ষোলো
আরও কয়েক ঘণ্টা পর গুহা থেকে বেরোল মাসুদ রানা। চারপাশে ঘন অরণ্য। সাধারণ মানুষ এমন জঙ্গলে হারিয়ে গেলে ভাববে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছে সে। চারদিকে ভয়ঙ্কর বিপদ, যদিও তার বেশিরভাগই কাল্পনিক। একবার এ ধরনের গোলকধাঁধার মত অরণ্যে পথ হারালে বেরোতে পারবে না তারা। তবে রানা ঠিক বুনো জন্তুর মতই নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। খিদে লাগলে শিকার ধরে কাঁচা খেতেও দ্বিধা করবে না। ঝর্না থেকে খালি হাতে ধরবে মাছ। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে এই যে চলেছে, তারও কোনও প্রমাণ থাকবে না কোথাও। নিজের বাড়ির সামনের বাগানের মতই এ ধরনের এলাকা চেনে রানা।
অবশ্য পরিবেশ এখন বিরূপ। রানা একা, নিরস্ত্র, আহত। তার ওপর ওকে খুঁজছে এখন লুইযিয়ানা স্টেটের শত শত পুলিশ। খুঁজছে হন্যে হয়ে। খুনের দায়ে।
প্রচুর রক্তক্ষরণে খুব দুর্বল বোধ করছে রানা। ভাল করেই জানে, বিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে টিকে থাকা খুবই কঠিন হবে।
তুমি শুধু দুটো দিন কোনমতে টিকে থাকো, বারবার নিজেকে বলছে রানা। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে চলার সময় প্রতিবার সামনের এক শ’ গজ দূরের কোনও গাছকে টার্গেট করছে। একবার ওখানে পৌছে গেলে আবারও স্থির করছে পরের টার্গেট। অবশ্য এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর দুর্বলতার কারণে টার্গেট নামিয়ে আনল পঞ্চাশ গজে। তারও কিছুক্ষণ পর প্রতি বিশ গজ পেরোতে নিজেকে সাহস জোগাতে লাগল। রানা এতই দুর্বল, বারবার মনে হচ্ছে পরের কদম ফেলতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে। ভীষণ শুকিয়ে গেছে গলা। ও তৃষ্ণার্ত। পেটেও কিছু দেয়া দরকার। দুর্বলতার কারণেই কি না কে জানে, ভীষণ খিদে লেগেছে। তবে এখন পর্যন্ত আশপাশে একটা জলাশয় বা খরগোশ চোখে পড়ল না।
আরও আধঘণ্টা চলার পর নিচের দিকে সামান্য ঢালু হলো জঙ্গলের মেঝে। তাতে কিছুটা সহজ হলো হাঁটা। একটু পর উপড়ে পড়া এক শেওলা ধরা গাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে বসল রানা। শুনছে কাছেই কলকল করে বইছে পাহাড়ি ঝর্না। আওয়াজটা আসছে ঢালু জঙ্গলের আরও কিছুটা নিচের দিক থেকে। একটু বিশ্রাম নিয়ে ওদিকেই চলল রানা। চারপাশে হালকা হয়ে এল জঙ্গল। ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে ওর চোখে পড়ল রোদে ঝিকিয়ে ওঠা পানি। ওটা ধীর গতির সবুজ, নোংরা বাইয়ু নয়। ছল-ছলাৎ আওয়াজে নাচতে নাচতে চলেছে পাহাড়ি ঝর্না। পরিষ্কার টলটলে জল। চারপাশের পরিবেশটা রীতিমত লোভনীয়।
সবুজ ঝোপঝাড় গিয়ে থেমেছে নদীর তীরে। তৃষ্ণায় শুকনো কাঠের মত খড়খড়ে গলা নিয়ে নদীর দিকে পা বাড়িয়েও থেমে গেল রানা।
ছেলেটার বয়স বড়জোর তেরো কি চোদ্দ। উজানে মাত্র বিশ গজ দূরে। বড় এক সাইপ্রেস গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছিপ ফেলেছে নদীতে। রানা লক্ষ করল, বেশ বড়সড় একটা মাছ আটকেও ফেলেছে বড়শিতে। ছেলেটার খুব কাছে পৌঁছে না গেলে রানা টেরই পেত না ওখানে কেউ আছে। কিশোরের পরনে মিলিটারি ক্যামোফ্লেজ জ্যাকেট ও প্যান্ট। চট্ করে ওগুলো চিনল রানা। জঙ্গলে ব্যবহারের জন্যে ইউএস আর্মির তৈরি ইউনিফর্ম। জ্যাকেটটা ছেলেটার তুলনায় তিন সাইয বড়। ঢলঢল করছে হাড্ডিসার শরীরে। প্যান্টের পায়া তুলেছে হাঁটু পর্যন্ত। ছেলেটাকে ঝোপের ভেতর লাগছে একটু বেশি ঘন সবুজ ঝোপ। কলকল করে বইছে ঝর্না। একদৃষ্টে পানির দিকে চেয়ে রয়েছে কিশোর। রানার দিকে পিঠ। একবার মাছটাকে কাছে নিয়ে আসতে পারলেই নেমে পড়বে হাঁটু পানিতে। দু’হাতে ধরেছে ছিপ। টানটান হয়ে আছে সুতো। মাছটা চটাস্ করে লেজের ঝাপ্টা মারল পানিতে।
সহজেই কিশোরের পেছনে পৌঁছুতে পারবে দক্ষ কোনও শিকারী। তীরের ঝোপে ঢুকল আহত, হতক্লান্ত রানা। একটু পর খোলা জায়গায় বেরিয়ে এসে প্রায় পৌঁছে গেল ছেলেটার পেছনে। ডেঙ্গু জ্বরের রোগীর মত বনবন করে ঘুরছে রানার মাথা। ঝাপসা হয়ে আসছে চোখ। স্পষ্ট দেখার জন্যে একটু পর পর মিটমিট করছে দু’চোখ। নদীতীর থেকে কয়েক গজ পেছনে রাখা আছে ছেলেটার ব্যাকপ্যাক। ওটার চেইন খোলা। ভেতরে দুই লিটারের একটা পেপসির প্লাস্টিক বোতল দেখল রানা। এ ছাড়া আছে বড় একটা লোভনীয় চকোলেট বার। ওটার ওপর আঠার মত সেঁটে গেল রানার দৃষ্টি, পানি এসে গেছে জিভে। যেমন করে হোক চকোলেট বারটা ওর চাই-ই চাই। এটা চুরি হোক বা ডাকাতি, ওটা ছাড়া যেন বাঁচবে না ও, তেমনই মনে হলো রানার। তবে এ-ও লক্ষ করল, এরই মধ্যে রুপালি রাংতা খুলে চৌকো কয়েক টুকরো চকোলেট খেয়ে নিয়েছে রাক্ষসটা।
ছিপ-সুতো ছাড়াও ছেলেটা সঙ্গে এনেছে তীর-ধনুক। তূণে ভরা ঝকঝকে এক সেট তীর দেখা যাচ্ছে। ধনুকটা আকারে কিছুটা ছোট হলেও অত্যন্ত আধুনিক। চকচক করছে অ্যালিউমিনিয়ামের ফ্রেম, কেব্ল্ ও পুলি। ধনুকের পাশেই রয়েছে তৃণ। মাছ ধরতে না পারলে ছেলেটা হয়তো ডিনারের জন্যে জঙ্গল থেকে শিকার করত জ্যাকর্যাবিট বা বুনো টার্কি। অথবা, কে জানে, তীর-ধনুক রেখেছে হয়তো আত্মরক্ষার জন্যে। মাঝে মাঝেই এদিকে আসে কালো ভালুক। ঘটনা যা-ই হোক, তরুণ শিক্ষানবিশ শিকারির জন্যে এই তীর- ধনুক ভাল একটা অস্ত্র। তবে ছেলেটা বেখেয়াল। ওর বয়সে রানা হলে কখনও ধুলোর ভেতর ধনুক ফেলে রাখত না। জঙ্গল বা পাহাড় থেকে নেমে এসে তীর-ধনুক চুরি করতে গিয়ে হয়তো ছেলেটাকে খুন করবে কোনও চোর।
ছেলেটা জানে না খুব কাছে পৌঁছে গেছে কেউ। মাছটাকে তীরে তুলবে বলে ব্যস্ত সে। নিঃশব্দে নিজের ব্যাগ মাটিতে রেখে ছেলেটার ব্যাকপ্যাক থেকে পেপসির বোতল নিল রানা। কয়েক ঢোক কালচে তরল গিলে চকোলেট বার থেকে ভেঙে মুখে ফেলল কয়েক টুকরো চৌকো অমৃত। একগাদা চিনির জোরে মুহূর্তে শরীরে ফিরল শক্তি। এখনও রানার দিকে পিঠ দিয়ে আছে ছেলেটা। মাছের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারছে না। রেগে গিয়ে চিৎকার করল: ‘উঠে আয়! উঠে আয় বলছি!’
ছেলেটা সুদর্শন, বড় হলে সুঠাম হবে। বারবার বামহাতে চোখের ওপর থেকে সরিয়ে দিচ্ছে দীর্ঘ সোনালি চুল। পেপসির বোতলে আরেক চুমুক দিয়েই দ্বিতীয় ছেলেটাকে দেখল রানা। এই ছেলে আরও ছোট। বয়সে বড়জোর পাঁচ বা ছয়। তেরো বছরের ছেলেটা শ্বেতাঙ্গ হলেও এই পিচ্চি বর্ণসংকর। মাথার চুল ও ত্বক চকোলেটের মত খয়েরি। নদীতীর থেকে একটু দূরে কয়েকটা পাথরের বোল্ডারের ভেতর বসে আনমনে খেলছিল, কিশোর ছেলেটা চিৎকার করে ওঠায় হৈ-হৈ করে দৌড়ে এল সে। গলা ফাটিয়ে উৎসাহ দিচ্ছে ওর ওস্তাদকে।
‘পারবে তুমি! এক টানে তুলে আনো! মারো টান হেঁইও!’
দু’জনের বয়সের পার্থক্য দেখে রানার মনে হলো না ওরা বন্ধু। মনে প্রশ্ন জাগল, এরা স্কুলে যায়নি কেন?
আরেক টুকরো চকোলেট চিবুতে গিয়ে নিজেকে ভয়ঙ্কর খারাপ এক চোর বলেই মনে হলো রানার। ও আহত হোক বা হোক মৃতপ্রায়, এটা খুব লজ্জার ব্যাপার যে ওর পেটে চালান হচ্ছে বাচ্চার কাছ থেকে চুরি করা খাবার। বদলে ওদেরকে পুষিয়ে দিতে হবে। টাকা দিয়ে দেয়াই ভাল। ওর মানিব্যাগ ফুলে আছে আমেরিকান ডলারে। ওখান থেকে দশ ডলারের পাঁচটা নোট নিয়ে ছেলেটার ব্যাকপ্যাকে গুঁজে দিল রানা। তাতে একটু কমল চুরির গ্লানি।
তবে মুশকিল হচ্ছে, এখন যে-কোনও সময়ে ওকে দেখে ফেলবে ওরা। রক্তাক্ত একটা লোক। ওদের দৃষ্টিতে খুনি বা ডাকাত! ছেলেগুলো একদৌড়ে গিয়ে অভিভাবকদেরকে খবর দেবে, জানাজানি হয়ে যাবে ওর উপস্থিতির কথা। নিঃশব্দে আবারও জঙ্গলে গিয়ে ঢুকবে, ভাবল রানা।
ছেলেরা নদীতীর থেকে সরে গেলে আবারও ফিরবে ও এখানে। পেট ভরে পানি খাবে। তখন ধুয়ে পরিষ্কার করবে মুখ-হাত-পা।
নিজের ব্যাগটা তুলে নিয়ে নীরবে সরে যেতে গিয়েও আবার থমকে দাঁড়াল রানা। নদীতীরে দেখা যাচ্ছে কেমন অস্বাভাবিক নড়াচড়া। জিনিসটার গায়ে ধূসর ও কালো ছোপ-ছোপ চক্কোর আঁকা। লম্বা। বাচ্চাদের বাহুর মত মোটা। ঘাসের মাঝ দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে কিশোরের বাম পা লক্ষ্য করে। মাথাটা ত্রিকোণ। চাঁদিতে আবছা সব দাগ। রানা বুঝে গেল, ওটা কোনও ধরনের পিট ভাইপার!
এ-ও বুঝল, মস্তবড় বিপদে আছে বড় ছেলেটা। মাছ তুলতে গিয়ে কোনও দিকেই আর নজর নেই। নড়াচড়া ও চেঁচামেচি করতে গিয়ে বিরক্ত করেছে সাপটাকে। জানে না, ওর দিকে তেড়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যু!
দ্বিতীয়বার ভাবল না রানা। খপ্ করে মাটি থেকে তুলে নিল ধনুক। সেইসঙ্গে বিদ্যুৎ-বেগে তূণ থেকে কার্বন ফাইবারের একটা তীর তুলে নিয়ে ছিলায় পরাল। শক্ত হাতে ধনুক ধরল রানা। এতই দুর্বল হয়ে গেছে যে ওটাকে খুব ভারী লাগল ওর কাছে। ছিলা কানের কাছে টানতে গিয়ে প্রায় ফুরিয়ে গেল শক্তি। কাঁপা হাতে সাপের দিকে তাক করল তীর। বড় একটা গোল বিস্কিটের সমান হবে পিট ভাইপারের মাথা। এগোতে গিয়ে বারবার উঁচু করছে। দু’বার চোখ টিপে দৃষ্টি পরিষ্কার করে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে হাত স্থির করল রানা।
ছেলেটার বাম পায়ের খুব কাছে পৌঁছে গেছে পিট ভাইপার। হঠাৎ করেই কয়েলের মত গুটিয়ে গেল। মাটি থেকে মাথা ওপরে তুলে পিছিয়ে নিল ঘাড়। খোলা মুখ থেকে বেরোল হিলহিলে, কালো, চেরা জিভ।
ওই একইসময়ে ঘুরে রানাকে দেখে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল বাচ্চা ছেলেটা। চরকির মত ঘুরে তাকাল ওর কিশোর সঙ্গী। ভয় পেয়েছে বলে ওর হাত থেকে ছপাস্ করে নদীতে পড়ল ছিপ। বিস্ফারিত চোখে রক্তাক্ত রানাকে দেখছে ছেলেটা। বুঝতে পারছে না, হঠাৎ কোথা থেকে এল এই ভয়ঙ্কর লোকটা। পরনে ময়লা জিন্সের প্যান্ট। কাঁধে ঝুলছে জ্যাকেট। পেটে ছেঁড়া শার্টের টুকরো। দুলছে লোকটা ওর ধনুক হাতে।
তখনই হঠাৎ এগিয়ে ফোঁস আওয়াজ তুলে ছোবল দিল পিট ভাইপার। খুলে হাঁ হয়ে গেছে চোয়াল। এতই দ্রুতগতি যে আবছাভাবে ওটাকে দেখল রানা।