1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৩২

বত্রিশ

রানার কথা শুনে হাসতে শুরু করেছে নোভাকরা।

ছোট দুই ভাইয়ের দিকে তাকাল হাস্যরত রিচি। ‘কথা শুনেছ ওর? আমি ওকে ভালবেসে ফেলছি কিন্তু!’

‘ব্যাটার দুই বিচি বোধহয় স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি, ‘ মন্তব্য করল হ্যাঙ্ক নোভাক। ‘তবুও ওকে মরতেই হচ্ছে।’

চকচক করছে প্যাট্রিকের দু’চোখ। ‘কাজটা আমার হাতে ছেড়ে দাও।’

‘শেষবারের মত সাবধান করছি,’ বলল রানা। ছিলা টেনে কানের কাছে নিয়েছে। ধনুকের হ্যাণ্ডেলে লাগানো ব্যাটারির টার্মিনাল স্পর্শ করছে তীরের গায়ে জড়ানো স্টিল উল। বৈদ্যুতিক তরঙ্গের কারণে আগুনের মত লাল হয়ে কয়েক সেকেণ্ডে শিখা জ্বলে উঠল জালের মত স্টিল উলের গায়ে। তীরের গতি যত বাড়বে, ততই বেশি পুড়বে স্টিল উল।

কয়েক ডিগ্রি সরিয়ে তিন নোভাকের পেছনে তীর তাক করল রানা। অ্যালকোহলে ভরা সিলিণ্ডারের নরম তামার গা সহজেই ফুটো করবে জ্বলন্ত তীর। বুলেটের মত মুহূর্তে আগুন জ্বেলে দেবে ইথানলের বাষ্পে। অকটেনের ভাণ্ড যেভাবে আগুনে-বোমার মত ফাটে, সেভাবেই বিস্ফোরিত হবে সিলিণ্ডার। চারদিকে ছিটিয়ে পড়বে বিশাল নীল শিখার ফুটবল। ওই আগুন জ্বেলে দেবে অন্যান্য সিলিণ্ডারগুলোকে। কয়েক মুহূর্তে- নরকের গনগনে কুণ্ড হবে এই ঘর। বাঁচবে না কেউ। আগুন নিভলে এখানে থাকবে পোড়া মাটির গভীর এক গর্ত।

এই কথাটা রানার চেয়ে কম জানে না নোভাকরা।

‘আগেই বলেছি, আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে ভুল করেছ, বলল রানা। ‘এবার সোজা ফিরবে নরকে।’

‘তীর ছুঁড়ো না,’ কাতর সুরে বলল প্যাট্রিক, ‘এই যে, আমার পিস্তল দিয়ে দিচ্ছি। তীরটা সরাও। খুন হব তো সবাই!’ শার্টের তলা থেকে লুকিয়ে রাখা গ্লক পিস্তল নিয়ে রানার পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেলল সে।

‘আমারটাও,’ তিক্ত সুরে বলল হ্যাঙ্ক নোভাক। ওয়েস্ট ব্যাণ্ড থেকে নিয়ে মাটিতে বেরেটা পিস্তল রাখল সে। পা দিয়ে ঠেলে দিল রানার দিকে।

একবারের জন্যে নড়াচড়া করেনি রিচি। ঠোঁটের কোণে বিচিত্র একটুকরো হাসি। ঢিলা শার্টের ওপর দিয়েও বড়সড় একটা হোলস্টার দেখছে রানা। পরিষ্কার বুঝল, পিস্তল যদি বের করে, সেটা আত্মসমর্পণের জন্যে করবে না ওই লোক।

‘ভাঁওতা দিয়ে পার পাবে না,’ বলল রানা।

‘পাব না?’ নিচু গলায় বলল রিচি নোভাক।

ওই একই সময়ে বাতাস লাগল রানার কানের পেছনে। কিছু একটা আসছে ওর দিকে! হাতে তীর-ধনুক নিয়েই চরকির মত ঘুরে দাঁড়াল রানা। ওর পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে বিশালাকৃতি সেই কাঠুরে! কাছ থেকে তাকে আরও প্রকাণ্ড লাগল। দৈর্ঘ্যে অন্তত সাত ফুট। বিকৃত দেহের ভয়ঙ্কর এক রাক্ষস! মাথার পেছনে ইঁদুরের লেজের মত দীর্ঘ বেণী। এক চোখের মণি রানার ওপর, আর ট্যারা মণিটা চেয়ে আছে সোজা ছাতের দিকে। গাছের গুঁড়ির মত দুই পেশিবহুল হাতে মাথার ওপরে তুলেছে কাঠ কাটার সেই মস্ত কুঠার। এক কোপে মাথা থেকে শুরু করে রানাকে দু’টুকরো করবে দানব। ওর মাথা লক্ষ্য করে সাঁই করে নামছে গিলোটিনের মত কুঠারের চকচকে রুপালি ফলা

ঝট করে সরেই প্রায় বসে পড়ল রানা। ওর বাম কানের এক ইঞ্চি দূর দিয়ে নেমে কংক্রিটের মেঝে ফাটিয়ে দিল কুঠার। চারপাশে ছিটকে গেল লালচে ফুলকি। বিকট এক গর্জন ছেড়ে আবারও কুঠার মাথার ওপর তুলল দানব। ভীষণ রেগে গেছে। কত বড় সাহস, পুঁচকে ওই বাঁদরের মত বাদামি লোকটা হুমকি দেয় তার মালিকদেরকে!

হাত থেকে ধনুক ও জ্বলন্ত তীর ছেড়ে দিয়েছে রানা। খটাস্ করে মেঝেতে পড়ল ওগুলো। তার আগেই কাঁধ থেকে খুলে নিয়েছে স্লিংসহ বন্দুক। তবে ওটা তাক করার আগেই হুইশ্ আওয়াজে আবারও ওর দিকে এল মারাত্মক কুঠার। ঠিকভাবে কোপ পড়লে দুই ফালি হবে রানা। গুলি করে দানবের মাথা উড়িয়ে দিলেও ভারী ওজনের কারণে ওর ওপর নামবে ধারালো কুঠারের কোপ।

অবশ্য গুলি ছাড়াও অন্য কাজে লাগে বন্দুক। দু’হাতে ওটার নল আর গ্রিপ ধরে কুঠারের আঘাতটা ঠেকাতে চাইল রানা। জোরালো খটাং আওয়াজে লোহার সঙ্গে লোহার সংঘর্ষে চারদিকে ছিটকে গেল আগুনের ফুলকি। চমকে গেছে রানা। এতই জোরে লেগেছে কুঠার, আরেকটু হলে ওর হাত থেকে খসে পড়ত বন্দুক। কার্ডবোর্ডের টিউবের মত মুচড়ে গেছে অস্ত্রের ভারী ব্যারেল।

বাতিল অস্ত্র হাতে এক পা পিছিয়ে গেল চমকিত রানা। টলতে টলতে ওর দিকে এগোল ট্যারা দানব। হাসছে নাক কুঁচকে। সে মুখ হাঁ করতেই রানা দেখল, এবড়োখেবড়ো কালো কয়েকটা ধারালো বড় দাঁত। বেচারা বুঝে গেল, লাখে লাখে আখ খেয়ে বেঁচে আছে এই কুৎসিত রাক্ষসটা!

‘পরিচয় করিয়ে দিই, ও আমার প্রিয় অনুচর রুডলফ, ‘ বলল রিচি, ‘কেউ আমার কাজে নাক গলাতে গেলে খুব আপত্তি তোলে। একটু অপেক্ষা করো, চৌকো সব মাংসের টুকরো হবে তুমি। আমাদের অবশ্য খারাপ লাগবে না দৃশ্যটা দেখতে।’

প্রভুর প্রশংসা পেয়ে চিকচিক করে উঠল রুডলফের শুয়োরের মত কুঁতকুঁতে দু’চোখ। ডান থেকে বামে কুঠার চালাল সে। ঠিক সময়ে রানা না সরলে কাটা পড়ত ওর গলা। পাশ থেকে কুঠার চালিয়ে নিজেও ভারসাম্য রাখতে না পেরে ঘুরে গেছে রুডলফ। দেরি না করে সামনে বেড়ে সুযোগটা নিল রানা। দানবটা বিশাল হলেও পোয়াতী মোষের মতই ধীরগতি। গুলির সময় যেন কাঁধে খুব জোরে ব্যথা না লাগে, সেজন্যে বন্দুকের আমেরিকান কালো ওয়ালনাট কাঠের বাঁটের শেষে রয়েছে শক্ত রাবারের প্যাড, ধাঁই করে ওটা রুডলফের নাকে-মুখে নামাল রানা। ভীষণ ব্যথা পেয়ে কেঁউ করে উঠল দানব। ভাবতে পারেনি এমন মারাত্মক আঘাত হানতে পারে পুঁচকে এই লোকটা। বন্দুকের কুঁদোর এক ঘায়ে খসে গেছে দৈত্যের অন্তত পনেরোটা দাঁত। টেরও পেল না, কখন হাত থেকে মেঝেতে পড়েছে কুঠার। ঝড়ে পড়া জাহাজের মত টলমল করে উঠে দুই হাতে মুখ চেপে ধরল সে।

বিদ্যুদ্বেগে এগোল রানা। বন্দুকের কুঁদো প্রচণ্ড জোরে পড়ল এবার দানবের গলায়, ঠিক কণ্ঠার ওপর। খুন করতেই হামলা করেছে বিসিআই এজেন্ট। বন্দুকের সাত পাউণ্ডের কাঠ ও স্টিল তো আছেই, সঙ্গে রয়েছে ওর এক শত ষাট পাউণ্ডের ওজন— ভচ্ করে ভেঙে গেল রুডলফের শ্বাসনালী। কুঠার দিয়ে কাটা ওক গাছের মত দড়াম করে মেঝেতে পড়ল লোকটা। দুই হাতে খামচে ধরেছে গলা। ছটফট করতে করতে শ্বাস নিতে চাইলেও আর কখনও বুক ভরে বাতাস নিতে পারবে না দানব।

টিনের ছাতের মস্ত ঘরে বিকট আওয়াজ তুলল পিস্তলের গুলি। রানা যখন দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করতে ব্যস্ত, সেসময়ে সামনে বেড়ে নিজের পিস্তল কুড়িয়ে নিয়েছে প্যাট্রিক। তবে তাড়াহুড়ো করেছে বলে রানার দুই ফুট দূর দিয়ে গেছে গুলি।

অবশ্য, ওদের বড়ভাই রিচি এমন ভুল করবে না। প্র্যাকটিস করা হাতে কোমরের হোলস্টার থেকে চকচকে স্টিলের বড় একটা অটোমেটিক পিস্তল বের করেছে সে।

সরে যাওয়ার জন্যে মাত্র এক সেকেও পাবে রানা, তাতে কোনও ভুল হলে খুন হবে নির্ঘাত!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *