1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৫

পাঁচ

এয়ারপোর্ট থেকে বিশ বছরের পুরনো এক বোতল ল্যাফ্রোইগ কোয়ার্টার কাস্ক সিঙ্গেল মল্ট কিনে হ্যারির জন্যে জ্যামাইকায় পাঠাবে বলে স্থির করেছে রানা। আর এটা? এটাও ভাল জাতের জিনিস, কিন্তু… প্রলোভনটাকে দাবিয়ে গ্লেনমোরেঞ্জির বোতলটা ব্যাগে তুলে রাখল রানা। এটার ব্যাপারে পরে ভেবে দেখবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পোশাক পাল্টে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল ও বিছানায়। সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভাঙল ভোরে। বারান্দায় বেরিয়ে দেখল, সাদা বাড়িগুলো স্নান করছে নরম, ধূসর আলোয়। একটু পর সূর্যের কাঁচা লালিমার পোঁচ পড়ল বাড়িগুলোর দেয়ালে দেয়ালে। গতরাতে ডিনারে বেশি খেয়েছে রানা। ঘরে ফিরে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি ব্যায়াম করল। স্ট্রেচিং, বুকডন ও সিটআপ সেরে সোজা ঢুকল গিয়ে ওঅশরুমে। পনেরো মিনিট পর বেরিয়ে এল যেন নতুন মানুষ। প্রথমেই চোখ পড়ল বার্নার মোবাইলটার ওপর। সোহেলের কাছ থেকে মেসেজ এসেছে: বিসিআই অফিসে কোনও ধরনের সমস্যা নেই— রানা ইচ্ছে করলে এখন যখন খুশি নিশ্চিন্তে মরতে পারে।

অবশ্য খবর একটা আছে। সোহানা এখন চিনে। ওর কোভিড নাইন্টিন হতে পারে, কথাটা মাথায় ঢুকতেই দুনিয়ার সবার ওপর খেপে গেছেন মেজর জেনারেল। বকা শুনতে শুনতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে সোহেলের।

‘ভালই তো! চুপচাপ বকা শুনতে থাক্, তাতে তোর মাথাটা খুলবে, একদিন মানুষ হয়ে যাবি,’ জবাব পাঠিয়ে দিয়ে ছোট্ট ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল রানা।

রাস্তায় সবে চলাচল শুরু হয়েছে যানবাহনের। বেশিরভাগ মানুষ ব্যবহার করছে পিকআপ ট্রাক। সাইকেল নিয়ে প্রতিটা বাড়ির সামনে থামছে কুচকুচে কালো এক কিশোর, পেছনের ক্যারিয়ার থেকে দৈনিক পত্রিকা নিয়ে ছুঁড়ে মারছে রাস্তার দু’পাশের বারান্দাগুলোর দিকে, তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে ছুটছে আবার। এখনও পুরো ডিজিটালাইড় হয়নি ক্লোভিস প্যারিশের নাগরিকরা। দৈনিক পত্রিকার মত পুরনো কিছু জিনিস বদলে না গেলেই হয়তো ভাল হয়— আনমনে ভাবল রানা। নিউযপ্রিন্টের গন্ধটা ভাল লাগে ওর।

একটু পর দক্ষিণ থেকে ঝিরঝিরে হাওয়ায় ভর করে নাকে এল দামি, ভাল কফির সুবাস। ঘরে ফিরে রানা টের পেল, কফির গন্ধ ভেতরে আরও জোরালো। এ ছাড়াও, তৈরি হচ্ছে স্ক্র্যাম্বল্‌ড্ এগ, স্টেক আর বাটার টোস্ট। নাস্তা তৈরি করছে মোটেলের মালকিন রিটা মর্টন।

গোটা পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে রানা এজেন্সির অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে সকালে ঘুম থেকে উঠে চট্ করে সামান্য নাস্তা নাকে-মুখে গুঁজেই অফিসে নেমে যেতে হয় রানাকে। তবে বাইয়ু ইনের ব্যাপার অন্যরকম। নিচতলায় নামতেই কারুকাজ করা টেবিলক্লথ দিয়ে ঢাকা সাদা পাইনের টেবিলটা ওকে দেখিয়ে দিল রিটা মর্টন। কড়া এক মগ কফি সামনে রেখে চলে গেল কিচেনে। ওখান থেকে এল হাঁড়ি-কড়াই- সসপ্যান নাড়ার মিষ্টি খুটুং-খাটুং আওয়াজ।

পুরনো আমলের মন-মানসিকতার মানুষ রিটা। তার ধারণা, সারাদিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবার হচ্ছে সকালের নাস্তা। কাজেই বড় একটা প্লেটে উঁচু স্তূপ করা স্ক্র্যাম্বড্ এগ, পুরু স্টেক, চারটে বাটারটোস্ট, পোয়াটেক পুডিং ইত্যাদি টেবিলের ওপর রানার নাকের নিচে গুঁজে দিল সে। তারপর কারাগারের জেলারের মত পাহারায় থাকল নিজে। রানা দেখল, প্লেটের একপাশে শুয়ে আছে এক জোড়া ইয়া সাইজের দোপেঁয়াজা করা লবস্টার। দেখেই আগুন ধরে গেল ওর পেটে। কিন্তু অর্ধেক খাবার শেষ করে আর তো পারা যায় না। রানা উঠে পড়তে চাইলেই কুঁচকে ওঠে মহিলার দুই ভুরু। কষ্ট করে রান্না করেছে, আর সেসব নষ্ট করবে কেউ? একদম অসম্ভব কথা!

মহিলাকে সন্তুষ্ট করতে পাউরুটির গুঁড়োও খুঁটে খেল রানা। মনে মনে বলল, ওরে, ব্যাটা, কাল থেকে তিনগুণ বেশি ব্যায়াম করবি! আজই বিকেল থেকে শুরু করবি অন্তত বিশ মাইল দৌড়! বুঝলি?

আরেক মগ কফি দিয়ে খালি প্লেট হাতে কিচেনে গেল রিটা মর্টন। তার আগে টেবিলে রেখেছে সাইকেল আরোহী কৃষ্ণাঙ্গ হকারের দেয়া ক্লোভিস প্যারিশ টাইম্‌স্ দৈনিক পত্রিকা। কৌতূহল হওয়ায় ওটার ভাঁজ খুলল রানা। বড় হেডলাইনটার ওপর চোখ পড়তেই ওর শার্টে ছলকে পড়ল গরম কফি। পত্রিকায় লিখেছে:

মাঝরাতে মদের দোকানে ডাকাতি ঠেকিয়ে দিল
বাংলাদেশ আর্মির প্রাক্তন এক সদস্য!

অপলক চোখে ক’মুহূর্ত হেডলাইনটা দেখল রানা। ওর মনে হলো, ভর দুপুরে চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়ে সবার সামনে খুলে নেয়া হয়েছে গায়ের সব কাপড়।

ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে এভাবে:

গতরাতে ওয়েস্ট রিউ জিরাম সড়কে টিমোথি হেকেথর্নের লিকার স্টোরে ডাকাতির সময় দুই ডাকাতকে বাধা দেন অপরিচিত এক বাংলাদেশি আগন্তুক। ক্লোভিস প্যারিশের শেরিফের ডিপার্টমেন্ট থেকে জানা গেছে, ডাকাতদের নাম: জর্জি এস. ডান, ৩৫, ও মিকি হাওয়ার্ড, ৩১। ডান এবং হাওয়ার্ড ওই স্টোরে প্রবেশ করে আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে দোকানের বর্ষীয়ান মালিক টিমোথি হেকেথনকে জিম্মি করে ক্যাশের নগদ টাকা হাতিয়ে নিতে চেষ্টা করে। বৃদ্ধ হেকেথনের ধারণা, ডাকাতি শেষে খুন করা হতো তাঁকে। ঠিকসময়ে ওই দুই ডাকাতকে বাধা দিয়ে তাদেরকে নিরস্ত্ করেন বাংলাদেশি আগন্তুক। এরপর ফোনে ডেকে আনা হয় শেরিফের ডিপার্টমেন্ট থেকে ক’জন পুলিশকে। নিজের গুলিতে আহত অবস্থায় অস্ত্রোপচারের জন্যে অপরাধী মিকি হাওয়ার্ডকে পুলিশ প্রহরায় নেয়া হয়েছে স্থানীয় হাসপাতালে। আর হাতের ভাঙা হাড় প্লাস্টারের পর বিচারের জন্য ক্লোভিস প্যারিশের জেলহাজতে রাখা হয়েছে জর্জি এস. ডানকে। বর্ণনা করতে গিয়ে দোকানের মালিক মিস্টার টিমোথি হেকেথন বলেন, ‘আমি তো ধরেই নিয়েছিলাম মারা যাচ্ছি। ঠিক তখনই দেবদূতের মত কোথা থেকে এসে আমাকে বাঁচিয়ে দিল অচেনা ওই অসমসাহসী যুবক।’
এ বিষয়ে আপাতত আর কোনও মন্তব্য পাওয়া যায়নি শেরিফের ডিপার্টমেন্ট থেকে। আগামীকাল জানা যাবে বিস্তারিত সংবাদ।

আগাগোড়া দুইবার খবরটা পড়ল রানা। ভোরে পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্যে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে দৈনিক পত্রিকার কর্তৃপক্ষ। বোধহয় গভীর রাতেই বৃদ্ধ হেকেথনকে ঘুম থেকে তুলেছে সাংবাদিক। স্থানীয় দৈনিকের সাংবাদিককে দোষ দিতে পারল না রানা। ঘুমন্ত এক বসতির : পাঠকদেরকে তাজা খবর দিতে পেরে উত্তেজিত তারা। দেরি করেনি অন্য খবর স্থগিত করে ডাকাতির খবর ছাপতে।

ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল রানা। আর্টিকেলে ওর নাম নেই। তবে ও যে বাংলাদেশ আর্মিতে ছিল, তা জানার কথা নয় হেকেথর্নের। ওই গুজব ছড়িয়েছে স্বয়ং শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। রানার মনে হলো, একবার কিছু ধরে নিলে আর তা বেরোয় না লোকটার মগজ থেকে।

ভুল ভাবেনি লোকটা। সাধারণ কেউ কখনওই সশস্ত্র দুই ডাকাতকে বাধা দিতে যেত না।

কে জানে, সাংবাদিককে আরও কী বলেছে শেরিফ, ভাবল রানা। সে কি এ-ও বলেছে, আগামীকাল রাতে বাঁশি শুনতে টাউন হলে হাজির হবে ও? অথবা, এটা কি বলেছে, আপাতত বাইয়ু ইন মোটেলে উঠেছে বাঙালি যুবক?

রানার পেশায় গোপনীয়তা খুব জরুরি। অসতর্ক হলে যে-কোনও মুহূর্তে খুন হবে। আর ওর বিপদের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে সাংবাদিকরা। কেউ খুঁড়তে শুরু করলে হয়তো পেয়ে যাবে জরুরি কোনও তথ্য।

ওকে নিয়ে মেতে উঠছে কেউ, ভাবতে ভাল লাগছে না রানার। নিজেকে জিজ্ঞেস করল, ডাকাতিতে বাধা না দিয়ে আর কোনও উপায় ছিল? গুলি খেয়ে মরতে দিতাম বুড়ো মানুষটাকে? ওর অতীত নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে মুখ খোলা ঠিক হয়নি শেরিফের।

এরপর কী করবে ভাবছে রানা, এমনসময় আবারও হাজির হলো রিটা মর্টন। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। বলল, ‘দু’জন লোক লবিতে অপেক্ষা করছে। আপনার নাম বলল, মিস্টার ওয়ানা। তাদের একজন জানাল, তারা এসেছে ভিলেনিউভ কুরিয়ার পত্রিকা থেকে।

মোটেলে বসে থাকলে লোকগুলো বিদায় হবে না। দেখা করতে হবে তাদের সঙ্গে। চেয়ার ছেড়ে দরজার সামনে গিয়ে থামল রানা। কবাট খুলে দেখল, কালো কোট আর জীর্ণ জিন্সের প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন লোক। তাদের একজন চট করে ওর দিকে ক্যামেরা তাক করল।

‘মিস্টার ওয়ানা, তাই না?’ ক্যামেরাম্যানের পাশ থেকে বলল অন্যজন। কোটের পকেট থেকে নিল প্যাড ও কলম।

‘আমি কে, তা পরে বলছি। আগে বলুন, আমার কাছে কী চান?’ বলল রানা।

‘আমি এলমো রোউক, ভিলেনিউভ কুরিয়ার পত্রিকার সঙ্গে আছি। আশাকরি কয়েকটা মিনিট ব্যয় করতে আপত্তি থাকবে না আপনার। কিছু বিষয়ে জানতে চাই।’

খুব মোলায়েম গলায় জানাল রানা, কাউকে ইন্টারভিউ দিতে চায় না। বলল, ‘আমি ছুটিতে আছি, ভাই। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না।’

‘অন্তত কিছু তো বলবেন, ম্যান? এতবড় একটা ঘটনা ঘটে গেল, সবাই জানতে চাইবে না? গরম খবর! আপনি তো এখন হিরো! ডাকাতি ঠেকিয়ে দিয়েছেন! অনেকে ভাবছে আপনি আসলে সুপার হিরো!

‘আমার হিরো হওয়ার শখ নেই,’ বলল রানা। ‘আমি কিছু করেছি সেটা কে বলল আপনাদেরকে?’

বাঁকা হাসল সাংবাদিক। ‘সরি, সোর্সের নাম বলব না।’

‘আপনার সোর্সকে গিয়ে বলুন, ভুল ভেবে নিয়ে অসত্য বলেছেন তিনি।’ কড়া চোখে ফোটোগ্রাফারকে দেখল রানা। ক্লিক-ক্লিক করে ছবি তুলছে সে। ‘চোখের সামনে থেকে ওটা সরান, নইলে গলার ভেতর ভরে দেব ক্যামেরাটা।’ মেজাজ ক্রমেই আরও গরম হয়ে উঠছে ওর।

বাঙালি যুবকের গম্ভীর চেহারা দেখে চট করে ঘুরে গাড়ির দিকে চলল দুই সাংবাদিক। দু’বার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখল রানাকে। ফোন বের করেছে এলমো রোউক। বোধহয় দলে ভারী হতে চাইছে।

কয়েক মুহূর্ত তাদেরকে দেখল রানা। বুঝে গেছে, ঠেকিয়ে দিয়েছে প্রথম ধাক্কাটা। তবে এরপর দলবল নিয়ে এসে আরও বিরক্ত করবে এই লোক। যা খুশি লিখবে পত্রিকায়। দুপুর হওয়ার আগেই খবর যাবে সিএনএন, ডাব্লিউএনবিসির মত সংস্থার সাংবাদিকদের কাছে। যতই আপত্তি থাকুক ওর, বেশ কিছু দিনের জন্যে আশপাশের এলাকার মানুষের আগ্রহ তৈরি হবে ওকে ঘিরে। এ থেকে রক্ষা নেই। সুতরাং, একমাত্র কাজটাই করতে হবে কে। বিড়বিড় করল রানা, ‘আর দেরি করলে স্রেফ মারা পড়ব। ভাগতে হবে এই শহর ছেড়ে!’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *