, ম্যান। মানে… দেখেছি ওদেরকে, কিন্তু পরিচয় নেই।’

‘তার মানে, জানো না ওরা কোথায় আড্ডা দেয়? ভুল হচ্ছে না তো তোমার?’

দরদর করে ঘামছে ডয়েল। স্টিয়ারিং হুইল থেকে ডানহাত তুলে ঘর্মাক্ত মুখ মুছল। ‘সত্যিই জানি না। ঈশ্বরের মায়ের কসম!’

‘যাহ্, তা হলে তো ভুলই করে ফেলেছি,’ বলল রানা। ‘আমি খুব নিশ্চিত ছিলাম। যাক্ গে, বাদ দাও। তার মানে, তোমাকে আর লাগবে না আমার। সেক্ষেত্রে শহর থেকে দূরে নির্জন কোথাও থামব। তারপর এক এক করে ভাঙব তোমার গোড়ালি, হাঁটু, কনুই আর হাত-পায়ের আঙুলগুলো। তারপর ফেলে দেব শুকনো কোনও নালায়। এরপর একাই আরাম করে তোমার বসের গাড়িটা নিয়ে বেরোব হাওয়া খেতে। ওটার কাজ শেষ হলে গিয়ে রাখব ভিলেনিউভ শহরে শেরিফের অফিসের সামনে। সরে যাওয়ার আগে আগুন দেব ওটাতে। এসব শুনে ঠিক কেমন লাগছে তোমার, মাই ডিয়ার ডয়েল?’

পাহাড়ি ঝর্নার মত কুলকুল করে ঘামছে যুবক। পিঠ কুঁজো করে বিড়বিড় করল, ‘তুমি শালা আসলে বদ্ধ উন্মাদ!’

‘আমাকে সাইকোপ্যাথও বলতে পারো, নরম সুরে বলল রানা। ‘তবে খবরের কাগজ থেকে এরই ভেতর নিশ্চয়ই জেনে গেছ, কী ধরনের খুন-জখম করতে ভালবাসি।’

‘আ… আমি একটা মেয়েকে চিনি, গলা ভেঙে গেল ডয়েলের। ‘সে আসলে প্যাট্রিকের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। ‘

‘এই তো বোল ফুটতে শুরু করেছে। তো ওই মেয়ে আসলে কে? তার কাজ কী?’

‘ওই মেয়ে আসলে বেশ্যা। নাম জেসি। ক্লোভিস প্যারিশের কয়েক জায়গায় পতিতালয় চালায় প্যাট্রিক।’

‘তুমি একবার মুখ খুললে দেখছি অনেক তথ্য দিতে পারো, ডয়েল। এখন ভাবছি, ওই মেয়েকে ধরলে হয়তো সে আমাকে বলবে, কোথায় আছে প্যাট্রিক। এবার বলো তো, ডয়েল, ওই মেয়েকে কোথায় পাই?’

‘আমি জানি না, ম্যান! উস্‌, বাবারে! সত্যিই…’

তীরের ডগা দিয়ে ঘাড়ে আরেকটা খোঁচা দিল রানা। ‘মিথ্যা বলছ।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, ওরা দেহব্যবসা করে এন সার্কেলে। ওটা একটা মোটেল।’ তৃতীয় খোঁচা আসার আগেই গড়গড় করে বলল সে, কোন্ হাইওয়েতে আছে মোটেলটা।

তীরের ডগা আধ ইঞ্চি পিছিয়ে নিল রানা। ‘ওই জায়গা এখান থেকে কতটা দূরে?’

‘কমবেশি তিরিশ মাইল। আমি অবশ্য ওখানে কখনও যাইনি।’

‘হ্যাঁ, চোখ দেখেই বুঝেছি। আগে যাওনি তাতে কী, আজ তোমার ফুর্তির দিন। আমরা ওখানেই যাচ্ছি।’

‘হাজার হাজার পুলিশ তোমাকে খুঁজছে। ওই পর্যন্ত তুমি পৌঁছুতেই পারবে না।‘

‘যদি না পারি, এ জীবনে আর কোনও দিন মৌজ করতে পারবে না। কারণ, ঘাড় ফুটো হয়ে মগজে গিয়ে ঢুকবে তীর।’

পরের আধঘণ্টায় টু-শব্দ করল না ওরা। পশ্চিমের রাস্তা ধরে দক্ষিণের সড়কে পড়ল ডয়েল। পেছনের সিটে নিচু হয়ে বসে থাকল রানা। কালো টিণ্ট করা জানালা, চট্‌ করে ওকে দেখবে না কেউ। রানা বুঝতে পারছে, মস্তবড় ঝুঁকি নিয়েছে। সামনে হয়তো থাকবে পুলিশের রোডব্লক। অবশ্য ভেবেই বা এখন ফায়দা কী? দুশ্চিন্তার ময়দান ছেড়ে দিল রানা মুখ ভরা লাল ফুটকিওয়ালা মাস্তান ডয়েলের ওপর।

পয়েন্ট ব্লাঞ্চের তিরিশ মাইল দূরে এন সার্কেল মোটেলে নিরাপদেই পৌছুল ওরা। মোটেলটা জীর্ণ, পুরনো দোতলা বাড়ি। হাইওয়ে ধরে ক্লোভিস প্যারিশের দিকে আসার পথে এমন বহু বাড়ি দেখেছে রানা। সামনে চওড়া পার্কিং লটে নানাধরনের ঝোপঝাড়। একতলায় ধুলোভরা কাঁচের দরজায় নো স্মোকিং বা নো কনসিল্ড হ্যাণ্ড গান সাইন নেই। ওদিকে রিসেপশন অফিস। আপাতত সেখানে কাউকে দেখা গেল না। থমথম করছে চারপাশ।

পার্কিং লটের মুখে ফায়ারবার্ড থামাল ডয়েল। রিয়ার ভিউ মিররে তাকাল। ‘এবার?’

ডয়েলের ঘাড় থেকে তীর সরাল রানা। ওটার ডগায় ঝুলছে একফোঁটা রক্ত। খোঁচা খেয়ে বন্দির ঘাড়ে তৈরি হয়েছে ছোট্ট একটা ফুটো।

‘পার্কিং লটে গাড়ি রাখো। চোখ রাখতে চাই রিসেপশন অফিসের দরজার ওপর। মুখ বুজে মনে মনে প্রার্থনা করতে খাকো, যেন অধৈর্য না হই। ধৈর্য শেষ তো তুমিও শেষ!’

নানান মিশনে শত্রুর ওপর চোখ রাখতে গিয়ে হাজারো ঘণ্টা ব্যয় করেছে রানা। কখনও কনকনে বরফের প্রান্তরে, ঊষর মরুভূমিতে, গভীর ঘন জঙ্গলে, দুর্গম পাহাড়ে, কখনও বা ঝোড়ো সাগরে। চুপ করে বসে থাকল রানা। প্রাণের ভয় এমনই জিনিস, অপেক্ষা করতে গিয়ে ওর চেয়ে খারাপ করছে না মণ্টি ডয়েল।

পার্কিং লটে লাল গাড়ি থেকে কাস্টমার নামছে না দেখে হয়তো বিস্মিত রিসেপশন স্টাফ। তবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল না কেউ। মাত্র একজন খদ্দেরকে নিয়ে চিন্তা করার পর্যায়ে নেই এন সার্কেলের কর্তৃপক্ষ। একটু পর পর বাড়ির সামনে থামছে একটা দুটো গাড়ি। ধীর ভঙ্গিতে ওগুলো থেকে নেমে বাড়িতে প্রবেশ করছে একজন বা দু’জন যুবক। বাড়ি থেকে বেরিয়েও আসছে কেউ কেউ। গাড়িতে চেপে চলে যাচ্ছে রাস্তার ডানে বা বাঁয়ে। এইমাত্র রিসেপশন অফিসের দরজা ঘেঁষে থামল একটা গাড়ি। ওটা থেকে নেমে পড়ল এক যুবক। চট্ করে তাকাল রাস্তার দিকে। নার্ভাস। ভাবছে, কেউ পিছু নিতে পারে। আরেকবার চারপাশ দেখে নিয়ে রিসেপশন অফিসে ঢুকল সে। মুখে হাসি নিয়ে তাকে অভ্যর্থনা জানাল সোনালি চুলের এক যুবতী। সিঁড়ি বেয়ে ওপরতলায় উঠল যুবক। এ মোটেলে পনেরো বা বিশ মিনিট পর পর আসছে- যাচ্ছে যুবকেরা।

‘তেরো নম্বর ঘর জেসির,’ নিচু গলায় বলল ডয়েল। ওর চাহিদা সবচেয়ে বেশি।’

চুপ করে বসে থাকল রানা।

পেরোল আরও বিশ মিনিট। বাড়ি ছেড়ে গাড়িতে উঠল একটু আগের সেই যুবক। চেহারা হাসি-হাসি। মাঝারি গতি তুলে বামের রাস্তায় গেল সে।

এন সার্কেল ব্যস্ত পতিতালয়।

পরবর্তী একঘণ্টায় এল আরও পাঁচজন কাস্টোমার।

ধীর গতি তুলে পেরোল আরও একঘন্টা।

জ্বলন্ত রোদের তাপে আভেনের মত তপ্ত হয়েছে ফায়ারবার্ডের ভেতরটা। বিশ মিনিট পর বিরক্ত হয়ে রানা ভাবল: যথেষ্ট হয়েছে, এবার ঘাড় ধরে ডয়েলকে নিয়ে ঢুকব তেরো নম্বর ঘরে। ওখানে ব্যস্ত কোনও যুবক রয়ে গেলে ঝামেলা হবে। তা হোক! তাকে ঢিট করে মেয়েটার কাছ থেকে জানব জরুরি তথ্য। গাড়ি থেকে নেমে পড়বে ভেবেছে রানা, এমনসময় পার্কিং লটে ঢুকল বাক্সের মত কালো একটা ক্যাডিলাক এসইউভি। রিসেপশন দরজার সামনে কড়া ব্রেক কষে থামল ওটা। প্রায় ঝাঁপ দিয়ে গাড়ি থেকে নামল এক যুবক। হাঁটার ভঙ্গি থেকে ঝরছে আত্মবিশ্বাস। তার বয়স হবে তিরিশ-একত্রিশ। মাথার চুল লালচে। চোখে কালো সানগ্লাস। পরনে নীল জিন্স, পায়ে দামি বুট। তাকে সাধারণ খদ্দের বলে মনে হলো না রানার। কী যেন আছে যুবকের ভেতর। রিসেপশন অফিসের দরজা খুলে কোনও দিকে না চেয়ে উঠে গেল সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়।

তাকে চিনেছে ডয়েল। বিড়বিড় করল, ‘ক্রাইস্ট! এ-ই তো প্যাট্রিক নোভাক!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *