1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৫০

পঞ্চাশ

মাসুদ রানার গ্রেফতারের রিপোর্ট টিভিতে আসার পর বাড়ি থেকে বেরোয়নি রিচি নোভাক। রাগে জ্বলছে ওর ব্রহ্মতালু। এত পরিশ্রম করে লিয বাউয়ারের খুনের দায় লোকটার ঘাড়ে চাপিয়ে লাভ হলো না। গুবলেট হয়ে গেছে সব। তার ওপর, এবার হয়তো নিজেরাই মস্ত কোনও বিপদে জড়িয়ে পড়বে।

দ্রুত ভাবছে রিচি, কারাগারের বেশ ক’জন কয়েদির সঙ্গে তার পরিচয় আছে। খুশি মনে তার হয়ে কাজটা করবে তারা। জেলখানার ভেতর সহজেই শেষ করা যাবে মাসুদ রানাকে। বড় জোর খুনির কয়েদের মেয়াদ কিছুটা বাড়বে, ব্যস্…

সেক্ষেত্রে প্যাট্রিকের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেয়া গেলেও, নিজ হাতে লোকটাকে আর খুন করতে পারবে না সে। মনের ভেতর অতৃপ্তি বোধ করছে রিচি।

হঠাৎ টিভির দিকে নজর গেল তার। সাধারণ সং বিরতি দিয়ে জরুরি বার্তা দিচ্ছে সংবাদ পাঠিকা।

আর্মচেয়ারে বসে আছে রিচি। সামনে ঝুঁকল। পর্দায় দেখছে ভিলেনিউভ শহরের কোর্ট ভবন। ওখানে জড় হয়েছে একদল সাংবাদিক। ব্রিফ করছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। সামনে মাইক্রোফোন। অপ্রত্যাশিত খবরটা জানাল শেরিফ। ছেড়ে দেয়া হচ্ছে মাসুদ রানাকে। তার বিরুদ্ধে আর কোনও অভিযোগ নেই শেরিফ ডিপার্টমেন্টের। খুনের তদন্ত করবে তারা। যদিও এই মুহূর্তে সন্দেহজনক কোনও অপরাধী তাদের তালিকায় নেই। আর কোনও মন্তব্য না করেই আবারও কোর্ট ভবনে ঢুকে পড়ল শেরিফ।

টিভির পর্দার দিকে চেয়ে তৃপ্তির হাসি হাসল রিচি। ভাল, এখনও তা হলে সুযোগ আছে মাসুদ রানাকে মুঠোয় নেয়ার।

টিভি বন্ধ করে আর্মচেয়ার ছাড়ল রিচি। ফ্রিষ থেকে নিল এক বোতল রুট বিয়ার। তিক্ত এই পানীয় সেরা মনে হয় তার। কর্ক খুলে ঢকঢক করে গলায় বিয়ার ঢালল সে। অর্ধেক বিয়ার শেষ হতেই তার প্যান্টের পকেটে বাজল মোবাইল ফোন। ওটা বের করে কলার আইডি দেখল রিচি, তারপর রিসিভ করল কল। ‘বলো, শুনছি!’

কর্কশ আওয়াজে কথা বলছে এক লোক। মন দিয়ে শুনছে রিচি। সব শোনার পর ফোন অফ করে আবারও রেখে দিল প্যান্টের পকেটে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে ঢুকল ক্লাব হাউসে। শেষ দুপুরের গরমে দরদর করে ঘামছে সে। ক্লাব হাউসে পুল টেবিলের পাশে একা বসে আছে টিনাশে বব। টেবিলের সবুজ বেইযের ওপর ম্যাক-১০ সাবমেশিন গান। এরই ভেতর খুলেছে কিছু পার্ট। তেল ভরা একটা ন্যাকড়া দিয়ে ওগুলো মুছছে। গুলি করুক বা না করুক, প্রতিদিন এই একই কাজ করে সে।

‘হ্যাঙ্ককে দেখেছ?’ ক্লাব হাউসের দরজা থেকে জানতে চাইল রিচি।

নিজের কাজ বন্ধ করে চোখ তুলে তাকাল টিনাশে বব। ‘এখানে নেই। বোধহয় ওই কালো কুত্তী আর ওটার বাচ্চাগুলোকে নিয়ে গেছে পন্টুনে। অন্য ছেলেটাও ওখানে আছে… ওই যে সাদা চামড়ার। ওর জন্যে খারাপ লাগছে। একপাল বাঁদরের সঙ্গে মিশে বড় হচ্ছিল।’ বিরক্ত হয়ে মাথা নাড়ল টিনাশে বব। ‘বোঝো কী হাল আজ আমেরিকার!’

‘হ্যাঙ্ক পন্টুনে গেছে কেন?’ জানতে চাইল রিচি।

‘হয়তো একটু ব্যায়াম করবে,’ বোল্ট মেকানিযমে রয়ে যাওয়া সামান্য তেল কাপড় দিয়ে মুছল টিনাশে বব।

‘ও।’ যে লোককে নিজ হাতে বাউয়ি নাইফ দিয়ে ক্ষত- বিক্ষত করেছে, তার সঙ্গে বাড়তি কথা বলার আগ্রহ রিচির নেই।

ক্লাব হাউস থেকে বেরিয়ে উঠানে থামল রিচি। কোয়াড বাইক যেখানে থাকে, সেখানে এখন দুটো বাইক নেই। উধাও হয়েছে খাঁচার মত ছোট ট্রেইলার। তৃতীয় মোটরসাইকেলে চেপে ইঞ্জিন চালু করল রিচি। রুক্ষ ট্র্যাকে পড়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে চলল পুবে। ওদিকে দ্বীপটা ঢালু হয়ে নেমেছে গিয়ে বাইয়ুতে।

পল্টুনের কাছে যাওয়ার আগেই চিৎকার শুনল রিচি।

হ্যাঁ, ফুর্তির জন্যেই ওখানে গেছে হ্যাঙ্ক। ওর সঙ্গে আছে রেলি জ্যাকব। নিশ্চয়ই দু’জন মিলে নির্যাতন করছে বন্দিদেরকে। দড়ির ফাঁসে পিচ্চি মেয়েটাকে ঝুলিয়ে আটকে দিয়েছে কেবলের হুকে। বুম নিয়েছে বাইয়ুর ওপর। মেয়েটা আছে পানি থেকে দুই ফুট ওপরে। মরা এক হরিণের দেহ থেকে মাংস ছিঁড়ে বাইয়ুর ভেতর ফেলছে জ্যাকব। অ্যালিগেটর কিলবিল করছে বলে খলবলিয়ে উঠছে নিচের পানি। ভীষণ ভয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে টিনা। টানটান কেবল থেকে এদিক ওদিক দুলছে ওর ছোট্ট শরীরটা।

তীরে তিনটে গাছের কাণ্ডে বেঁধে রাখা হয়েছে এলিসা, রন আর রবকে। অসহায় চোখে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই এলিসার। ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়েছে সে। রবের গাল বেয়ে দরদর করে অশ্রু পড়ছে চিবুকে। বাপ-মা তুলে হ্যাঙ্ক আর জ্যাকবকে গালি দিচ্ছে রন।

কাওয়াসাকি মোটরসাইকেল থেকে নেমে পল্টুনে উঠল রিচি। ঘুরে ওকে দেখল হ্যাঙ্ক, মুখে চওড়া হাসি। আপাতত ভুলে গেছে ছোটভাইয়ের মৃত্যুর কষ্ট। এটাও মনে নেই যে হাতে গুলির জখমে টনটনে ব্যথা।

‘এসব বন্ধ করো, হ্যাঙ্ক,’ কড়া সুরে বলল রিচি। ‘আগেই বলেছি কাজ ফুরিয়ে গেলে ওদেরকে নিয়ে কী করব।’

‘অত রাগ কীসের, বড়ভাই? আমি তো শুধু একটু মজা করছি।’

‘আমরা কালো পাছাওয়ালা ছেমড়িকে টোপ হিসেবে ঝুলিয়ে দিয়েছি অ্যালিগেটরগুলোর জন্যে!’ বিশ্রী ভঙ্গিতে খ্যাক খ্যাক খ্যাক শব্দে হাসছে রেলি জ্যাকব।

‘লজ্জার কথা, এখনও পার্টিতে যোগ দেয়নি ওসাইরিস,‘ খিক খিক করে হাসল হ্যাঙ্ক। ‘বোধহয় মেয়ে অ্যালিগেটরের খোঁজে নদীতে গেছে।’

চোখ পড়তেই রিচি দেখল, তীরে একগাদা ডিক্সি বিয়ারের বোতল। চেহারা গম্ভীর করে বলল সে, ‘আমার মনে হয় যথেষ্ট ফুর্তি হয়েছে। জ্যাকব, জায়গামত নিয়ে যাও বন্দিদের। এদিকে জরুরি কিছু কথা সেরে নিই হ্যাঙ্কের সঙ্গে।’

‘ঠিক আছে, বস,’ খ্যাক-খেকে হাসি দিল রেলি জ্যাকব। রিচি নোভাকের চোখের চাহনি দেখেই বুঝেছে, সিরিয়াস কিছু নিয়ে ভাবছে সে। বুম ঘুরিয়ে পল্টুনের ওপর আনল জ্যাকব। হাতল ঘুরিয়ে টিনাকে নামাল কাঠের পুরনো মেঝেতে।

এতই ভয় পেয়েছে মেয়েটা, থরথর করে কাঁপছে। মুখ থেকে বেরোচ্ছে চাপা গোঙানি।

কেবলের হুক থেকে টিনাকে ছুটিয়ে খাঁচার মত ট্রেইলারে ভরল জ্যাকব। খাপ থেকে কা-বার ছোরা নিয়ে অন্য বন্দিদের হাত-পায়ের বাঁধন কাটল। ছোরা দেখিয়ে একে একে এলিসা, রন আর রবকে বাধ্য করল ট্রেইলারে উঠতে। এলিসা মানসিকভাবে এতই ভেঙে পড়েছে, প্রতিবাদের সাধ্য নেই। বিড়বিড় করে হ্যাঙ্ক আর জ্যাকবকে গালি দিচ্ছে রন। তবে জোর কয়েকটা চড় গালে পড়তেই চুপ হয়ে গেল সে।

টেইলারের দরজা বন্ধ করে তালা মারল জ্যাকব। ইঞ্জিন চালু করে কোয়াড বাইকে চেপে রওনা হলো, পেছনে চলল এবড়োখেবড়ো পথে ছোট্ট ট্রেইলার

কড়া চোখে হ্যাঙ্ককে দেখল রিচি। ‘কী ব্যাপার, হ্যাঙ্ক? তোমার মনে নেই কী বলেছি?’

‘মনে আছে। আমি তো কারও ক্ষতি করছিলাম না।

‘মৌজ করছিলে। কোনও দিকে খেয়াল ছিল না। এইমাত্র টিভিতে বলেছে, জেল থেকে মাসুদ রানাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে আর কোনও অভিযোগ নেই শেরিফের।’

‘কিন্তু…’

‘সে এখন মুক্ত বিহঙ্গের মতই স্বাধীন। সাংবাদিকদেরকে শেরিফ বলেছে, মাসুদ রানা খুন করেনি। তারা জানে না কুকীর্তিটা কে করেছে। তারা আরও তদন্ত করবে।’

নাক দিয়ে ঘোঁৎ আওয়াজ বের করল হ্যাঙ্ক। ‘মরুক শালারা। তার মানে আগের প্ল্যান মতই কাজ করব আমরা। তাই না?’

‘হ্যাঁ।’

‘তা হলে তো আমাদের ছেলেদেরকে পাঠাতে হবে। এন সার্কেল তো বহু দূরের পথ।’

মেঝোভাইকে দেখল রিচি। ‘ভুল বললে। ওরা রাস্তার দিকেই যাবে। তবে এন সার্কেলে নয়।’

ভুরু কুঁচকে ফেলল হ্যাঙ্ক। ‘এসব কী বলছ? আমরা না প্ল্যান করলাম এন সার্কেলে মাসুদ রানা পৌঁছে গেলে তাকে বন্দি করে এখানে আনব? তা না পারলে ছোরা দিয়ে মোরব্বা করে দেব মেয়েলোকটা আর কুকুরছানাগুলোকে? মাসুদ রানা যখন মুক্ত, তো আগের প্ল্যানই তো ভাল, তাই না?’

‘ভুল বলছ,’ বলল রিচি। ‘প্রথম থেকেই ওটা আমাদের প্ল্যান ছিল না।’

অবাক চোখে বড়ভাইকে দেখল হ্যাঙ্ক। ‘ছিল না?’

মাথা নাড়ল রিচি। ‘ওটা বলেছি মোটা ওই উকিলকে, যাতে সেটাই বলে মাসুদ রানাকে। কিন্তু আমরা কি গাধার বাচ্চা নাকি?’

‘তা হলে আমরা আসলে কী করব?’ চিন্তিত কণ্ঠে বলল হ্যাঙ্ক।

ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখল রিচি। ‘সহজ করে সব বুঝিয়ে বলছি। এন সার্কেলে যাবে না টিনাশে বব, রেলি জ্যাকব আর অন্যরা, কারণ নিজেই এখানে হাজির হবে মাসুদ রানা। বোকা নয় সে। কোথাও গিয়ে ধরা দিত না কোনভাবেই। উল্টো আমাদেরকে ফাঁদে ফেলত।’

‘তুমি জানলে কী করে?

‘কারণ, ওর জায়গায় আমি নিজে হলেও তা-ই করতাম, ‘ বলল রিচি। ‘নিজেকে চালাক মনে করে রানা। তবে জানে না আমি ওর চেয়েও আর এককাঠি সরেস।’

‘কী করবে সে?’

‘সোজা হাজির হবে এই দ্বীপে। যে-মুহূর্তে ছেলেদের পাঠাব এন সার্কেলে, কমে যাবে আমাদের লোকবল, সেই মুহূর্তে এখানে হামলা করবে সে।

‘একাই শেষ করব ওকে,’ গর্ব ভরে বলল হ্যাঙ্ক। ‘সে একা। কপালের জোরে পুড়িয়ে দিয়েছে ডিসটিলারি, আর তখন দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা গেছে প্যাট্রিক। তবে রানা যেটা করেছিল, সেটা চোরাগোপ্তা হামলা।’ এবার আর তা পারবে না। আমরা তৈরি থাকব। আসুক। বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেব শুয়োরটার।’

‘একা আসবে না, বলল রিচি। ‘সঙ্গে থাকবে একদল পুলিশ।’

‘কিন্তু পুলিশ ওকে সাহায্য করবে কেন? এটা তো যুক্তির কথা হলো না।’

‘যুক্তি আছে, হ্যাঙ্ক। জানতে চাইবে না কোথা থেকে জানলাম এসব?’

‘রিচি, তুমি তো সবসময় ভাব করো, যেন দুনিয়ার সবই জানো,’ বেজার হয়ে বলল হ্যাঙ্ক।

‘আসলে জানি না বহু কিছুই। তবে আমাদের চর সবই বলেছে আমাকে। একটু আগে ফোন করেছিল। তার কাছেই শুনলাম, রানা আর শেরিড্যান এখন একই হাঁড়ির ভাত খাচ্ছে। গোপনে এসে হামলা করবে। আমাদেরকে গ্রেফতার করবে খুন, কিডন্যাপিং আর অন্যান্য অভিযোগে। এত কিছু জানার উপায় ছিল না তাদের, তবে চোখ উল্টে ফেলেছে আমাদের প্রিয় ডেপুটি শেরিফ বিলি এস. কনরাড।’

‘শুয়োরের বাচ্চা! আজকাল দেখছি কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না! পচে গেছে দুনিয়া! তার মানে শেরিড্যান এখন জানে কারা খুন করেছে লিয বাউয়ারকে।’

‘এই তো বুঝতে শুরু করেছ, হ্যাঙ্ক।’

পন্টুন থেকে নেমে ধুলোয় লাথি ছুঁড়ল রিচির মেঝোভাই। ‘তা হলে তো মহাবিপদে পড়েছি দেখছি!’

‘তা ঠিক,’ বলল রিচি। ‘তবে আমাদের নয়, বিপদটা হবে ওদেরই। এসো, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *