1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৪৮

আটচল্লিশ

স্বীকারোক্তি সত্যিই দিল বিলি এস. কনরাড। শেরিফ স্যাম শেরিড্যান, রানা এবং চারজন ডেপুটির সামনে একটা কথাও গোপন করল না। সাক্ষী হিসেবে রইল তার প্রাক্তন সহকর্মীরা। প্রতিটা কথা রেকর্ড করা হলো। কাঁদতে কাঁদতে জানাল কনরাড, গত তিনবছর ধরে নোভাকদের হয়ে কাজ করছে সে। কী কী করেছে, কেন করেছে, জানাল তা-ও।

দরকার ছিল টাকার। শোধ দিচ্ছে মর্টগেজের ঋণ। তার ওপর ভাল স্কুলে পড়াচ্ছে ছেলেমেয়েদেরকে। সমস্ত খরচ দিয়েছে নোভাকরা। বদলে কোনও বিপদের সম্ভাবনা দেখলেই নোভাকদের সতর্ক করেছে সে। এ ছাড়াও ড্রাগ আর বেআইনি অস্ত্র বিক্রির সময় মুনাফার ভাগ পেত। কখনও ভাবেনি এত গভীর পাঁকে তলিয়ে যাবে। পরে যখন টের পেল, ততক্ষণে চোরাবালিতে গলা পর্যন্ত ডুবে গেছে সে।

হ্যাঁ, রানাকে খুনের দায়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার যে পরিকল্পনা করেছিল নোভাকরা, প্রথম থেকেই তাতে ছিল কনরাড। মিথ্যা নয় যে সেই রাতে রানাকে খুন করতে চেয়েছে সে। এ ছাড়া উপায় ছিল না। নইলে আদালতে রানা জানিয়ে দিত খুনির চেহারার বর্ণনা। আর আজ নিজেই সে এলিসা ও তার বাচ্চাদেরকে কিডন্যাপ করে পৌঁছে দিয়েছে নোভাক দ্বীপে।

‘কিন্তু এসব করতে চাইনি আমি,’ আবার ফুঁপিয়ে উঠল কনরাড। ‘তিনটে ছেলেমেয়ে মহিলার। নোভাকদের হাতে ওদেরকে তুলে দেয়ার সময় আমার নিজের মেয়ে সামান্থার কথা মনে পড়েছে। বারবার রিচিকে বলেছি, তোমরা এসব ঠিক করছ না। এরপর থেকে আর কখনও আমার কাছ থেকে কোনও সাহায্য পাবে না।’

কঠোর চোখে কনরাডকে দেখছে রানা। চোখে আগুন নিয়ে অপরাধী সহকর্মীকে দেখছে শেরিফ এবং ডেপুটিরা।

‘খুব সম্মানের কাজ করেছ, কনরাড, চিবিয়ে চিবিয়ে বলল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ‘এটাও ভুলে যাচ্ছি না, একটু আগে পিস্তল দিয়ে আমার মাথাটা উড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলে। যাকে খুন করতে এত কিছু করলে, সেই মাসুদ রানা সাহায্য না করলে এই মুহূর্তে মেঝেতে পড়ে থাকত আমার লাশ। একটা কথা জানো, কনরাড, সে রাতে ওর হাতে তুমি খুন হলেই হয়তো ভাল হতো।’

‘আমি দুঃখিত, শেরিফ,’ ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদতে লাগল কনরাড। ‘বুঝতে পারিনি করছি।’ মাথাটা বুকের কাছে ঝুলে গেল তার। ‘হায়, ঈশ্বর! কখনও ভাবতে পারিনি এত অপমানিত হব!’

‘একটা কথা জানো, কনরাড?’ মাথা নাড়ল শেরিড্যান। ‘তুমি যতটা লজ্জা পেয়েছ, তার দশগুণ লজ্জা পেয়েছি আমি। আমার উচিত ছিল চাকরিতে নেয়ার আগে মানুষ চিনে নেয়া। তোমার মত এত নির্বোধ এবং নির্লজ্জ লোক আগে কখনও দেখিনি। যা করেছ, বেঁচে থাকলে সেজন্যে অ্যাঙ্গোলা জেলখানায় পচবে বহু বছর। তোমার তো জানা আছে, লুইযিয়ানা স্টেট পেনিটেনশিয়ারিতে অপরাধী পুলিশদেরকে কী ধরনের নির্যাতন করে কয়েদিরা। এখন তোমার জন্যে খারাপই লাগছে।’

ডেপুটি শেরিফদের দিকে তাকাল শেরিড্যান। তার দিকে চেয়ে নেই কেউ। আগুনের মত তপ্ত দৃষ্টি সবার কনরাডের ওপর। প্রত্যেকের ভেতর ঘুরছে একই চিন্তা: এই শুয়োরটাকে গুলি করে মেরে ফেলা উচিত!

‘ফিল, রেলি, লট, ট্রন, কাপুরুষটাকে নিয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে! নিচতলায় নিয়ে গ্রেফতার দেখাবে। এমন কোনও অপরাধ নেই, যা করেনি। লিখিত অভিযোগ তৈরির সময় খেয়াল রাখবে, অন্তত বিশ বছরের ভেতর যেন জেল থেকে বেরোতে না পারে।

‘আমি হারামজাদাটাকে শুকনো প্যান্ট জোগাড় করে দেব, শেরিফ?’ জানতে চাইল ডেপুটি ফিল জনসন।

অন্যদিকে তাকাল শেরিড্যান। ‘না। ভেজা প্যান্টেই বসে থাকুক বেইসমেন্টের সেলের মেঝেতে।’

খুশিমনে শেরিফের নির্দেশ পালন করল চার ডেপুটি। টেনেহিঁচড়ে বাইরের করিডোরে নিল কনরাডকে। তার আগেই কবজিতে আটকে দিয়েছে হ্যাণ্ডকাফ। লজ্জা ও অপমানে হাউমাউ করে কাঁদছে কনরাড।

রানার দিকে তাকাল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ‘ঠিক আছে, মিস্টার রানা, এখন জানি তুমি অপরাধী নও। আর অনিচ্ছাকৃত যে ভুল হয়ে গেছে, সেজন্যে আমার বোধহয় তোমার কাছে মাফ চেয়ে নেয়া উচিত।’

‘আমি আপনার ক্ষমা-প্রার্থনা আশা করছি না, শেরিফ।’

‘তা হলে কী চাও?’

‘আগে জোসেফ গুডরিচকে জেল থেকে বের করুন।’

‘ধরে নাও তা করা হয়েছে। মুক্তি পেয়ে গেছে সে। তুমি নিজেও মুক্ত। তুলে নিচ্ছি সব অভিযোগ। আমার প্যারিশে যা ঘটল, এরপর এটা আমার দায়িত্ব। তবে আবারও পুড়িয়ে দিয়ো না আমাদের পেট্রল কার, তাতেই আমরা খুশি থাকব।’

‘আমি এই মর্মে শেরিফ ডিপার্টমেন্টের সিলমোহর করা চিঠি চাই, যাতে লেখা থাকবে: আমার বিরুদ্ধে আপনাদের কোনও অভিযোগ নেই।’

কাঁধ ঝাঁকাল শেরিফ। ‘আমার মুখের কথাই যথেষ্ট, রানা। কেউ তোমার বিরুদ্ধে আঙুলও তুলবে না।’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। জানালার কাছে গিয়ে পর্দা সামান্য ফাঁক করে বাইরে তাকাল। তা হলে গিয়ে সাংবাদিকদেরকে সেটা জানান। তাদের জানা উচিত খুনের দায় আমার ওপর থেকে তুলে নেয়া হয়েছে।’

মাথা দোলাল শেরিফ। ‘ওদেরকে ঠিক কী বলতে বলো?’

‘অর্ধেক কথা বলবেন, বাকিটা থাকুক আপনার পেটে। এটা বলাই যথেষ্ট, নতুন প্রমাণ পাওয়ায় আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। খুনের দায়ে খোঁজা হবে সত্যিকারের খুনিকে। তবে আপাতত কারও বিরুদ্ধে সন্দেহজনক তথ্য আপনাদের হাতে নেই।’

‘এই মিথ্যাটা বলব কেন?’

জানালা থেকে ঘুরে শেরিফকে দেখল রানা। ‘কারণ, আমার ধারণা টিভির সংবাদ দেখছে নোভাকরা। আমি জেলে গেলে জিম্মি বদলের সুযোগ পাবে না। রেগে গিয়ে হয়তো খুনোখুনি করবে। তবে আমি মুক্ত হলে আগের মতই এলিসা আর বাচ্চাদের বদলে আমাকে চাইবে তারা। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, ওদেরকে উদ্ধার করার জন্য হাতে খুব কম সময় পাচ্ছি।’ অফিসের দেয়ালঘড়ি দেখাল রানা। ওটাতে বাজে বিকেল পাঁচটা পাঁচ মিনিট।

‘সত্যিই ভাবছ কয়েকটা বাচ্চাকে খুন করবে নোভাকরা?’

‘তার আগে রেপ করবে একজন ভদ্রমহিলাকে, তারপর তার চোখের সামনে অকথ্য নির্যাতন করে হাত-পা ভেঙে দেবে তার তিন সন্তানের। সবশেষে অ্যালিগেটর দিয়ে খাওয়াবে ওদের সবাইকে, যাতে কোথাও ওদের চিহ্নমাত্র খুঁজে না পাওয়া যায়।’

‘ও, মাই গড!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্যাম শেরিড্যান। ঠিক আছে। আমি গিয়ে সাংবাদিকদেরকে আধ-খাপচা তথ্য দেব। আশা করি তাতে কাজ হবে। নোভাকরা ভাববে এন সার্কেল মোটেলে হাজির হবে তুমি। এদিকে রাত নামার আগেই ওখানে পৌছবে সোয়্যাট ইউনিট। নোভাকরা ওখানে গেলেই গ্রেফতার হবে। আমার ওপর বিশ্বাস রাখো, রানা, কোনভাবেই ছাড়া পাবে না রিচি আর হ্যাঙ্ক। টোকাও পড়তে দেব না বাচ্চাদের গায়ে।’

‘কিন্তু এন সার্কেলে হয়তো যাবে না দুই নোভাক। দলের কয়েকজনকে পাঠাবে আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে। আর তাতে বাধা এলেই খুন হবে এলিসা আর বাচ্চারা।’

‘তা হতে পারে। সেক্ষেত্রে তুমি কী করতে চাও?’

‘হামলা করব নোভাক দ্বীপে।’

‘ব্যাকআপ টিম হিসেবে আমার লোক পাবে। তবে তুমি

একা ওখানে পা রাখলে মস্ত ভুল করবে। তোমাকে হাতে পেলে অ্যালিগেটর দিয়ে খাওয়াবে ওরা।’

‘তবুও ঝুঁকিটা নেব আমি।’

‘প্রায়-অচেনা মানুষের জন্যে প্রাণের এমন ঝুঁকি নেবে?’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘পুরোপুরি অচেনা হলেও তাই করতাম।’

হঠাৎ ক্লান্তির ছাপ পড়ল শেরিফ স্যাম শেরিড্যানের চোখে-মুখে। ধীর গলায় বলল, ‘রিটায়ারমেন্টের সময় ঘনিয়ে এল। ভেবেছি একটা নৌকা কিনব। নদীতে ঘুরে বেড়াব নাতিদের নিয়ে। আসলে গোলাগুলির বয়স ফুরিয়ে গেছে, বুড়ো হয়ে গেছি। তবুও নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে তোমাকে একা যেতে দেব না আমি। ডেপুটি আর সোয়্যাট টিম নিয়ে তোমার সঙ্গে আমিও যাব ওই দ্বীপে।’

আরেকবার দেয়ালঘড়ি দেখল রানা। ‘ওই দ্বীপ শুনেছি দুর্গম ঘাঁটি। চারপাশে পরিখার মত বাইয়ু। দ্বীপে ঘন হয়ে জন্মেছে জঙ্গল। মাঝে নোভাকদের বাড়ি। যে-কোনও দিক থেকে হামলা হবে।’

‘দলে ভারী হয়েই যাব। সঙ্গে থাকবে সোয়্যাট ট্যাঙ্ক আর ট্রুপার।’

এতজন গেলে টের পাবে নোভাকরা, ভাবছে রানা। আজ গুডরিচের খামারে যে আনাড়িপনা দেখাল পুলিশ আর ট্রুপাররা, তার এক শতভাগের একভাগ ভুল হলে এরাও খুন হবে নোভাকদের হাতে, এলিসা আর বাচ্চারাও। শেরিফকে মানা করে দিতে গিয়েও মনে পড়ল, কাঁচা ওর পেটের ক্ষত। ওকে লড়তে হবে একদল ইবলিশের বিরুদ্ধে। তবুও বোঝাতে চেষ্টা করল শেরিফকে, ‘আপনারা গেলে হয়তো খুন হবে এলিসা আর বাচ্চারা। আমার একা যাওয়াই ভাল।’

মাথা নাড়ল শেরিফ। ‘নিজের দায়িত্ব এড়াতে পারি না, রানা। যেতে আমাকে হবেই।’

শেরিফ শুনবে না, বুঝে গেল রানা। ক’মুহূর্ত ভাবার পর ও বলল, ‘সত্যিই যেতে চাইলে দলের সবাইকে তৈরি হতে বলুন।’

মাথা দোলাল শেরিড্যান। ‘ধরে নাও, নিজের চামড়া বাঁচাতে চাইছি। আবারও পরিবারের কেউ খুন হলে আদালতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলবে জোসেফ গুডরিচ। অথবা হয়তো আদালতে গেলই না। আমার ভুলে খুন হয়েছে ওর প্রথম স্ত্রী। নোভাকরা আরও খারাপ কিছু করলে হয়তো নিজ হাতে আমাকে গুলি করে মারবে জোসেফ।’

‘ক্যারির ব্যাপারটা শুনেছি ওর মুখে,’ বলল রানা।

চোখ নিচু করল শেরিড্যান। ‘মস্ত ভুল করেছি। চিরকালের জন্যে দোষী হয়ে গেছি বিবেকের কাছে।’

শেরিফের চোখে অনুতপ্ত দৃষ্টি। রানা নরম সুরে বলল, ‘তো বাইরে গিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়ে দিন আমি এখন মুক্ত। এরপর অ্যাটাক টিম গুছিয়ে নেয়ার সময় দলের সদস্যদেরকে বলবেন, আপনাদের সঙ্গে অবসার্ভার হিসেবে আমিও যাব নোভাক দ্বীপে।’

মাথা দুলিয়ে দরজার দিকে চলল শেরিফ শেরিড্যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *