1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৩৯

ঊনচল্লিশ

মানুষ নানানভাবে মনের দুঃখ দূর করতে চায়। কেউ চিৎকার করে কাঁদে, বিষণ্ণ বদনে কপাল চাপড়ায়। আবার কেউ যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঢকঢক করে মদ গিলে ভুলে যেতে চায় সবকিছু। তবে নিজের মনের দুঃখ ভোলার জন্যে অসহায় কারও ওপর অকথ্য নির্যাতন করা রিচি নোভাকের পন্থা। প্রিয় ছোটভাইয়ের মৃত্যুর পর ওটা হয়ে উঠেছে জরুরি। আর সেজন্যেই আজ এলিযিয়াম প্যারিশে হানা দিয়ে প্যাট্রিকের বন্ধু ব্র্যাডলি হাওয়ার্ডকে ধরে এনেছে রিচি আর হ্যাঙ্ক নোভাক।

টাকা মেরে দিতে চেয়েছিল লোকটা। কাজেই তাকে শাস্তি পেতে হবে। তার মুখ-হাত-পা বেঁধে তাকে ভ্যানে তুলে সোজা নিজেদের দ্বীপে ফিরেছে ওরা। এখন পূর্বপুরুষদের তৈরি বাড়ির উঠানে জ্বলছে ফ্লাডলাইট। ভ্যান রেখে নেমে পড়ল রিচি ও হ্যাঙ্ক নোভাক। পেছন সিট থেকে টান দিয়ে বের করে ব্র্যাডলিকে ফেলল মাটির ওপর।

হ্যাঙ্কের হাতের ট্রাইসেপে রানার গুলি লেগেছে বলে ক্ষতের ওপর এখন পুরু ব্যাণ্ডেজ। এদিকে লতি ছিঁড়ে গেছে বলে কানে ড্রেসিং করিয়েছে রিচি। গনগনে রাগে জ্বলছে দুই ভাই। প্রতিশোধ নেবে মাসুদ রানার ওপর। তবে আপাতত তাকে হাতের নাগালে পাওয়া যাচ্ছে না বলে গায়ের ঝাল মেটাবে ব্র্যাডলি হাওয়ার্ডের ওপর। সকালে তার সঙ্গে দেখা করেছিল প্যাট্রিক। বদমাশটা টাকা বুঝিয়ে দিলে ওদের ভাই পতিতালয় থেকে দালালির টাকা নিয়ে বহু আগেই ডিসটিলারিতে পৌছুত। ওর পিছু নিয়ে ওখানে যেত না মাসুদ রানা। সুতরাং, সব দোষ ওই হাওয়ার্ডের বাচ্চা ব্র্যাডলির!

মাথা থেকে বস্তা খুলে নেয়ার পর ব্র্যাডলি বুঝল, তাকে কিডন্যাপ করেছে কারা। ফ্যাকাসে হয়ে গেল সে। ভয়ে ছরছর করে প্রস্রাব করে দিল। কাঁদতে চাইলেও বুক-পেটে রিচির স্যাঙাৎদের লাথি খেয়ে মুখ বুজে গেল তার। মাটিতে পড়ে করুণভাবে গোঙাতে লাগল। বারবার হাতদুটো তুলে মাফ চাইছে রিচির কাছে। মাথা নেমেছে বুকের কাছে। ভাবছে, এবার হয়তো ক্ষমা করে দেবে তাকে রিচি। প্রাণপণে ভয়ের অভিনয় করছে। চোখ থেকে টপটপ করে ঝরছে অশ্রু। তবে রিচি বা হ্যাঙ্ক ভুলবে না যে ড্রাগ কেনার টাকা দশ হাজার ডলার দেয়নি সে। হাতজোড় করে ব্র্যাডলি বলল, কালকেই সমস্ত টাকা শোধ করে দেবে। আজই সন্ধ্যায় ফোন দিত প্যাট্রিককে। তবে জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল বলে…

‘প্যাট্রিক মারা গেছে,’ ব্র্যাডলির মাথায় বাজ ফেলল রিচি। ‘তোমার চুক্তি ছিল ওর সঙ্গে। ওটাও এখন মারা গেছে। এবার প্যাট্রিকের বদলে আমার সঙ্গে লেনদেন হবে, পাড়নাহ্! আর এটা তোমার জন্যে খুব বড় ধরনের দুঃসংবাদ!’

কথা শুনে চোয়াল ঝুলে গেল ব্র্যাডলি হাওয়ার্ডের। ‘হায়, ঈশ্বর! ঈশ্বরের মায়ের কসম! আমি কিছুই জানি না! প্যাট্রিক মরে যাওয়ার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই!’

‘সেটা আমরা জানি, শুয়োরের বাচ্চা,’ বলল হ্যাঙ্ক।

‘ও, তো তুই ভেবেছিলি আমাদের নোভাকদের কাউকে মারার মত বুকের পাটা আছে তোর?’ জানতে চাইল রিচি।

‘না-না-না! তা বলিনি!’

‘তুই ভাবছিস আমাদের ছোটভাই একটা গাধা ছিল?’

‘নাহ্! একদম ঈশ্বরের কসম! একটা কথা, আজই ওই টাকা জোগাড় করে দেব! এক্ষুণি! আমাকে শুধু একবারের জন্যে যেতে দাও!’

‘এ ব্যাটা বিরক্ত করে ফেলেছে আমাকে,’ বলল হ্যাঙ্ক। ট্রাইসেপে হাত রাখতেই ব্যথা পেয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল সে। ‘উহ্, ব্যথা লাগছে!’

‘একটা কথা জানো, ব্র্যাডলি?’ বলল রিচি। ‘আমরা আসলে ওই টাকার জন্যে বসে নেই। ওই টাকা এখন আর চাইও না। তবে এবার তোমার কারণে সাবধান হবে এদিকের সবাই।’ দলের এক লোকের দিকে তাকাল রিচি। ‘জ্যাকব, ক্যামেরা ঠিক আছে তো?’

প্যানাসনিক ক্যামকর্ডার দেখাল লোকটা। খ্যাক-খ্যাক শব্দে হেসে বলল, ‘একদম তৈরি, বস্!’

‘হাওয়ার্ড, এবার তোর পাছাটা ভাইরাল হবে,’ বলল হ্যাঙ্ক। ‘তোর কুত্তীর বেটি মা দেখবে তুই বিখ্যাত হয়েছিস! কত যে খুশি হবে!’

দ্বীপে ঘোরার সময় অল টেরেইন কোয়াড বাইক ব্যবহার করে নোভাকরা। ও-দুটোর ওপর চেপে বসল দুই ভাই। দ্বীপের দক্ষিণ তীরের দিকে চলেছে। আজকের রাতে আনন্দ হবে ওখানেই। সত্তর সালের দিকে বাইয়ুর ওপর একটা পন্টুন তৈরি করিয়ে নিয়েছিল রিচি ও হ্যাঙ্কের বাবা ‘কিলার’ নোভাক। ওই পন্টুনের পাশেই আছে পুরনো এক বোটহাউস। তীর থেকে ওদিকটা দেখা যায় না। জায়গাটা খুব পছন্দ ছিল বুড়ো নোভাকের। বাইয়ুতে নৌকায় বসে মাছ ধরত, আর সেইসঙ্গে রাই উইস্কি গিলে বেহেড মাতাল হতো।

অবশ্য, পরে অন্য কাজে ওই পন্টুন ব্যবহার করছে তিন ভাই।

ট্র্যাক ফুরিয়ে যেতেই মোটর সাইকেল থেকে নেমে পড়ল রিচি ও হ্যাঙ্ক। টেনে-হিচড়ে বন্দিকে নিয়ে তুলল পন্টুনের ওপর। ওখানে মার্লিন মাছ ঝুলিয়ে দেয়ার উপযোগী একটা হেভি ডিউটি এক্সটেণ্ডে বুম রিগ রয়েছে। ওটার স্টিলের বড় হুক ও শক্তপোক্ত কেবলে সংযুক্ত আছে গিয়ারওয়ালা হ্যাণ্ডেল। মাঝে মাঝে এই বুম রিগ ব্যবহার করে নোভাকরা। ক্যামেরা নিয়ে জ্যাকব তৈরি হতেই, তার সঙ্গী টিনাশে বব ঘোরাল বুমের লোহার হাতল। দুই লাথি মেরে বুমের বাহুর নিচে ব্র্যাডলি হাওয়ার্ডকে পৌঁছে দিল রিচি। এদিকে বন্দির বেল্টে হুকটা আটকে দিল হ্যাঙ্ক নোভাক। কাজটা শেষ হতেই ঢিলা কেই পেঁচিয়ে টানটান করল টিনাশে বব। কয়েক সেকেণ্ডে মস্ত এক কেঁচোর মত শূন্যে ভেসে উ ব্র্যাডলি হাওয়ার্ড।

তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইলে কী হবে, বাইয়ুর পানিতে বড় মাছ নেই যে গপ্ করে গিলবে।

বুমের বাহুটা সোজা গিয়ে স্থির হলো পানির ওপর। ওজন নিতে সমস্যা হচ্ছে না ওটার। কয়েক মুহূর্ত ব্র্যাডলিকে দেখার পর একটা বালতির সামনে থেমে ওটা থেকে বড় একটা হাতা নিল হ্যাঙ্ক নোভাক। বালতির ওপর ক্যামেরার লেন্স যুম করল জ্যাকব। ভেতরে একটা ল্যাব্রাডর রিট্রিভার কুকুরের পচা লাশ। কয়েক দিন আগে ওটাকে খুন করেছে রিচি। বালতির ভেতর থিকথিক করছে প্রাণীটার পচা রক্ত, চর্বি, মাংস ও একগাদা ভোজনরসিক কিলবিলে পোকায়।

‘ইয়াক্-থু!’ বাজে গন্ধ পেয়ে নাক কুঁচকে ফেলল জ্যাকব। পরক্ষণে হেসে উঠল তার বিখ্যাত হাসি: ‘খ্যাক– খ্যাক খ্যাক খ্যাক

বালতির সব আবর্জনা বাইয়ুর পানিতে ছুঁড়ে ফেলল হ্যাঙ্ক নোভাক। গলা ছেড়ে ডাক দিল, কই রে! আয়-আয়! দেরি কীসের!’ ফ্লাডলাইটের আলোয় দেখল বাইয়ুর পানিতে ভাসছে কুকুরটার চকচকে চর্বি ও জমাট রক্ত।

‘চিড়িয়াখানায় খাবার দেয়া হয়েছে,’ জোর গলায় বলল রিচি নোভাক।

ক্র্যাঙ্ক হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে ব্র্যাডলি হাওয়ার্ডকে পানির দিকে নামাতে লাগল টিনাশে বব। তার ক্ষত-বিক্ষত মুখে পৈশাচিক হাসি। কয়েক বছর আগে নিজ হাতে তার চেহারার ওই হাল করেছে রিচি নোভাক।

পচা মাংস, রক্ত ও চর্বির গন্ধে পানির ওপর ভেসে উঠেছে কয়েকটা নাক। এই দ্বীপকে পরিখার মত ঘিরেছে বাইয়ু। আর বহু বছর ধরেই এখানে বাস করছে একদল অ্যালিগেটর। তবে গত ক’বছর ধরে মাংস জোগান দিয়ে তাদেরকে লোভী করে তুলেছে নোভাকরা। আজও দারুণ সুস্বাদু খাবারের জন্যে অপেক্ষা করছে অ্যালিগেটরগুলো।

প্রাণপণে আর্ত চিৎকার ছাড়ছে ব্র্যাডলি হাওয়ার্ড, চিরে যাচ্ছে গলা। হ্যাণ্ডেল ঘুরিয়ে একটু একটু করে বুম নিচু করছে টিনাশে বব। ছপাস্ করে ড্রাগ ব্যবসায়ীর পা পড়ল বাইয়ুর তেলতেলে রক্তভরা পানির ভেতর। অমনি ভুস্ করে ভেসে উঠল বড় একটা কালো কিছু। রকেটের বেগে এল হাওয়ার্ডের দিকে। হাঁ করেছে দুই চোয়াল।

‘ওই যে আমাদের বুড়ো ওসাইরিস, মন্তব্যের সুরে বলল হ্যাঙ্ক।

ওই অ্যালিগেটরের বয়স কমপক্ষে ষাট। দৈর্ঘ্যে পনেরো ফুট। নোভাকরা বাইয়ুতে কিছু ফেললে সবার আগে হাজির হয় ওটাই। আর কাউকে ভাগ দিতে চায় না।

ব্র্যাডলি হাওয়ার্ডের উরু কামড়ে ধরে তাকে পানির নিচে নিয়ে গেল বুড়ো অ্যালিগেটর। মাথাটা পানির নিচে যেতেই চিৎকার থেমে গেল ড্রাগ ব্যবসায়ীর। বুদ্বুদ বেরুচ্ছে নাক-মুখ দিয়ে। চারপাশ থেকে তাকে ঘিরে নিল বেশ কয়েকটা কালো অবয়ব। আবার তোলা হলো হাওয়ার্ডকে। একটা হাত নেই, বাম পায়ের হাঁটু পর্যন্ত গায়েব। স্রোতের মত ঝরছে রক্ত। এখন আর চিৎকার নেই, ফ্যাসফেঁসে আওয়াজ বেরোচ্ছে ওর গলা দিয়ে। লাল হয়ে গেল পানি। এই দৃশ্যের ছবি তোলা হয়ে গেলে আবার নামানো হলো ওকে পানিতে। হুটোপুটি শুরু হয়ে গেল, তোলপাড় হচ্ছে পানির নিচে। কাঁপছে বুমের আগাটা অনিয়মিত ছন্দে। একটু পরেই আবার যখন হ্যালে ঘুরিয়ে কে

ওপরে তুলল টিনাশে বব, তখন হুকের সঙ্গে কেউ নেই। পানিতে ভাসছে হাওয়ার্ডের ছেঁড়া কয়েক টুকরো রক্তমাখা পোষাক। একটু পর ওগুলোও আর থাকবে না।

‘লেডিয অ্যাণ্ড জেন্টলমেন, আজকের শো শেষ, বলল হ্যাঙ্ক। ‘জ্যাকব, ঠিকমত ছবি তুলেছ তো?’

‘নিশ্চয়ই! খ্যাক খ্যাক খ্যাক-খ্যাক!’

ভিডিয়ো ইন্টারনেটে ছাড়ার আগে ঝাপসা করা হবে ব্র্যাডলি হাওয়ার্ড ছাড়া বাকি সবার মুখ। এ ধরনের ভিডিয়ো দেখতে পছন্দ করে বিকৃত মনের মানুষ। তবে তাদের অনেকে ঠিকই বুঝবে, কাজটা নোভাকদের। সেক্ষেত্রে আরেকবার সতর্ক হবে তারা— বাড়াবাড়ি করতে হয় না নোভাক পরিবারের কারও সঙ্গে।

দ্বীপের ক্লাবহাউসে বিলিয়ার্ড খেলার জন্যে একটা মোটর সাইকেল নিয়ে বিদায় হলো জ্যাকব আর টিনাশে বব। বুদ্বুদ ওঠা পানির দিকে তাকাল রিচি নোভাক। তার পাশেই থামল হ্যাঙ্ক। চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল দুই ভাই। ভুলে যেতে চাইছে প্যাট্রিক এখন আর তাদের সঙ্গে নেই।

‘গাধা ছিল প্যাট্রিক,’ নিচু গলায় বলল রিচি। ‘বোকার মত মরতে গেল কেন? ডেকেই বা আনল কেন বিপদ?’

‘গাধাটা নেই বলে বুকটা কেমন খাঁ-খাঁ করছে,’ বলল হ্যাঙ্ক।

‘বলদও এত নির্বোধ হয় না। টেরই পায়নি, পথ দেখিয়ে এনেছে মাসুদ রানাকে।

‘তবুও তো সে আমাদেরই ভাই,’ বলল হ্যাঙ্ক। ‘রক্ত সবসময় পানির চেয়ে ঘন। ঠিক বললাম না, রিচি?’

আস্তে করে মাথা দোলাল রিচি – নোভাক। ‘কথা ঠিক আর নোভাকদের রক্ত আবার অন্যদের চেয়ে বেশি ঘন। আর…’ দাঁতে দাঁত চেপে চোয়ালদুটো শক্ত করে ফেলল ও, ‘যা ভেবেছিলাম তার চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক ওই বিদেশি লোকটা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *