1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৪৫

পঁয়তাল্লিশ

উপড়ে যাওয়া এক গাছের কাণ্ডের ওপরে রাইফেলের নল রেখেছে পুলিশের মার্কসম্যান। নিজে আছে ঝোপের ভেতর। সামনে থেকে কেউ এলে পরিষ্কার তাকে দেখবে সে। অবশ্য পেছন থেকে কেউ এলে সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

ট্যাকটিকাল সিচুয়েশনে কোনও কিছু নিশ্চিত ধরে নেয়া মস্তবড় ভুল। তা ছাড়া, স্নাইপারের আস্তানা থেকে কখনোই তিরিশ ডিগ্রির বেশি দেখতে চাওয়া অনুচিত। তাতে উল্টে নিজেদের লোকের গায়ে গুলি বিধিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তার চেয়েও খারাপ কাজ মাথা থেকে ট্যাকটিকাল হেলমেট খুলে অস্ত্র রেখে ডিউটির সময় ধূমপান করা।

পুলিশের স্নাইপার একেবারেই অদক্ষ, ভাবল রানা।

গাছের আড়াল নিয়ে পা টিপে এগোল ও। মাত্র তিন মিনিট পর পৌঁছুল টার্গেটের পেছনে। আশপাশে কেউ আছে তা বুঝল না লোকটা। তবে যখন টের পেল পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে কেউ, ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। স্নাইপারের কলার চেপে ধরে হেলমেটটা খটাস্ করে তারই কপালে নামাল রানা। এতই ব্যথা পেল লোকটা, একেবারে হতভম্ব হয়ে গেল। পরক্ষণে তাকে চোক হোল্ডে ধরল রানা। নিজেকে ছুটিয়ে নেয়ার উপায় নেই লোকটার। মাত্র আট সেকেণ্ডে বুজে গেল সামনের কর্টেক্স। নবম সেকেণ্ডে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল স্নাইপার। তাকে নিয়ে এখন আর ভাবতে হবে না। তার ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট ছিড়ে দুটো ফিতার মত কাপড় সংগ্রহ করল রানা। প্রথমটা গোল পাকিয়ে পুরে দিল হাইপারের মুখে। দ্বিতীয়টা ব্যবহার করল তার মুখ বাঁধতে। লোকটার ডিউটি বেল্ট থেকে নিজের জন্যে ব্যাটনটা নিল রানা। স্নাইপারের পাউচ থেকে হ্যাণ্ডকাফ নিয়ে পাঁচ সেকেণ্ডে শেষ করল কাজ।

বিশ সেকেণ্ড পর চেতনা ফিরল লোকটার। চোখ মেলে দেখল হ্যাণ্ডকাফ আর বেল্ট দিয়ে আটকে ফেলা হয়েছে দুই কবজি ও দুই গোড়ালি। কোথাও যাওয়ার উপায় নেই তার!

বড় বড় চোখে চারপাশ দেখল স্নাইপার। কাছেই রানাকে দাঁড়ানো দেখে আঁৎকে উঠল। টিশটিশে ব্যথা থেকে বুঝল, ফুলে গেছে কপাল। তার রাইফেলটা হাতে তুলে নিয়েছে রানা। ওটা নতুন মডেলের আরএসএএসএস বা রেমিংটন সেমি-অটোমেটিক স্নাইপার সিস্টেম। এআর১৫ রাইফেলকে অনুসরণ করে তৈরি। ম্যাগাযিনে বিশটা বুলেট। সাধারণ মানুষের জন্যে বাজারে পাওয়া যায় না এই অস্ত্র। ম্যাগাযিন খুলে ওটা থেকে নিয়ে বুলেটগুলো নানান দিকের ঝোপে ফেলল রানা। কাছের গাছে ঠাস্ করে বাড়ি দিল রাইফেলের নল। ফলে অস্ত্রটা দেখতে হলো সাগর কলার মত বাঁকা।

‘এবার কোনাকুনি গুলি ছুঁড়তে পারবে,’ হাইপারকে জানাল রানা। জবাবে গোঁ-গোঁ করল লোকটা। ধুলোবালিতে গড়িয়ে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে। কাজটা অসম্ভব।

এক পলক তাকে দেখে নিয়ে জঙ্গলের অন্যদিকে চলল রানা। গুডরিচদের বাড়িকে বৃত্তের মাঝে রাখলে চারপাশে আছে একত্রিশ হাজার বর্গগজ। বাড়ির চারদিকের অন্তত এক শ’ গজ জঙ্গল বিপজ্জনক। গাছ ও ঝোপের মাঝ দিয়ে অদৃশ্য এক ঘড়ির কাঁটা অনুসরণ করল রানা। ধরে নিয়েছে ফিল্ড অভ ফায়ারের সীমানায় থাকবে তিন থেকে চারজন স্নাইপার। সঠিক সব জায়গায় অবস্থান নেবে, যাতে নিজেদের ভেতর ক্রসফায়ার শুরু না হয়।

আবারও হিসেব মিলে গেল রানার।

প্রথম স্নাইপারের অবস্থানকে যিরো ডিগ্রি ধরে নিলে দ্বিতীয় স্নাইপারকে পেল রানা ষাট ডিগ্রিতে। এক শত পঞ্চাশ ডিগ্রিতে তৃতীয়জন। এ দু’জন বোকার মত সিগারেট ফুঁকছে না। পুরো মনোযোগ কাজের প্রতি। কিন্তু তাতেও রক্ষা পেল না তারা। অদৃশ্য ভূতের মত হাজির হলো রানা। উভয় ক্ষেত্রে জ্ঞান হারাতে দুই স্নাইপার সময় নিল বড়জোর দশ সেকেণ্ড করে। প্রতিবার পেছন থেকে এসেছে রানা। ব্যাটনের কঠিন বাড়ি মেরে ঠাণ্ডা করে দিয়েছে তাদেরকে। ওদেরই বেল্ট ও হ্যাণ্ডকাফ ব্যবহার করে বেঁধে ফেলেছে তাদের হাত-পা।

এই তিন স্নাইপারের জন্যে দুঃখই লাগছে রানার। মুক্ত হওয়ার পর লজ্জায় লাল হবে এদের মুখ। তবে এ থেকে হয়তো বুঝবে শুধু ট্রেইনিং পেলেই হবে না, সম্যক অভিজ্ঞতা অর্জন করাও খুব জরুরি।

বৃত্তের অন্য অংশ সাবধানে ঘুরে দেখল রানা। বাদ গেল না গুডরিচদের ড্রাইভওয়ে। কাজটা শেষ হওয়ায় বুঝল, চতুর্থ স্নাইপার নেই।

আবারও তৃতীয় স্নাইপারের কাছে ফিরল রানা

সে ঘুমিয়ে আছে ঝোপের ভেতর। একটু দূরেই তার আরএসএএসএস রাইফেল। ওটার ক্ষতি করেনি রানা। বসে রাইফেলের স্কোপের ভেতর দিয়ে তাকাল গুডরিচদের বাড়ির দিকে। কোথাও কোনও নড়চড়া নেই। শব্দ বলতে ওদিকের খাঁচা থেকে এল মুরগির কক-কক আওয়াজ। ওকে ধরতে কতজন ট্রুপারকে সঙ্গে এনেছে শেরিফ শেরিড্যান, কে জানে!

তবে এবার সময় হয়েছে সংখ্যা জেনে নেয়ার।

রাইফেল রেখে ব্যাগ নামিয়ে পরের কয়েক মিনিটে তৈরি হয়ে নিল রানা। কাজটা শেষ হতেই আবারও নিল রাইফেল। কাউকে গুলি করবে না। লড়াই করতেও এখানে আসেনি। রাইফেলের নল আকাশে তাক করে সেফটি ক্যাচ অফ করল রানা। পরক্ষণে টান দিল ট্রিগারে।

হাই-ভেলোসিটি রাইফেলের বিকট গর্জনে খানখান হলো চারপাশের নিস্তব্ধতা। মাত্র ক’সেকেণ্ডে খালি হলো বিশ রাউণ্ডের ম্যাগাযিন। যে-কেউ ভাববে, যুদ্ধ লেগেছে কাডাহাডাচো ক্রিক এলাকায়। কর্কশ আওয়াজ ছেড়ে গাছ থেকে উড়াল দিয়েছে এক দঙ্গল পাখি। ভীষণ ভয় পেয়ে ডানা নেড়ে পালাতে চাইছে গুডরিচদের মুরগিগুলোও। মাসুদ রানাকে গ্রেফতারের জন্যে লুকিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ বেরিয়ে এসেছে ড্রাইভওয়েতে। মস্তবড় গোলাঘর থেকে বেরোল দু’জন। তিনজন গেল ছাউনির ভেতর। ওখানেই থাকে জোসেফের গাড়ি। দুই পুলিশ অফিসার এল বাড়ির দু’দিক থেকে। পিস্তল ও বন্দুক হাতে পরস্পরের ভেতর আলাপ করছে সবাই। তারা লুইযিয়ানার সেরা পুলিশ সদস্য। কাজ বুঝে নিতে দেরি হলো না কারও

রাস্তা থেকে এসে গুডরিচদের উঠানে ঢুকল পুলিশের দুটো ডজ চার্জার গাড়ি। তীক্ষ্ণ আওয়াজে বাজছে সাইরেন। ছাতে জ্বলছে নীল আলো। দুই গাড়ির পিছু নিয়ে এল বিশাল আকারের ছয় চাকাওয়ালা কালো এক প্যারামিলিটারি ভেহিকেল। ওটার সামনে পোক্ত র‍্যামিং বার। গাড়ির দু’দিকে বড় করে লেখা: শেরিফ। কড়া ব্রেক কষে পুলিশের দুই গাড়ির মাঝে থামল দানবের মত গাড়িটা।

আগেই স্নাইপার রাইফেল রেখে ধনুক হাতে নিয়েছে রানা। তৃণে মাত্র তিনটে তীর, প্রতিটায় জড়ানো আছে স্টিল উল। নোভাকদের ডিসটিলারিতে ওয়াকি-টকির ব্যাটারি ও জালের মত স্টিল উল কাজে লেগেছিল। এবার দেখা যাক এখানেও একই কৌশল খাটে কি না। পুলিশদের গাড়ি উঠানে ঢুকতেই ধনুকের ছিলায় তীর জুড়ে নিয়েছে। একটানে কানের কাছে নিল ছিলা। ব্যাটারির টার্মিনাল তীরের ডগা স্পর্শ করতেই লাল আগুন জ্বলে উঠল স্টিল উলের গায়ে। একটা পুলিশের ডজ গাড়ির পেছনদিকে তাক করে তীর ছুঁড়ল রানা। স্যাৎ করে গিয়ে গাড়ির পাতলা বড়ি ভেদ করল তীর। তবে নিখুঁত হয়নি লক্ষ্যভেদ। ফিউয়েল ট্যাঙ্কের ঢাকনি ভেদ না করে দুই ইঞ্চি দূরে লেগেছে জ্বলন্ত শলাকা।

অবশ্য তাতেই কাজ হলো। পেট্রল ট্যাঙ্কের ভেতর স্টিল উলের আগুন ঢুকতেই কমলা আগুন ধরে গেল গাড়িতে। দরজা খুলে মাটিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল ভেতরের দুই পুলিশ। ধুলোর ভেতর গড়াতে শুরু করেছে। কাপড়ের আগুন নিভে যেতেই উঠে দৌড় দিল নিরাপদ জায়গা লক্ষ্য করে। আমড় সোয়াট গাড়ির পেছন থেকে লাফ দিয়ে নেমেছে মিলিটারি পোশাক পরা ট্রুপাররা। কাঁধে অস্ত্র তুলে নানান দিকে খুঁজছে টার্গেট। এ দলকে সাধারণ পুলিশের চেয়ে দক্ষ বলে মনে হলো রানার। পুলিশের লোক ধরে নিয়েছে হামলা হয়েছে তাদের ওপর। এদিক ওদিক গুলি করছে তারা। রানার মাথার ওপর দিয়ে গেল দুটো বুলেট। তৃতীয়টা লাগল ছয় ফুট দূরের এক গাছের কাণ্ডে। কপাল নিতান্ত খারাপ না হলে আহত হওয়ার কথা নয় রানার। কেউ জানে না কোথা থেকে এসেছে তীর।

ধনুকে দ্বিতীয় তীর জুড়ল রানা। ছিলা টেনে নিল কানের কাছে। ব্যাটারির টার্মিনালের স্পর্শে স্টিল উল জ্বলে উঠতেই ছেড়ে দিল ছিলা। উঠানে কালো ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে দ্বিতীয় গাড়ির পেট্রল ট্যাঙ্কে ঢুকল তীর। ফলাফল একই, তবে এবার আগ্নেয়গিরির মত বিস্ফোরিত হলো ট্যাঙ্ক। আগুনের হলকা গিয়ে পড়ল সোয়্যাট ট্রাকের ওপর। কাভার নেয়ার জন্যে নানাদিকে ছুটল ট্রুপাররা। ক্যাব থেকে নেমে ঝেড়ে দৌড় দিল ড্রাইভার। ঘন কালো ধোঁয়ার ওদিকে আড়াল নিচ্ছে সবাই। কয়েকজনকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখল রানা। খড়-খড় শব্দ তুলছে রেডিয়ো। কর্কশ গলায় চিৎকার করে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলছে পুলিশ অফিসাররা। চড়চড় আওয়াজে গাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে কমলা আগুনের শিখা।

আহত না হলেও হতভম্ব হয়েছে শেরিফের লোক। কেউ কেউ ভাবছে, উচিত ছিল সঙ্গে কুকুরের দল আনা। ভাল হতো আকাশে হেলিকপ্টার থাকলে।

উঠান ও বাড়ির দিকে তাকাল রানা। শেষ তীরটা ওর কাছে রয়ে গেলেও আপাতত কাজে লাগবে না। রনের দেয়া ধনুকটা মাটিতে রেখে আদরের ভঙ্গিতে ওটার গায়ে দুটো চাপড় দিল রানা। পরক্ষণে কাঁধে ব্যাগ তুলে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে এগিয়ে চলল বাড়ির পেছন দিক লক্ষ্য করে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *