1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৩

তিন

র‍্যাকের বাঁক ঘুরে নিঃশব্দে তিন পা এগিয়ে থামল রানা। নরম সুরে বলল, ‘হ্যালো, ছেলেরা, ব্যবসা করছ?’ ওর ডানহাতে পুরো এক লিটারের ল্যাফ্রোইগ কোয়ার্টার কাস্ক সিঙ্গেল মল্ট উইস্কির বোতল। ওজন প্রায় পৌনে দুই কেজি কাউকে জখম করতে দারুণ জিনিস। দুই তস্কর কিছু বুঝবার আগেই মাঝের দূরত্ব, ল্যাফ্রোইগের বোতলের গতিবেগ, ঘূর্ণন আর পতনের হিসেব কষে নিয়েছে রানা। তবে এখন গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক টার্গেট বেছে নেয়া। ভারী মোষ তার নলকাটা শটগানের ট্রিগারটা টিপে দিলেই ছিন্নভিন্ন হবে বৃদ্ধের হৃৎপিণ্ড। পিঠ ফাটিয়ে পেছনের দেয়ালে গিয়ে লাগবে বুকের হাড়গোড়, মাংস-রক্ত। অবশ্য, বড়সড় ডাকাতকে ধীরগতি বলে মনে হয়েছে রানার। সে তুলনায় সত্যিকারের বিপজ্জনক হচ্ছে তার সঙ্গী। চট করে সরে যেতে পারবে সে। কাউন্টারের ওদিকে ক্যাশবাক্স হাতড়াচ্ছে লোকটা একমনে। ওর দিক থেকেই আসবে প্রথম আক্রমণ।

রানার ধারণাই ঠিক!

ঝাপসা উল্কি আঁকা ডানহাতের টাকার বাণ্ডিল ছেড়ে দিয়ে ঝট্ করে সোজা হয়ে দাঁড়াল সে। ঝনঝন করে মেঝেতে পড়ল কিছু খুচরো কয়েন। বিদ্যুদ্বেগে তার ডানহাতের কবজি নামল প্যান্টে গুঁজে রাখা কড্ রিভলভারের বাঁটের কাছে।

অবশ্য আগেই কাজে নেমেছে রানা। সাঁই করে বৃদ্ধ দোকানির নাক ঘেঁষে উড়ে গেল উইস্কির বোতল। ওটার তলি গিয়ে ঠকাস্ করে লাগল ক্যাশবাক্সের সামনে দাঁড়ানো শুটকি ডাকাতের কপালে।

ফিযিক্সের জটিল হিসাব কষতে যায়নি রানা। ভাল করেই জানে, দ্রুত ছুঁড়ে দেয়া জিনিসের শক্তির বিষয়ে রয়েছে জটিল ফর্মুলা। ওর ভুল না হয়ে থাকলে ওই সূত্র আবিষ্কার করেন নিউটন। সবটা মিলে ম্যাস অভ ভেক্টর, ভেলোসিটি, অ্যাক্সেলারেশন ও মোমেনটামের প্যাঁচ। বৈজ্ঞানিক সূত্র অনুযায়ী টার্গেটে দ্রুতগতি বোতল আঘাত হানলে চিরকালের জন্যে বিকৃত হবে শেয়ালের কপালের হাড়। ওদিকে তলপেটে গুঁজে রাখা রিভলভার টেনে বের করতে গিয়ে ট্রিগারে টিপ দিয়ে বসেছে সে।

স্মিথ অ্যাণ্ড ওয়েসন রিভলভারের ট্রিগারে তিন/চার পাউণ্ডের চাপ পড়লেই কার্তুজের পেছনে প্রাইমারের ওপর খটাস্ করে নামে হ্যামার। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। কপালে বোতলের গুঁতো খেয়ে চমকে গেছে লোকটা। হ্যাঁচকা টান লাগতেই বুম্ শব্দে গর্জে উঠেছে .৩৫৭ ম্যাগনাম রিভলভার। বুলেটের আঘাতে গায়েব হয়েছে লোকটার পুরুষাঙ্গের অর্ধেক আর অণ্ডকোষের ডানপাশের ডিমটা। প্রায় উড়ে পিছিয়ে গিয়ে হুড়মুড় করে মেঝেতে পড়ল সে।

বদ্ধ দোকানের ভেতর বজ্রপাতের হুঙ্কার তুলেছে বুলেট। সেটা মিলিয়ে যেতেই রানা শুনল অদ্ভুত টানা আর্তনাদ 1 চিকন ডাকাত বুঝেছে, ভীষণ কোনও ক্ষতি হয়ে গেছে তার।

সঙ্গীর হুক্কা-হুয়া আর্তনাদে নড়ে উঠে ধাক্কা দিয়ে বৃদ্ধকে সরাল গণ্ডার। একহাতে রানার দিকে ঘোরাল নলকাটা বন্দুক। দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে রানাকে দেখছে সে। মুখ থেকে মিলিয়ে গেছে শ্লথ হাসিটা। রানার বুকে তাক করার আগে বন্দুকের দুই নল উঠেছে সিলিঙের দিকে। সুযোগটা নষ্ট না করে ক্ষিপ্র চিতার বেগে এগিয়ে গণ্ডারের ডান কবজির ওপর মোক্ষম এক ফ্লাইং কিক্ ঝাড়ল রানা। ফলে মড়াৎ করে ভাঙল মোটা কবজি। অকেজো হাত থেকে লিনোলিয়ামের মেঝেতে খটাস্ করে পড়ল বন্দুক। গুলি বেরোল না ওটা থেকে। পিছলে সরে গেল কয়েক ফুট দূরে। ওই একই সময়ে আইকিডোর জয়েন্ট লক-এ গণ্ডারের ভাঙা কবজি পেঁচিয়ে ধরল রানা। ওই লকে আটকে নিলে প্রচণ্ড ব্যথা লাগে। মুখটা ভীষণ বিকৃত করে হাঁটু গেড়ে মেঝেতে বসল গণ্ডার। থুতনি গিয়ে ঠেকেছে বুকে। চিরস্থায়ী ক্ষতি হবে না এমন মাপা এক লাথি লাগাল রানা তার কণ্ঠনালীতে। শ্বাস আটকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল দানব মেঝেতে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গোল হয়ে গেছে কেন্নোর মত।

কাউন্টারের ওপাশের মেঝেতে গোপনাঙ্গ চেপে ধরে শুয়োরের মত ঘোঁৎ-ঘোঁৎ শব্দ তুলছে চিকন ডাকাত। খেয়াল নেই কোমর থেকে খসে হাতের কাছেই পড়েছে রিভলভার। তার কোমর থেকে হাঁটু পর্যন্ত ভিজে গেছে প্যান্ট। লাল হয়ে উঠেছে রিভলভারের নল ও সিলিণ্ডার। মেঝেতে কলের জলের মত ঝরঝর ঝরছে রক্ত। কপালের মাঝখানটায় বোতলের তলির স্পষ্ট, গভীর ছাপ।

মোষটাকে পাত্তা না দিয়ে কাউন্টারের পেছনে চলে গেল রানা, এক লাথিতে দূরে পাঠিয়ে দিল রিভলভার। আক্ষেপ নিয়ে দেখল চুরমার হয়ে যাওয়া ল্যাফ্রোইগ কোয়ার্টার কাস্ক সিঙ্গেল মল্ট উইস্কির বোতলটা। আনমনে একবার মাথা নাড়ল রানা। ল্যাফ্রোইগের বোতলের বদলে সিক্স প্যাক ডিক্সি বিয়ারের কার্টন ছুঁড়লেই বোধহয় ভাল হতো!

তবে এখন আর আফসোস করে লাভ নেই। যা হবার হয়ে গেছে।

মেঝেতে ছটফট করছে আর থেকে থেকে কাতরে উঠছে চিকন ডাকাত। তার রক্তাক্ত ঊরু দেখল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘বোধহয় দ্বিতীয়বার কাটা পড়েছে তোমার যন্ত্রটা। ইস্, কেউ ওই জায়গায় রাখে এসব অস্ত্র?’

কথা শোনার অবস্থায় নেই লোকটা।

বৃদ্ধ দোকানীর দিকে ঘুরে তাকাল রানা। কাউন্টারের একপাশে কুঁজো হয়ে গেছেন বেচারা। ঠেকাবার ভঙ্গিতে সামনে বাড়িয়ে দিয়েছেন একটা হাত। ভয় পাচ্ছেন, এবার বোধহয় তাঁর পালা, মারবে রানা। কাউন্টারের পাশের দেয়ালে ঝুলন্ত টেলিফোন সেটটা দেখাল ও। ‘শেরিফের অফিস তো বোধহয় সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা, তাই না? তবে অফিসে একজন ডেপুটি থাকার কথা। তাকে ফোন করুন। বলে দেবেন, সঙ্গে যেন অ্যাম্বুলেন্স আনে।’

রানা মারধর করবে না বুঝে স্বস্তির ছাপ ফুটল বৃদ্ধের চেহারায়। মুখের কাছ থেকে হাত নামিয়ে দেখলেন, সামনের মেঝেতে পড়ে আছে গণ্ডার। কাউন্টারের এদিকে নিজের রক্তের ভেতর ছটফট করছে অপর লোকটা।

আস্তে করে মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। ‘হোলি শিট, মিস্টার! বাপের জন্মেও এমন কাণ্ড দেখিনি! ওই দু’জন দেখছি তোমার কাছে দুধের বাচ্চা! ঝড়ের মত কী করলে, আর তাতেই শুয়ে পড়ল দুই-দুইজন গুণ্ডা!’ বড়সড় ডাকাতকে দেখালেন তিনি। ‘এ হচ্ছে জর্জি ডান। ওর চেয়ে খারাপ লোক আর নেই এই প্যারিশে। মাথা চলে না গাধার, কিন্তু দুই পায়ের ফাঁকে ওটা ডেঞ্জারাস জিনিস। ষাট বছর আগে ওর মাকে ভাল করেই চিনতাম। সে-ও মারাত্মক ছিল। শহরের বদমাস যুবকগুলো ভাবতে শুরু করেছিল দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। …আর ওই যে নড়েচড়ে উঠছে, এই লোকটা আমাদের শহরের কেউ নয়। পাকা ডাকাত। কিন্তু তাতে লাভ কী, তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে তো বিচিই উড়িয়ে দিল নিজের! তা হলে আর থাকলটা কী!’

এত আওয়াজের মাঝে বৃদ্ধের কথা বোঝা যাচ্ছে না ঠিক মত। রক্তাক্ত, ডাকাতের পাশে থেমে ওর মাথার চাঁদিতে ছোট্ট একটা লাথি মেরে ঘুম পাড়িয়ে দিল রানা। এদিকে ডেক সেট থামিয়ে দিয়েছেন বৃদ্ধ। শান্তি ফিরেছে দোকানে। আবারও আঙুল তুলে টেলিফোন দেখিয়ে দিল রানা। ‘কলটা করে ঝামেলা শেষ করুন। এরপর খুশি হব আরেকটা ল্যাফ্রোইগ কোয়ার্টার কাস্ক সিঙ্গেল মল্ট উইস্কির বোতল জুটিয়ে দিলে। ওটা নিয়ে মোটেলে ফিরতে চাই।’

‘ওই জিনিস আর নেই, পাডনাহ্। শেষ যেটা ছিল, ভেঙে ফেলেছ তুমি।’

‘তা হলে গ্লেনমোরেঞ্জিই সই,’ বলল রানা।

‘ওটা পাবে বিনা পয়সায়,’ বললেন বৃদ্ধ। ‘এই যে আমার জীবন বাঁচিয়ে দিলে, সেজন্যে এটুকু না দিলে ছোট হয়ে যাব নিজের কাছে।’ ডানহাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। হাতের পিঠে লাখ লাখ ভাঁজ। ‘আমি টিমোথি। টিমোথি হেকেথন। বাহাত্তর সাল থেকে এই দোকান চালাচ্ছি। এর আগে কখনও এদের মত ডাকাতি করতে আসেনি কেউ।’

মৃদু হেসে করমর্দন করল রানা। ‘আমার নাম রানা। নিজে থেকে এক বোতল মদ দিতে চেয়েছেন বলে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। তবে কেনার মত টাকা আছে আমার কাছে। যেটা ভেঙেছি, সেটার জন্যেও ক্ষতিপূরণ দেব।’

জবাব না দিয়ে শুধু মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ, তারপর কল দিলেন শেরিফের অফিসে। কাউন্টারে কনুই রেখে অপেক্ষা করল রানা। একটু বিরক্ত। আমেরিকান পুলিশ সম্পর্কে ওর অভিজ্ঞতা অত্যন্ত তিক্ত।

কিছুক্ষণ পর দূর থেকে এল সাইরেনের আওয়াজ।

দু’মিনিট পেরোবার আগেই বাইরের রাস্তা ভরে গেল নীল আলোর ঝিলিকে। দোকানের সামনে থেমেছে দুটো ক্রাউন ভিক্টোরিয়া পুলিশ পেট্রল ক্রুযার। দরজায় লেখা: ক্লোভিস প্যারিশ শেরিফ’স ডিপার্টমেন্ট।

‘ওই যে, সামনের গাড়িতে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান,’ জানালার দিকে আঙুল তাক করলেন বৃদ্ধ। ‘ভেজা প্যান্থারের চেয়েও নীচমনা।’

‘বাজে পুলিশ?’ জানতে চাইল রানা।

‘না, তা নয়। স্যাম শেরিড্যান এদিকের সেরা শেরিফ।’

সামনের গাড়ি থেকে বেরোল চওড়া হাড়সর্বস্ব এক ঢ্যাঙা লোক। পরনে ইউনিফর্ম। মাথায় কাত করে পরেছে একটা ক্যাম্পেইন হ্যাট। একপাশের ধূসর চুল দেখল রানা। শীতে রুক্ষ হওয়া কঠিন পাথরের মত লোকটার চেহারা। পেছনের গাড়ি থেকে নেমেছে তার দুই ডেপুটি। লিকারের স্টোরের দরজা খুলে ভেতরে চোখ বোলাল শেরিফ। পরিবেশটা বুঝেই আরও কঠিন হলো তার চেহারা। দুই ঊরুর পাশে পাকিয়ে গেল দুই হাতের মুঠো।

রানা বুঝল, আজকের সুন্দর রাতটা কঠিন হয়ে উঠছে ওর জন্যে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *