1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ২৫

পঁচিশ

‘আসলে, মরিস, মানুষ ভুলেই গেছে যে যুদ্ধের সময় উত্তরের রাজ্যগুলোর চেয়ে নানান দিক থেকে ভাল অবস্থানে ছিল দক্ষিণের কনফেডারেসি,’ বললেন প্রফেসর। ‘বিদ্রোহী আর্মিতে ছিল তরুণ ও যুবকদের বিশাল বাহিনী। তাদের বেশিরভাগই এসেছে দরিদ্র পরিবার থেকে। এদিকের এলাকা ভাল করেই চিনত তারা। সেই ছোটবেলা থেকেই শিকার করে পরিবারের পেট চালাত। ফলে তারা অনায়াসেই হয়ে ওঠে দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধা। শুধু তা-ই নয়, বোকার মত উত্তর রাজ্যের পদাতিক জেনারেল জর্জ ম্যাকক্লেল্যাণ্ডের ওপর ইউনিয়ান আর্মির দায়িত্ব দেন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কন। ওটা ছিল চরম ভুল। ওই লোকের চেয়ে সেনাপতি হিসেবে নানান দিক থেকে দক্ষ ছিলেন দক্ষিণের জেনারেল স্টোনওয়েল জ্যাকসন, নাথান বেডফোর্ড ফরেস্ট বা রবার্টস ই. লি। ফলে যুদ্ধের শুরুর দিকে একের পর এক সফলতা নিজেদের ঝুলিতে পুরল দক্ষিণের রাজ্য। যেমন আঠারো শ’ একষট্টি সালের বুল রানের প্রথম যুদ্ধে ইউনিয়ান আর্মিকে হতভম্ব করে দেয় তারা। পরের কয়েক বছর সাধারণ মানুষ ধরে নেয়, এ যুদ্ধে নির্ঘাত হারবে উত্তর রাজ্যের ইউনিয়ান।’

চুপ হয়ে ভুরু কুঁচকে কী যেন ভাবলেন ম্যাকগাইভার, তারপর বললেন, ‘তবে আমাদের মনে রাখতে হবে, সাধারণ কোনও যুদ্ধ ছিল না ওটা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের বিষয় ছিল না। ইতিহাসের পাতায় যা-ই লেখা হোক, আসলে ওই যুদ্ধের ফলে বদলে যায় এ দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ। আমরা হয়ে উঠি অন্য ধরনের মানসিকতার মানুষ। দক্ষিণ যদি স্বাধীন দেশ হিসেবে টিকে যেত, ভাগ হয়ে আজকের আমেরিকায় থাকত একেবারেই ভিন্ন মানসিকতার দুটো জাতি। ফলে উনিশ ও বিংশ শতকে একের পর এক যুদ্ধে বিপর্যস্ত হতো উত্তর এবং দক্ষিণ অঞ্চল। হয়তো কখনওই দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দেশ হতো না আমেরিকা। আর তার ফলে অন্যরকম হতো নানান দেশের গ্লোবাল রাজনীতি এবং অর্থনীতি।’

কফিতে চুমুক দিয়ে টেবিলে মগ রাখলেন প্রফেসর। ‘এবার মূল কথায় আসি। উত্তরদিকের রাজ্যগুলোয় ছিল অনেক বেশি মানুষ, তার ওপর ওরা ছিল শিল্পোন্নত। ফলে দক্ষিণের রাজ্যগুলো প্রথমদিকে যুদ্ধে ভাল করলেও উত্তরের আধুনিকায়নের কারণে নানানদিক থেকে পিছিয়ে পড়ে তারা। আঠারো শ’ চৌষট্টি সালে দক্ষিণের রাজ্যগুলোর ভেতর শুরু হলো পর্যাপ্ত সম্পদের ভাটা। সে সময়ে ইউনিয়ান আর্মি পেল দক্ষ এক কমাণ্ডার-ইন-চিফ। তিনি ছিলেন জেনারেল ইউলিসিস এস. গ্র্যাণ্ড। দুর্দান্ত লড়াই শুরু করলেন তিনি। সবার মনে জুগিয়ে দিলেন আত্মবিশ্বাস। সবাই বুঝে গেল, এই অসাধারণ সেনাপতির রণকৌশলের জন্যে শেষপর্যন্ত যুদ্ধে বিজয়ী হবে উত্তরের রাজ্যগুলো। এদিকে মন ভেঙে গেল দক্ষিণের বিশৃঙ্খল সৈনিকদের। তা ছাড়া, যথেষ্ট পরিমাণে খাবার, অস্ত্র বা গোলাগুলিও ছিল না তাদের কাছে। দক্ষিণের মানুষ যুদ্ধের প্রতি পদে বুঝতে লাগল, ঘনিয়ে এসেছে চরম পরাজয়। তার ওপর, নানাদিক থেকে বন্ধুরাষ্ট্র ফ্রান্সের সাহায্য পাবে ভেবেছিল দক্ষিণের নেতারা। কিন্তু তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় যুদ্ধে জেতার শেষ আশাও মিলিয়ে গেল। অসহায় হয়ে পড়ল দক্ষিণের রাজ্যগুলো। যুদ্ধের কারণে দাউ-দাউ করে পুড়ছে তাদের একের পর এক শহর। খাবার নেই যে পেট ভরাবে কেউ। ভুট্টার ফসলহীন ফাঁকা মাঠে পড়ে থাকল দশ হাজারেরও বেশি মৃত মানুষ। দক্ষিণের রাজ্যের ক্ষমতাশালীরা বুঝল, এ ভয়াবহ পরিবেশে জরুরি ভিত্তিতে দ্রুত কিছু করতে হবে।’

ক’মুহূর্ত বিশ্রাম নিয়ে মুখ খুললেন প্রফেসর, ‘একটা বাস্তব সত্য হচ্ছে: যুদ্ধের সময়ে নানান ষড়যন্ত্রমূলক প্লট গজিয়ে ওঠে মানুষের মগজে। যেমন, ঠিক করা হয়েছিল, খুন করা হবে আব্রাহাম লিঙ্কনকে। যদিও পরে তা সম্ভব হয়নি। যাক গে, যুদ্ধে হারছেন বলে গোপনে কনফেডারেট আর্মির ক’জন কমাণ্ডার কথা বলেন লুইযিয়ানার নামকরা এক জমিদারের সঙ্গে। ওই লোক ছিল টেক্সাসের মানুষ। নাম ডক্টর উইলিয়াম এফ. নোভাক। তার প্ল্যান্টেশন ছিল এই ক্লোভিস প্যারিশেই।’

নোভাক নামটা শুনেই সতর্ক হয়েছে রানা। দু’একদিনের ভেতর শুনেছে নামটা, যদিও মনে পড়ল না, কে বলেছে।

‘অদ্ভুত স্বভাবের লোক ছিল উইলিয়াম এফ. নোভাক, ‘ বললেন ম্যাকগাইভার, ‘খুবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যবসায়ী। আজকের হিসেবে তার ছিল অন্তত এক শ’ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি সম্পত্তি ও সম্পদ। কথাটা ভুলও হতে পারে। হয়তো বিলিয়নেয়ারই ছিল সে। তবে তার বিজ্ঞান বিষয়ক দক্ষতা এবং ডাক্তারি বিদ্যার কারণে হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর এক ষড়যন্ত্রের মূল চালক। ওই পরিকল্পনা সফল হলে চরম পরিণতি হতো ইউনিয়ান আর্মির। অফিশিয়ালি ওই কুকীর্তির অনুমোদন দিত না কনফেডারেটদের ওপরমহল। তবে বাধ্য হলে কী-ই না করে মানুষ! যুদ্ধের সময় সাধারণ সব মানবিক রীতি-নীতি হারিয়ে বসে সবাই। যদিও শেষতক যুদ্ধের ময়দানে করা হয়নি সেই মারাত্মক অন্যায়।’

প্রফেসরের কফির মগ খালি। ওটা টেবিলে রেখে খক-খক করে কাশতে লাগলেন তিনি। একটু পর কাশির দমক সামলে নিয়ে বললেন, ‘এক্সকিউয মি। গত ক’বছর এত কথা বলিনি। একেবারে শুকনো কাঠের গুঁড়ো হয়ে গেছে গলাটা।’

‘আপনাকে একগ্লাস পানি দেব, প্রফেসর?’ নরম সুরে জানতে চাইল এলিসা।

কথাটা শুনে চেহারা বিকৃত করলেন প্রফেসর। তাঁর ভাব দেখে রানার মনে হলো, বিষ খাইয়ে দেয়া হয়েছে তাঁকে তর্জনী তুলে একটু দূরের কাবার্ড দেখালেন। ‘তোমার মঙ্গল হোক, মিসেস গুডরিচ, তবে পানি নয়, আমার চাই ওটার ভেতরের জিনিস।’

এলিসা গিয়ে কাবার্ড খুলতেই রানা দেখল, ভেতরে সারি দিয়ে রাখা অন্তত বিশটা উইস্কির বোতল। কাবার্ডের দিকে মগ বাড়িয়ে দিলেন প্রফেসর। চেহারায় অনিচ্ছা নিয়ে একটা বোতলের ছিপি খুলে কানায় কানায় মগটা ভরে দিল এলিসা। ঠোটের কাছে মগ নিয়ে সোনালি তরলে লম্বা চুমুক দিলেন প্রফেসর। ‘আহ্! কী শান্তি! এবার আগের কথায় ফেরা যাক। আমি যেন কোথায় ছিলাম?’

‘নোভাকের পরিকল্পনা সফল হলে ভয়ঙ্কর পরিণতি হতো ইউনিয়ান আর্মির,’ খেই ধরিয়ে দিল রানা। বুঝতে পারছে, জরুরি কিছু বলবেন প্রফেসর। তবে নতুন করে উইস্কি গিলতে শুরু করেছেন তিনি। জরুরি তথ্যটা জানাতে গিয়ে কতটা সময় নেবেন, তা বোঝার উপায় নেই।

আরেক ঢোক উইস্কি গিলে রানাকে দেখলেন প্রফেসর। ‘মরিস, বলো তো, আসলে কতটা জানো বায়োলজিকাল ওঅরফেয়ার সম্পর্কে?’

বিস্ময় লুকিয়ে বলল রানা, ‘অতি সামান্য।’

‘উইলিয়াম এফ. নোভাক ও তার সঙ্গীরাও বেশি কিছু জানত না। তবে এটা বুঝে গিয়েছিল, যেভাবেই হোক যুদ্ধে জিততে হবে। ন্যায় বা অন্যায়ের কথা তারা ভেবে দেখেনি। আঠারো শত চৌষট্টি সালেও পুরনো বিষয় ছিল না বায়োলজিকাল ওঅরফেয়ার। আগেও বহুবার রোগাক্রান্ত মানুষ বা প্রাণীকে নেয়া হয়েছে শত্রু এলাকায়, যাতে রোগে ভুগে কাবু হয় শত্রুপক্ষ। অবরুদ্ধ শহরের পানি সরবরাহে মেশানো হয়েছে বিষ বা ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। মধ্যযুগে শত্রু-নগরীর প্রাচীরের বাইরে থেকে ক্যাটাপল্ট দিয়ে দুর্গের ভিতরে ছুঁড়ে ফেলা হতো প্লেগে মরা মানুষের দেহ। রোগের জীবাণুর আক্রমণে মারাও গেছে হাজার হাজার মানুষ। ধারণা করা হয়, রেড ইণ্ডিয়ানদের পরাজিত করতে তাদের এলাকায় গুটি বসন্ত ভরা কম্বল ফেলেছিল কলোনিস্ট ব্রিটিশ আর্মি। তাদেরই এক হারামি ব্রিটিশ কমাণ্ডার-ইন-চিফের নাম ব্যারন জেফরি আমহার্স্ট। পরে কুইবেক এলাকার গভর্নর হয় সে। তার অধীনস্থ এক লোকের কাছে চিঠিতে লেখে সে: ‘অভিশপ্ত নীচজাতির মানুষগুলোকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে হবে।’ তার মতলব খুব পরিষ্কার ছিল। তার কিছু দিনের ভেতর রোগে ভুগে মরল অন্তত পাঁচ লাখ রেড ইণ্ডিয়ান।’

‘এ তো গণহত্যা,’ তিক্ত স্বরে বলল এলিসা।

‘অবাক হওয়ার কিছু নেই, ম্যাম,’ বললেন প্রফেসর। ‘মানুষ আসলে এমনই হারামি প্রাণী। এই ধরনের প্লেগ বা রোগ ছড়িয়ে দেয়ার ব্যাপারটা মাথায় রেখেছিল ডক্টর নোভাক। তার এক সহকর্মীর কাছ থেকে জেনেছিল, প্রচণ্ড কলেরা মহামারি চলছে বারমুডা এলাকায়। মারা পড়ছে হাজার হাজার মানুষ। কাজেই তাদের পোশাক সংগ্রহে নামে সে। সবই রাখা হয়েছিল বিশেষভাবে তৈরি বায়ুরোধক কাঠের পিপেতে। ঠিক করা হয়, এসব মারণাস্ত্র পৌঁছে দেয়া হবে টেক্সাসের গ্যালভেস্টন বন্দরে। ওটাই ছিল নোভাকের জন্মস্থান। সংক্রমিত কাপড়চোপড় সংগ্রহে কনফেডারেটদের একটা দল জাহাজ নিয়ে যায় বারমুডায়। কলেরার জীবাণু সংগ্রহ করে দক্ষিণ সাগরে ইউনিয়ান ফ্লিটকে ফাঁকি দিয়ে পৌছুত উত্তরদিকের নিউ ইয়র্ক, বস্টন, শিকাগো আর ওয়াশিংটনে। তা পারলেই ওসব শহরে সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত জলাধারে জীবাণু মিশিয়ে দিত কনফেডারেটরা।’

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তৃষ্ণার্তের মত তিন ঢোক উইস্কি গিললেন প্রফেসর ম্যাকগাইভার। আবারও শুরু করলেন, ‘ভাবতে পারো, উত্তরদিকের রাজ্যগুলোর প্রাণকেন্দ্রে হঠাৎ করেই দাবানলের মত ছড়িয়ে গেছে মৃত্যুবাহী রোগ? সে আমলে কয়েকটা রোগের ভেতর অন্যতম ছিল কলেরা। উপনিবেশ করার সময় ব্রিটিশ আর্মি যে ক্ষতি করেছিল রেড ইণ্ডিয়ান উপজাতির, তার অন্তত দশগুণ মহামারি তৈরি করত ডক্টর নোভাক। বিপর্যস্ত হতো ইউনিয়ান আর্মির শক্তিশালী সব ঘাঁটি। বলা যায় না, হয়তো পটাপট মরত উত্তরদিকের সরকারের বড় পদের ক্ষমতাশালী লোকজন। ফলে অনেক দুর্বল হতো ইউনিয়ান আর্মি। আর সেই সুযোগে নিজেদেরকে সামলে নিত দক্ষিণের সরকার। নতুন করে উত্তরের রাজ্যে হামলা করত তাদের আর্মি। হয়তো বদলে যেত ইউএসএ-র ভবিষ্যৎ। … কী বুঝলে, বুঝলে, মরিস?’

আনমনে মাথা নাড়ছে এলিসা ও জোসেফ। মুখ শুকিয়ে গেছে কিশোর রনের। কী ঘটত, বুঝতে পেরেছে রানা। মূল বিষয়ে যেতে চাইল ও, ‘এসবের ভেতর কীভাবে জড়িয়ে গেল শেলি লং ল্যান্স?’

‘এবার সে কথাই বলব। সাধারণ এক ক্রীতদাসী ছিল সে। কাজ করত নোভাকের তুলার প্ল্যান্টেশনে। কাজের মেয়ে হিসেবে থেকেছে নোভাকের রাজপ্রাসাদের মত বাড়ি থাউয্যাণ্ড ওক-এ। ধারণা করা হয়, শেলির যখন নয় বছর বয়স, সেসময়ে ডিপথেরিয়ায় মারা গিয়েছিল তার মা। বাবা মরে টিটেনাসের সংক্রমণে। সে সময়ে খুব খারাপ পরিবেশে প্ল্যান্টেশনে বাস করত ক্রীতদাসরা। তাদের গড় আয়ুও ছিল খুব কম। তিরিশ বছর পেরোেত না কেউ। তবে নানান রোগ থেকে বেঁচে গেল শেলি লং ল্যান্স আর তার বোন।’

‘জিলিয়ান লং ল্যান্স,’ বলল রানা। ‘শেলির যমজ বোন।’

মাথা দোলালেন প্রফেসর ম্যাকগাইভার। ‘সে আমলে খাবারের প্রচণ্ড অভাব ছিল ক্রীতদাসদের। তাদের ভেতর খুব কম পরিবারেই যমজ সন্তান হতো। আর যারা জন্মাত, তাদের বেশিরভাগই মরত শিশু বয়সেই। পনেরো বা ষোলো বছর বয়সে জিলিয়ান রয়ে গেল প্ল্যান্টেশনে। আর ম্যানশনের গৃহস্থালী কাজের জন্যে নেয়া হলো তার বোনকে। পদোন্নতিই বলা চলে। রান্না করা, ঘর গোছানো, টেবিলে খাবার দেয়া… কাজের শেষ ছিল না শেলির। নোভাক কখনও তাকে ভোগ করেছে কি না, তা আমরা জানতে পারিনি। তবে ইতিহাসবিদরা লিখেছেন, বুদ্ধিমতী, চটপটে মেয়ে ছিল শেলি লং ল্যান্স। যে-কোনও কাজে ভরসা রাখা যেত তার ওপর। অনুগত এমন ক্রীতদাস-দাসীদেরকেই পছন্দ করত বড়লোকরা। শেলির ছিল অদ্ভুত এক গুণ। একবার কিছু শুনলে গড়গড় করে সব রিপিট করতে পারত। তার নেমোনিক স্মৃতিশক্তি আর ওই গুণ কাজে লাগল এক দুপুরে। তখন লাঞ্চের পর গোপন মিটিং করছিল নোভাক ও কয়েকজন কনফেডারেট আর্মি অফিসার। এ থেকে বুঝে নাও, ক্রীতদাস বা ক্রীতদাসীদেরকে কতটা মানুষ বলে গণ্য করত শ্বেতাঙ্গরা। আর, সেজন্যেই নোভাক ভাবতেও পারেনি মিটিঙে তাদের বলা সব কথা মন দিয়ে গিলছে শেলি।’

হঠাৎ টেবিলে লাফিয়ে উঠল কালো একটা বেড়াল। প্রফেসরের মগে গা ঘষতে শুরু করতেই ঠেলে ওটাকে সরিয়ে দিলেন ম্যাকগাইভার। নতুন করে বোতল থেকে মদ ভরে নিলেন মগে। খুব দ্রুত খালি হচ্ছে উইস্কির বোতল। আবারও বলতে লাগলেন তিনি, ‘শেলি লং ল্যান্স যে শুধু বুদ্ধিমতী ছিল, তা-ই নয়, খুব সাহসীও ছিল। ভাল করেই বুঝেছিল, এরপর কী ঘটবে যুদ্ধের ময়দানে। তখনই ঠিক করে ফেলল, যোগাযোগ করবে ইউনিয়ান আর্মির কোনও অফিসারের সঙ্গে। আমরা জানি না, কীভাবে সে তথ্য পাচার করে। তবে এটা ধরে নেয়া যায়, এক বা দুই সপ্তাহের ভেতর কিংবদন্তির পিঙ্কারটন ডিটেকটিভ এজেন্সির কোনও আণ্ডারকাভার এজেন্টের সঙ্গে কথা বলে সে। ওই লোক আবার লিঙ্কনের হয়ে গোপন তথ্য সংগ্রহের জন্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল দক্ষিণের এলাকায়। গৃহযুদ্ধের সময় এমন শত শত গুপ্তচর ছিল দুই পক্ষেরই। সব যুদ্ধেই এমন হয়। দক্ষিণে যেমন ছিল কুখ্যাত গুপ্তচর বেলে বয়েড। একইভাবে ইউনিয়ানকে টিকিয়ে রাখতে গুপ্তচরদের ওপর নির্ভরশীল ছিল উত্তরের রাজ্যগুলো।

‘যাই হোক, এরপর ঘটতে লাগল একের পর এক ঘটনা। ওদিকে নোভাকের জাহাজ রয়েছে বারমুডার তীরে। ওটাতে তোলা হয়েছে জীবাণু ভরা পিপে। এদিকে আব্রাহাম লিঙ্কনের কানে গেল শেলির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য। ভীষণ ভয় পেলেন লিঙ্কন। দেরি না করে নোভাকের জাহাজটা খুঁজে বের করে পুড়িয়ে বা ডুবিয়ে দেয়ার জন্যে ইউনিয়ান নেভির চারটে ফ্রিগেট পাঠিয়ে দিলেন তিনি। বাহামার উপকূলে নোভাকের জাহাজ পৌঁছুবার আগেই ধ্বংস করে দেয়া হলো ওটা। সেসময়ে আবার রেড রিভার ক্যাম্পেইন শুরু করল ইউনিয়ান আর্মি। আঠারো শ’ চৌষট্টি সালের মে মাসে তারা ঢুকল লুইযিয়ানার অনেক গভীরে। বড় একটা ডিটাচমেন্টকে পাঠানো হলো ক্লোভিস প্যারিশে। যেহেতু আইন অনুযায়ী কোনও কনফেডারেট নাগরিককে কোর্ট মার্শাল করতে পারবে না ইউনিয়ান আর্মি, তাই ওই দলকে হুকুম দেয়া হলো নির্দিষ্ট এস্টেটে গিয়ে গোপনে নোভাককে হত্যা করতে। ওই একই দিনে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া হলো ভিলেনিউভ শহর। ইউনিয়ান আর্মির বিশেষ একটি দল গেল নোভাকের বাড়ি থাউয্যাণ্ড ওক-এ। কামানের আঘাতে বিধ্বস্ত হলো বিশাল ম্যানশন। ওই হামলায় মারা পড়ল নোভাকের বিশ্বস্ত ক’জন কর্মচারী এবং ফোরম্যান। আগুন ও ধোঁয়ার ভেতর খুঁজতে গিয়ে ইউনিয়ান আর্মি বুঝল, কোনও এক সুযোগে পালিয়ে গেছে উইলিয়াম এফ. নোভাক। সে ইউনিয়ানের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অশুভ পরিকল্পনা করেছিল বলে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হলো তার এস্টেট আর প্ল্যান্টেশন।’

‘ওই জায়গা দেখেছি,’ বলল জোসেফ। ‘ওখানে আছে শুধু ভাঙাচোরা ইঁট আর পাথরের ধ্বংসাবশেষ।’

‘এরপর শেলির কী হলো?’ জানতে চাইল রানা।

‘শোনা যায় শেলিকে উত্তরের কোনও রাজ্যে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দেন আব্রাহাম লিঙ্কন। মেয়েটার সাহসের জন্যে পুরস্কারও দিতে চান। কিন্তু ক্লোভিস প্যারিশ ছেড়ে বোনকে ফেলে কোথাও যেতে রাজি হয়নি শেলি। তার ইচ্ছেকে সম্মান দেখানো হয়। তবে পরে করুণভাবে মারা যায় সে। নোভাক তো পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু তার আগে বাড়ির ছাত ধসিয়ে কামানের গোলা পড়লে পঙ্গু হয় সে। আরেকটু হলে পিষে যেত। যেভাবেই হোক পালিয়ে তো গেল, ওদিকে নতুন নির্বাচিত সরকারের তরফ থেকে কেড়ে নেয়া হলো তার সব সম্পত্তি ও সম্পদ। ভয়ানক অপরাধ করতে যাচ্ছিল বলে এমন কী দক্ষিণের মানুষও মন্দ কথা বলতে লাগল নোভাকের বিরুদ্ধে। আর যাই হোক, নিরীহ মানুষকে গণহারে হত্যার ব্যাপারটাকে ভাল চোখে দেখেনি কেউ।

‘এরপর কিসেচি হিলের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকল অসুস্থ নোভাক। পরে বিয়ে করলে তার একটা ছেলেও হলো। অনেকে বলে, তখনও নোভাককে ঘিরে রাখত চরমভাবে বঞ্চিত একদল বিদ্রোহী। তারা হয়ে ওঠে গলাকাটা ডাকাত শপথ করে, একদিন প্রতিশোধ নেবে কালো কুত্তীর ওপর।’ চট করে এলিসাকে দেখলেন প্রফেসর। ‘মাফ করবে, ম্যাম। ওটাই ছিল তাদের মুখের ভাষা।’

‘তারা বাজে লোক ছিল, আপনি যে নিজে থেকে খারাপ কিছু বলছেন না, তা বুঝতে পেরেছি,’ মৃদু হাসল এলিসা।

‘নোভাক ভাল করেই বুঝেছিল, শেলি লং ল্যান্সের জন্যেই এত বড় শাস্তি পেয়েছে সে,’ বললেন প্রফেসর।

‘কাজেই গোপন আস্তানা থেকে শেলির ওপর হামলা করল সে বা তার লোক?’ যা বুঝবার বুঝে গেছে রানা।

‘চরম প্রতিশোধ নেবে এটাই তো স্বাভাবিক,’ বললেন প্রফেসর। ‘ওরা তো অমানুষ ছিল।’

‘এরপর আঠারো শ’ তিয়াত্তর সালে সেইবার দিয়ে খুন করা হলো শেলি লং ল্যান্সকে,’ কথা শেষ করল রানা।

‘তার এক সঙ্গী উপহার দিয়েছিল উইলিয়াম এফ. নোভাককে ওই তলোয়ার। ওটা দিয়েই খুন করা হয় শেলিকে। কৃষ্ণাঙ্গরা দোষ দিল নোভাককে। তবে আইন- শৃঙ্খলা বাহিনীর তরফ থেকে কোনও অভিযোগ তোলা হলো না লোকটার বিরুদ্ধে।’

‘শেলি কি বিয়ে করেছিল?’ জানতে চাইল রানা।

‘হ্যাঁ। ওরই মত মুক্তি পাওয়া এক ক্রীতদাসকে বিয়ে করেছিল। সেই লোকের নাম ছিল জোনাথন স্মিথ। দুটো ছেলেমেয়ে হয় তাদের।’

‘তাদের এই দুই সন্তানের কী হলো?’

‘জানি না, বললেন প্রফেসর। ‘জোনাথন স্মিথ আর তার বাচ্চারা শেলির মত খুন হয়েছিল কি না, ইতিহাসে উল্লেখ নেই। তাদের মতই মানুষের মন থেকে হারিয়ে গেছে নোভাকের চিহ্নও। আর কখনও তাকে দেখতে পায়নি কেউ।’

গলা পর্যন্ত মদ গিলে বসে বসে টলছেন প্রফেসর জ্যাক ম্যাকগাইভার। প্রায় ফুরিয়ে গেছে বোতল। ভারী হয়েছে তাঁর কণ্ঠস্বর। বারবার বুজে ফেলছেন চোখের পাতা। এখন পর্যন্ত যা শুনেছে, চুপচাপ হজম করছে রানা, এলিসা, জোসেফ আর রন। বোতলের শেষ দুই ঢোক মদ গলায় ঢাললেন প্রফেসর। শুরু হয়েছে একের পর এক বড় বড় হিক্কা।

‘যা বলেছি, ঠিক তাই লিখেছে ইতিহাসের বাচ্চারা। এর বেশি আর কিচ্ছু জানি না। জানব কী করে? আমি তো এক বিভ্রান্ত, ভ্রষ্ট-পণ্ডিত। লোকে লোকারণ্য গির্জায় গুরুগম্ভীর প্রার্থনার সময়ে ঠিক মাঝখানে বসা এক দুষ্ট ছেলের পুট করে দুর্গন্ধ ছেড়ে দেয়া বাতাস আমি। বুঝলেন না?’

এই পর্যন্ত বলেই টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন জ্ঞানী প্রফেসর!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *