একচল্লিশ
রহস্যজনক ফোনকল পাওয়ার পৌনে পাঁচ ঘণ্টা পর চিটিমাচা থেকে বিশ মাইল দূরে একটা ফোর্ড টরাস গাড়ির প্যাসেঞ্জার সিটে বসে আছে মাসুদ রানা। একটু দূরেই পরিত্যক্ত পেট্রল পাম্প। ওটার জিপিএস লোকেশন দিয়েছে এবি পামবোর দেহরক্ষীদের নেতা চার্লস। একটা ঝোপের আড়াল থেকে পেট্রল স্টেশনের ওপর চোখ রেখেছে রানা। ধীরে ধীরে ফর্সা হয়ে উঠছে পুবাকাশ।
এখানে পৌছুতে গিয়ে সারারাত বাইয়ুর মাঝ দিয়ে এগিয়েছে রানা। এখন বিশ্রাম নেয়ার ফাঁকে ভাবছে, সত্যিই কি কোনও লাভ হবে এত দূরে ছুটে এসে? কী ধরনের তথ্য দেবেন এবি পামবো? আচ্ছা, এই যে ভাগ্যগুণে টরাস গাড়িটা পেয়ে যাওয়া— এতে ওই জাদুর রানীর হাত নেই তো?
গভীর রাতে এই ঝরঝরে টরাস গাড়িটা পেট্রল পাম্পে রেখে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল ইঁদুরমুখো এক মুশকো লোক। এলোমেলো পা পড়ছে দেখে রানা বুঝল, বন্ধুদের সঙ্গে আকণ্ঠ মদ গিলে পুরো মাতাল হয়ে ঘরে ফিরছে ব্যাটা। এক শত ডলারের একটা নোট বাড়িয়ে ধরে রানা গাড়িটার প্যাসেঞ্জার সিটে কিছুক্ষণ বসার অনুমতি চাওয়ায় আপত্তি তো করেইনি, বিনা দ্বিধায় গাড়ির চাবিটা ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে টাকা না নিয়েই টলতে টলতে চলে গেছে বাড়ির পথে। ঘুম ভাঙলে বোধহয় কিছুই মনে পড়বে না মাতালটার।
ভোর সোয়া ছয়টায় দেখা হবে রানা ও এবি পামবোর। গাড়িটা নিয়ে কাঁচা রাস্তা থেকে একটু দূরে ঝোপঝাড়ে ভরা টিলার আড়ালে বসে পেট্রল স্টেশনের ওপর চোখ রেখেছে ও। যদিও আগেই এখানে পৌঁছে আশপাশে ঘুরে বুঝেছে ও ফাঁদ পাতা হয়নি। তা ছাড়া, মহিলার সঙ্গে কথা বলে তাঁকে চিটিংবাজ বলেও মনে হয়নি রানার।
টিলার ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে বহু দূর।
থম মেরে কালো একটা মরা সাপের মত পড়ে আছে অব্যবহৃত নির্জন রাস্তা। এদিকে কেউ নেই বলেই এই জায়গাটা বেছে নিয়েছেন এবি পামবো।
ঠিক ছয়টা বাজতেই দূরে কালো একটা স্টেশন ওয়্যাগন দেখল রানা। পেছনে উড়ছে একরাশ ধুলো। ধীরগতি তুলে পেট্রল স্টেশনের অকেজো পাম্পের সামনে থামল গাড়িটা। খুলে গেল ড্রাইভারের দরজা। ভেতর থেকে নেমে এল এক লোক।
চোখে বিনকিউলার তুলে তাকে দেখল রানা। যা ভেবেছে, হাজির হয়েছে বড়মার দেহরক্ষীদের দলনেতা চার্লস। তবে কেউ নেই তার সঙ্গে। পরনে সাদা শার্ট, কালো টাই আর কালো ক্যাপ। সুটও কালো রঙের।
দ্বিতীয়বার আরও মন দিয়ে গাড়িটা খেয়াল করল রানা। এটা সাধারণ কোনও স্টেশন ওয়্যাগন নয়। আমেরিকানরা ওই জিনিস ব্যবহার করে লাশ বহনের কাজে!
সূর্যের কাঁচা রোদে চকচক করছে পুরনো গাড়িটা।
ওকে মেরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে এল নাকি লোকটা, ভাবল রানা। মনে হয় না। যদিও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, পেছনের কম্পার্টমেন্টে রাখা আছে একটা কফিন।
টিলার আড়াল থেকে বেরিয়ে করোনারের গাড়ির পাশে থামল রানা। ওর দিকে এগিয়ে এল কুচকুচে কালো চার্লস।
‘আমি তো ভেবেছি বড়মা নিজেই আসবেন,’ বলল রানা। ‘তা, আপনি একা এলেন যে?’
‘আপনাকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে,’ কফিনবাহী গাড়িটা দেখাল চার্লস।
‘খুব অস্বাভাবিক গাড়ি। আপনি কি নানান জায়গায় লাশ পৌঁছে দেন?’
মাথা নাড়ল চার্লস। ‘না, এটা আমার চাচাত ভাই জিমির। সে একজন করোনার।’
‘কফিনের ভেতর লাশ আছে?’ জানতে চাইল রানা।
‘না। আপনি ওখানে শোবেন।’
‘ঠাট্টা করছেন?’
‘না। গোটা প্যারিশ জুড়ে আপনাকে খুঁজছে পুলিশের লোক, রানা। কিন্তু মনে হয় না তারাও কফিনের ডালা তুলে লাশ দেখতে চাইবে।’
দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘দিনের শুরুতেই লাশ হতে বলছেন?’
কাঁধ ঝাঁকাল চার্লস। ‘আপাতত লাশ হওয়াই ভাল। সোজা পৌঁছে যাবেন বড়মার কাছে। তাতে যদি রাজি না থাকেন, তো বলে দিন, খালি বাক্স নিয়ে বিদায় হই।’
পুরো তিন শ’ ষাট ডিগ্রি ঘুরে চারপাশ দেখল রানা। আগের মতই ফাঁকা রাস্তা। এমন কেউ নেই যে দেখবে স্বেচ্ছায় কফিনে উঠছে একটা লাশ। কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে লাশবাহী গাড়ির পেছনে থামল রানা। ডালা ধরে টান দিতেই ঘড়ঘড় শব্দে রোলারে ভর করে বেরিয়ে এল কফিন। ওটার ঢাকনি তুলে ভেতরে তাকাল রানা। চারদিকে সাটিনের সাদা ধবধবে লাইনিং। চার্লসের দিকে তাকাল। ‘ভেতরে বাতাস ঢোকার পথ আছে, নাকি আসল লাশের মতই আমাকে চিরকালের জন্যে শ্বাস আটকে থাকতে হবে?’
‘দেখতে যেমনই হোক, হাওয়া ঢোকার পথ আছে,’ বলল চার্লস।
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘ঠিক আছে, আপনাকে বিশ্বাস করছি। তবে পরে যদি দেখি মিথ্যা বলেছেন, তখন কিন্তু অন্য লোক খুলে দেখবে ওখানে চিরকালের জন্যে শুয়ে আছেন আপনি। কথা বুঝতে পেরেছেন?’
মৃদু হাসল চার্লস। ‘ভয় নেই। নিশ্চিন্তে ভেতরে ঢুকে শুয়ে পড়ন। ভাবতে থাকুন মরে গেছেন। হাতে বেশি সময় নেই। ঠিক সময়ে পৌছুতে হবে বড়মার ওখানে।’
উদাস ভঙ্গি নিয়ে কফিনে ঢুকে শুয়ে পড়ল রানা। কিছু বলার আগেই ধুপ্ করে বন্ধ হলো ডালা। কফিনের ভেতরে থলথলে গদি। কোনও বাজে গন্ধ নেই। রানা টের পেল, সরসর করে গাড়ির ভেতরে কফিন পাঠিয়ে দিল চার্লস। ধুপ্ শব্দে বন্ধ হলো গাড়ির পেছন-দরজা। কয়েক মুহূর্ত পর চাপা আওয়াজ তুলল ইঞ্জিন। দুলে উঠে রওনা হলো দীর্ঘ গাড়িটা।
জেনেবুঝে কফিনে শুয়ে শেষকৃত্যের জন্যে চলেছে এমন আর কাউকে দেখেনি রানা। অনুভূতিটা মোটেও স্বস্তিকর নয়। তবে কফিনটা আরামদায়ক। গদির ভেতরে রয়েছে এয়ার কুলারের ডাক্ট। ঠাণ্ডা বাতাসে শুয়ে একটু পর ঘুম পেল ওর। আর জেগেই বা কী করবে? কিছুই তো করার নেই! হ্যাঁ, সময়টা বিশ্রামের মাধ্যমে পার করাই ভাল। এমনিতেই ভাল করে ঘুমাতে পারেনি গত কয়েকটা দিন। চোখ বুজে বুকের ওপর দুই হাত রেখে মড়ার মতই ঘুমিয়ে পড়ল রানা।
বেশ কিছুক্ষণ পর ঝাঁকি খেয়ে ভেঙে গেল ওর কাঁচা ঘুম। সরসর করে পেছনদিকে টেনে নেয়া হয়েছে কফিন। চোখ মেলতেই রানা দেখল খুলে গেছে ঢাকনা। ভেতরে এসে পড়েছে কাঁচা রোদ।
‘বাহ্! সুদর্শন এক জ্যান্ত লাশ দেখছি!’ চাপা কণ্ঠে বলে উঠলেন বড়মা এবি পামবো।
উঠে বসল রানা। পুরনো গোরস্তানের ভেতর আছে ওরা। পরিবেশে রয়েছে ভেজা ভেজা একটা ভাব। কবরের এবড়োখেবড়ো সব সমাধি ফলকের ওপর থেকে বাষ্প উঠে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে। এটা যেন অন্য কোনও জগতের অন্য কোনও সময়ের চিরদিনের জন্য ভুলে যাওয়া কোনও জায়গা।
এবি পামবোর পরনে রঙচঙে জোব্বা। কাঁধের ওপর বয়স্কা মহিলা চাপিয়ে নিয়েছেন কয়েকটা শাল। চওড়া ব্রিমের হ্যাট ঢেকে দিয়েছে ধবধবে সাদা, কোঁকড়া চুল। হ্যাটের কারণে কুয়াশা ভরা রোদ পড়ছে না বড়মার মুখে।
মহিলার সঙ্গে অপেক্ষা করছে দেহরক্ষীদের দু’জন। একটু দূরেই মরা ঘাসের মাঝে ন্যাড়া এক গাছের নিচে পার্ক করা হয়েছে একটা ভ্যান। ওটাতে চেপেই এসেছে এরা। প্রয়োজনে যাতে চট করে দেহরক্ষীর ওপর দেহের ভর রাখতে পারেন এবি পামবো, সেজন্যে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকদু’জন। তবে জেদ প্রকাশ পেল শতবর্ষী মহিলার মুখে। একহাতে শক্ত করে ধরেছেন গিঠ ভরা দীর্ঘ একটা লাঠি।
কফিন থেকে লাফিয়ে নেমে এল রানা। ‘গুড মর্নিং, বড়মা।’
‘আবারও জন্ম নিয়ে কেমন লাগছে, বাছা?’ গাল কুঁচকে হাসলেন বৃদ্ধা। দিনের আলোয় তাঁকে আরও বেশি বয়স্কা লাগছে। মুখের ত্বকে হাজার হাজার ভাঁজ। যদিও অদ্ভুত এক আগুন জ্বলছে বৃদ্ধার চোখে।
‘দ্বিতীয়বার বাঁচলে যেমন লাগে, তেমনই বোধ করছি,’ হাসল রানা।
হাতের ইশারায় নিরাপত্তা রক্ষীদেরকে সরে যেতে বললেন এবি পামবো। রানার বাহুতে হাত রাখলেন। ‘আমার হাত ধরে এগোও, বাছা। জরুরি কিছু কথা বলব।’
বৃদ্ধার পাশে পা বাড়াল রানা।
ভ্যানের কাছে রয়ে গেল চার্লস ও তার দুই অনুচর। তাদের চোখ বড়মা ও রানার ওপর।
কৌতূহল বোধ করছে রানা। তবে সেটা প্রকাশ করল না। চারপাশ দেখছে। বহু দিন হলো এই গোরস্তানের যত্ন নেয়া হয় না। কবরের ফলকগুলোর ওপর জন্মেছে শ্যাওলা। জায়গায় জায়গায় ঝোপঝাড়। কিছু কবর-ফলক দেখে রানা বুঝল, গত এক শ’ বছরের ভেতর এখানে কাউকে গোর দেয়া হয়নি।
‘এখানে আছে বহু বছর আগের ইতিহাস,’ মন্তব্য করলেন বড়মা।
‘আর সেজন্যে এ জায়গাটাই বেছে নিয়েছেন আপনি,’ বলল রানা।
‘আমি প্রায়ই এখানে আসি, বাছা,’ বললেন এবি পামবো। ‘যারা এখানে শুয়ে আছে, তাদের বড় একা লাগে। কেউ এলে খুশি হয়। তাই মাঝে মাঝে এসে তাদের সঙ্গে কথা বলি।’
‘আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, সেজন্যে আপনাকে ধন্যবাদ, বড়মা,’ বলল ‘রানা। ‘গতবার আমার মনে হয়েছে, কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেছিলেন। এবার কি সে বিষয়ে কিছু বলবেন?’
ভুরু কুঁচকে দূরে তাকালেন বৃদ্ধা। ‘আসলে তোমার সঙ্গে কথা বলার পর থেকে অনেক কিছু ভেবেছি।’
‘আমার মনে হয়েছে, আপনি শেলি লং ল্যান্সের খুনের ব্যাপারে বহু কিছুই জানেন,’ বলল রানা। ‘তবে যে কারণেই হোক আমাদেরকে বলতে চাননি। আর ওই একই বিষয়ে ভাবতে গিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। আমি কি ভুল বললাম, বড়মা?’
চুপ করে থাকলেন বয়স্কা মহিলা।
‘আপনি ভয় পান যে বিপদ ডেকে আনবে নোভাকরা। ঠিক যেমন করে খুনোখুনি করেছিল আঠারো শত তেয়াত্তর সালে।’
‘ব্যাপারটা ভয় পাওয়ার মতই। সব জানলে তুমিও ভয় পাবে। নোভাকদের আত্মা দখল করে নিয়েছে অশুভ 1 প্রেতাত্মা। সেটা করেছে, কারণ তাদেরকে চালায় একদণ কালো জাদুকর। শত শত বছর ধরেই এমনটা হচ্ছে।’
মৃদু হাসল রানা। ‘আমি অশুভ আত্মার ব্যাপারটা বিশ্বাস করি না, বড়মা। আমি শুধু চিনি খারাপ লোকদেরকে।’
ঘন ঘন মাথা নাড়লেন এবি পামবো। ‘বড়মা জানে জাদু কেমন হয়। বলো তো, রানা, জাদুর ব্যাপারে কী জানো তুমি?’
‘আপনি ভুডু ম্যাজিকের কথা বলছেন?’ বলল রানা। ‘এলিসা গুডরিচ ওই ব্যাপারে আমাকে সামান্য বলেছিলেন।’
এলিসা খুব ভাল মনের মেয়ে,’ বললেন বৃদ্ধা। ‘ওর অনেক কিছু দেখার ক্ষমতা আছে। তবে অভিজ্ঞতা নেই। তাই এমন কিছু দেখতে পায় না, যেটা দেখে এবি পামবো। এলিসা শুধু বুঝতে পারে সাদা জাদু। যেটা ক্ষতিকর নয়। গাছপালা, জন্তু আর পৃথিবীর ওপর কাজ করে ওই জাদু। সারিয়ে তোলে ক্ষত। আর ওই ভাল জাদুকেই বলে হুডু। ওটাকে বলতে পারো স্রষ্টার তৈরি জাদু। কিন্তু ওটার বিপরীতে রয়েছে অসম্ভব খারাপ এক ধরনের কালো জাদু।
চুপ করে থাকল রানা।
ওর বাহুর ওপর হাত রাখলেন বড়মা এবি পামবো। ‘তুমি আসলে এসব জানতে চাও না, রানা। তবে মনে রেখো, ওই কালো জাদুর মালিক হচ্ছে স্বয়ং শয়তান। দুনিয়ার সব ভালো বা আলো গিলে নিতে চায় ওই জাদু। কষ্টভরা মৃত্যু ডেকে আনে। অসুখ যেমন ছড়িয়ে দেবে, তেমনই বেদনা দেবে। ওই কালো জাদু শয়তানের আদেশ পেয়ে ক্ষতি করে পৃথিবীর। ওই অশুভ শক্তি আসে নরক থেকে। আর নোভাকদের মত খারাপ মানুষদের ওপর ভর করেছে ওটা।’
‘হতে পারে, বড়মা,’ বলল রানা, ‘আপনি কি সেজন্যেই নোভাকদের কথা তুলছেন?’
উদাস চোখে রানাকে দেখে আস্তে করে মাথা দোলালেন বৃদ্ধা। ‘মানুষের মত দেখতে হলেও আত্মার দিক থেকে তারা ইবলিশের মত, বাছা। ওদের এতই ক্ষমতা, ভাবতেও পারবে না। আজ থেকে বহু বছর আগে এই ক্লোভিস প্যারিশে ক্রীতদাস ও ক্রীতদাসীদেরকে নির্যাতন, ধর্ষণ আর খুনের মাধ্যমে ভয়ঙ্কর পরিবেশ তৈরি করেছিল উইলিয়াম এফ. নোভাক। তাকে বাধা দেয়ার সাধ্য কারও ছিল না। করুণভাবে মরত কালো মানুষরা।’
হাঁটতে হাঁটতে রানার কবজি শক্ত করে ধরলেন বৃদ্ধা। ‘হয়তো বুঝতে পেরেছ, কেন তাদের ব্যাপারে কিছু বলতে ভয় পেয়েছি? আমি তো দুর্বল এক বুড়ি মেয়েলোক। মরতে ভয় পাই না, কারণ সময় হলেই নিজের কোলে তুলে নেবেন স্রষ্টা। তবে আর সবার মতই প্রশান্তি নিয়ে মরতে চাই। দানবদের হাতে মরতে আপত্তি আছে। একবার শিউরে উঠলেন এবি পামবো। ‘নোভাকদের হাত অনেক লম্বা, রানা। একবার যদি তারা জানে, তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলেছে কেউ, তবে আর রক্ষা নেই। তাদের কালো জাদুর কবলে পড়ে মরবে মানুষটা।’
‘আমি রিচি নোভাকের মুখোমুখি হয়েছি, বড়মা,’ বলল রানা। ‘সে যদি দানব বা অশুভ কালো জাদুকর হয়, তো আমি তার চেয়েও শক্তিশালী এক সাদা জাদুকর। এরই ভেতর আমার সামনে মরেছে তাদের ছোটভাই। এ থেকে প্রমাণ হচ্ছে, তারা আসলে নীচ মনের একদল দুশ্চরিত্র মানুষই। বহু দিন ধরেই সাধারণ মানুষকে ভয় দেখিয়ে যা খুশি করলেও এবার আর রেহাই পাবে না আমার হাত থেকে। এ ব্যাপারে মনে কোনও সন্দেহ রাখবেন না, বড়মা।’
‘তা জানি, বাছা।’ সরাসরি রানার চোখে তাকালেন বৃদ্ধা, ‘আমি সবই দেখেছি। তোমাকে পাঠানো হয়েছে অশুভ এই লোকগুলোকে শেকড় ছিঁড়ে উপড়ে ফেলার জন্যে। কালো মানুষদের জন্যে তোমার মনে যে ভালবাসা দেখেছি, অচেনা- অজানা একটা কালো মেয়ে লিষের জন্যে তোমার ভেতরে যে
মায়া দেখেছি, যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তুমি এমনভাবে ফুসে উঠেছ— এর তুলনা হয় না। আমি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়েছি, বাছা। তাই কিছু দিতে তোমাকে এখানে ডেকেছি। মৃতরা এবার জানবে, আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি।
‘আমি সাধারণ এক মানুষ, বড়মা,’ বলল রানা। ‘কেউ এখানে পাঠায়নি আমাকে। লুইযিয়ানায় এসেছি বন্ধুর বিয়ে খেতে। তবে পরে জানলাম এখানে বাঁশি বাজাবেন আমার প্রিয় এক বংশীবাদক। আর কোনও কারণে এখানে আসিনি আমি, আমাকে ফাঁদে ফেলা হয়েছে। ব্যাপারটাকে দুঃখজনক বলতে পারেন।
রানার কথা শুনে মাথা নাড়লেন এবি পামবো। তুমি জানো, বাছা। ….আর বাঁশি? ওটা তুমি ঠিকই শুনবে।’ নাক দিয়ে ঘোঁৎ আওয়াজ তুললেন বৃদ্ধা। ‘তবে মনে রেখো, তুমি এসেছ নিয়তির টানে। নির্ধারণ করা হয়েছে নোভাকদের মৃত্যুর দিনক্ষণ। আর এসব জানি বলেই তোমাকে ডেকেছি এখানে। কারণ, আমার জানা আছে এই মুহূর্তে ঠিক কে আছে নোভাকরা।’
ঝট করে এবি পামবোর দিকে তাকাল রানা। ‘কী বললেন, বড়মা? আপনি জানেন কোথায় ওদের নোভাক দ্বীপ?’
‘ওটাকে এখন লোকে বলে নোভাক দ্বীপ, তিক্ত সুরে বললেন বৃদ্ধা। তবে আগে অন্য নাম ছিল ওটার।’
‘একটু খুলে বলুন।’
পোশাকের বুকপকেট থেকে কোঁচকানো ভাঁজ করা একটা কাগজ নিয়ে ওটা রানার দিকে বাড়িয়ে দিলেন বৃদ্ধা।
কাগজটা নিয়ে ভাঁজ খুলল রানা।
‘কীভাবে ওখানে পৌঁছুবে, তা জানা কঠিন নয়,’ বললেন বৃদ্ধা
কাগজটা পুরনো আমলের কোনও মানচিত্র নয়। গুগল ম্যাপের স্যাটেলাইট ইমেজ। বহু ওপর থেকে তোলা। দেখলে মনে হবে অ্যামায়নের রেইনফরেস্ট।
আরও মনোযোগ দিতেই রানা দেখল, ম্যাপের পাশে ছোট সব নোটে লেখা কীভাবে ওখানে যেতে হবে। এ ছাড়া রয়েছে জিপিএস কোঅর্ডিনেট্স্।
‘ধন্যবাদ। কাজটা সহজ হয়ে গেল, বড়মা,’ বলল রানা। বাতাসে হাত নাড়লেন এবি পামবো। নিচু গলায় বললেন, ‘আমার ভাতিজা কমপিউটার নিয়ে কাজ করে। তার কাছ থেকেই পেয়েছি। কখনও ভাবিনি আধুনিক এসব টেকনোলজি আমার কাজে লাগবে।’
‘ডিরেকশন একদম নিখুঁত,’ বলল রানা। ‘ তবে মনে হচ্ছে, আপনি নিজেও কখনও ওই দ্বীপে গিয়েছিলেন। আমি কি ভুল বললাম?’
কুঁচকে গেল এবি পামবোর মুখ। ‘তা গেছি। তখন ছিল উনিশ শ’ তেত্রিশ সাল। আজও মনে হয় এই তো ক’দিন আগের কথা। ভয়ঙ্কর সব ঘটনা ঘটে শুনে আমরা ক’জন গিয়েছিলাম ওই দ্বীপ দেখতে। সেতু পেরোলাম চারজন মিলে। জঙ্গলে কিছুটা যাওয়ার পর মাত্র চোখে পড়েছে ইঁটের বাড়িটা, এমন সময় আত্মা উড়ে গেল আমার। জীবনে আগে কখনও এত ভয় পাইনি। কালো দাড়িওয়ালা বিশাল এক লোক তেড়ে এল বন্দুক হাতে। গুলিও করল। ওই লোক ছিল উইলকার ‘কিলার’ নোভাকের বাবা। পরে খুনের দায়ে তাকে গাছে ঝুলিয়ে দিয়েছিল কারা যেন। সে মরেছে বোধহয় আটচল্লিশ সালে। যাই হোক, প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে এলাম আমরা। তারপর শুনিনি ওই সেতু পার হয়ে অভিশপ্ত দ্বীপে পা রেখেছে কেউ। এমন কী কোনও শেরিফও ওদিকে যেত না।’
‘ওই দ্বীপ অভিশপ্ত বলে মনে করি না,’ বলল রানা।
‘তুমি নিজে না জেনে কিছুই মেনে নেবে না, তাই না, বাছা?’ হাসলেন এবি পামবো। বেরিয়ে এসেছে দাঁতহীন লালচে দুই পাটি মাড়ি। ‘তবে পরে সবই বুঝবে। এবার আরেকটা ব্যাপারে কথা বলব।’ ঢোলা জোব্বার অসংখ্য পকেটের ভেতর থেকে কাপড়ের তৈরি ছোট এক তাবিজ বের করলেন তিনি। ওটার সঙ্গে রয়েছে চামড়ার সুতলি। ‘এটা নাও, বাছা। কাজে লাগবে। এই জিনিস না থাকলে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারবে না ওই দ্বীপ থেকে।’
তাবিজটা নিল রানা। নরম সুরে জানতে চাইল, ‘এটা কীসের জন্যে, বড়মা?’
ওর বাহুতে হালকা চাপড় দিলেন বৃদ্ধা। ‘এটা গ্রিস-গ্রিস। মোজো ব্যাগ। তালিসমান বলতে পারো। ওটার ভেতর যেটা আছে, ওটাই রক্ষা করবে তোমাকে। অনেকটা সময় নিয়ে ওই মোজো ব্যাগের ওপর নিজের সব জাদু খাটিয়ে দিয়েছি। একবার গলায় পরার পর ওটা খুলবে না। ওটা থাকলে আর দানবরা ক্ষতি করতে পারবে না তোমার। তবে কাজ শেষ হলেই ফেলে দেবে বাইয়ুর পানিতে।’
যে চোখে চেয়ে আছেন এবি পামবো, রানা বুঝল বৃদ্ধাকে কষ্ট দিতে না চাইলে এখন গলায় কবচ না পরে উপায় নেই ওর। মাথা গলিয়ে বুকের ওপর মোজো ব্যাগ রাখল রানা। সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন শিরশিরে একটা অনুভূতি হলো ওর বুকের ভিতর। ব্যাপারটা পাগলামি বলে মনে হচ্ছে ওর। শার্টের নিচে কবচটা পাচার করে দিতেই দন্তহীন হাসি দিলেন বৃদ্ধা। ‘হ্যাঁ, এবার আর কেউ কোনও ক্ষতি করতে পারবে না তোমার।’
‘আমার জন্যে এত ভেবেছেন বলে আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, বড়মা,’ বলল রানা।
‘আমাকে ধন্যবাদ দিয়ো না, বাছা। আমি শুধু স্রষ্টার হয়ে সামান্য কাজ করেছি,’ বললেন বৃদ্ধা। ‘এবার ফিরব নিজের আস্তানায়।’
আবারও লাশবাহী গাড়ির কাছে ফিরল রানা ও এরি পামবো। বৃদ্ধাকে ভ্যানে তুলে দিল তিন দেহরক্ষী। কাজটা শেষ হতেই নিজের চাচাত ভাইয়ের গাড়িটা রানাকে দেখাল চার্লস। ‘আগের মত উঠে পড়ুন, রানা। আপনাকে পৌঁছে দেব আপনার গাড়ির কাছে।’
কফিনে উঠে ভ্যানের দিকে তাকাল রানা। ‘গুড বাই, বড়মা। আপনার মঙ্গল হোক।’
‘আমিও চাই মঙ্গল হোক তোমার, বাছা। গলা থেকে মোজো ব্যাগটা কিন্তু ভুলেও খুলবে না।’ রওনা হয়ে গেল বৃদ্ধার ভ্যান।
কফিনে রানা শুতেই বন্ধ হলো ডালা। কয়েক মুহূর্ত পর রওনা হয়ে গেল লাশবাহী গাড়ি।