1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ২৭

সাতাশ

ফোন নম্বর বিনিময়ের পর পরস্পরকে কথা দিয়েছে রানা আর গুডরিচরা, যোগাযোগ থাকবে ওদের ভেতর। তখনও টেবিলে মাথা রেখে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন মাতাল প্রফেসর জ্যাক ম্যাকগাইভার। বারান্দায় সূর্যের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে রানা দেখল, দূরের বাঁকে হারিয়ে যাচ্ছে এলিসার ছোট্ট গাড়ি। পেছনের সিটে বসে জানালা দিয়ে হাত নাড়ছে কিশোর রন।

ওর উদ্দেশে হাত নাড়ল রানা। তারপর বাঁকের ওদিকে চলে গেল গাড়িটা।

বিশাল এলাকা নিয়ে ম্যাকগাইভারদের এস্টেট। পুরনো বাড়িটাকে প্রায় ঘিরে ফেলেছে ওক আর সিকামোর গাছের ঘন জঙ্গল। নানান ডাল থেকে ঝুলছে লতাপাতা আর স্প্যানিশ মস। কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে দিক ঠিক করে নিয়ে জঙ্গলের মাঝ দিয়ে পশ্চিমে চলল রানা। জানা নেই অদূর ভবিষ্যতে কী ঘটবে।

পেটের জখমে আর জোরে টান পড়ছে না। ওর ডান কাঁধে ঝুলছে ব্যাগ। রানার বামহাতে হান্টিং তীরভরা তূণ আর ধনুক। সাপের ছোবল থেকে রক্ষা করেছে বলে ওটা ওকে উপহার দিয়েছে কিশোর রন।

ছেলেটার আন্তরিক আচরণে মনটা ভিজে গেছে রানার। একবার দু’বার মানা করার পর বেচারা কষ্ট পাচ্ছে বুঝতে পেরে মৃদু হেসে তীর-ধনুক নিয়েছে ও। ওটা প্রায়-নিঃশব্দ এক অস্ত্র। বিপদে পড়লে হয়তো কাজে লাগবে।

ম্যাকগাইভার এস্টেটের একদিকে তারকাঁটার বেড়ার কাছে পৌঁছে গেল রানা। একটু দূরেই সরু রাস্তা। দুপুর ঘনিয়ে এসেছে বলে ক্রমেই বাড়ছে রোদের তাপ। পরিবেশটা বিশ্রী স্যাঁতসেঁতে। গা থেকে জ্যাকেট খুলে ওটা দিয়ে ধনুক ও তূণ পেঁচিয়ে বগলের নিচে ভরল রানা।

তারকাঁটার বেড়া টপকে এগিয়ে চলল সরু পথে। কোনও গাড়ির ইঞ্জিনের আওয়াজ শুনলেই চট্ করে লুকিয়ে পড়বে সবুজ ঝোপঝাড়ের ভেতর। পরের ঘণ্টায় দুটো মালবাহী ট্রাক আর পাঁচটা গাড়ি দেখল রানা। সেগুলোর ভেতর তিনটে ক্লোভিস প্যারিশ পুলিশের ক্রুযার। অন্যটা একটা সোয়্যাট ভেহিকেল। বাতি জ্বেলে সাইরেন বাজিয়ে দ্রুত চলে গেল গাড়িগুলো। রানা ধারণা করল, ভিতু কোনও নাগরিক ফোন করেছে পুলিশের কাছে— এইমাত্র আমার বাড়ির কাছেই দেখেছি সেই ভয়ঙ্কর খুনি মাসুদ রানাকে!

আরও একঘণ্টা হাঁটার পর দূরে দেখল টিনের ছাত দেয়া নিচু একটা বড় ঘর। প্রথমে রানা ভেবেছিল, ওটা পরিত্যক্ত। তবে আরও একটু এগোবার পর দেখল জংধরা সাইনবোর্ডে লেখা: গ্রেগের পানশালা। বারের ভেতর থেকে আসছে কান্ট্রি মিউযিকের জোরালো আওয়াজ। পলকের জন্যে রানা ভাবল, এই গরমে ঠাণ্ডা দুটো বিয়ার পেলে দারুণ হয়। তবে ওখানে পা রাখলে খুন হবে স্থানীয়দের হাতে।

বারের বাইরে পার্কিং লটে তিনটে পিকআপ। দু’দিকের জং ভরা পুরনো দুই গাড়ির মালিকের টাকা নেই যে নতুন পিকআপ কিনবে। তবে রানার চোখ মাঝের চকচকে রুপালি নতুন ডজ র‍্যাম ক্রু ক্যাবের ওপর। ওটার চাকা অস্বাভাবিক বড়। একফোঁটা কাদা বা ধুলো নেই গাড়ির গায়ে। মালিক শৌখিন লোক। সামনের দিকে লাগিয়ে নিয়েছে উইঞ্চ। ছাতে স্পটলাইট।

ঝুঁকি নিয়ে বারের জানালা দিয়ে উঁকি দিল রানা। চট্ করে চিনল ডজ গাড়ির মালিককে। তার পরনে কোট। মাথায় স্টেটসন হ্যাট। পায়ে অ্যালিগেটরের চামড়া দিয়ে তৈরি বুট। সুযোগ পেলেই পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বারমেইডের গুরুনিতম্বে হাত দিচ্ছে সে। তবে খদ্দের বলে কথা, বিরক্তি প্রকাশ করছে না মেয়েটা।

দামি গাড়িচোর হিসেবে বিবেকের যে দংশন থাকত, সেটা কেটে গেল রানার। তিন মিনিট পর ঝড়ের বেগে চলল চকচকে রুপালি নতুন ডজ র‍্যাম। ওটার ফিউয়েল ট্যাঙ্ক গলা পর্যন্ত ভরা। এটা নিয়ে নাক বরাবর উত্তরে রওয়ানা দিলে ক্যানাডার অর্ধেক রাস্তা পাড়ি দিতে পারবে রানা। পেছনের সিটে একটা কাউবয় হ্যাট রাখা। ব্রিম কাত করে মাথায় ওটা চাপিয়ে নিল রানা। আনমনে ভাবল: তা হলে দেখা যাচ্ছে তুমি কঠিন ছদ্মবেশী এক বাঙালি গুপ্তচর!

গাড়িতে আছে জিপিএস ও ডিজিটাল রেডিয়ো স্ক্যানার। রেডিয়ো হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করার সময় ব্যবহার করে ডজের মালিক। এদিকের মানুষ অনেকেই ব্যবহার করে সিটিযেন’স ব্যাণ্ড। একটু পর ওটা টিউন করে স্থানীয় পুলিশ রেডিয়োর ফ্রিকোয়েন্সি ধরল রানা। জানল, ওকে ধরতে নানাদিকে রেইড দিচ্ছে ক্লোভিস প্যারিশের শেরিফ ডিপার্টমেন্টের সদস্যরা। জিপিএস ব্যবহার করে আঁকাবাঁকা এক পথে পরের গন্তব্যের উদ্দেশে চলল রানা। এড়িয়ে যাচ্ছে প্রতিটা মেইন রোড। পয়েন্ট ব্লাঞ্চের বাজার লক্ষ্য করে চলেছে চোরাই গাড়ি। রানা ঠিক করেছে, দেখা করবে মণ্টি ডয়েলের সঙ্গে। লোকটা জানেও না কেমন গাড্ডায় পড়ছে সে।

রানার অনুমান যদি ঠিক হয়, চিটিমাচায় এখনও গিজ করছে পুলিশের লোক। তাদের ধারণা, খুনের এলাকা থেকে বেশি দূরে যায়নি ও। মনে মনে তিক্ত হাসল রানা। চোখের কাছে হ্যাটের ব্রিম নামিয়ে স্বাভাবিক গতি তুলে এগিয়ে চলল। কেউ চট করে সন্দেহ করবে না ওকে। নানান কাজেই তো দূর থেকে দূরে যায় লুইযিয়ানার মানুষ। পুলিশ রেডিয়োতে এখনও বলা হয়নি চুরি হয়েছে কোনও ডজ গাড়ি। রানা বুঝে গেল, এখনও বিয়ার গিলতে গিলতে বারমেইডের পেছনে লেগে আছে ডজের মালিক।

চিটিমাচার পশ্চিমে পুলিশের আনাগোনা নেই বললেই চলে। আগের চেয়ে বেশি স্বস্তি নিয়ে পয়েন্ট ব্রাঞ্চের নির্দিষ্ট রাস্তায় পৌঁছল রানা। গাড়ি মেরামতের হাম্পি-ডাম্পি গ্যারাজ থেকে কয়েক ব্লক দূরেই রাখল গাড়ি।

চোখের কাছে হ্যাটের ব্রিম নামিয়ে গ্যারাজটার দিকে হেঁটে চলল রানা। হাতে জ্যাকেট। ওটার ভেতর শুয়ে আছে রনের তীর-ধনুক। কোনও সন্দেহ না করেই ওকে পাশ কাটিয়ে গেল কয়েকজন। দু’মিনিট পর রানা পৌছে গেল চেইন-লিঙ্কের বেড়ার সামনে। গ্যারাজের গেট খোলা। হনহন করে হেঁটে ভেতরে ঢুকল রানা।

আপাতত গ্যারাজে একা মন্টি ডয়েল। দু’দিকে বজ্রপাতের চিহ্ন দেয়া লাল একটা গাড়ির বনেট খুলে ইঞ্জিনের দিকে ঝুঁকে রয়েছে সে। যন্ত্রদানবটা সত্তর দশকের পশ্চিয়াক ফায়ারবার্ড অথবা শেভি ক্যামারো। আমেরিকা ছাড়া অন্য কোনও দেশে এমন হামবড়া গাড়ি দেখলেই সন্দেহের চোখে মালিকের দিকে তাকাবে পুলিশের লোক।

নিঃশব্দে মণ্টি ডয়েলের পেছনে পৌঁছুল রানা। বনেটের নিচে মাথা আর কাঁধ দুটো ঢুকিয়ে রেঞ্চ দিয়ে ইঞ্জিনে কী যেন করছে লোকটা। ‘এতেই হওয়ার কথা, বিড়বিড় করল। বনেটের তলা থেকে বেরোতে চাইল। কিন্তু তখনই ঘাড় ধরে বেদম এক ধাক্কা দিয়ে তাকে ইঞ্জিনের ওপর ফেলল রানা। ধুম করে লোকটার মাথার ওপর নামাল ভারী বনেট।

ব্যথা আর আতঙ্কে কেউ করে উঠল মন্টি ডয়েল। আবার বনেট তুলে তার মাথায় ফেলল রানা। পরক্ষণে তৃতীয়বার। একেবারে হতভম্ব হয়ে গেছে লোকটা। এবার একহাতে বনেট তুলে অন্যহাতে তার বেল্ট টেনে মন্টিকে মেঝেতে ফেলল রানা। লোকটার হাত থেকে তার নাকের কাছেই পড়ল রেঞ্চ।

কয়েক মুহূর্ত কিছুই বুঝল না যুবক। চিত হয়ে পড়ে আছে। তারপর তার চোখ পড়ল কঠোর চেহারার মাসুদ রানার ওপর। চোয়াল হাঁ হয়ে গেল ডয়েলের। বিড়বিড় করে বলল, ‘হা, ঈশ্বর! কী সর্বনাশ!’

দু’হাত বুকে বেঁধে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল রানা। নরম সুরে বলল, ‘মনে পড়ল, আমাদের দু’জনের পুরনো একটা হিসাব-নিকাশ বাকি রয়ে গেছে। তাই ভাবলাম একবার দেখা করে যাই।’

ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পা পিছলে আবার মেঝেতে পড়ল মন্টি ডয়েল। পরক্ষণে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। এখন তার হাতে ভারী রেঞ্চ। চোখ থেকে ঝরছে তীব্র ঘৃণা। রেঞ্চ ওপরে তুলে দুই পা এগোল সে। ভেবে গদার মত করে রানার মাথার ওপর নামাবে ওটা। খুব গতিতে রেঞ্চটা এল রানার দিকে। যুবকের বরই-বিচির মত ছোট্ট মগজটা হামলার কথা ভাবার আগেই রানা জেনেছে এরপর কী করবে সে। রেঞ্চ আসার আগে অন্তত তিনবার মনে মনে হামলা ঠেকাবার রিহার্সালের সুযোগ পেয়েছে ও। রেঞ্চ ধরা টেরিয়ারের ডানহাতটা বামহাতে ব্লক করল রানা। তার মুঠো থেকে ঝট্‌কা খেয়ে দূরের মেঝেতে পড়ল ভারী রেঞ্চ। ততক্ষণে রানার ডানহাতের ঘুষি গেঁথে গেছে ডয়েলের গলায়।

কাটা কলাগাছের মত ধুপ করে মেঝেতে পড়ল যুবক। দম আটকে গেছে বলে গলা থেকে বেরোল গড়গড়া করার মত বিদঘুটে আওয়াজ। ডয়েলের ঘাড়ের ওপর পা রেখে নরম সুরে বলল রানা, ‘পাগলামি কোরো না, ডয়েল। শক্তি খাটিয়ে কোনও লাভ হবে না। ওই ডিপার্টমেন্টটা আমার।’

‘ক্-ক্… কী চাও?’ ডানহাত চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল ডয়েল। এমন ভাব করছে, হাতটা যেন ভেঙেই গেছে। ‘কোথা থেকে এত বড় সাহস পেলে? তোমাকে ধরতে চারপাশে তল্লাসী করছে পুলিশের লোক!’

প্রকাণ্ড গাড়িটা দেখাল রানা। ‘এটা কি তোমার?’

‘না, আমার বস হাম্পি-ডাম্পির। যিশুর কসম, কোনও কারণ ছাড়াই আমার কনুইটা ভেঙে দিয়েছ তুমি!’

তার মানে সত্যিই পৃথিবীর বুকে টিকে আছে হাম্পি- ডাম্পি, আনমনে ভাবল রানা। জন্মসনদে লোকটার নাম আসলে কী, কে জানে! বাপ-মা যে নাম রাখার সময় অন্যায় করেছে তাদের ছেলের প্রতি, তাতে কোনও ভুল নেই।

‘কনুই ঠিক হবে, নাকী কান্না বন্ধ করো। এখন কোথায় আছে তোমার বস হাম্পি-ডাম্পি?’

‘ছুটিতে ফ্লোরিডায়। বলেছে গাড়িটা মেরামত করে রাখতে। তা এখানে কী চাও, ম্যান!’

‘ভাবছি একটু ঘুরিয়ে আনব তোমাকে,’ বজ্রপাত আঁকা লাল গাড়িটা দেখাল রানা।

ভুরু কুঁচকে ফেলল মণ্টি। ‘ভুলেও ওই গাড়িতে হাত দেবে না! হাম্পি ডাম্পি জানলে সঙ্গে সঙ্গে খুন হয়ে যাব!’

‘আমার সঙ্গে না এলে আমিও তো খুনই করব তোমাকে, ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর চেহারা করল রানা। ‘বুঝতে পেরেছ? এবার মেঝে থেকে ওঠো! মেলা কাজ পড়ে আছে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *