সাতচল্লিশ
মাঝ দুপুরে সাইরেন বাজিয়ে ভিলেনিউভ শহরে ঢুকল পুলিশের কনভয়। সবার আগে শেরিফের ক্রুযার। কোর্ট স্কয়্যারে গিয়ে থামল গাড়িগুলো। চারপাশে খবর ছড়িয়ে গেল ম্যান-হান্ট শেষ। ধরা পড়েছে খুনি মাসুদ রানা। সেই রাতে খুনের পর থেকে ব্যস্ত হয়ে খবর চালাচালি করছে স্থানীয় মিডিয়া। এবার নতুন খবরের জন্যে সবাই ছুটল শেরিফ ডিপার্টমেণ্ট লক্ষ্য করে। গত কয়েক দিন শহরের সাধারণ মানুষ ভয়ের ভেতর ছিল, যে-কোনও সময়ে বাড়িতে ঢুকবে ভয়ঙ্কর খুনি মাসুদ রানা। লোকটাকে জেলহাজতে নেয়া হয়েছে জানার পর স্বস্তির শ্বাস ফেলল তারা। আদালত ভবনে পুলিশের কর্ডনের বাইরে থেকে ক্লিক-ক্লিক শব্দে রানার ছবি তুলল ফোটো সাংবাদিকরা। হাতকড়া পরা মাসুদ রানাকে গাড়ি থেকে বের করে কোর্ট হাউসে ঢুকল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। সদর দরজার পাহারায় থাকল সশস্ত্র একদল পুলিশ। খুনি মাসুদ রানা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সামান্য দ্বিধা না করে গুলি চালানো হবে।
কিন্তু বাইরের জনসমাবেশ থেকে দূরে ভবনের ভেতর হলো ভিন্ন পরিবেশ। এমন কী শেরিফের ডেপুটিরাও নিশ্চিত হতে পারল না, শেরিফ আনুষ্ঠানিকভাবে মাসুদ রানাকে অভিযুক্ত করেছে কি না। এ-ও কেউ জানে না, মাসুদ রানার সাধারণ অধিকারের ব্যাপারে তাকে কিছু জানানো হয়েছে কি হয়নি। তবে আইনি পক্ষের সবাই ধরে নিল, শেরিফ যেহেতু একা মাসুদ রানাকে গ্রেফতার করেছে, কাজেই বন্দি করার পর আইনি দিকগুলো জানিয়ে দিয়েছে সে। সবাই বুঝতে পারছে, এটা সাধারণ কোনও গ্রেফতার নয়। কী যেন হয়েছে শেরিফের। ফিঙ্গার প্রিন্ট নেয়া, ফোটো তোলা আর ক্লোভিস প্যারিশের কোর্ট ভবনের বেইসমেন্টের সেলে মাসুদ রানাকে নিয়ে বন্দি করা হয়নি। অস্বাভাবিক আচরণ করছে শেরিফ। ভবনে ঢুকে লম্বা করিডোর পার হয়ে অপরাধীকে নিয়ে সোজা গিয়ে ঢুকেছে নিজের অফিসে। শুধু তা-ই নয়, মাসুদ রানা ঢোকার পর বন্ধ করে দিয়েছে অফিসের দরজা। জানা যাচ্ছে না ভেতরে কী করছে তারা।
প্যারিশের সবাই জানে, কখনও কখনও আইনের বাইরে গিয়ে কাজ করে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। সবাই ভাবছে, এই গ্রেফতারটাও সে ধরনের কিছু। শেরিফের অফিসের বাইরের করিডোরে সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল ডেপুটি ফিল জনসন, ‘ব্যাপারটা আসলে কী, রে? জেলে ভরল না কেন?’
জবাবে মাথা নাড়ল ডেপুটি শেরিফ লট সুয়ের। ‘কিছুই তো বুঝতে পারছি না, দোস্ত।’
একটু পর অফিসের দরজা খুলে করিডোরে মাথা বের করল শেরিফ। ‘ফিল, এখানে নিয়ে এসো কনরাডকে। বলবে, ওর জন্যে নতুন অ্যাসাইনমেন্ট আছে। ব্যক্তিগতভাবে ওকে সব বুঝিয়ে দেব। যেন দেরি না করে চলে আসে আমার . অফিসে।’
‘যাচ্ছি, শেরিফ, দ্বিধা নিয়ে বলল ফিল জনসন। দরজার ফাঁক দিয়ে চট্ করে উঁকি দিল ঘরের ভেতর। উৎকণ্ঠা নিয়ে জানতে চাইল, ‘কোথাও কোনও সমস্যা হয়নি তো, স্যর?’
‘না, সমস্যা হয়নি। তুমি সময় নষ্ট করছ, ফিল। দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এসো কনরাডকে।’ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করল শেরিড্যান। জানালার কাছের সোফায় গিয়ে বসল। চিন্তায় ডুবে যাওয়ার আগে ভাবল, জীবনে ক’ঘণ্টা ঘুমাতে পেরেছি?
‘নাইস ওঅর্ক,’ বলল রানা। ‘এতেই কাজ হওয়ার কথা। এরই ভেতর সব জেনে পালিয়ে না গিয়ে থাকলে চলে আসবে কনরাড।’
‘তোমার কথা শুনে মস্ত ঝুঁকি নিয়েছি,’ কড়া গলায় বলল শেরিফ। ‘তবে আমি তোমার বুযম ফ্রেণ্ড নই যে যা খুশি বলবে আর তা-ই করব।’
‘বুযম ফ্রেণ্ড হয়ে যাবেন শীঘ্রিই,’ হাসল রানা। ‘আমার ভুল হয়ে না থাকলে, ক্যারিকে খুন করার সময়ই আপনার ক্যারিয়ারের সেরা ব্লাণ্ডারটা করেছেন আপনি,’ বলল রানা। ‘দ্বিতীয় ভুল আমার নামে হুলিয়া জারি। যদি সব কথা প্রকাশ পায় তা হলে দুনিয়া জানবে, কত বড় ভুল করেছে আপনার ডিপার্টমেন্ট। ক্যারির কথা মনে আছে না আপনার? নাকি ভুলে গেছেন কত বড় ভুল করেছিলেন?’
‘তুমি কি আমাকে আইনি হুমকি দিচ্ছ?’
‘তা দিচ্ছি না। তবে, বলা যায় না, জোসেফ হয়তো আপনাকে জেল খাটাতে চাইবে। ও দক্ষ উকিল।’
তিক্ত চেহারা করল শেরিড্যান। ‘কী বলতে চাইছ বুঝতে পেরেছি, রানা। তবে তুমি মিথ্যা বলে থাকলে…
‘সেক্ষেত্রে গাড়ি চুরি, অফিসারকে পিট্টি দেয়া আর পুলিশের জিনিসপত্র নষ্টের দায়ে জেল খাটিয়ে ছাড়বেন, তাই না?’ বলল রানা। ‘বোধহয় বেআইনি ডিসটিলারি ধ্বংস করে দেয়ায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলবে না আদালত। আগে যা বললাম, তার বাইরে আমার বিরুদ্ধে আর কিছু প্রমাণ করতে পারবেন না।’
‘আর খুনের দায়?’ বলল শেরিফ, ‘প্রমাণ না হওয়া তক তোমাকেই অপরাধী ধরে নেব।’
শেরিফের দিকে হ্যাণ্ডকাফ পরা দু’হাত বাড়িয়ে দিল রানা। ‘হাত খুলে দিলে অখুশি হব না। ভয় পাবেন না, হাত খোলা হলেও আপনাকে পিটিয়ে অজ্ঞান করব না।’
রাগ চেপে নাক দিয়ে ঘোঁৎ আওয়াজ ছাড়ল শেরিড্যান। কয়েক মুহূর্ত পর ডেস্ক থেকে চাবি নিয়ে খুলে দিল রানার হ্যাণ্ডকাফ।
‘অনেক ধন্যবাদ।’ সোফায় হেলান দিয়ে বসল রানা। ডেস্কের পেছনের চেয়ার দখল করল শেরিড্যান। হোলস্টার থেকে নিয়ে ডেস্কে রাখল পুরনো রিভলভার। ওটার নল রেখেছে রানার বুকের দিকে।
‘এখনও আমাকে বিশ্বাস করছেন না?’ জানতে চাইল রানা।
‘সত্যি বলছ কি না ঠিকই বুঝব,’ বলল শেরিড্যান।
চোখ বুজে বিলি এস. কনরাডের জন্যে অপেক্ষায় থাকল রানা। বাইরে থেকে ওকে দেখলে যে-কেউ বলবে: ও চুপচাপ স্বভাবের শান্তিপ্রিয় মানুষ। তবে টিকটিক করে প্রতিটা সেকেণ্ড পেরোচ্ছে, আর ওর মগজে কে যেন বলছে: ফুরিয়ে আসছে সময়। বারবার মনে পড়ছে এলিসা, রন, রব আর টিনার মুখ। এদিকে বোধহয় চিন্তায় পাগল হয়ে গেছে জোসেফ গুডরিচ।
নীরব পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর বিইপ শব্দে বেজে উঠল ইন্টারকম। সামনে ঝুঁকে মেশিনটার লাল বাটনে চাপ দিল শেরিড্যান। ওদিক থেকে বলা হলো, ‘শেরিফ, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায় কনরাড।’
‘ওকে পাঠিয়ে দাও।
‘ওর কাছে গোপন অস্ত্র থাকতে পারে,’ বলল রানা। ‘সাবধান হওয়া উচিত।’
‘ভাল করেই জানি আমার লোকদেরকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়,’ ধমকের সুরে বলল শেরিড্যান।
‘তাই?’ সোফা ছেড়ে দরজার আড়ালে সরল রানা।
নক হলো দরজার ওপর, কবাট খুলে ভেতরে পা রাখল বিলি এস. কনরাড। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। ‘আমাকে ডেকেছেন, শেরিফ?’ তার জানা নেই কবাটের ওদিক থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে রানা।
‘দরজাটা বন্ধ করো, কনরাড,’ বলল শেরিড্যান।
কবাট আটকে দেয়ার জন্যে ঘুরেই রানাকে দেখল কনরাড। ভয়ে নীল হয়ে গেল বেগুনি নাক-মুখের একাংশ। ঝট্ করে পিছিয়ে গেল এক পা। একবার ভাবল দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। মুখ হাঁ হওয়ায় ঝুলে গেছে চোয়াল। বারকয়েক কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তারপর তোতলা হয়ে গেল, ‘বুব… বুব… বুঝতে পারছি না! এ অফিসে কেন এই লোক?’
এক পা সামনে বাড়ল রানা।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ডান হাত বাড়িয়ে দিল কনরাডের দিকে। ‘তোমার সার্ভিস. ওয়েপনটা দাও দেখি, ডেপুটি।’
লালচে মুখ বরফের মত সাদা হলো কনরাডের। আপত্তি তুলতে গিয়েও বুঝল শেরিফের চোখের দৃষ্টি ভীষণ কে পলকের জন্যে রানার মনে হলো, অস্ত্র বের করেই করবে কনরাড। তবে ঢোক গিলে দ্বিধা কাটিয়ে হোলস্টার থেকে নিয়ে বসের হাতে গ্লক পিস্তলটা দিল সে।
ডেস্কে অস্ত্রটা রাখল শেরিড্যান। ‘আশা করি বেআইনি আর কোনও অস্ত্র নেই তোমার কাছে, কনরাড? যেমন ধরো বুটের খাপে পোরা ছোরা বা তেমন কিছু? তোমার তো জানার কথা ওই ধরনের জিনিস নিজের সঙ্গে রাখা বেআইনি।’
‘কী হয়েছে, শেরিফ?’ রাগী কণ্ঠে বলল কনরাড। মুখে ফুটেছে অপরাধের পরিষ্কার ছাপ। অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার মত অভিনয় জানা নেই তার। ‘আমাকে তো বলা হলো একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেয়া হবে।’
দরজাটা আটকে দিল রানা।
‘আজ কী ধরনের কাজ করেছ, কনরাড?’ জানতে চাইল শেরিড্যান। কণ্ঠ নরম হলেও তার ভেতর কোথায় যেন রয়েছে চরম কঠোরতা। ‘আমরা যখন ওই খামারে গেলাম, তার আগে কোথায় গিয়েছিলে?’
‘কোথাও তো… না তো!’
ডেস্ক ঘুরে তার দু’ফুটের ভেতর পৌঁছে গেল শেরিড্যান। ‘আজকে এলিসা গুডরিচের সঙ্গে দেখা করেছ?’
‘এলিসা… না তো!’
‘গাড়িতে করে মহিলা আর তার ছেলেমেয়েদেরকে কোথায় নিয়েছিলে?’
আড়ষ্ট হাসল কনরাড। ‘এসব কী বলছেন, শেরিফ! আমি তো কোথাও যাইনি!’
‘আজ তোমার দেখা হয়েছে রিচি আর তার ভাইয়ের সঙ্গে?’
আবারও চোয়াল ঝুলে গেল কনরাডের। চোরের দৃষ্টিতে চট করে তাকাল রানার দিকে। আবারও দেখল শেরিফের চোখ।
হিমালয়ের মত তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রৌঢ় শেরিফ। চাপা স্বরে বলল সে, ‘এই লোকের একটা কথাও বিশ্বাস করতে চাইনি। তবে এখন মনে হচ্ছে আমার ডিপার্টমেন্টে ঢুকেছে পঁচে গলে যাওয়া দুর্গন্ধময় একটা ছুঁচো। আমি তোমার কাছ থেকে ব্যাখ্যা আশা করছি, কনরাড। জবাব দেয়ার জন্যে চিরকাল সময় পাবে না।’
এক পা পিছিয়ে গেল কনরাড। তারপর আরেকটা পা। কোনাকুনিভাবে সরছে ডেস্কের দিকে। ওটার ওপর আছে গ্লক পিস্তল।
রিভলভারের ইস্পাতের চেয়েও কঠোর শেরিফ স্যাম শেরিড্যানের মুখ। কর্কশ স্বরে বলল, ‘এত ভয় কীসের, কনরাড? চার্চেও তো এত ঘামে না পাপী। তোমার যদি কিছু বলার থাকে, তো এটাই শেষ সুযোগ।’
হঠাৎ চোখে ঘৃণার আগুন নিয়ে রানাকে দেখল কনরাড। বুঝে গেছে, ধরা পড়েছে সে। ‘তোমরা ভেবেছ যা খুশি চাপিয়ে দেবে আমার ওপর? আবার নিজেকে বলে শেরিফ! বুড়ো ভাম!’ ঝট্ করে ডেস্কের ওপর থেকে গ্লক পিস্তল তুলে নিল কনরাড। সরাসরি শেরিড্যানের মাথা লক্ষ্য করে তাক করল নল। পরক্ষণে আছড়ে পড়ল দেয়ালে। কোঁৎ করে একটা আওয়াজ বেরোল কনরাডের গলা দিয়ে।
এক পাশ থেকে তার গলা পেঁচিয়ে ধরেছে রানা। অন্য হাতে মুচড়ে ধরল লোকটার কবজি। এতই ব্যথা পেল, ট্রিগারে রাখা আঙুল অবশ হয়ে গেল কনরাডের।
‘সব খুলে বলো,’ সহজ সুরে বলল রানা।
‘আমার পাছার ফুটো চাটবি তুই, শুয়োরের বাচ্চা শেরিফ!’ চিৎকার করে উঠল কনরাড।
তাকে দেয়ালে ঠেসে ধরে রেখেছে রানা। এবার ছেড়ে দিল। পা হড়কে দেয়াল ঘেঁষে মেঝেতে বসে পড়ল কনরাড। কত বড় বিপদে জড়িয়ে গেছে, তা বুঝতে পেরে ছ্যারছ্যার, করে প্রস্রাব করে দিল কার্পেটে। প্যান্টের পায়া একটু সরে যেতেই দেখা গেল ডানপায়ের বুটের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে খাপে পোরা একটা ছোরা। বাম হাতের তর্জনী ও বুড়ো আঙুলে ধরে ওটা বের করে টেবিলের ওপর গ্লকের পাশে রাখল রানা।
হতবাক হয়ে ডেপুটিকে দেখল স্যাম শেরিড্যান, তারপর তাকাল রানার দিকে।
‘আশা করি কনরাড স্বীকারোক্তি দেবে, শেরিফ,’ বলল রানা।
বিশাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান।