1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ২৪

চব্বিশ

গতরাতে রানাকে বলেছে এলিসা, বাড়িতে বসে লেখাপড়া করছে বলে রনের জন্যে প্রাইভেট টিউটর রাখা হয়েছিল। তাঁর নাম প্রফেসর ম্যাকগাইভার। তবে অতিরিক্ত মদ্যপান করেন বলে শেষপর্যন্ত তাঁকে বরখাস্ত করেছে জোসেফ। এরপর থেকে ছেলেকে নিজেই পড়াচ্ছে সে।

লুইযিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ইতিহাস বিভাগে টানা ছাব্বিশ বছর শিক্ষকতা করেন প্রফেসর জ্যাক ম্যাকগাইভার। এর ভেতর বহুবার মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানের জন্যে তাঁকে সতর্ক করা হয়েছে। তিনি কারও কথা শোনেননি, তাই একসময় বরখাস্ত করা হয় তাঁকে। কাজ হারিয়ে সোজা ফেরেন ক্লোভিস প্যারিশে পূর্বপুরুষদের পুরনো বিশাল বাড়িতে। তারপর থেকে ওখানেই বাস করছেন একা। কোনও কিছুতে তাড়া নেই তাঁর। সামনের বারান্দায় বসে মদ্যপান করে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছেন মৃত্যুর কবলে।

প্রফেসর ম্যাকগাইভারের মত মানুষগুলোর উচ্ছৃঙ্খলতা দেখে একটা কথা ছড়িয়ে গেছে দক্ষিণে: এসব লোকের কাছে আছে ওল্ড মানি। গত কয়েক পুরুষ ধরে ম্যাকগাইভারেরা ছিল অভিজাত পরিবার। অভাব ছিল না টাকা-পয়সার। প্যারিশের নানান জায়গায় ছিল আখের প্ল্যান্টেশন ও দামি কাঠের গাছ ভরা জঙ্গল। তবে আজ আর পূর্বপুরুষদের গড়ে দেয়া সেই প্রাচুর্য নেই। একে একে বিক্রি হয়েছে নানান সম্পত্তি। তবে ব্যাঙ্কে এখনও ম্যাকগাইভারের জন্যে রয়ে গেছে চলার মত যথেষ্ট টাকা। আজকাল সেটা ভেঙেই দিনরাত উইস্কি গিলে চলেছেন তিনি। যারা তাঁকে চেনে, ধরে নিয়েছে যে-কোনও দিন বেশি মাতাল হয়ে ব্রেইন স্ট্রোক করে বারান্দার রকিং চেয়ারে মরে পড়ে থাকবেন তিনি।

‘খুবই দুঃখের কথা, এত প্রতিভাবান একজন মানুষ এভাবে নিজেকে শেষ করে দিচ্ছেন,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে এলিসা। ‘টিচার হিসেবেও তুলনা নেই তাঁর। তবে বেশি মাতাল হলে তখন আর কোনও কথাই বলতে পারেন না।’

এলিসা ব্যাখ্যা করে বলেছে, প্রফেসরের পড়ানোর ভঙ্গি খুবই পছন্দ করত রন। তবে সমস্যা হলো, পড়াশোনা দেখিয়ে দেয়ার সময়েও মাতালামি করতেন তিনি। তাঁর মত জ্ঞান না থাকলেও বাধ্য হয়ে মানুষটাকে বাদ দিয়ে নিজেই রনকে ইতিহাস পড়াতে লাগল জোসেফ। ইতিহাস বুঝিয়ে দেয়ায় খারাপ করছে সে, তা-ও নয়। আর প্রফেসরের তো কথাই নেই, মগজটা একেবারে এনসাইক্লোপিডিয়ার মত।

‘ওই লোক এরই ভেতর ভেজিটেবল না হয়ে গেলে হয়তো সাহায্য করতে পারবেন,’ বলেছে জোসেফ। ‘মনে রেখো, আমাদের সঙ্গে তাঁর শেষ দেখা হয়েছে অন্তত দুই বছর আগে। ঈশ্বর জানেন, এত দিনে নিজের কী হাল করেছেন তিনি।’

এবি পামবোর ওখান থেকে বেশ রাতে হোমস্টিডে ফিরে রানাকে বাড়িতে রেখে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে এসেছে জোসেফ আর এলিসা। তার আগে বয়স্ক মানুষগুলোকে আবারও অনুরোধ করেছে, যাতে আগামীকাল সকালে আরও কয়েক ঘণ্টার জন্যে বাচ্চাদের সময় দেন তাঁরা। তাতে খুশি মনেই রাজি হয়েছেন বয়স্ক দম্পতি। ঠিক হয়েছে, আগামীকাল সকালে রওনা হওয়ার আগে পিচ্চি রব আর টিনাকে বেবি সিটিঙের জন্যে তাঁদের কাছে রেখে যাবে গুডরিচরা।

গভীর রাতে একসঙ্গে বসে ডিনার সেরেছে ওরা। এরপর যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেও হাজার চিন্তার ভিড়ে সারারাত একফোঁটা ঘুমাতে পারেনি রানা। বারবার ভেবেছে: এখানে রয়ে গিয়ে মস্ত বিপদে ফেলছে গুডরিচদেরকে। নীরবে বিদায় নিত, তবে রয়ে গেছে একটা কারণে। এবি পামবোর কথাগুলোর মাঝে রয়েছে কিছু ফাঁক। সেগুলো খোলাসা করেননি তিনি। সেগুলো হয়তো জানাতে পারবেন মা ইতিহাসবিদ। তাই রানা ঠিক করেছে, আগামীকাল দুপুর পর্যন্ত এখানে রয়ে যাবে।

পরদিন সকালে রব আর টিনাকে রেখে আসা হলো ডেসমণ্ড ও রোণ্ডা ম্যালয়ের বাড়িতে। রানাকে নিয়ে রওনা হলো জোসেফ ও এলিসা। তবে এবার ওদের সঙ্গে রয়েছে কিশোর রন। ওকে নেয়া হয়েছে প্রফেসরের মন উইস্কি থেকে সরাবার জন্যে। প্রিয় ছাত্রকে দেখলে হয়তো ঢকঢক করে বোতলের পর বোতল উইস্কি গিলবেন না তিনি।

গাড়ি নিয়ে আধ মাইল পেরোতেই রিয়ার ভিউ মিররে ছেলেকে দেখল জোসেফ। সঙ্গে সঙ্গে কুঁচকে গেল ভুরু। কম্পাউণ্ড ধনুক আর তূণ হাতে পেছন সিটে বসেছে রন। ‘ওগুলো সঙ্গে কেন, রন?’

‘পুলিশ বা খারাপ কারও সঙ্গে দেখা হলে রক্ষা করব মিস্টার রানাকে,’ সোজাসাপ্টা জবাব দিল রন।

‘লাগবে না ওটা,’ নরম সুরে বলল রানা।

আরও শক্ত হাতে ধনুক ধরল রন।

‘গোঁয়ার,’ মুচকি হাসল জোসেফ। ‘ওর বাপের মতই।’

কাডাহাডাচো ক্রিক থেকে মাত্র সোয়া বারো মাইল পুবে ম্যাকগাইভার ভবন। তবে পুলিশ রোডব্লকের জন্যে হয়তো কঠিন হবে ওখানে পৌছুনো। নিজের বিপদ হবে সেজন্যে নয়, গুডরিচদের কথা ভেবে ভীষণ অস্বস্তি বোধ করছে রানা।

অবশ্য পথে কোনও বিপদ হলো না। হাইওয়ে এড়িয়ে সরু এক পথে সকাল দশটায় এলিসার ছোট্ট গাড়ি পৌঁছুল প্রফেসর জ্যাক ম্যাকগাইভারের এস্টেটে। হাট করে খোলা লোহার গেট পেরোল ওরা। গাছের সারি পেছনে ফেলে বাঁক নিতেই সামনে পড়ল পুরনো আমলের বিশাল এক সাদা ম্যানশন। উঠান ও ড্রাইভওয়েতে ঘন হয়ে জন্মেছে ঝোপঝাড়। দ্বিতীয়বার না দেখেও যে-কেউ বুঝবে, গত কয়েক দশকে মেরামত করা হয়নি প্রকাণ্ড বাড়িটা। দেয়াল থেকে খসে পড়েছে রঙ। ক্রমে চারদিক থেকে বাড়ির দিকে চেপে এসেছে জঙ্গল। ওদিকে খেয়াল নেই কারও। রানার মাথায় চিন্তা এল: ম্যানশনের যে হাল, ওটার মালিক কী আর সুস্থ আছে?

এলিসার গাড়ি বাড়ির সামনে রাখতেই নেমে পড়ল ওরা চারজন। ‘ওই যে প্রফেসর!’ বলে উঠল রন।

এইমাত্র একতলার সদর দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন এলোমেলো পোশাক পরা বয়স্ক এক লোক। তাঁর বয়স বড়জোর ষাট হলেও দেখাচ্ছে পঁচাশি। ধূসর রঙের একহাত দীর্ঘ চুল-দাড়ি। আগে বোধহয় গায়ের শার্টটা মেঝে মোছার কাজে লাগত, এমনই নোংরা। ডানহাতে প্রায়-খালি মদের বোতল। অন্যহাতে সোনালি তরলে ভরা গ্লাস। অবাক চোখে রানাদেরকে দেখলেন তিনি। ভাবতে পারেননি তাঁর বাড়িতে কেউ আসতে পারে। দাঁড়াতে গিয়ে টলমল করছেন।

‘যাব্বাবা!’ মনে মনে বলল রানা। ‘এ তো পুরো মাতাল!’

‘আজ বোধহয় ভোর থেকেই শুরু করেছেন,’ নিচু গলায় বলল জোসেফ। ‘অথবা রাতে আর ঘুমাতে যাননি।’

‘অ্যাই, চুপ!’ ফিসফিস করে স্বামীকে বকল এলিসা। পরক্ষণে চওড়া হাসি দিয়ে প্রফেসরের দিকে হাত নাড়ল। ‘কেমন আছেন, প্রফেসর! কী দারুণ সুন্দর সকাল, কী বলেন, স্যর? আপনার জন্যে কয়েকটা ডিম নিয়ে এসেছি।’

অতিথিদেরকে স্বাগত জানাতে গিয়ে কাঠের জীর্ণ বারান্দায় বেরোলেন প্রফেসর। রোদে যেভাবে চোখ পিটপিট করছেন, মনে হলো গত একসপ্তাহ ছিলেন গাঢ় অন্ধকারে। দরজা থেকে আরও তিন পা এগোতেই মচাৎ আওয়াজে ধসে গেল তাঁর পায়ের নিচে বারান্দার পচা তক্তা। মুহূর্তে গ্লাস, বোতল আর নিজের মোটা শরীর নিয়ে সাঁই করে পাতালমুখী হলেন তিনি। ভাঙা বারান্দার নিচ থেকে ভেসে এল করুণ গোঙানি: ‘ওরে, বাবা! এ আবার কী হলো? আমি কোথায়?’

গর্ত থেকে প্রফেসরকে টেনে তুলতে রানা আর জোসেফের লাগল তিন মিনিট। পুরো সময় চোখে আতঙ্ক নিয়ে ওদের কাজ দেখল এলিসা। দারুণ মজা পেয়েছে রন। ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি। তবে আস্ত উদ্ধার করার পর দেখা গেল প্রফেসরের কিছুই হয়নি। এদিকে আছাড় খেয়ে নেশাও কমে গেছে। মাথার চুল থেকে ঝেড়ে ফেললেন পচা কাঠের টুকরো। তার ফাঁকে তাঁকে রক্ষা করেছে বলে জোসেফকে বারবার ধন্যবাদ দিতে লাগলেন।

‘আশা করি এভাবে আপনার বাড়িতে এসে হাজির হয়েছি বলে কিছু মনে করেননি, প্রফেসর,’ বলল এলিসা।

‘না-না, একদমই না,’ বললেন প্রফেসর ম্যাকগাইভার। ‘আজকাল তো কেউ আসেই না। তাই এলে খুশিই হই। ওহ্! ডিমগুলো তো খুব সুন্দর! অনেক ধন্যবাদ! প্লিয, আসুন, ভেতরে গিয়ে বসি। তবে ওই গর্ত থেকে সাবধান! পরে মেরামত করিয়ে নেব। আরে, রন, বাছা! তুমি তো গত ক’দিনে বেশ বড় হয়ে গেছ!’

এত ঝামেলার ভেতর প্রফেসরের মগজে খেলেনি, সঙ্গে করে এক অচেনা লোককে এনেছে গুডরিচরা। এবার হুঁশ হলো। ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখলেন ম্যাকগাইভার। ‘আমার তো মনে হয় না আগে কখনও এঁকে দেখেছি। কী হতে পারে এঁর নাম?’

‘রেইনার,’ বলল রানা। ‘মরিস রেইনার।’

‘আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান বলে তো মনে হচ্ছে না।’

‘আমাদের অতিথি,’ বলল জোসেফ। ‘উনি এসেছেন সুদূর বাংলাদেশ থেকে।’

‘জেনে খুব খুশি হলাম,’ রানার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করলেন প্রফেসর। ‘আমার পরনে ভাল পোশাক নেই বলে মাফ করবেন। ভাবতেই পারিনি অতিথি আসবেন।’

একটু পর রানা বুঝল, টিভি বা খবরের কাগজ থেকে সাত সাগর তেরো নদী দূরে কল্পনার অদ্ভুত এক রাজ্যে বাস করেন প্রফেসর। মদের বোতল গিলে নিয়েছে তাঁর বেশিরভাগ সময়।

অগোছালো বড় এক কিচেনে ঢুকে ওরা দেখল, অন্তত বারোটা বেড়াল বাস করে ওখানে। একদিকের কোণে স্তূপ করা হয়েছে উইস্কির খালি কার্টন। সবকিছুর ওপর জমেছে পুরু ধুলো আর বেড়ালের রোম। বাড়ির ভেতর কেমন চিমসে দুর্গন্ধ। রানার মনে গভীর সন্দেহ জন্মাল, একটু বেশি মাতাল হলে যে-কোনও জায়গায় হিসু করেন প্রফেসর। প্রায় জোর করেই কফি তৈরির কাজে নামল এলিসা। কাবার্ড ঘাঁটতে লাগল কফি আর চিনির খোঁজে।

এদিকে ধুলোভরা দীর্ঘ একটা টেবিল দেখালেন প্রফেসর। যে যার মত বসতে গিয়ে চমকে গেল সবাই। রানার চেয়ারে ছিল মোটা এক বেড়াল। সাপের মত ফোঁস করে উঠে একলাফে কিচেনের আরেকদিকে গিয়ে পড়ল ওটা।

রানা বসতেই জানতে চাইলেন প্রফেসর ম্যাকগাইভার, ‘খুব খুশি হয়েছি, তবে কেন যেন মনে হচ্ছে জরুরি কোনও কাজেই দেখা করতে এসেছেন আপনারা।’

‘মরিস একজন লেখক, রানার আগে থেকে বলে দেয়া মিথ্যাটা ঝেড়ে দিল জোসেফ।

‘লেখক?’ রক্তলাল চোখে রানাকে দেখে নিয়ে হাসলেন প্রফেসর।

‘আমার ফিল্ড হিস্টোরিকাল নন-ফিকশন,’ বলল রানা। ‘লিখতে শুরু করেছি মাত্র কিছু দিন আগে।’

‘প্রফেসর, কথায় কথায় রেইনারকে বলেছি, ওর বইয়ের বেশকিছু বিষয় খুব ভাল করেই বোঝাতে পারবেন আপনি।’

‘উপায় থাকলে দ্বিধা করব না সাহায্য করতে,’ বললেন ম্যাকগাইভার। ‘রেইনার, আপনি তা হলে আমার ভাইয়ের মতই। আমি নিজেও বেশ কিছু বই লিখেছি।’ পাশের বুক শেল্‌ফ্ দেখালেন তিনি।

ওখানে রয়েছে বিশটার বেশি মোটা ভলিউম। সবগুলোর ওজনে টুপ করে ডুববে মাঝারি আকারের নৌকা। তবে আজকাল আর বাজারে পাওয়া যায় না এসব বই। প্রফেসরি করার স্বর্ণ যুগে এসব লেখেন ম্যাকগাইভার। বাড়ি থেকে রওনা হওয়ার আগে কয়েকটা ভলিউম রানাকে দেখিয়ে নিয়েছে জোসেফ। ভিলেনিউভ শহরে সেকেণ্ড হ্যাণ্ড বইয়ের দোকান থেকে কিনেছিল। সতেরো শত চুয়ান্ন থেকে তেষট্টি সালের ফ্রেঞ্চ ও রেড ইণ্ডিয়ানদের যুদ্ধের কথা লেখা আছে ওগুলোর একটায়। ঠাস বুনটে লেখা বইটির পৃষ্ঠা-সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। বিশেষ করে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে লেক্সিংটন যুদ্ধের বিষয়ে। বইয়ের ভেতর লেখকের বিবলিওগ্রাফি পড়ে রানা জেনেছে, মস্তবড় পণ্ডিত এই প্রফেসর জ্যাক ম্যাক- গাইভার। তবে এ-ও ভেবেছে, রিসার্চ লাইব্রেরির বাইরে খুব কম মানুষই পড়েছে তাঁর বই।

‘আপনার তো তুলনা হয় না, স্যর,’ সম্মানের সঙ্গে বলল রানা। ‘আপনার মত একজন জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে দেখা করতে পেরে খুবই সম্মানিত বোধ করছি।’

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় ভাল করেই জেনেছে রানা, দুনিয়ার বেশিরভাগ অ্যাকাডেমিক পাম্প খেয়ে বেলুনের মত ফুলে গেলেও কখনও ভেবে দেখেন না, আসলে কীজন্যে তাঁকে এত হাওয়া দেয়া হচ্ছে। এলিসা কড়া কফির মগ নিয়ে টেবিলের কাছে আসার আগেই প্রফেসর ম্যাকগাইভার হয়ে গেলেন রানার বুযম ফ্রেণ্ড! ‘বলো তো, তরুণ বন্ধু, তোমার জন্যে কী করতে পারি? দুনিয়ায় এমন কিছু নেই, যেটা তোমার জন্যে করতে দ্বিধা করব আমি।’

এবার সুযোগ পেয়ে নিজের বইয়ের ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিল রানা। আমেরিকার কৃষ্ণাঙ্গিনী এক তরুণীর ওপর বিশেষ আলোকপাত করতে চায়। সেই মেয়ে ছিল গৃহযুদ্ধের সময় একজন গুপ্তচর। ‘আসলে সবাই তো বিখ্যাত হ্যারিয়েট টুবম্যান বা মেরি এলিযাবেথ ব্রাউযারের কথা বহুবার শুনেছে,’ পাকা ইতিহাসবিদের ভঙ্গিতে বলল রানা। ‘তাই ভাবলাম, আমি আলোকপাত করব অপেক্ষাকৃত কম খ্যাত গুপ্তচরদের ওপর। যেমন ওই শেলি লং ল্যান্স।

প্রশিক্ষিত মিলিটারি স্নাইপার এবং কাউন্টার স্নাইপার হিসেবে কাজ করতে অভ্যস্ত রানা। এবারও বহু দূর থেকেই বুলেট ছুঁড়েছে টার্গেটে। বেশি আগ্রহ না দেখিয়েই জানিয়েছে শেলি লং ল্যান্সের কথা। জরুরি কোনও তথ্য থাকলে তাতেই কাজ হবে ভেবেছে। আগামী কয়েক মুহূর্তে প্রফেসর যদি বলেন, ‘না তো, রেইনার, বাপের জন্মেও শুনিনি শেলি লং ল্যান্সের নাম,’ তা হলে মাঠে মারা পড়বে ওর সব প্রচেষ্টা।

ঘরে নেমেছে থমথমে নীরবতা। অনুভূতিহীন চেহারায় নিজের হাতের তালুর দিকে চেয়ে আছেন প্রফেসর। পেরিয়ে গেল প্রায় পঁচিশ সেকেণ্ড। রানা বুঝে গেল, টার্গেটের অন্তত হাজার ফুট দূর দিয়ে গেছে ওর গুলি। চোখে সম্মান নিয়ে প্রাক্তন শিক্ষকের দিকে চেয়ে আছে কিশোর রন। পরস্পর চোখাচোখি করছে এলিসা আর জোসেফ।

পুরো একমিনিট পর ফোলা হাতে কফির মগ নিলেন প্রফেসর ম্যাকগাইভার। নাকের কাছে নিয়ে বার কয়েক শ্বাস, নিলেন। রানার ধারণা হলো, কফির মগের ভেতর উইস্কির প্রিয় গন্ধ খুঁজছেন ভদ্রলোক। একবার চুমুক দিলেন কড়া তরলে।

অধৈর্য হয়ে গেছে রানা। নরম সুরে জানতে চাইল, ‘এ ব্যাপারে কিছু বলবেন, প্রফেসর?’

হাতের চেটো দিয়ে ঠোঁট মুছলেন ম্যাকগাইভার। টেবিলে মগ নামিয়ে রেখে বললেন, ‘আসলে, রেইনার, রিসার্চ করতে গিয়ে এরই ভেতর বহু দূর এগিয়ে গেছ তুমি। আমি অবাক না হয়ে পারিনি। আজকালকার কোনও ছেলে জানতেই চায় না গৃহযুদ্ধের সময় কী অবস্থান ছিল দক্ষিণ আর উত্তরের স্টেটগুলোর। বা কী ভূমিকা ছিল শেলি লং ল্যান্সের।

‘আপনি তো, স্যর, আমার ধারণা ওই বিষয়ে দুনিয়ার সেরা অ্যাকাডেমিক,’ আবারও বেলুনের মুখে ফুঁ দিল রানা।

‘ঘটনা এদিকের এলাকার, না জেনে উপায় কী? গোটা ব্যাপারটার ভেতর নাটকীয়তারও শেষ ছিল না। তোমার হাতে যথেষ্ট সময় থাকলে, সব খুলে বলতে আপত্তি নেই আমার। আসলে এতদিনে শেলি লং ল্যান্সের নাম ভুলেই যেত সবাই, কিন্তু মনে রেখে দিয়েছে অন্য কারণে।’

বহু বছর ধরেই মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপান করে নিজের বারোটা বাজিয়ে ছেড়েছেন প্রফেসর জ্যাক ম্যাকগাইভার। তবে এখনও ভেজিটেবল হয়নি তুখোড় মগজটা। ভদ্রলোক অদ্ভুত এক কাহিনী বলতে শুরু করায় তাঁর কথায় পূর্ণ মনোযোগ দিল রানা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *