1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৪২

বেয়াল্লিশ

গতকাল হাতের মুঠোয় মাসুদ রানাকে পেয়েও শেষে হারিয়ে ফেলে ভীষণ তিক্ত হয়েছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যানের মন। রাতে বাড়ি ফিরে ঘুমাতে পারেনি। বারবার ভেবেছে: আসলেই কি মানুষ ওই লোকটা, নাকি ভয়ানক কোনও প্রেতাত্মা? সেতুর ওপর শত শত পুলিশের চোখের সামনে থেকে কীভাবে উধাও হয় সে!

আজ নিজ চোখে শেরিড্যান দেখেছে, বাইয়ুর তলা থেকে তোলা হয়েছে মুচড়ে যাওয়া ফায়ারবার্ড গাড়িটা। তবে ওটার ভেতর মাসুদ রানার লাশ ছিল না। সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে কী করবে ভাবছে শেরিফ, এমন সময় শহর থেকে রেডিয়ো করল ডেস্ক সার্জেন্ট। ‘স্যর, আপনাকে এখনই চাই! এঁরা খুব নার্ভাস হয়ে উঠেছেন। মনে হয় না বেশিক্ষণ আটকে রাখতে পারব।’

‘কাদের কথা বলছ?’ বিরক্ত হয়ে জানতে চাইল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।

‘ডেসমণ্ড আর রোণ্ডা ম্যালয়। কয়েক বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ, চিনি। তবে পরিচয় নেই।’ নিজের কাজের কারণে ক্লোভিস প্যারিশের প্রায় সবাইকে চেনে শেরিফ শেরিড্যান। ‘কাডাহাডাচো ক্রিকের কাছে থাকে। কী চায় তারা?

‘খুলে বলছেন না কিছুই, শেরিফ। আমাকে শুধু বলেছেন ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্যেই নিজেরা হাজির হয়েছেন শেরিফের ডিপার্টমেন্টে। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তাঁদের সঙ্গে কথা বললে ঠকবেন না আপনি।’

ঝড়ের বেগে গাড়ি চালিয়ে পঞ্চাশ মিনিটের ভেতর নিজের অফিসে ফিরল শেরিড্যান। তার জন্যে অপেক্ষা করছে ডেস্ক সার্জেন্ট ট্যালন। ছোট্ট ইন্টারভিউ অফিসে কাগজের কাপে চা হাতে বসে আছেন ডেসমণ্ড ম্যালয় আর তাঁর স্ত্রী। শেরিফ ভেতরে গিয়ে হ্যাণ্ডশেক করল তাঁদের সঙ্গে। নরম সুরে বলল, ‘মিস্টার অ্যাণ্ড মিসেস ম্যালয়, একটু খুলে বলুন কী জন্যে দেখা করতে চেয়েছেন।’

‘না এসে পারিনি,’ নার্ভাস সুরে বললেন মিস্টার ম্যালয়। ‘গত পুরো দু’দিন নিজেরা আলাপ করেছি আমরা। বুঝতে পারছিলাম না কী করব। এখনও কেমন যেন বেশ ধোঁয়াশা লাগছে সব।’

মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল শেরিডান, ‘বলুন, কী বলতে চান?’

দরদর করে ঘামছেন মিসেস ম্যালয়। ভুরু থেকে ঘাম ঝেড়ে ফেলে বললেন, ‘আমরা ঈশ্বর-ভক্ত মানুষ, শেরিফ। কোনও দিনও কোনও বন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করিনি। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেল।’

শেরিফ স্যাম শেরিড্যান বুঝল, উৎসাহ দিয়ে বুড়ো-বুড়ির পেট থেকে খবরটা বের করতে হবে। নিজের সেরা হাসিটা দিল সে। কোমল সুরে বলল, ‘ঠিক আছে, তাড়াহুড়ো করে কিছুই বলতে হবে না আপনাদেরকে। আরাম করে বসুন। মনের ভেতর সব গুছিয়ে নেয়ার পর আমাকে সব খুলে বলুন।’

ক’মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন মিস্টার ম্যালয়, তারপর বললেন, ‘ব্যাপারটা গুডরিচদের ব্যাপারে। ওরা আমাদের প্রতিবেশী।’

চট্ করে গুডরিচদেরকে চিনল শেরিড্যান। ‘গুডরিচ? ও, হ্যাঁ, ওদিকেই থাকে জোসেফ গুডরিচ। আমার ভুল না হলে কৃষ্ণাঙ্গিনী এক মেয়েকে বিয়ে করেছে সে। মেয়েটার নাম বোধহয়… এলি?’

‘এলিসা, শুধরে দিলেন রোণ্ডা ম্যালয়।

আস্তে করে মাথা দোলাল শেরিড্যান। ধৈর্য ধরতে গিয়ে ক্লান্ত বোধ করছে।

‘ওদের দুটো বাচ্চা আছে,’ বলল মহিলা। ‘রব আর টিনা। এ ছাড়া, আছে প্রথম পক্ষের সন্তান রন।’

‘জোসেফ গুডরিচের প্রথম বিয়ের ব্যাপারে কিছু কথা মনে পড়েছে আমার,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেরিড্যান। ‘তবে এসবের ভেতর তো কোনও ধরনের ঝামেলা দেখছি না।

‘গুডরিচদের বাচ্চাদের প্রাণের চেয়েও ভালবাসি আ বললেন ডেসমও ম্যালয়। ‘আমাদের নিজেদের তো আর বাচ্চা হয়নি। বিশেষ করে ওই পিচ্চি টিনাকে সত্যি খুবই ভালবাসি। মাঝে মাঝে গুডরিচরা দূরে কোথাও গেলে আমাদের বাড়িতে কয়েক ঘণ্টার জন্যে ওদেরকে রেখে যায়। – সময়টা দারুণ কাটে আমাদের। কিন্তু গত দু’তিন দিন হলো অন্তত দু’বার বাচ্চাদেরকে আমাদের কাছে রেখে গেছে গুডরিচরা। আর…’

‘তাতে আমাদের আপত্তিও নেই,’ বললেন রোণ্ডা। ‘তবে…’

‘সমস্যা হচ্ছে অন্যখানে,’ বললেন ডেসমণ্ড।

মাথা দোলালেন তাঁর স্ত্রী। ‘গত দু’রাত আগে আর্লি ডিনারের সময় পিচ্চি টিনা বলল অদ্ভুত একটা কথা…’

‘অদ্ভুত?’ বিরক্তি চেপে জানতে চাইল শেরিড্যান। মনে হচ্ছে, রিভলভারটা বের করে হুমকি দেয়: ‘যা বলার জলদি! নইলে কিন্তু এই গুলি করলাম!’

ঘন ঘন মাথা দোলালেন রোণ্ডা। ‘হ্যাঁ, শেরিফ, বড় অদ্ভুত কথা বলল মেয়েটা।’

‘কী বলেছে ও?’

‘বলল ওদের বাড়িতে উঠেছে অচেনা এক লোক।’

ভুরু কুঁচকে সামনে ঝুঁকল শেরিড্যান। ‘একটা লোক? কী ধরনের লোক সে?’

‘অতিথি। উচ্চারণ ইংরেজদের মত। বোধহয় এসেছে ইংল্যাণ্ড থেকে।’

‘টিনা ওই কথাটা বলতেই ওকে ধমক দিল ওর বড় ভাই রন,’ বললেন ডেসমণ্ড: ‘টিনা, তোমাকে না বলা হয়েছে তাঁর কথা কাউকে বলা যাবে না।’

মাথা দোলালেন রোণ্ডা। ‘টিনা বলল, ‘তাই তো! তবে উনিই কিন্তু তোমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন সাপের কামড় থেকে! ওই যে ক্রিকে মাছ ধরতে গেলে সাপ কামড়ে দিয়েছিল… তখন!’

‘সাপ আর ক্রিকের কথা আপাতত থাকুক,’ চাপা স্বরে বলল শেরিড্যান। পুরো ঘটনা জানতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। ‘ওই লোকের কথাই বলুন। তার সম্পর্কে আর কিছু বলেছে ছেলেমেয়েরা? নাম কি তার? ক’দিন ধরে ওখানে আছে সে?’

‘মনে পড়ছে না যে ওরা লোকটার নাম বলেছে,’ মাথা চুলকে নিয়ে বললেন ডেসমণ্ড। ‘ক’দিন ধরে আছে, তা-ও জানি না। তবে আমাদের মনে হয়েছে, গত ক’দিন কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে গুডরিচরা। ছেলেমেয়েদেরকে আমাদের বাড়িতে নামিয়ে দিয়েই চলে যাচ্ছে। প্রায় কোনও কথাই বলছে না। অথচ, আগে জানিয়ে যেত কোথায় যাচ্ছে বা কতক্ষণ পর ফিরবে। তাতে আমাদের কোনও সমস্যা নেই। তবে শেষবার অনেক রাত করে বাড়ি ফিরল তারা। বাচ্চারাও জানত না কখন ফিরবে তারা।’

‘আর ওই লোকও ঘুরতে গিয়েছিল গুডরিচদের সঙ্গে?’

‘তা জানি না,’ বললেন রোণ্ডা, তবে টের পেয়েছি, কী যেন বদলে গেছে গুডরিচদের ফার্মে। আর তারপর টিভিতে দেখলাম ভয়ঙ্কর এক খুনিকে খুঁজছে পুলিশের লোক। তখন…‘

‘এখন তো খুব খারাপ সময়,’ জানালেন ডেসমণ্ড। গোটা দুনিয়া বদলে গেছে। তাই আমাদের মনে হলো আপনাকে সব খুলে বলা ভাল।’

স্বামীর বাহুতে হাত রাখলেন রোণ্ডা। ‘দেশটার কী যে হয়েছে! …তো, শেরিফ, টিভি দেখার পর জানলাম ওই খুনি ইংরেজদের মত কথা বললেও আসলে বাংলাদেশি। একজন সৈনিক। আমরা বুঝতে পারছি না তার সঙ্গে কীভাবে জড়িয়ে গেল গুডরিচরা! তবে ওরা কোনও ঝামেলায় পড়লে মনে কষ্ট পাব আমরা।’

ঝট্ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে শেরিড্যান। ধাক্কা খেয়ে মেঝেতে চিত হয়ে পড়ল চেয়ার। ‘ঠিক আছে, আমরা খোঁজ নিচ্ছি। অনেক ধন্যবাদ আপনাদেরকে। আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। ঠিক সময়েই যোগাযোগ করেছেন।’

‘দেরি করে থাকলে আমরা দুঃখিত, শেরিফ। আসলে বুঝতে পারছিলাম না কী করা উচিত।’

‘আপনারা একেবারে ঠিক কাজই করেছেন। এবার আমাকে একটা ফোনকল করতে যেতে হবে। আপনারা ফেরার জন্যে তৈরি হলে অফিসাররা আপনাদেরকে বাইরে পৌঁছে দিয়ে আসবে।’

ইন্টারভিউ রুম থেকে দৌড়ে বেরোল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ছুটে গিয়ে ঢুকল নিজের অফিসে। এক মিনিটের ভেতর জারি করল কোড ৩৫। সন্দেহজনক লোকের খোঁজে সতর্ক হয়ে উঠেছে কাডাহাডাচো ক্রিকের আশপাশের পুলিশ অফিসাররা।

সবার আগে শেরিফের সঙ্গে যোগাযোগ করল ডেপুটি শেরিফ বিলি এস. কনরাড। ‘বুঝলাম, শেরিফ। আমি গুডরিচদের ফার্মে পৌঁছুতে পারব বিশ মিনিটের ভেতর। রওনা হয়ে যাচ্ছি।’

‘সাবধানে থেকো, কনরাড, বলল শেরিড্যান। ‘ভাল করবে ব্যাকআপের জন্যে অপেক্ষা করলে।’

কর্কশ হাসল কনরাড। ‘আমাকে নিয়ে ভাববেন না, শেরিফ। এবার আর কোনও ঝুঁকি নেব না।’

.

বাংলাদেশি অতিথি বিদায় নেয়ার পর নীরব হয়ে গেছে গুডরিচদের খামার। বড় হোক বা ছোট, সবার ভেতরেই কাজ করছে চাপা দুশ্চিন্তা। কয়েক দিনের জন্যে কাজ থেকে ছুটি নিয়েছে এলিসা গুডরিচ। স্বামীর সঙ্গে বসে বেশিরভাগ সময় টিভি দেখছে। গতকাল জানা গেছে উঁচু এক সেতু থেকে গাড়ি নিয়ে বাইয়ুর পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে উধাও হয়েছে লুইযিয়ানার সবচেয়ে বিপজ্জনক অপরাধী মাসুদ রানা।

আজ ভোরে টিভিতে সংক্ষিপ্ত ভিডিয়ো ক্লিপে দেখানো হয়েছে, কী ভয়ঙ্করভাবে গাড়ি নিয়ে তলিয়ে গেছে মানুষটা। পরে গাড়ি তুললেও ভেতরে লাশ ছিল না। পরস্পরের দিকে চেয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলেছে এলিসা ও জোসেফ।

মাসুদ রানা সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সরে পড়েছে জানার পর খেপে গিয়ে ন্যাশনাল গার্ডদের ডাকার হুমকি দিয়েছেন স্টেট গভর্নর। ক্লোভিস প্যারিশের কোর্টহাউসের বাইরে গল্প করছে একদল সাংবাদিক। তাদের ডেকে নিয়েছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ব্যাখ্যা করে বলেছে, এটা শুধু সময়ের বিষয় যে ধরা পড়বে মাসুদ রানা। আপাতত তদন্তের খাতিরে জরুরি কোনও তথ্য দিচ্ছে না শেরিফের ডিপার্টমেন্ট।

এসব টিভিতে দেখে বিরক্ত হয়ে যন্ত্রটা বন্ধ করেছে জোসেফ। শেরিফকে দেখলে বুকের ভেতর আগুন জ্বলে ওঠে ওর। মেজাজ ঠিক রাখতে পারে না।

‘শেষপর্যন্ত কী হবে বলে মনে হয়, ডার্লিং?’ জানতে চেয়েছে এলিসা।

আস্তে করে মাথা নেড়েছে জোসেফ। ‘ভয় লাগছে রানার জন্যে। যে-কোনও সময়ে ধরা পড়বে, বেচারি। সেক্ষেত্রে হয়তো খুন হবে।’

এসব কথা হয়েছে ওদের ভেতর সকাল আটটার দিকে। আর এখন মাঝ-সকাল। একটু আগে চিটিমাচায় গেছে জোসেফ। ওখান থেকে কিনবে কিছু হার্ডওয়্যার। ওগুলো না থাকলে মেরামত করতে পারছে না বার্নের ছাত।

কিচেন টেবিলে নিজের হোমওঅর্ক করছে রন।

একটু দূরের চেয়ারে বসে পাখির ছবি আঁকছে টিনা।

ওদিকে খামারের টুকটাক নানান কাজে মাকে সাহায্য করছে রব। একটু আগে মুরগির ডিম তুলে রেখে এসেছে কিচেনে।

বাড়ির দিকে চলেছে মা-ছেলে, এমন সময় ওরা দেখল উঠানের দিকে আসছে পুলিশের ক্রুযার। ওটার ছাতে ঝলমল করছে নীল আলো। বাড়ির সামনে কড়া ব্রেক কষে কর্কশ শব্দে থামল গাড়িটা। ভুরু কুঁচকে ওদিকে তাকাল এলিসা। সূর্যের আলো পড়েছে বলে দেখতে পেল না ড্রাইভারের চেহারা। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে নিচু গলায় বলল এলিসা, ‘তুমি বাসায় যাও, রব। ডিম তুলে রাখবে মিটসেফে। চোখ রাখবে তোমার ছোটবোনের ওপর। আমি একটু পরে আসছি।

দৌড়ে গিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকল রব।

গাড়িটার দিকে চেয়ে রইল এলিসা।

কয়েক মুহূর্ত পর গাড়ির দরজা খুলে নেমে এল এক পুলিশ অফিসার

এলিসা ভাবল, কী চায় এই লোক? ওর ভাল লাগছে, এখন বাড়িতে নেই জোসেফ। নইলে প্রকাশ করত নিজের বিরক্তি। প্রথম স্ত্রী পুলিশের হাতে খুন হওয়ার পর থেকেই পুলিশ দেখলে খেপে যায় সে।

এলিসার সামনে এসে থামল ডেপুটি শেরিফ বিলি এস. কনরাড। হাসছে দাঁত বের করে। ‘মর্নিং, মিসেস গুডরিচ! চমৎকার সকাল, কী বলেন?’

‘মর্নিং!’ জবাবে অস্ফুট স্বরে বলল এলিসা। নিজেকে সামলে নিল। ‘অফিসার, কী বিষয়ে এসেছেন?’ বুকের ভেতর কাঁপছে ওর। জরুরি কারণ ছাড়া আসার কথা নয় পুলিশের। তার মানেই কেউ না কেউ মাসুদ রানার ব্যাপারে তথ্য দিয়েছে তাদের কাছে। হয়তো বলেছে, অপরাধীকে লুকিয়ে রেখেছে ওরা। তা হলে কি এখন ওকে গ্রেফতার করবে লোকটা? সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের কী হবে?

‘ভাবলাম একবার দেখা করে যাই,’ আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসল কনরাড। ‘বাড়িতে কি মিস্টার গুডরিচ আছেন?’

‘শহরে গেছে,’ জবাবে বলল এলিসা। মনের চোখে দেখল, চিটিমাচায় গিয়ে জোসেফকে গ্রেফতার করছে একদল পুলিশ। এটা ভাবতে গিয়ে গলা শুকিয়ে গেল ওর। জোসেফ যদি আত্মসমর্পণ না করে? ওকে যদি গুলি করে তারা?

‘তার মানে, শুধু আপনি আর বাচ্চারা বাড়িতে?’ মাথা নাড়ল কনরাড। ‘কী লজ্জার কথা!’ এলিসাকে এক চক্কর কেটে মুখোমুখি হলো সে।

এলিসার মনে হলো অশুভ কী যেন আছে লোকটার ভেতর। জ্বলজ্বলে চোখে দেখছে ওকে। ডানহাত পিস্তলের বাঁটের ওপর। নাক-মুখে মার খাওয়া দাগ। এলিসার মনে পড়ল, লিয বাউয়ারের খুনের রাতে এই ডেপুটি শেরিফই রানাকে খুন করতে গিয়েছিল। কথাটা শুনেছে জোসেফের মুখে।

এক পা পিছিয়ে গেল এলিসা। হঠাৎ করেই ওর মনে হলো, জোসেফ নেই সেটা বোধহয় ভাল হয়নি। ঢোক গিলল দু’বার। চোখে ফুটেছে ভয়ের চাতনি। মনটা চাইল ঘুরেই ছুটে পালিয়ে যেতে। কিন্তু যাবে কোথায়?

‘ইয়ে…’ চাপা স্বরে বলল এলিসা, ‘আপনার জন্যে কী করতে পারি, অফিসার?’

হঠাৎ করেই কনরাডের আন্তরিক হাসিটা রূপান্তরিত হলো কুৎসিত টিটকারির হাসিতে। ঝট্ করে হোলস্টার থেকে পিস্তল বের করে এলিসার গালে ওটার নল দিয়ে গুঁতো দিল সে।

ভয়ের চোটে থমকে গেছে এলিসা

‘শোন্,’ বলল কনরাড, ‘ডাক দে তোর বাচ্চাগুলোকে। ওদেরকে নিয়ে ঘুরতে বেরোব। বাদ দিবি না একটাকেও। বুঝতে পেরেছিস?’

‘আপনি এভাবে আমাকে গ্রেফতার করতে পারেন না। আমি কী করেছি?’

খিক খিক করে হাসল কনরাড। ‘তুই ভাবছিস মিরাণ্ডাস শোনাব তোকে? বেশ্যা মাগী, আমি তো তোকে গ্রেফতারই করছি না।’

এলিসার মনে হলো মাথা ঘুরে জ্ঞান হারাবে। ‘আপনি আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যেতে চান?’

‘আমার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করাব তোদেরকে। তোদের পেলে খুব খুশি হবে ওরা। বাকি জীবনের জন্যে তোরা হবি যা ছিলি, ক্রীতদাসী আর ক্রীতদাস!’

‘আমাকে নিয়ে যান, কিন্তু আমার বাচ্চাদেরকে ছেড়ে দিন,’ ফুঁপিয়ে উঠল এলিসা।

‘চুপ! নিগারের বাচ্চা! ডেকে নে তোর সবক’টা বাচ্চাকে, নইলে বাড়ির ভেতর ঢুকে গুলি করে মারব শুয়োরগুলোকে।’

চিৎকার করে বাচ্চাদেরকে বলতে ইচ্ছে হলো এলিসার, ‘তোমরা পালাও! পালিয়ে যাও দূরে!’ কিন্তু চেঁচালে বাড়িতে ঢুকে সবার ওপর চড়াও হবে লোকটা।

এলিসা বুঝে গেল, আসলে কিছুই করার নেই ওর। দু’চোখ বেয়ে দরদর করে নামল অশ্রুজল। প্রায় স্বাভাবিক স্বরে বাচ্চাদেরকে ডাকল এলিসা।

প্রথমে বাড়ি থেকে বেরোল রন। একজন পুলিশ মায়ের দিকে অস্ত্র তাক করেছে দেখে বিস্ফারিত হলো ওর দুই চোখ।

নাকে আড়াল করে দাঁড়াতে চাইল রন। কিন্তু বেচারা খুন হবে বুঝতে পেরে নরম সুরে বলল এলিসা, ‘ঠিক আছে, রন। কিচ্ছু হয়নি। আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না। সাবধানে এসে পাশে দাঁড়াও। রব, টিনা, তোমরাও এসো।’

পিস্তলের নল ঘুরিয়ে গাড়ি দেখাল কনরাড। ‘সবাই গাড়িতে! ওই দুই কেলেভূত আমার গাড়ির সিটে মুতে দিলে সব চাটিয়ে তোলাব তোদেরকে দিয়ে।’

পুলিশ ক্রুয়ারের পেছনদিক প্রিযন ভ্যানের মত। বেঞ্চ সিট নিচু আর অস্বস্তিকর। লোহার জাল দিয়ে আলাদা করা আছে গাড়ির সামনের দিক। পেছনের জানালায় লোহার রড। ভেতরটা খাঁচার মত। চারজন পেছনে ওঠার পর নড়াচড়ার জায়গা প্রায় থাকল না। নিজের দু’পাশে রব আর টিনাকে বসিয়েছে এলিসা। মন চাইছে কাঁদতে, কিন্তু তা করলে বাচ্চারা ভেঙে পড়বে ভেবে নিজের কান্না চেপে রাখল ও। ফ্যাকাসে হয়েছে রন। রাগে থরথর করে কাঁপছে। কয়েক মুহূর্ত পর চিৎকার করে বলল, ‘হারামজাদা! আমাদেরকে ছেড়ে দে!’

‘চেঁচাবি না, শুয়োরের বাচ্চা! নইলে পোঁদে এমন লাথি দেব, শেষে হাগু গিয়ে উঠবে তোর গলার কাছে,’ ধমক দিল কনরাড। ইঞ্জিন চালু করে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি। ফিরে চলেছে মেইন রোডের দিকে। বন্ধ করল পুলিশ রেডিয়ো।

কাডাহাডাচো ক্রিকের রাস্তায় পড়ার পর পলকের জন্যে জোসেফের পুরনো জিপগাড়িটাকে দেখল এলিসা। বাড়ির দিকে চলেছে ওর স্বামী।

চিৎকার করে বাবাকে ডাকল বাচ্চারা। ‘পাপা! পাপা!’

জানালার রডের এদিক থেকে পলকের জন্যে স্বামীর হতভম্ব মুখ দেখল এলিসা। ভীষণ ভয় আর বিস্ময় জোসেফের চোখে-মুখে। জানালা দিয়ে এলিসা দেখতে পেল রাস্তার মাঝে থেমে গেছে জিপ। ইউ টার্ন নিয়ে এগিয়ে এল জোসেফ। গতি তুলছে বলে আরেকটু হলে কাত হয়ে পড়ত জিপ।

নিচু গলায় গুঙিয়ে উঠল এলিসা, ‘না, সোনা, এতবড় ঝুঁকি নিয়ো না!’ ও বুঝে গেছে, বাধা দিলে জোসেফকে খুন করবে অমানুষ এই জানোয়ারটা!

রিয়ার ভিউ মিররে জিপটাকে দেখল বিলি এস. কনরাড, মুখে টিটকারির হাসি। মেঝেতে চেপে ধরল অ্যাক্সেলারেটর। গতি বাড়তেই সিটে গেঁথে গেল এলিসা।

পিছু নেয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করছে জোসেফ। কিন্তু পুরনো জিপগাড়ির তুলনায় অনেক দ্রুতগামী পুলিশ ক্রুষার।

মিনিট খানেক পর পিছিয়ে পড়ল জোসেফ। একবার বাঁক নেয়ার পর হারিয়ে গেল পেছনে। রব আর টিনাকে দু’হাতে বুকে চেপে ধরল এলিসা। ভাবছে, আর কি কখনও দেখা হবে এদের বাবার সঙ্গে?

চোখ বুজে ফুঁপিয়ে উঠল এলিসা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *