1 of 2

স্ট্রেঞ্জার – ৩৪

চৌত্রিশ

ক’মুহূর্ত পেরোবার পর কাঠের দুটো খুঁটি এবং মুচড়ে যাওয়া করোগেটেড আয়ার্নের পাতের তলা থেকে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে বেরোল রানা। শরীরের এখানে ওখানে কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে। পুড়ে গেছে মাথার পেছনের চুল। হাতে-পায়ে ছড়ে যাওয়ার দাগ। বেঁচে আছে, সেজন্যে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিল। মনে পড়ল, পালিয়ে যাওয়ার জন্যে মাস্ট্যাং বা অন্য কোনও গাড়ির কাছে যাচ্ছে হ্যাঙ্ক ও রিচি নোভাক। তবে প্রতিটা গাড়ির চাকা ফাঁসিয়ে দিয়েছে রানা। চাইলেও এখন সহজে এখান থেকে বেরোতে পারবে না নোভাকরা।

হাত থেকে খসে পড়া বেরেটার খোঁজে চারপাশে তাকাল রানা। মাটিতে মিশে গেছে স্টোররুম ও সরু প্যাসেজ। প্রকাণ্ড ঘরের দিকে চেয়ে ওর মনে হলো, এইমাত্র ওটার ওপর আকাশ থেকে বোমা ফেলেছে এয়ার ফোর্সের যুদ্ধবিমান। দাউদাউ করে জ্বলছে কাঠের খুঁটি ও বিম। যে-কোনও সময়ে ওর ওপর ধসে পড়বে কাঠামোর বাকি অংশ। ঘন ধোঁয়ার মাঝ দিয়ে দেখল এখনও দাঁড়িয়ে আছে দীর্ঘ চিমনিটা। ভারসাম্য রাখতে না পেরে এখন যে-কোনও সময় কাত হয়ে পড়বে।

বিপদ বুঝে পালিয়ে গিয়েছিল রাইফেলধারী লোকটা। আশপাশে নেই সে। মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে অস্ত্রটা তুলে নিল রানা। ওটা পুরনো আমলের লিভার অ্যাকশন মার্লিন ডিয়ার কারবাইন। এবার ওর বুঝতে দেরি হলো না, কীজন্যে ভেগে গেছে লোকটা। লিভার টেনে চেম্বারে গুলি ভরার সময় কম শক্তি ব্যবহার করেছে বলে জ্যাম হয়ে গেছে অস্ত্রটা। মার্লিন কারবাইনের বড় একটা দোষ এটা। এই অস্ত্র এখন ঠিক করতে হলে চাই গানস্মিথ।

অকেজো কারবাইন ফেলে রানা দেখল, আবর্জনার ভেতর থেকে বেরিয়ে আছে রক্তাক্ত একটা বাহু। লোকটা শত্রুপক্ষের, খুন করতে চেয়েছে ওকে, তবুও চাপা পড়ে শ্বাস আটকে মরবে সে, সেটা চাইল না রানা। তবে পাল্স্ দেখে বুঝল, মারা গেছে সে। আধ মিনিট খুঁজে মেঝে থেকে ধনুক আর পিস্তল উদ্ধার করে নিয়ে হ্যাঙ্ক ও রিচির খোঁজে চলল রানা।

ঘন কালো ধোঁয়া আর হলদে ধুলোয় ঢাকা পড়েছে সূর্য। আকাশ কালচে। অবশিষ্ট ঘরগুলোর পাশ দিয়ে গাড়ি রাখার পার্কিং লটের দিকে ছুটল রানা। এখানে ওখানে খসে পড়ছে ডিসটিলারি ঘরের জ্বলন্ত টুকরো। কয়েক মুহূর্ত পর বিকট মড়-মড় আওয়াজে ধীরে ধীরে কাত হলো লোহার বিশাল চিমনি।

ছোটার ফাঁকে ওটার দিকে চেয়ে রানার মনে হলো, ওর দিকেই পড়ছে কালো চিমনি। থমকে পিছিয়ে যেতে পারে রানা, অথবা চেষ্টা করতে পারে জায়গাটা পেছনে ফেলতে। দৌড়ের গতি আরও বাড়ল ওর। তীর বেগে ছুটছে। সরাসরি সামনে চোখ। মড়-মড়াৎ আওয়াজে চিমনি নেমে এল রানার ছয় ফুট পেছনের মাটিতে। চারপাশে ছিটকে উঠল ধুলোবালি। চিমনির সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়েছে নোভাকদের মদের কারখানার অবশিষ্ট কাঠামো। চ্যাপ্টা হয়ে গেল পাশের গুদামের ছাউনি।

দাউদাউ করে জ্বলছে গুদাম। ওখানে আছে হাজার হাজার লিটার মদের ড্রাম। যে-কোনও সময়ে আগুন ধরে হাই-অকটেন ফিউয়েল রিফাইনারির মতই চারপাশ নরক করে দেবে শক্তিশালী অ্যালকোহল। আগুন ও ধোঁয়ার ভেতর দিয়ে জেদি বাচ্চার মত ছুটে চলেছে রানা। নানাদিকে উড়ে এসে পড়ছে জ্বলন্ত আবর্জনা। গনগনে তাপের মাঝ দিয়ে এগোতে গিয়ে বারবার মুখ ঢাকছে রানা। এখানে ওখানে জ্বলে উঠছে ছোট সব নীল অগ্নিকুণ্ড।

আরও কয়েক গজ যেতেই পেরিমিটার ফেন্সের ধারে গাড়ি রাখার উঠানটা দেখল রানা। ওখানে সারি দিয়ে রাখা মাস্ট্যাং, দুটো পিকআপ, প্যাট্রিকের ক্যাডিলাক এবং প্রাচীন একটা ফ্ল্যাটবেড ট্রাক। বিস্ফোরণের ধুলোয় ঢেকে গেছে ওগুলো।

এদিকে কোথাও নেই হ্যাঙ্ক বা রিচি নোভাক।

চোখ সরু করে চারপাশে তাকাল রানা। হাতে পিস্তল। ওই দুই ভাইকে দেখলেই গুলি করবে।

কিন্তু গেল কোথায় তারা?

একমুহূর্ত পর মোটর সাইকেলের ইঞ্জিনের গর্জন শুনল রানা। চরকির মত ঘুরে দেখল, অবশিষ্ট গুদামের ছাউনির তলা থেকে বেরিয়ে এসেছে দুটো ডার্ট বাইক। জ্বলন্ত শত শত আবর্জনার ভেতর দিয়ে উন্মাদের মত তুমুল বেগে ছুটছে রিচি ও হ্যাঙ্ক। রিচির ডানদিকের কানের লতি ছিঁড়ে দিয়েছে রানার কার্বন ফাইবারের অব্যর্থ তীরের ফলা। রক্তে ভেসে যাচ্ছে টি-শার্ট। এদিকে ডানহাতে মোটর সাইকেল চালাচ্ছে হ্যাঙ্ক। অন্যহাতে নলকাটা বন্দুক। ওটা যেন বিশাল আকারের কোনও ডাবল ব্যারেলের পিস্তল। রানাকে দেখেই হ্যাণ্ডেলবারের ওপর বন্দুকের নল রেখে গুলি করল সে।

‘বুম্!’ আওয়াজে গর্জে উঠেছে বন্দুক। নল থেকে ছিটকে বেরোল কমলা আগুনের হলকা। একলাফে ধসে পড়া এক ছাউনির আড়ালে সরল রানা। ওর মাথার এক ইঞ্চি দূরে করোগেটেড আয়ার্নের পাত ফুটো করেছে হরিণ মারার কয়েকটা বল। কর্কশ গর্জন ছেড়ে ছুটে চলেছে অফ রোড বাইক। প্রচুর ধুলো তুলছে এবড়োখেবড়ো চাকা।

ধসে পড়া ছাউনির আড়াল থেকে বেরিয়ে পিস্তল দিয়ে কয়েকটা গুলি করল রানা। একটা গুলি লেগেছে জায়গামত। হ্যাঙ্কের বাম বাহু থেকে ছিটকে বেরোল রক্ত। এদিকে ওদিকে ভীষণ দুলে উঠলেও এগিয়ে চলল তার মোটর সাইকেল। খেপা মানুষের মত দুই নোভাকের পিছু নিল রানা। পিস্তল দিয়ে ছুটন্ত টার্গেটে লক্ষ্যভেদ করা খুব কঠিন।

তীব্র বেগে চলেছে দুই নোভাক। তবে সামনেই সরাসরি ধসে যাওয়া চিমনি। রানার মনে হলো, সরাসরি ওখানে গুঁতো খেয়ে ছিটকে পড়বে লোকদুটো। বামে সরে গেল রিচি নোভাক। ওদিকে চিমনির ওপরে পড়েছে গুদামের ছাউনি। ওটা আছে ঠিক র‍্যাম্পের মত। ধুপ্ শব্দে ওটার ওপর উঠল রিচি নোভাকের মোটর সাইকেল। কর্কশ আওয়াজে গর্জে উঠল ইঞ্জিন। পরক্ষণে স্টান্টম্যানদের মতই শূন্যে উঠে চিমনির ওপর দিয়ে পেরিয়ে গেল লোকটা।

বড়ভাইকে অনুকরণ করল হ্যাঙ্ক। মাটিতে নেমে প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলল তালাবদ্ধ মেইন গেটের দিকে। দৌড়ে গিয়ে ধড়মড় করে ছাউনি থেকে নামল রানা। গুলি করতে গিয়ে বুঝল, পিস্তল খালি। বিরক্ত হয়ে অস্ত্রটা ফেলে দুই মোটর সাইকেলের পিছু নিল ছুটন্ত রানা।

হ্যাঙ্ক নোভাকের বন্দুকে এখনও রয়েছে একটা কার্তুজ। সরাসরি প্যাডলক আর শেকলের ওপর গুলি করল সে। শেকল থেকে খসে পড়ল তুবড়ে যাওয়া তালা। বাইরের দিকে খুলে গেছে মেইন গেটের দুই পাল্লা। গতি না কমিয়েই মাঝের জায়গা দিয়ে বেরিয়ে গেল দুই মোটর সাইকেল। মাত্র কয়েক সেকেণ্ডে বহু দূরে চলে গেল হ্যাঙ্ক ও রিচি।

গেটের কাছে থামল রানা। ভাবছে, তিন নোভাকের একজন মারা গেলেও ওর নিজের উদ্দেশ্য মোটেও সফল হয়নি। মনে মনে স্বীকার করল, আর কিছুই করার ছিল না ওর। নিজেকে দোষ দিল, অনুচিত হয়েছে শত্রুকে হালকাভাবে নেয়া। এখন হারিয়ে গেল একমাত্র সূত্রটা। আবারও নোভাকদের সঙ্গে দেখা হবে, তেমনটা না-ও হতে পারে।

অন্যদিকে মন দিল রানা। শত শত ফুট ওপরের আকাশে উঠেছে ঘন ধোঁয়ার উঁচু স্তম্ভ। এখন প্রথম কাজ হওয়া উচিত এ এলাকা থেকে সরে যাওয়া। কেউ না কেউ ওই ধোঁয়া দেখে পুলিশে যোগাযোগ করবে। ফলে একঘণ্টার ভেতর এদিকে গিজগিজ করবে শেরিফের লোকজন।

ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে পৌঁছুল রানা। লালচে হয়ে উঠছে বিকেলের রোদ। কানে এল হেলিকপ্টারের রোটরের মৃদু আওয়াজ। যান্ত্রিক ফড়িংটা এখনও বহু দূরে। মুখ তুলে আকাশে চোখ বোলাল রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর দেখল দূরে পাহাড়ের চূড়ার কাছে ভাসছে ওটা। ওর অভিজ্ঞ চোখ জেনে গেল, ওটা বেল ৪৩০। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও মিলিটারি ইউনিটগুলো ব্যবহার করে এসব হেলিকপ্টার। এত দূর থেকে বোঝার উপায় নেই, ওটার লেজে স্টেট পুলিশের অফিশিয়াল নীল-সোনালি ডিযাইন আছে কি না। রানা নিশ্চিত, পাইলট ওকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে তার চোখে পড়েছে বিধ্বস্ত ডিসটিলারির ধোঁয়া। এখানে হাজির হবে সে খোঁজ নিতে।

ড্রাইভিং সিটে উঠে দরজা আটকে নিল রানা। ইঞ্জিন চালু করে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি। এবড়োখেবড়ো ট্র্যাকে নাচতে নাচতে ফিরে চলেছে হাইওয়ের দিকে। দশ মাইল পেরোবার পর সামনে সরু এক কাউন্টি রোড পেয়ে ওখানে থামল রানা। গাড়ি থেকে নেমে চলে গেল পেছনের বুটের কাছে। তালা খুলে পেছন ডালা তুলে বলল, ‘কী হাল তোমার?’

‘তুমি আসলে মানুষের বাচ্চা না!’ নালিশের সুরে বলল মন্টি ডয়েল। ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাউকে এভাবে আটকে রাখে?’

‘কথা ঠিক,’ বলল রানা। ‘ভুলই করে ফেলেছি। আর তাই তো ঠিক করেছি তোমাকে ছেড়ে দেব।’

লালচে চেহারা খুশিতে ঝলমল করে উঠল ডয়েলের। পরক্ষণে চোখে দেখা দিল সন্দেহের ছাপ। ‘সত্যি? তুমি যে বলেছিলে আমার হাত-পা ভেঙে দেবে, সেটা করবে না তো?’

‘আপাতত না। তবে আবারও আমার সামনে পড়লে কিংবা পেছনে লাগলে খুঁজে নিতেও বেশি দেরি করব না। সেক্ষেত্রে মাথা থেকে শুরু করে পায়ের কড়ে আঙুল পর্যন্ত প্লাস্টার করে দেবে ডাক্তার। ওই ছয়টামাস তুমি গিলবে শুধু বাচ্চাদের সাবুদানা আর বার্লি। এবার বেরোও আমার গাড়ির বুট থেকে।’

‘গাড়িটা তো তোমার নয়!’

‘চোপ! আবারও ফালতু তর্ক করে!

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে বুট থেকে নেমে এল ডয়েল। চারপাশে তাকাল। ওরা আছে জঙ্গুলে পাহাড়ি এলাকায়। ‘ইয়ে, রানা, এটা কোথায় নামিয়ে দিচ্ছ আমাকে, ভাই আমার? এখান থেকে পয়েন্ট ব্লাঞ্চ তো অন্তত পঞ্চাশ-ষাট মাইল দূরে!’

‘তা তো হবেই,’ সায় দিল রানা। তবে তাতে কী? ব্যায়াম সবসময় শরীরের জন্যে ভাল। রওনা হয়ে যাও। আবারও যদি দেখেছি তোমার লাল মুলোর মত চেহারা, একদম গুঁড়িয়ে দেব চোয়াল। আমার কথা বোঝা গেছে?’

না বোঝার মত কথা নয়। রাস্তার ধারে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইল মন্টি ডয়েল। তাকে শুকনো একরাশ ধুলোয় ঝাপসা করে দিয়ে চলে গেল রানার গাড়ি।

সগর্জনে চলেছে ফায়ারবার্ড। এবার কী করবে, ভাবছে রানা। সামনে কোনও সূত্র নেই। আবারও এন সার্কেল মোটেলে ফিরে লাভ হবে না। জায়গাটা অনিরাপদ। কখন যেন গাড়ির গতি আশি থেকে এক শ’ মাইলে তুলেছে রানা। ঝড়ের বেগে পেছনে পড়ছে গাছপালা, ফার্ম ও নানান বাইয়ুর শাখা-প্রশাখা। বুঝতে পারছে, এবার বিশাল এই লুইযিয়ানার কোথাও লুকিয়ে পড়তে হবে। ভেবে বের করতে হবে কীভাবে হাতের মুঠোয় পাওয়া যায় অবশিষ্ট দুই নোভাককে।

সামনেই রাস্তার তীক্ষ্ণ বাঁক। ফায়ারবার্ড গাড়ি নিয়ে এক শ’ মাইল বেগে ঘুরেই কপালে উঠল রানার দু’চোখের ভুরু।

সরাসরি পঞ্চাশ গজ সামনে পুলিশ চেকপোস্ট!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *