1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ১১

এগারো

হাত-পায়ের ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলো ভীষণ জ্বললেও হাঁটার গতি বাড়াল রানা। এরই ভেতর আশপাশের বাড়ির দোতলায় জ্বলে উঠেছে বাতি। গুলির শব্দে জেগে গেছে প্রতিবেশীরা। আরামদায়ক বিছানা ছেড়ে কেউ কেউ উঁকি দিচ্ছে জানালা দিয়ে। মিনিটখানেক পর লিয়ের গেস্টহাউসের সদর দরজায় পৌঁছুল রানা। এখন আর মার্সিডিযে চেপে খুনির পিছু নিতে পারবে না। বাকি রইল লিযকে হাসপাতালে নেয়ার জন্যে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে আনা।

গেস্টহাউসের হলওয়েতে পা রেখে রানা দেখল, নড়ছে না লিয। ভেজা কার্পেট হয়েছে ফোলা স্পঞ্জের মত। আরও ছড়িয়ে গেছে রক্তের কালো দাগ।

লিযের পাশে বসতেই ভিজে গেল রানার প্যান্টের হাঁটুর ছেঁড়া অংশ। মৃতপ্রায় মানুষটার পাল্স্ পরখ করল ও।

খুব ধীরে অনিয়মিতভাবে চলছে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন।

মাথা কাত করে ওকে দেখতে চাইল লিয। ঘষা কাঁচের মত অস্বচ্ছ দুই চোখ। ঠোঁট ফাঁক করে কী যেন বলতে যেতেই গলা থেকে বেরোল অস্ফুট গোঙানি। ঠোঁটের কোণ বেয়ে গলগল করে বেরোল তাজা রক্ত। মেঝেতে ফেলে পেটে তলোয়ার গেঁথে দেয়ার সময়, পৌঁচ মেরে গাল চিরে দিয়েছে আততায়ী। ফ্লোরবোর্ডে গেঁথে আছে তলোয়ারের ডগা।

অস্ত্রটা সাধারণ নয়— সেইবার। একসময়ে সম্মুখ সমরে ব্যবহার হতো। পরে মিলিটারি বিশেষজ্ঞরা বুঝল, স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে ওটা কিছুই নয়। ফলে বাদ পড়ল এটা অস্ত্র হিসেবে।

লিযের পেটে গেঁথে থাকা তলোয়ারের ফলা ভরে আছে কালচে মরিচায়। বহুকাল আগের জিনিস। হাতলে হাঙরের চামড়ার ওপর জড়ানো হয়েছে সোনার তার। হাত বাঁচাতে বাঁকা চাঁদের মত তামার পুরু পাত। বয়সের কারণে রঙ হারিয়েছে ওই তামা। পাতের ওপর প্রতিপক্ষের হামলার অজস্র দাগ। সেইবারটাকে অ্যান্টিক বললেও ভুল হবে না। হাজার হাজার ডলারে বিক্রি হয় এসব অস্ত্র।

কিন্তু কেন অ্যান্টিক তলোয়ার নিয়ে এ বাড়িতে হামলা করল লোকটা?

কিচেন থেকে ছুরি বা হাতুড়ি নিলেই তো কাজ চলত।

আরও বড় কথা, খুনের অস্ত্র রেখে গেল কেন সে?

লিয কেশে উঠতেই পেটের ক্ষত থেকে তির তির করে বেরোল তাজা রক্ত। ভিজে কালো হয়েছে বাথরোব ও নাইট ড্রেস। সেইবারের হাতল ধরল রানা। টান দিয়ে বের করতে গিয়েও থেমে গেল। ওই পাত জায়গামত আছে বলেই ওটার চাপে রক্তনালী থেকে কম রক্ত বেরোচ্ছে। এখন ফলা বের করলে আরও বেশি ক্ষতি হবে, আরও দ্রুত মরবে লিয।

রানার চোখ পড়ল হলওয়ের ওদিকের স্ট্যাণ্ডের ওপর। ওখানেই আছে ল্যাণ্ড ফোনের সেট

‘অ্যাম্বুলেন্স ডাকছি, লিয়, একটু অপেক্ষা করো,’ উঠে দাঁড়াতে গিয়েও থমকে গেল রানা।

রক্তাক্ত হাত তুলে ওর আস্তিন ধরেছে লিয। আর তা করতে গিয়েই বোধহয় ফুরিয়ে গেছে শরীরের সব শক্তি।

রানা ভাবল, উঠে বসতে চাইছে লিয। তবে সেই সাধ্য তার নেই। সেটা লিযও বুঝেছে। আস্তে করে টান দিল রানার আস্তিন ধরে। আশা করছে ওর মুখের কাছে কান নেবে রানা। মৃত্যুর আগে কিছু বলতে চাইছে লিয?

হাঁটু গেড়ে তার মুখের কাছে কান নিল রানা। ‘কিছু বলবে, লিয়?’

‘আ… আমি… সবসময়… ফুরিয়ে গেল লিযের শক্তি কেশে উঠল। মুচড়ে গেল পেটের পেশি। সেইবারের ফলার চারপাশ থেকে বেরোল রক্ত। চোখ বুজে ফেলল লিয।

রানার বুঝল, যে-কোনও সময়ে মারা যাবে বেচারি

তবে কয়েক মুহূর্ত পর আবারও চোখ মেলল লিয়। রক্তের মতই লাল দুই চোখের সাদা অংশ। চোখে ভীষণ ব্যথার চাহনি। আঁকড়ে ধরল রানার হাত। জীবন-মরণের মাঝে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারছে, চলে যেতেই হবে অচেনা কোনও জগতে।

‘জানতাম…. এটাই হবে,’ ফিসফিস করল লিয।

রানা বুঝল, সন্ধ্যায় নিজের বলা সেই গোপন বিষয়ে কিছু বলতে চাইছে লিয। জীবনের বেশিরভাগ সময় ভয় পেয়েছে বেচারি ওটার কথা ভেবে। তবে এখন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে এসে ভাবছে, কাউকে বলবে সেই সত্যটা।

‘আমাকে কিছু বলবে, লিয?’ বলল রানা।

অতল ঘোরে তলিয়ে যাচ্ছে লিয। অনিয়মিত শ্বাস নিচ্ছে। অস্বচ্ছ কাঁচের মত দুই চোখ। মনের ভেতর ভীষণ ভয়। রক্তাক্ত হাতে প্রাণপণে ধরল রানার আস্তিন। ওকে ঘিরে ধরছে কালো এক চাদর। প্রায় ফিসফিস করল লিয, ‘ওরা…. জেনে গেছে… তাই মেরে ফেলত… আগেও… যেমন ….. খুন… শেলি লং ল্যান্সকে।’

লিযের হাতে হাত রাখল রানা। ‘শেলি কে, লিয? তুমি কি জানো, কে বা কারা হামলা করল? আমাকে বলো, আমি ওদেরকে খুঁজে বের করব। ছাড়ব না ওদের একটাকেও।’

ফোঁস করে শ্বাস ফেলে চোখ বুজল লিয। তারপর একদম শিথিল হয়ে গেল ওর দেহ।

রানা বুঝে গেল, চিরকালের জন্যে বিদায় নিয়েছে লিয বাউয়ার। এত কম সময়ের পরিচয় ওদের, অথচ বুকের ভেতরটা হু-হু করে কাঁদছে রানার। মনে হচ্ছে পেয়েও হারিয়ে বসেছে আপন জনকে। রক্তের মাঝে হাঁটু গেড়ে বসে লিষের হাত ধরে থাকল রানা। মাথাটা ঝুঁকে গেল ওর। আনমনে ভাবল, খুলে নেব পেট থেকে সেইবার? তা হলে অসম্মান নিয়ে পড়ে থাকবে না লিয়ের লাশ।

তবে এখানে খুন হয়েছে মানুষ, পুলিশী নিয়ম মেনে চলাই উচিত। জখম থেকে তলোয়ারটা খুলল না রানা। ভাবছে, ‘কেন এভাবে খুন হলো লিয? আর কে ওই শেলি লং ল্যান্স?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *