1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ২৯

ঊনত্রিশ

রানার ধারণা, এন সার্কেল মোটেলে ফুর্তির জন্যে হাজির হয়নি প্যাট্রিক নোভাক। তার উদ্দেশ্য পতিতাদের কাছ থেকে নিজেদের বখরা বুঝে নেয়া। দোতলার জানালার দিকে তাকাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর খুলে গেল ঘরের দরজা। টাকা বুঝে নিতে প্যাট্রিকের কয়েক মিনিট লাগবে। ডয়েলকে হাতের ইশারায় রানা বুঝিয়ে দিল, যেন বাড়ির একপাশে রাখা হয় গাড়িটা।

জবাবে কাঁধ ঝাঁকাল ডয়েল। ফায়ারবার্ডের ইঞ্জিন চালু করে পৌছে গেল মোটেলের পাশে ঝোপ-ঝাড়ের আড়ালে। এদিকটা আবর্জনা ফেলার জায়গা। একদিকে সারি সারি ডাম্পস্টারের ভেতর ভাঙাচোরা চেয়ার, পুরনো ম্যাট্রেস ও ছেঁড়া, রং ওঠা কার্পেট ঠাসা। এখন আর তেরো নম্বর ঘর থেকে দেখা যাচ্ছে না গাড়িটা।

‘ব্যস, যথেষ্ট,’ রানা বলল, ‘এবার গাড়ি থেকে বেরোও। ইঞ্জিন চালু রাখবে।’

গিয়ার নিউট্রাল করে গাড়ি থেকে নামল ডয়েল। সামনের সিট ঠেলে নিজেও গাড়ি থেকে বেরোল রানা। নিচু গলায় বলল, ‘এবার বুট খোলো।’

নিজের জুতোর দিকে তাকাল ডয়েল। ‘এগুলো দিয়ে কী করবে?’

‘গাড়ির পেছনের ট্রাঙ্ক খোলো,’ কথাটা অন্যভাবে বলল রানা।

নীরবে নির্দেশ পালন করল ডয়েল। তখনই আকাশে চোখ রেখে বলে উঠল রানা, ‘ওটা পুলিশের হেলিকপ্টার?’

মুখ তুলে আকাশে চোখ বোলাল ডয়েল।

একইসময়ে তার থুতনিতে লাগল রানার জোরালো আপারকাট। কড়াৎ শব্দে ফুটল ডয়েলের ঘাড়। অচেতন হয়ে পড়ে যাচ্ছে যুবক। মাটিতে আছড়ে পড়ার আগেই তাকে ধরে ফেলল রানা। ঘাসে শুইয়ে দিয়ে ওর পোশাকের পকেট দ্রুত সার্চ করল রানা। ডয়েলের সঙ্গে রয়েছে দু’শ’ ডলার, একটা ব্ল্যাকবেরি মোবাইল ফোন, গিটারের ক’টা পিক আর লেদারম্যান মাল্টি-টুল। পিক ছাড়া অন্যগুলো পরে কাজে লাগতে পারে ভেবে সব নিজের পকেটে ঢোকাল রানা। কসরৎ করে চেতনাহীন দেহটা তুলে ধুপ করে ফেলল গাড়ির বুটের ভেতর।

ভেতর। প্রথমে ভেবেছিল ডামস্টারে ফেলবে ডয়েলকে। তবে পরে মনে হয়েছে, জরুরি কোনও কাজে লাগতে পারে ব্যাটা।

এক পলক ডয়েলকে দেখে বিড়বিড় করল রানা, ‘তুই ব্যাটা একেবারেই গাধা, রে!’ ধুম করে বন্ধ করল গাড়ির ব্যাক ডালার ঢাকনি। তখনই মনে হলো, ব্যাটা তো শ্বাস আটকে মরবে! লেদারম্যান টুলের ছোট একটা স্ক্রু ড্রাইভার ব্যবহার করে কয়েকটা ফুটো করল বুটের ঢাকনির ওপর। এবার গরমে ঝলসে শিক কাবাব হয়ে গেলেও অক্সিজেনের অভাবে মরবে না মন্টি ডয়েল।

ড্রাইভিং সিটে চেপে গাড়ি ঘুরিয়ে মোটেলের পার্কিং লটে ফিরল রানা। এদিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজের ক্যাডিলাকের দিকে চলেছে প্যাট্রিক নোভাক। প্যান্টের দুই পকেট ডলারে ভরা। মেয়েদের বেআইনি আয়ের শতকরা কত ভাগ কেড়ে নেয় এই লোক? হাতে প্রায় কোনও টাকাই থাকার কথা নয় মেয়েগুলোর। দুঃখজনক পেশায় আছে তারা। তবে ভবিষ্যতে বাড়বে রোজগার, কারণ আজ থেকে তাদের রক্ত চুষবে না কোনও দালাল।

এসইউভি ক্যাডিলাকের ইঞ্জিন চালু করল প্যাট্রিক নোভাক। চাকার রাবার ক্ষয় করে পার্কিং লট থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে হাইওয়েতে উঠল রানাও। উড়ে চলেছে প্যাট্রিকের ক্যাডিলাক। গতিবেগ ঘণ্টায় অন্তত আশি মাইল। বজ্রপাত আঁকা পুরনো গাড়িতে চেপে ওর পিছু নেয়া বেশ কঠিন। বিরক্ত বোধ করছে রানা। তার ওপর এখন বেশি গতির জন্যে পুলিশের পেট্রলকার পিছু নিলে সাড়ে-সর্বনাশ হবে।

দুই গাড়ির মাঝের ব্যবধান বাড়িয়ে নিল রানা। লোকটাকে অনুসরণ করছে অন্তত আড়াই শ’ গজ দূর থেকে।

উত্তরদিকে চলেছে প্যাট্রিক। আঠারো মাইল যাওয়ার পর হাইওয়ে ছেড়ে নেমে গেল পুবের একটা সরু, আঁকাবাঁকা পিচ ঢালা রাস্তায়। এই পথে যানবাহন নেই, তবে একটু পর পরই রাস্তাটা ডাইনে-বামে বাঁক নিচ্ছে বলে আড়াল পেতে অসুবিধা হচ্ছে না। দূরত্ব বজায় রেখে ক্যাডিলাকের ‘পিছু নিচ্ছে রানা।

বিকেল পাঁচটায় ধুলোভরা একটা মেটো পথে পড়ল প্যাট্রিক। পাহাড়ি এলাকা। রাস্তার দু’পাশে ঘন সবুজ জঙ্গল। এ পথে একজন পথচারীরও দেখা পেল না রানা।

গোপনে পিছু নিয়ে মাঝে মাঝে পথের বাঁকে কালো ক্যাডিলাকের পেছনদিক দেখছে রানা। ভাবছে, কোথায় চলেছে লোকটা? সামনেই কি রহস্যময় নোভাক দ্বীপ? ওটার কথা বলেছে শেরিফ। অথচ, এমন কোনও দ্বীপের নাম শোনেনি গুডরিচরা। আগামী এক বা দুই ঘণ্টা হয়তো খুব বিপজ্জনক হবে।

আরও চল্লিশ মিনিট পর শুরু হলো চড়াই পথ। রিজে হালকাভাবে জন্মেছে ঝোপঝাড় ও গাছ। ডাইনে উপত্যকা। রানার দু’শ’ গজ দূরে বাঁক নিয়ে ডানদিকে গেল এসইউভি। গতি কমিয়ে জঙ্গলের বাঁকে থামল রানা। নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। একটু সামনেই ঢালু পথ গিয়ে মিশেছে পাঁচ শ’ গজ দূরে জঙ্গলের মাঝে বেড়া দেয়া বৃত্তাকার বড়সড় এক জায়গায়। ওখানে দেখা যাচ্ছে জংধরা টিনের কিছু বাড়িঘর।

রানার ধারণা হলো, ওটা ছোট কোনও খামার। আশপাশে নদী বা খাল নেই যে ওটাকে দ্বীপ ভাববে কেউ। সরাসরি ঘরগুলোর দিকে চলেছে প্যাট্রিক। ফায়ারবার্ডের ইঞ্জিন বন্ধ করে ব্যাগ হাতে গাড়ি থেকে নামল রানা। ব্যাগ থেকে ছোট কিন্তু শক্তিশালী বিনকিউলার নিয়ে জংধরা বাড়িগুলো দেখল। ওখানে গিয়ে শেষ হয়েছে কাঁচা রাস্তা। কুঁজো হয়ে ঝোপঝাড় ও গাছের মাঝ দিয়ে এগোল রানা। জঙ্গলের কিনারায় পৌঁছে চোখে লাগাল বিনকিউলার রহস্যময় আস্তানার দিকে চলেছে ক্যাডিলাক। ওটার চাকা থেকে উড়ছে ঘন ধুলোবালি।

কমপাউণ্ডের ডানে বিনকিউলার ঘুরিয়ে রানা দেখল, দুই বিঘা পরিমাণ জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু বাড়িঘর আর ছাউনি। পুরো এলাকা ঘিরে রেখেছে উঁচু সিকিউরিটি ফেন্স। ওপরে রেযর ওয়াএয়ার। তবে ওখানে জায়গা এতই কম, হাঁস-মুরগি বা গরু-ছাগলের খামারও এত ছোট হয় না।

মনোযোগ দিয়ে ঘরগুলো দেখল রানা। কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি প্রতিটা ঘরের দেয়াল। ছাত হিসেবে রয়েছে করোগেটেড টিন। এখানে-ওখানে দগদগে বাদামি জং। মাঝের ঘরটা বিশাল। চারদিকে ছাউনির ভেতরে মালামাল। একপাশের দুই ছাউনির সামনের দেয়াল নেই। ওখানে রানা দেখল সারি দিয়ে রাখা নীল রঙের অসংখ্য সিলিণ্ডার। বড় প্রোপেন গ্যাস বটল মনে হলেও পরক্ষণে রানা বুঝল, ওগুলো আসলে কন্টেইনার ড্রাম বা কাঠের পিপে। দুরমুশ করা মাটিতে পড়ে আছে বেশ কিছু ড্রাম।

সামনের দিকে দেয়াল নেই এমন একটা বার্নে ঢিবির মত উঁচু করে রাখা হয়েছে শস্যের বস্তা। কিছু ছেঁড়া বস্তা থেকে মাটিতে ছড়িয়ে পড়েছে কীসের যেন অসংখ্য দানা। আরেক দিকের এক ছাউনির ভেতর ছাত পর্যন্ত ঠেসে রাখা হয়েছে জ্বালানী কাঠ। সামনের দিকে বড় একটা বৈদ্যুতিক করাতের সামনে বিশাল এক গাছের গুঁড়ি। কুঠার দিয়ে কাঠ চেরাই করছে প্রকাণ্ডদেহী এক লোক। তার নড়াচড়া রোবটের মত।

বড়সড়, ভারী একটা গুঁড়ি সরাল সে। মস্ত কুঠার হাতে মাত্র কয়েক কোপে টুকরো হলো ওটা। জ্বালানী কাঠের স্তূপের ভেতর লোকটা রাখল চেরাই করা কাঠ। রানা বুঝে গেল, গরিলার মত জোর ওই লোকের শরীরে। একের পর এক কাঠের গুঁড়ি অনায়াসে চেরাই করছে সে। ক্লান্তি নেই। প্রতিটা কোপের সঙ্গে সঙ্গে কিলবিল করে উঠছে শরীরের পেশিগুলো।

মাঝের বিশাল ঘরটা খড় রাখার বার্নের মত। ফাটল ধরা কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি চার দেয়াল। চারদিক থেকে ওপরে উঠেছে জংধরা টিনের ছাত। মাঝে মোটা একটা চিমনি। রানার মনে হলো, ওটা বড় কোনও রকেট। চিমনির ভেতর থেকে হালকা ধোঁয়া উঠে মিশে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝিরঝিরে হাওয়ায়। ওদিক থেকে আসছে বিশ্রী গন্ধ।

তিক্ত হাসল রানা। পথ দেখিয়ে তাদের বেআইনি মদের কারখানায় নিয়ে এসেছে ওকে প্যাট্রিক নোভাক। জঙ্গুলে পাহাড়ি এলাকায় হয়তো এমন আরও কারখানা আছে তাদের। স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা এটিএফ-এর ফেডারেল অফিসাররা জানে না এখানে কী করছে তারা। কারখানার জংধরা ছাত ও আশপাশ দেখে যে-কেউ বুঝবে, অন্তত কয়েক বছর ধরে এখানে তৈরি হচ্ছে বেআইনি মদ। আয়করহীন যে পরিমাণ মদ জড় করা হয়েছে, তাতে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর অর্ধেক মানুষকে মাতাল করে দিতে পারবে নোভাকরা। পূর্বপুরুষদের মতই এরা এখনও যা খুশি তাই করছে।

উঁচু গেটের সামনে থামল প্যাট্রিকের ক্যাডিলাক। চওড়া গেটের দুই পাল্লা বন্ধ। ওদিকে চেয়ে রইল রানা। কয়েক মুহূর্ত পর গার্ডদের কুটির থেকে বেরোল মাথায় ক্যাপ আর গায়ে লাল চেক শার্ট পরা দাড়িওয়ালা এক লোক। গেটের কাছে থামল সে। প্যাডলক খুলে দরজায় জড়িয়ে রাখা মোটা শেকল সরাল। লোকটার কাঁধে ঝুলছে নলকাটা বন্দুক। সে হয়তো নোভাকদের বেআইনি অস্ত্রের ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত, ভাবল রানা। একদিকের পাল্লা সরিয়ে দিল লোকটা। কী যেন কথা হলো প্যাট্রিকের সঙ্গে। গাড়ি ভেতরে ঢুকতেই আবারও পাল্লা আটকে শেকল জড়িয়ে প্যাডলক আটকে দিল দাড়িওয়ালা। আবারও গিয়ে ঢুকল টিনের ছাতওয়ালা গার্ড কটেজে।

উঠোন পেরিয়ে বড় ঘরটা পেছনে ফেলে দুই ছাউনির মাঝে ক্যাডিলাক রাখল প্যাট্রিক। ওখানে কয়েকটা গাড়ি দেখল রানা। সিগারেট ধরাতে গেলে বা সামান্য অসাবধান হলেই আগুন ধরবে মদের কারখানায়। সেক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর দাহ্য বাষ্প থেকে ঘটতে পারে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। তাই গাড়িঘোড়া প্ল্যান্ট থেকে দূরে রেখেছে নোভাকরা।

ক্যাডিলাকের একপাশে প্রাচীন, ভাঙাচোরা এক ফ্ল্যাটবেড ট্রাক। আরেকদিকে দুটো পিকআপ। তবে ওগুলো দেখে তাজ্জব হয়নি রানা। বিনকিউলার দিয়ে দেখছে একটু দূরের ধুলোমাখা একটা গাড়ি। ওটা দেখে শিরশির করে উঠল ওর মেরুদণ্ড। কালো রঙের মাস্ট্যাং!

এক পলকে চিনেছে রানা ওটাকে।

লিয বাউয়ার খুন হওয়ার রাতে ওটাতে চেপেই গেস্ট হাউসের সামনে হাজির হয়েছিল দুই যুবক।

ওই গাড়ি যখন আছে, আশা করা যায় খুনিও জড়িত আছে এই কারবারে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *