1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ১৮

আঠারো

হঠাৎ জেগে উঠে কোথায় আছে বুঝল না রানা। পিঠের নিচে নরম, আরামদায়ক বিছানা। জানালার নেটের পর্দার মাঝ দিয়ে মেঝেতে এসে পড়েছে ঝলমলে সোনালি রোদ। চারপাশে তাকাল রানা। এটা ছোট বেডরুম। কাঠের দেয়ালে হলদে প্যানেল। সুতির চাদর থেকে আসছে ল্যাভেণ্ডারের সুবাস। মাথার নিচে নরম বালিশ।

এখন আর বমি-বমি ভাব ও মাথা ঘোরা নেই। পেটে চাপা ব্যথা। উঠে বসতে যেতেই বাড়ল ওটা। বুকের ওপর থেকে চাদর সরে গেছে। রানা দেখল, ওর পরনে জাঙ্গিয়া ছাড়া আর কিছুই নেই। পেটের চেরা ক্ষতের ওপর দক্ষ হাতে ড্রেসিং করেছে কেউ। বিছানার পাশেই কাঠের চেয়ারে রাখা ওর পোশাক। ধুয়ে, শুকিয়ে, ভাঁজ করে রাখা হয়েছে ওগুলো। বিছানার পাশের কেবিনেটে একটা বাউল ভরা ফলমূল ও এক গ্লাস পানি।

পরিবেশটা অদ্ভুত লাগছে রানার। কারণ, ভাল করেই মনে আছে, জ্ঞান হারাবার আগে ওর মুখের দিকে তাক করা ছিল একটা বন্দুকের নল। ভীষণ আতঙ্ক নিয়ে ওকে দেখছিল এলিসা ও তার স্বামী জোসেফ। তারপর কী ঘটে গেল যে এত রাজকীয় আতিথেয়তা করছে এরা?

ব্যাপারটা কী ভাবতে শুরু করেছে রানা, এমন সময় দরজা খুলে বেডরুমে ঢুকল রন ও রবের বাবা। তার পরনে এখন গ্রিস মাখা ওভারঅল নেই। হাতেও নেই সেই ভয়ঙ্কর বন্দুক। বিষয়টা আসলে কী, সেটা ভাবতে চাইলেও কোনও কূল পেল না রানা।

‘যাক, শেষে তোমার জ্ঞান ফিরল,’ বিছানার একপাশে বসে মৃদু হাসল লোকটা। তার ভারী ওজনে করুণ সুরে গুঙিয়ে উঠল গদিওয়ালা খাট।

‘আমি কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম?’ জানতে চাইল রানা।

‘মাত্র বাইশ ঘণ্টার কিছু বেশি।’

রানা বুঝল, আর শুনতে পাবে না পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার বাঁশির ইন্দ্রজাল। অবশ্য, যে বিপদে জড়িয়ে গেছে, এমনিতেও সিভিক সেন্টারে পা রাখতে পারত না। মনটা খারাপ হয়ে গেল রানার। বড় করে শ্বাস ফেলল।

‘এখন কেমন লাগছে?’ জানতে চাইল জোসেফ গুডরিচ।

‘আগের চেয়ে ভাল। সেজন্যে তোমাদেরকে ধন্যবাদ। ব্যাণ্ডেজ দেখে মনে হচ্ছে ওটা বেঁধে দিয়েছে পেশাদার কেউ।

‘ওটা করেছে আমার স্ত্রী। আমি তো নিজে আঙুলের কাটা ঠিকভাবে ব্যাণ্ড-এইড দিয়েও আটকে নিতে পারি না। তোমার আহত জায়গাটা পরিষ্কার করে সেলাই করেছে এলিসা। তারপর গিলিয়ে দিয়েছে একগাদা অ্যান্টিবায়োটিক, পেইনকিলার, ভিটামিন আর আরও কীসব যেন। ধরে নিতে পারো, এখন আর চেষ্টা করলেও মরতে পারবে না।’

‘তোমার স্ত্রী… এলিসা… সে কি ডাক্তার?’

‘নার্স। ভেটেরিনারি। তাতে কী, কুকুরের গায়ে সেলাই দেয়া যা, মানুষের গায়ে দেয়াও তো একই ব্যাপার।’

‘আমি তোমার স্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’

‘জানিয়ো পরে। এখন বাড়িতে নেই। রবের জন্যে জুতো কিনতে শহরে গেছে।’ কড়া পরা তর্জনী রানার দিকে তাক করল জোসেফ গুডরিচ। ‘আর এই ফাঁকে এসো, জেনে নিই পরস্পরকে। আমার নাম জোসেফ গুডরিচ। আর তুমি হচ্ছ মাসুদ রানা। যাকে নিয়ে হৈ-চৈ করছে সবাই। … ঠিক বলেছি, তাই না?’

আড়ষ্ট হাত বাড়িয়ে লোকটার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল রানা। ‘অন্তত এ ব্যাপারটা অস্বীকার করার উপায় নেই।’

‘সেটাই হলো আসল কথা। তোমার কপাল ভাল, আমাদের বাড়িতে এসেছিলে। গুলি মেরে খুলিটা উড়িয়ে দেয়ার জন্যে তোমাকে খুঁজছে শত শত লোক। সেটা যদি পারে, হিরো হয়ে যাবে পুলিশের লোকদের কাছে। বেচারী মহিলা খুন হওয়ায় সতর্ক হয়ে উঠেছে ক্লোভিস প্যারিশের সবাই। আমার কথা বুঝতে পারছ? খুন এখানে কিছুই নয়। আমেরিকার এই স্টেটে সবচেয়ে বেশি মানুষ মরে। কিন্তু তাই বলে কেউ সেইবার দিয়ে একজন মহিলাকে গেঁথে ফেলবে, এটা মেনে নেবে না কেউ। তাই লুইযিয়ানার সবক’জন পুলিশ এখন খুঁজছে তোমাকে। পেলেই গুলি করে তোমার পাছায় আরেকটা ফুটো তৈরি করবে। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে আমাদের প্রাণপ্রিয় শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। আমার কোনও ভুল না হলে… মোটা অঙ্কের পুরস্কারও ঘোষণা করেছে ওরা। তোমাকে একবার ধরিয়ে দিলেই মেলা টাকা পাওয়া যাবে। এই টাকার বড় অভাব এদিকের মানুষের। তাদের ভেতরে আমিও আছি।’

‘আগেও বলেছি, আমি খুন করিনি,’ বলল রানা। ‘আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো।’

ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল জোসেফ গুডরিচের। একটু পর মুখ খুলল, ‘জেনে বুঝে কোনও খুনিকে নিজেদের বাড়িতে উঠতে দেব না এলিসা বা আমি। বাদ দাও খেদমত করার কথা। তুমি যখন ঘুমিয়ে ছিলে, এলিসা আর আমি অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করেছি। তারপর ঠিক করেছি, তিনটে কারণে তোমাকে আশ্রয় দেয়া উচিত। নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ, আমরা তোমার কথা বিশ্বাস করেছি বলেই এখানে আছ। কিন্তু আমরা যদি ভুল ভেবে থাকি, ঈশ্বর যেন ক্ষমা করেন আমাদেরকে। আর সেক্ষেত্রে তুমি নিজেও পড়বে মস্তবড় বিপদে। কারণ নিরীহ ওই মহিলাকে খুন করেছ বলে সোজা পৌঁছুবে সবচেয়ে খারাপ নরকে। সেজন্যে জগতের কোনও আইন লাগবে না। ‘

‘তোমরা আমাকে বিশ্বাস করেছ বলে ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘আর আশ্রয় দিয়েছ বলে আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। তবে কোন্ তিনটে কারণে এমন জামাই আদর পাচ্ছি, সেটা খুলে বলবে?’

‘বলতে আপত্তি নেই,’ আরাম করে বসল গুডরিচ। ‘প্রথম কথা, টিভির খবর আমরা বিশ্বাস করিনি। তুমি যদি খুনিই হবে, তা হলে তো রনের মত বিপদে পড়া ছোট একটা ছেলেকে সাহায্য করতে না। ওই ভাইপারের কবল থেকে ওকে বাঁচিয়েছ। শুধু তা-ই নয়, তারপর অজ্ঞান ছেলেটাকে এই পর্যন্ত বয়ে আনতে গিয়ে নিজেও প্রায় খুন হয়ে গেছিলে।’

‘যে-কারও জন্যে এই কাজটা করতাম,’ বলল রানা।

‘হয়তো।’ কাঁধ ঝাঁকাল গুডরিচ। ‘তবে বেশিরভাগ মানুষ নিজের স্বার্থ ছাড়া এক পা-ও নড়ে না। যাই হোক, রনকে রক্ষা করেছ বলে আমি তোমার কাছে ঋণী। আমরা দু’জন ঝর্নার ধারে গিয়ে মরা সাপটা নিজ চোখে দেখে এসেছি। …ভাল কথা, কোথা থেকে শিখলে এমন ধনুর্বিদ্যা? ছোবল দেয়ার সময় ওই ধরনের সাপের গতি বিদ্যুতের চেয়েও বেশি থাকে। আমি অন্তত এমন কাউকে দেখিনি, যে কিনা তীর মেরে শেষ করতে পারবে কটনমাউথকে। আমার মনে হয় না, ধনুক দিয়ে শিকার করতে শেখানো হয় বাংলাদেশ আর্মিতে।’

‘তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, স্থানীয় মিডিয়ার সবই ফলো করছ।’

‘শুধু আমি নই, অনেকেই নিউয ফলো করছে। তোমাকে খতম করতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছে হাজার হাজার সশস্ত্র মানুষ। দেখা পেলেই গুলি করবে। চারদিকে গুজব ছড়িয়ে গেছে, তুমিই খুন করেছ লিয বাউয়ারকে। এই ধরনের বাজে প্রচারণা হয়তো শেষ করে দেবে তোমাকে।’

‘শুনে খুব খুশি হতে পারলাম না।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। এবার দ্বিতীয় কারণটা বলো।’

‘এলিসা। ওর আধ্যাত্মিক ক্ষমতা আছে।’

‘তাই?’ মনে মনে হাসল রানা।

‘ব্যাপারটা ঠাট্টা নয়। ও সত্যিই যে-কোনও মানুষকে দেখেই চট্ করে বহু কিছু বুঝে ফেলে। ওটাকে বলতে পারো ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। যে-কারও দিকে চেয়ে বুঝতে পারে তার অন্তরটা ভাল কি না। এ ছাড়া, আগেই জেনে যায় বহু কিছু। কীভাবে পারে, আমার জানা নেই। তবে ছোটবেলা থেকেই ওই ক্ষমতাটা আছে ওর। এলিসা যদি মুখ ফুটে একবার বলে যে তুমি আসলে ভালমানুষ, অবিশ্বাস করার উপায় নেই আমার। ব্যাপারটা এমনই সহজ।’

মৃদু হাসল রানা। ‘আর তৃতীয় কারণ?’

‘ওটা ব্যক্তিগত,’ বলল জোসেফ। ‘তুমি হয়তো খেয়াল করেছ, রন এলিসার পেটের ছেলে নয়। যদিও ছেলেটাকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে এলিসা।’

‘সেটা খেয়াল করেছি।’

‘আমার বড় ছেলেটাকে নিয়ে গর্ব করতে পারি,’ বলল জোসেফ। ‘ঈশ্বর জানেন, এত ভাল স্বভাব আমার কাছ থেকে পায়নি ও। আসলে রন হয়েছে ওর মা ক্যারির মত। ক্যারি ছিল আমার প্রথম স্ত্রী।’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে কোলের ওপর হাতদুটো রাখল গুডরিচ। ‘আশা করি ওকে স্বর্গে ভাল রেখেছেন ঈশ্বর।’

‘তোমার প্রথম স্ত্রী আর জীবিত নেই শুনে খারাপ লাগছে।’

‘খুন করা হয়েছে ওকে, রাগের ছাপ পড়ল জোসেফের চোখে। ‘গুলিটা করেছিল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। তার সঙ্গে ছিল তার অযোগ্য দুই ডেপুটি। ওই ঘটনা ঘটেছিল আজ থেকে সাত বছর আগে। দিনটা ছিল রনের জন্মদিন। আমার স্ত্রীকে খুন করেছে বলে কোনও দিন ওই লোককে ক্ষমা করব না আমি। আর ওটাই তৃতীয় কারণ। এজন্যেই ওই লোকটার হাতে তোমাকে তুলে দিইনি। তুমি যদি সত্যি অপরাধী হও, আমি বরং নিজ হাতে তোমাকে খুন করব। তবুও বাহাদুরি নিতে দেব না স্যাম শেরিড্যানকে।’

অবাক চোখে তাকে দেখল রানা। ওই লোক গুলি করেছে তোমার স্ত্রীকে?’

বড় করে শ্বাস ফেলে বলতে শুরু করল জোসেফ, ‘ওই দিন শুধু যে ক্যারিই মারা গিয়েছিল, তা নয়। ভিলেনিউভ শহরে নিরীহ আরেক লোকের মাথা গুলি করে চুরমার করে দিয়েছিল শেরিড্যানের কুকুরগুলো। সেসময়ে ওই শহরেই বাস করতাম আমরা। খুন হয়ে যাওয়া লোকটার নাম ছিল জনি রচেস্টার। কাজ করত স’ মিলে। তার সঙ্গে অনেক মিল ছিল ডাকাত স্টিভ এভার্সের। সে ঠিক করেছিল ব্যাঙ্ক ডাকাতি করবে। যাই হোক, দুই হাজার তেরো সালের এপ্রিলের ওই দিন কষ্টার্জিত টাকা দিয়ে পরিবারের জন্যে খাবার কিনে গ্রোসারির দোকান থেকে বেরিয়েছিল জনি রচেস্টার। কিন্তু তখনই হাজির হলো শেরিফ আর তার কুকুরগুলো। চিৎকার করে বলল, ‘মাথার ওপর হাত তোলো, স্টিভ এভার্স! হাঁটু গেড়ে বসে পড়ো রাস্তায়! নইলে তোমার বুকে গুলি করব আমরা!’

‘বেচারা রচেস্টার বুঝতেই পারেনি কী ঘটছে। বুক পকেট থেকে স’ মিলের কর্তৃপক্ষের দেয়া আইডি বের করতে গেল সে। মুখেও বলল, ‘আমার নাম জনি রচেস্টার। আমি স্টিভ এভার্স নই!’

‘কিন্তু তখনই কোনও কথা না বলে তার ওপর গুলি চালাল শেরিফের দুই কুকুর। বেচারা রচেস্টার যেন জলাতঙ্ক রোগাক্রান্ত কুকুর। ঝাঁঝরা হয়ে গ্রোসারি স্টোরের সামনে পড়ে থাকল সে। এখানেই সব শেষ নয়। তাড়াহুড়ো করে তার শখের .৪৫ ক্যালিবারের রিভলভার দিয়ে গুলি করেছিল শেরিফ শেরিড্যান। তার প্রথম গুলি গেল রচেস্টারের কাছ থেকে আধ মাইল দূর দিয়ে। তবে ওই বুলেট সোজা ঢুকল দোকানের কাঁচের জানালা ভেদ করে। ভেতরেই রনের জন্মদিনের কেক তৈরির জন্যে ময়দা, বেকিং পাউডার এসব কিনছিল ক্যারি। শেরিড্যানের গুলি ছিঁড়ে দিল ওর ঘাড়।’

ঝোপ সদৃশ দাড়িতে কড়া ভরা আঙুল গুঁজল জোসেফ গুডরিচ। দৃঢ়বদ্ধ হয়েছে চোয়াল। ‘সেসময়ে আমি ছিলাম ওকালতি পেশায়। কি, অবাক হচ্ছ? গুলির আওয়াজ পেলাম অফিস থেকে। একটু পর কে যেন দৌড়ে এসে বলল, গুলি খেয়েছে ক্যারি। অ্যাম্বুলেন্স আসার আগেই ওই দোকানে পৌছে গেলাম। আমার কোলে মাথা রেখে মারা গেল ক্যারি।’

কী বলবে ভেবে পেল না রানা। তবুও কিছু বলতে হবে। ‘আমি দুঃখিত,’ নিচু গলায় বলল ও।

‘আমিও। একগাদা খোঁড়া কৈফিয়ত দিল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। কারও নাকি দোষ নেই! ভুল সময়ে ভুল জায়গায় ছিল ক্যারি। কাজ করতে গেলে এমন ভুল হতেই পারে!’ মাথা নিচু করে নিল জোসেফ গুডরিচ। বুজে ফেলেছে চোখ। একফোঁটা অশ্রু পড়ল গালে। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ‘একা হয়ে গেলাম। কিছুই রইল না জীবনে। সাত বছরের বাচ্চা ছেলে রন। ওকে কী করে বোঝাব, আর কোনও দিন ফিরবে না ওর মা? কী করে মানুষ করব ওকে? তুমি বুঝবে না কতটা অসহায় হয়ে গেলাম।’

মাথা দোলাল রানা। নিশ্চুপ।

‘এরপর সংক্ষেপে বললে: বেশিরভাগ মানুষের জীবনে যা হয়, আমারও তাই হলো। মানব-সভ্যতার প্রতি মনে জন্মাল চরম অবিশ্বাস।’

‘স্বাভাবিক,’ বলল রানা।

‘চরম ঘৃণা করি শেরিড্যানকে। প্রশ্নই ওঠে না তাকে বিশ্বাস করার।’ রানার দিকে তাকাল জোসেফ। ‘কিন্তু একটা কথা, পাডনাহ্, ওই খুন তুমি না করলে কুকীর্তিটা করল কে?’

‘আমিও সেটাই জানতে চাই,’ বলল রানা।

নিজ জীবনের কাহিনী বলেছে জোসেফ গুডরিচ, এবার রানার পালা। কেন লুইযিয়ানায় এল, কীভাবে জড়িয়ে গেল মদের দোকানের ডাকাতিতে, কেন উঠল লিয বাউয়ারের গেস্টহাউসে, কেমন চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হলো মহিলার সঙ্গে— সবই খুলে বলল রানা। ছোট ওই বসতিতে গিয়ে বাজার করা, গাড়ির গ্যারাজে যুবকদের সঙ্গে বিরোধ হওয়া, বাড়ি ফিরে গভীর রাতে আওয়াজ পেয়ে নিচে নেমে লিযের রক্তাক্ত দেহ দেখা, কালো মাস্ট্যাং ও খুনির পালিয়ে যাওয়া, আর তারপর থেকে যা ঘটেছে, বাদ পড়ল না কিছুই

রানার কথা শুনতে শুনতে হাঁ হয়ে গেল গুডরিচ। কুঁচকে গেছে ঝোপের মত ভুরু। ‘এ তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার! তা হলে তো বলব, আমার দেখা সবচেয়ে খারাপ শুয়োরের বাচ্চা হচ্ছে ওই ডেপুটি শেরিফ বিলি এস. কনরাড! শপথ করে আইনের পোশাক গায়ে চড়িয়ে তারপর চরম অন্যায় করছে সে! ভাবা যায় না খুন করতে চেয়েছে নিরীহ এক সাক্ষীকে! তা-ও ঠাণ্ডা মাথায়! কিন্তু এ ধরনের বেআইনি কাজ করবে কেন সে?’

‘ভাল প্রশ্ন,’ বলল রানা। ‘তবে আপাতত প্ৰায় কিছুই জানা নেই আমার। অবশ্য, এটা বুঝতে পারছি, ভালভাবেই আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে খুনের দায়ে। কী কারণে এসব ঘটছে, সেটা খুঁজে বের করতে হবে আমাকেই।’

ক’মুহূর্ত পর বলল গুডরিচ, ‘ভাবছি ওই মাস্ট্যাং গাড়ির লোকদুটোর কথা। আগেই বলেছি, একসময় উকিল ছিলাম। ক্রিমিনাল ডিফেন্স অ্যাটর্নি। খুব খারাপও ছিলাম না নিজের পেশায়। তারপর তো ওলটপালট হয়ে গেল জীবনটাই। আর তখন ভাল করেই বুঝেছি কিছু জটিল বিষয়। বারবার মনে হয়েছে, নিজের পাপের জন্যে আজ শাস্তি পাচ্ছি। কারণ, পাঁচ শ’ মাইলের ভেতর সমস্ত বর্ণবাদী হারামজাদাকে আইনি সহায়তা দিতাম। চিনি ওদের প্রত্যেককে। তুমি যে একটু আগে বললে মদের দোকানের ডাকাত জর্জি এস. ডানের কথা, ওই লোকও ছিল আমার মক্কেল। আর তাই মনে হচ্ছে, তুমি ওই দুই খুনির চেহারার বর্ণনা দিলে, আমি হয়তো বলে দিতে পারব তারা আসলে কারা।’

‘ভাল করে দেখতে পাইনি,’ বলল রানা। ‘শুধু মনে আছে চুলের কাটিং আর পোশাক। দৈহিক গড়নও এখন চিনি। আবার দেখলে ভুল হবে না। হয়তো সময় লাগবে, তবে ঠিকই খুঁজে নেব ওদেরকে। আর তখন ছাড় পাবে না আমার কাছ থেকে।’

মৃদু মাথা নাড়ল জোসেফ। ‘একমিনিট! খুনিকে খুঁজে বের করে নিজেকে আইনের ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়া এককথা, আর খুনির বিরুদ্ধে লড়তে যাওয়া আলাদা কথা। মনে রেখো, ওরা ভয়ঙ্কর মানুষ। যে-কোনও সময়ে খুন হবে তুমি।’

‘আগে আর্মি কমাণ্ডো ছিলাম,’ নিচু গলায় বলল রানা। চেপে গেল বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের দুর্ধর্ষ এক গুপ্তচর ও। ‘ওদের চেয়েও খারাপ কিছু লোককে শায়েস্তা করেছি। ধরে নাও, লিযকে যারা খুন করেছে, ঠিক সময়ে তারা বুঝবে জীবনটা ঠিক অতটা সহজ নয়।’

‘কী করবে তুমি?’

‘ওরা জানবে, ওদের চেয়েও বিপজ্জনক কেউ আছে। মানুষ-শিকারে তার দক্ষতাও হয়তো তাদের চেয়ে বেশি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *