পঁয়ত্রিশ
জ্বলন্ত ডিসটিলারির ওপর দিয়ে দু’বার চক্কর দিয়ে অফিসে রেডিয়ো করল লুইযিয়ানা স্টেট পুলিশ এয়ার সাপোর্ট ইউনিট বেল ৪৩০ হেলিকপ্টারের পাইলট জোনাথন ব্রিড। জানিয়ে দিল সে আছে পয়েন্ট ব্লাঞ্চ শহর থেকে উত্তর-পশ্চিমে পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে নির্জন ডিক্লোউয়েট হিলে। কাছেই এলিযিয়াম প্যারিশের সীমান্ত। নির্জন এই এলাকায় আগুন ধরেছে কোনও খামারে।
অফিস থেকে পাইলটকে বলা হলো, যেন হেলিকপ্টার থেকে নেমে চারপাশ তদন্ত করে দেখে সে ও তার সহকারী পাইলট জন ম্যাথিউ।
নিজেদের দায়িত্ব পালনে কোনও ত্রুটি রাখল না দুই পাইলট। ল্যাণ্ড করার পর কাছ থেকে দেখে তারা বুঝল, কিছুক্ষণ আগে আগুন ধরেছে ফ্যাক্টরিতে। দাউ-দাউ করে জ্বলছে বিধ্বস্ত বাড়িঘর। আবর্জনার ভেতর কিছু অস্ত্র পেল তারা। কাছেই খরচ করা গুলির খোসা। টনকে টন টিন ও কাঠের খুঁটির নিচে চাপা পড়েছে এক লোকের লাশ। তার মৃতদেহ উদ্ধার করতে হলে চাই আরও লোকের সাহায্য।
কিছুটা দূরে কালিঝুলি মেখে পড়ে আছে আরেক লাশ। কীভাবে যেন উড়ে গেছে মাথার অর্ধেকটা। পোড়া একটা কুঠরির ভেতর চেয়ারে আরেকটা লাশ। হাত-পা বেঁধে রাখা হয়েছে ইলেকট্রিকাল তার দিয়ে। ঘরের ভেতর চোখ বুলিয়ে পাইলট জোনাথন এবং তার সহকারী ম্যাথিউ বুঝল, নির্জন এই পাহাড়ি এলাকায় ছিল বেআইনি মদের কারখানা। তারা ধারণা করল, প্রতিযোগিতা কমাতে চেয়েছে প্রতিপক্ষ। ফলে হামলা করে পুড়িয়ে দিয়েছে এই ডিসটিলারি।
একটা ছাউনিতে দু’জন লোককে লুকিয়ে থাকতে দেখে তাদের গ্রেফতার করল পুলিশ পাইলট জোনাথন। জানিয়ে দিল কী ধরনের আইনি অধিকার আছে লোকদু’জনের। তাদের একজনের গালে চাপ দাড়ি। ফুলে আছে মাথার একদিক। নাম উইলসন বললেও আর কিছুই জানাল না সে। অন্যজনের নাম ডুগি হাওয়ার্ড। কথার রাজা। ভড়ভড় করে বলতে লাগল কী ঘটেছে এখানে। কান পেতে তার কথা শুনল জোনাথন ও ম্যাথিউ। পরস্পরের দিকে তাকাল। বুঝে গেছে, এখনই এসব জানাতে হবে শেরিফ শেরিড্যানকে। হেলিকপ্টারের রেডিয়োর মাধ্যমে যোগাযোগ করল তারা শেরিফের সঙ্গে।
দশ মিনিট পর দ্বিতীয় স্টেট পুলিশ বেল ৪৩০-এ চেপে ডিক্লোউয়েট হিলের দিকে রওনা হলো শেরিফ। নিজ কানে শুনবে অপরাধীর বক্তব্য।
বিশ মিনিট পর বিধ্বস্ত ডিসটিলারিতে প্রথম হেলিকপ্টারের পাশে নামল দ্বিতীয় বেল ৪৩০। রোটর থেমে যাওয়ার আগেই ডানহাতে ক্যাম্পেইন হ্যাট চেপে ধরে নেমে পড়ল শেরিফ। তার পিছু নিল ডেপুটি শেরিফ বিলি এস. কনরাড এবং বব ট্রায়াল। ধ্বংসস্তূপের দিকে চেয়ে শেরিফের মনে হলো, একদল বদমাশ হামলা করেছে আরেকদল বদমাশের ওপর। বারোটা বেজে গেছে কারখানা ও আশপাশের বাড়িঘরের। ক্লোভিস প্যারিশে আগে কখনও এ ধরনের হামলা হতে দেখেনি সে।
‘আশা করি জরুরি কাজে ডেকেছ,’ অফিসার জোনাথন ও ম্যাথিউয়ের উদ্দেশে বলল শেরিফ। হাত হোলস্টারে রাখা কোল্টের বাঁটে। ‘এখনও ধরা পড়েনি মাসুদ রানা। সবার পাগল হওয়ার দশা। এখন এসব! যা বলার সংক্ষেপে সারো।’
‘আজ বিকেলের ঘটনা, শেরিফ,’ শুরু করল জোনাথন ব্রিড, ‘এখানে এসে একরাশ গুলির খোসা পেয়েছি। মারা গেছে তিনজন লোক। তাদের লাশ পাঠাতে হবে করোনারের কাছে। তাদের একজনকে খুঁড়ে তুলতে হবে আবর্জনার তলা থেকে। তবে আমাদের মনে হয়নি, এখানে হামলা করেছে কোনও দল।
কড়া চোখে দুই অফিসারকে দেখল শেরিফ স্যাম শেরিড্যান। ‘কী বলতে চাও?’
মাটিতে কুঁজো হয়ে বসে আছে বন্দি ডুগি হাওয়ার্ড। তার পিঠে পিস্তলের নলের খোঁচা দিল অফিসার ম্যাথিউ। ‘শেরিফকে সব খুলে বলো।
‘কোনও দলবল হামলা করেনি,’ বলল ডুগি হাওয়ার্ড। ‘এসেছিল মাত্র একজন।’
‘মাত্র একজন?’ আরও কঠোর হলো শেরিফের মুখ। ‘খুলে বলো।’
‘একাই সে আর্মির পুরো এক রেজিমেন্টের মত!’ বিড়বিড় করল ডুগি। ‘গুলি করতে করতে বেরিয়ে এল ডিসটিলারি থেকে। আরেকটু হলে খুন হতো উইলি।’
‘উইলির কথা বাদ দাও, আমি বেরিয়ে আসা ওই লোকের কথা শুনতে চাই,’ ঘড়ঘড়ে কণ্ঠে ধমক দিল শেরিফ।
‘ওই লোক বিদেশি, গায়ের রঙ বাদামি। ওই একই লোক ঘাড় প্রায় ভেঙে দিয়েছে জর্জি এস. ডানের। তারপর খুন করেছে চিটিমাচার ওই কালো মহিলাকে। তার নাম বোধহয়…’
‘রানা, শ্বাস আটকে ডুগির কথা শেষ করল শেরিফ। ‘ওর নাম মাসুদ রানা।’ আনমনে মাথা নাড়ল সে। বুঝতে পারছে না এসবের সঙ্গে মাসুদ রানার কীসের সম্পর্ক। ‘আমার বোঝা উচিত ছিল যে এ ধরনের কাজই করবে ওই ভয়ঙ্কর ম্যানিয়াক। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছে সে। কিন্তু এখানে হামলা করল কেন?’
‘আমিও বুঝলাম না, শেরিফ,’ বলল হেলিকপ্টারের পাইলট জোনাথন ব্রিড। ‘তবে এটা জানা গেছে, এরা কাজ করত নোভাকদের ডিসটিলারিতে। আজ দুপুরে বেআইনি মদ তৈরি করছিল। তারপর… খুনি হামলা করল নোভাকদের কারখানায়।
‘নোভাক?’ মাথা নাড়ল ডেপুটি শেরিফ কনরাড। ‘আমার মনে হয় না ওরা এসবে জড়িত থাকতে পারে।’
কৌতূহলী চোখে তাকে দেখল শেরিফ। ‘তোমার মনে হয় না? তা হলে তুমিই বরং বলো এখানে কী হয়েছে!’
ডুগির পিঠে পিস্তলের নলের গুঁতো দিল পাইলট জোনাথন। ‘প্রথম থেকে খুলে বলো। বাদ দেবে না কিছু।’
দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল ডুগি। কয়েক মুহূর্ত পর বলল, ‘আগে উকিল চাই। আমার আইনি অধিকার আছে। আপনারা ফেডারেল উইটনেস হিসেবে আমাকে চাইলে আমার নিরাপত্তা দিতে হবে। নইলে একটা কথাও বলব না।’
‘উকিল তুমি পাবে,’ কঠোর চোখে তাকে দেখল শেরিফ। ভাবছে, আগের সেই দিন আর নেই। নইলে কোল্টের নলের এক বাড়িতে ক্লাউনটার চোয়াল ফাটিয়ে দিতাম। বাপ-বাপ করে সব বলত। ‘জেলহাউসে পৌঁছে গেলেই তোমার জন্যে হাজির করা হবে শ্যাম্পেইন আর স্টেক। তবে আগে জানাতে হবে সব। এবার শুরু করো।’
আইনের কঠিন প্যাচ থেকে বাঁচতে কথা বলতে রাজি ডুগি হাওয়ার্ড। ‘এখানেই ছিল নোভাকদের মদের বেআইনি কারখানা,’ বলতে শুরু করল সে। ‘আজকে নিজেও এখানে ছিল রিচি নোভাক।’ বলার সুরে গর্ব প্রকাশ পেল, যেন মস্ত এক রাজার কাঁধে হাত রেখেছিল সে। ‘আমার মনে হলো ওই মাসুদ রানা লোকটা খেপে গিয়ে খুন করতে চাইল নোভাক ভাইদেরকে। কিন্তু শেষে আর পারল না। ব্যাটম্যানের মত মোটর সাইকেলে চেপে ভোঁ করে পালিয়ে গেল রিচি আর হ্যাঙ্ক নোভাক। তবে ডিসটিলারি ঘরের ভেতর বোধহয় পুড়ে মরেছে তাদের ছোটভাই প্যাট্রিক নোভাক। ওই ঘরেই মরেছে রুডলফ আর উইলি।
‘উইলি মানে উইলসন এন. ব্র্যাগ, বলল অফিসার জন ম্যাথিউ। ‘তার নামে ফোর্ড পিকআপ রেজিস্ট্রি করা আছে। ওদিকের প্রত্যেকটা গাড়ি সার্চ করেছি আমরা। কয়েক বছর আগে চুরি করা হয়েছে ক্যাডিলাক এস্কেলেড আর মাস্ট্যাং গাড়িদুটো। রুডলফকেও খুঁজছি আমরা দু’জন মহিলাকে রেপ করার দায়ে।’
অফিসারদেরকে ছাউনি থেকে বেরোতে ইঙ্গিত করল শেরিফ। চুপ হয়ে গেছে ডেপুটি শেরিফ বিলি এস. কনরাড।
‘আপনার কী মনে হয়, শেরিফ?’ জানতে চাইল জোনাথন ব্রিড।
হ্যাট খুলে ধূসর চুলে হাত বোলাল শেরিফ। ‘অন্তত বারো-তেরো বছর আগে ডাকাতি আর বেআইনি অস্ত্র রাখার জন্যে জেলে ভরেছিলাম উইলসন এন. ব্র্যাগকে। মাঝে মাঝে মনে হতো, সে যোগ দিয়েছে নোভাকদের দলে। তবে হাতে কোনও প্রমাণ ছিল না। তা না হয় বুঝলাম, কিন্তু মাসুদ রানা কীভাবে জড়িয়ে গেল এসবে?’
‘আমরা তো আগেই জানি, কয়েক বছর ধরে বেআইনি অস্ত্রের ব্যবসা করছে নোভাকরা,’ বলল জোনাথন ব্রিড। ‘মনে হয় অস্ত্র জোগাড় করতেই এখানে এসেছিল মাসুদ রানা।’
‘অথবা, সে ছিল ওই দলের কেউ, বলল জন ম্যাথিউ। ‘ঝগড়া লেগে গেলে গোলাগুলি শুরু হয়।’
কী যেন ভাবছে শেরিফ। পাথরের মত রুক্ষ দেখাচ্ছে চেহারাটা। কয়েক মুহূর্ত পর মাথা নাড়ল। ‘নাহ্। আমার তা মনে হয় না। অন্যকিছু আছে এসবের ভেতর। যদিও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না কিছুই।’
কেউ কিছু বলার আগেই খড়-খড় শব্দ ছাড়ল শেরিফের রেডিয়ো। খপ্ করে ওটা নিয়ে কানের কাছে ধরল শেরিফ। ‘শেরিড্যান বলছি। কী ব্যাপার?’
‘শেরিফ!’ ওদিক থেকে এল উত্তেজিত কন্ঠস্বর। ‘আমরা পেয়েছি ওকে! মাসুদ রানা! এবার ধরা পড়বে ও!’