1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ১৯

উনিশ

জোসেফ গুডরিচ বিদায় নেয়ার আধঘণ্টা পর খাবারের সুগন্ধ ভেসে এল বেডরুমে। বিশ ঘণ্টারও বেশি বিছানায় আছে বলে বিরক্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে পড়ল রানা। আড়মোড়া ভাঙতে গিয়ে টের পেল, পেটের পেশি আড়ষ্ট। তবে ব্যথা নেই বললেই চলে। রানা বুঝে গেল, ওকে যে পেইনকিলার দিয়েছে এলিসা গুডরিচ, সেটাই ঠিকঠাক কাজে দিয়েছে। কিন্তু… কিন্তু ওটা তো গরু-ছাগলের ওষুধ ছিল! তবে কী…! চট্ করে আয়নার দিকে চেয়ে নিশ্চিন্ত হলো রানা: নাহ্, ওকে মানুষের মতই লাগছে। চেয়ার থেকে ইস্তিরি করা পোশাক নিয়ে পরে ফেলল। ওর ব্যাগে ছিল বাড়তি জিন্সের প্যান্ট। তবে চেক শার্টটা ওর নয়। জোসেফ গুডরিচ যখন অর্ধেক সাইজের ছিল, সেসময়ে হয়তো পরত এটা। প্রায় নিখুঁতভাবেই রানার গায়ে ফিট করল শার্টটা।

ছোট্ট বেডরুম থেকে হল-এ বেরিয়ে ছোট এক কিচেনে পা রাখল রানা। হাঁড়ি ও প্যান নিয়ে রীতিমত যুদ্ধে নেমেছে জোসেফ গুডরিচ। তুবড়ে যাওয়া পুরনো এক চুলোর ওপর রাখা হাঁড়ি থেকে আসছে খাবারের সুঘ্রাণ। রানা কিচেনে পা রাখতেই বিশালদেহী উকিল বলল, ‘খিদে? লাগারই তো কথা। চেয়ার টেনে বসে পড়ো। তৈরি হয়ে গেছে স্টু।

জুতো কিনতে শহরে গিয়ে এখনও ফেরেনি এলিসা ও রব। কিচেনের টেবিলে আছে রন। লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত। খসখস করে অঙ্ক কষছে। কিশোর ছেলেটার মাথার একদিকে ব্যাণ্ডেজ। এ ছাড়া, তাকে বেশ তরতাজা বলেই মনে হলো রানার। মুখ তুলে ওকে দেখে হাসল ছেলেটা। ‘ধন্যবাদ দিয়ে আপনাকে ছোট করব না, স্যর। চিরকালের জন্যে কৃতজ্ঞ হয়ে গেছি।’

‘আমাকে রানা বলেই ডেকো, বুঝলে?’ চেয়ার টেনে বসল রানা। ‘আর আমিই বরং কৃতজ্ঞ তোমার বাবা-মার প্রতি। চিকিৎসা আর বিশ্রাম পেয়েছি, এখন খাবারও পাব।’ খাতার ওপর চোখ পড়তেই নাক কুঁচকে ফেলল রানা। ‘ওফ্, অ্যালজেব্রা?’

‘বাসায় বসেই লেখাপড়া করছে রন,’ বলল জোসেফ। হাঁড়ি থেকে বড় একটা বাটিতে স্টু ঢালল। ‘খামারের কাজের ফাঁকে ওকে পড়াই। এদিকে টাকা রোজগারের দায়িত্ব এলিসার। অঙ্ক আর ইংরেজিতে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ের চেয়ে এগিয়ে আছে রন। ওর ইচ্ছে, বড় হয়ে বিজ্ঞানী হবে। …ঠিক বললাম তো, নাকি, রন?’

কাঁধ ঝাঁকাল কিশোর ছেলেটা। ‘একদম ঠিক, বাবা!’

‘মন দিয়ে পড়াশোনা করলে সত্যিই তুমি একদিন মস্তবড় বিজ্ঞানী হবে,’ বলল রানা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। ঝলমল করছে সোনালি রোদ। একটু দূরে বার্নের ছাতে ঝিকিয়ে উঠে প্রতিফলিত হচ্ছে এক সারিতে সোলার প্যানেল। বার্নের ওদিকে বেড়া দেয়া শুয়োরের খোঁয়াড়। দরজায় বড় একটা তালা। কিচেনে চোখ বোলাল রানা। চার দেয়াল, মেঝে ও ছাত কমদামি প্লাইউডের। জোসেফের কাছে জানতে চাইল ও, ‘তুমি নিজে তৈরি করেছ এই বাড়ি?’

‘সবই আমার তৈরি,’ গর্বের সঙ্গে বলল জোসেফ গুডরিচ, ‘চেয়েছি শহর থেকে বহু দূরে নির্জন কোনও জায়গায় চলে যেতে। এমন জায়গা, যেখানে বিরক্ত করবে না ভদ্রলোকেরা। শেষপর্যন্ত এখানেই থিতু হয়েছি। তবে চিরকালের জন্যে নয়। সামনে যে বিপদ, সেটা এড়াতে হলে এ ছাড়া উপায়ও ছিল না।’

‘কী ধরনের বিপদ?’ জানতে চাইল রানা।

বাটির ভেতর চামচ দিয়ে রানার সামনে গরম স্টুর বাটি রাখল জোসেফ। নিচু গলায় বলল, ‘তোমরা হয়তো জানো না, যে-কোনও দিন গোটা আমেরিকা জুড়ে শুরু হবে দ্বিতীয় গৃহযুদ্ধ। বহু বছর ধরেই ঘনিয়ে আসছে ওই ঝড়। তবে ওই যুদ্ধের জন্যে এখানে আমরা তৈরি।’ উল্টোদিকের চেয়ারে বসল সে। ‘নাও, শুরু করো। বাড়ির মুরগি, মশলা, কাঁচা মরিচ আর শাকসব্জি দিয়ে তৈরি। বাড়ির রান্না আমিই করি। এই খাবারের নাম দিয়েছি গাম্বো আ লা গুডরিচ।

লিযের তৈরি গাম্বোর চেয়ে কম স্বাদের জোসেফের গাম্বো। তাতে আপত্তি নেই রানার। যেমন ভয়ানক খিদে লেগেছে, খুর ও দাঁতসহ জ্যান্ত পাহাড়ি ছাগল চিবিয়ে খেয়ে নেবে।

‘কেমন?’ রানা এক চামচ মুখে দিতেই জানতে চাইল জোসেফ।

‘দারুণ,’ চুপচাপ বাটি খালি করার কাজে ব্যস্ত হলো রানা। প্রায় শেষ করে এনেছে, এমন সময় বাইরে গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ পাওয়া গেল।

‘ওই যে, বাড়ি ফিরেছে এলিসা,’ বলল জোসেফ। ‘এসেই জানতে চাইবে ওর রোগী ভাল আছে কি না।’

‘খুবই ভাল আছি,’ বলল রানা।

চেয়ার ছেড়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে লিভিং রুমে এল ওরা। সামনেই বাড়ি থেকে বেরোবার দরজা। অজ্ঞান ছিল বলে চারপাশ দেখার সুযোগ হয়নি রানার। এবার দেখল, দেয়ালে ঝুলছে যুদ্ধকালীন কনফেডারেটদের বড় একটা লাল পতাকা। লাল পটভূমির ওপর কোনাকুনি নীল ফিতার মত কাপড়ে সেলাই করা হয়েছে তেরোটা সাদা নক্ষত্র। ওই দুই ফিতা তৈরি করেছে বড় একটা এক্স আকৃতি। ডিক্সিল্যাণ্ডের সিম্বল। ওটা দিয়েই বোঝানো হয় দক্ষিণের বিদ্রোহ। ওগুলো আসলে আধুনিক সময়ে তার চেয়েও অনেক বেশি কিছু।

মস্ত পতাকা দেখে কিছু বলবে রানা, এমন সময় খুলে গেল সদর দরজা। ভেতরে ঢুকল এলিসা ও রব। পিচ্চির হাতে এখন স্যাণ্ডেলের চকচকে রাক্স। খুশিতে ঝিকমিক করছে ওর দুই চোখ। পিছু নিয়ে ঘরে ঢুকল রবের ছোট বোন। ওর বয়স বড়জোর তিন।

রানাকে দেখে মিষ্টি হাসল এলিসা গুডরিচ। আর এই ভদ্রমহিলার নাম টিনা গুডরিচ। টিনা, আমাদের অতিথিকে হ্যালো বলো। তোমার বড় ভাইয়াকে সাপের ছোবল থেকে বাঁচিয়েছেন তিনি।

লজ্জা ভরা মুখে আস্তে করে হাত নাড়ল খুদে টিনা।

‘বাচ্চারা, তোমরা গিয়ে বাইরে খেলো গে যাও, একটু পর আসবে মামা,’ বাচ্চাদেরকে উঠান দেখাল এলিসা। ওরা চলে যেতেই রানার দিকে ফিরল সে। ‘উঠে দাঁড়াতে পেরেছ দেখে ভাল লাগছে।’

মৃদু হাসল রানা। ‘এত ভাল নার্স পেলে রোগীর তো শুয়ে থাকার কথা নয়।’

কথাটা উড়িয়ে দিয়ে হাত নাড়ল এলিসা গুডরিচ।

‘আমি সত্যিই কাউকে খুন করিনি,’ বলল রানা। ‘নিজে মরে গেলেও ক্ষতি করতাম না লিয়ের।

‘তা আমি জানি,’ বলল মহিলা।

‘তুমি চাইলে খুলে বলতে পারি কী ঘটেছে।’

‘লাগবে না,’ দৃঢ়কণ্ঠে বলল এলিসা, ‘যত দিন ইচ্ছে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারো, মিস্টার রানা।’

‘যত দ্রুত সম্ভব চলে যাব।’

‘যেতে চাইলে ঠেকাব না। তবে আপাতত এখানে রয়ে যাওয়াই বোধহয় ভাল।’

কিচেনের টেবিল ছয়জনের জন্যে ছোট বলে দুপুরে লাঞ্চ দেয়া হলো লিভিংরুমের টেবিলে। রানাকে ডেকে আনা হলো ওখানে। খুশি মনে মুরগির স্বাস্থ্যকর স্টু খেল রানা।

সবার সামনে খাবার দেয়ার পর পুতুলের মত ছোট্ট টিনার দিকে তাকাল এলিসা। ‘টিনা, এইবেলা খাবার খেতে পাচ্ছি বলে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার পালা তোমার।

ভুরু কুঁচকে চোখ বুজল পিচ্চি। ছোট্ট দু’হাত মুঠো করে বলল:

‘সুন্দর এই দুনিয়ায়
সুবাস ছড়ায় ফুল, পাখি গান গায়;
তোমারই দয়ায়, প্ৰভু,
তোমারই দয়ায় ॥
দু’বেলা পাচ্ছি আহার
মিষ্টি আদর মা-বাবার
তোমারই দয়ায়, প্ৰভু,
তোমারই দয়ায় ॥’

‘আমেন,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল জোসেফ গুডরিচ।

টিনার বাহু স্পর্শ করল এলিসা। ‘সুন্দর বলেছ, মা!’

শহরে যা ঘটেছে, তারপরেও এ পরিবার এত সহজভাবে ওকে গ্রহণ করেছে, ভাবতে গিয়ে বিস্মিত বোধ করছে রানা।

‘আজও কি চার্চে যাও, রানা?’ সবাই খেতে শুরু করলে জানতে চাইল এলিসা।

সামান্য অস্বস্তি নিয়ে বলল রানা, ‘আমি জন্ম নিয়েছি বাংলাদেশের এক মুসলিম পরিবারে।’

‘চার্চ, মন্দির, প্যাগোডা বা মসজিদের চেয়েও বড় জায়গা মানুষের অন্তর,’ বলল জোসেফ। ‘তুমি সৎ কি না, সেটাই ওখানে উঁকি দিয়ে দেখে যান ঈশ্বরের দূত।’

‘স্রষ্টা তো আছেনই,’ বলল এলিসা, ‘দেখভাল করছেন। পৃথিবীতে শেষ দিনটা পর্যন্ত তিনিই সাহায্য করেন আমাদেরকে। তুমিও সবার বাইরে নও। তোমাকে কখনও ত্যাগ করেননি ঈশ্বর। নইলে বহু আগেই পৃথিবী ছাড়তে।’ মৃদু হাসল এলিসা।

চুপচাপ চামচে তুলে স্টু খাচ্ছে রানা। ভাবছে: এই একই কথা বলেছিল লিয।

‘ওটা দেখছিলে,’ দেয়ালে ঝুলন্ত কনফেডারেট পতাকা দেখাল জোসেফ, ‘তোমার কোনও আপত্তি আছে ওই পতাকার বিষয়ে?’

‘না,’ স্টু ভরা চামচ বাটিতে রাখল রানা, তবে ভাবছিলাম।’

‘নিশ্চয়ই ভেবেছ, ডিক্সি পতাকা যার বাসায়, সেই শ্বেতাঙ্গ লোকের স্ত্রী কৃষ্ণাঙ্গিনী হয় কী করে? রানা, আমি আসলে দক্ষিণের মানুষ। এই দক্ষিণকে নিয়ে গর্ব করি। তাই বলে হারামজাদা বর্ণবাদী তো আর হয়ে যাইনি!’

‘খাওয়ার সময় গালমন্দ থাক,’ মানা করল এলিসা।

‘থাকবে কেন?’ জেদি সুরে বলল জোসেফ।

‘আমি ধরে নিইনি যে তুমি বর্ণবাদী,’ বলল রানা।

‘ভাবলেও অবাক হতাম না,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল জোসেফ, ‘লিবারাল বা উদারপন্থীরা এই পতাকা দেখলেই আঁৎকে ওঠে। এটা যেন নাযিদের সেই স্বস্তিকার মত ঘৃণ্য। আর দক্ষিণের সবাই খুনি, ডাকাত, চোর আর অমানুষ। উত্তরের নাকউঁচু নেমকহারামদের ধারণা আমাদেরকে পাঠিয়ে দেয়া উচিত জেলখানায়, নয়তো নরকে।’

‘খেতে বসে কোনও গালাগালি চলবে না,’ কড়া চোখে স্বামীকে দেখল এলিসা।

হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে হাসতে লাগল রব আর তবে গম্ভীর চেহারায় খাবার গিলছে রন। রানা বুঝে গেল, এসব আগেও শুনেছে ছেলেটা।

‘সত্যিই মনে করো আমেরিকায় আবারও গৃহযুদ্ধ হবে?’ কৌতূহল নিয়ে জানতে চাইল রানা।

দু’বার ওপর-নিচ মাথা দোলাল জোসেফ। ‘অন্তর থেকে তা-ই বিশ্বাস করি।’

‘কিন্তু কেন বিশ্বাস করো?’

‘জানতে চাইছ? ওই একই কারণে প্রথমবার ইউনিয়ান থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল দক্ষিণের স্টেটগুলো। দানবের মত সরকার ঘাড়ে চেপে বসলে যা হয়। মানুষের বাঁচার কোনও অধিকার ছিল না।’

‘আমি তো জানতাম উত্তর আর দক্ষিণের রাজ্যের লড়াই হয়েছিল দাসত্ব ইত্য নিয়ে,’ বলল রানা, ‘দক্ষিণের মানুষ চেয়েছে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে ক্রীতদাস বানিয়ে রাখতে। আর উত্তরের ওরা চেয়েছে তাদেরকে মুক্তি দিতে। ইতিহাসের বইয়ে সেটাই পড়েছি।’

‘ইতিহাস? হ্যাঁ, ওসব বইয়ে তাই লেখা আছে,’ সায় দিল জোসেফ, ‘প্রচুর টাকা খেয়ে ইতিহাস গোপন করতে গিয়ে অর্ধসত্য লিখেছে নামকরা সব পণ্ডিত।’ কাঁটাচামচ তাক করে পতাকা দেখাল সে। ‘একটা কথা পরিষ্কার জেনে নাও- বর্ণবাদের কিছুই ছিল না কনফেডারেশনে। আর শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের জন্যে তৈরি হয়নি ওই পতাকা। তবে গণ্ডারের মত কিছু লোক যা খুশি ভাবত। আগেও এ ধরনের শুয়োরের বাচ্চা ছিল, এখনও আছে।’

‘আগেই বলেছি গালাগালি চলবে না,’ বিরক্ত হয়ে বলল এলিসা। ‘তুমি বাচ্চাদের মাথা খাচ্ছ।’

বাবা-মার লড়াই উপভোগ করছে বাচ্চারা।

‘সরি, ডার্লিং, গলা নিচু করল জোসেফ। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘এসব উদারপন্থী ইতিহাসবিদদের বড় সমস্যা ছিল, সব জেনেশুনেও সত্য গোপন করেছে তারা। জোর করে বলতে চেয়েছে, দুই পক্ষে যুদ্ধ হয়েছে শুধু দাস প্রথার কারণে। এ যুগে ওই একই দল এখন বলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন করার মত রাসায়নিক অস্ত্র ইরাকের কাছে ছিল বলেই ওই দেশে হামলা করেছে আমেরিকা। কিন্তু ওই কথা প্রথম থেকেই চরম মিথ্যা ছিল। রানা, তুমি তো আর্মি অফিসার ছিলে। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ সম্পদ লুঠ করতেই ওই দেশে হামলা করে জর্জ বুশের চোদ্দ গুষ্টি।’

‘এটা জানি, কখনও কখনও নিজেদের স্বার্থের জন্যে গোপন করা হয় যুদ্ধের আসল কারণ,’ বলল রানা।

‘আপনি সত্যিই মিলিটারি অফিসার ছিলেন?’ জানতে চাইল রন। উত্তেজনায় চকচক করছে চোখ। ‘আপনি কি মানুষ খুন করেছেন?’

‘এসব কথা চলবে না,’ শাসনের সুরে বলল এলিসা।

মুখের স্টু শেষ করল জোসেফ। ‘আমিও সেটাই বলছি: গৃহযুদ্ধের আসল কারণ অন্যখানে ছিল। আর সেজন্যেই দক্ষিণের মানুষ ওটাকে সিভিল ওঅর বলতে রাজি নয়। আমরা সবাই বলি: চরম লজ্জাজনকভাবে আমাদের ওপর আগ্রাসন চালিয়েছে উত্তরের রাজ্যগুলো। দক্ষিণ সবসময় ছিল কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর ওদিকে প্রকৃতির সর্বনাশ হবে জেনেও লাখ লাখ কারখানা করেছিল উত্তরের রাজ্যগুলোর ক্ষমতাশালী লোকেরা। ওরা হয়ে উঠেছিল ভীষণ লোভী। আর মেলা টাকা হতেই তারা চাইল আমাদের মত সাধারণ মানুষকে পরাধীন করতে। টাকার জোরে কেড়ে নিতে চাইল দেশের ক্ষমতা। এই পৃথিবীর নানান দেশে আগেও এমন হয়েছে, ভবিষ্যতেও হবে।’

গৃহযুদ্ধ নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে জোসেফ গুডরিচ, বুঝে গেছে রানা। তবে না বলে পারল না, ‘একমিনিট, জোসেফ। এটা তো অস্বীকার করতে পারবে না, এদিকের রাজ্যের কৃষিকাজ সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল ক্রীতদাসদের ওপর। ওই চরম অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন।’ কথাটা বলেই রানা বুঝল, রাগিয়ে দিয়েছে গর্বিত এক দেশপ্রেমী বিদ্রোহীকে।

মাথা পেছনে হেলিয়ে গলা ছেড়ে হো-হো করে হেসে উঠল জোসেফ গুডরিচ। কণ্ঠে টিটকারি নিয়ে বলল, ‘ও, তুমি বলছ আমেরিকার ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বাটপারিটার কথা? তোমার ধারণা লিঙ্কন ছিল একজন উদারপন্থী? অত্যাচারিত কৃষ্ণাঙ্গদের ত্রাতা?’ নাক দিয়ে ঘোঁৎ শব্দ ছাড়ল সে। ‘প্লিয, হাসিয়ে মেরো না আমাকে, হাসতে গিয়ে খুন হয়ে যাব! তার প্রতিপক্ষ জেফারসন ডেভিসের চেয়ে একতিল ভাল ছিল না লিঙ্কন। এতই যদি কৃষ্ণাঙ্গদের জন্যে চোখের পানিতে বুক ভাসবে তার, তাহলে কেন্টাকি, মিসৌরি, ডেলাওয়্যার আর মেরিল্যাণ্ডের সৈনিকদেরকে কী কারণে ইউনিয়ান আর্মিতে নিল সে? ওরা তো ক্রীতদাসদের মুক্তি দেয়নি? …না, রানা, কখনওই উদারপন্থী ছিল না লিঙ্কন। ওই সুবিধাবাদী জঘন্য লোকটার বক্তব্য শুনবে? ওর মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে কথাগুলো: ‘ক্রীতদাসদের মুক্ত না করে ইউনিয়ান টিকিয়ে রাখা গেলে তা-ই করতাম। আবার সমস্ত কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসকে মুক্ত করে ইউনিয়ান রক্ষা করা গেলেও আমি তা-ই করতাম। কিছু ক্রীতদাসকে মুক্তি দিয়ে এবং অন্যদেরকে ক্রীতদাস হিসেবে রেখেও ইউনিয়ান বজায় থাকলে, তাতেই রাজি হতাম।’

‘লিঙ্কন নিজে এই কথা বলেছেন?’ হাঁ হয়ে গেল রন।

‘হ্যাঁ, বাপ, এই কথাই বলেছিল সে। আরও বলেছে: কৃষ্ণাঙ্গদেরকে সমান অধিকার দেয়া অনুচিত। সাদারা কালোদেরকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে ছিল লিঙ্কন। কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটের অধিকার দেয়ার ব্যাপারেও আপত্তি ছিল তার। তবে কালোরা ইউনিয়ান আর্মির হয়ে যুদ্ধ করলে, তখন অন্যকথা। সোজা কথায়: উত্তরের আর্মির হয়ে লড়লে মানুষ হিসেবে গণ্য করা হবে কালোদেরকে। ওই শঠ লোকটা এমন কী নিজের রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে রাখতে চায়নি। তার ধারণা হয়েছিল, একই জমিতে বাস করতে পারবে না কালো আর সাদারা। তার লিখিত আঠারো শ’ বাষট্টি সালের ইম্যানসিপেশন প্রোক্লেইমেশন-এ চরমভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল বর্ণবিদ্বেষ। তার ইচ্ছে ছিল, আবারও জাহাজে তুলে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে পাঠিয়ে দেবে আফ্রিকায়। কিন্তু পরে দেখল তা সম্ভব নয়। তখন চাইল লাখ লাখ কালো মানুষকে দক্ষিণ আমেরিকায় পাঠিয়ে দিতে। যাতে স্প্যানিশদের গুলি খেয়ে মরে তারা।’

আফসোস নিয়ে মাথা নাড়ল জোসেফ। এবার আসি তার খোদ ইম্যানসিপেশন প্রোক্লেইমেশনের বিষয়ে। স্পষ্টভাবে ওখানে লেখা: উত্তরের রাজ্যের ক্রীতদাসদেরকে মুক্তি দেয়া হবে না। আঠারো শত ষাট সালের জনসংখ্যার জরিপ অনুযায়ী উত্তরের রাজ্যে ছিল পাঁচ লাখ কৃষ্ণাঙ্গ। কিন্তু বলে দেয়া হলো, শুধু বিদ্রোহী রাজ্যগুলোর ক্রীতদাসদেরকে মুক্ত করা হবে। কেন রে, বাবা? দক্ষিণের রাজ্যে তো ছিল আলাদা সরকার, আলাদা প্রেসিডেন্ট। লিঙ্কনের তো কোনও অধিকারই ছিল না গায়ের জোরে আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার। আসলে ওই বেজন্মা, চতুর শুয়োরের বাচ্চা ভাল করেই জানত, নিজ স্বার্থে ফাঁকা বুলি আওড়াচ্ছে সে। বাস্তবে চেয়েছিল দক্ষিণের লাখ লাখ ক্রীতদাস যেন দলে দলে যোগ দেয় ইউনিয়ান আর্মিতে। গোটা ব্যাপারটা ছিল তার তরফ থেকে চরম বাটপারির সম্যক প্রমাণ।’

আগে কখনও কারও মুখে এসব শোনেনি রানা। এলিসার দিকে চাইতেই মৃদু মাথা দোলাল সে। ‘কথা একদম ঠিক।’

উৎসাহের সঙ্গে বলল জোসেফ, ‘আজকাল, দাসত্বের কথা শুনলে নাক কুঁচকে ফেলে ইংরেজরা। অথচ ওদের গোটা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য গড়ে ওঠার ভিত্তি ছিল ক্রীতদাস ব্যবসা লাখ-লাখ কালো মানুষকে আফ্রিকা থেকে ধরে এনে দুনিয়ার নানান ব্রিটিশ বন্দরে চালান দিত ইংরেজরা। শুধু সতেরো শ’ বিরানব্বুই সালেই দু’শ’র বেশি জাহাজ ভর্তি করে হাজার হাজার ক্রীতদাসকে সরিয়ে নিয়ে বিক্রি করে ব্রিটিশরা। ইংরেজদের চেয়ে আরেক কাঠি সরেস ছিল ফ্রেঞ্চরা। আঠারো শতকে আফ্রিকা থেকে এনে প্রতি সের হিসেবে েেমপে লুইযিয়ানায় কৃষ্ণাঙ্গদেরকে বিক্রি করে তারা। ওদিকে নানান এলাকা থেকে এ রাজ্যে যারা বসতি করেছে, তারা কিন্তু একজন ক্রীতদাসকেও এখানে আমদানি করেনি। কী বুঝলে, রানা? শ্বেতাঙ্গরা এ রাজ্যের মালিক হওয়ার আগেই এখানে ছিল ক্রীতদাসরা। আমরা তো আর তাদেরকে না খাইয়ে মেরে ফেলতে পারতাম না, তা-ই না? শ্বেতাঙ্গদের কাছে ব্যাপারটা ছিল ঘুমন্ত বাঘের লেজ দিয়ে কান চুলকে নেয়ার মত। সময় পেলে দক্ষিণের শ্বেতাঙ্গরাও মুক্ত করত কৃষ্ণাঙ্গদেরকে। গৃহযুদ্ধের আগের দশকে কমে গিয়েছিল ক্রীতদাস বিক্রি। তবে এ কথা ভুলেও লেখা হবে না উত্তরের রাজ্যগুলোর ইতিহাসের বইয়ে।’

‘যথেষ্ট,’ স্বামীকে থামাতে চাইল এলিসা। ‘অতীত মানেই আগেকালের কথা। এখন বড় বড় লেকচার মেরে তা বদলে দেয়া যাবে না। আরেকটা কথা শুনে নাও, জোসেফ গুডরিচ, আবারও যদি শুনেছি এই নিষ্পাপ, মাসুম বাচ্চাদের সামনে গালাগালি দিচ্ছ, আমার সামনের এই সসপ্যান দিয়ে বাড়ি মেরে মাথাটা ফাটিয়ে দেব তোমার! এ-ও ভুলে গেছ, ফালতু সব বাজে কথা বকছ অতিথির সামনে!’

নিষ্পাপ বাচ্চারা এককান থেকে আরেক কানে ঠোঁটের প্রান্ত পাঠিয়ে খিকখিক করে হাসছে। স্টু মুখে দিয়ে বিষম খেল রব। নাকের ফুটো দিয়ে বেরোল স্টুর হলদে ঝোল।

এদিকে জোসেফের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেছে রানা।

স্ত্রী সসপ্যান দিয়ে তার মাথা ফাটাবে শুনে বোকা-বোকা চেহারা করল জোসেফ। চুপ হয়ে গেল প্রাণের ভয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *