1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৩৬

ছত্রিশ

পঞ্চাশ গজ দূরে সারি দিয়ে রাখা ট্রাফিক কোন্। বামের লেন-এ এক্সপ্লোরার ইন্টারসেপ্টর গাড়ি। দ্বিতীয় লেন জুড়ে দুটো ডজ চার্জার পারসুইট ভেহিকেল। লুইযিয়ানার প্রায়- ঘুমন্ত কোনও মোটরিস্ট ট্রাফিক কোন্ বা গাড়িগুলো না দেখলেও ধাতব হলদে সাইনে বড় করে লেখা: পুলিশ চেকপয়েন্ট দেখলে ধড়মড় করে জেগে উঠবে। গাড়ির কাছেই পাম্প-অ্যাকশন শটগান হাতে ক’জন পুলিশ অফিসার কারও কারও হাতে জ্বলন্ত সিগারেট বা কোকের খোলা ক্যান। প্রত্যেকের চেহারায় বিরক্তি। পুরো দুটো দিন পেরোলেও খোঁজ পাওয়া যায়নি ভয়ঙ্কর খুনি মাসুদ রানার। কোথায় গায়েব হলো লোকটা?

অবশ্য, এবার সময় ঘনিয়েছে সব বদলে যাওয়ার।

রোডব্লক এবং পুলিশ দেখেই রানা বুঝেছে, যত দ্রুত সম্ভব ভেগে যেতে হবে ওকে। ফায়ারবার্ডের গতি পঞ্চাশ মাইলে নামিয়ে হ্যাণ্ড ব্রেক টেনে গাড়িটা এক শ’ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে নিল রানা। কর্কশ আওয়াজে পুড়ল চাকার রাবার। ভুস্ করে আকাশে উঠল কালো ধোঁয়া। পরক্ষণে অ্যাক্সেলারেটর চেপে ধরল বিসিআই এজেন্ট।

হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল পুলিশ অফিসাররা। সিগারেট ও কোকের ক্যান ফেলে ঝটকা দিয়ে হোলস্টার থেকে আগ্নেয়াস্ত্র বের করেছে কেউ কেউ। রেডিয়োতে চিৎকার করে অন্য রোডব্লকের সহকর্মীদেরকে সতর্ক করছে দু’জন। লাফিয়ে দুই চার্জার গাড়িতে উঠতে গিয়ে রাস্তায় পিছলে পড়ল দুই অফিসার। আগেই গর্জে উঠেছে পেট্রল কারের ইঞ্জিন। গাড়ির মাথায় জ্বলছে উজ্জ্বল আলো। ওঁয়া-ওঁয়া আওয়াজে সাইরেন বাজিয়ে পণ্টিয়াক ফায়ারবার্ডের পিছু নিল অফিসাররা।

রিয়ার ভিউ মিররে গাড়ির হেডলাইট দেখছে রানা। মেঝের সঙ্গে মিশিয়ে দিল অ্যাক্সেলারেটর। ফায়ারবার্ড দ্রুতগামী হলেও, পুলিশ ইন্টারসেপ্টর ছুটতে পারে ঘণ্টায় দেড় শত মাইল বেগে। ওগুলোর ব্রেক আধুনিক, তেমনি গাড়ির ভারসাম্য। ফায়ারবার্ড গাড়ির ড্যাশবোর্ডে উঠছে নানান কাঁটা। বনেটের নিচে গর্জন ছাড়ছে ভি-এইট ইঞ্জিন। মুহূর্তে ছিটকে পিছনে পড়ছে সরু, কালো রাস্তা। রানা দেখল, পিছিয়ে পড়ছে পুলিশের গাড়িগুলো। তবে তা মাত্র ক’মুহূর্তের জন্যে, তারপর আবারও এগিয়ে আসতে লাগল হেডলাইটগুলো।

পুলিশ অফিসারদের দিকে রানা গুলি করলে খুন হবে ও নিজে। পুলিশ পেছনে ধাওয়া করছে, তাতে একমাত্র সুবিধা হচ্ছে, বাজে কোনও দল ওকে ধরতে আসবে না। নিজেদের প্রাণের ওপর হুমকি না এলে গুলি করার কথা নয় পুলিশ অফিসারদের।

অন্তত এমনই হওয়ার কথা। তবে মন্দ দিক হচ্ছে, বাজে কোনও দলের লোক এত শৃঙ্খলাবদ্ধ হয় না। রেডিয়ো করে বলেও দিতে পারে না, যেন আকাশ থেকে হেলিকপ্টার দিয়ে ধাওয়া দেয়া হয় রানাকে।

তার ওপর জায়গায় জায়গায় রোডব্লক করবে পুলিশ। রানা গ্রেফতার এড়াতে গেলেই বিপদ। গেলেই বিপদ। ডযনখানেক অফিসারের ফুল অটোমেটিক কারবাইন থেকে আসবে শতখানেক গুলি। ফলে মুহূর্তে খুন হবে ও।

যে-কোনও সময়ে সামনে পড়বে রোডব্লক। বা হয়তো ওদিক থেকে গাড়ি নিয়ে আসবে আরও একদল পুলিশ অফিসার। তবে কপাল ভাল হলে তাদেরকে এড়াতে পারবে রানা। আগেও বহুবার বিপদের সময় লুকিয়ে পড়েছে কোথাও না কোথাও।

নোভাকরা যে টিলা ও জঙ্গলে ডিসটিলারি করেছিল, সে জায়গা থেকে বহু দূরে সরে এসেছে রানা। চারপাশে এখন বিস্তৃত সমতল জমি বা জলাভূমি। কোথাও কোথাও ধানখেত বা লেক। ওখানে আছে শত শত সারস, বক, হাঁস ও রাজহাঁস। এখানে ওখানে একটা-দুটো চ্যাপ্টা তলীওয়ালা বোট ডোরি। বেশ কিছু মানুষ নিশ্চিন্তে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে এই গ্রাম্য পরিবেশে। তাদের ভাবতে হচ্ছে না, হাই পাওয়ার পারসুইট ভেহিকেলে চেপে ছুটে আসা সশস্ত্র একদল পুলিশের ব্যাপারে।

মন খারাপ হয়ে গেল রানার। যে অপরাধ করেনি, সেটার জন্যে ধাওয়া খাচ্ছে ও। একটু একটু করে এগিয়ে আসছে পুলিশের সুপার চার্জড় গাড়িগুলো। আরও জোরে যাওয়ার সাধ্য নেই এই চল্লিশোর্ধ্ব, প্রৌঢ় ফায়ারবার্ডের। এক শ’ বিশ মাইল বেগে চলতে গিয়ে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে ইঞ্জিন। রানা জানে, দেড় শ’ মাইল বেগে আরও কয়েক ঘণ্টা চলতে পারবে পুলিশের গাড়ি। অথচ তার অনেক আগেই ইঞ্জিন সিয হয়ে যাওয়ায় থামতে হবে ওকে।

এইমাত্র পেছনে পড়ল ধানখেত ও জলাভূমি। দু’দিকে চওড়া বাইয়ু। সামনে লোহার তৈরি বহু পুরনো একটা সেতু। ঝড়ের বেগে পিছিয়ে যাচ্ছে কালো রাজপথ। ওপরে উঠে সমতল হয়ে লোহার সেতুর সঙ্গে মিশল রাস্তা। তীরবেগে যেতে যেতে নিচে কাদাময় বাদামি বাইয়ু দেখল রানা।

সেতুর মাঝামাঝি গিয়েই টের পেল, সামনে গিজগিজ করছে সাদা-কালো সব গাড়ি। ওগুলোর ছাতে দপদপ করে জ্বলছে নীল বাতি। এখন আর সেতু থেকে নেমে যাওয়ার উপায় নেই! গাড়ির দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে গুলি করতে তৈরি একদল পুলিশ অফিসার! তাদেরকে বলা হয়েছে, খুনি মাসুদ রানা অত্যন্ত বিপজ্জনক লোক। তার সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র আছে।

এবার কী করবে, মুহূর্তে ভেবে নিল রানা।

ফায়ারবার্ডের মালিক হাম্পি-ডাম্পি খুব কষ্ট পাবে মনে!

গাড়ি চলছে এক শ’ বিশ মাইল বেগে। চট্ করে সিটবেল্ট আটকে নিল রানা। শান্ত হয়েছে মন। ভয়ানক বোকামির সময় বোধহয় এমনই করে বদ্ধ উন্মাদরা!

ব্রেক প্যাডেল মেঝেতে দাবিয়ে দিল রানা, সেইসঙ্গে বনবন করে ডানদিকে ঘোরাল স্টিয়ারিং হুইল। সাঁই করে ঘুরেই সেতুর ডানপাশের রেলিঙে চড়াও হলো ভারী ফায়ারবার্ড। প্রচণ্ড জোরে গুঁতো লাগতেই ছিটকে এগোতে চাইল রানা। তবে ওকে আটকে রাখল সিটবেল্ট। পুরনো গাড়িতে ড্রাইভার বা যাত্রীদের জন্যে এয়ারব্যাগ নেই। রানার মুখ চেপে ধরল না বাতাস ভরা বালিশ। উইণ্ডশিল্ড ভেঙে ভেতরে ঢুকল রেলিঙের অ্যালিউমিনিয়ামের ভাঙা টুকরো। মুহূর্তে মুড়ির টিনের মত মুচড়ে গেল গাড়ির ছাত। পরক্ষণে পৌরাণিক পাখি ফিনিক্সের মত আকাশে উড়াল দিল ফায়ারবার্ড। অবশ্য তা মাত্র দু-তিন সেকেণ্ডের জন্যে, তারপর জোরালো ধপাস্ শব্দে বাইয়ুর নিস্তরঙ্গ কাদাময় পানিতে নামল গাড়িটা।

মুহূর্তে রানার চোখের সামনে থেকে উধাও হলো শেষ- বিকেলের সোনালি রোদ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *