1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৪০

চল্লিশ

মোটর সাইকেলে চেপে বাড়ি ফিরল হ্যাঙ্ক ও রিচি নোভাক। সেই ছোটবেলা থেকেই এখানে বাস করেছে ওরা তিন ভাই। এখন একজন নেই বলে ফাঁকা লাগছে চারপাশ

দ্বীপে একমাত্র ইঁটের দালান বলতে এই বাসাবাড়িটাই। গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মাত্র কয়েকজন পলাতক সঙ্গীর সাহায্য নিয়ে আঠারো শত আটষট্টি সালে এটা তৈরি করেছিল উইলিয়াম নোভাক। এরপর থেকে এই বংশের লোকদের হেডকোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে এই বাড়ি। এমন এক জায়গা, যেখানে বিপদ হলে লুকিয়ে পড়ত তারা। কারও সাহস নেই এই দ্বীপে পা রাখবে। শুধু যে এই দ্বীপ দুর্গম দুর্গের মত, তা নয়, এখানে রয়েছে পনেরো একর জমির ভেতর দুর্ভেদ্য জঙ্গল। দ্বীপের চারদিকে কাদাভরা থকথকে বাইয়ুতে গিজগিজ করছে নরখাদক একপাল অ্যালিগেটর এই দ্বীপে পা রাখতে বা বেরোতে হলে ব্যবহার করতে হবে শক্তপোক্ত একটা কাঠের সেতু। ওটা আবার পাহারা দেয়া হয় সবসময়। দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা।

ক্যাজুনদের বুড়োবুড়িরা নোভাক দ্বীপের কথা শুনেছে বাবা-মার কাছে। নোভাকরা এখানে বাস করতে শুরু করার আগে এই দ্বীপের নাম ছিল ভুডু আইল্যাণ্ড। বলা হয়, এখানে কালো জাদুর অনুষ্ঠান করত ক্রিয়োল জাতির মানুষ। অনেকে বলে শয়তানের কাছে ক্ষমতা পাওয়ার জন্যে কালো জাদুকররা নরবলি দিত এ দ্বীপে। আরও আগে একই কাজ করত ইণ্ডিয়ান পুরোহিতরা।

বাড়িতে প্রবেশ করে পাথরের তৈরি লিভিংরুমে পা রাখল রিচি ও হ্যাঙ্ক। ঘরের এককোণে টিভি। উল্টো দিকের কোণে ফ্রিয়। খানিকটা দূরে কয়েকটা আর্মচেয়ার ও অস্ত্রে ভরা গান র‍্যাক। এ ছাড়া ঘরে আর কোনও আসবাবপত্র নেই। চিলার থেকে আধখালি ভোদকার বোতল নিল হ্যাঙ্ক। মগে কয়েক পেগ মদ ঢেলে ঢকঢক করে গিলল। একটা বিয়ারের বোতল খুলে চুমুক দিল রিচি।

হাতের ব্যথা নিয়ে নালিশের সুরে অভিযোগ তুলছে হ্যাঙ্ক। তবে তাকে পাত্তা না দিয়ে পাথরের পুরনো ফায়ারপ্লেসের ওপর রাখা পারিবারিক ছবির ফ্রেমগুলো দেখল রিচি। রঙ জ্বলে যাওয়া এক ছবিতে আছে তাদের বাবা উইলকার ‘কিলার’ নোভাক। পৃথিবীতে মাত্র ওই একজনকেই ভয় পেত রিচি। খুশি মনে মদ গিলতে গিলতে বাষট্টি বছর বয়সে মরে গেল লোকটা। পাশে দেয়ালে ঝুলছে পূর্বপুরুষদের পোরট্রেট। তাদের ভেতর গর্বিত চেহারায় দাঁড়িয়ে আছে উইলিয়াম এফ. নোভাক। ইয়াঙ্কি সৈনিক দলের হামলার পর প্ল্যান্টেশনের সেই বিধ্বস্ত বাড়ি থাউয্যাণ্ড ওক থেকে প্রায় কিছুই পাওয়া না গেলেও এই তৈলচিত্রটা পাওয়া গিয়েছিল। ছবিতে দেখা যাচ্ছে সাদা কলাম দিয়ে তৈরি রাজকীয় বিশাল এক বাড়ি। পেছনে নীল আকাশ।

এই তৈলচিত্র দেখলেই বুকে তিক্ত আগুনের শিখা জ্বলে ওঠে রিচি নোভাকের। সেই ছোটবেলা থেকে শুনেছে কত বিলিয়ন ডলারের তুলার প্ল্যান্টেশন ছিল তাদের। অথচ, আজ আর তার কিছুই অবশিষ্ট নেই!

যে পরিবারের মানুষদের গর্বিত হয়ে সমাজে মাথা তুলে ঘোরার কথা, আজ তাদেরই কী করুণ পরিণতি!

একেই বলে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, নইলে আজ গোটা রাজ্যের সবচেয়ে ধনী থাকত তারা।

কী দুর্ভাগ্য, সব হারাতে হয়েছে বেইমান এক কালো কুত্তীর জন্যে। কখনও শেলি লং ল্যান্সকে মন থেকে মাফ করতে পারবে না রিচি। বহুবার ভেবেছে, নরকের আগুনে বারবার পুড়ে ছাই হোক বেশ্যাটা!

দক্ষিণের হিরো হওয়ার কথা তাদের পূর্বপুরুষ উইলিয়াম এফ. নোভাকের, কিন্তু সামান্য এক দ্বীপে চোরের মত লুকিয়ে শেষ জীবনটা পার করতে হয়েছে তাকে।

ওই মেয়েলোকের জন্যেই আজ অপরাধী-জীবন মেনে নিতে হয়েছে রিচিদেরকে। পুরো পরিবারটা অভাবে থেকেছে গ্রেট ডিপ্রেশন, প্রহিভিশন আর দুটো বিশ্বযুদ্ধের সময়। বেআইনি কাজ করছে বলে যে-কোনও সময়ে আইনের লোকের হাতে ধরা পড়ে জেলে যাওয়ার আশঙ্কা তাড়া করে ফিরেছে তাদের। কারই বা ভাল লাগে চোরের মত অসম্মানিত জীবন যাপন করতে?

ছোটবেলা থেকেই রিচি দেখেছে, বিলাস করার মত টাকা নেই তাদের। এ পরিবারের পুরষদের যে একসময়ে বিলিয়ন- বিলিয়ন ডলার ছিল, তার সবই গেছে এক হারামি, কালো মেয়েলোকের শয়তানিতে

দেয়ালের দিকে তাকাল রিচি। কয়েক দিন আগেও ওখানে ঝুলত উইলিয়াম এফ. নোভাকের ক্যাভালরি সেইবার। পরে ওটা ব্যবহার করেই ইয়াঙ্কিদের পা চাটা বেইমান কুত্তী শেলি লং ল্যান্সের বংশের শেষ নিগারটাকে খুন করেছে সে।

এতবছর পর শয়তানের বাচ্চা কালো বেশ্যাটাকে খুঁজে বের করেছিল প্যাট্রিক। আর সেজন্যে ভাইকে নিয়ে গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল রিচির। যত দেরিই হোক, পূর্বপুরুষদের ঋণ শোধ করেছে ওরা তিন ভাই মিলে।

প্যাট্রিক বোকা হলেও সে-ই বের করেছিল কোথায় আছে শেলি লং ল্যান্সের বংশধর কুত্তী লিয বাউয়ার।

ড্রাগসের মামলায় ফেঁসে যাওয়ায় লুইযিয়ানা স্টেট পেনিটেনশিয়ারিতে সাজা হয়েছিল প্যাট্রিকের। তখনই ওর সঙ্গে পরিচয় হয় রডরিগের। মেয়েদের ধর্ষণ করার পর নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা ছিল তার প্রিয় হবি। লোকটাকে সহ্য করতে সমস্যা হতো না প্যাট্রিকের। তবে জেলের অনেকেই রডরিগকে খুন করতে চাইত। তাদেরই একজন ছিল স্টিভ বোমার। ন্যাড়ামাথা, নিরীহ চেহারার চশমাওয়ালা মধ্যবয়স্ক লোক সে। চার বছর আগে মাতাল হয়ে গাড়ি চাপা দিয়ে দুটো বাচ্চাকে মেরে ফেলে। ওই খুনের দায়ে জেল হওয়ার আগে বোমার ছিল জিনিয়ালজিস্ট। সে আসলে কী ধরনের কাজ করত, জানতও না প্যাট্রিক। কিন্তু কারাগারের সেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার সময় আলাপ করল লোকটার সঙ্গে। প্যাট্রিক জানাল কত বড় বংশের মানুষ সে। কথায় কথায় বলল, নোভাকদের প্রতি কী ধরনের বেইমানি করেছে শেলি লং ল্যান্স। সে যদি পারত প্রতিশোধ নিতে, তো পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিত মেয়েলোকটার বংশধরদের প্রত্যেককে। সেক্ষেত্রে বড় দুই ভাই বুঝত, আসলে কতটা বুদ্ধি ওর।

জেলখানায় খুব অসহায় বোধ করত স্টিভ বোমার। প্রথম বছর নিগ্রো ষণ্ডাদের যৌন নির্যাতনে গররাজি হওয়ায় কয়েকবার প্রচণ্ড মার খেয়ে গুরুতর জখম হয়েছিল। তখনই বুঝে গেছে, শেষপর্যন্ত করুণভাবে মরবে এই জেলে। খুব মন খারাপ নিয়ে বসে থাকত সেলের ভেতর। বারবার ভাবত, কীভাবে আত্মহত্যা করে দূর করবে এই জীবনের গ্লানি। আর সেসময়েই তাকে ভাল একটা প্রস্তাব দিল প্যাট্রিক। পরের তিন বছর স্টিভ বোমারকে নিরাপত্তা দেবে সে। বদলে সাজা শেষ হলে তার জন্যে শেলি লং ল্যান্সের উত্তরপুরুষদেরকে খুঁজে বের করবে বোমার।

এই প্রস্তাব ছিল বোমারের কাছে স্বর্গ হাতে পাওয়ার মত।

সাধারণ জেলখানার চেয়ে অনেক খারাপ পরিবেশ অ্যাংগোলা, অর্থাৎ লুইযিয়ানা স্টেট কারাগারের। কিছুদিনের ভেতর ঘুষ দিয়ে দুর্নীতিপরায়ণ এক গার্ডকে হাত করল প্যাট্রিক। সংগ্রহ করা হলো ইন্টারনেট সংযোগসহ একটা ল্যাপটপ। সরকারি অফিসে বসে পেশাদার এক জিনিয়ালজি সফট্ওয়্যার ইন্সটল করল বোমার ওটাতে। এরপর ঘাঁটতে লাগল আমেরিকার জাতীয় প্রতিটি ডেটা। কবরস্তান, চার্চ, আদমশুমারি, মিলিটারি, কোর্ট, জেলখানা, ভূমি রেকর্ড, মৃত্যু- সনদ, খবরের কাগজের আর্টিকেল, মানুষের উইল করা কাগজপত্র, আয়করের সনদ বাদ পড়ল না কিছুই। ওসবের কিছুই বুঝত না প্যাট্রিক, তবে অলস চোখে দেখত গাদা গাদা তথ্য ঘাঁটছে তার নতুন বন্ধু।

এভাবে কয়েক মাস যাওয়ার পর জানা গেল, স্টিভ বোমার আসলেই খুব পারঙ্গম লোক। সব তথ্য ঘেঁটে বের করে এনেছে অতি জরুরি খবরটা।

আঠারো শ’ তেয়াত্তর সালে বোন শেলি লং ল্যান্স মারা গেলে বিয়ে করে জিলিয়ান লং ল্যান্স। স্বামী রেমণ্ড গোমেজের সঙ্গে চলে যায় আর্কানসাসে। পুলাসকি কাউন্টিতে গিয়ে মাঝারি এক খামার গড়ে তোলে স্বামী-স্ত্রী। তিনবছর পর তাদের একটা ছেলে জন্মায়। তার নাম ছিল অরেন্স গোমেজ। তারপর আঠারো শত নিরানব্বুই সালে অরেন্স বিয়ে করল ড্যান্সি মোবাম্বা নামের এক মেয়েকে। তাদের একটা ছেলে হলো। তার নাম জন গোমেজ। উনিশ শ’ ছত্রিশ সালে বিয়ে করে সে। আর সেই বছরই মারা গেল তার দাদী। এরপর আবারও দক্ষিণে লুইযিয়ানায় ফিরল জন গোমেজ। সে এবং তার স্ত্রীর প্রথম মেয়ের নাম লুসি। মাত্র তিন বছর বয়সে নিউমোনিয়ায় মারা গেল সে। গোমেজ পরিবারে উনিশ শ’ একচল্লিশ সালে জন্ম নিল দ্বিতীয় সন্তান পেটি। এরপর উনিশ শত ছিষট্টি সালে চিটিমাচার এক খামার মালিক এল বাউয়ারকে বিয়ে করল সে। একটা মেয়েও হলো তাদের উনিশ শ’ সাতাত্তর সালে। তার নাম লিয বাউয়ার। কম বয়সেই মারা গেল তার মা পেটি গোমেজ আর বাবা এল বাউয়ার। এই লিয বাউয়ার বিয়ে করল মার্ক ডওসন নামের কৃষ্ণাঙ্গ এক ডেন্টিস্টকে। তবে বেশ কয়েক বছর সংসার করার পর তালাক হলো তাদের দু’জনের। বর্তমান কাগজপত্র অনুযায়ী আবারও নিজের বাবার বংশের পদবি ব্যবহার করছে লিয বাউয়ার।

স্টিভ বোমারের কাছ থেকে প্যাট্রিক জানল, শেলি লং ল্যান্সের রক্ত-সম্পর্কিত একজন আত্মীয় আজও বেঁচে আছে পৃথিবীর বুকে।

অর্থাৎ, উইলিয়াম এফ. নোভাকের প্রতিশোধ নেয়ার শপথ এখনও পরিপূর্ণতা পায়নি। প্যাট্রিক ভাবল, আগের সে ক্ষমতা বা বিপুল টাকা ফেরত না পেলেও উত্তরপুরুষদের উচিত রক্তের হিসাব মিটিয়ে দেয়া। আর তাতে বড় দুই ভাইয়ের কাছে নিজের গুরুত্বটাও তুলে ধরতে পারবে সে।

শেলি লং ল্যান্সের রক্ত-সম্পর্কিত কেউ বেঁচে আছে সেটা প্যাট্রিকের কাছে জানতে পেরে খেপে গিয়েছিল রিচি আর হ্যাঙ্ক। দেরি না করে খোঁজ নিতে শুরু তারা। জানা যায়, কোথায় যেন গেছে লিয বাউয়ার। এরপর পেরিয়ে গেল কয়েকটা বছর। এ সময়ে জেলখানা থেকে ছাড়া পেল প্যাট্রিক। আর তার কয়েক দিনের ভেতর নোভাকরা জানল, ইউরোপ থেকে চিটিমাচায় ফিরেছে লিয বাউয়ার।

এদিকে স্টিভ বোমার জরুরি তথ্য দেয়ার পর, তাকে আর নিরাপত্তা দেয়নি প্যাট্রিক। খবরটা জানাবার তেরো দিনের মাথায় কারাগারের স্নানঘরে জবাই হয়ে খুন হয় বোমার। ওই খুনের দায়ে আরও দশ বছরের জেল হয় জেরেমি হল নামের এক কয়েদীর।

বহু দিন ধরে প্রতিশোধ নিতে চাইলেও খুব সহজেই লিয বাউয়ারকে খুন করতে পেরেছে রিচি। খুনের দায় চাপিয়ে দিয়েছে বিদেশি মাসুদ রানার ঘাড়ে। সে ডাকাতি ঠেকিয়ে নোভাকদের পুরনো স্যাঙাৎ জর্জি এস. ডানকে ধরে হিরো হয়ে উঠেছিল স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার পাতায়। খুনের পর দায় চাপিয়ে দেয়ার জন্যে এমন লোকই খুঁজছিল রিচি। তিন ভাই হেসেছে: কত সহজেই না ঘাড় থেকে খুনের দায় নামিয়ে দিচ্ছে তারা।

তখন ওরা বোঝেনি জড়িয়ে যাচ্ছে কতবড় ঝামেলায়। অবশ্য এবার সবই শেষ হবে ঠিকঠাক ভাবে।

বাইয়ুর অ্যালিগেটর দিয়ে রানাকে খাওয়াবার সময় প্রাণ খুলে হাসবে রিচি ও হ্যাঙ্ক। লোকটাকে ধীরে ধীরে একটু একটু করে চুবিয়ে মারবে ওরা। একইঞ্চি-দু’ইঞ্চি নামাবে বাইয়ুর পানির নিচে। বা একটা পা রাখবে অ্যালিগেটরের জন্যে। হয়তো হাঁটু কেটে নেবে ওসাইরিস বা তার ভাই- বেরাদাররা।

মরার আগেই মাসুদ রানাকে পানি থেকে তুলে আনবে তারা। চিৎকার করে নিজের মৃত্যু কামনা করবে লোকটা।

রাতের ওই পার্টি হবে দীর্ঘ। চিরকালের জন্যে সময়টা স্মরণীয় করে রাখবে হ্যাঙ্ক ও রিচি।

মাসুদ রানার মৃত্যু হবে খুবই যন্ত্রণার।

বিয়ার ও বারবিকিউ খেতে খেতে মৃত্যুদৃশ্য দেখবে রিচি ও হ্যাঙ্ক।

ডকে বাজবে রোমান্টিক বাজনা।

উলঙ্গ সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে নাচবে তারা।

পুরনো প্রতিশোধের আগুন নিভতেই ওদের ভিতর যেন জ্বলে উঠেছে নতুন আরেক প্রতিহিংসা!

এবার রক্ষা নেই মাসুদ রানার!

খুব দ্রুত তাকে খুঁজে বের করবে রিচি আর হ্যাঙ্ক!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *